ভুঁইচাপার ঘ্রাণ কাব্যগ্রন্থ থেকে মোস্তফা হামেদীর ১০ টি কবিতা


আভা

মৃত ফুলের ঝাড় থেকে খসে পড়ছে রোদ
এক অনুক্ত দুপুর
মেঘে নিপাট হয়ে আছে;
আমি তার সঙ্গী হই

এক হতশ্রী গাছের মতো বিগত গানগুলি
গেয়ে চলেছি
ডুবে থাকা বিল কিছু ধ্বনির জোগান দিয়ে যায়,

যখন মন্দ্র মুহূর্ত
ছিন্ন কোনো ঋতু ফুরিয়ে এসেছে এখানে,

যেন খসা ফল
স্রোতে বহুদূর ভেসে গেল;

তার আভাটুকু লেগে আছে এই এখানে
পাতায়, ডালে, স্মরণঘরের গোলায়।

───────── ౨ৎ ─────────


ভ্রমর

যেন একটা লাল রেলগাড়ি গাছের ফাঁক বেয়ে
গড়িয়ে যায়
দেখব না কিছুই
গেরস্থালি ভেজা
জারুল ফুল ঝরে-মনভারে
কেউ যদি ভুলে ডাক দেয়
চিকন সুর
ঘোমটার গভীর থেকে
একটা ভ্রমর রেখো,
কবরের ওপর, প্রভু।

───────── ౨ৎ ─────────


শরণার্থী

সমস্ত সংসার ভ্যানে তুলে আকাশের নিচে দাঁড়াই
রোদ তেরচা হয়ে পড়ছে

শূন্যে ভাসমান এই মৃদু ঢেউয়ের ওপর
মনে হয় এই এখনি তলিয়ে যাব

গড়িয়ে চলেছে টায়ারের সরু চাকা
পুলসিরাত পার হচ্ছে যেন
পিছনে স্মৃতির কুঠুরি
শূন্যতার গমগমে বেজে চলা পাখোয়াজ

অদেখার পথে ধীর হাঁটা

চিরকালীন শরণার্থীর মতো কোথাও জানটুকু
কোথাও ছোটো এক ভ্যান
সঙ্গে চলেছে…

───────── ౨ৎ ─────────


গুঞ্জন

ঝনঝন করে ভাঙতে থাকা কাচের বাটির সুর হয়ে বাজতে থাকি
এলোমেলো দুপুর বেলায়

তালাশ করি ভিতরে-

মাটির ঢিবির ভিতর কারা যেন বসিয়েছে
অনুরোধের আসর

পা ছড়িয়ে বসে পড়ি রং মরে যাওয়া স্যান্ডেলের ওপর
টিউন করে শরীরী ট্রানজিস্টারে
নিজেরই গুঞ্জন শুনি,

বিবাদের মাঝখানে একা পড়ে থাকা
নিস্পৃহ ঢিবির পাড়ে বসে।

───────── ౨ৎ ─────────


তুষ্টি

টিলা কখনো পাহাড় পেরোতে পারে না
এই দুঃখ নিয়ে সে বসে থাকে পাদদেশে
ছোটো ছোটো ঘাস, বাদাবন, ভাঁটগাছ,
কোমল বৃষ্টিফোঁটা দিয়ে
নিজেকে সাজায়

নিজস্ব একটা টিলার ওপর বসে
আমি ছিপ ফেলছি
ছোটো ঝিরিতে

যা পাই তা দিয়েই হাঁড়ি চড়ে
পাতা চুঁইয়ে আসা রোদ
লতায় ঝুলে থাকা মিষ্টি আলু
লাল মাটির ছড়া
কাঁচা লবঙ্গের ঘ্রাণে মিশ্রিত বাতাস
গুলে খাই

আমার হয়ে যায়

পাহাড় পেরোতে পারি না বলে
আমি নিজেকে কখনো দুঃখ দেইনি।

───────── ౨ৎ ─────────


প্রতিকৃতি

আমার মেয়ে, সে ঘুমায়, আমার প্রতিকৃতি হয়ে।
কখনো ফুল ভাবি। বলি পাখি, কথা কও

সে ভঙ্গি করে, আর সব বিচিত্র আওয়াজ
চিনির মতো ঝরঝরা
সে ভাষা আমাদের ভাষা থেকে অনেক দূরের,

পশুর ভাষার সাথে- পাখির ভাষার সাথে- নদীর গানের
সাথে সে ভাষা একাকার

আমি তাকে খাপে পুরি,

বাংলা ভাষার খাপে- আমার মনোবাসনার খাপে

তাকে আলতো টেনে আনি মহৎ জগৎ থেকে
এই ছোট ছোট ভাষা মহলায়;

আমার মেয়ে, সে ধীরে বড় হয়, আর একটু একটু করে নিজেকে হারায়।

───────── ౨ৎ ─────────


রঙের আনন্দে

এলাচ ফুলের এলাকায় রোদ আসে রোজ,
তাকে পেতে দিই একটা সহজ বকুল ডাল

মশলার বাগানে ঘ্রাণময় রাত-জাগিয়ে রাখে অন্তর-রংময়
দুনিয়াকে এত নত দেখেছি আমি এই ফুলের বাগানে!

এত ভরপুর হয়ে থাকে মনে-
বাগিচার দিকে গিয়ে বাদশারা নীরব হলো রণ বাজনা থামিয়ে
বিষ্টিও সবচেয়ে সুন্দর হয় ফুলের গায়ে,

ঘ্রাণের আমিও হয়ে উঠতে পারি সাবলীল কোনো
গান-নীরব রোমন্থনরত যেন কোনো ঝাড়বাতি চুপচাপ জ্বলে

রঙের আমি প্রতিভাত হই ফুলে।

───────── ౨ৎ ─────────


বেড়া

বয়স পঁয়ত্রিশ হতে চলল

‘গৌতম গৌতম’ বলে
কে যেন ডাকছে বেড়ায় গলা উচিয়ে-

আমি শুনতে পাই-
শিশুর কান্না
হাঁড়ি ধোয়ার আওয়াজ

একটা অরণ্য নৈঃশব্দ্যে কেঁপে উঠছে
ভিতরে-

পাতা পড়ার ক্ষীণ ধ্বনি
সংগত করছে ধ্যানে।

───────── ౨ৎ ─────────


মেঝে

এখানে বিছানা পাতি, ফুলের গাছের পাশে-
অস্থির দৌড়ে বেড়ায়
ঋতুচক্র থেকে ধরে এনেছি মওসুম;

এখানে সে উপুড় হয়েছে- পাটির কাছা ঘেঁষে
রাশিফল থেকে ছেনে আনে ঘ্রাণ-

কিছুই বুঝতে না পারা শিশুর মতো মঙ্গল হোক আমাদের;
তাকে ফুল শিখাই
বলি, এখানে সব নিপাট হয়ে আছে;

লেপে যাই পুরানা সব দাগ জালকাটার পোচে-

আমি যেন সেই মেঝে আল্পনায় লুকানো
কারু নকশায় সামান্যই ছোঁয়া যায়!

───────── ౨ৎ ─────────


সরোবর

কত লোক যে কতদিক থেকে এসে
উপচে পড়েছে আমার ভিতরে

স্মৃতি ধরে বসে আছি-
ধোঁয়া ওঠা মেঘের নিচে
বিচিত্র সরোবর যেন,

বুক চেপে আছি কথার দমকা
এখন সেসব ভারী-

পাতা পচায় বুদবুদ ওঠে
মাঝে মাঝে কেবলি।

Facebook Comments

comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top