জর্জ অরওয়েলের মা ও বাবা ।। মধুসূদন মিহির চক্রবর্তী

আমি মনে করি যে কোনো লেখকের প্রাথমিক বিকাশ সম্পর্কে কিছু না জেনে তার উদ্দেশ্যসমূহ মূল্যায়ন করা সম্ভব না, তাই আমি এই সমস্ত পটভূমির অবতারনা করছি। লেখক যে যুগে বসবাস করছেন তা দ্বারা তার লেখার বিষয়বস্তু নির্ধারণ হবে। এটি অন্তত আমাদের নিজেদের যুগের মতো অশান্ত, বিপ্লবী যুগে সত্য। তবে লেখক লিখতে শুরু করার আগে এমন এক আবেগপূর্ণ মনোভাব অর্জন করবেন যেখান থেকে তিনি কখনই সম্পূর্ণরূপে সরে যেতে পারবেন না। নিঃসন্দেহে, তার কাজ হলো নিজের মেজাজকে নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং কোনও অপরিপক্ক পর্যায়ে বা কোনও বিকৃত মেজাজে আটকে যাওয়া এড়ানো। তবে যদি তিনি তার প্রথম দিকের প্রভাব থেকে পুরোপুরি সরে যান তবে তিনি তার লেখক সত্তাকে বিনাশ করবেন।
-জর্জ অরওয়েল, কেন আমি লিখি (১৯৪৬)

রিচার্ড ওয়েমেসলে ব্লেয়ার ও ইডা ব্লেয়ার

অরওয়েলের বন্ধু, হিতৈষী, সম্পাদক এবং সাহিত্য নির্বাহক রিচার্ড রিস জীবনীকারদের পরামর্শ দিয়েছেন যে জর্জ অরওয়েলকে বোঝার জন্য এরিক আর্থার ব্লেয়ারকে বুঝতে হবে। সত্যিকার অর্থে অরওয়েলকে বোঝার জন্য, তার মা ও বাবা এবং তাদের প্রসঙ্গকে আমাদের বর্তমানের চেয়ে আরও বিশদভাবে বুঝতে হবে।

অরওয়েল খুব কমই চিঠি সংরক্ষণ করেছেন। তার লেখাতেও খুব কমই তার পারিবারিক প্রেক্ষাপট প্রতিফলিত হয়েছে। দুটি উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম অবশ্য রয়েছে, দ্য রোড টু উইগান পিয়ার (১৯৩৮) এবং তার প্রবন্ধ ‘কেন আমি লিখি’ (১৯৪৬) । তার এই দুটি রচনায় বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের উপর শৈশব প্রভাবের অত্যন্ত মৌলিক এবং উপলব্ধিমূলক বিশ্লেষণ রয়েছে। তার মায়ের সংক্ষিপ্ত দিনপঞ্জী (১৯০৫) পাওয়া যায় কিন্তু তার পিতার কাছ থেকে এমন কিছুই পাওয়া যায়নি। রিচার্ড ওয়ালমেসলে ব্লেয়ারকে বৃদ্ধ বয়সে চিনতেন এমন লোকদের কাছ থেকে কয়েকটি উপাখ্যান পাওয়া যায় মাত্র। ১৯৩৮ সালে মরক্কোতে বসবাসকালে অরওয়েল তার বাবাকে পাঠানো কয়েকটি ফটোগ্রাফ এবং মাত্র একটি চিঠি পাওয়া যায়। বোধগম্যভাবে, প্রাথমিক উত্সগুলোর তীব্র সংকটের ফলে জীবনীকারদের অনেক ত্রুটি রয়েই গেছে। অরওয়েলের বাবা-মা সম্পর্কে তাদের একমাত্র পুত্রের জন্মের সময় পর্যন্ত কতিপয় তথ্য পাওয়া যায়।

আগ্রা এবং অযোধ্যার সংযুক্ত প্রদেশ সরকারের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী ছিল নৈনিতাল। প্রায় নিশ্চিতভাবেই বলা যেতে পারে, অরওয়েলের বাবা-মা ১৮৯৬ সালে নৈনিতালে দেখা করেছিলেন। ২১ বছর বয়সী ইডা মেবেল লিমুজিন তখন স্থানীয় একটি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। নয়াদিল্লি থেকে ৩৪৫ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বের এই শহরটির আবহাওয়া ছিল খুবই মনোরম। ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের আফিম বিভাগের কর্মকর্তা ৩৯ বছর বয়সী রিচার্ড ওয়ালমেসলে ব্লেয়ার সেখানে ছয় মাসের ছুটি উপভোগ করছিলেন। বছরের মাঝামাঝি সময়ে সমতল ভূমিতে তাপমাত্রা অসহনীয় হয়ে উঠলে ভারতীয় উপমহাদেশের অনুচ্চ এই পাহাড়ি শহরটি সৌখিন পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। এখানে একমাত্র অ-ইউরোপীয়রাই ছিল চাকর বাকর বা সরাসরি জনপদের সেবায় জড়িত।

হাতেগোনা কয়েকটি পাহাড়ি স্থানের মধ্যে নৈনিতাল ছিল অনন্য। বিশাল এক প্রাকৃতিক জলাধার এবং বিশাল সমতলভূমির সমন্বয়ে প্রকৃতির আশীর্বাদধন্য অঞ্চল। ১৮৮০ সালের ভূমিধস হ্রদের এক প্রান্ত ভরাট করে ফেলে। একারণেই শহরটি খেলাধুলা এবং বিনোদনের একটি জনপ্রিয় ব্যবহারিক স্থানে পরিণত হয়েছিল। ফ্যান্সি ড্রেস ব্যালে, গুপ্তধনের সন্ধান, নৃত্য, সৌখিন কুকুর প্রদর্শনী, নাটক মঞ্চায়ন এবং শুটিং পার্টিসমূহে নারী-পুরুষদের পরস্পর পরিচিত হওয়ার প্রচুর সুযোগ ছিল। টেনিস বা ক্রিকেট খেলা, পোলো দেখা, রোয়িং উপভোগ করার সময়, বোট রেস এবং পুরুষ বনাম প্রমীলা ক্রিকেট ম্যাচের সময়ও সেই সুযোগ অবারিত ছিল।

ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত ব্যক্তিরাই নৈনিতালের বসতি স্থাপন ও উন্নয়নের পাশাপাশি পর্যটনের সূচনার জন্য কৃতিত্বের দাবীদার ছিলেন। এই উদ্যোগটি মূলত মেরি জেনের কৃতিত্ব বলা যেতে পারে, যিনি কিংবদন্তি শিকারী-পরিবেশবিদ জিম করবেটের মা হিসেবে পরিচিত। তিনিই কার্যত পাহাড়ী শহরটির পর্যটন বিষয়ক কর্মকাণ্ডের জননী ছিলেন কারণ তিনিই সর্বপ্রথম দর্শনার্থীদের থাকার জন্য প্রথম আবাসিক স্থাপনা নির্মাণ করেছিলেন। তার সন্তান কিংবদন্তি শিকারী-পরিবেশবিদ এবং কুমায়নের লেখক জিম করবেটের নামে “করবেট ন্যাশনাল পার্ক” নামকরণ করা হয়েছে। ইতিহাসের এই অংশটি মনে হয় সময়ের স্তরে চাপা পড়ে গেছে কারণ মনোরম পাহাড়ি শহরটি এখন প্রতি বছর পর্যটকদের ভিড়ে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। মেরি জেন বসবাস করতেন মুসৌরি এবং নৈনিতালের পাহাড়ে এবং নৈনিতালেই মৃত্যুবরন করেন। তিনি ১৯২৪ সালের ১৬ মে মৃত্যুবরন করেন। তাকে সেন্ট জন-ইন-দ্য-উইল্ডারনেস চার্চের কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। তার শেষ বিশ্রামের স্থানটিও এই শহরের কোলে অবস্থিত।

