অনেকদিন পরে একদিন হাসতে হাসতে লাবণ্য তাঁর স্বামীকে জিজ্ঞেস করেছিলেন: ‘আচ্ছা, তুমি প্রথম দিনেই জীবন মরণের সীমানা ছাড়াতে চেয়েছিলে কেন?’জীবনানন্দ হেসে এই গানের দুটি লাইনের অর্থ জানতে চান:
‘আজি এ কোন্ গান নিখিল প্লাবিয়া
তোমার বীণা হতে আসিল নামিয়া।’
লাবণ্য চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলেন। জীবনানন্দ স্বভাবসুলব ক্ষীণকণ্ঠে বললেন: ‘জীবনের শুভ আরম্ভেই তো এ গান গাওয়া উচিত এবং শোনাও উচিত।’
বস্তুত জীবনানন্দ সারা জীবনই মনের ভেতরে একটা সুর বয়ে বেড়িয়েছেন; যে সুরের নাম সম্ভবত ‘বিপন্ন বিস্ময়’।
বিয়ের পিঁড়িতে জীবনানন্দ ও লাবণ্য; ০৯ মে ১৯৩০
জীবনানন্দের অনেক কবিতার শব্দার্থ করা কঠিন। অনেক সময় দুর্বোধ্য। কিন্তু সুর দেয়া যায়। কিছু কবিতার সুরারোপ করা হয়েছে। কিন্তু সত্যিই যে লিরিক বা গান/গীতিকবিতা তিনি লিখেছিলেন, সেগুলোয় সুর দেয়া হয়েছে বলে জানা যায় না।
জীবনানন্দ কেন গান লিখেছিলেন, সেই সংখ্যা কত এবং যে উদ্দেশ্যে লিখেছিলেন, তা কি সফল হয়েছিল? গান বা সংগীতের প্রতি তাঁর আগ্রহ কেমন ছিল? জীবনানন্দের যে কয়টি কবিতার সুরারোপ করা হয়েছে, সেগুলো কি ঠিক গান হয়ে উঠেছে?
জীবদ্দশায় মূলত কবি হিসেবে পরিচিত জীবনানন্দ দাশ যে অনেকগুলো উপন্যাস ও গল্পও লিখেছিলেন, তা জানা যায় তাঁর মৃত্যুর পরে। জীবদ্দশায় কিছু প্রবন্ধ এবং বই আলোচনাও বেরিয়েছিল। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত জীবনানন্দের সৃষ্টিসম্ভারের মধ্যে রয়েছে তিন হাজার কবিতা, ১৯টি উপন্যাস, ১২৭টি গল্প, ৭৯টি প্রবন্ধ-নিবন্ধ-আলোচনা-ব্যক্তিগত রচনা, ৫৬টি খাতা ভর্তি ৪০০২ পৃষ্ঠার ডায়েরি এবং দেড়শোর মতো চিঠিপত্র ও চিঠিপত্রের খসড়া। (গৌতম মিত্র, পাণ্ডুলিপি থেকে ডায়েরি, ঋত/২০২১, পৃ. ২০)। কিন্তু সাহিত্যের প্রায় সব শাখায় আঁচড়কাটা জীবনানন্দ যে কিছু গানও লিখেছিলেন, তা জানা যায় আরও পরে।
দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, কলকাতার জাতীয় গ্রন্থাগারে জীবনানন্দের যে ৪৮টি পাণ্ডুলিপি সংরক্ষিত আছে, সেখানে ৪১ নম্বর খাতায় ১৫টি গান আছে। যদিও গানের আলগা খাতাগুলো পাওয়া যায়নি। তার মানে আরও কিছু গান হয়তো ছিলো। (জীবনানন্দ দাশ বিকাশ প্রতিষ্ঠার ইতিবৃত্ত, দেজ/২০০৭, পৃ. ৫৮৫)।
গানের রচনাকাল আগস্ট-সেপ্টেম্বর ১৯৪৬। অর্থাৎ জীবনানন্দ যে সময়টায় জন্মস্থান বরিশাল ব্রজমোহন কলেজের শিক্ষক, কিন্তু সেখান থেকে কলকাতায় চলে আসার কথা ভাবছেন। কার্যত ১৯৪৬ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসেই তিনি বরিশাল ছেড়ে কলকাতায় চলে যান। তার মানে এই গানগুলোর রচনকাল একটি ক্রান্তিকালে। কেন তিনি গান লিখলেন, নিতান্তই খেয়ালবশত নাকি প্রয়োজনে?
