অধ্যায় ৫
গ্রীষ্মের মাঝামাঝি সময়। জমি-মাটি-ক্ষেত, সবকিছু চুলোর মধ্যে জ¦ালানীর মতো পুড়ে পুড়ে যাচ্ছে। হামিদা অস্থির হয়েছিল। একবার সে উঠে দাঁড়ায়, আরেকবার বসে পড়ে;আরেকবার সটান হয়ে শুয়ে পড়ে। কিন্তু কিছুতেই শান্ত হতে পারে না। বারবার ঘটি ভরে পানি গিলেও তার অস্থিরতা কাটেনা। বয়সী মহিলারা ওকে মাথায় ভালোভাবে পানি ঢেলে গোছল করার উপদেশ দেয়। কেননা বাচ্চা কখন ভ‚মিষ্ট হবে, তা কেউ বলতে পারে না। আর তখন তো বেশ কয়েকদিনের জন্য হামিদা শয্যা ছেড়ে উঠতেও পারবে না।
প্রত্যেকটা যন্ত্রণার ¯্রােতের সাথে হামিদা আরো বিবর্র্ণ, ফ্যাকাশে হয়ে ওঠে, একসময় ওর মুখটা রক্তশূন্য হয়ে সাদা তুলোর মতো হয়ে যায়। ওকে দেখে রশিদের অবিকল পুরো’র সেই মুহর্তের চেহারার মতো লাগে,যখন রশিদপুরোকে হাতে ধরে, তার ঘোড়ায় উঠিয়ে নিয়ে ঘোড়া ছুটিয়েছিল- একেবারে ধানা পাথরের মতো ফ্যাকাশে-সাদা। সেদিন পুরো’র কান্না তার আত্মা চিরে বেরিয়ে এসেছিল; আর আজ তার রক্ত-মাংসের বেদনায় সে কেঁদে উঠছে।
রশিদ রহিমার মাকে ডাকিয়ে আনে। রহিমার মা আসতে আসতে হামিদার শরীরময় যন্ত্রণার একেকটা ঢেউ ধাক্কা দিয়ে যায়। রহিমার মা এসেই একজন ধাইমা ডাকতে পাঠায়। ধাইমা এসে, মাটিতে একটা পুরোনো মাদুর পেতে সেখানে হামিদাকে শুইয়ে দেয়। নরম বিছানা ছেড়ে শক্ত মাটিতে শুয়ে হামিদার আরো কষ্ট হতে থাকে; হামিদা ব্যথায় গোঙ্গাতে শুরু করে।
রশিদ চৌকাঠে প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে থাকে। ওখান থেকে সে বন্ধ দরোজার ভিতর দিয়ে আসা হামিদার দীর্ঘ, শ^াস আটকে আসা যন্ত্রণার গোঙানি শুনতে পায়। তার শুধু মনে হয় যে, সবটুকু না হোক- হামিদার এই যন্ত্রণার কিছুটাও যদি সে কোনোভাবে নিজের শরীরে নিয়ে নিতে পারতো! কিন্তু কি আর করা- একা একা হামিদাকেই সব কষ্ট, দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।
ধাইমা হামিদার মুখের ওপর বাতাস করতে থাকে। চায়ের চামচে করে রহিমার মা হামিদার মুখে পানি দিতে থাকে। ব্যথায় হামিদাকে তিনবার প্রবল চিৎকার করে উঠতে শোনে রশিদ। এরপর আচমকা নীরবতা ভেঙ্গে একটা সদ্যজাত শিশুর কান্না তার কানে আসে। বুকের মধ্যে দীর্ঘসময় আটকে রাখা একটা শ^াস ছাড়ে রশিদ। অবশেষে যন্ত্রণার অবসান ঘটলো তাহলে। তার মন চায় ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে তার বউয়ের হাত-পা একটুখানি টিপে দিতে, মেয়েটাকে একটু স্বস্তি-আরাম দিতে। সে হামিদার কষ্ট যন্ত্রণা ভুলিয়ে দিতে চায়। আজ পর্যন্ত মেয়েটার জন্য কান্না ছাড়া সে আর কিছুই দিতে পারেনি। কিন্তু রশিদকে অস্থির, উতলা হয়ে উঠোনময় পায়চারী করে বেড়াতে হয়। ধাইমা আর রহিমার মা এখনো যে ভিতরে ব্যস্ত হয়ে আছে।
পলে পলে, মুহুর্তে মুহুর্তে সময় গড়িয়ে যায়, কিন্তু ঘরের ভিতর থেকে আর কোনো আওয়াজ আসে না। রশিদ রীতিমতো ঘাবড়ে যায়। হামিদা কি মারা গেল?
