৯
কাকের ঘরে কোকিল ছাউ,
ডিম পাড়ে কোকিলা ফাউ!
সুবোধ আর অঞ্জনা ভালবাসাবাসির আলাপে বসে। আলাপ করতে করতে সুবোধ অঞ্জনাকে কাছে টেনে নেয়। অঞ্জনা স্নানে যাবার জন্য বের হয়েছে। হাতে কাপড়।বাঁশঝাড়ে লুকিয়ে তারা আলাপ করে।
সুবোধ : যাচ্ছিলে কুয়ানে?
অঞ্জনা : স্নানে যাবো পুকুরে।
সুবোধ : তা এই রাস্তা দ্যে যাচ্ছ যে?
অঞ্জনা : এট্টা পাখি দেখতি দেখতি রাস্তা ভুল কইরে ফেলাইছি।
সুবোধ : তা ভালো, অন্তত দেহা হলো পাখির জন্যি।
অঞ্জনা : অইসব ফাউল কথা আমাগেরে কয়ে লাভ নেই।নিজেরা তো উধাও হয়ে যাও।একবার খোঁজ নিইলে? গেইলে তো সেই ছয়মাস আগেরে।
সুবোধ : সর্দার বদলায়ে এই দলে ঢুকিছি তো এই রাস্তা দিয়ে যাবো বইলে। তা যদি লোকে বোঝতো।
অঞ্জনা : তা লোকে বোঝবে ক্যান।নিজে যদি বুইঝতে মাসের পর মাস গেলি আমাগের কিরাম লাগে।ছোটকালে বিয়ে দিইলো, সেই স্বামীডা হলো বিবাগী। লোকে কয় এদ্দিনে মইরে ভূত হইছে।আবার কেউ কেউ কয় আমার দোষে নাকি পলায় গেইছে।আমি তো তার অপেক্ষায় বচ্ছরের পর বচ্ছর কাটালাম।ফেরলো না।তাই মনের মদ্দি ভয় লাগে কারো কাছে গেলি। কাউরে মনে ধরলি।যদি সে আমার দোষে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়।
সুবোধ : অইরাম কইরে কইয়ে না।তোমারে ভালোবাইসে ফেলিছি বইলেই এ বচ্ছর আবার এই রাস্তার পাল ধইরে আইছি।
অঞ্জনা : কী কলা? কী বাসিছো?
সুবোধ চুপ করে থাকে।অঞ্জনার চোখে জল আসে। সুবোধ হঠাৎ খপ করে অঞ্জনার হাত ধরে টান দিয়ে বুকের মধ্যে নেয়। চারদিকে যেন কীর্তনের সুর ওঠে! যেন কেউ গেয়ে ওঠে!
সখি সঙ্গে মন রঙ্গে হেলিয়া দুলিয়া যায়
সে আসে গোপন মধু আলাপন
বুকেতে করিয়া হায়
আমি নিরুপায় মরিয়া সে মায়ায়
হৃদয়ো ব্যথায় মজিয়া ডুবিয়া যাই
অতলে তলায়ে হায়
১০
কেন দেবো শাঁখা সিন্দুর আলতার চরণ
অঙ্গে অঙ্গে তাজা সুন্দরী বদন,
শ্বেতবস্ত্র পরিধানে হয়কি সুমতি
নিভাই কি করে আমি উন্মাদিনী রতি?
নীলে তার ঘরের মধ্যে আয়নার সামনে একা।নিজেকে ঘুরেঘুরে দেখে। পরনের সাদা থান খুলে ফেলে রঙ্গিন শাড়ি পরে।শাঁখা পরে দুইহাতে। সিঁদুরের কৌটা নেয় হাতে। আয়নায় তাকিয়ে নিজে নিজে বলে,
নীলে : কী-রে নীলে? আছিস? কিরাম আছিস? নাকি মইরে ভ্যাটকায় গেইছিস? সাদা থানে শরীর ঢাকলিই কী শরীর মরে? ও নীলে কথা কচ্চিস ন্যে ক্যান?
সিথিতে সিঁদুর দিতে যায় নীলে, পায়ের কাছে ঘুরঘুর করতে থাকা শুয়োরের বাচ্চাটা ঘোৎ ঘোৎ করে ওঠে। নীলে বাচ্চাটাকে একটা লাথি কষায়।
১১
তুমি ব্যাটা কালাকুলা
আমি ধলা দুধ,
তোমারে কর্জ দিয়া
খাই আমি সুদ!
শুয়োরের পাল চরাচ্ছে চিন্তিত মুখে মঙ্গলের দল।একপাল বাচ্চাকাচ্চা রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে কাওড়াদের দিকে তাকিয়ে ছড়া কাটে।
কাব্রা বিটা শুয়োর চরায়
হাইগে মুইতে খায়,
কাব্রা মাগীর ভাতার ছাড়া
খোঁয়াড় ভইরে যায়।
দিনেশ খেঁকিয়ে উঠে বাচ্চাকাচ্চাদের গালাগাল করতে করতে লাঠি নিয়ে তাড়া দেয়।মঙ্গল দিনেশকে থামতে বলে। দিনে থামে না। বাচ্চারা ছড়া কাটতে কাটতে দৌড়ে পালায়।
দিনেশ : হেঁই খানকির বাচ্চারা।মা বাপ নেই তুগের? জাইরোর দল।
মঙ্গল : খামাখা উগেরে তাড়া দিস ক্যান?