ভারতের উত্তপ্ত এবং তিক্ত আবহাওয়ার মধ্যে নৈনিতালের আবিষ্কারটি ব্রিটিশদের জন্য একটি আশীর্বাদের মতো ছিল। মাতৃভূমির শীতল তাপমাত্রার জন্য স্মৃতিকাতর ব্রিটিশ নাগরিকগণ নৈনিতালের আবহাওয়ায় স্বস্তি পেতেন।

অরওয়েল অ্যান্ড রিলিজিয়ন (২০১৭) গ্রন্থে মাইকেল ব্রেনান প্রস্তাব করেন যে, ইডা লিমুজিনের পরিবার রোমান ধর্মমতাবলম্বী ছিল। ইডা সম্ভবত নৈনিতালের সেন্ট জোসেফ ক্রিশ্চিয়ান ব্রাদার্স বয়েজ স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। ব্রেনান অনুমান করেছিলেন যে ইডার মা থেরেসা ক্যাথরিন হ্যালিলি (১৮৪৩-১৯২৫), নামের একটি খুব ক্যাথলিক সংমিশ্রণ ছিল এবং তার বাবা “ফ্রাঙ্ক” ম্যাথু লিমুজিন (১৮৩৫-১৯১৫) ছিলেন ফ্রান্সের ধর্মপ্রাণ ক্যাথলিক অঞ্চল বলে খ্যাত লিমোজেসের বাসিন্দা। প্রামাণিক তথ্যসমূহ এই বিবৃতিকে সমর্থন করে না।

হ্যালিলি’র নিজের বাবা-মা কলম্বোর বিখ্যাত অ্যাংলিকান চার্চ সেন্ট পিটারস গির্জায় বিয়ে করেছিলেন। ফ্রাঙ্ক এসেছিলেন ফ্রান্সের বোর্দো থেকে। বোর্দো অঞ্চলের পাদরিরা ঈশ্বরভক্তির চেয়েও তাদের দ্রাক্ষাক্ষেত্রের জন্য বেশি পরিচিত ছিলেন। প্রমাণ রয়েছে যে ফ্রাঙ্কের ঠাকুরদা আন্তোইন লিমুজিন (১৭৬৪-১৮৪১) যিনি তাঁর নাতির মতো একজন জাহাজের কাপ্তান ছিলেন। তিনি ইডা লিমুজিনের জন্মের একশ বছর আগে রোমান ক্যাথলিক চার্চে বাপ্তিস্ম নিয়েছিলেন। ইডার পরিবার নিজেদেরকে রোমান ক্যাথলিক বলে মনে করত এমন কোনো ইতিহাস নেই। এটাও লক্ষণীয় যে লিমুজিন এবং হ্যালিলি গোষ্ঠীর বেশ কয়েকজন সদস্য ছিলেন ফ্রিম্যাসন। ফ্রিম্যাসন হল ১৮ শতক থেকে ক্যাথলিক চার্চ দ্বারা নিষিদ্ধকৃত একটি গোপন সমাজ। এটাও উল্লেখযোগ্য যে ফ্র্যাঙ্ক লিমুজিনের প্রথম স্ত্রী ছিলেন এলিজা ফ্যালন (১৮৪১-১৮৬৫) তাকে এবং তার দুই সন্তানকে ১৮৬৫ সালে মৌলমেইনের অ্যাংলিকান কবরস্থানে সমাহিত করা হয়েছিল।

থ্যাকার‘স ইন্ডিয়ান ডাইরেক্টরি (১৮৯৭) মিস লিমুজিনকে নৈনিতালে “প্রথম শিক্ষক, বালিকা বিদ্যালয়” হিসাবে তালিকাভুক্ত করেছে। মাত্র দুটি সম্ভাবনা আছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের রেকর্ড বিদ্যমান নেই তবে কিছু স্পষ্ট প্রাসঙ্গিক সূত্র রয়েছে যে ইডা লিমুজিন তখন সেইন্ট মেরি‘জ কনভেন্ট হাই স্কুলে নয়, অল সেন্টস ডায়োসেসান হাই স্কুলে নিযুক্ত ছিলেন। থ্যাকার‘স ইন্ডিয়ান ডাইরেক্টরি অরওয়েলের মাকে “ফার্ন কটেজে” বসবাসকারী হিসাবে তালিকাভুক্ত করেছেন। এই বাসভবনটি তখন ডায়োসেসান স্কুল ফর বয়েজ-এর প্রাক্তন অধ্যক্ষ মিস্টার আর জে এলিয়ট এর মালিকানাধীন ছিল। বর্তমানে এটি শেরউড কলেজ নামে পরিচিত। ১৮৬৯ সালে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান শিশুদের পাঠদানের উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। প্রতিষ্ঠানটি মূলত বালক-বালিকাদের একত্রে শিক্ষাদান করতো।
১৮৭১ সালে স্কুলটি বিভাজিত হয়ে ডায়োসেসান গার্লস হাই স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৯২ সালে এই স্কুলটির বর্তমান অবস্থান আয়ারপাট্টা পাহাড়ে স্থানান্তর করা হয়। এই তথ্যটি উন্মোচনের ফলে অরওয়েলের মা যেখানে শিক্ষকতা করতেন সেই স্কুলের প্রাথমিক ইতিহাসের একটি ভাল ধারনা পাওয়া যায়। ইডা লিমুজিনের বোন নেলি লিমুজিন সহ স্বজনেরা ছিল, যারা রেঙ্গুনের ডায়োসেসান গার্লস হাই স্কুলে কাজ করতেন। এলিয়ট তার সম্পত্তি একজন নতুন শিক্ষককে ভাড়া দিয়েছেন বলে বিবেচনা করা হয়। উপরের আলোচনাটি বিবেচনায় এই মনোমুগ্ধকর কুটিরটি এখনও দাঁড়িয়ে আছে বিদ্রূপাত্মকভাবে। বাড়িটির অভ্যন্তরে একটি ছোট প্রার্থনালয় রয়েছে যা মূল মালিক রবার্ট রিড তার ‘ক্যাথলিক স্ত্রী’র জন্য নির্মাণ করেছিলেন। ইডা লিমুজিন কেন নৈনিতালে চাকুরি করছিলেন? বাস্তবে এর কোনোটিই এই প্রশ্নের পর্যাপ্ত উত্তর দেয় না।বলা হয়ে থাকে, তিনি কারও প্রেমে প্রতারিত হয়েছিলেন যিনি তাকে এই শহরে নিরুপায় ও অসহায় অবস্থায় ফেলে চলে যান। অথবা সম্ভবত তিনি দুঃসাহসিক ছিলেন এবং স্বেচ্ছায় মৌলমেইনে থাকা তার পরিবার থেকে দূরে নৈনিতালে চাকরির সুযোগটি লুফে নিয়েছিলেন। এই দুইটি বক্তব্যেরও নির্ভরযোগ্য কোন সূত্র নেই, শুধুই জল্পনা বলা যেতে পারে।

রিচার্ড এবং ইডা লিমুজিন ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই জুন নৈনিতালের সেন্ট জন-ইন-দ্য-উইল্ডারনেস চার্চে বিয়ে করেন। বিয়ের সনদ অনুসারে বলা হয়ে থাকে যে ইডা লিমুজিনের বোনদের মধ্যে একজন বিয়েতে উপস্থিত ছিলেন এবং রিচার্ড ওয়ালমেসলে ব্লেয়ারের পক্ষ থেকে লখনউয়ের অধিবাসী একজন আইনজীবী বন্ধু উপস্থিত ছিলেন। কোনো ক্যাথলিক স্কুলের একজন শিক্ষক স্থানীয় অ্যাংলিকান চার্চে বিয়ে করবে- এ বিষয়টির সম্ভাব্যতা খুবই কম।