টানা এক ঘন্টা উদ্বেগ-উৎকন্ঠাশেষে দাইমা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে রশিদকে বললো, ‘সুখবর বেটা। তোমার একটা পুত্র সন্তান হয়েছে!’
‘আর, ও কেমন আছে?’ রশিদের মুখ গলে প্রশ্নটা বেরিয়ে যায়। আশ^াসের হাসি দিয়ে ধাইমা বলে, ‘ও ভালো আছে।’এরপর ধাইমা নিজ থেকে বলে, ‘পরিবার বৃক্ষে এভাবেই তো ফল ধরে, বেটা। পুত্র সন্তান কি আর আকাশ থেকে টপকে পড়ে, পড়ে নাকি?’ তার গলায় আশ^স্ততার ছোঁয়া; যায় পরশে শত শত নারী তাদের প্রসব বেদনা কাটিয়ে উঠেছে। রশিদ যখন ঘরের ভেতরে গেল, হামিদা তখন বিছানায় চোখ বন্ধ করে শুয়েছিল। পাশেই সাদা, নরম কাপড়ের মধ্যে তাদের সদ্যজাত পুত্র বুড়ো আঙ্গুল চুষছে। রশিদের মন গর্বে ভরে ওঠে। সে পুরোকে পেয়েছে। পুরো এখন আর তার ভাগিয়ে আনা রক্ষিতা থাকলো না, শুধু ঘরদোর দেখে রাখার বউও না- সে এখন হামিদা, তার পুত্র সন্তানের মা!
রহিমার মার কথামতো রশিদ একরুপির একটা রুপার মুদ্রা আর একদলা গুড় হাতে নিয়ে ছেলের মাথার ওপর দিয়ে ঘোরায়। হামিদার চোখ খুলে যায়, সে তাকিয়ে রশিদকে দেখে। তার দু’চোখ যেন বলছে ‘আর কি চাও কি তুমি আমার কাছে? আমি আমাকে তোমার হাতে তুলে দিয়েছি; তোমাকে একটা পুত্রসন্তানও দিলাম। আর আমার দেবার কি বাকি থাকলো কি?’ চোখে চোখ রেখে এসব কথা যেন বলা হয়ে গেলে,হামিদা চোখ নামিয়ে নেয়।
গরম গুড়ের সাথে বাদামচ‚র্ণ মিশিয়ে,হামিদাকে কয়েক চামচ খাইয়ে দিলে ওর শরীরে কিছুটা বল ফেরে। ও আবার চোখ খোলে। ওর অনুভব হয় যে, ছেলের নরম মুখটা ওর হাতের সাথে লেগে আছে। পুরোর শরীর জুড়ে অদ্ভুত এক কাঁপুনি খেলে যায়- যেন নরম সাদা একটা পোকা ওর শরীর বেয়ে উঠে আসছে। হামিদার ঘৃণা লাগে, দাঁতে দাঁত কাটে, তার মনে চায় পোকাটাকে হাত থেকে ঝেড়ে ফেলে দিতে, তারপর ওটাকে আঙ্গুলে তুলে দূরে ছুঁড়ে মারতে…. এমনভাবে, এমনভাবে…. যেভাবে বিঁধে যাওয়া কাঁটাকে দুই আঙ্গুলে তুলে ছুঁড়ে ফেলা হয়, যেমনটা কামড়ে ধরা গোখরাকে একটানে ছাড়িয়ে নিয়ে দূরে ছুঁড়ে মারা হয়; বা কামড়ে বসে রক্ত চুষতে থাকা জোঁকের পেট গালিয়ে দিয়ে আলাদা করে ফেলা হয়….!
