জুলাই ১
কিংবদন্তি ‘সন্ত্রাসী‘
২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার তার বিপদজনক সন্ত্রাসীর তালিকা থেকে নেলসন ম্যান্ডেলার নাম মুছে ফেলে!
বিশ্বব্যাপী সম্মানিত এই প্রণম্য আফ্রিকান সুদীর্ঘ ষাট বছর ধরে আমেরিকার কাছে ভয়ংকর সন্ত্রাসী হিসেবে ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ ছিলেন!
সেই সময় বিশ্ববাসীর কাছেও তিনি ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ – অতুল ভালোবাসায়, আর পরম শ্রদ্ধায়!
জুলাই ২
সেকেলে অলিম্পিক
১৯০৪ সালে আমেরিকার সেইন্ট লুইস অলিম্পিকে অভিনব আর অদ্ভুত এক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। ‘নৃতাত্ত্বিক পর্ব‘ নাম দিয়ে পৃথিবীর নানা আদিবাসী সম্প্রদায়ের লোকজন নিয়ে হাস্যকরসব ইভেন্ট খুলে বসেন তাঁরা। বিশেষ এই ইভেন্টে দেখা যায় আমেরিকার রেড ইন্ডিয়ান, জাপানি আইনু, আফ্রিকান পিগমি জুলুসহ বিচিত্রসব নৃতাত্ত্বিক মানুষ। তাঁদেরকে অলিম্পিকের মূল পর্বে অংশ নিতে দেয়া হয়নি।
যদিও বিশেষ বিবেচনায় দুই আফ্রিকান জুলু ম্যারাথন দৌড়ে অংশ নেন। দৌড়ে একজন পঞ্চম, অন্যজন দ্বাদশ স্থান লাভ করেন। প্রথম হন শ্বেতাঙ্গ পুরুষ – ‘ফ্রেড লর্জ’। পরে জানা যায়, অর্ধেক পথ তিনি তাঁর বন্ধুর গাড়িতে পার হয়েছেন!
ড্রাগ-ডোপামিন প্রভৃতি রাসায়নিক জোচ্চুরি ছাড়া এটাই শেষ অলিম্পিক!
এরপর অলিম্পিক আধুনিক স্মার্ট হয়ে ওঠে। প্রতিযোগীরা এখন আর শারীরিক শক্তি সক্ষমতা দিয়ে জয়লাভ করে না, তাঁদের শরীর জুড়ে শক্তি যোগায় রাজ্যেরসব রাসায়নিক বলবর্ধক দাওয়াই!
জুলাই ৩
গলফ-দখল
গলফ নিষিদ্ধ হওয়ার তিন মাস পরেও স্কটিশরা ধুন্ধুমার নির্বিকার খেলে বেড়াচ্ছে তাঁদের অতিপ্রিয় এই খেলা।
রাজা দ্বিতীয় জেমসের ১৪৫৭ সালের ‘গলফ নিষেধাজ্ঞা‘ কেউ আমলেই নিচ্ছে না! নিষেধাজ্ঞায় বার বার বলা হয়েছে – ‘তরুণদের উচিত জাতীয় প্রতিরক্ষায় কাজে লাগে এমন খেলা ও শরীরচর্চায় আত্মনিয়োগ করা। তাঁরা এখন তীরন্দাজি করবে, অস্ত্র চালনা, ঘোড়দৌঁড় প্রভৃতি শিখবে। এসব না-করে ক্ষুদে একটি বল নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় নষ্ট করা জাতীয় সম্পদ অপচয় বলে গণ্য হবে। তাই এই খেলা আজ থেকে নিষিদ্ধ।‘
কিন্তু বহু আগে, এই স্কটল্যান্ডের সবুজ বিস্তীর্ণ প্রান্তরে গলফের জন্ম হয় রাখালদের হাতে। একঘেঁয়ে ক্লান্তিকর পশুপালনের ফাঁকে ফাঁকে তাঁরা এই অদ্ভুত খেলা আবিস্কার করে – খরগোশের ছোট্ট গর্তে পাথর গড়িয়ে ফেলার অভিনব খেলা!
স্কটল্যান্ডে এখনো আছে বিশ্বের সবথেকে পুরনো দুই দুইটি গলফ মাঠ। এ-মাঠ সকলের জন্য উন্মুক্ত, চাইলে যে-কেউ নামমাত্র মূল্যে এখানে গলফ খেলতে পারে।
কিন্তু বিশ্বজুড়ে এই খেলার চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। দুনিয়ার তাবৎ গলফ মাঠ কতিপয় হোমরাচোমরা আর সেনা বাহাদুরের হাতে জিম্মি! জনসাধারণের ন্যায্য হক তাঁরা ছিনিয়ে নিয়েছে!
