প্রদীপ সিং: প্রথমেই আপনাকে অভিনন্দন। আপনার ‘রেত সমাধি’ উপন্যাসের অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী বৃদ্ধ মায়ের গল্পটি এখন ফরাসি সাহিত্যের অংশ। আপনার উপন্যাসটি ফরাসি ভাষায় অনূদিত হওয়ায় আপনার অনুভূতি কেমন তা জানতে চাই?
গীতাঞ্জলি শ্রী: ধন্যবাদ। উপন্যাসটির ফরাসী অনুবাদ আমার জন্য একটি বড় অর্জন। ফরাসি ভাষায় ভিন্ন সংস্কৃতি ও জীবনধারার পাঠকরা এখন উপন্যাসটি পড়ার সুযোগ পাবেন। তাদের চিন্তাভাবনা, উপলব্ধি এবং কাজের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা তৈরি হবে। তারা তাদের জীবনে নতুন একটি দৃষ্টিভঙ্গি খুঁজে পাবেন।
নিজের বই অনূদিত হলে বিশেষভাবে ভাল লাগে এই কারণে, বিদেশী পাঠকরা তাদের সংস্কৃতি থেকে ভিন্ন আরেকটি সংস্কৃতির জীবনবোধ সেখানে খুঁজে পায় যা তাদেরকে জীবন সম্পর্কে একটি ভিন্ন দৃষ্টিকোনের অভিজ্ঞতা নিতে সহযোগীতা করে। ভিন্ন সংস্কৃতির হলেও সে জীবনবোধ তাদের অভিজ্ঞতার অংশ হয়ে উঠে অর্থাৎ এমন একটি অভিজ্ঞতা যা তাঁদের জন্য বিশেষ হলেও সার্বজনীন এবং মানবিক। একজন ‘অপর’ আপন হয়ে উঠে।
ফরাসি ভাষায় পূর্বেও আমার দুটি উপন্যাস অনুবাদ হয়েছে। আমি ভাগ্যবান যে আমি উভয় অনুবাদকের সঙ্গে একটি ভাল সম্পর্ক গড়ে তুলেতে পেরেছি। একজন হলেন সুপরিচিত হিন্দি ভাষার প-িত, অধ্যাপক অ্যানি মন্টাও যিনি প্যারিসে থাকেন। এবং অন্যজন হলেন নিকোলা পটজা, সুইজারল্যান্ডে হিন্দিভাষা ও সাহিত্য নিয়ে কাজ করেন। দুজনেই হিন্দি সাহিত্য ও হিন্দুস্তানের সাথে বেশ পরিচিত এবং কিছুটা হলেও ভারতীয় হয়ে উঠেছেন।
প্রদীপ সিং: ‘রেত সমাধি’ উপন্যাসটির বিশেষত্ব হল পাঠকের মনেই হবে না, আপনি এই চরিত্রগুলি সৃষ্টি করেছেন। এমনভাবে লিখেছেন, যেন এই পৃথিবী আপনার নিজের শ্বাস-প্রশ্বাসের পৃথিবী। বাস্তব জীবনে এমন চরিত্রের দেখা পেয়েছেন কখনো?