অধ্যায় ৬
রহিমার মা’র ওদের ঘরে একটানা তেরো দিন থাকার কথা। কিন্তু হামিদার ছেলে হয়েছে সবে মাত্র চারদিন হয়েছে। পাঁচ নম্বর দিনে হামিদার স্তনে স্তন্যধারা শুরু হলো। এই কয়দিন দাই তুলোয় দুধ নিয়ে,চিপে চিপে,ফোঁটায় ফোঁটায় বাচ্চাকে খাইয়েছে। আজ দাই হামিদার ছেলেকে মায়ের স্তনের সাথে লাগিয়ে দিলো। ছেলেটা হামিদার কোলের মধ্যে, শরীরের সাথে লেপ্টে-মিশে ছিল। হামিদা তার শরীরের ভেতরে এক ধরনের খিঁচুনী অনুভব করে। তার মন চায় ছেলেটাকে তার মুখের সাথে লাগিয়ে মন-প্রাণ জুড়িয়ে কাঁদে। তার ছেলে তারই রক্তে তৈরি একটা পুতুল, তারই মাংসপিন্ড দিয়ে, তিলে তিলে তৈরি হওয়া একটা জীবন্ত মূর্তি। এই বিশ^চরাচরে, এইজগত-সংসারে এই ছেলেই তার একমাত্র আপন। সে আর কখনো তার মায়ের মুখটা দেখতে পাবেনা, বাবার দেখা পাবে না; নিজের ভাইবোনদের সাথেও এইজনমে আর দেখা হবে না…. সে শুধু তার ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকবে- যার রক্তের মধ্যে হামিদার নিজের বাবা-মায়ের রক্তও মিলে-মিশে আছে। ওর বাবা, মা তো ওকে শিকড় উপড়ে ফেলে রেখে গিয়েছে, কিন্তু ওর শরীরে বহমান রক্তকে কিভাবে ওরা আলাদা করবে? ওর ছেলের শরীরে তাদের রক্তকে কিভাবে আলাদা করবে?
বাচ্চা হামিদার স্তন্যপান করতে থাকে। হামিদার মনে হতে থাকে যে, ছেলেটা তার শিরা থেকে জবরদস্তি স্তন্য টেনে টেনে, চুষে নিচ্ছে।
জবরদস্তি! হ্যাঁ জবরদস্তিই তো। ওর বাপও তো তার সাথে জবরদস্তিই করেছিল। এই ছেলেও তো তার বাপের বেটা! আপন বাপের রক্ত, আপন বাপের মাংস। জবরদস্তি করেই তো ছেলের বীজ ওর মধ্যে ভরে দেওয়া হয়েছিল! জবরদস্তি করেই ওর পেটে পেলে-পুছে বড় করতে হলো। আর এখন সেই ছেলে জবরদস্তি তার স্তন থেকে দুধ টেনে টেনে নিচ্ছে!