এর ছয় বছর পরে ১৯০৩ সালের ২৫ জুন ব্লেয়ার দম্পতির একমাত্র পুত্র এরিক আর্থার ব্লেয়ার (জর্জ অরওয়েল) হিমালয় পর্বতমালার পাদদেশে তখনকার বাংলা প্রদেশের বিহারের মতিহারিতে জন্মগ্রহন করেন। নীচের ছবিটি সম্ভবত ৩০শে অক্টোবর তোলা হয়েছিল, যেদিন অরওয়েল ১৯০৩ সালে প্রোটেস্ট্যান্ট, রিজিয়ন্স বিয়ন্ড মিশনারি ইউনিয়নে বাপ্তিস্ম গ্রহণ করেছিলেন। ১৮৭৩ সালে রিজিয়ন্স বিয়ন্ড মিশনারি ইউনিয়ন অঞ্চলগুলি ছিল হেনরি গ্র্যাটান গিনেস, ডিডি এবং তার স্ত্রী ফ্যানিদ্বারা প্রতিষ্ঠিত একটি প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টান মিশনারি সমাজ।

মায়ের কোলে শিশু এরিক আর্থার ব্লেয়ার (বাপ্তিস্ম গ্রহনের দিন)

অরওয়েলের জন্মের অনেক আগে থেকেই তার জীবনের সুত্রগুলো উপনিবেশের গভীর বুননে বোনা হয়েছিল। মতিহারিতে অরওয়েল যে বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সেখান থেকে একটি ঢিল ছোঁড়ার দূরত্বে ছিল আফিম সংরক্ষণের গুদাম। অরওয়েলের জন্মস্থান মোতিহারির বাড়িটি ১৯৮৩ সালে স্কটিশ সাংবাদিক ইয়ান জ্যাকের পরিদর্শনের আগ পর্যন্ত কয়েক দশক ধরে অবহেলিত হিশেবে পড়েছিল। প্রতীকীভাবে উল্লেখযোগ্য এর পরের বছরেই অর্থাৎ ‘১৯৮৪’ সালে তিনি একটি নিবন্ধ প্রকাশ করার জন্য অরওয়েলের শিকড়ের সন্ধান করতে ভারতে আসেন। পরবর্তীতে সেই নিবন্ধে জ্যাক দাবি করেছিলেন যে শহরের কোনো ব্যক্তিই বিশ্বখ্যাত এই লেখকের স্থানীয় শিকড় সম্পর্কে সচেতন ছিলেন না।

অরওয়েলের জন্মস্থান মতিহারির বাড়িটি এখন অরওয়েল মিউজিয়াম

ভারতের বিহার রাজ্য সরকার ২০১৪ সালে ঘোষণা করে যে অরওয়েলের জন্মস্থান হিশেবে ভারতের বিহারের মতিহারিতে একটি বাংলো বিশ্বের প্রথম অরওয়েল যাদুঘর হিশেবে পরিচিত হবে। মতিহারিতে তাঁর জন্মস্থান এবং পৈতৃক বাড়িটিকে ঐতিহাসিক গুরুত্বের একটি সুরক্ষিত স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। জর্জ অরওয়েল যে জরাজীর্ণ ঔপনিবেশিক বাংলোতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ভারতের সংরক্ষণবাদীরা সেটি পুনরুদ্ধার করতে শুরু করেন। বিহার রাজ্য সরকার বাড়িটিকে লেখকের নামে উত্সর্গ করে একটি জাদুঘরে রূপান্তর করার পরিকল্পনা ঘোষণা করে। ১৯০৩ সালের ২৫জুন অরওয়েল যে তিন কক্ষের বাড়িটিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তার পাশাপাশি, মতিহারির ছোট্ট শহরটির সম্পত্তিতে কয়েকটি ছোট কটেজ এবং একটি বড় গুদাম রয়েছে যা আফিম সংরক্ষণের জন্য ব্যবহৃত হত। অরওয়েলের বাবা, রিচার্ড ডব্লিউ ব্লেয়ার, আফিম বিভাগের জন্য ভারত-নেপালী সীমান্তের কাছে এই প্রত্যন্ত শহরে কাজ করতেন। পপি চাষীদের তত্ত্বাবধান করতেন এবং চীনে রপ্তানির জন্য আফিম সংগ্রহ করতেন। কয়েক বছর আগে “বিহার প্রাচীন স্মৃতিস্তম্ভ (সুরক্ষা) আইন, ১৯৭৬”-এর অধীনে রাজ্য সরকার এর চারপাশের জমি অধিগ্রহণ না করা পর্যন্ত বহু বছর ধরে এটি একটি সরকারি স্কুলের দখলে ছিল।

অনেক ভবনই ধ্বংসাবশেষে রূপান্তরিত হয়েছে কিন্তু বাংলো এবং কাছাকাছি একটি কটেজ এখনও দাঁড়িয়ে আছে। আফিম গুদামটিও পুনসংস্কার করা হয়েছে। সংস্কার করার পর অবশেষে বাড়িটিকে একটি জাদুঘরে রূপান্তর করা হয়েছে। রাজ্যের কর্মকর্তারা আশা করেন যে এটি শেক্সপিয়রের স্ট্রাটফোর্ড-আপন-অ্যাভন বা টলস্টয়ের ইয়াসনায়া পলিয়ানার মতো একটি তীর্থস্থানে পরিণত হবে।

ভারতের বর্তমান বিহার রাজ্যের পূর্ব চম্পারন জেলার অংশ মতিহারী এমন একটি এলাকা যেখান থেকে ১৯১৭ সালে মহাত্মা গান্ধী আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করেন যা অবশেষে ৩০ বছর পরে ভারত থেকে ব্রিটিশদের প্রস্থান করতে বাধ্য করে। বিহারের চাষীদের দুর্দশা দেখে মহাত্মা গান্ধী অনুপ্রাণিত হন যারা যথাক্রমে চীন এবং ইউরোপের লাভজনক বাজারের জন্য আফিম এবং নীল উৎপাদন করতে বাধ্য হতো।

অরওয়েলের বাবা আফিম সংরক্ষন ও রপ্তানির দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। অরওয়েলের পূর্বপুরুষগণ অর্থাৎ ব্লেয়ার, হ্যালিলি, ফেইন, হেয়ার এবং লিমুজিনরা সাম্রাজ্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন মাত্রায় সেবা দিয়েছেন। আরও অনুসন্ধানযোগ্য একজন আত্মীয় হলেন তার মাতামহ, উইলিয়াম আগর হ্যালিলি (১৮১৬-১৮৮৬) যিনি সিলন (বর্তমান শ্রীলংকা) সিভিল সার্ভিসে শুল্ক দপ্তরের প্রিন্সিপাল কালেক্টর হয়েছিলেন। ১৯০৪ সালে ইডা ব্লেয়ার তার দুই সন্তানকে নিয়ে ইংল্যান্ডের উদ্দেশে ভারত ত্যাগ করেন। মার্জোরি নামে অরওয়েলের একজন সহোদরা ছিলেন যিনি ১৮৯৮ সালে ভারতের গয়া শহরে জন্মগ্রহণ করেন। উপমহাদেশে চাকুরি করার সময় বিলেতের পুরুষ সরকারি কর্মচারীদের স্ত্রী ও সন্তানদের পড়াশুনার তাগিদে বিলেতে ফিরে যাওয়া অস্বাভাবিক ছিল না। অরওয়েলের বাবা সাব-ডেপুটি আফিম এজেন্ট হিসাবে ১৯১২ সালে অবসর গ্রহণের আগ পর্যন্ত তার চাকুরি অব্যাহত রেখেছিলেন।