জুলাই ৪
দক্ষিণের নক্ষত্রমণ্ডল
১৭৯৯ সালের এই দিন রাতে অন্তহীন সাগরের বুকে ভাসতে ভাসতে আলেকজান্ডার ফন হুমবোল্ট এবং এইমে বঁপলান সাউদার্ন ক্রস বা ত্রিশঙ্কু নক্ষত্রমণ্ডল আবিস্কার করেন। এই নক্ষত্রমণ্ডল লাতিন আমেরিকা যাওয়ার পথ বাতলে দেয়৷ সেই পথ ধরে তাঁরা আমেরিকায় এসে পৌঁছয়৷
হুমবোল্ট এবং বঁপলান আমেরিকার সম্পদ শোষণ করতে আসেননি৷ তাঁরা আসেন প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা করতে, সম্প্রীতি গড়ে তুলতে৷ এই বিজ্ঞানী অভিযাত্রীদ্বয় মানুষকে দেখিয়েছেন নিজস্ব সত্তা, চিনিয়েছেন প্রকৃতির অফুরন্ত সম্পদ৷
বছরের পর বছর পর্যটন আর গবেষণা শেষে, দক্ষিণ আমেরিকার বন্দর থেকে হুমবোল্ট ফিরে যান ইউরোপে৷ আর বঁপলান আমেরিকা ভালোবেসে থেকে যান সেখানেই৷ আপন করে নেন দেশটির মানুষ প্রকৃতি ও উদ্ভিদ জগত৷ স্থানীয় জনতাও তাঁকে গ্রহণ করে নিবিড় মমতায়, ভালোবেসে নাম দেয় ‘দন আমাদো’ বলে৷
দন আমাদো সেখানে হাজার হাজার উদ্ভিদের নতুন প্রজাতি খুঁজে বের করে সযত্নে শ্রেণীবিন্যস্ত করেন৷ সেই সাথে অসংখ্য ঐতিহ্যবাহী ভেষজ উদ্ভিদ পরম মমতায় সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করেন৷ গড়ে তোলেন সবার জন্য সহজলভ্য ভেষজ ফার্মেসি৷ জীবনভর তিনি শিখিয়েছেন প্রকৃতিকে ভালবাসতে, প্রতিবেশীকে ভালোবাসতে৷
জুলাই ৫
প্রাণখুলে হাসুন
বাইবেলে আছে রাজা সোলেমান হাসিঠাট্টা খুব একটা পছন্দ করতেন না। তাঁর মতে, বদ্ধ উন্মাদই কেবল রঙ্গ তামাশায় জীবন পার করে দেয়। জীবনে এসবের মানে তিনি বুঝতে পারতেন না!
আবার সহি কিতাবে আছে, যীশুখ্রিষ্ট কখনোই হাসিতামাশা করেননি।
পুণ্যাত্মা ব্যক্তির হাসির জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে অনেক বছর। অবশেষে তা দেখা যায়, ১১৮২ খ্রিষ্টাব্দের এইদিনে। সেইন্ট ফ্রান্সিস ডি আসিসি এইদিন জন্মেই কান্নার বদলে হেসেছেন নির্মল। জীবনভর তিনি শিষ্যদের শিখিয়েছেন – ‘তোমরা গোমড়ামুখে থাকবে না, রাগ ক্ষোভ বিদ্বেষ ভুলে সবসময় প্রাণ খুলে হাসবে – হেসে পবিত্র হবে!’
জুলাই ৬
নির্মল বিস্ময়
১৮১০ সালের এই দিনে কানেকটিকাটের একটি গীর্জায় ফিনিয়াস বার্নামের ব্যাপ্টিজম হয়৷
জগতের বিখ্যাত ও জনপ্রিয়তম সার্কাসদল গঠন করার নিয়তি নিয়ে এই শিশু বড় হতে থাকে৷ তাঁর প্রতিষ্ঠিত বার্নাম এন্ড বেইলি সার্কাস পৃথিবীর বিরল নমুনা সমূহের এক অসামান্য জাদুঘর, যা লক্ষ লক্ষ মানুষকে মুগ্ধ করেছে, বিমোহিত করেছে৷
বিস্মিত মানুষ সশ্রদ্ধ কুর্নিশ করেছে ১৬১ বছরের জীবন্ত কিংবদন্তি ক্রীতদাস এক অন্ধ নারীর প্রতি, যিনি শিশু জর্জ ওয়াশিংটনকে স্তন্যদান করেছেন৷ উৎফুল্ল মানুষ আবেগে চুম্বন করেছে পঁচিশ ইঞ্চি উচ্চতার নিজস্ব নেপোলিয়নকে৷ অবাক জনতা বিস্ফারিত চোখে দেখেছে থাই যমজভ্রাতা চ্যাং এবং এয়াং এর অভিন্ন একক শরীর৷ তাঁরা আরও দেখেছে মৎস্যকন্যার ফিনফিনে পাখনা ও লেজ৷
পৃথিবীর ঝানু রাজনীতিবিদগণ বার্নামকে অন্য সবার থেকে বেশি ঈর্ষা করে৷ কেননা, বার্নাম তাঁর আবিষ্কৃত তত্ত্ব দিয়ে মানুষকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতে পেরেছে৷ তাঁর মন্ত্রমুগ্ধ করা সরল তত্ত্ব – ‘ মানুষ বিস্ময়ে বোকা হতে ভালোবাসে!’
জুলাই ৭
ফ্রিদাম্যানিয়া
১৯৫৪ সালে মেক্সিকো সিটির একদল সমাজতান্ত্রিক মানুষ রাজপথে বিক্ষোভ করতে করতে চলে যায়৷ প্রতিবাদী সেই শোভাযাত্রায় অংশ নিয়েছিলেন ফ্রিদা কাহলো, হুইল চেয়ারে বসে৷ জনসমক্ষে সেই তাঁর শেষ উপস্থিতি৷ এই সমাবেশের অব্যবহিত পরেই তাঁর নীরব আলোড়নহীন মৃত্যু হয়৷
কিন্তু কয়েক বছর পরই প্লাবনের মতো ছড়িয়ে পড়ে ‘ফ্রিদাম্যানিয়া’র জোয়ার৷ এটা কি শুধুই সুন্দরকে জাগিয়ে তোলা নাকি বাজার বৃদ্ধির অভিনব কৌশল? যিনি প্রচলিত সাফল্যকে ঘৃণা করতেন, তুলতুলে সর্বাঙ্গ সুন্দরকে অপছন্দ করতেন; তিনি কি এই বিপুল জাগরণ সহজে মেনে নিতেন? যে-শিল্পী নির্দয় আত্মপ্রতিকৃতি আঁকতে পারেন – জোড়া ভ্রু আর গোঁফে ঢাকতে পারেন কমনীয় সৌন্দর্য – যার শরীরে অস্ত্রোপচারের অসংখ্য চিহ্ন ফুটে আছে – তিনি কি এই জোয়ারের ভালোবাসা নিতে পারতেন সহজ আন্তরিকতায়?