জীবনানন্দের কর্মজীবন এবং চাকরি হিসেবে শিক্ষকতা নিয়ে তাঁর খেদ বিশ্লেষণ করলে বোঝা যাবে, তিনি আসলে নতুন কিছু চাইছিলেন। সেটি শিক্ষকতা ছাড়া অন্য কিছু। যদিও আমৃত্যু শিক্ষকতা করেই তাঁকে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়েছে। মাঝখানে একটি পত্রিকায় (স্বরাজ) কিছুদিন চাকরি করলেও সেখানে থিতু হতে পারেননি। শিক্ষকতার প্রতি তাঁর খেদের প্রধান কারণ ছিল সামান্য মজুরি এবং শিক্ষার পদ্ধতি। তাঁর সময়ে কলেজের শিক্ষকরা খুব সম্মানজনক বেতন পেতেন না। এর মধ্যে দেশভাগের ডামাডোল শুরু হয়ে গেলে জীবিকা নিয়ে আরও বেশি চিন্তিত হয়ে পড়েন। একটি ‘বিশুদ্ধ চাকরি’র সন্ধানে ছুটে বেড়িয়েছেন এখানে-ওখানে।
শোনা যায় ওই সময়ে তাঁর কোনো এক সুহৃদ বলেছিলেন সিনেমার গান লিখে ভালো পয়সা পাওয়া যায়। জীবনানন্দ ভেবেছিলেন তিনিও হয়তো গান লিখে পয়সা কামাতে পারবেন। বস্তুত সেই ধারণা থেকেই গান লেখার চেষ্টা করেন। কিন্তু গানগুলো সিনেমায় ব্যবহারের জন্য কাউকে দিয়েছিলেন বা এ নিয়ে কারো সাথে আলাপ-আলোচনা হয়েছিল কি না, তা জানা যায় না।
কলকাতার জাতীয় গ্রন্থাগারে পাণ্ডুলিপির ৪১ নম্বর খাতায় সংরক্ষিত গানগুলোর প্রথম লাইন [প্রবন্ধের শেষে গানগুলো সংযুক্ত করা আছে]:
১. আজ বিকেলের ধূসর আলোয়
২. রাতের আঁধারে নীল নীরব সাগরে
৩. সারা দিন আমি কোথায় ছিলাম, আলো
৪. অন্ধকারের ঘুমসাগরের রাতে
৫. আজ সকালের এই পৃথিবীর আলো
৬. আমরা যেন মেঘের আলোর ভিতর থেকে এসে
৭. ঘুমের হাওয়া, ঘুমের আলো
৮. দেশ-সময়ের ক্রান্তি রাতে আজ এ পৃথিবীর
৯. কাউকে ভালোবেসেছিলাম জানি
১০. (তোমার সাথে আমার ভালোবাসা —)
১১. ভোরের বেলায় তুমি আমি—
১২. ধ্বনি পাখির আলো নদীর স্মরণে এসেছি
১৩. তুমি আমার মনে এলে।
১৪. কোথায় সবি ফুরিয়ে গেল অতল সনাতনে।
১৫. মনে পড়ে আমি ছিলাম বেবিলনের রাজা
পর্যবেক্ষণ
১. যে ১৫টি গানের সন্ধান পাওয়া যায়, সেগুলোকে তাঁর কবিতা থেকে আলাদা করা যায় না। তাঁর অনেক কবিতাকেও বিন্যাস ও শব্দ চয়নের কারণে গান মনে হয়। আবার গান হিসেবে যা লিখেছেন তার সবগুলোকে সাদা চোখে দেখলে গান মনে হয় না। কবিতার চেয়ে গানের কথা সাধারণত সহজ ও সরল হয়। কিন্তু জীবনানন্দের গানগুলোও তাঁর কবিতার মতোই ধোঁয়াশা। অনেক ক্ষেত্রেই দুর্বোধ্য—যার সুর করে গাওয়া খুব কঠিন। সম্ভবত এ কারণেই কেউ গানগুলোয় সুর করে গাওয়ার চেষ্টা কেউ করেননি। বিশেষ করে যে উদ্দেশ্যে তিনি গানগুলো লিখেছিলেন বলে শোনা যায়, সেই সিনেমার প্লেব্যাক হিসেবে গানগুলো খুব যুৎসই নয়। কেননা সিনেমার গানের সঙ্গে সাধারণত অভিনেতা অভিনেত্রীদের কোরিওগ্রাফ বা শারীরিক ক্রিয়াকলাপ বিশেষত নাচ থাকে। দুর্বোধ্য বা কঠিন লিরিকের সাথে শারীরিক অ্যাক্টিভিটি, বিশেষ করে বাংলা সিনেমায় যেমন নায়ক-নায়িকাদের যে নাচের ব্যাপার থাকে, সেই ধরনের ক্রিয়াকলাপ কঠিন। তাছাড়া সিনেমার গল্পের সঙ্গে গানের লিরিকের মিল থাকতে হয়। একটা গল্প চলছে, খাপছাড়াভাবে সেখানে কোনো একটা গান ঢুকে গেলে সেটা সিনেমার ছন্দপতন ঘটায়। এসব বিবেচনায় জীবনানন্দের যে লিরিকগুলো আমরা গান হিসেবে পাচ্ছি, সেগুলো আর যাই হোক, সিনেমার গান হিসেবে ব্যবহার করা বেশ কঠিন।
২. জীবনানন্দের যে ১৫টি লিরিককে আমরা গান হিসেবে পাচ্ছি, তার সবগুলোর বিষয় প্রেম। অর্থাৎ তিনি হয়তো সিনেমা নায়ক-নায়িকারা ঠোঁট মেলাবেন—এমন ভাবনা থেকেই গানগুলো লিখেছিলেন।
৩. গান হিসেবে লিখিত জীবনানন্দের লিরিকগুলোর প্রত্যেকটি ভালো কবিতা তাতে সন্দেহ নেই। অর্থাৎ কাব্যগুণ আছে এবং কথাপ্রধান গান হিসেবে এগুলোর গুরুত্ব আছে। কিন্তু তাতে গানের কাঠামো আছে কি না, সেটি বিরাট প্রশ্ন। কেননা ছন্দ ও অন্ত্যমিল নেই অনেক গানেই। অর্থাৎ এগুলো গানের সাধারণ কাঠামোর সাথে মেলে না।
৪. গানের প্রতি দুই লাইনে অন্ত্যমিল থাকে। এই গানগুলোয় সেই সাধারণ রীতি মানা হয়নি। গদ্য কবিতার মতো এগুলোকে গদ্য গান বলা হবে কি না?