১৯০৫ সালের ইডার ডায়েরিতে দেখা যায় যে তার একটি সক্রিয় সামাজিক জীবন ছিল। তিনি ফটোগ্রাফি করতেন এবং তার ভাইবোনদের, বিশেষ করে নিজ বোন নেলি লিমুজিনের সঙ্গ উপভোগ করতেন। ১৯১২ সাল পর্যন্ত তিনি তার সন্তানদের লালন-পালন করেছেন তাদের বাবাকে ছাড়াই। ১৯০৭ সালে রিচার্ড ওয়ালমেসলে ব্লেয়ার তার পরিবারের সাথে দেখা করার জন্য ৮ মাস ৭ দিনের একটি লম্বা ছুটিতে ইংল্যান্ডে যান। এরপর তাদের দ্বিতীয় কন্যা এভ্রিল ১৯০৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন।

ফরাসি বংশোদ্ভূত পিতার সন্তান হওয়া সত্বেও ইডা লিমুজিন সেই সময়কালের অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের জীবনধারায় অভ্যস্ত ছিলেন। দুই মহাদেশের মাঝামাঝি স্থানে তিনি তার সংসার পেতেছিলেন। তার গতিপথের সময়রেখা সম্পর্কে আরও গভীর গবেষণার দাবী রাখে। তবে তিনি ১৮৭৫ সালে লন্ডনের দক্ষিণ উপকণ্ঠে পেঙ্গে এলাকায় হ্যালিলি নিবাসে এক পারিবারিক ছুটির সময় জন্মগ্রহণ করেন। ইডা তার শৈশবকাল বার্মায় কাটিয়েছেন কিন্তু ১৮৮৬ থেকে ১১ বছর বয়সে তার দুই বোনের সাথে ইংল্যান্ডের বেডফোর্ড হাই স্কুলে পড়াশুনা করেছেন। বিয়ের আগ পর্যন্ত তিনি ফরাসী পাসপোর্টে ভ্রমণ করেছেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, অরওয়েলের মায়ের ফরাসি বংশের বাস্তব অনুধ্যায় এড়িয়ে গিয়ে দাবী করা হয় যে তার মায়ের পরিবার ইয়র্কশায়ার থেকে এসেছিল এবং উপনিবেশের চাকুরি এবং সাম্রাজ্যের সাথে সেই বংশের গভীর সংযোগ ছিল। ইডার জীবনসঙ্গী নির্বাচন বিষয়টিতে অরওয়েলের জীবনীকাররা সর্বদা হতবুদ্ধি হয়েছেন। রিচার্ড ওয়ালমেসলে ব্লেয়ারের তুলনায় যথেষ্ট কম বয়সী, বুদ্ধিমান, আরও পরিশীলিত ও হালকা উড়নচণ্ডি ইডা লিমুজিনকে অসম একটি বিয়ের পাত্রী হিসাবে চিত্রিত করেছেন। কিছু পরিচিতদের স্মৃতিচারণ থেকে জানা গেছে রিচার্ডের বয়স বাড়ার সাথে সাথে তিনি কিছুটা খুঁতখুঁতে এবং রক্ষণশীল হয়ে উঠেছিলেন ।

অরওয়েলের পিতামাতার এই অসঙ্গতিগুলি তাদের ছেলের আপাতবিরোধী, কিছুটা চমকপ্রদ এবং পরস্পরবিরোধী ব্যক্তিত্ব ব্যাখ্যা করার জন্য প্রায়শই প্রয়োগ করা হয়েছে। একটি আমূল, অর্ধেক প্রেমে সে কেন বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিল। উদাহরণ হিশেবে বলা যেতে পারে, অরওয়েলের রচনাবলী সাধারন পাঠকের কাছে যেমনটি প্রতিভাত হয়, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের প্রতি তার মনোভাব ছিল তার চেয়েও জটিল।

জর্জ অরওয়েল সর্বপ্রথম ক্ষুধা, দারিদ্র্য এবং সাম্রাজ্যবাদ নিয়ে লেখালেখিতে আসেন ডাউন অ্যান্ড আউট ইন প্যারিস এবং লন্ডন, বার্মিজ ডেজ, দ্য রোড টু উইগান পিয়ার, এবং ব্যক্তিগত প্রবন্ধের মাধ্যমে। যদিও প্রবন্ধসমূহ ছোটগল্পের মতোই, যেমন ‘দ্য স্পাইক’ এবং ‘আ হ্যাঙ্গিং’ তার নিজের আশল নাম ‘এরিক আর্থার ব্লেয়ার’ হিশেবে প্রকাশিত হয়েছিল। একজন যুবক হিসেবে ভারতীয় ইম্পেরিয়াল পুলিশে পাঁচ বছর চাকরি করার পর ‘ডাউন অ্যান্ড আউট’ হওয়ার অভিজ্ঞতা তার মতামতের রূপান্তরে সহায়তা করেছে। অরওয়েলের পূর্বপুরুষরা দাস ব্যবসা থেকে কীভাবে সম্পদ এবং সুযোগ-সুবিধা অর্জন করেছিলেন এবং তার পিতা তার পুরো কর্মজীবন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের হয়ে চীন দেশে আফিম রফতানির কাজ করেছেন তা প্রায়শই আলোচনা করা হয় না। অরওয়েল সাম্রাজ্যবাদ বা তার বেড়ে ওঠার সময় সম্পর্কে তার নিজের লেখায় এই বিষয়গুলোর কোনওটিই উল্লেখ করেননি।

তার বাবার সাথে কোনো আলোচনার বিষয়বস্তু সম্পর্কে কার্যত কোন প্রমাণ নেই তবে রিচার্ড ডব্লিউ ব্লেয়ারের ১৯১২ সালে অবসর যাওয়ার পরে ভারতে চাকুরিকালীন অভিজ্ঞতার গল্পগুলো তার ছেলেকে বলেছেন বলেই ধরে নেওয়া যায়। যদি তাই হয়, তাহলে অরওয়েলের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে তাদের কীরকম প্রভাব পড়েছিল? ১৯২২ সালে কিশোর বয়সে উপমহাদেশের বার্মার মাটিতে পা দিয়ে ভারতীয় ইম্পেরিয়াল পুলিশ হিসাবে অরওয়েলের নিজের কর্মজীবনে তার বাবার প্রভাব কী হওয়া উচিত ? যেমনটি তার বাবা তার প্রায় অর্ধ শতাব্দী আগে করেছিলেন। একজন সাব-ডেপুটি আফিম এজেন্টের কাজ মোটেই চমকপ্রদ ছিল না। তা সত্বেও উপমহাদেশে প্রায় চার দশক পরে, তার বাবার কাছে অবশ্যই অনেক গল্পের ভান্ডার ছিল।