দিনেশ : উরা যে আমাগেরে গাইল দ্যে গেলো?
মঙ্গল : ঝুতপালা উরা বোঝে নাকি অতশত? লাঠি নিয়ে তাড়ালি বাড়ি যাইয়ে নালিশ দেবেনে।তহন দেখপিনি সাহেবগের ছুয়াল মাইয়ে উরা। তহন উল্টো আইসে চোদবে নে।
দিনেশ : তা বইলে গাইল খাবো? আমাগের বউ মাইয়েগের যে গুষ্টি মাইরে গেলো তাতে কোন দোষ নেই উগের?
মঙ্গল : অত রাগিস নে। আমরা নিচু জাতের, উপায় নেই, এট্টুআট্টু গাইল খাতিই হবে চলতি গেলি। চুপ কর তুই।
দিনেশ : রাহো দিনি কাকা তুমার কথা হয় না।জাতের গুষ্টি চুদি।
মঙ্গল : চুইদেও লাভ নেই।কেউ তোরে চোদে না।
দিপেন ছুটে এসে, উব্দেগ নিয়ে জানায় আরও কয়েকটা শূকর মরার মতন অবস্থা। হুট করে উত্তেজনার মধ্যে এক ধরনের থমথমে নিস্তব্ধতা নামে। শঙ্কিত হয়ে ওঠে সবার চোখেমুখ।
দিপেন : কাকা?
মঙ্গল : কয়ডা?
দিপেন : তিন্ডে।
মঙ্গল : নাহ্।পারা যাচ্ছে না আর।এলাকা ছাড়তি হবে।
১২
মালতি ফুল মালতি ফুল
সন্ধ্যাবেলায় লাগলো ভুল,
নদীর কাছে যাইয়ে দেখি
এমন নদী নাই যে কূল!
সন্ধ্যায় পাল খোঁয়াড় দিয়ে মঙ্গলের ভ্রু কুঁচকে আছে। কোমরে হাত দিয়ে শুয়োর গুলোকে দেখছে।মঙ্গল বাদে অন্যরা রাতের খাবার খেতে বসে।একটা আতংকের নিরবতা সবার মধ্যে। সপ সপ শব্দে ভাত খেতে থাকে প্রচণ্ড ক্ষুধা নিয়ে।ট্যাংরা মাছের ঝোল আর ডাল।
দিনেশ : কাকা, অবস্থা কিরাম বুঝতিছো?
মঙ্গল : ভালো না।কালকেরে সকালে এহেন থে পাল সরায় নেবো।
দিনেশ : বাতাস খারাপ? না জল?
মঙ্গল : জানি নে।আনন্দ ঠাকুররে পালি বোঝা যাবে।ঠাকুর জানেন এর নিদান।
দিপেন : কাকা, এট্টু বাড়ি যাতি পাল্লি ভালো হতো।
মঙ্গল কয়েক সেকেন্ড বিরক্তি চেপে তাকিয়ে থাকে দিপেনের দিকে তারপর খ্যাঁক করে ওঠে,
মঙ্গল : অত শরীর গরম হলি বাজারে যা দিনি বাড়া।
দিপেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়।চোখে জল আসে।
দিনেশ : হেঁই দিপেন ওদিকি দ্যাখ দিনি সুবোধ লবন আনতি যাইয়ে ফিরিছে নাকি? যা যা জলদি যা তরকারীতে লবন কম হইছে!
ক্লান্ত হরিপদ ফেরে হরিপদ ফিরে আসে আনন্দকে না পেয়ে। সুবোধ তার সঙ্গে।
মঙ্গল : কিরে পাইছিস আনন্দ ঠাকুরের খবর?
হরিপদ : নাহ।নেই।গেলো ছয়মাসে কেউ দেখিনি এদিকি।
মঙ্গল : আপদের সময় এরামই হয়।উনার আর কী দোষ।সবাই যারে চায়, সে কি কারোর থাহে? আমি বিপদে এহন তাই খোঁজ করতিছি নালি কি খোঁজতাম?