গীতাঞ্জলি শ্রী: আপনি আমার উপন্যাসটিকে ‘ব্রীফিং ইউর ওয়ার্ল্ড’ বলছেন এবং এর বিপরীতে ‘বাস্তব জীবনের’ প্রসঙ্গ তুলছেন। বাস্তবে এর ভিন্নতা নেই। সৃজন প্রক্রিয়ায় কল্পনা ও বাস্তব জীবনের এক অদ্ভুত খেলা আছে এবং সরলভাবে লেখার বিষয়টি যদি বাদ দেই, তাহলে এমন নয় যে, জীবন থেকে চরিত্রগুলোকে সোজা আলাদা করে নিয়ে সাহিত্যে রেখে দেই। অর্থাৎ অনেক উপাদান মিলিত হয়, সাহিত্য সেসব চরিত্র, ঘটনা প্রভৃতির মধ্যে জন্ম নেয়। প্রায়ই বাস্তব জীবনের অনেক চরিত্র একত্রিত হয়ে সাহিত্যে একটি চরিত্র গঠন করে। আর লেখকের কল্পনা সেখানে কাজ করে।
আসল বিষয় হলো, লেখকরা তাদের চারপাশের জীবন থেকে অনেক কিছু গ্রহণ করেন এবং পরবর্তিতে সেগুলো অতিক্রমও করেন। তাদের কল্পনা এই মিশ্রণটিকে জীবন্ত করে তোলে এবং বাস্তবকে প্রসারিত করে।
আমি এটাও বলব যে, জীবনের সম্ভাবনা, যা হয়তো এখনও অর্জিত হয়নি, তাও লেখককে অনুপ্রাণিত করে। এই সম্ভাবনাগুলো যেমন ভালো তেমনি খারাপও হতে পারে। একজন লেখক উৎসাহিত বা সতর্ক হতে পারেন। এই কারণেই প্রায়শই সাহিত্যে ভবিষ্যত অনুরণিত হয়। জর্জ অরওয়েলের সাহিত্যই ধরুন। অথবা আমাদের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচিত ‘গোরা’ উপন্যাসের কথাই ধরুন। হিন্দুসমাজ এখনও তাদের গোরাকে খুঁজে পায়নি অথচ আমাদের মুক্তির জন্য ‘গোরা’ কতটা পরিমার্জিত, স্তরিভূত এবং গভীর চরিত্র।
প্রদীপ সিং: ‘রেত সমাধি’ উপন্যাসের এক জায়গায় আপনি লিখেছেন, কন্যারা হাওয়ার তৈরি। কেবল নীরব মুহূর্তেই সেটি দৃশ্যমান হয় এমন নয় যারা খুব সূক্ষ্মমভাবে অনুভব করতে সক্ষম তারাই তাদের উপলব্ধি করতে পারে। তাহলে কি আপনি বিশ্বাস করেন যে নারীরা পুরুষদের থেকে আলাদা? যেখানে নারীবাদী লেখাগুলোতে দেখা যায় প্রায় সকল ক্ষেত্রেই নারীকে পুরুষের মুখোমুখি করে তোলা হচ্ছে।
গীতাঞ্জলি শ্রী: আমি যা লিখেছি তার অনেক ধ্বনি-প্রতিধ্বনি আছে। একটা বিষয় হল, যে পুরুষ শাসিত সমাজে কন্যা বা নারীকে উপেক্ষা করা হয় বা বিশেষ ‘চোখে’ দেখা হয়। নারীরা আসলে যেভাবে চায় এবং যেমনটা প্রত্যাশা করে তেমনভাবে নয়। সুতরাং আপনি যে উদ্ধৃতিটি নিয়েছেন তা সেই সংবেদনের উদ্দেশ্যে করা হয়েছে যেখানে একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে, মেয়েটিকে চিনতে হবে, তার শুদ্ধতাটিকে দেখা উচিৎ। নারী ও পুরুষ কীভাবে আলাদা, কতটা আলাদা, কী উপায়ে তা নিয়ে অনেক আলোচনা করা গেলেও সেটিকে চূড়ান্ত বিষয় হিসেবে বিবেচনা বা নির্ণয়ের চেয়ে সেই আলোচনা অন্য আরো অনেক বিষয়ে আলোচনার দ্বার খুলে দেয়। সমাজ ও সংস্কৃতি কীভাবে তাদের আলাদা জীব ও পরিচয় নির্ণয় করেছে, সে আলোচনাও করতে হবে। অথচ আমাদের বেশিরভাগ আলোচনাগুলোতে সেটির স্থান নেই।