পূর্বেকার অরওয়েল গবেষকদের অজানা একটি বিষয় সম্প্রতি গবেষণায় উঠে এসেছে। রিচার্ড ডব্লিউ ব্লেয়ার তার কর্মজীবনের প্রথম দিকে গ্রেট ফামিন(১৮৭৬-১৮৭৮) বা দুর্বিসহ ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের সময় দক্ষিণ ভারতের বেলারিতে একজন দুর্ভিক্ষ ত্রাণ কর্মকর্তা ছিলেন। এক তীব্র খরার ফলে দাক্ষিণাত্য মালভূমিতে ফসল নষ্ট হওয়ার পর ১৮৭৬ সালে এই মহা দুর্ভিক্ষ শুরু হয়। এই মহা দুর্ভিক্ষ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম ভারতের মাদ্রাজ ও বোম্বাইয়ের ব্রিটিশ-শাসিত প্রেসিডেন্সিসহ মহীশূর ও হায়দ্রাবাদের রাজ্যকে দুই বছর সময় ধরে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করে। ১৮৭৭ সালে দুর্ভিক্ষ উত্তর দিকের অঞ্চলসমূহকে প্রভাবিত করে, যার মধ্যে কেন্দ্রীয় প্রদেশ এবং উত্তর-পশ্চিম প্রদেশের কিছু অংশ এবং পাঞ্জাবের একটি ছোট এলাকা অন্তর্ভুক্ত ছিল। দুর্ভিক্ষ শেষ পর্যন্ত ৬৭০,০০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকাকে প্রভাবিত করে এবং মোট ৫৮,৫০০,০০০ জনসংখ্যার জীবনে দুর্ভোগ বয়ে আনে। দুর্ভিক্ষের অতিরিক্ত মৃত্যুহার সর্বনিম্ন ৫.৬ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু এবং সর্বোচ্চ ৯.৬ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু হিশেবে ধরা হলেও একটি সচেতন আধুনিক জরিপে ৮.২ মিলিয়ন জনগণের মৃত্যু হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। দুর্ভিক্ষটি ১৮৭৬-১৮৭৮ সালের দক্ষিণ ভারতের দুর্ভিক্ষ এবং ১৮৭৭ সালের মাদ্রাজ দুর্ভিক্ষ নামেও পরিচিত। ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অধীনে অনেক দুর্ভিক্ষের মধ্যে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর উল্লেখযোগ্য একটি।

মহা দুর্ভিক্ষটি ভারত, চীন, দক্ষিণ আমেরিকা এবং আফ্রিকার কিছু অংশ জুড়ে খরার ফলে ফসলের ব্যর্থতার একটি বৃহত্তর ধকলের অংশ ছিল। শক্তিশালী এল নিনো অর্থাৎ দক্ষিণ আমেরিকার সংলগ্ন প্রশান্ত মহাসাগরে উষ্ণ জলের স্রোত উৎপন্ন হওয়ার ফলে বিশ্বের অনেক অংশে আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটিয়ে দেয়া জলবায়ু এবং ভারত মহাসাগরীয় সক্রিয় এক জোড়া সমান এবং বিপরীত চুম্বকীয় পোলের মধ্যে পারস্পরিক ক্রিয়াকলাপের কারণে এরকম খরা ঘটে বলে ধারণা করা হয়। খরায় ফসলের কম উৎপাদন সত্বেও ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সরকারের নিয়মিত শস্য রপ্তানি অব্যাহত ছিল। দুর্ভিক্ষের সময় ভাইসরয় লর্ড রবার্ট বুলওয়ার-লিটন ইংল্যান্ডে রেকর্ড পরিমাণ ৩২০,০০০ টন গম রপ্তানির তত্ত্বাবধান করেন। এর ফলে এই অঞ্চলটি আরও বেশি খাদ্যঝুঁকিতে পতিত হয়। শস্যের পণ্যায়নের পাশাপাশি বিকল্প অর্থকরী ফসলের চাষ দুর্ভিক্ষ কবলিত অঞ্চলমূহকে প্রভাবিত করে। ঔপনিবেশিক সরকার যখন মানবকল্যাণে ব্যয় কমানোর চেষ্টা করছে ঠিক তখনই এই দুর্ভিক্ষ ঘটে। এর আগে ১৮৭৩-৭৪ সালের বিহারের দুর্ভিক্ষে বার্মা থেকে চাল আমদানি করে গনহারে মৃত্যু এড়ানো সম্ভব হযয়েছিল। দাতব্য ত্রাণে অত্যধিক ব্যয়ের জন্য বাংলা সরকার এবং এর লেফটেন্যান্ট-গভর্নর স্যার রিচার্ড টেম্পল ব্রিটিশ সরকারের কাছে সমালোচিত হন। ১৮৭৬ সালে ভারত সরকারের দুর্ভিক্ষ কমিশনার থাকাকালে নতুন করে কোনো অতিরিক্ত অভিযোগের প্রতি সংবেদনশীল টেম্পল শস্যের বাণিজ্যের পাশাপাশি ত্রাণ এবং ত্রাণের জন্য যোগ্যতার কঠোর মানদণ্ডের উপর জোর দেন। তখন দুই ধরণের ত্রাণ দেওয়া হয় : সামর্থ্যবান পুরুষ, নারী এবং শ্রমজীবী শিশুদের জন্য “রিলিফ ওয়ার্কস” এবং ছোট শিশু, বয়স্ক এবং অসহায়দের দাতব্য ত্রাণ।

বেল্লারিতে মহাদুর্ভিক্ষের সময়ে ত্রাণ বিতরণের একটি ছবি

দুর্ভিক্ষের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়ার পর ১৮৭৮ সালের ১১ আগস্ট থেকে ১৮৭৯ সালের ১১ জানুয়ারি পর‌্যন্ত পাঁচ মাসের জন্য আফিম বিভাগ থেকে প্রতিনিধিত্বকালে রিচার্ড ডব্লিউ ব্লেয়ারের বয়স ছিল মাত্র ২১ বছর। তিনি অবশ্যই সেই ভয়ানক যন্ত্রণার সাক্ষী থাকবেন যা ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের একটি প্রজন্মকে সরাসরি প্রভাবিত করেছিল। তিনি যেভাবে সাম্রাজ্য দেখেছেন তাতে কি এই প্রভাব পড়েছে? তার একমাত্র ছেলে জর্জ অরওয়েল বার্মায় “সাম্রাজ্যের নোংরা কাজ” করে পাঁচ বছর অতিবাহিত করে পদত্যাগ করেন। অরওয়েল বুঝতে পেরেছিলেন যে তিনি এমন একটি পেশা বেছে নিয়েছেন যার জন্য তিনি অনুপযুক্ত এবং অসহ্য বিষয়গুলো হজম করতে পারছেন না। দশ ভাইবোনের মধ্যে সবচেয়ে ছোট ছাপোষা রিচার্ড ডব্লিউ ব্লেয়ারের কাছে সেই বিকল্প ছিল না।