স্থুল ব্যবসায়িক লোভ নয়, গড্ডলিকা সমাদর নয়; দুঃখ যাতনাকে যে-নারী অনিন্দ্য সুন্দর শিল্পে পরিণত করেছে, তাঁকে আজ সত্যিকারে ভালোবাসার সময় এসেছে৷
জুলাই ৮
চিরজীবনের নেতা
১৯৯৪ সালে অমর এই ব্যক্তির মৃত্যু হয়৷ মৃত্যুর পরও তিনি বেঁচে আছেন সগর্বে অবিস্মৃত!
উত্তর কোরিয়ার সংবিধান অনুযায়ী কিম ইল সুং মানবতার নতুন যুগের প্রথম দিনে জন্মগ্রহণ করেন, আর তিনিই এই জাতির প্রেরিত উদ্ধারকর্তা অবিসংবাদিত নেতা৷ তাঁর প্রবর্তিত স্বর্ণালী যুগ এখনো চলমান, সেই সাথে চলমান তাঁর প্রত্যক্ষ শাসন!
দেশের সর্বোচ্চ স্থাপত্য নিজের ভাস্কর্যের সিংহাসনে বসে আজও তিনি দেশ শাসন করছেন দৃঢ় হস্তে৷
জুলাই ৯
জাদুর আঙ্গুল
১৯০৯ সালের পূর্ব ব্রাজিলে ভিতালিনো জন্মগ্রহণ করেন৷
শুষ্ক ঊষর পৃথিবী মাটির পুত্তলিকা জন্ম দেবে বলে সিক্ত হয়ে ওঠে৷ শৈশবে তার হাতে গড়া এইসব মাটির পুতুল তাকে সঙ্গ দিত বন্ধুর মতো৷ সময়ের আবর্তে এই খেলনা পুতুল হয়ে ওঠে বাঘের অনিন্দ্যসুন্দর ছোট্ট ভাস্কর্য৷ হয়ে ওঠে শিকারি, গাইতি হাতে শ্রমিক, মরুভূমির দুর্ধর্ষ যোদ্ধা ছুটে চলে বন্দুক হাতে, জলের সন্ধানে ছুটে চলা ক্যারাভান, গিটারবাদক, নর্তকি, প্রেমিকা, শোভাযাত্রার বিচিত্র মানুষ, পাদ্রি মশাই…
এভাবেই ভিতালিনোর জাদুর আঙ্গুল বলে চলে জনপদের শোকগাথা আর উৎসবের পদাবলী৷
জুলাই ১০
উপন্যাস উৎপাদন
১৮৪৪ সালের অভিশপ্ত এই দিন থেকে ফরাসি পাঠকদের পড়ার মতো আর কিছু থাকলো না৷ এই দিন ‘লো সিয়েক্লো’ পত্রিকা ব্যাপক জনপ্রিয় রোমাঞ্চ উপন্যাসের শেষ কিস্তি ছাপে৷ এমন উপন্যাস শেষ হয়ে গেল? এরপর? পাঠক এখন কী পড়বে?
“থ্রি মাস্কেটিয়ার্স”-এর উজ্জীবনী শক্তি ছাড়া কে আর রানীর সম্মানার্থে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বেরিয়ে পড়বে?
আলেক্সান্ডার দ্যুমা এই উপন্যাসের লেখক৷ এছাড়াও প্রায় তিন শতাধিক বই লিখেছেন তিনি তাঁর ৬৮ বছরের জীবনে৷ সেই হিসেবে প্রতিদিন গড়ে ছয় হাজার শব্দ লিখতে হতো৷ দুর্মুখ সমালোচকেরা অভিযোগ করে, দ্যুমা অন্যের অজস্র লেখা নিজের নামে চালিয়ে দিয়েছে৷ তাছাড়া স্বল্প পারিশ্রমিকে বহু নকলনবিশ লেখককে দিয়ে বিস্তর লেখা তিনি লিখিয়ে নিয়েছেন৷ তাঁর বহু বিশ্রুত ভোজনবিলাসের প্রয়োজনীয় অর্থ তিনি এই উৎপাদিত উপন্যাসের স্বত্ব থেকে জোগাড় করতেন৷
ফরাসি সরকার একটি উপন্যাস লেখার জন্য তাঁকে বিপুল অর্থের জোগান দেয়৷ উরুগুয়ের বন্দরনগরীর উপনিবেশিক দুর্গ রক্ষার বীরত্বব্যঞ্জক কল্পিত এক কাহিনী কেন্দ্র করে তিনি লেখেন ‘মন্টেভিডিও অর দ্য নিউ ট্রয়’৷ স্থানীয় আদিবাসীদের প্রতিহত করার মাধ্যমে ফরাসি প্রতিপত্তি তুলে ধরার অসামান্য আখ্যান রচনা করেন তিনি এর মধ্যে দিয়ে৷ আর এই উপন্যাস লিখতে গিয়ে নগ্নপদের সেইসব আদিবাসীদের তিনি বর্ণনা করেন,”সভ্যতার পথে বর্বর বন্য বাধা” বলে৷
জুলাই ১১
অশ্রু উৎপাদন
১৯৪১ সালে দেশের প্রথম রেডিও অপেরা শো শুরু হলে ব্রাজিলজুড়ে কান্নার রোল পড়ে যায়৷
কোলগেট টুথপেস্ট নিবেদিত..