আমি শুধু বলতে চাই যে তারা আলাদা, কোন উপায়ে আলাদা, আর কোন উপায়ে আলাদা না, নারী পুরুষ সমতার দাবিতে এরকম কোনো পার্থক্য করা উচিত নয়। আমি ভিন্ন হলেও সমতা চাইব। সমতার মানে এই নয় নারীর শিশ্ন থাকতে হবে আর পুরুষেরও স্তন থাকবে। বরং যে কোনও ক্ষেত্রে উভয়েরই সম অধিকার, পছন্দ, এমনকি ব্যাক্তি ইচ্ছা ও ভাবনার স্বাধীনতা থাকা উচিত।
প্রদীপ সিং: আজ হিন্দি সাহিত্যে নতুন করে গল্প বলার ধরন, গল্পের বুনন, দৃষ্টিভঙ্গি বিরল। কিন্তু আপনার উপন্যাস ‘রেত সমাধি’ সেইসব প্রতিবন্ধকতা দূর করে এমন একটি জায়গা কওে নিয়েছে যে, তা পাঠককে নতুন করে আবারও ভাবতে, চিন্তা করতে শিখাবে। নতুন দৃষ্টিভঙ্গির সন্ধান দিবে।
গীতাঞ্জলি শ্রী: আমি অন্য লেখকদের কথা জানি না, কিন্তু আমার নিজের সাহিত্য যাত্রা আমাকে শিখিয়েছে যে একটি রচনা শক্তিশালী হয়ে উঠে তখনই যখন সেটি তার নিজস্ব স্বতন্ত্র সুর খুঁজে পায়, নিজের পায়ে দাঁড়ায়, নিজের গতি ঠিক করে নেয়। লেখককে তার নিজের অবস্থানে শক্ত হয়ে দাঁড়াতে হবে। আমি কোনো কিছু আরোপ করার চেষ্টা করি না, নিজেকে মুক্ত রেখে পথ চলতে শুরু করি। ভাষা আর শিল্পশৈলী বেছে নেওয়ার উদ্যোগ নিই। তবে এটা কোনো নৈরাজ্যকে অনুসরণ করার জন্য নয়।
আমার ভেতরের মন, লেখক-মন, চেতন-অবচেতন, আমার ইন্দ্রিয়, উপলব্ধি, কল্পনা-শক্তি, আমার বুদ্ধি, এই সবই আমার সৃজনশীল শক্তিকে খোদাই করে চলেছে এবং এখনও করছে। আমার বিবেক অজান্তেই আমাকে পথ দেখায়। বিশৃঙ্খলা রোধ করে, সাহসকে উৎসাহিত করে, ঝুঁকি নেয়, কিন্তু পতনের বিরুদ্ধে সতর্ক করে। হয়ত গুটির চাল ভুলভাবেও এগুতে পারে তবে এর মূলে কিন্তু রয়েছে সৃজনধর্ম। আর চ্যালেঞ্জ হল একঘেয়ে, ঘষামাজা আন্দাজ, জরাজীর্ণ স্টাইল কিংবা বিরক্ত হয়ে যাওয়া নয় বরং ভারসাম্য খুঁজে বের করা।
রামানুজনের এই উক্তিটি আমার ভীষণ প্রিয়, ‘আমি কবিতার পিছনে ছুটি না, বরং নিজেকে এমন একটি স্থানে স্থির করে নেই যেনো কবিতা আমাকে খুঁজে পায়।’ অথবা ওস্তাদ আলী আকবর খান যেমন বলেছেন, ‘আমি সরোদ বাজাতে শুরু করি, তারপর সরোদ আমাকে বাজাতে শুরু করে।’
তাই ‘রেত সমাধি’ উপন্যাসটি যদি সেই বন্ধন ছিন্ন করে থাকে, তাহলে সেটি তার নিজের অনুসন্ধান ও প্রাপ্ত সত্যের জন্য করেছে। যদি সেটি নির্ভরযোগ্য হয়ে ওঠে, শক্তিশালী হয়ে থাকে, তার ব্যক্তিত্ব খুঁজে পায়, তবে আমি কৃতজ্ঞ যে এত বছরের ডুবে থাকা কেবল ডুবে থাকাই হয়নি বরং সেখান থেকে কিছু ‘মুক্তা’ উঠে এসেছে। হয়তো আপনার হাতেও রয়েছে সে মুক্তা।
প্রদীপ সিং: আপনার উপন্যাসে, জীবন বদলে যায়, নতুন আবেগ এবং ঘৃণার উদ্ভব হয়, প্রতিদান এবং প্রতিশোধ আছে, তবে গোপনে। আপনি লেখার মধ্য দিয়ে অনেক অপ্রকাশিত কথা অনেক দৃঢ়ভাবে ইঙ্গিত দিয়ে যান?