হামিদা নিজের মাথাটা স্পর্শ করলো। আগুনে পুড়তে থাকা ইটের মতো ওর মাথাটা গরম হয়েছিল। মনে হয় ওর জ¦র এসেছে। হামিদা ভাবতে থাকে তার এই ছেলে, এর বাপ,মর্দ, সারা পুরুষজাতি- সবাই নারীর শরীরকে কুকুরের হাড্ডি চোষার মতোচোষে, ভোগ করে। ছেলেটা হামিদার দুধ খেতে থাকে। আর হামিদার মন কুয়োর চাকায় আটকানো বালতির মতো একবার ভরে উঠতে থাকে, আরেকবার খালি হতে থাকে। আর এই ভালোবাসা,এই ঘৃণা, এই প্রেম…. এই প্রেম-ঘৃণা-ভালোবাসার মধ্য দিয়েই হামিদার ছেলেটা জন্ম নেয়…. আর জন্ম নেয় হামিদার হৃদয়ে তার স্বামী রশিদের জন্য ভালোবাসা।
হামিদার গোলগাল ছেলেটাকে সবাই জাভেদ বলে ডাকতে শুরু করে। সুতোর কাপড়ে মোড়া ছেলেকে হামিদা দেখতে থাকে। পা দিয়ে লাথি দিয়ে দিয়ে এতটুকুন ছেলে গায়ের ওপরের চাদর ফেলে দিতো।হামিদা ছেলের দুই পায়ে রুপোর পাতলা নুপুর পরিয়ে দেয়। জাভেদ যখন পা দাপাতো, বিছানা থেকে নুপুরের হালকা ‘ছান ছান’ আওয়াজ পাওয়া যেত। মাঝে মাঝে চিৎকার করে কান্না করতে করতে ওর মুখটা একেবারে লাল হয়ে যেতো, হিঁচকি উঠে যেতো। হামিদা তখন ছেলের ফর্সা ফর্সা, ফোলা দুটো হাতের তালু দেখতো; একেবারে মোমের পুতুলের মতো ভরা ভরা, মসৃণ। ঠিক সেই পুতুলটার মতো-ছোটবেলায় সিয়াম থেকে আসার পর, কোলকাতার এক বাজার থেকে পুরো’র বাবা ওকে যে পুতুলটা কিনে দিয়েছিল। সেই পুতুলটাকে নিজের ক্রুসে বুনে একটা জামা পরিয়েছিল সে; ছোট ছোট মুক্তো সুতোয় গেঁথে পুতুলের গলায় মালা পরিয়েছিল। জাভেদের হাতও সেই পুতুলের মতো তুলতুলে। মোমের সেই পুতুল মনে হয় আজো অক্ষতই আছে, কে জানে। হামিদা ভাবে, মাঝে মাঝে মাটির আর কাঁচের তৈরি জিনিষের জীবনও কি অদ্ভুত লম্বা হয়ে যায়!হয়তো হামিদার ছোটো কোনো বোন এখন ঐ পুতুলটা নিয়ে খেলা করে।
আবহাওয়া দিন দিন ঠান্ডা হয়ে আসে। শীতল বাতাস একটুখানি চিমটি কেটে শীতের আগমনী জানান দিচ্ছে। ভোরের আগে আগে, মুখ দেখা যায় না এমন অন্ধকারে,হামিদা প্রাতঃকৃত্য সারতে ক্ষেতের মধ্যে যেতো। ঐ সময়টাকে সে তার অভ্যেস করে নিয়েছিল। রশিদ তখন ঘরের দাওয়ার ওপর বসে থাকতো। এরকম অন্ধকারে একদিন হামিদা ক্ষেত থেকে ফিরছিল। পথে মুসলমানদের ব্যবহার করা কুয়ো থেকে পানি তুলে, হাত-পা ধুয়ে ঘরে ফেরার সময়, সে তার নিজগ্রামের, বাপের বাড়িরএকই গলিতে, একদাবাস করা এক কিশোরী মেয়ে, কাম্মো’কে দেখতে পেলো। কাম্মো কুয়োর বাঁধানো প্রাচীরের ওপর ভরা কলসিটা রেখে একটু জিরিয়ে নিচ্ছিল। হামিদা যখন মেয়েটার পাশ দিয়ে এগোতে লাগলো, কাম্মো তখন হালকা শীতের কাঁপুনিতে, কাঁপতে কাঁপতে কলসটা তুলে নিল।