হরিপদ : উনি জ্যান্ত না মরা সেইটেও বুঝি না।জন্মের থে শুনতিছি উনি উনার পাল নিয়ে মাঠে।জীবনে একবার ফিরতি দেখলাম না।মাঠে মাঠেই দেহাদেহি।
দিনেশ : কিন্তু আমাগের কী হবে? পাল বাঁচাবো কিরাম কইরে? মহাজন তো ছাড়বে নানে।
মঙ্গল : নে খায়েদায়ে গোছায় ফেলা সব।সকালে বাথান এহেন থে তুইলে অন্য যায়গায় নেবো।
হরিপদ : দে ভাত দে সুবোধ।সারাদিন হাইটে দোম ফুরোয় আইছে।
সুবোধ থালে থালে ভাত বেড়ে দেয়।ট্যাংরা মাছের ঝোল দিয়ে দেয় ভাতের উপর।একটা পেলাস্টিকের বোতলে লবন এগিয়ে দেয়।ডালের হাঁড়িটা মাঝখানে রেখে দেয়।সবাই ভাত মাখতে থাকে।সপ সপ শব্দে হরিপদ খাওয়া শুরু করে। দিপেনের মনটা খারাপ।মঙ্গল চিন্তিত চোখেমুখে অন্যদের ভাত মাখা দেখে।
১৩
যারে আমি দেখতে চাই
সে-তো থাকে দূরে,
জপি তারে গানে গানে
তার বান্ধা সুরে!
মঙ্গলের ঘরে তার একমাত্র বিধবা মেয়ে শিখা তার বাচ্চা মেয়ে মায়াকে নিয়ে থাকে।আজ মায়াকে তার কাকা নিতে এসেছে।মায়াকে তৈরি করে দিচ্ছে শিখা।চুল বেঁধে দিচ্ছে।
শিখা : ঠাকুরদার বাড়ি যাইয়ে ভালো মতন থাইকেনে মনা।কান্নাকাটি করবানা কলাম? ওডা তোমার বাড়ি।আর রাস্তায় কাকারে জ্বালাবা না। অল্পেট্টু সময় লাগবে যাতি।ভ্যানে উঠলিই ভুস কইরে তোমার বাবার গিরাম।
মায়া : তুই যাবি না মা?
শিখা : উঁহু।পরে যাবো, যহন তুই বড় হবি তহন।
মায়া : তালি আমি যাবো না।
শিখা : যাও নালি কাকা রাগ করবেনে। ঠাকুরদা কানবেনে। ওখেনে কত মজা হবেনে। ম্যালা খাওয়াদাওয়া আজকেরে ঐ বাড়িতে। যাও ঘুইরে আসো।এট্টা মাত্তর রাইত তো।কাল্কে দুফুরে কাকা দ্যে যাবেনে।ঠাকুরদার তোমার জন্যি বুক পুড়তিছে না? কত ভালোবাসে তোমারে সে।
মায়াকে নিয়ে বের হয়। বারান্দায় বসে থাকা তার দেবর বাসুর হাতে তুলে দেয়।
বাসু : তায়োই আস্পে নাকি শিগগির বউদি?
শিখা : নাহ। সে কী পাল ফেইলে ফেরার মানুষ? আগে দেখিছি মা বাইচে থাকতি আসতো। তারপর আর না।
বাসু : টাকাপয়সা লাগ্লি জানাইয়েনে আমারে। দাদা মইরে গেইছে বইলে তো আমরা পর হইয়ে যাই নি।
শিখা : ছি ছি তা হবা ক্যান ঠাকুরপো? আর টাকা-পয়সা লাগবে না, বাবার সে সবে খিয়াল অনেক।
বাসু : তোমারে তো বলিছিলাম তোমার নিজের ঘরে থাকতি।তাও থাকলা না বাপের বাড়ি চইলে আইসলে। মাইয়েডারে আমাগে দেখতি ইচ্ছে হয় না?
শিখা : নিয়ে যাও। তোমাগেই তো।
বাসু : তালি উঠতিছি বউদি। কাইল্কেরে দুপুরে দিয়ে যাবা নি। তুমি কলাম গেলি পাত্তা?
শিখা মুচকি হেসে অসম্মতি জানায়। বাসু বেরিয়ে যায় মায়াকে নিয়ে দীপালি এগিয়ে আসে,
দীপালি : বাসু দা না?
শিখা : হয়।
দীপালি : মায়ারে নিয়ে গেলো?
শিখা : হয়।
দীপালি : তুমি আর গেলা না কোনদিন দিদি?
শিখা : তুই কী পাগল হইছিস? ওহেনে গেলি আমি আর বাঁচপো না।মায়া না থাকলি মরতাম কিন্তু ওর এট্টা হিল্লে না কইরে গেলি।
দীপালি : ওরা কলাম মানুষ ভালো।জোর করিনি তোমারে।
শিখা : নাহ।একবার খালি ওগের এক পিসি বলিলো, বাসুরে বিয়ে করতি। তা কি হয়? একসাথে চাড়া খেলতাম, ঘিন্না লাগে না তারে বর ভাবতি?
ঘর থেকে নীলেকে বের হতে দেখা যায় খুব সন্তপর্নে। শিখা আর দীপালি পরস্পরের মুখের দিকে তাকায়।অন্ধকারে মিশে নীলে বেরিয়ে যাচ্ছে।
দীপালি : শুধু তোমারেই দেখলাম আলাদা।ঐ দেহো?
শিখা : নীলে না?
দীপালি : হয়।মহাজনের ছুয়াল সুমিতরে বস করিছে।ডাক পড়িছে মনে হয়।
শিখা কিছু বলে না, ম্লান হাসে ।
কাওড়ামঙ্গল (পর্ব ২) II রোমেল রহমান