বলে রাখা দরকার, অরওয়েলের জন্মের আগে তার পিতা রিচার্ড ওয়ালমেসলে ব্লেয়ার বাংলা প্রেসিডেন্সির বিহারের তেহতায় কর্মরত অবস্থায় তার বড়বোন মার্জোরির জন্ম হয় গয়া জেলায়। পিতা রিচার্ড ওয়ালমেসলে ব্লেয়ার ছিলেন ভারত সরকারের আফিম বিভাগে কর্মরত। ১৮৬০ সাল থেকে চীনের সাথে একচেটিয়াভাবে আফিম ব্যবসা সরকারী হিশেবে বৈধ করা হয়। রিচার্ড মাত্র ১৮ বছর বয়সে ভাগ্য অন্বেষণে এই চাকুরিতে যোগ দিয়েছিলেন। তার অনুল্লেখ্য কর্মজীবনে তিনি বছরের শুরুর দিকে একজন আফিম এজেন্ট হিশেবে জেলায় ঘুরে বেড়াতেন, পপি চাষীদের অগ্রিম দিতেন এবং বুড়ো আঙ্গুলের টিপসই নিতেন। একটি নির্দিষ্ট সময় পরে তিনি ফসলের গুণমান পরীক্ষা করতে আবার ফিরে আসতেন। কাজটি পরিষ্কারভাবে নিস্তেজ এবং একঘেয়েমি ধরনের ছিল।
গেজেটেড এবং বাংলা সরকারের অধীনে কর্মরত চিকিৎসা, পুলিশ, শিক্ষা এবং অন্যান্য বিবিধ বিভাগের অধীনস্থ কর্মকর্তাদের পরিষেবার ইতিহাস তালিকার দ্বিতীয় খণ্ডে দেখা যায় যে বেচারা ভদ্রলোক ১৮৭৫ সালে প্রথমে সহকারী সাব-ডেপুটি আফিম এজেন্ট হিশেবে চাকরিতে যোগদানের পর থেকে প্রায় প্রতি বছর বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে বদলী হতেন। ৫৫ বছর বয়সে অবসর না নেওয়া পর্যন্ত তিনি সাব-ডেপুটি আফিম এজেন্টহিশেবে কর্মরত ছিলেন। প্রায় কুড়ি বছর ধরে তার কর্মস্থল বদল হতেই থাকে, বলাবাহুল্য যে কর্মস্থলের কোনোটিই তেমন ভাল স্থান ছিল না। একবারই মাত্র তিনি ১৮৯০-এর দশকে বিহারের তেহতার গয়াতে ছয় বছর কাজ করেন। সেই সময় তার প্রথম কন্যা সন্তান মার্জোরি ব্লেয়ার জন্মগ্রহন করেন ১৮৯৮ সালের ২১ এপ্রিল। এছাড়াও অন্য আরেকটি জায়গায় তিনি দীর্ঘ একটি সময় চাকুরি করেন, ইতিহাসখ্যাত স্থানটির নাম মুঙ্গের। বর্তমানে ভারতের বিহার রাজ্যের ৩৯টি জেলার অন্যতম হল এই মুঙ্গের। মুঙ্গের নামটির ব্যুৎপত্তি নিয়ে একাধিক কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। একটি কিংবদন্তি অনুসারে, মুঙ্গের নামটি প্রাচীন মুদ্গগিরি নাম থেকে এসেছে। মহাভারত ও দেবপালের তাম্রলিপিতেও এই নামটি পাওয়া যায়। অন্যমতে এই নামটি এসেছে ঋষি মুদগল বা গৌতম বুদ্ধের শিষ্য মৌদগল্যায়নের নাম থেকে। মুঙ্গের জেলার ভূখণ্ডটি প্রাচীনকালে অঙ্গ মহাজনপদের অন্তর্গত ছিল। মহাভারতে কর্ণকে অঙ্গের রাজা বলা হয়েছে। পাল সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল মুদ্গগিরি বা মুঙ্গের। বাংলার নবাব মিরকাশিম ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য মুঙ্গেরে গঙ্গার তীরে তিনটি দরজাবিশিষ্ট একটি দুর্গ নির্মাণ করেন। ব্রিটিশ শাসনের প্রথম দিকে মুঙ্গের ভাগলপুর জেলার অংশ ছিল। ১৮৩২ সালে মুঙ্গের পৃথক জেলার স্বীকৃতি লাভ করে। যাই হোক, রিচার্ড ওয়ালমেসলে ব্লেয়ার তার পুত্র জর্জ অরওয়েলের জন্মের এক বছর পর মুঙ্গেরে বদলী হন। সেই থেকে অবসর নেওয়া পর্যন্ত তিনি ওখানেই কর্মরত ছিলেন।
অরওয়েলের বাবা রিচার্ড ওয়ালমেসলে ব্লেয়ারের জীবনের যাত্রাপথ কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। তার প্রপিতামহ চার্লস ব্লেয়ার (১৭৪৩-১৮২০) ছিলেন একজন ধনাঢ্য ব্যক্তি, জ্যামাইকার ইক্ষু বাগান ও ক্রীতদাস ব্যবসার মালিক। তিনি অভিজাত পরিবারে বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু তার দশম তথা শেষ পুত্র থমাস রিচার্ড ব্লেয়ারের জন্মের সময় তার সৌভাগ্যের সূর্য স্তিমিত হয়ে পড়েছিল। থমাস রিচার্ড ব্লেয়ার ১৮০২ সালে ইংল্যান্ডের হ্যাম্পশায়ারের এক্সবারিতে জন্মগ্রহণ করেন। তাই একজন ধর্মপুত্র এবং ওয়েস্টমোরল্যান্ডের মাননীয় আর্লের তুতো ভাই হওয়া সত্বেও সেই শেষ সন্তান অর্থাৎ এরিকের ঠাকুরদাদা থমাস রিচার্ড ব্লেয়ারকে জীবিকা অর্জনের তরে দেশ ছেড়ে বের হতে হয়েছিল। কেমব্রিজের পেমব্রোক কলেজে মাত্র এক বছর থাকার পর জর্জ অরওয়েলের ঠাকুরদাদা উপনিবেশ অঞ্চলে চলে যান। তিনি ১৮৩৯ সালে কলকাতার চার্চ অফ ইংল্যান্ডে ডিকন নিযুক্ত হন। এরপর ১৮৪৩ সালে তাসমানিয়ায় যাজক হিশেবে নিযুক্ত হন। ব্রিটিশ অভিজাত পরিবারসমূহের দরিদ্র সন্তানদের জন্য বিষয়টি ছিল দেশান্তরের উপনিবেশসমূহে একধরনের ত্রাণসম ব্যবস্থা। ১৮৫৪ সালে অরওয়েলের ঠাকুরদাদা ডরসেটের মিলবোর্ন সেন্ট অ্যান্ড্রু-এর বিশপের প্রতিনিধি হয়ে ইংল্যান্ডে ফিরে যান। মিলবোর্ন সেন্ট অ্যান্ড্রু দক্ষিণ ইংল্যান্ডের ডরসেট কাউন্টির একটি গ্রাম এবং নাগরিক পল্লী। কাউন্টি শহর ডরচেস্টার থেকে ১৪ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে, ডরসেট ডাউনসের গভীর ঢালে একটি উইন্টারবোর্ন উপত্যকায় এর অবস্থান।