কলসের ভার ওর কাঁধ নিতে পারলো না বলে মনে হলো;কলসটা আস্তে আস্তে ছলকে নীচের দিকে নেমেআসতে লাগলো। কলসের নীচে রাখা ডান হাতটাও কলসির ভারে নীচে নেমে আসতে থাকে। অস্ফুট শব্দে কাম্মো ‘উই মা!’ বলে ওঠে।হামিদা কাম্মোর কাছে এগিয়ে যায়। তার মনে চাইছিল বারো বছরের এই দূর্বল, ক্ষীণাঙ্গী মেয়েটার কাছ থেকে ভরা কলসটা নিজের কাঁধে তুলে নেয়। কিন্তু সে ইতস্তত মনে দাঁড়িয়ে থাকলো। এর মধ্যে এক ঝটকায় কাম্মো কলসিটা ওর মাথার ওপর উঠিয়ে নিতে পারে। দু’জনেই এবার বাড়ীর উদ্দেশ্যে পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করে। হামিদা খেয়াল করে দেখলো, কাম্মো সেই আগের মতোই আছে; খালি পা, মোটা সবুজ খদ্দরের সালোয়ার, গলার কাছে ফেঁসে যাওয়া ডুরে জামা, তার ওপর আবার অনেকগুলো তালি-তাপ্পি মারা। ওর ওড়না এখন একটা ছিন্ন ন্যাকড়ার চেহারা নিয়েছে। এলোমেলো, উসকো-খুসকো মাথার চুল কাম্মোর মুখটাকে প্রায় ঢেকে ফেলেছে। আগেও দূর থেকে সে কাম্মোকে ওভাবেই দেখেছিল, ওকে ডেকে কখনো দু’একটা কথা বলতেও হামিদার কখনো ইচ্ছে হয়নি। অথচ আজ, মেয়েটার কাঁধ থেকে পানির ভারী কলসিটা নিজের কাঁধে নিতে মন চাইছে তার। কাম্মোর কাঁধের ছোট হাড় পিতলের কলসের চাপে পিষ্ট হাচ্ছিল।
‘আজ বড্ড দেরী হয়ে গেল,’ কলসির নীচে চাপা পড়া কাম্মো বলে ওঠে। যেন সে আসলে অন্যের মুখ থেকে শুনে আশ^স্ত হতে চাইছে যে, না; আসলে খুব একটা দেরী তার হয় নি।
‘ভোরই তো এখনো শুরু হয়নি,’হামিদা আশ^স্তির ভঙ্গিতে বললো। তার এই কথায় আশ^স্ত হয়ে কাম্মো, ভরা কলসি মাথা থেকে নামিয়ে মাটির ওপর রাখলো। হামিদাও থেমে গেল। কলসি থেকে পানি কিছুটা ছিলকে কাম্মোর কাঁধের ওপর পড়লো। ফেঁসে যাওয়া জামার আবরণ ভেদ করে ঠান্ডা পানি ওর শরীর স্পর্শ করলেকাম্মোর শরীরজুড়েঠান্ডার একটা কাঁপুনি উঠে গেল। সেহামিদার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললো। এই এক মুহুর্ত আগেও মেয়েটা দেরী হয়ে যাবার ভয়ে ভীত ছিল, ভরা কলসির চাপে ক্লিষ্ট হয়ে ছিল। এখন, এই প্রথমবারের মতো মেয়েটাকে হামিদা হাসতে দেখলো। দেখে মনে হলো, মেয়েটা মনে হয় হাসতে পারে না, জোর করে হাসার চেষ্টা করছে।
‘কাম্মো, তুই রোজ এই সময়েই এদিকে আসিস?’হামিদার বাপের বাড়ির গলিতে কম্মো’কে বিভিন্নজনের ডাকাডাকির ফলে ওর নামটা হামিদার জানাছিল।
‘আজকে আমার মনে হয় একটু দেরীই হয়ে গেছে; ঘরে ফিরলে নির্ঘাত মার খাবো,’ বলে কাম্মো কলসিতে আবার হাত রাখে। ততক্ষণে কাঁচা রঙের মতো ওর মুখের হাসিটা উবে গিয়ে, পুরোনো সেই ভয়ার্ত মুখটা ফিরে এসেছে।
‘কাম্মো, ঐ বুড়ি তোর কি হয়, রে?’
