শঙ্করীপ্রসাদ বসু ‘মধ্য যুগের কবি ও কাব্য’, ‘চন্ডীদাস ও বিদ্যাপতি’, ‘লোকমাতা নিবেদিতা’, ‘বিবেকানন্দ ও সমকালীন ভারতবর্ষ’- এমনি গুরুগম্ভীর বিষয়ের খ্যাতিমান লেখক ও অধ্যাপক। ক্রিকেট লেখা তাঁর উপরে কেমন করে ‘ভর’ করেছিলো সে-এক বিস্ময়। তাঁর লেখা সাতটি ক্রিকেট গ্রন্থ এবং ‘সুর ও নৃত্যের উর্বশী’ লেখকের দ্বিতীয় সত্তার প্রতিষ্ঠা করেছে। শুধু দ্বিতীয় সত্তা কেন বাঙালীর আনন্দলাভের দুর্লভ সংস্কৃতির দিক উন্মোচিত ও উচ্চকিত হয়েছে। ১৯৬০ থেকে ১৯৬৭ এবং পরে ১৯৭৬ পর্যন্ত তাঁর লেখা ‘ইডেনে শীতের দুপুর’ (১৯৬০), ‘রমণীয় ক্রিকেট’ (১৯৬১) ‘বল পড়ে ব্যাট নড়ে’ (১৯৬২), ‘ক্রিকেট সুন্দর ক্রিকেট’ (১৯৬৩) ‘নট আউট’ (১৯৬৫), ‘লাল বল লারউড’ (১৯৬৭), এবং ‘সারা দিনের খেলা’ (১৯৭৬)- এই সাতটি ক্রিকেট ক্লাসিকের যে কোনোটিই পড়তে থাকলে ঐন্দ্রজালিক কথোপকথন, দুর্লভ বাশক্তি, চাতুর্যপূর্ণ লেখার শক্তি ও মনোময় বর্ণনা পাঠককে নিমেষে আচ্ছন্ন করে ফেলবে (যেমন হয়ে থাকে উচ্চতর প্রতিভাবান গায়ক গায়িকার উচ্চতর রীতির গান শুনে)। স্বচক্ষে দেখা বা শোনা ক্রিকেট খেলা, খেলোয়াড়দের চরিত্র, ক্রিকেট-ঘটনা পাঠকের হৃদয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠবে এবং বিমূর্ত ভাব সৃষ্টি করবে। পাঠকের সৌভাগ্য, বৈষ্ণব সাহিত্যের অধ্যাপকের কাছ থেকে জীবন থেকে টেনে আনা চরিত্র নির্মাণ করে অন্তরঙ্গ অনুভূতি দিয়ে ক্রিকেটের বহু চরিত্র ও ঘটনাকে অনুপম সাহিত্য মাধ্যমে পড়তে পেরেছেন। সংস্কৃতিবান বাঙালী ক্রিকেট অনুরাগী সন্ধান পেয়েছেন অবিশ্বাস্য আনন্দলাভের এক দুর্লভ উৎস। ক্রিকেট অনুরাগীদের মধ্যে যাঁরা সমাজ সচেতন, সংস্কৃতিবান ও মননসমৃদ্ধ মানুষ এবং সকল ঘটনা বিশ্লেষণধর্মী মন দিয়ে দেখে থাকেন এবং সঙ্গীত, সাহিত্য ও ক্রীড়া দিয়ে অবিমিশ্ররূপে মন তৈরী, তাঁদের কাছে শঙ্করীপ্রসাদের ক্রিকেট গ্রন্থগুলো মূল্যবান দলিল ও অমূল্য শিল্পকর্ম বলে বিবেচিত হবে। বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির গভীরতর বিষয়কে ধারণ করতে পেরেছেন বলেই শঙ্করীপ্রসাদের ক্রিকেট লেখা শীলিত, আলোকিত ও বর্ণাঢ্যময় এবং বাংলা সাহিত্যের অবিচ্ছেদ্য বিষয় হিসাবে উত্তীর্ণ। তাই তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘ইডেনে শীতের দুপুর’ প্রকাশিত হওয়ার পর পরই আনন্দ বাজারে (৫.১২.৬০) নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী লিখেছেন ‘ক্রিকেট বিষয়ে বঙ্গভাষায় এটি প্রথম না-হোক প্রথম সাহিত্যগ্রন্থ।’ মাসিক বসুমতীতে (পৌষ ১৩৬৭) বলা হয়েছে, ‘বইটির অন্যতম প্রধান গুণ এর ভাষা। এমন দীপ্ত উজ্জ্বল তীক্ষ্ণ ও সরসগদ্য অল্পই দেখা যায়, যে কোনো বিষয়কে গৌরবান্বিত করার যোগ্য গদ্য। লেখক প্রচুর অজানিত আকষর্ণীয় তথ্য নিপুণভাবে বিন্যস্ত করেছেন। তার লেখা কতগুলি স্কোরের সংকলন না-হয়ে উন্মোচন করেছে ক্রিকেটের ব্যক্তিত্বকে। নিঃসন্দেহে বাংলায় লেখা এইটিই ক্রিকেটের প্রথম সাহিত্য গ্রন্থ।” লেখকের সকল গ্রন্থ সম্বন্ধেও একই কথা বলবো। যদিও ‘রমণীয় ক্রিকেট’, ‘নট আউট’ আর ‘লাল বল লারউড’ সার্বজনীন আবেদন নিয়ে সর্বকালের ক্রীড়া সাহিত্যে অমর গাথা হয়ে থাকবে।
ক্রীড়া সাহিত্য, ক্রিকেট সাহিত্য বহু অর্থবোধক। আর্থার হ্যাগার্থ অবর্ণনীয় শ্রম দিয়ে দীর্ঘ সময়ে ১৫ খন্ডে Scores and Biographies (১৭৪৬-১৮৭৮) সংকলন করে গিয়েছিলেন।
জন নাইরেন লিখেছিলেন কোচিং ক্লাসিক Young Cricketers Tutor (১৮৩৩)। ডেনিস ক্রিকেটারদের জীবন চরিত ও টেকনিকের কথা লিখতে গিয়ে প্রকাশ করলেন Sketches of Players (১৮৪৬) এবং জন উইজডেন ১৮৬৩ সালে প্রকাশিত করলের বিস্ময়কর বার্ষিকী Wisden Cricketers Almanac যা অবিচ্ছিন্নভাবে আজও প্রকাশিত হচ্ছে (১৩৯ সংখ্যা চলছে)। এ ক্রিকেট বাইবেল সারা বিশ্বব্যাপী ক্রিকেট অনুরাগীর গভীর আকাক্ষার বস্তু। শিল্প সাহিত্য বা বিজ্ঞান নিয়ে এমনটি দেখা যায়নি। এসবই ক্রিকেট সাহিত্যের অংশ। বিগত শতাব্দীতে ক্রিকেট নিয়ে এমনি সব সুন্দর সাহিত্য প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমান শতাব্দীর প্রথম দশক পর্যন্ত ছবি দিয়ে বড়-বড় মোটা সংকলনও বেরিয়েছে। এর মধ্যে রণজির লেখা Jubilee Book of Cricket (১৮৯৯) এবং সি. বি. ফ্রাই ও জর্জ বেল্ডহ্যাম সম্পাদিত Great Batsmen- Great Bowlers & Fielders (১৯০৫) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
তবে ক্রিকেটে রসময় বর্ণনাত্মক ভাষা নিয়ে ১৯১৯ সালের দিকে যাত্রা আরম্ভ করলেন স্যার নেভিল কার্ডাস মানচেস্টার গার্ডিয়ানে তাঁর কাব্যময় বর্ণনা নিয়মিত ছাপা হতে থাকে। Turn of The Wheel ১৯২৯ প্রকাশ করে টেস্টম্যাচ বর্ণনার ঐতিহ্য সৃষ্টি করলেন পি.জি.এইচ. ফেল্ডার (১ম শ্রেণীর ক্রিকেটে ১৯২০ দ্রুততম শতরানের বিশ্বরেকর্ডের অধিকারী)। নেভিল কার্ডাস না-আসা পর্যন্ত অভিজাত ও উচু মর্যাদার সাহিত্য ক্রিকেটের গায়ে লাগেনি। যদিও লেখালেখি এবং ক্রিকেট গ্রন্থের অভাব ছিলো না। ১৮৯০-১৯১৪ সালের মধ্যে ক্রিকেট ইংরেজ সমাজের শীর্ষস্থানীয় বিষয়- ক্রিকেট তখন ওদের জাতীয় খেলা আর এ সময়কেই ক্রিকেটের স্বর্ণযুগ বলে চিহ্নিত করা হয়। তখন ক্রিকেট হয়ে উঠেছে ইংরেজ সমাজ ও সংস্কৃতির এক সম্পৃক্ত বিষয়। ইংরেজ সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগই ক্রিকেটের স্বর্ণযুগ।