গীতাঞ্জলি শ্রী: সাহিত্য হল প্রকাশ এবং অপ্রকাশের এক সাংকেতিক খেলা। খোঁজ করেও এখানে অভিধাকে পাওয়া যাবে না। এও বলি, যেখানে অব্যক্ত সেখানে দম আছে। সাহিত্যকেও নিজের জন্য প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিতে হয়। সবাই বলল, তাদের দম বন্ধ হয়ে আসছে আর দেখা গেল সবাই মৃত।
প্রদীপ সিং: আপনার লেখায় খুব গভীর অনুভূতি নিয়ে নারীর মনস্তত্ব এবং সংবেদনশীলতা ফুটে ওঠে। বর্তমানে নারীর অধিকার নিয়ে অনেক প্রশ্ন আলাপ আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু আপনি ফ্ল্যাশব্যাক থেকে জিনিসগুলো তুলে নেন। নারীর অধিকার নিয়ে লিখতে হলে কি ‘নারীবাদী’ হওয়া প্রয়োজন আছে?
গীতাঞ্জলি শ্রী: ফ্ল্যাশব্যাকই এই বিষয়গুলো বাছাই এবং সেগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করার একমাত্র উপায় নয়, আরও বিভিন্ন ধরণের জিনিস রয়েছে যা প্রকাশ করা হয়। আমার মতে, এটা সংবেদনের বিষয়, তর্কের নয়। সাহিত্য বিতর্ক ও আদর্শের শৃঙ্খলে বন্দী হওয়ার বিষয় নয়। এই চিন্তা পাঠক, সমালোচক এবং একাডেমিক বিতর্কের সাথে জড়িতদের জন্য। মুশকিল এই যে, প্রায়শই তারা প্রতিটি কাজকে আদর্শ এবং আদর্শের গন্ডিতে ফেলে নির্ণয় করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। আমি বলব, আমার চিন্তাধারায় যাই থাকুক না কেন, আমার লেখা যে বিতর্ক আর আদর্শকে অতিক্রম করে, তা আমাকে সমৃদ্ধ করে এবং সতেজ করে। মাঝে মাঝে অবাক করে দেয়।
প্রদীপ সিং: দৈনন্দিন ঘটনা এবং অনন্য দৃশ্যকল্পের আঙুল ধরে, আপনি মনের সূক্ষ্ম গভীরতায় নিমজ্জিত থাকেন। যেখানে কখনো আকাশ, ঘর, পাখি, কখনো অন্ধকার, অস্থিরতা আর হাহাকার, কখনো দুঃখ, কষ্ট…
গীতাঞ্জলি শ্রী: আপনি নিজেই এত সুন্দর করে বলেছেন। হ্যাঁ, আমি বিশ্বাস করি যে বিশেষ এবং অসাধারণ কিছু আমাদের দৈনন্দিন এবং সাধারন জীবন যাপনের মধ্যেই থাকে। শান্ত, নিস্তব্ধ, ঠুনকো কোনো বিষয়ের আড়ালে বড় কোনো গল্প লুকিয়ে থাকতে পারে। বড় কোনো ইতিহাস বা আদিম কোনো প্রতিধ্বনি এতে গেঁথে থাকতে পারে।