‘কাকী….’ বলতে বলতে কাম্মোর কলসি কাঁধ থেকে পিছলে হাতের ওপর চলে আসে। তা, কলসির ভারে, না ‘কাকী’ বলায় ঘটনাটা ঘটল, ঠিক অবশ্য বোঝা গেল না।
‘তুই চাইলে আমি কিন্তু তোর কলসি বয়ে দিতে পারি,’হামিদা বললো বটে, কিন্তু হাত আগে বাড়ালো না। কেননা হামিদার এই জ্ঞান খুব ভালোভাবে ছিল যে, লোকজন তার নাম জানে হামিদা, হামিদা- রশিদের বিবি। আর কাম্মো একটা হিন্দু মেয়ে।
‘কলসিটাই তাহলে অশুচি হয়ে যাবে,’বিনাসংকোচে কাম্মো বলে ফেলে।
‘পানি অশুচি হবে না, আমি পানি স্পর্শ করবো না। আর তুই কলসিটা তো পরে বাইরে থেকে মেজেও নিতে পারবি,’ বলতে বলতে হামিদা হেসে ফেলে। কাম্মোও চাপা হাসি হাসে। কিন্তু সে তার কলসী হাতছাড়া করে না; দুজনেই হেঁটে এগোতে থাকে। কয়েক কদম যেতে না যেতেই কাম্মো একটা হোঁচট খায়। হামিদা কলসিটা ধরে সামলে নিতে পারলেও কাম্মো পাথুরে মাটির ওপর পড়ে গিয়ে পায়ে ভীষণ চোট পায়। হামিদা কলসি একপাশে নামিয়ে রেখে,কাম্মোর পায়ের পাতা গোড়ালি পর্যন্ত ভালো করে টিপে-ঢলে দেয়। ব্যথা দ্রæত কমে গেলে কাম্মো উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে। হামিদা কলসিটা কাঁধে তুলে নিয়ে পাশাপাশি হাঁটতে থাকে। কয়েক কদম পরপর ওর ব্যাথা টনটন করে উঠলে কাম্মো, ‘উই মা’ বলে উঠতে থাকে। হামিদার মনে হয় যে, কাম্মো তার সব দুঃখের দায়ভার ওর মরা মায়ের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে।
হামিদা কাম্মো’র কাকী’কে অনেকবার গজগজ করে শুনেছে ‘পয়দা করে আমাদের ঘাড়ে ফেলে চলে গেছে।’ কাম্মোর বাবা-মা কেউ ছিল না। বাবা হয়তো ছিল, তবে ওর মা মরে যাবার পর বাবা আরেকটা বিয়ে করে শহরে চলে যায়। মেয়ের কোনো খোঁজখবর পর্যন্ত করে না। হামিদার ভাবনা হয়- যখন মা মরে যায়, তখন বাবাও আর আপন থাকে না, পর হয়ে যায়। ভাবতে ভাবতে হামিদার ভাবনা অন্যদিকে চলে যায়। মা জীবিত থাকার পরও তো পিতা পর হয়ে যায়! আর বিধবা না হয়েও, মাও তো পর হয়ে যেতে পারে!
অধ্যায় ৭
পূবের আকাশ কালো থেকে ধূসর হতে শুরু করেছে। বাড়িঘর, গলিপথ, রাস্তার আবছা রেখা দেখা যাচ্ছিল। হাঁটতে হাঁটতে দু’জন রাঁস্তার বাঁকে এসে দাঁড়ায়। দু’জনের মনেই তখন এই ভয় যে, কেউ হামিদার কাঁধে কাম্মোর কলসি না দেখে ফেলে। কাম্মো কলসি তুলতে গেলে ওর পা দু’টো কাঁপতে থাকে। হামিদা জোর কদমে এগিয়ে নিজের গলিতে বাঁক নিয়ে দেয়। কাম্মো ধীরপায়ে আরেক গলিতে কাকীবাড়ীর দিকে এগোয়।