৫. লিরিকগুলোকে কবিতার সঙ্গে পার্থক্য করা যায় না। যেমন ১ নম্বর গানের দুটি লাইন: ‘বেতের ফলের মতন আমার ম্লান চোখে তুমি হাজার বছর রয়ে গেছ।’ বেতের ফলের মতো ম্লান চোখের কথা আছে তাঁর হায় চিল কবিতায়: ‘তোমার কান্নার সুরে বেতের ফলের মতো তার ম্লান চোখ মনে আসে।’ ‘সে’ শিরোনামের কবিতায়ও আছে ‘বলেছিল এ নদীর জল তোমার চোখের মতোই ম্লান বেতফল।’
৬. গানের কথায় সাধারণত ব্র্যাকেট ব্যবহার করা হয় না। কিন্তু জীবনানন্দের কোনো কোনো গানের বাক্যে ব্র্যাকেট আছে। ফলে ব্র্যাকেটবন্দি লাইনগুলো কীভাবে উচ্চারিত হবে, তা স্পষ্ট নয়।
৭. জীবনানন্দের কবিতায় যেমন প্রচুর ড্যাশের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়, গানেও তা-ই।
৮. আট নম্বর গানের শেষটা এরকম: ‘অপার ব্যথা, অসীম প্রয়াস ইত্যাদি…’। এভাবে কোনো গান শেষ হওয়ার কথা নয়। ইত্যাদি শব্দ দিয়ে কোনো গান শেষ হয় না। তার মানে এখানে গানটি বোধ হয় শেষ হয়নি অথবা তিনি শেষ করেননি।
৯. একাধিক লাইনে প্রশ্নবোধক চিহ্ন। গানের লিরিকে সাধারণত প্রশ্নবোধক চিহ্ন থাকে না।
গানের মতো যেসব কবিতা
জীবনানন্দের অনেক কবিতার শিরোনামে ‘গান’ শব্দটি আছে, যেমন: অবসরের গান, পিপাসার গান, অনুসূর্যের গান, তিমিরহননের গান, নব হরিতের গান, ঝরা ফসলের গান, আলোসাগরের গান।
‘সহজ’ কবিতার শুরুটা এরকম:
‘আমার এ গান
কোনোদিন শুনিবে না তুমি এসে,-
আজ রাত্রে আমার আহ্বান
ভেসে যাবে পথের বাতাসে,-’।
অনেকটা একই সুরে লেখা ‘নির্জন স্বাক্ষর’ কবিতার শুরুটাও কাছাকাছি:
‘তুমি তা জান না কিছু,
না জানিলে-
আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য করে!’
অর্থাৎ কাঙ্ক্ষিত নারীকে তিনি আসলে গান শোনাতে চান, কবিতা নয়। যেমন বাসর রাতে নবপরিণীতার কাছে গান শুনতে চেয়েছিলেন। মৃত্যুশয্যায়ও সেই গান। মেয়ে মঞ্জুশ্রী লিখেছেন, হাসপাতালে মৃত্যুশয্যায় তিনি রবীন্দ্রসংগীত শুনতে চেয়েছিলেন। আর মৃত্যুর পরে ছোট ভাই অশোকানন্দের বাসায় জীবনানন্দের মরদেহ ঘিরে ব্রাহ্মমতে রবীন্দ্রসংগীত গেয়েছিলেন নারীরা। অর্থাৎ গান বা সংগীত অথবা সুরের প্রতি একটা বিশেষ পক্ষপাত জীবনানন্দের ছিল। সম্ভবত সকল কবির ভেতরেই এই পক্ষপাতটা থাকে।
জীবনানন্দ গান হিসেবে যে লিরিকগুলো লিখেছেন, তার সঙ্গে তার অন্য অনেক কবিতার যথেষ্ট মিল রয়েছে। ফলে তাঁর গানকে কবিতা থেকে ঠিক আলাদা করা যায় না। আবার তার অনেকগুলো কবিতার স্তবকবিন্যাস, ভাষা ও বলার ভঙ্গি গানের মতো।
বাংলার মুখ থেকে সুরঞ্জনা…
জীবনানন্দের কবিতায় দুর্বোধ্যতার অভিযোগ যেহেতু বেশ পুরনো, তাই তাঁর তুলনামূলকভাবে সহজ কিছু কবিতায় সুরারোপ করে গাওয়া হয়েছে। বিশেষ করে যেসব কবিতার বিষয়বস্তু বাংলার প্রকৃতি, সৌন্দর্য ও দেশপ্রেম। যেমন:
১. বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর (রূপসী বাংলা): সুর ও কণ্ঠ অজিত রায়।
২. আবার আসিব ফিরে ধানসিড়িটির তীরে এই বাংলায় (রূপসী বাংলা): সুর ও কণ্ঠ অজিত রায়। (বেঙ্গল ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত অ্যালবাম ‘মহাজীবন’-এ এই গান দুটি রয়েছে।)
৩. আবার আসিব ফিরে: সুর অরিন্দম বন্দ্যোপাধ্যায়, কণ্ঠ লোপামুদ্রা মিত্র। অরিন্দম এই গানে দুটি সুর করেছেন। লোপামুদ্রার কণ্ঠে দুটি ভার্সনই পাওয়া যায়।
৪. হায় চিল, সোনালি ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে তুমি আর কেঁদো নাকো উড়ে- উড়ে ধানসিড়ি নদীটির পাশে (হায় চিল, বনলতা সেন): সুর দিলীপ রায়, কণ্ঠ গোপা ত্রিবেদী।
৫. হায় চিল: সুর ও কণ্ঠ অনুপ ঘোষাল।
৬. পাড়াগাঁর দু-পহর ভালোবাসি—রৌদ্রে যেন গন্ধ লেগে আছে (রূপসী বাংলা): সুর বাসব চট্টোপাধ্যায়, কণ্ঠ মানস কুমার দাস।
৭. সুরঞ্জনা, অইখানে যেয়োনাকে তুমি; বোলোনাকো কথা অই যুবকের সাথে ((আকাশলীনা, সাতটি তারার তিমির): সুর ও কণ্ঠ: পুষ্কর বন্দোপাধ্যায়।