ডরসেটের মিলবোর্ন সেন্ট অ্যান্ড্রু চার্চ

সম্ভবত অরওয়েলের ঠাকুরদাদাই ছিলেন এই পরিবারের শেষ পুরুষ যিনি অভিজাত পৃষ্ঠপোষকতা উপভোগ করেছিলেন। ভাগ্যের পরিহাসে এরপর তার ছেলে রিচার্ড ওয়ালমেসলে ব্লেয়ারকে ১৮ বছর বয়স থেকেই নিজের ভরনপোষণের ব্যবস্থা করতে হয়েছিল। তাই তিনি ‘চাকুরি’ বেছে নিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন বারোজন সন্তানের একজন, ব্যয়সঙ্কোচনের জন্য তিনি বাড়িতে শিক্ষালাভ করেছেন। পাবলিক স্কুল বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ না পাওয়ার ফলে তিনি বিশাল ভারতীয় উপনিবেশের প্রশাসনে পছন্দসই বা কেতাদূরস্ত শাখায় উঠতে পারেননি। সেই পোস্টিং এবং গ্রেডিংয়ের দ্বারা মূল্যায়িত হওয়ার করার ফলেই তিনি হৃতমান আফিম বিভাগে বিশেষ কোনো উন্নতি করতে পারেননি। কতিপয় রুপানির্মিত মনোগ্রাম এবং কয়েকটি আসবাবপত্রের বাইরে কোনো পারিবারিক উত্তরাধিকার ছাড়াই তিনি পেনশনে অবসর গ্রহণ করেন।
সম্ভবত রিচার্ড ব্লেয়ারের জীবনে একমাত্র সৌভাগ্যপূর্ণ ঘটনাটি ছিল তার বিয়ে। তিনি ১৮৯৬ সালে ৩৯ বছর বয়সে ইডা মেবেল লিমুজিনকে বিয়ে করেন। ইডা তখন ২১ বছর বয়সী এক তরুণী। তিনি লন্ডনের কাছে তখনকার এক আধা-গ্রামীণ, নতুন আবাসিক শহরতলী পেঙ্গেতে জন্মগ্রহণ করেন। তার মা ছিলেন ইংরেজ এবং তার বাবা ফরাসী বংশোদ্ভুত। ইডা মেবেল লিমুজিন বার্মার মৌলমেইনে বিয়ের আগ পর্যন্ত অন্য এক রকমের জীবন কাটিয়েছেন। সেখানে তার বাবা ছিলেন একজন সেগুন কাঠ ব্যবসায়ী এবং নৌকা নির্মাতা হিসাবে ব্যবসা পরিচালনা করতেন। কিন্তু পরে তিনি অনেক অর্থ দণ্ড দিয়েছেন। ইডার লিমুজিনের মা ছিলেন শক্তিশালী চরিত্রের এবং যথেষ্ট বুদ্ধিমত্তার অধিকারী একজন নারী। ১৯২২ সালে যখন তার নাতি এরিক আর্থার ব্লেয়ার বার্মায় চাকুরি করতে গিয়েছেন তখনও তিনি বেঁচে ছিলেন। ইডা ব্লেয়ার তার স্বামীর চেয়ে আঠারো বছরের ছোট হলেও ছিলেন আরও প্রাণবন্ত, সবার থেকে একটু আলাদা, ব্যাপকভাবে পড়ুয়া এবং সবদিক থেকে অপেক্ষাকৃত আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারিনী। ইডা লিমুজিন ছিলেন একজন বাস্তববাদী নারী যিনি কঠিন পরিস্থিতিতেও স্থির থাকতে পারতেন, এমনকি আনন্দিত হতেও পারতেন। সেই যুগে শুভবিবাহ অনুষ্ঠানের স্বার্থে বয়স ও মেজাজের অসঙ্গতিগুলিকে মেনে নেওয়া হয়। অনেকেই মনে করতেন অরওয়েলের মা ও বাবা হয়তো কিছুটা অসুখী দম্পতি ছিলেন কিন্তু যদি তাদের দুজনের মধ্যে কোনো একজনকে সেই দিনের ভাষায় জিজ্ঞাসা করা হত, “তারা কি সুখী বিবাহিত দম্পতি ছিল?” তাহলে জবাবটি হত ‘হ্যাঁ’। রিচার্ড স্পষ্টতই একজন সহনশীল এবং সহজ-সরল ধরনের মানুষ ছিলেন।