বাংলাভাষায় ক্রিকেট লেখার বিষয়টি ভিন্ন। ১৯২৬ সালে আর্থার গিলিগ্যানের এমসিসি দল ইডেন-গার্ডেনে ভারতের সঙ্গে যখন ১ম বেসরকারী টেস্টম্যাচ খেলছিলো তখনো বাংলাভাষায় ক্রিকেট লেখার খবর পাওয়া যায়। খেলাধূলা নিয়েও ইংরেজীতে লেখারই চেষ্টা। বাংলায় হয়ত দৈনিক কাগজে রিপোর্টিং জাতীয় কিছু লেখা হতো।
বাঙালীদের মধ্যে ক্রিকেট খেলার আবির্ভাব ঘটেছিলো ১৮৬৯ সালের দিকে। ত্রিপুরা রাজ্যে ক্রিকেট ম্যাচ হচ্ছিলো সে বছর। কিন্তু তারও বহু আগে ১৭৯৩ সালের দিকে কোলকাতায় ইংরেজরা গড়ে তুলেছিলো Calcutta Cricket Club। এটি ইংল্যান্ডের বাইরে বিশ্বের প্রাচীনতম ক্রিকেট ক্লাব হিসাবে পরিচিত। পলাশী যুদ্ধের পর কোলকাতাই ছিলো ভারতের রাজধানী। ইস্ট ইন্ডিয়া কোঃ কর্মকর্তা, কর্মচারী ইংরেজরা ইংল্যান্ডের হাওয়াতেই গড়ে তুলেছিলো কোলকাতাকে।
আশ্চর্য হতে হয়, বাঙালীদের মধ্যে ক্রিকেটের দীর্ঘ অস্তিত্ব দেখে। কিন্তু তা সত্ত্বেও বাংলায় না লেখা হলো ইতিহাস, খেলা শেখার বই, না-প্রকাশিত হলো কোন পত্রপত্রিকা। বাঙালী ক্রিকেট অনুরাগীরা নাকি ইংরেজীতেই ক্রিকেট লেখা আরম্ভ করেছিলো। ইংরেজ অনুকরণের বাঙালীর তখন অভাব ছিল না। ফলে বাংলা সাহিত্যক্ষেত্রে কাব্য, উপন্যাস, প্রবন্ধ, ছোটগল্প ও নাটকের যখন সমৃদ্ধ যুগ তখন বিজ্ঞান, সঙ্গীত, চিত্রকলা ও এমনি বিষয়ে দু’একটি আকরিক গ্রন্থ বাদ দিলে বিশেষ কোনো গ্রন্থ ত্রিশের দশকেও অনুপস্থিত। ভাবলে আশ্চর্য হতে হয় মাছ শিকার নিয়ে Complete Angler এর মত ক্লাসিক বই দেড়শো বছর আগেই ইংরেজরা প্রকাশ করেছিলো।
গান, ভ্রমণ, শিকার, ছবি আঁকা ও এমনি বিষয়ে রচনা বহু আগেই ইউরোপীয় সাহিত্যে পাওয়া যাবে। অবশ্য আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্য সমৃদ্ধ। বিশেষ করে সংস্কৃত সাহিত্যে সঙ্গীত, নাটক, রন্ধন শাস্ত্র ও এমনি বিষয়ে বহু প্রাচীন গ্রন্থ ভাস্কর্যের মত দাঁড়িয়ে আছে। আধুনিক কালেও বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান সাহিত্য, সঙ্গীত সাহিত্য, ভ্রমণ, শিকার ও বিভিন্ন ক্রীড়া নিয়ে যা লেখা হয়েছে সে খুবই সীমিত। ক্রিকেট নিয়ে অচিন্ত্যকুমার ত্রিশের দশকে লেখা আরম্ভ করেছিলেন সুমিষ্ট গদ্যে। কিন্তু তাঁর হাতে সে ধারা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। পঞ্চাশ দশকের মধ্যভাগে প্রকাশিত বিনয় মুখোপাধ্যায়ের ‘খেলার রাজা ক্রিকেট’ ও ‘মজার খেলা ক্রিকেট’ কোচিং বই হয়েও অনবদ্য সাহিত্য। কিন্তু এ দুটোর পরে আর তেমন কোন লেখা তখন দেখা যায়নি। বাংলা সাহিত্যের এই পতিত জমিতেই শঙ্করীপ্রসাদ নতুন প্রজাতির সার্থক