এর বাইরে সুমন ব্যানার্জি ৮টি কবিতায় সুর দিয়েছেন, যেগুলো গেয়েছেন কুমার সানু। অ্যালবামের নাম ‘মেঠো চাঁদ’। এই অ্যালবামে যে কবিতাগুলো গান হিসেবে গাওয়া হয়েছে সেগুলো হচ্ছে ১. আকাশে সাতটি তারা যখন উঠেছে ফুটে আমি এই ঘাসে বসে থাকি (রূপসী বাংলা); ২. আমাকে সে নিয়েছিলো ডেকে, বলেছিল এ নদীর জল তোমার চোখের মতো ম্লান বেতফল (সে, অন্যান্য কবিতা); ৩. মেঠো চাঁদ রয়েছে তাকায়ে আমার মুখের দিকে, ডাইনে আর বাঁয়ে (মাঠের গল্প, ধূসর পাণ্ডুলিপি); ৪. সময় মুছিয়া ফেলে সব এসে, সময়ের হাত সৌন্দর্যেরে করে না আঘাত (সময় মুছিয়া ফেলে সব এসে, অন্যান্য কবিতা); ৫. একদিন এ পৃথিবী জ্ঞানে আকাঙ্ক্ষায় বুঝি স্পষ্ট ছিল আহা (রাত্রিদিন, অন্যান্য কবিতা); ৬. বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি (রূপসী বাংলা); ৭. তোমায় আমি দেখেছিলাম ঢের, শাদা কালো রঙের সাগরের কিনারে এক দেশে (তোমায় আমি দেখেছিলাম, অন্যান্য কবিতা); ৮. সুরঞ্জনা অইখানে যেয়োনাকো তুমি (আকাশলীনা, সাতটি তারার তিমির)।
দেখা যাচ্ছে এ পর্যন্ত তাঁর যতগুলো কবিতায় সুর দেয়া হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে, তার অধিকাংশই ‘রূপসী বাংলা’ কাব্যগ্রন্থের। এর বাইরে হয়তো আরও এক বা একাধিক কবিতায় সুরারোপ করে গাওয়া হয়েছে এবং এখনও হয়তো আরও অনেকেই জীবনানন্দের অন্য কোনো কবিতাকে সুর দিয়ে গান বানানোর চেষ্টা করছেন।
প্রথম সুরকার অজিত রায়
জীবনানন্দ দাশের কবিতায় প্রথম সুরারোপ করেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত সংগীতজ্ঞ অজিত রায়। সেটি ছিলো ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি’। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে তিনি এই কবিতায় সুরারোপ করেছিলেন। তাঁর কণ্ঠে ওই গানটি মুক্তিযোদ্ধা এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষকে অনুপ্রাণিত করে। গানটি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হলে সেটি ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়।
জীবনানন্দের কব্তিায় সুরারোপের ভাবনাটি অজিত রায়ের মাথায় কী করে এলো? একটি সাক্ষাৎকারে তিনি এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। ‘১৯৬২ সালের পর থেকে প্রতি একুশে ফেব্রুয়ারিতে একটি করে নতুন গান করার প্রস্তুতি আমরা নিতাম। আবৃত্তিকার আশরাফুল আলম জীবনানন্দ দাশের ‘‘রূপসী বাংলা’’ থেকে কবিতায় সুরারোপ করার জন্য প্রায়ই তাগিদ দিতেন। আমিও ভাবছিলাম ‘‘রূপসী বাংলা’’র কোনো কবিতাকে গানে রূপান্তরিত করতে পারলে একটা অসাধারণ ব্যাপার হবে। শুরু করলাম। এক লাইন দুলাইন করে করতে করতেই হয়ে গেলো। ‘‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি’’ কবিতাটির দুটি অংশের প্রথম অংশটিতে প্রথম সুরারোপ করি। এটি ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারির ঘটনা।’(উত্তরাধিকার জীবনানন্দ সংখ্যা, বাংলা একাডেমি ২০০১, পৃষ্ঠা ৪৪৭)।
অবশেষে কবিতায় সুরারোপ করা হয় এবং অজিত রায় গানটি প্রথম শোনান জাতীয় প্রেস ক্লাবে ১৯৭১ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারি রাতে। অজিত রায় জানাচ্ছেন, শহীদ মিনারে যাওয়ার আগে প্রেস ক্লাবে সংগীতের আসর বসতো। ‘এই অনুষ্ঠান শেষ করেই আমরা সাড়ে এগারটার দিকে শহীদ মিনারের দিকে যাত্রা করতাম। ১৯৭১ সালের ওইরকম অনুষ্ঠানেই প্রথম ‘‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি’’ গানটি করি।’