“সুখের খোঁজে”
বেজে উঠলেই মানুষ সব কাজ ভুলে যায়৷ সব ফেলে জড়ো হয় রেডিও’র চারপাশ৷
ধারাবাহিক এই কাহিনীর মূল উৎস কিউবার লোকগাথা৷ কিন্তু রেডিওতে প্রচার হয় ব্রাজিলীয় উপাদান অনুষঙ্গ মিশিয়ে৷ প্রতিটি আখ্যানের নায়ক প্রভূত অর্থ সম্পদের মালিক প্রচণ্ড ক্ষমতাধর; কিন্তু প্রত্যেকেই কোনো-না-কোনো ভাবে দুর্ভাগ্যের শিকার৷ ট্রাজিক নায়কের এই কাহিনী জমে ওঠে প্রতি এপিসোডে৷ এভাবে তিন বছর ধরে টানা চলতে থাকে “সুখের খোঁজে” রেডিও নাটক৷
দূরের প্রত্যন্ত কোনো কোনো গ্রামে হয়তো রেডিও নেই! কিন্তু তাতে কী হয়েছে! প্রত্যেক গ্রামে অতি উৎসাহী কেউ-না-কেউ থাকেই, যিনি ঘোড়া ছুটিয়ে দূর গ্রামে চলে যান এই অনুষ্ঠান শুনতে৷ গভীর একাগ্রতায় অনুষ্ঠান শুনে স্মৃতির কোষে গল্পমালা সাজিয়ে তিনি বাড়ি ফেরেন৷
বাড়িতে অপেক্ষা করছে গাঁয়ের সমস্ত লোক৷ তিনি এসেই শুরু করেন কাহিনীর পুনঃপ্রচার! মূল গল্পের থেকে দীর্ঘ আর রসালো হয় পুনঃকথন৷ বিত্তশালী ধনীদের দুর্দশা শুনে তাঁদের চোখ ছলছল করে ওঠে, বিপর্যস্ত নায়কের জন্য তাঁদের দয়া জেগে উঠে৷
ধনীদের দয়া করে কী যে আনন্দ, তা তাঁরা কিভাবে বোঝাবে!
জুলাই ১২
সেরা গোলদাতার অভিষেক
১৯৪৯ সালের ইতালিয়ান ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে সর্বোচ্চ গোলদাতার খেতাব জেতেন জাম্পিয়েরো বনিপেরতি৷ তখন তিনি কিংবদন্তি তারকা ফুটবলার৷
লোকে বলে, তাঁর জন্ম হয়েছে উল্টো দিকে – পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে তিনি পৃথিবীতে আসেন, আর দোলনায় শুয়ে ফুটবল খেলতে শেখেন৷
তাঁর ক্লাব জুভেন্টাস প্রতি গোলের জন্য তাঁকে একটি করে গাভী উপহার দেয়৷
“Altri tempi” “আহা! সেইসব দিন!”
জুলাই ১৩
শতাব্দীর সেরা গোল
২০০২ সালের এই দিনে, ফুটবলের বিশ্বকর্তাগণ “শতাব্দীর সেরা গোল” নির্বাচনের ফল ঘোষণা করেন৷
বিপুল ভোটে জিতে যায় দিয়েগো ম্যারাডোনার ৮৬’ বিশ্বকাপের সেই বিখ্যাত গোল৷ বল নিয়ে অপ্রতিহত ছুটে চলছেন আর্জেন্টিনার কিংবদন্তি অধিনায়ক৷ ছয় ছয় জন তুখোর ব্রিটিশ খেলোয়ারকে মন্ত্র বলে পাশ কাটিয়ে উড়ে চলছেন ফুটবলের জাদুকর৷ সামনেই প্রসারিত গোলপোস্ট! পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়ে আছেন পিটার শিলটন! আর একটা পাস! ঐ তো জেগে উঠলো ম্যারাডোনার অপার্থিব পা! আর গো-ও-ও-ল!!
আর এই অবিস্মরণীয় দৃশ্য ম্যানুয়েল এলবা অলিভারেসের শেষ জাগতিক দৃশ্যস্মৃতি৷ স্মরণীয় সেই খেলা শেষে এগারো বছর বয়সে অলিভারেস চিরতরে অন্ধ হয়ে যান৷ কিন্তু সেই অবিশ্বাস্য গোলের দীপ্তি চোখে লেগে আছে এখনো৷ সেই অনবদ্য মুহূর্তের উজ্জ্বল বর্ণনা বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ধারাভাষ্যকেও ম্লান করে দেয়৷
ম্যারাডোনার দীপ্তিময় নৈপুণ্য দেখার পর জগতের আর কোনো খেলা বা মোহন দৃশ্য দেখতে তাঁর সাধ জাগেনি৷
জুলাই ১৪
স্বপ্নের মায়াবী সিন্দুক
হেলেনা ভিলাগ্রা স্বপ্নে দেখলেন, তিনি এক সুবিশাল জাদুর সিন্দুক খুঁজে পেয়েছেন৷
সুপ্রাচীন মায়াবী চাবি দিয়ে সিন্দুক খুলতেই একে একে বেরিয়ে এলো লজ্জায় মোড়া একগুচ্ছ পরাজয়, ভুল শট, ব্যর্থ পেনাল্টি! কিন্তু কী আশ্চর্য!! সেইসব ভুল শট নিমিষেই হয়ে উঠল অব্যর্থ সফল, পেনাল্টির তীব্র বল সতেজ কাঁপিয়ে দিলো গোলপোস্টের জাল, আর ব্যর্থ মনোরথ পরাজিত দলের মুখে ফুটে উঠলো অম্লান হাসি, বিজয়ের উল্লাস!!
স্বপ্নরাজ্যে এসে, মানুষ ভুলে থাকে তার পরাজয়ের বেদনা, ভুলের দুঃসহ স্মৃতি!
জুলাই ১৫
নিয়তির অভিশাপ
১৯৫০ সালের এই রাতে, বিশ্বকাপ ফাইনালের প্রাক্কালে, মোয়াসির বারবোসা স্বর্গীয় দেবদূতের নিরাপদ আশ্রয়ে নিবিড় ঘুমিয়েছেন।
বারবোসা ব্রাজিলের কিংবদন্তি নায়ক, প্রিয়তম খেলোয়াড়৷ কিন্তু পরদিন, জগতের এই শ্রেষ্ঠ গোলরক্ষক হয়ে ওঠেন ব্রাজিলের ঘৃণ্য চরিত্র, অদ্বিতীয় বিশ্বাসঘাতক৷ তাঁর কারণেই প্রায় জিতে-যাওয়া খেলায় ব্রাজিল উরুগুয়ের কাছে হেরে যায়৷ দুই দুইবার তাঁর জালে বল আসলে তিনি ছিলেন উদাসীন, অনড়!