ফসল আবাদ করেছেন। ক্রীড়া সাহিত্যে নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেছেন। যান্ত্রিক রিপোর্টিং বা কালানুক্রমিক ক্রিকেট ইতিহাস না-লিখে লিখেছেন সমাজের মানুষ আর তার আকাঙ্খীত ক্রিকেট খেলোয়াড়, ক্রিকেটের সুনিপুণ দক্ষতা আর ক্রিকেট উদ্ভুত সকল পরিস্থিতি ও ঘটনাকে নিয়ে। লিখেছেন রসালো রম্যরচনার ঢঙে। প্রকাশিত হয়েছে ক্রিকেটের অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য ও দর্শন। জন্ম হয়েছে সুখপাঠ্য ও সৃজনধর্মী অনুপম সাহিত্য, যে সাহিত্য পাঠে পাঠক বার বার রসে আপ্লুত হবেন। কে বা কারা শঙ্করীপ্রসাদকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিলো এ অনুপম শিল্পকলা নিয়ে লিখতে? গোর্কি ১৯১৬ সালে পেট্রোগ্রাড থেকে রোঁমা রোলাঁকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন অমৃতলোকের সুরকার বিথোভেনকে নিয়ে লিখতে, “শিশুদের জন্যে বিথোভেনের জীবনী লিখতে আমি আপনাকে আহ্বান করছি। আমি চাইছি, একালের শ্রেষ্ঠ লেখকদের অংশ গ্রহণের দ্বারা মানব জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের জীবনকথা অবলম্বন করে শিশুদের জন্যে একটি গ্রন্থমালা প্রকাশ করতে’। শঙ্করীপ্রসাদ বসুকে এমনিভাবে ক্রিকেট লিখতে কেউ অনুরোধ করেছিলেন কিনা তা জানা নেই। তিনি নিজেই হয়ত বাঙালীর বহু দিনের আকাঙ্ক্ষীত বিষয়টি জানতেন। ভাষা লেখার কলাবন্ত হয়েও শ্রীবসু ‘বালক ক্রীড়তিঃ’ বলে অবহেলা করেননি। কেননা, তিনি নিজেই ক্রিকেটকে পেয়েছেন ‘প্রেমে প্রাণে গানে গন্ধে আলোকে পুলকে।’
লেখকের প্রথম গ্রন্থ ‘ইডেনে শীতের দুপুর (প্রকাশ কাল মহালয়া, ১৩৬৭, প্রকাশক-মণ্ডলবুক হাউস, ৭৮/১ মহাত্নী গান্ধী রোড়, কোলকাতা-৯) বেরোনোর পরই পত্রপত্রিকা ও গুণীজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ১৯৬০ সালের ডিসেম্বর ‘আনন্দবাজারে’ ছাপা হলো, ‘স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে, ঘরে বসেই ক্রিকেট খেলা দেখেছি। দেখা সম্ভব হতো না, তাঁর ভাষা যদি না বর্ণনাময় এবং নিখুঁত না হতো। ভালবাসার বস্তুটিকে তিনি প্রাণ দিয়েছেন। দূরের থেকে কাছে টেনে এনেছেন। এ অতি শক্ত কাজ, তাতে সন্দেহ নেই।’ দৈনিক বসুমতী লিখছে, ‘শ্রীযুক্ত বসু তাঁর গ্রন্থের প্রথম অংশে নেভিল কার্ভাসীয় ভঙ্গিতে কয়েকজন খ্যাতিমান বাঙালী ও ভারতীয় ক্রিকেটারের রেখাচিত্র উপহার দিয়েছেন। বাংলা ভাষায় এমন চিত্তচমৎকারী রচনা ইতিপূর্বে পাঠ করার সৌভাগ্য আমার হয়নি।’ ‘বিদেশী ক্রীড়ারসিকদের খেলার উপরে বই আছে, সেগুলোর রস একরকম, এখানে আরেক রকম রস। যাঁরা খেলা জানেন, ক্ষীর-সাগরে ডুবে যাবেন।’
চলবে…