জীবনানন্দ দাশের কবিতায় প্রতিবাদ-প্রতিরোধের বিষয়টি প্রত্যক্ষভাবে না এলেও মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর কবিতাগুলো মুক্তিকামী বাঙালিকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে দেশপ্রেমের কারণে। বাংলার নৈসর্গিক সৌন্দর্য এবং দেশপ্রেম যত বিস্তৃতভাবে তাঁর কবিতায় এসেছে, আর কোনো কবির সঙ্গে তার তুলনা হয় না। জীবনানন্দের কবিতা পড়লে যেভাবে চোখের সামনে সবুজ শ্যামল বাংলাদেশ মূর্ত হয়ে ওঠে, আর কারো কবিতা এতটা প্রভাববিস্তারী নয়। নয় বলেই মুক্তিযোদ্ধারা ভাত-কাপড় কিংবা অস্ত্র নয়, চেয়েছিলেন রূপসী বাংলার একখানি কপি—যে গল্পটি আমাদের জানাচ্ছেন বরেণ্য শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান: ‘আমার এক ভারতীয় বন্ধু মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে গিয়ে একবার জানতে চেয়েছিলেন, পরেরবার যখন আসবেন, তখন কী নিয়ে আসবেন তাদের জন্য? তারা বহু দ্বিধার পরে উত্তর দিয়েছিল। জামাকাপড় নয়, খাদ্যদ্রব্য নয়, ‘রূপসী বাংলা’র একটি কপি। হয়তো এ বিচার নন্দনতাত্ত্বিক নয়, তবে একজন কবির পক্ষে এর চেয়ে বড় পাওয়া কী হতে পারে, আমার তা জানা নেই।’ (জীবনানন্দ দাশ জন্মশতবার্ষিক স্মারকগ্রন্থ, আবদুল মান্নান সৈয়দ ও আবুল হাসনাত সম্পাদিত, পৃষ্ঠা ২৭)।
স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি’ গানটি প্রচারিত হয়েছে। অজিত রায়ের সংশয় ছিল এই ধীর লয়ের গানটি সশস্ত্র সংগ্রামে উত্তাল দেশের মানুষের মনে কতড়া অনুরণন তুলবে বা মুক্তিযুদ্ধে এ গানের আবেদন কতটা সাড়া জাগাবে? কিন্তু দেখা গেলো, গানটি দারুণ সাড়া ফেললো এবং গানের ভেতরে বীররস না থাকলেও মানুষকে দেশপ্রেমে উজ্জীবীত করতে এই গানটি দারুণ ভূমিকা পালন করে।
রূপসী বাংলা কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ‘পাড়াগাঁর দু-পহর ভালোবাসি’ কবিতাটিতে প্রথম সুরাপোর করা হয় সত্তুর দশকে। ১৯৭৭ সালে কুমিল্লা বীরচন্দ্র নগর মিলনায়তন (টাউন হলে) কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতা ও সাহিত্যকর্ম নিয়ে আয়োজিত অনুষ্ঠানে গানটি প্রথম গাওয়া হয় বলে ধারণা করা হয়।
গান নিয়ে জীবনানন্দের ভাবনা
জীবনানন্দের গল্প-উপন্যাসগুলোকে তাঁর আত্মজীবনীর খসড়া বলে মনে করা হয়। এর মধ্যে তাঁর ‘মাল্যবান’ উপন্যাসটি আরও বেশি আত্মজৈবনিক। এই উপন্যাসের নায়ক মাল্যবান গানের ব্যাপারে স্ত্রীকে কোনোদিন কিছু বলে না। ‘বড়ো একটা বেশি ঝালাপালা বোধ করলে অবিশ্যি ‘‘গান খুব ভালো করে শিখতে হয়’’, ‘‘অনেকে খুব মন খুলে গায়, ভালো লাগে; মন খুলেছে বলে ভালো লাগে’’ এরকম এক-আধটা ইশারায় অনুযোগ জানায় মাল্যবান। এ ধরনের ইঙ্গিতের জন্যে স্ত্রীর কাছ থেকে সে সত্যিই শাস্তি পায়; কাজেই পারতপক্ষে স্ত্রীকে কিছুই বড়ো একটা বলতে যায় না। নিজে মাল্যবান গানমুজরো না ভালোবাসে তা নয়। যখন সে কলকাতার চাকরিতে বাঁধা পড়েনি, পাড়াগাঁয়ে ছিল, সেই ছোটবেলা এক এক দিন শীতের শেষ রাতে বাউলের গান শুনতে তার খুব ভালো লাগত; কোনো দূর হিজল বনের ওপার থেকে অন্ধকারের মধ্যে সে সুর ভেসে এসে তার কিশোর আঁতে ব্যথা দিয়ে যেত। কতদিন যখন দিন শেষ হয়-দাণ্ডাগুলি খেলে যখন সে কাঁচা কাঁচা কালিজিরা ধানশালি রূপশালির ক্ষেতের আলপথ দিয়ে বাড়ি ফিরছে, ভাটিয়াল গান শুনে মনটা তার কেমন করে উঠত যেন; সারা দিনের সমস্ত কথা কাজ অবসন্ন শোল-বোয়ালের মতো দিঘির অতলে তলিয়ে যেত যেন, ঝির ঝির ফটিক ফটিক ঝিক ঝিক ঝর ঝর করে উঠত ওপরের জল: যে জল গানের মতো, যে গান জলের মতো চারদিককার খেজুরছড়ি, নারকোলঝিরঝিরি ঝাউয়ের শনশনানি ছায়া অন্ধকার একটি তারার ভেতর এক কিনারে চুপ করে বসে থাকত সে।