তেরো বছর পর, মারাকানা স্টেডিয়ামে নতুন গোলপোস্ট বসলে, বারবোসা অপয়া পুরোনো গোলপোস্ট এবং ক্রসবার বাড়ী নিয়ে আসেন তীব্র মনঃযাতনায়। প্রচণ্ড আক্রোশে কুড়াল দিয়ে টুকরো টুকরো করে পুড়িয়ে ভস্ম করে দেন দুঃসহ এই স্মৃতিরস্মারক৷
বারবোসা তবুও অভিশাপমুক্ত হতে পারেননি!
জুলাই ১৬
শত্রু তুমি বন্ধু তুমি
ব্রাজিল ফুটবল দলের আদি জার্সির রং ছিল সাদা৷ কিন্তু ১৯৫০ সালের বিশ্বকাপে দেখা গেল সাদা রং তাদের জন্য ভীষণ অপয়া৷ সেই থেকে সাদা আর কখনোই গায়ে ওঠেনি৷
বিশ্বকাপের চূড়ান্তপর্ব সদ্যই শেষ হয়েছে, চ্যাম্পিয়ন উরুগুয়ে বিজয়োল্লাস করছে৷ কিন্তু স্টেডিয়াম নীরব নিথর৷ দুই লক্ষ ব্রাজিলিয়ান সমর্থক সেদিন শোকে স্তব্ধ, নিঃসার পাথর হয়ে আছে৷ মাঠে কয়েকজন ব্রাজিলিয়ান খেলোয়াড় তখনো ভূতগ্রস্থ হয়ে ঘুরে ফিরছে৷ উল্লাস করছে পাশে উরুগুয়ের গোটা দল৷ হঠাৎ মুখোমুখি দুই খেলোয়াড়: উরুগুয়ের অধিনায়ক ‘অবদুলিও’ আর ব্রাজিলের মিডফিল্ডার ‘জিজিনহো’৷
তাঁদের মধ্যে বিস্তর অমিল: একজন বিজয়ী অন্যজন বিজিত৷ একজনের গঠন সুদৃঢ় ইস্পাতে অন্যজন তৈরি কম্পিত সংগীতে৷ দুজনের সাদৃশ্যও কম নয়৷ পুরো টুর্নামেন্ট দুজনেই খেলেছেন শরীরে অসংখ্য আঘাত নিয়ে, একজনের ভাঙ্গা গোড়ালি তো অন্যজনের স্ফীত হাঁটু; তবুও কারও মুখে কোনো অভিযোগ নেই!
দুজন দাঁড়ালেন মুখোমুখি, চোখে চোখ রাখলেন মুহূর্তের জন্য৷
অনেকদিন পর আমি অবদুলিও কে জিজ্ঞেস করি, ‘জিজিনহোর সাথে আর কখনো দেখা হয়েছে?’ ‘নিশ্চয়ই! চোখ বন্ধ করলেই আমরা একজন আরেকজনকে দেখতে পাই!’, বললেন অধিনায়ক অবদুলিও৷
জুলাই ১৭
আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার দিবস
রানী বলল, ‘ রাজার দূতকে বন্দী করা হয়েছে। ইতিমধ্যে শাস্তিও শুরু হয়েছে যথারীতি। তার অপরাধ খুঁজে দেখার সময় কই? আগামী বুধবারের আগে বিচারসভা বসার কোনো সম্ভাবনাই নাই।’
শুনে অ্যালিস বলল, ‘ মনে তো হচ্ছে সে কোনো অপরাধ করেনি!’
— অ্যালিস থ্রু দ্য লুকিং গ্লাসের অংশবিশেষ। অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড, লুইস ক্যারল, ১৮৭২।
জুলাই ১৮
ইচ্ছেপূরণ
ইফিসাস নগরীতে দেবী আর্টিমিসের মন্দির তৈরি করতে সুদীর্ঘ একশো কুড়ি বছর সময় লাগে৷ কালে এই মন্দির জগতের আশ্চর্য স্থাপনার স্বীকৃতি পায়।খ্রিস্টপূর্ব ৩৫৬ অব্দে, এক অভিশপ্ত রাতে এই মন্দির জ্বালিয়ে ভষ্ম করে দেওয়া হয়৷ কেউ জানে না কে বা কারা এই মন্দির তৈরি করেছিল৷ কিন্তু যে একে জ্বালিয়ে ভস্ম করে দিয়েছে, তাকে মানুষ ভালো করেই চেনে।
দুর্বৃত্ত অগ্নিবাজ হেরোস্ট্রেটাসে ইতিহাসে জায়গা করে নিতে চেয়েছিল৷ তাঁর মনস্কামনা পূর্ণ হয়েছে – মানুষের ঘৃণায় ধিক্কারে।
জুলাই ১৯
সৈকতের স্মৃতি
১৮১০ সালে রানী মারিয়ার পুত্র যুবরাজ ‘রিজেন্ট জোয়াও’ ডাক্তারের পরামর্শে বায়ু পরিবর্তনের জন্য রিও ডি জেনেরিও’র সমুদ্র সৈকতে আসেন৷ লম্বা জুতা পরে আর শরীরে শূন্য ব্যারেল জড়িয়ে তিনি সমুদ্রের পানিতে নামেন৷
কাকড়া ও সমুদ্রের ঢেউ-এ তার সাংঘাতিক ভীতি! তাই এই বাড়তি সতর্কতা!