সেদিন দুপুরে হামিদার ছেলে জেদ ধরেই কান্নাকটি করছিল, হামিদা ছেলেকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করছিল। এমন সময়, অর্গল না দেওয়া বাইরের উঠোনের দরোজা ঠেলে কাম্মো ভেতরে ঢুকে পড়লো। হামিদা এগিয়ে গিয়ে কাম্মোকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে। তার মনে হলো যে, ছেলেকে ভোলানোর চাইতে এখন কাম্মোকে স্বান্তনা দেওয়াটা বেশি জরুরী। কাম্মোর চোখের পানি মোছার কেউ নেই; ওর চোখে দিয়ে টপটপ করে পানি হামিদার হাতের ওপর পড়তে থাকে। হামিদার মধ্যে মাতৃত্ব জেগে ওঠে। মনের মধ্যে তার মুহুর্মুহু মনে হতে থাকে যে, জাভেদের মা’র মতো সে কাম্মোরও মা হয়ে যায়। কাম্মো হু হু করে কাঁদতে থাকে। হামিদা ওকে প্রায় কোলে করে কিছুক্ষণ হেঁটে ফেরে, দুই হাতের বন্ধনে আঁকড়ে রাখে, বারবার কপালে চুমু দিতে থাকে। সেই মুহুর্তে তার দুনিয়ার সব অনাথের মা হয়ে উঠতে প্রবল আকাঙ্খা জাগে। মনে হয়, ভালো মেয়ে হয়ে উঠতে পারিনি ঠিক আছে, ভালো একজন মা তো অন্তত হতে পারি।
কিন্তু কাম্মো হিন্দু ছিল আর হামিদা-হামিদা একজন মুসলমান। সে খুব ভালো করে জানে যে, কাম্মো তার বাড়িতে কিছুই খেতে পারবে না, এমনকি পানিও না। কিন্তু হামিদার মন চাইছে কাম্মোকে নিজ হাতে খাওয়ায়, মুখে তুলে দেয়। সে দুধের বাটি ধরে রাখবে আর কাম্মো সেটা চুমুকে চুমুকে খাবে।
হামিদা আবার কাম্মোর পা টিপে দেয়; গরম ঘি দিয়ে টেনে টেনে মালিশ করে দেয়। তুলোর দলা গরম করে সেঁক দিয়ে দেয়। এদিকে, আচমকা কাম্মো অস্থির হয়ে ওঠে, ঘরে ফেরার তাড়া করে। কাকির হাতের লম্বা ঝাঁটাটা ওর চোখের সামনে কুড়ালের মতো নাচতে থাকে।কাম্মো সেলাইয়ের জন্য সুঁই নেবার বাহানা করে হামিদার বাসায় এসেছে। হামিদা ওকে বাদামমিশ্রিত গুড় খাওয়ায়, আর ঘরের ভেতর থেকে সুঁই এনে ওর হাতে দেয়।
বাতাসে দিন দিন শীত প্রকোপ বেড়ে চলেছে। লোকজন গায়ে মোটা কাপড়-চোপড় চাপাতে শুরু করে দিয়েছে, কালো মোটা ফতুয়া সেলাই করিয়ে নিচ্ছে। কাম্মোর শরীরে অপুষ্টির ষ্পষ্ট ছাপ দেখা যায়। না ওর শরীরে যৌবন প্রস্ফুঠিত হয়, না ওর শরীরে পরিষ্কার নতুন পোশাক দেখা যায়। গ্রীষ্মে কি শীতে, সেই সবুজ খদ্দেরের ফেঁসে যাওয়া জামা তার পরনে থাকে। আর সেইসাথে পা দু’টো সব সময়ের জন্য খালি। হামিদা ওকে একজোড়া চপ্পল দেয়। কিন্তু সেটাও ওর পায়ে তোলা খুব কঠিন হয়ে দাঁড়ালো। অনেক চিন্তা-ভাবনা করে হামিদা চপ্পলজোড়া কাম্মোর পায়ে পরিয়ে দিতে পারলো। কাম্মো বাড়ীতে তার কাকীকে বললো যে, জুতোজোড়া সে বাড়ির সামনের আখ-বাগানের মধ্যে পরিত্যাক্ত অবস্থায় পেয়েছে। কাকী তার কথা বিশ^াস না করে বললো, ‘গ্রামে এমন কে আছে যে তার নতুন চপ্পলটা ক্ষেতের মধ্যে ফেলে রেখে আসবে, হ্যাঁ?’ অবশ্য এরপর কাকী ওকে আর কিছু না বলায়,কাম্মো নিয়মিত চপ্পল পায়ে দিতে লাগলো।