বাপ-মাকে ফাঁকি দিয়ে কত রাত সে যাত্রা শুনতে গেছে-তারপর সেই সব গানের সুর এমন পেয়ে বসেছে তাকে যে পরীক্ষার পড়া মুখস্ত করতে করতে এক একবার টেবিলের ওপর মাথা রেখে অনেকক্ষণ নিঝঝুম হয়ে পড়ে থাকত; কোথাও মেঘ নেই, বৈশাখ আকাশের বিদ্যুৎচমকানির মতো ভরে যেত মন এ কানা থেকে সে কানায়; বালিশে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে উঠবার পূর্বাভাসের মতো; কিন্তু তার আগেই সে মাথা খাড়া করে অন্য পৃথিবীতে চলে যেতে চেষ্টা করত, ফোঁপাতে যেত না। মণিভূপকণ্ঠ চক্রবর্তী বলে একজন ভদ্রলোক ছিলেন-সত্যিই কি তাঁর নাম মণিভূপকণ্ঠ? কী মানে এই নামের? কিন্তু তবুও সকলেই তো তাঁকে এই নামে ডাকত; মণিভূপের গানের কথা মনে পড়ে; শমনহরা বোস-ঝুনু ঝুনু বোস-চৌধুরাণী নামেই বেশি খ্যাত-তার গান; সেসব দিন কোথায় গেছে যে আজ! পাড়ায় পাড়ায় গানের বৈঠকের লোভে পড়াশুনো ফেলে যেমনি সে আসরের এক কিনারে গিয়ে বসেছে, অমনি কাকা তাকে কান টেনে-হিঁচড়ে বাসায় নিয়ে গেছেন; তবুও তার মায়ের সঙ্গে ষাট করে ফের আবার পালিয়ে যেতে ইতস্তত করেনি সে।’ (মাল্যবান, জীবনানন্দ-রচনাবলি-৪, ঐতিহ্য/২০১৭, পৃষ্ঠা ১০৮)।
উপসংহার
জীবনানন্দের গানকে তাঁর কবিতা থেকে আলাদা করা যায় না। তাঁর উপন্যাস ও গল্পগুলো তাঁর ব্যক্তিজীবন থেকে আলাদা করা যায় না। কবিতার মতো তাঁর প্রবন্ধগুলোও দুর্বোধ্যতার অভিযোগে অভিযুক্ত। অতএব সমস্ত অস্পষ্টতা, ধোঁয়াশা আর দুর্বোধ্যতা নিয়েই জীবনানন্দ দাশ।
কবিতায় সুরারোপিত গানের ইউটিউব লিংক:
১. বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, অজিত রায়: https://www.youtube.com/watch?v=RyF4wZ7jKqw
২. আবার আসিব ফিরে, অজিত রায়: https://www.youtube.com/watch?v=UWby27608g8
৩. আবার আসিব ফিরে, লোপামুদ্রা: https://www.youtube.com/watch?v=fSEsue8Hh1Y
৪. আবার আসিব ফিরে, রুপঙ্কর বাগচী : https://www.youtube.com/watch?v=3BPpUxoEKf8
৫. হায় চিল, গোপা ত্রিবেদী: https://www.youtube.com/watch?v=DNAk4Qcu-Qc
৬. হায় চিল, অনুপ ঘোষাল: https://www.youtube.com/watch?v=Tf77QeoeA84
৭. পাড়াগাঁর দুপ্রহর ভালোবাসি, মানস কুমার দাস: https://www.youtube.com/watch?v=gbUQU4XIZEI
৮. আকাশলীনা, পুষ্কর বন্দোপাধ্যায়: https://www.youtube.com/watch?v=pkDiLdBXsxQ
৯. মেঠো চাঁদ অ্যালবাম, কুমার সানু: https://www.youtube.com/watch?v=G9hfnZEjmnw
১.
আজ বিকেলের ধূসর আলোয়
তোমার সাথে দেখা
এতটা দিন পথ চলেছি- শেষে
কালো মেঘের কেয়াবনের জলহিজলের দেশে
আমি তোমার পাতা শিশির
হাতের তুলির রেখা
বেতের ফলের মতন আমার ম্লান
চোখে তুমি হাজার বছর রয়ে গেছ, আহা
সময় তোমার হাড়ের স্রোতে লেখা
সকল দারা-সুতের শিয়র ছেড়ে আমি একা
আকাশ আলো পাহাড় শিশির
সে কত পৃথিবীর
তামাকে শেখা সে কত রমণীর
সে কত রজনীর
আঁধার অবচেতন থেকে শেখা।
২.
রাতের আঁধারে নীল নীরব সাগরে
আমাদের এ জীবন জনহীন বলয়ে আকাশে
সাগরের দূরগামী জাহাজের মতো
কী ক’রে কখন
অতি দূর থেকে ভেসে আসে।
কোথায় সে ছিল কবে ভুল তারকায়
সাগরের রাঙা নীল জলকাকলিতে
ঢের মৃত-ঢের অনৃতে
কুহুলীন দ্বীপের আভাসে
হে নাবিক, হে মানব রজনীর,
এ আঁধার বন্দিনী জানি, তবু
যুগে যুগে কেউ
জেনেছ কি তুমি আছ
শুনেছ কি সাগরের ঢেউ
শঙ্খরেখায় ঘুরে আঁধারে আঁধারে
দূর দিকমাধুরীর পারে
আরো আশা আলো ভালোবাসে।
৩.
সারা দিন আমি কোথায় ছিলাম, আলো
এই জীবনের ইতিহাসে আমি আগে
তোমাকে কখনও দেখি নি, তবুও দেখেছি
সূর্যে যখন আকাশী গ্রহণ লাগে
পৃথিবী মলিন হয়
হৃদয়ে গ্রহণ নয়
আলোর অশোক ঝর্নার মতো কাঁপে
সব মুখে সব শোকে সব পরিতাপে
তোমার শরীর সমাসূর্যের ধারা
আঙিনা ছড়ানো স্নান পায়রারা
আলো হয়ে ওঠে ঘুম-
ঘুমনগরীর রাজার কুমারী জাগে।
৪.
অন্ধকারের ঘুমসাগরের রাতে
দূর আকাশের তারা,
নীল নিখিলের নীরবতা
নেই কিছু এ ছাড়া,
অকূল অলখ থেকে হাওয়া
কোন্ দিকে তার চলে যাওয়া
মৃত্যু-স্বাতীর থেকে এসে
কী মৃত্যু-ফোয়ারা!
একটি জাহাজ, একটি সাগর, একটি অনিমেষ,
আগুন আলো জ্যোতিষ্কদের দেশ,
ঘুমের মাঝে তবুও যেন অপর বন্দিনী
আরেক আলোক জানালা দিয়ে দিয়েছিল সাড়া।
এই জীবনের দিক্-শরণের গভীর রাতে আমি
তোমায় ছেড়ে দিক্-অ-চেনা ক্রান্তিসাগরগামী,
সৃষ্টি কি নীলকণ্ঠ পাখির অধরা আকাশে
উড়ে যাওয়ার অপরিসীম সাগরধ্বনিধারা।
৫.