যুবরাজের এই অদ্ভুত রীতি রিও-তে কেউ অনুসরণ করেনি৷
জঘন্য নোংরা এই সৈকতে ক্রীতদাস ছাড়া কেউ খুব একটা আসতোই না৷ তারাও আসতো শুধু রাত্রে, প্রভুর প্রভূত আবর্জনা ফেলতে৷
বিংশ শতাব্দীতে এসে সৈকত আবর্জনা মুক্ত হয়, মানুষের ঢল নামে পরিচ্ছন্ন সাগর তীরে৷ কিন্তু একটা নির্দেশনা মানতে হয় সবাইকে৷ সৈকতে এসে নারী-পুরুষের নিরাপদ দূরত্বের নিশ্চয়তা দিতে হয় সবার আগে! শালীনতার নিয়ম এখানে বড় কড়া, তাই অবশ্যমান্য! আজ নগ্নতার স্বর্গরাজ্য যে সৈকত, সেখানে হাঁটু পর্যন্ত পোশাক পরে পুরুষ পানিতে নামতো৷ আর ফ্যাকাসে রমনীরা নিজেদের আপাদমস্তক ঢেকে রাখতো সর্বক্ষণ! তাদের ভয়, সূর্যের আলোয় ত্বক পুড়ে কালোদের মতো হয়ে যাবে!
জুলাই ২০
অনাহুত
১৯৫০ সালে ‘লাইফ ম্যাগাজিন’-এ ছাপা একটি ছবি নিয়ে শিল্পজগতে ব্যাপক আলোড়ন শুরু হয়ে যায়।
নিউইয়র্কের নিরীক্ষাধর্মী বিখ্যাতসব চিত্রশিল্পী প্রথমবারের মতো একত্রিত হন। মার্ক রথকো, জ্যাকসন পোলক, উইলহেম দ্য কুনিয়ের মতো বিমূর্ত চিত্রকলার পনেরজন রথি-মহারথির সম্মিলিত এই ফটোগ্রাফ শিল্পাঙ্গনে সত্যিই সাড়া ফেলে দেয়।
ফটোগ্রাফে পনেরজন পুরুষের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে এক নারী। ছোট্ট টুপি মাথায়, ব্যাগ হাতে কালো পোশাকের এই নারীকে কেউ-ই তাঁদের মধ্যে মানতে পারছে না। কেউ একজন অনাহুত এই নারীর ব্যাজস্তুতি করে বলছে, ‘ আহা, থাকুক না। উনি তো পুরুষের মতোই ছবি আঁকেন!’
এই নারী প্রখ্যাত স্যুরিয়ালিস্ট শিল্পী ‘হেডা স্টার্ন’ ।
জুলাই ২১
অগোচরের নভোচারী
১৯৬৯ সালের এই দিনে দুনিয়ার তাবৎ সংবাদপত্র শতাব্দীর উত্তুঙ্গ সফলতার এক ছবি ছাপে অবাক বিস্ময়ে।
ছবিতে দেখা যায় – অভিনব পোশাকে এক নভোচারী শ্লথগতিতে এগিয়ে যাচ্ছেন, আর পেছনে চাঁদের বুকে পড়ে আছে অসম্ভবের পদচিহ্ন – মানবের শ্রেষ্ঠ অর্জন। আমরা জেনে যাই চন্দ্রবিজয় আর তার নায়কদের নাম – এডউইন অলড্রিন, নীল আর্মস্ট্রং, ও মাইকেল কলিন্স।
কিন্তু মানবের এই শ্রেষ্ঠকীর্তির প্রকৃত নায়কের নাম আমরা প্রায় জানিই না। তিনি ওয়ার্নার ভন ব্রায়ান! এপোলো এগারোর মূল নকশাবিদ ও সার্বিক উড্ডয়ন পরিচালক।
ওয়ার্নার ভন আমেরিকার হয়ে চন্দ্রবিজয়ের পূর্বে জার্মানির হয়ে ইউরোপ বিজয়ে নেমেছিলেন। নাৎসি এস.এস ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে তিনি হিটলারের ভীষণ প্রিয় ছিলেন! কিন্তু যুদ্ধ শেষেই তিনি দুনিয়ার বিপরীত পৃষ্ঠে পা রাখেন আর মানব জাতিকে সাহায্য করেন চন্দ্রপৃষ্ঠে পা রাখতে!
জুলাই ২২
গ্রিক চন্দ্রাভিযান
চাঁদের বুকে নাসার নভোচারীরাই প্রথম পদার্পণ করেননি!
প্রায় দুই হাজার বছর আগে ‘লুসিয়ান অফ সামোসাতা‘ চন্দ্রাভিযান সম্পন্ন করেন! যদিও চাঁদে তাঁর হেঁটে বেড়ানোর ছবি টেলিভিশনে কেউ দেখেনি, সংবাদপত্রে পদচিহ্নসহ ছবি ছাপা হয়নি, আর এই অসম্ভব অভিযান কেউ বিশ্বাসও করেনি! তবুও লুসিয়ান তাঁর চন্দ্রবিজয়ের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ লিখে যান গ্রিক ভাষায়।
সেই ১৫০ খ্রিস্টাব্দে লুসিয়ান ও তাঁর সহনাবিকেরা চাঁদের উদ্দেশে জিব্রাল্টার প্রণালীর পিলার্স অফ হারকিউলিস থেকে যাত্রা শুরু করেন। প্রচণ্ড ঝড় জলোচ্ছ্বাসে তাঁদের জাহাজ ঢেউয়ের মাথায় ভাসতে থাকে। ঘূর্ণিব্যাত্যায় জাহাজ এক সময় শূন্যে উঠে পড়ে, অসীম অন্তরীক্ষে প্রচণ্ড বাতাসে ভাসতে ভাসতে জাহাজ গিয়ে আছড়ে পড়ে চাঁদের গায়ে!
চাঁদের বুকে তাঁদের কারও রহস্যময় মৃত্যু হয়নি কোনো অসুবিধাও হয়নি। তাঁরা সেখানে থকথকে ধূম্র আর মিষ্টি-দেয়া দুধ পান করতেন। ধনীরা কাচে মোড়া পোশাক পড়তেন, গরিবদের পোশাক থাকতো না বললেই চলে।চারপাশ ভালোভাবে দেখার জন্য ধনীদের অসংখ্য চোখ থাকত, গরিবদের থাকত মোটে একটা চোখ! চাঁদবাসি এইসব মানুষেরা আয়নায় মহাজাগতিক প্রাণীদের আসা-যাওয়া দেখতে পারতেন! চন্দ্রবাসকালীন সময়ে লুসিয়ান ও তাঁর সহযাত্রীরা ‘ট্যাব‘ ব্যবহার করে এথেন্সের দৈনন্দিন খবরা-খবর জানতেন!