হেনলি-অন-টেমসের ভিকারেজ রোডের বাড়ি

ইডা ব্লেয়ার তাদের দুই শিশু সন্তানকে ইংল্যান্ডে নিয়ে যান। সেই সময়কালে এমনটি করা খুবই সাধারণ ব্যাপার ছিল। তারা অক্সফোর্ডশায়ারের হেনলি-অন-টেমসের ভিকারেজ রোডের এরমাডেল নামক একটি বাড়িতে অস্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করেন। এরপর ১৯০৫ সালের এপ্রিল মাসে এই বাড়িটি ছেড়ে দেন এবং ‘দ্য নাটশেল’ নামের ওয়েস্টার্ন রোডের সামান্য বড় অন্য একটি ভাড়া বাড়িতে বসবাস করতে থাকেন। রিচার্ড ব্লেয়ার ১৯০৭ সাল পর্যন্ত তাদের আর দেখতে পাননি। ১৯০৭ সালে সাব-ডেপুটি আফিম এজেন্ট (দ্বিতীয় গ্রেড) থেকে সাব-ডেপুটি আফিম এজেন্ট (প্রথম গ্রেড) তার চূড়ান্ত পদোন্নতি উপলক্ষে তিন মাসের ছুটি দেওয়া হয়েছিল। অরওয়েলের ছোট বোন এভ্রিল এসময়েই ইডা ব্লেয়ারের গর্ভে আসেন। এভ্রিলের জন্মের আগে তিনি ভারতের মুঙ্গেরে ফিরে আসেন। এর পর থেকে মোট চার বছর অর্থাৎ অবসর গ্রহণ করা পর্যন্ত তিনি তার পরিবারের সাথে মিলিত হতে পারেননি। এই আয়োজন অসাধারণ কিছু বলে ভাবা হতো না। প্রায় সমস্ত ‘অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান’ (ভারতে বসবাসরত ব্রিটিশরা) ইংল্যান্ডে রেখে তাদের বাচ্চাদের লালন-পালনের সুবিধার্থে এরকম করতো। তখন থেকে ইডা ব্লেয়ার প্রতিদিন একজন ঠিকা ঝিয়ের সহায়তায় সংসারের সব কাজই করতেন। একজন বাবুর্চি বা খাবার পরিবেশনের পরিচারিকাও রাখেননি। এইভাবে বেশিরভাগ কাজ নিজেই করতেন। শেষ পর‌্যন্ত নিজেদের একটি বাড়ি হওয়ার মতো বৃহত্তর স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতেন বলেই তিনি সম্ভবত এমনটি করেছিলেন। এইরকম দীর্ঘ সময়ের বিচ্ছেদ ইডাকে তার স্বামীর চুড়ান্ত অবসরের পর একটি ‘নিজেদের বাড়ী’ তৈরি করতে সক্ষম করেছিল। সম্ভবত অরওয়েলের স্বাস্থ্য নিয়েও নির্দিষ্ট উদ্বেগ ছিল যা মিসেস ব্লেয়ারকে ইংল্যান্ডে বসবাস করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল।
অরওয়েলের শৈশবের বন্ধু জ্যাসিন্থা বুডিকম তার লেখায় রিচার্ড ব্লেয়ারকে বরং একজন নীরস এবং নিস্তেজ ব্যক্তি হিসাবে উপস্থাপন করেছেন। জ্যাসিন্থার বিস্ময়কর আকর্ষক স্মৃতিকথা “এরিক অ্যান্ড আস”(১৯৭৪) গ্রন্থে তখন তার কাছে এরিক ব্লেয়ার নামে পরিচিত অরওয়েলের প্রসঙ্গে লিখেছেন:
“পূর্ববর্তী প্রজন্মের মানুষ এরিকের বাবা রিচার্ড ওয়ালমেসলে ব্লেয়ার (ডাকনাম ছিল ডিক) ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ৭ জানুয়ারী জন্মগ্রহণ করেন … আমাদের শিশুদের কাছে তাকে নিশ্চিতভাবে খুব প্রাচীন এবং সহানুভূতিশীল বলে মনে হতো। তিনি নির্দয় ছিলেন না – তিনি কখনও এরিককে মারেননি – তবে আমি মনে করি, শিশুদের প্রতি তিনি খুব বেশি যত্নশীল ছিলেন না বা তিনি বুঝতে পারতেন না। সর্বোপরি, তিনি পঞ্চাশ বছর বয়স পর্যন্ত খুব কমই নিজের পরিবারকে দেখতে পেয়েছেন। তিনি সর্বদা আমাদের সকলকে তার পথ থেকে দূরে রাখার আশা করতেন, আমরাও তা করতে পেরে আনন্দিত ছিলাম।”
গর্ডন বোকার মন্তব্য করেছেন: “৩৭ বছর চাকরি করার পর ৫৫ বছর বয়সে রিচার্ড ব্লেয়ার বাংলা প্রদেশের আফিম সার্ভিসের সাব-অফিম এজেন্ট শ্রেণী-১ এর পদে উত্থানের পর বছরে মাত্র ৪০০ পাউন্ডের কিছু বেশি পেনশনে অবসর নেন, সম্ভবত বাড়তি কিছু বরাদ্দ এবং একটি পারিবারিক পরিপূরকসহ। ইডা আবার গর্ভবতী না হতে সংকল্পবদ্ধ হয়ে ডিককে তার নিজের ঘরে নির্বাসিত করেন”। রিচার্ড তখন স্থানীয় গলফ ক্লাবের সেক্রেটারি হয়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখেন। বোকার বলেছেন, ”তখন সব সময়ের জন্য অরওয়েল একজন বিষাদময় বয়স্ক ব্যক্তির এটা করবে না, ওটা করবে না – এই ধরনের কথা শোনার মুখোমুখি হতে হয়েছে“। জ্যাসিন্থা বুডিকম মন্তব্য করেছেন : “ব্লেয়ার পরিবার, যদিও অবশ্যই প্রকাশ্যে নয়, তবুও তারা ছিল একটি সংযুক্ত পরিবার এবং তাদের বাড়িটি আমাদের কাছে সুখী বাড়ি বলে মনে হতো। এরিক তার বাবাকে শ্রদ্ধা করত এবং মান্য করত তবে আমি মনে হয়নি যে সে তার বাবাকে পছন্দ করত। কিন্তু সন্দেহ নেই যে সে তার মা এবং বোনদের, বিশেষ করে এভ্রিলের সত্যিকারের অনুরাগী ছিল।”
তারপর ১৯১৭ সালে ৬০ বছর বয়সে রিচার্ড ব্লেয়ার ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সবচেয়ে বয়স্ক সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হয়ে সবাইকে অবাক করে দিলেন। তিনি মার্সেইলের কাছে একটি ক্যাম্প এবং ডিপোতে খচ্চরের দায়িত্বে নিয়োজিত হলেন। কী অসাধারণ! অরওয়েল নিজে একসময় লন্ডন এবং প্যারিসে (১৯২৮-১৯৩১) নিঃস্ব ও ভবঘুরেদের সাথে বসবাস করার জীবন বেছে নিয়েছিলেন, ইংল্যান্ডের উত্তরে দারিদ্র্যের তদন্ত করার সময় কয়লা খনির শ্রমিকের জীবনের গভীরে ডুব দেওয়া (১৯৩৬), স্পেনীয় গৃহযুদ্ধ চলাকালীন রিপাবলিকান মিলিশিয়াদের সহযোদ্ধা হয়ে লড়াই করা এবং শুধুমাত্র মারাত্মকভাবে আহত হয়ে পালিয়ে ফিরে আসা (১৯৩৭), দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (১৯৪৫) শেষ দিনগুলোতে মহাদেশের যুদ্ধক্ষেত্রের প্রথম সারিতে থেকে সংবাদ সংগ্রহ করা এবং তার সদ্য দত্তক নেওয়া ছেলেকে নিয়ে প্রত্যন্ত স্কটিশ দ্বীপ জুরায় ‘সাধারণ জীবন’ যাপন করতে যাওয়া (১৯৪৬-১৯৪৯) প্রভৃতি সবকিছুই সম্ভবত তার পিতার কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছিলেন। ইংরেজ লেখক এল জে হার্স্ট প্রথম বিশ্বযুদ্ধে খচ্চর এবং ঘোড়ার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার উপর জোর দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, “ব্রিটিশ সেনাবাহিনী আবিষ্কার করেছিল যে তাদের প্রতি মাসে প্রায় ১৫,০০০ ঘোড়া কিনতে হয়। গণনা করে দেখা হয়েছে যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর মালিকানাধীন প্রায় অর্ধ মিলিয়ন ঘোড়া নিহত হয়েছিল”। এছাড়াও তার কতিপয় সহকর্মীর পিতাসুলভ যথেষ্ট বয়সে রিচার্ড ব্লেয়ার ‘ভিড়ের মধ্যে দাঁড়াতেন না’ যেহেতু ১৯১৮ সালের নভেম্বরে অশ্ব সরবরাহ বিভাগে কর্মকর্তা এবং পুরুষ মিলিয়ে মোট সংখ্যাটি ছিল ১৮৭৭৬ ।
তবুও অরওয়েল তার বাবার ‘বীরত্ব’ দেখে বিস্মিত এবং বিব্রত হয়েছিলেন। যেমন বার্নার্ড ক্রিক উল্লেখ করেছেন : “ইটন কলেজে এরিকের সমসাময়িক কেউই স্মরণ করে বলতে পারেনি যে তার বাবা সেনাবাহিনীতে ছিলেন। তখন পর্যন্ত তার পরিবার সম্পর্কে কাউকে কিছু বলতেন না। তিনি হয়তো তার বাবার হাস্যকর পদবী ও দায়িত্বের পাশাপিাশি তার বয়সের প্রসঙ্গকেও বিব্রতকর বলে মনে করতেন। অরওয়েলের “কামিং আপ ফর এয়ার (১৯৩৯) উপন্যাসের জর্জ বোলিং চরিত্রটি যখন সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হন, তখন তাকে সুদূর কর্নওয়ালের উত্তর উপকূলে একটি বিস্মৃত সামরিক রসদখানায় এগারো টিন ষাঁড়ের মাংস পাহারা দেওয়ার জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।”
১৯৩৯ সালের জুনে অরওয়েলের পিতা যখন মৃত্যুশয্যায়, তখন তিনি সাউথওল্ডের বাড়িতে তার সাথে দেখা করতে যান। ঠিক তখনই সানডে টাইমস পত্রিকায় “কামিং আপ ফর এয়ার” -এর একটি বিস্ময়কর পর্যালোচনা ছাপা হয়। সিলভিয়া টপ উল্লেখ করেছেন কিভাবে এভ্রিল রিচার্ড ব্লেয়ারের বেডরুমে পর্যালোচনাটি নিয়ে গিয়ে তাকে পড়ে শোনান। ‘একটু পরে তিনি শেষবারের মতো জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন’। অরওয়েল তার বাবার চোখ বন্ধ করে চিরাচরিত প্রথা অনুসারে চোখের পাতায় ব্রিটিশ মুদ্রা পেনি রাখেন এবং পরে সমুদ্রে নেমে সেগুলোকে ছুঁড়ে ফেলেন।
অরওয়েলের মা ইডা মেবেল ব্লেয়ার ১৯৪৩ সালের ১৯ মার্চ ৬৭ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।

তথ্যসূত্র :
`George Orwell: A Life’, By Bernard Crick (1992). Harmondsworth, Middlesex: Penguin, second edition.
George Orwell and Religion, by Michael G. Brennan. Bloomsbury Academic.
`George Orwell’, By Gordon Bowker, London: Abacus.
Women of the Raj: The Mothers, Wives, and Daughters of the British Empire in India, By Margaret MacMillan.

‘Orwell and the Appeal of Opium’ By Darcy Moore (2018). George Orwell Studies, Vol. 3, No.1, Bury St. Edmunds: Abramis Academic.

A Guide to Naini Tal and Kumaun, By C.W. Murphy, (1906) Allahabad, Pioneer Press.

Facing Unpleasant Facts: 1937–1939, George Orwell. The Complete Works of George Orwell – Volume 11, Secker & Warburg.

Fugitive from the Camp of Victory, By Richard Rees. (1961) London: Secker & Warburg.

Thacker, Spink and Co. (1897) Thacker”s Indian Directory, East India Company.

S. Guha, Environment and Ethnicity in India, 1200-1991 2006.
Mike Davis, 2001. Late Victorian Holocausts: El Nino Famines and the Making of the Third World. Verso, London.

Facebook Comments

comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top