আজ সকালের এই পৃথিবীর আলো
চকোর ঘুঘুর ঝলকানিতে অপার নীলিমা
আলোয়–গভীর আলোয় মিশে গিয়ে
উড়ো গাঁয়ের প্রদীপ জ্বালিয়ে
নগরীদের মিনার জ্বালাল।
ভাঙা খিলান মৃত দেয়াল
অন্ধকারের খাত
নরনারীর চোখে অকূল রাত,
অন্তবিহীন প্রেম-বেদনায়
নিষ্ফলতার কালো।
এসো, অফুরন্ত সূর্য
আলোর ঈগল
জ্যোতির্ময়ী ফণা,
ইতিহাসের চেয়ে মানবইতিহাসের
আলোর প্রার্থনা,
সকল বিরাট নৃপতিদের ধূলির চেয়ে ভালো
এসো আলো-।
৬.
আমরা যেন মেঘের আলোর ভিতর থেকে এসে
নগরী দিনের মতন কলরবে
এই জীবনের পথে চ’লে তবু
জানি শুধু এখনও যেতে হবে
তবুও দেখি সকলই ঘুমে ঘেরা
সাগরতীরে শঙ্খবালকেরা
সে উতরোল রোলের ধু ধু নীল
দেখেছে কিছু-ভেবেছে কিছু
খেলেছে ঝিলমিল
আলোর জিব্রাইল)
শাদা আলোর, শাদা পাখির মতো
সহজ ঘুমে ডুবেছে নীরবে
ঘুমের ভিতর যে ঘুম আছে
সে দিক পানে চ’লে
ঘুমিয়ে জেগে আছি
অসীমারই ওপরে তুমি স্বাতী
ভেবেছি প্রতিপদের কাছাকাছি
চিত্রাতারার মতন (তবু তুমিও) জেগে রবে।
৭.
ঘুমের হাওয়া, ঘুমের আলো
ঘুমের দেশের প্রেম (কী তোমার নাম?)
অইখানেতে শঙ্খনদীর তীরে তুমি দাঁড়িয়েছিলে নাকি
আমিও এলাম।
আমায় তুমি মেঘের গভীর থেকে ভেবেছিলে
এখনও সেই মেঘ
তোমায় আমায় জড়িয়ে আছে, তবু
এই কি জীবন? জেগে ওঠা?
ভোর? হৃদয়াবেগ?
এই কি তোমার শরীরতীরে পেলাম।
গভীর ঘুমে হৃদয় ছেয়ে আসে
মিনার বাড়ি নগরী রোল যুদ্ধ জনগণ
পাথর ধোঁয়া ধুলো খড়ের মতো
এখন অচেতন
এই কি জীবন? জেগে থাকা?
অমৃতেরই হাওয়া?
জ্যোতিষ্কদের ঘুম ভাঙানো?
নারীর দেখা পাওয়া?
৮.
দেশ-সময়ের ক্রান্তি রাতে আজ এ পৃথিবীর
এই নগরীর হৃদয় দেখা যায়
পথে ঘাটে মেঘে মনের বর্তিকাতে
সেই কি মিলাল
সব পৃথিবীর হারিয়ে যাওয়া আলো?
যে সব নারী নগরীরা চলে গেছে
পুনরুদযাপনের তারায় জ্বলে গেছে,
যারা স্ফীত অবহিত ছায়ার মায়ায় অকথিত
সকলে আজ নতুন করে জেগে।
জলের কলরোলে রাত্রি-সংক্রান্তি হাওয়ায়
অপার ব্যথা অসীম প্রয়াস আশা ভালোবাসা
অশোক সাধনায়
নতুন সময় সৃষ্টি যন্ত্রগিরি জ্বালাল কি?
মৃত সূর্য অমর করে জ্বালিয়ে নিতে চায়?
ভাঙা দেয়াল বস্তি ব্যথা ধূসর মিনার
নিভে যাওয়া ইতিহাসের ঊষর কিনার
নিভে গেছে—নিভে গেছে—
ভোরের চাতক চিলের সাগর একক এখন
ইতিহাসের জ্যোতির কল্পনায়।
অপার ব্যথা, অসীম প্রয়াস ইত্যাদি…
৯.
কাউকে ভালোবেসেছিলাম জানি
তবুও ভালোবাসা,
দুপুরবেলার সূর্যে ভোরের
শিশির নেমে আসা,
ভোরের দিকে হৃদয় ফেরাই
যাই চলে যাই—
নীল সকালে যাই চলে যাই—
একটি নদী একটি অরুণ
শিউলি শিশির পাখি—
‘আমরা মায়ার মনের জিনিস
মায়াবিনীর বেলায় শুধু জাগি’
বলছে সে কোন্ ত্রিকোণ থেকে
ছায়ার পরিভাষা।
কাউকে ভালোবেসেছিলাম, জানি,
তবুও ভালোবাসা।
সে কোন সুদূর মরুর মনে চলে গেছ
হায়, যাযাবর তুমি,
সেইখানে কি মিলবে বনহংসী বাঁধা বাসা!
হায় বলিভুক্, কখন ভেবেছিলে
মাটি ছেড়ে দূর আকাশের নীলে
ধূসর ডানার অগ্নি ছেড়ে দিলে
মিটে যাবে মায়াময়ী মাটির পিপাসা।
১০.
(তোমার সাথে আমার ভালোবাসা
চল কেবল সুমুখপানে চল
সূর্যডানায়—ঈগল পুরুষ জ্বলো
সময়সাগর শুকিয়ে গেলে সেই সোনালি বালির
সীমার মনে মরুভূমির সঙ্গে কথা বল।)
তোমার সাথে এই তো ভালোবাসা
নরনারীর অঙ্গ প্রতি অঙ্গ লাগি কাঁদলে আমার প্রেম
হে মীনকেতন, তোমার নারী ভালো—ভালো
দিকের থেকে দিগন্তরে এই তো আমি এলাম
হে প্রেম, তুমি গৃহবলিভুকের শান্ত কাতর ডানা ধরে
মহান যাযাবরের নিজের সূর্যে ফিরে আসা
হে মীনকেতন, তোমার নারী অমর জানি (আমি),
অমরতর (তবুও) আরো বলয় আকাশ আরো
আলোর পিপাসা-
১১.