জুলাই ২৩
যমজ ত্রাতা
১৯৪৪ সালের জুলাই মাসে ব্রেটন উডসের জাঁকালো বাংলোয় মানবতার মহানত্রাতা অভিন্নহৃদয় দুই যমজ সহদর জন্মগ্রহণ করে।
একজনের নাম রাখা হয় – ‘আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল’ বা আইএমএফ অন্যজন ‘বিশ্বব্যাংক’।
লাতিন পুরাণের যমজ ভ্রাতা ‘রোমুলাস ও রেমাসে’র মতোই হিংস্র নেকড়ের দুগ্ধপান করে তারা বেড়ে উঠেছে। শেষে যৌবনপ্রাপ্ত হয়ে স্থায়ী আসন গেড়েছে ওয়াশিংটনে – অন্য বৈমাত্রেয় ভ্রাতা হোয়াইট হাউসের অদূরে।
সেই থেকে তারা বিভিন্ন দেশের সরকারব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে আসছে! ভুক্তভোগী দেশগুলো এদের উদ্ধারকর্তা হিসেবে বেছে নেয়নি। বরং এরাই দেশগুলোর ভাগ্য নিয়ন্ত্রণে এগিয়ে আসছে, অভ্যন্তরীণ কর্মকাণ্ডে নজরদারি করছে, প্রয়োজনে হুমকি দিচ্ছে শাস্তির ব্যবস্থাও করছে!
এই যমজভ্রাতা সবসময় স্বভাবসুলভ মাস্টারি করে থাকে – ‘তোমার আচার-আচরণ ঠিক করো, নিয়ম-নীতি মেনে চলো, আর হ্যাঁ ভক্তি-শ্রদ্ধা ভুলে যেও না – মনে রেখো নিস্কাম ভক্তিই পরম মোক্ষের একমাত্র উপায়।’
জুলাই ২৪
‘ঋণ’ এক সার্বজনীন ‘পাপ’
যিশুখ্রিস্ট ও তাঁর শিষ্যরা যে-ভাষায় কথা বলতেন, সেই ‘আরামিয়‘ ভাষার একটি শব্দ ‘পাপ’ ও ‘ঋণ’ উভয়কেই বুঝাতো।
দুই হাজার বছর পর, আমরা দেখছি গরীবের যেকোনো ধরনের ঋণ তাঁর গুরুতর পাপের সমতুল্য। এর শাস্তি তাঁকে পেতে হয় পার্থিব জগতেই – হাতেনাতে সুদে-আসলে।
অঢেল বিত্তবৈভবের মালিকেরা বিত্তহীন নিঃস্ব মানুষদের নিরুপায় পাপের শাস্তি দিয়ে থাকে।
জুলাই ২৫
মরিছে মানুষ, সন্তান মোর মার
চতুর্দশ শতাব্দীতে ইউরোপের শহরে গ্রামে গোঁড়া ক্যাথলিক রক্ষিবাহিনী মার্জার নিধনে খড়গহস্ত হয়ে ওঠে। মিচকে পিশাচ অশুভ প্রাণী, শয়তানের জীবন্ত প্রতিনিধি ‘বিড়াল’কে তাঁরা ক্রুশবিদ্ধকরে মারে, ধারালো অস্ত্রে খুঁচিয়ে হত্যা করে, জীবন্ত শরীর থেকে চামড়া তুলে নেয়, অকাতরে অগ্নিকুণ্ডে ফেলে বিড়ালজ ফসিল বানায়। পুণ্যাত্মারা এই মার্জারজিহাদে নিরংকুশ জয়লাভ করে। পাপিষ্ঠ বিড়ালজাতি সমূলে নির্বংশ হয়ে যায়!
আর ঠিক তখনই চিরশত্রুর অবর্তমানে ইঁদুর দখল করে নেয় শহরের রাস্তাঘাট গুদাম গৃহ দপ্তর মন্দির সিংহাসন ভাগাড়। এই অজস্র অসংখ্য মূষিক থেকেই সারা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে কৃষ্ণমৃত্যু ‘ প্লেগ’। প্রাণ হারায় তিন কোটি বিশ্বাসী অবিশ্বাসী মানবসন্তান!
জুলাই ২৬
বিড়ালনামা
বৃহৎ বোর্নিও দ্বীপে খাদ্যচক্রের কিছুটা নমুনা –
বিড়াল গিরগিটি/ ইঁদুর ধরে খায়, গিরগিটির খাদ্য তেলাপোকা, তেলাপোকা রাজ্যেরসব ছোট পতঙ্গ খায়, আর পতঙ্গ সাবরে দেয় মশার ডিম লার্ভা। এই প্রাকৃতিক খাদ্যচক্রে বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য ‘ডিডিটি’র কোনো স্থান নেই।
বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ‘বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা’ বোর্নিও দ্বীপের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে মশকনিধন ও ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণে ব্যাপকহারে ‘ডিডিটি’ বর্ষণ করে। এই ডিডিটি বোমায় মশকবাহিনীর তেমন ক্ষতি না-হলেও খাদ্যচক্রের অনেকেই বিলুপ্ত বিলীন হয়ে যায়।
বিষক্রিয়ায় বিড়ালজাতি যখন নিশ্চিহ্ন, ঝাঁকে ঝাঁকে লাখে লাখে ইঁদুর তখন সারা বোর্নিও ছেয়ে ফেলে। মানুষের খাদ্য শস্য ফসলে চিরস্থায়ী অধিকার দাবী করে। বড় অসহায় নিরুপায় হয়ে পড়ে মানুষ! নিরুপায় এই মানুষকে ইঁদুর ভালোবেসে শ্রদ্ধা করে টাইফাস, প্লেগ ও অন্যান্য রোগের উপঢৌকন পাঠায়!
