পিঞ্জর (পর্ব ৪) // অমৃতা প্রীতম, অনুবাদ: জাভেদ ইকবাল

অধ্যায় ৪

রঙহীন, ধূসর আকাশ। চলে যাওয়া দিনগুলো একটা একটা করে হামিদার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। দু’পায়ের নিচে একটা বড় থলে বিছিয়ে নিয়ে, উদাস চোখজোড়া আকাশে নিবদ্ধ রেখে, পাথরের ভূত হয়ে সে সেই দিনগুলোকে দেখতে থাকে।
সামনের দরোজা দিয়ে রশিদ ভিতরে, উঠোনে ঢুকে পড়লো। ওর পায়ের আওয়াজ হামিদার কানে ঢুকলো না, রশিদের অবয়বও ওর দৃষ্টিতে ধরা পড়লো না; একেবারে মূর্তির মতো বসে থাকলো হামিদা। রশিদ আসলেই অন্তর থেকে হামিদাকে ভালোবেসে ফেলেছিল। সে এগিয়ে হামিদার পাশে গিয়ে বসলো। আলতো করে ওর হাতে হামিদার কাঁধ জড়িয়ে ফেললো, আর নরমভাবে বললো, ‘কি ভাবছো কি বসে, মেয়ে….’
হামিদা নড়াচড়া না করে একইভাবে বসে থাকে। রশিদ হামিদাকে হাতের মধ্যে আলতো দোলাতে থাকে। অনেকক্ষণ পর হামিদা বললো, ‘আমার ভেতরটা কে জানি খালি খোঁচাচ্ছে, খুঁচিয়েই যাচ্ছে।’
‘তুমি তো বাড়ির বাইরেই বেরোও না, কারো বাড়ি যাও না, মেলামেশা, দেখা-সাক্ষাৎ করো না,’ রশিদ থেমে থেমে বললো। ‘সারাক্ষণ একা একা থাকলে তুমি তো বিষন্ন হয়ে পড়বে। সুস্থ, ভালো মানুষই তাই অসুস্থ হয়ে পড়ে।’
‘তা, আমি যাবোটা কোথায় শুনি? তুমি ছাড়া এখানে আর কার সাথে আমার চেনাজানা, আত্মীয়তার বন্ধন আছে, বলো তো?’ রাগের স্বরে হামিদা বলে উঠলো।
রশিদ কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকলো, নীরব সময় পার হতে দিলো। এরপর নিঃশব্দে উঠে পড়ে সে চুলোয় আগুন জ্বাললো, আর সাথে করে আনা কোয়েলের মাংস একটা পাত্রের মধ্যে রেখে পাত্রটা চুলোয় চড়িয়ে দিলো। তারপর হামিদার কাছে এসে আবারো ওর কাঁধ জড়িয়ে বসে দু’জনে কোয়েলের মাংস রান্না হতে দেখলো।
‘তুমি এখন এই বাড়ির গিন্নি। আর কিছুদিন পর তো আরো একজন এই উঠোনে খেলা করে বেড়াবে। তা, আমার প্রতি না হয় তোমার কোনো দরদ না-ই থাকলো, কিন্তু যে নতুন সন্তান আসছে, তার জন্য তো অন্তত হাশিখুশি থাকো। বাচ্চাটা তো আর তোমার সাথে অন্যায় কিছু করেনি!’
মটরশুটির দানার মধ্যে ঘিনঘিনে পোকার চেহারাটা হামিদার মানসপটে ভেসে উঠে। মাথা ঘোরা, বমি বমি ভাব হয় ওর।
হামিদার সামনে একগাদা মটরশুটি দেখে রশিদ বললো, ‘কোয়েলের সাথে একটু মটরশুটি দেবে নাকি?’
‘এগুলো বেশি পেকে গেছে; মটরশুঁটির মৌসুম তো শেষ হয়ে এলো। বৈশাখও এসে গেল প্রায়,’ হামিদা বলে। ঐদিন মটরশুটি খাওয়ার কথা হামিদা আর ভাবতেই পারলো না; গা ঘিনঘিনিয়ে উঠলো।
‘কালকেই পহেলা বৈশাখ,’ শাস্ত ভঙ্গিতে রশিদ বললো; ‘খুব বড় মেলা হবে।’
‘বৈশাখ!’ ঘন্টাধ্বনির মতো হামিদার কানে বেজে উঠলো শব্দটা, বাজতেই থাকলো- ‘বৈশাখ!’ নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্য দ্রæত উঠে পড়ে সে চাপাতি’র খামির বানাতে শুরু করলো।