ভোরের বেলায় তুমি আমি—
নীল আকাশের ভরতপাখির গানে
কবে যে এই ধুলোমাটির পৃথিবীতে
প্রথম দেখেছিলাম
কেন এসেছিলাম এ সব আলোর অভিযানে
আজকে আবার সকাল এলে সেই কথা কি তুমি
পাখির গানের আলোর সিঁড়ি-সূর্যে উঠে ভাবো
(এই সৃষ্টির) অলখ আলোর থেকে এসেছিলাম
আবার কবে আলোয় মিশে যাব
অন্ধকারের এ ছাড়া কি নেইকো কোনো মানে?
ইতিহাসে ভায়ের-বুকে-ভাই
গল্প ছবি প্রেম-কি শুধু জ্বলন্ত মিথ্যাই
সকলই ছাই করে দিয়ে আঁধার সসম্মানে
বসেছে কি তোমার আমার—
ভোরের সাগরকণ্ঠী পাখির গানে?
হয়তো বা তাই হবে—তবু আজকে আলোয় আমি
এই পৃথিবীর প্রথম ভোরের
সূর্য পাখি নারী
দেখে কি তার আদিম আঁধার ভেবে নিতে পারি
যদিও গহীন থেকে এলাম-গহন আমায় টানে।
১২.
ধ্বনি পাখির আলো নদীর স্মরণে এসেছি
আবার তুমি আমি
ভেবেছিলাম আমরা দুজন
মিশরীয় মমি
ঘুমিয়ে আছি সকাল বিকাল
ভোরের হাওয়া সবুজ পাতার নড়া
আমলকীডাল শাল
রুপালি বৃষ্টি পড়া
হয়ে গিয়েছিলাম তুমি আমি।
আমরা কত নগরী হাটে জলে
রক্ত আগুন আবছা অবক্ষয়ে
অসময়ের অন্ধকারে মরেছি বারবার
তবুও আলো সাহস প্রাণ চেয়েছি হৃদয়ে
দূর ইতিহাসযানী।
কোথাও নীড় বেঁধেছিলাম
ভেঙে গেলে কেঁদেছিলাম
ফেনার শীষে হেসেছিলাম
জীবন ভালোবেসেছিলাম
আলো—আরো আলোর প্রয়াণী।
আজকে মানুষ চলে গেলে তবু
মানব রয়ে যাবে,
পাতা শিশির ইতিহাসের বেলা
হয়ে যাবে গভীরতরভাবে
নরনারীর নিজের রাজধানী।
১৩.
তুমি আমার মনে এলে।
বালুঘড়ি বিকল রাতের বেলা।
থেকে থেকে পড়ছে মনে
সে কোন ধূসর বেবিলনে
কবের গ্রীসের অলিভবনে
তোমার সাথে সূর্যতীরে
হয়েছিলো খেলা।
জানি সবই ফুরিয়ে গেলে অতল সনাতনে
থেকে থেকে তাঁবা নদীর অতল উৎসারণে
জলদেবীর মতন জেগে জানিয়ে গেছ তুমি
চম্পা কনকবতী এখন সুধার মরুভূমি
মরুভূমি-মরীচিকা-মায়ামৃগের খেলা।
তবুও আবার সূর্য নিয়ে এলো রজনী
আমার-তোমার-আধুনিকের
শতঘ্নী আঘাত
জননটের মতন নেচে-কবে
কী হারাল-সে কার মনে রবে
তোমার-আমার-
সে কার অবহেলা।
১৪. (পুরো গানটি পাওয়া যায়নি)
কোথায় সবি ফুরিয়ে গেল অতল সনাতনে
১৫.
মনে পড়ে আমি ছিলাম বেবিলনের রাজা
তুমি ছিলে আমার ক্রীতদাসী,
রাতের মিনার শুকতারকায় জোছনামলিন ছিল
দিনের প্রাসাদ পায়রা ঘেরা-সুনীল আকাশী
ধোঁয়ার মতো মিলিয়ে গেল কবে,
তোমার সাথে আবার দেখা হবে
তবুও আমার জানা ছিল-কালের কুহর থেকে
হাজার হাজার বছর তোমায় ডেকে
শুনেছি তুমি বলেছ ‘আসি-আসি-‘।
আজকে আবার গৃহবলিভুকের সকাল এলে
তাকিয়ে দেখি মিশর-নীলিমায়
সে সব চেনা দুধের মতো শাদা
পাখিরা উড়ে যায়-
আমি আমার মনকে বলি, ‘আমি ভালোবাসি’।
হাজার হাজার বছর আগে হারিয়েছিলাম যাকে
এখন সে তার প্রতীক নিয়ে হেতুর পারাবারে
খেলা করে ফেনার শীষে কেঁপে ওঠে শুনি,
আমি আমার নির্বলতায় বেবিলনের বাঁশি
বাজিয়ে তাকে নীল অতিবেল অন্ধকারের থেকে
আলো-আরো আলোর পানে
আসছি না কি ডেকে।
এ সব কারা মহিলারা আমার পাশাপাশি
চোখে চুলে হাতের নির্জনতার স্রোতে এসে
আধেক মনে পড়িয়ে হারায় কোথায় অনিমেষে
(হারায় রাতে) হঠাৎ জাগা শিশুর মতো:
ঘুমের পিয়াসী।
(মূল প্র্রবন্ধটি কালি ও কলম ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছে)
আজকে হঠাৎ করেই কয়েকটি লেখা ও সমালোচনা পড়লাম। আরামদায়ক লেখগুলো পড়ে ঋদ্ধ হোলাম।