মূষিক আক্রমণে নাজেহাল ‘বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা’ বিশেষ অধিবেশন ডাকে, নানা বিশেষজ্ঞ মত, আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রয়োগ বিবেচনা করেও তাঁরা সিদ্ধান্তে আসেন – দ্রুত বোর্নিও দ্বীপে প্যারাসুটে বিড়াল নামাতে হবে!
১৯৬০ সালের এই সময়ে আকাশ থেকে ডজনে ডজনে বিড়াল নেমে আসে দক্ষ প্যারাট্রুপারের মতো। অগণিত বিপর্যস্ত মানুষের হর্ষধ্বনিতে আকাশবাতাস মুখরিত হয়ে ওঠে!
জুলাই ২৭
রাষ্ট্রের পুরস্কার ও দণ্ড
১৯৫২ সালের এই দিনে হেলসেংকি অলিম্পিকের সমাপ্তি হয়। দূরপাল্লার দ্রুতগামী মানব এমিল জ্যাটোপেক বিভিন্ন দূরত্বের দৌড়ে তিন তিনটে স্বর্ণপদক যেতেন। নিজ দেশ চেকোস্লোভাকিয়ায় তিনি জাতীয় বীরের সম্মাননা পান, দেশটির সেনাবাহিনী তাঁকে সম্মানসূচক কর্নেল পদমর্যাদায় ভূষিত করে।
১৯৬৮ সালে তাঁর সম্মান ও মর্যাদা যখন তুঙ্গে, তখন তিনি নিজ দেশের গণআন্দোলনে অংশ নেন এবং আগ্রাসী রাশিয়ার বিরোধিতা করেন।
ফলে ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম এই দৌড়বিদ কাজ ও পদমর্যাদা হারিয়ে বেকার আর নিঃস্ব হয়ে পড়েন। সরকারের রোষানলের ভয়ে কেউ তাঁকে সম্মানজনক কোনো কাজ দেয়নি। জীবিকার তাগিদে দ্রুতগামী এই ‘চেক লোকোমোটিভ‘ রাস্তা ঝাঁড়ু দেয়ার কাজ বেছে নেন!
জুলাই ২৮
অনেক কথা যাও যে বলে কোনো কথা না বলি
১৮৯০ সালে ভাই থিও কে লেখা এক চিঠিতে ভিনসেণ্ট ভ্যানগগ লেখেন –
‘আমার সমগ্র চিত্রমালা কথা বলার জন্য মুখিয়ে আছে।পারলে একটু সুযোগ করে দিও।’
পরদিন নিজেকে তিনি চিরনির্বাক করে দেন, পৃথিবী ছেড়ে চলে যান শিল্পিত কোনো জগতে। তাঁর চিত্রকর্ম আজও কথা বলে যাচ্ছে বাঙ্ময় নিবিড় অন্তর্ভেদী ভাষায়!
জুলাই ২৯
নতুন সময়
১৮৩০ সালে হাজার হাজার জনতা প্যারিস শহর অবরোধ করে রাখে। ছয় হাজারের বেশি ব্যারিকেড ও পরিখা বসিয়ে শহরটি প্রায় বিচ্ছিন্ন করে রাখে পরিবর্তন প্রত্যাশীরা। এরপর চলে রাজার সৈন্যসামন্ত সেনাবাহিনীর সাথে তুমুল লড়াই। টানা তিনদিন ধরে চলা এই গণযুদ্ধে রাজার বাহিনী হেরে যায়!
বিক্ষুব্ধ জনতা রাজপ্রাসাদের আর চার্চের সব ঘড়ি, ঘণ্টা ভেঙে গুড়িয়ে দেয়, তাঁরা নতুন সময় আনতে চায় সমাজে ও রাষ্ট্রে!
জুলাই ৩০
আন্তর্জাতিক বন্ধুত্ব দিবস
কার্লোস ফনসেকা অ্যামাডর বলতেন, ‘ তোমার বন্ধু মুখের উপর তোমার সমালোচনা করবে, আর আড়ালে সবার কাছে করবে প্রশংসা।’
অভিজ্ঞতায় আমরা জানি, সত্যিকার বন্ধু সুখেদুঃখে সবসময় আমাদের পাশে থাকে, অন্যেরা কেবল বসন্তের কোকিল!
জুলাই ৩১
আমি অনন্য মানুষ
বলা হয় আদিকালে সবকিছুই এমনকি জড়বস্তুও বিদ্রোহ করত।
‘মায়ান’ জনপদে প্রচলিত আছে – রান্নাঘরের অবহেলিত তৈজসপত্র আন্দোলন বিদ্রোহ উস্কে দেয়। পুড়ে যাওয়া হাড়িপাতিল, ভাঙ্গা হামানদিস্তা, ক্ষয়ে যাওয়া ভোতা ছুরি প্রভৃতি নিত্যব্যবহার্য বাসনকোসনও প্রতিবাদে মুখর হতে পারে। আর দেবতারা এইসব বিপ্লব প্রতিবাদে সমর্থনও দিয়ে থাকে।
মায়ান দাসদের উপনিবেশিক শাসকেরা মানুষ নয় জড়বস্তু হিসেবে বিবেচনা করত। চাবুকের আঘাতে পশুর মতো ক্ষতবিক্ষত করত তাঁদের শরীর। জমিদার প্রভুর মতে দাসদের শ্রবণেন্দ্রিয় মাথায় নয়, পিঠে থাকে। তাই প্রয়োজন চাবুকের।
১৮৪৭ সালের আজ রাতে মায়ানরা তাই বিদ্রোহ করে। আন্দোলন বিদ্রোহের আগুনে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয় প্রভুদের যত নিয়মকানুন আইন। কৃষিজমির অধিকার ফিরিয়ে নেয়, দাসপ্রথার বিলুপ্তি ঘোষণা করে আর নিজেরাই হয়ে ওঠে নিজেদের প্রভু।
জড়বস্তু থেকে অনন্য মানুষ!