‘কোয়েলের গোস্ত খাওয়ার পর একটু গুড়ের সেমাই খেতে পারলে মন্দ হতো না,’ রশিদ বললো। হামিদা ঘরে ঢুকে সেমাই আর একদলা গুড় হাতে নিলো। আর তখুনি, একদিন সেমাই বেলতে বেলতে মা’কে বলা একটা কথা মনে পড়ে গেল তার: ‘মা, আমি মেশিনে বানানো সেমাই খেতে চাই।’ একথা শুনে ওর মা তেড়ে উঠে বলেছিল: ‘ছি ছি মেয়ে, মেশিনে বানানো সেমাই তো শুধু মুসলমানরা খায়!’ এই স্মৃতি ওর দু’চোখে এখন জল আনলেও, হামিদা হাসতে শুরু করে।
রশিদ মাথা উঁচু করে তাকায়, বিস্মিত হয়। ‘হাসছো কেন তুমি?’ হামিদা ঘটনাটা খুলে বলে এবার কাঁদতে শুরু করে। রশিদের চওড়া হাসি গোমড়া হতে হতে একসময় মিলিয়ে যায়।
পরদিন সকাল-সকাল ঘরের কাজ করতে করতে, ঢাক-ঢোলের শব্দে হামিদা একসময় ছাদে উঠে পড়ে। ছাদ থেকে ক্ষেত, মাঠঘাট চোখে পড়ে। মাঠ আর ক্ষেতগুলোতে গ্রামের কৃষক, জওয়ানেরা সব জড়ো হয়েছে। সেদিকে তাকিয়ে মানুষের সমুদ্র দেখতে পায় হামিদা; মেলাও দেখা যায়। উঁচু-লম্বা-বলবান, দাঁসাড়ে, গেঁয়ো পুরুষেরা আনকোরা লুঙ্গি কোমরে পেঁচিয়ে, ঝকঝকে পালিশ করা বাঁশের লাঠি হাতে ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছে। সূর্যের আলোয় লাঠিগুলোসব চকচক করছে। মানুষজন দলবেঁধে, অস্থির পদচারণায় প্রাণোচ্ছল মেলার ভীড়ে এপ্রান্ত-ওপ্রান্ত করছে। কেউ কেউ পরিবারকে ঘোড়ার পিঠে চাপিয়ে মেলায় নিয়ে এসেছে- এক কি দুইটা বাচ্চা সামনে বসিয়ে নিয়ে, বউটা পেছনে সিঁটকিয়ে আছে। অনেকে আবার সন্তানের হাত ধরে হেঁটে হেঁটে মেলায় চলেছে; বউগুলো একটু পেছন থেকে স্বামীদের অনুসরণ করছে। নওজওয়ানেরা নোটন পায়রার মতো বুক ফুলিয়ে, সদর্র্পে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। হৈ-হল্লা, কোলাহলে মুখর মেলা। হঠাৎ হঠাৎ উচ্চশব্দে গেয়ে ওঠা। এক কোনায় মাটি খুঁড়ে, কুস্তির ময়দান বানিয়ে জমজমাট কুস্তি খেলা চলছে। এতো দূর থেকেও বাতাসে মিষ্টি, রসালো জিলাপী আর তেলে ভাজা পাকোড়ার খুশবু পরিষ্কার নাকে এসে লাগছে। লোহার ছড়ানো পাত্রে মিঠাই-মন্ডা স্তুপ করে করে রাখা রয়েছে, হামিদা দেখতে পেলো। তারপর আচমকা একটা চিন্তা তার হৃদয়কে ছুরির ফলার মতো এফোঁড়-ওফোঁড় করে গেল। ওর ছোট তিনটা বোনের পর ওর ছোট্ট একটা ভাই হয়েছিলো। আর আজ ওর সেই ছোট্ট ভাইটার প্রথম বৈশাখ! মা নিশ্চয়ই তার ছোট ভাইটাকে প্রথমবারের মতো পানি মুখে দিয়েছে- নদীর পবিত্র পানিতে ডুবানো একটা গোলাপের পাপড়ি ওর ঠোঁটে ছুঁইয়ে দিয়েছে। ওদের আত্মীয়-স্বজনেরা নিশ্চয়ই বাড়ি এসে আশীর্বাদ করে গেছে…. আর হতে পারে যে, ঐ সময়ে মায়ের মন তার প্রথম সন্তান পুরো’র চিন্তায় উচাটন হয়ে উঠেছে!
হামিদার চোখে এখন আর কোনো অশ্রæ অবশিষ্ট নেই। সে শুধু দু’হাতের মধ্যে মুখটা গুঁজে দিয়ে ওখানে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে।
কানে-মাথায় ফুল জড়িয়ে, নওজওয়ানদের একটা দল বাড়ির সামনের রাস্তা ধরে এগিয়ে চলেছে। হাসাহাসি, হাত-পা ছোঁড়াছুড়িতে ওরা উচ্ছল, উদ্দাম। ওদের মধ্যে থেকে একজন উঁচু গলায় গাইতে শুরু করে:

রূপবতী তন্বী সে এক, কুয়োতলায় বসে
মুক্তোর মত দাঁতগুলো তার, যতন করে ঘষে।
ভয় কি তোমার, ও রূপসী, ভালবাসে যে
আপন করে বুকের মধ্যে ঠিকই নেবে সে।
একদিন সে চুরি করে নিয়ে যাবে তোমায়,
আসবে ঠিকই তোমার কাছে বিনে ইশারায়।
ডাকো তারে নাইবা ডাকো, তোমার কাছে এসে,
নিজের করে নেবে রে সে, তোমায় ভালবেসে!

রামচন্দ্র কেন তার জন্য এগিয়ে আসলো না? সে কি তাকে ভালোবাসেনি? অথচ না ইশারা করতেই, না ডাকতেই রশিদ চলে এলো? রশিদ এসেই তাকে সত্যি সত্যি চুরি করে নিলো; করে তার নিজের করে নিলো, বউ করে ঘর দিলো। কিন্তু রশিদ কি ওকে ভালোবাসে?
পথে যেতে যেতে ওরা ভাংড়া নাচতে নাচতে চলেছে। হৈ-হল্লা করছে, শূন্যে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে। ওদের মধ্যে থেকে একজন কয়েকটা চরণ গেয়ে ওঠে:

নাকফুলে তোর রোদের আভা জ্বলজ্বলিয়ে ফোটে
সেই আলোতে অন্ধ কৃষান লাঙ্গল ফেলে ছোটে
ভেজা বসন নিতম্বে তোর লেপ্টে-মিশে থাকে
ও সুন্দরী ধবল নারী, আড়ালে রাখিস তাকে।

আচ্ছা, সবসময় সুন্দরী রমনীদের অঙ্গসৌষ্ঠবের প্রশংসা করেই গানগুলো বাঁধা হয় কেন? কেন কোনোসময় রমনীর দুঃখ-দুর্দশা, দূর্ভাগ্য, পতিত অবস্থা নিয়ে কেউ শোকগাঁথা গায় না, গান বাঁধে না? সব গানে সাচ্চা প্রেমের বর্ণনা করা হয়; কখনো কি এমন গীত হবে, যাতে আমার মতো অসহায় মেয়েদের বিলাপগাঁধা লেখা হবে? কেন যে ঈশ্বর-বর্জিত নারীদের নিয়ে স্তোত্রগান, স্তুতিগীত রচিত হয়না? কখনো কি তাদের নিয়ে এমন ভজন গান হবে, যাদের কোনো ভগবানই থাকবে না?
একদল মেয়ে গলির মধ্যে দিয়ে হেঁটে হেঁটে আসছে। বয়সে ওরা কিশোরী হলেও, ওদের আচরণে, চলনে-বলনে যুবতীসুলভ চপলতা। নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব করতে করতে, আর খিলখিলিয়ে হাসতে হাসতে ওরা ভাংড়া নাচুনে নওজওয়ানদের দলটাকে অতিক্রম করে গেল। নওজয়ানেরা আড়ে আড়ে ওদের দেখতে লাগলো, ওদের শুনিয়ে ওদেরই খলখল হাসি অনুকরণ করলো। সেই সাথে অশ্লীল কিছু রসিকতাও করলো, আর শেষমেষ অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। আচ্ছা, হঠাৎ করে এই নওজয়ানেরা যদি মেয়েগুলোকে ওদের ঘোড়ায় করে তুলে নিয়ে যায়? সবগুলো মেয়েকে যদি ওরা অপহরণ করে ফেলে….?
উৎসবে, আনন্দে বৈশাখের পহেলা দিন এভাবে কেটে গেল।

পিঞ্জর (পর্ব ৩) // অমৃতা প্রীতম, অনুবাদ: জাভেদ ইকবাল

Facebook Comments

comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top