কিন্তু প্রতিদিনতো আর নতুন নতুন জিনিস পড়ে থাকা মেলে না। হামিদা কাম্মোর বেরিয়ে পড়া হাড়গোড় দেখে কষ্ট পায়। রাতের শেষভাগে, ভোরের আগে আগের ঐ ক্ষণটুকুই শুধু একথা জানতো যে, হামিদা মাঝেমাঝেই কম্মো’র দুই একটা কলসি নিজ কাঁধে তুলে নিয়ে দুর্বল মেয়েটাকে কিছুটা রেহাই দিতো। কাম্মো বিভিন্ন ছুঁতোয়, দিনে এক-দুইবার হামিদার বাড়িতে চলে আসতো। কখোনো চাক্কিতে মোটরদানা পেষার জন্য, কখোনো বা হামানে মসলা কোটার জন্য। হামিদা ওর কাজে সাহায্য করতো। কাকীর কতগুলো কাজ এভাবে সহজে হয়ে যেতো। ছোট্ট জাভেদ কাম্মোকে চিনে উঠতে শুরু করে। কাম্মো যেদিন যেদিন আসতে পারতো না, হামিদা তার ছেলে জাভেদের হয়ে কাম্মোকে বকে দিতো।
হামিদা আর কাম্মোর মধ্যে মা-মেয়ের সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেল। আবার দুই সখীর মতো ওরা দু’জন গায়ে গায়ে লেগে বসতো। হামিদার মাঝে মধ্যে ওর জন্য কিছু একটা বানিয়ে দিতে মন চায়। মেয়েটার হাড্ডিসার শরীর একটু একটু করে ভরে উঠতে শুরু করেছে। ওর দেবে বসা গালদুটো গোলগোল আর গোলাপী হয়ে উঠছে। কাম্মো এবাড়িতে এসে ওর চুল ভালো করে ধুয়ে নিতো। হামিদাওকে সাহায্য করতো। এরপর,হামিদা ওর চুলে ভালোকরে তেল মাখিয়ে দিয়ে, চুলে বেনী করে দিত।
একদিন ভোরের আগে আগে মুখ দেখতে না পাওয়া অন্ধকারে, কাম্মো হামিদাকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কাঁদতে শুরু করে। হামিদা কাম্মোর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখতে চেষ্টা করে, রস নিংড়ে নেওয়া লেবুর মতো অবস্থা ওর। হামিদা ওকে বুকের ভেতরে টেনে নেয়, কপালে চুমু দিয়ে দিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করে। কিন্তু কাম্মোর কান্না কিছুতেই থামে না। ওর অশ্রæতে হাত আর ওড়না ভিজে যায়। কাঁদতে কাঁদতে, হেঁচকি তুলতে তুলতে কাম্মো কোনোমতে বলে, ‘কাকী বলেছে যে, আমি যদি আর তোমার বাড়িতে কখনো যাই, তাহলে আমাকে একেবারে খুন করে ফেলবে।’ কাম্মো হামিদার বুকের মধ্যে অঝোরে কাঁদতে থাকে। হামিদা এই মেয়েটার সহায় হয়ে উঠেছে। আর কেউ যেন কাম্মোর হাত টেনে ধরে সেটুকু সহায়ও কেড়ে নিতে চাইছে।
হামিদা মুখ ফুটে এতটুকু বলতে পারলো, ‘কিন্তু কেন? আমি আবার কি করলাম?’
শ্বাস বারবার আটকে যেতে যেতে কাম্মো বললো, ‘কাকী বলেছে যে, তুমি নাকি ঘর থেকে পালিয়ে এখানে চলে এসেছো, আর তোমার মতো আমিও নাকি একদিন কারো সাথে ভেগে যাবো।’
মাটির খেলনার ভেঙ্গে পড়ার মতো হামিদা টুকরো টুকরো হয়ে যায়। বুকের মধ্যে ভয়ানক খাঁমচি-কামড়ের কষ্ট তাকে উথাল-পাথাল করে তোলে।
সূর্য আস্তে আস্তে করে ভোর নিয়ে আসে…. ভোরের আলো উজ্জ্বল থেকে উজ¦লতর হয়। কাম্মোর সাথে আপাততঃ তার ঐ শেষ দেখা।
পিঞ্জর (পর্ব ৪) // অমৃতা প্রীতম, অনুবাদ: জাভেদ ইকবাল