প্রদীপ সিং: আপনার জন্ম, পরিবার এবং শিক্ষা সম্পর্কে বলুন। মা বাবার সান্নিধ্যে থাকার কথা বলুন।
গীতাঞ্জলি শ্রী: আমার জন্ম এবং বেড়ে উঠা উত্তর প্রদেশে। আমাদের সময়েও ইংরেজীতে পড়াশোনা করাটাকে ভাল লেখাপড়া হিসেবে বিবেচনা করা হত। কিন্তু আমি ভাগ্যবান যে, আমি কোনো মহানগরে বড় হইনি।ছোট একটা শহরে বেড়ে উঠেছি এবং সেখানে স্কুলের বাইরে ভারতীয় পারিবারিক শিক্ষাটা ছিল। তখনকার দিনে ইংরেজির প্রাধান্য আজকের সময়ের মতো ছিল না। শহরে হিন্দি-উর্দু সাহিত্যিকদের যথেষ্ট কদর ছিল। কবি সুমিত্রানন্দ পন্ত, ফিরাক সাহেব, মহাদেবী বর্মা প্রমুখ আমাদের কাছে মান্য ব্যক্তি ছিলেন। আমরা বাড়িতে হিন্দি পত্রিকা এবং বই পড়ায় অভ্যস্থ ছিলাম। আজকের শহরে বেড়ে উঠা শিশুদের মতো হিন্দি থেকে বিচ্ছিন্ন হইনি। আজকের শিশুরা যেভাবে হিন্দি ভাষাকে গ্রহণ করে একরকম তাচ্ছিল্যভাবে, অপমানজনক বলে মনে করে আমাদের সময়টাতে তেমন ছিল না।
তবে সেরকমভাবে হিন্দি শিক্ষায় শিক্ষিত না হলেও পারিবারিক এবং পারিপার্শ্বিক আবহে ভাষাটা আমার নিজের প্রয়োজনে, নিজের মত করে ব্যবহার করার সচেতনতাটা তৈরি হয়েছিলো।
আমার বাবা মা দুজনের মধ্যে একরকম বিবাদ, একরকম মাধুর্য ছিল। তাদের এবং আমাদের সময় আলাদা। পিতা মাতা দুজনের সম্পর্কের উষ্ণতা সবসময় সন্তানদের মধ্যে থাকে এটাই স্বাভাবিক। সেটা সন্তানের সঙ্গে একরকম সম্পর্ক তৈরি করে নেয়।
মা তো মা, বাবা তো বাবা! আমি বাবা না মা কার সংস্পর্শে বেশি ছিলাম এ বিষয়ে কি উত্তর দেব? কারো কাছে থেকে দূরে থেকে কাছে ছিলাম আবার কারো কাছে থেকেও দূরে ছিলাম। উভয়ের প্রতি আমার আস্থা আছে, ভরসা আছে। তারাও আমাদেকে জ্বালাতন করেছে, আমিও তাদেরকে জ্বালাতন করেছি।
প্রদীপ সিং: আপনি মুন্সী প্রেমচাঁদের উপর পিএইচডি করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার কাজও করেছিলেন তারপর আচমকা সব ছেড়ে দিয়ে লেখায় মনযোগী হলেন। একজন লেখক হিসেবে নিজের পেশাকে বেছে নেওয়া কতটা কঠিন?
গীতাঞ্জলি শ্রী: হিন্দি সাহিত্য নিয়ে কাজ করবো বলে প্রেমচাঁদকে নিয়ে গবেষণা করেছি। অধ্যাপনার কাজ শুরু করেছিলাম, রুটি-রুজির প্রয়োজনেই। তবে হিন্দি সাহিত্য নিয়ে কাজ করার সিদ্ধান্তটা যখন নিশ্চিতভাবে নিয়েই ফেলেছিলাম তখন মনে হয়েছে অধ্যাপনার কাজে যুক্ত থাকলে পুরো মনযোগটা লেখালেখিতে দিতে পারব না। এই কারণে অধ্যাপনার কাজ ছেড়ে দিয়েছি। আমার স্বামীও সেজন্য আমাকে সহায়তা করেছেন। শুরুটা ভালই ছিল। রাজকমলে প্রখ্যাত লেখক শিলা সান্ধুর সঙ্গে আমারও গল্প ছাপা হয়েছিল। যদিও গল্পকার হওয়ার কারণে অর্থ-কড়ি খুব একটা হয়নি কিন্তু সম্মান, মর্যাদা পেয়েছি। আসলে জীবিকা নিয়ে চিন্তা না করে লেখালেখির পথেই সমগ্র মনযোগ দিয়ে এগিয়েছি। আমি সৌভাগ্যবান যে, আমাকে খুব একটা কষ্ট করতে হয়নি। খেয়ে পরে বেঁচে থাকতে পেরেছি। ফ্রিল্যান্সিং লেখালেখি, প্রজেক্ট, থিয়েটার এগুলো নিয়ে আমি বেশ আনন্দিতই ছিলাম। আমার স্বামীও যে খুব বেশি অর্ত রোজগার করেছে তাও নয় তবে আমরা কাঙ্গাল থাকিনি।
প্রদীপ সিং: আপনি সাহিত্য, থিয়েটার, অধ্যাপনা বিচিত্র কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এরমধ্য থেকে কোনটিতে আপনি নিজেকে পরিপূর্নরূপে প্রকাশ করতে পেরেছেন বলে মনে হয়?
গীতাঞ্জলি শ্রী: সাহিত্যিক হিসেবেই নিজেকে বেশি প্রকাশ করতে পেরেছি বলে মনে করি, বিশেষ করে আমার উপন্যাসগুলোর নানা চরিত্রে বিচরণ, বিস্তৃতি, দীর্ঘ ভ্রমণ এর ভেতর দিয়ে। তবে একই সাথে এটাও বলব, আমি অন্যকে শৃঙ্খলায় ঘিরে রাখতে চাই না। আমাদের অভিজ্ঞতাগুলো আদান-প্রদানের। একটা অভিজ্ঞতা আরেকটা অভিজ্ঞতাকে নতুন স্তর দান করে, পরিপূর্ণ করে। আমার থিয়েটার অভিজ্ঞতা আমাকে শব্দ সম্পর্কে সচেতন করেছে, ইতিহাস অধ্যয়ন আমাকে ঘটনার প্রেক্ষাপট ও বিভিন্ন চরিত্র সম্পর্কে ধারণা দিয়েছে। শিল্প শেষ পর্যন্ত শিল্পকলার মিলন দাবি করে। ভাষা-বিষয়, শব্দ, রং, ছবি, নাচ, অঙ্গবিন্যাস কি নেই সেখানে!
______________________________
*এই সাক্ষাৎকারটি সম্প্রতি বাংলা একাডেমি থেকে বের হওয়া বাৎসরিক ‘অনুবাদ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে (সূচি, পৃষ্ঠা-১২৮)। যেহেতু তথ্যপ্রযুক্তির এই সময়ে অনলাইন এবং অফলাইন দুটো ক্ষেত্রেই সাহিত্যের আলাদা পাঠক শ্রেনী তৈরি হয়েছে তাই অনলাইন পাঠকদের কথা বিবেচনা করে অনুবাদকের সম্মতিক্রমে সাক্ষাৎকারটি উঠানের অনলাইনে প্রকাশ করা হয়েছে।
সাক্ষাৎকারটি ১০ জুলাই ২০২০, গীতাঞ্জলি শ্রী’র উপন্যাস ‘রেত সমাধি’র ফরাসী অনুবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর হিন্দি দৈনিক ‘জনচৌক’ এর প্রতিনিধি হিসেবে নিয়েছিলেন প্রখ্যাত হিন্দি সাংবাদিক, লেখক প্রদীপ সিং। ‘জনচৌকের’ হিন্দি অনলাইন থেকে সাক্ষাৎকারটি বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে।