নিকিতা // আন্দ্রেই প্লাতোনভ // অনুবাদ রুখসানা কাজল 

খুব ভোরে জমিতে কাজ করার জন্য মা বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যায়। এই পরিবারে বাবা ছিল না, বাবা অনেক আগেই পৃথিবীর সবচেয়ে দরকারি কাজ যেটা –  যুদ্ধ –  তাতে যোগ দিতে চলে গিয়েছিল, এখনো ফিরে আসেনি। সে ফিরে আসবে এই আশা নিয়ে মা প্রতিদিন অপেক্ষা করে, কিন্তু  সে আর ফেরে না।

পাঁচ বছরের নিকিতাকে একাই রেখে যাওয়া হতো, কুঁড়েঘর আর উঠানের কর্তা হয়ে উঠত সে।  ওর মা প্রতিদিন কাজে যাওয়ার সময় ওকে বলে যেত,  ঘরটা যেন আগুনে পুড়িয়ে না ফেলে, বেড়ার নিচে অথবা চালাঘরে পেড়ে রাখা মুরগীর ডিম অবশ্যই সংগ্রহ করে রাখতে এবং অন্য কোন মোরগ ওদের উঠানে এসে ওদের মোরগকে যেন হামলা না করে  সেদিকে খেয়াল রাখতে— আর দুপুরে খাওয়ার জন্য টেবিলে যে দুধ এবং রুটি রেখে দিয়েছে তা  যেন সে খেয়ে নেয়। সন্ধ্যায় সে ফিরে আসবে এবং তখন ওর জন্য গরম গরম রাতের খাবার বানিয়ে দেবে।

মা ওকে বলত, ‘খুব বেশি দুষ্টুমি কর না নিকিতাসোনা, তোমার তো  বাবা নেই। তুমি এখন অনেক বুদ্ধিমান হয়েছ আর এই ঘরবাড়ি উঠানে যা আছে সেটুকু শুধু আমাদের আছে।’

‘আমি অনেক বুদ্ধিমান, এটুকুই শুধু আমাদের আছে আর আমার বাবা নেই।’ নিকিতা বলত। ‘তবু তুমি তাড়াতাড়ি ফিরে এসো মাগো। নইলে আমার যে ভয় করে।’

‘এখানে এত ভয় পাওয়ার কি আছে সোনা ? আকাশে সূর্য ঝকঝক করছে, মাঠভর্তি কত লোকজন। ভয় পেও না বেটা, ওসবএমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে।’

নিকিতা বলত, ‘কিন্তু  মাগো সূর্যটা যে অনেক দূরে থাকে। আর মেঘ এসে যদি সূর্যকে একেবারে ঢেকে ফেলে।’

মা চলে যাওয়ার পর, নিকিতা একদম চুপচাপ হয়ে যাওয়া বাড়িটাকে ঘিরে চক্কর দিত  —  পেছনের ঘর এবং অন্যান্য ঘর যেখানে রুশী চুলো রয়েছে সেখানে যেত — এরপর প্রবেশ দ্বার দিয়ে ও বাইরে চলে আসত। মোটাতাজা বড় বড় মাছিগুলো সেখানে গুনগুন করছে, একটি মাকড়সা তার জালের মাঝখানে ঘুমে ঝিমিয়ে আছে  আর একটি চড়ুইপাখি পায়ে পায়ে চৌকাঠ পেরিয়ে এসে মাটিতে পড়ে থাকা একটি বা দুটি দানা খুঁজে নিচ্ছে। নিকিতা এদের সবাইকে জানত – এই চড়ুইপাখি, মাকড়সা, মাছি এমনকি বাড়ির বাইরের মুরগিগুলো সম্পর্কে অনেক অনেক বেশি জানত, রোজ এদেরকে দেখতে দেখতে নিকিতা বিরক্ত হয়ে গেছিল।

ও এমন কিছু জানতে এবং শিখতে চাইছিলো যেগুলো সম্পর্কে ও কিছু জানে না।

নিকিতা তাই উঠানে বেরিয়ে  চালাঘরে  আসে, যেখানে অন্ধকারময়  জায়গায় একটি খালি পিপা খাড়া হয়ে পড়েছিল। হয়ত ওর মধ্যে কেউ বাস করে; কোন ছোটোখাটো মানুষ অথবা অন্য কেউ;  দিনের বেলা সে ঘুমিয়ে থাকে, কিন্তু রাত্তিরে বাইরে বেরিয়ে এসে রুটি খায়, পানি খায় এবং কিছু  চিন্তাভাবনা করে,  তারপর ভোরের  দিকে আবার ড্রামের ভেতর ঢুকে নিজেকে সে লুকিয়ে ফেলে এবং ঘুমিয়ে পড়ে।

নিকিতা বলল, ‘আমি তোমাকে চিনি, তুমি এখানেই থাকো।’ পায়ের পাতার উপর ভর দিয়ে অন্ধকারের দিকে নিচু  হয়ে কথাগুলো বলায় পিপার ভেতর প্রতিধ্বনি শোনা যায়। এরপর নিশ্চিত হতে ও হাত দিয়ে এটাতে ঠকঠক শব্দ করে বলে, ‘এই যে অলসের ধাড়ি, ঘুমানো বাদ দিয়ে এবার জাগো। শীত এলে খাবে কি তুমি ? উঠে পড়ো, জোয়ার আর বাজরার ক্ষেতের আগাছা পরিষ্কার করে দাও গে। তারা কাজের দিন হিসেবে এটা টুকে রাখবে।’

নিকিতা কান পেতে রেখেছিল। পিপাএ ভেতরটা একদম নিঃশব্দ। ‘মরে গেল নাকি,’ ও ভাবল। কিন্তু অই সময় কাঠের ভেতর কিচমিচ শব্দ শোনা গেল এবং  খারাপ কিছু ঘটার আগে নিকিতা দ্রুত সরে আসে। ওর মনে হলো ওখানে যে থাকে হয় সে পিঠ ফিরে , অথবা ওকে তাড়া করতে উঠে আসছে। কিন্তু কেমন দেখতে পিপার ভেতরের মানুষটি ?

নিকিতা মুহূর্তের মধ্যে মনে মনে লোকটার ছবি এঁকে ফেলে। লোকটি ছোট্ট হলেও বেশ প্রাণোচ্ছল। প্রায় মাটি ছুঁয়ে ফেলে এমন লম্বা দাড়ি আছে তার। রাত্তিরে হাঁটাচলা করার সময় এমনিতেই তার দাড়ি মেঝেতে পড়ে থাকা খড়কুটো আবর্জনা ঝেড়ে ফেলে যাতে চালাঘরের মেঝে পরিষ্কার হয়ে যায়। কিছুদিন আগে ওর মায়ের কাঁচিটা  হারিয়ে গেছে, এই ছোট্ট লোকটি  নিশ্চয় তার দাড়ি ছাঁটতে সেটা নিয়ে গেছে।
‘আমাদের কাঁচিটা ফেরত দাও!’ নিকিতা শান্তভাবে বলে, “বাবা যুদ্ধ থেকে ফিরে এলে এমনিতেই এগুলো ফিরিয়ে আনবে। তিনি তোমাকে মোটেও ভয় পাবেন না। ওটা ফেরত দাও। পিপার ভেতরটা চুপ। এসময়, গ্রামের বাইরে, জঙ্গলের ভিতর থেকে কেউ একজন পেঁচার মতো ডেকে ওঠল, আর পিপার  ভেতর থেকে ছোট্ট লোকটি অদ্ভুত ভৌতিক গলায় উত্তর দিল, ‘আমি এখানে !’

নিকিতা চালাঘর থেকে ছুটে উঠোনে বেরিয়ে আসে। মেঘশূন্য আকাশে দয়ালু সূর্য জ্বলজ্বল করছে। নিকিতা খুব ভয় পেয়ে গেছে, সে সূর্যের দিকে তাকায় এই আশা করে যে, নিশ্চয় সূর্য তাকে রক্ষা করবে।

‘সেখানে কেউ আছে – অবশ্যই কেউ থাকে ওই পিপার ভেতর !’ আকাশের দিকে তাকিয়ে নিকিতা বলে। মহান   সূর্য আগের মতোই  আকাশে আলো ছড়াচ্ছে আর নিকিতার দিকে স্নেহমুখে তাকিয়ে দেখছে। নিকিতার মনে হলো সূর্যকে দেখতে ওর মৃত দাদাভাইয়ের মতো লাগছে। তিনি যখন বেঁচে ছিলেন, এভাবে নিকিতার দিকে তাকিয়ে  দাদাভাই সবসময় মায়াময় হাসি হাসতেন, নিকিতার প্রতি খুব স্নেহশীল ছিলেন তিনি। ও ভাবল, দাদাভাই এখন সূর্যের দেশে থাকতে চলে গেছেন।

‘দাদাভাই তুমি কোথায় ? তুমি কি ওই উপরে থাক ?’ নিকিতা জানতে চায়। ‘বেশ, তুমি ওখানেই থাক। আমি কিন্তু এখানেই আমার মায়ের সঙ্গে থাকব।’

শাকসব্জির ক্ষেতটাত ছাড়িয়ে, ভাঁটফুল আর বিষকাঁটা গাছের ঝোপাঝাড়ের মধ্যে একটি কুয়ো ছিল। অনেকদিন আগে  ওই কুয়োর পানি ওরা ব্যবহার করত। এখন যৌথ-খামারে  আরেকটি কুয়ো খোঁড়া হয়েছে, সেখানকার পানি অনেক ভালো। এই পতিত কুয়োর গভীরে, এর গহন ঘন অন্ধকারে, চকচকে উজ্জ্বল পানির উপরে  পরিষ্কার আকাশ আর সূর্যের নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া মেঘের ছবি দেখা যায়। নিকিতা কুয়োর কাঠামোতে ঠেস দিয়ে ঝুঁকে জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি ওখানে ওই গভীরে কী করছ ?’

নিচে কুয়োর একদম তলদেশে, নিকিতা ভাবে, হয়তো ওখানে ছোট জলমানুষরা বাস করে। ও জানে তারা  দেখতে কেমন, কারণ তাদেরপকে সে স্বপ্নে দেখেছে এবং ধরতে চেয়েছে। কিন্তু তারা ঘাসের উপর দিয়ে ছুটে পালিয়ে গেছে তাদের কুয়োবাড়ির মধ্যে। দেখতে একেবারে চড়ুইপাখির মতো কিন্তু মোটা আর লোমহীন, কেমন ভেজা স্যাঁতসেঁতে আর ভয়ংকর। নিকিতা জানে, ও যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন তারা ওর চোখ শুষে পান করতে চায়।

‘দাঁড়াও, আমি তোমাদের উচিত শিক্ষা দেব !’ নিকিতা কুয়োর মধ্যে চেঁচিয়ে বলে,‘ওখানে নিচে তোমরা কী করছ ?’

কুয়োর পানি হঠাৎ ঘোলাটে হয়ে যায়, আর কারা ওদের চোয়াল চেপে ধরে। নিকিতা চিৎকার করার জন্য মুখ খুললেও কোনো শব্দ বেরুয় না। ভয়ে ওর কণ্ঠস্বর হারিয়ে গেছে। ওর হৃৎপিণ্ড কেঁপে উঠল আর মুহুর্তের জন্য  স্পন্দন বন্ধ হয়ে গেল। ও বুঝতে পারল, ‘এখানে ছেলেমেয়ে নিয়ে এক দৈত্য বাস করছে !’ ‘দাদাভাই,’ সূর্যের দিকে মুখ করে নিকিতা চেঁচিয়ে উঠল, ‘তুমি ওখানে আছ তো  দাদাভাই ?’ নিকিতা এরপর  ছুটে বাড়ি ফিরে আসে।

চালাঘরের কাছে আসার পর নিকিতার অনুভূতি ফিরে আসে। বেড়ার নিচ দিয়ে মাটিতে দুটো গর্ত চলে গেছে।  এখানেও গোপন বাসিন্দারা থাকে। কিন্তু তারা কারা ? সাপ হতে পারে। রাতে বুকে হেঁটে বেরিয়ে আসবে ওদের ঘরে, চুপিচুপি ঢুকে পড়বে, আর ঘুমে মগ্ন ওর মাকে কামড় দেবে। তখন মা মরে যাবে।

নিকিতা তাড়াতাড়ি ছুটে ঘরের ভিতরে গিয়ে টেবিল থেকে দুটো রুটির টুকরো  নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। প্রতিটি গর্তের কাছে এক টুকরো রুটি রেখে সাপদের বলল, ‘সাপ, সাপ, তোমরা রুটি খাও। দয়া করে রাত্তিরে আমাদের জ্বালাতন করো না।’

নিকিতা চারদিকে ঘুরে তাকালো। সবজি ক্ষেতের ভেতর একটি পুরনো গাছের গুঁড়ি আছে। ও যখন ওটার দিকে তাকাল, ওর মনে হলো, এটা দেখতে মানুষের মাথার মতো লাগছে। গুঁড়িটার চোখ, নাক এমনকি একটি মুখও আছে। নিকিতাকে দেখে সে চুপিচুপি হাসছিল। ‘তুমিও কি এখানে থাক ?’ নিকিতা জিজ্ঞেস করে নিকিতা।‘তবে বেরিয়ে এসো, গ্রামে আমাদের সবার সঙ্গে যোগ দাও, ক্ষেতজমিতে চাষবাস করো।’ উত্তরে গুঁড়িটি প্যাঁকপ্যাঁক করে    উঠল আর তার মুখে রাগ ভেসে উঠল। নিকিতা ভয় পেয়ে বলল, ‘আচ্ছা আচ্ছা,  ঠিক আছে, তোমাকে বেরিয়ে  আসতে হবে না, তুমি যেখানে আছ সেখানেই থাক বাপু।’

গ্রামের সব জায়গা সুনসান নীরব হয়ে গেছে, কোথাও কোনো শব্দ নেই। ওর মা কাজ করতে চলে গেছে অনেক দূরের জমিতে। সময়মত মায়ের কাছে ও পৌঁছাতে পারবে না। নিকিতা তাই রাগী গাছের গুঁড়িটাকে ছেড়ে কুঁড়েঘরের ভেতরে চলে আসে। এখানে ও ভয় পায় না, কিছুক্ষণ আগেও ওর মা এখানে ছিল। ঘরটি এখনও উষ্ণ হয়ে আছে। নিকিতা ওর জন্য মার রেখে যাওয়া দুধ খেতে চাইছিল, কিন্তু টেবিলের দিকে তাকাতেই ও খেয়াল করে, আরে ! টেবিলটাও যেন একজন মানুষ। এর শুধু চারটি পা আছে কিন্তু  কোনো হাত নেই।

নিকিতা বারান্দায় বেরিয়ে এল। সবজি ক্ষেত আর কুয়ো ছাড়িয়ে ওদের পুরনো গোসলখানা দেখা যাচ্ছে। চিমনিটা বদ্ধ থাকায় সেটার ভেতরেটা কালো হয়ে গেছে। মা বলেছিল, বেঁচে থাকতে ওর দাদাভাই সেখানে গোসল করতে খুব পছন্দ করত। গোসলখানাটি ছিল বেশ পুরনো আর শ্যাওলায় ঢাকা বিষাদছাওয়া ছোট্ট একটি ছাউনি।
‘এটি হচ্ছে আমাদের দাদিমা। তিনি আসলে মারা যাননি, বরং একটি গোসলখানায় পরিণত হয়ে গেছেন!’ প্রচন্ড আতঙ্ক নিয়ে নিকিতা ভাবল। ‘তিনি বেঁচে আছেন, বেঁচে আছেন; ওই যে তার মাথা – ওটা কোনো চিমনি নয়, ওটা হচ্ছে একটি মাথা; আর ওই যে তাঁর ফোকলা দাঁতের মুখখানি। আমি নিশ্চিত বলতে পারি,  দাদিমা আসলে এই গোসলখানা হওয়ার ভান করছে, সে আসলে এখনও একজন সহৃদয়া মহিলাই আছেন।’

কারুর একটা মোরগ রাস্তা থেকে উঠোনে ঢুকে পড়েছে। মোরগের মুখটা ছিল গত বসন্তে নদীতে ডুবে যাওয়া  সেই ছোট দাড়িওয়ালা শুকনো পশুপালকের মুখের মতন। লোকটি বন্যার জল সাঁতরে ওপারে যাওয়ার চেষ্টা করছিল যাতে সেখানকার  কোনো গ্রামের বিয়েতে গিয়ে সে মজা করতে পারে। নিকিতার ধারণা হলো যে, মৃত থাকার ব্যাপারটি  পশুপালক লোকটি মোটেও পছন্দ করছিল না, তাই এখন সে একটি মোরগ হয়ে গেছে। সুতরাং এই মোরগটি হচ্ছে একজন মানুষ – একজন গুপ্ত মানুষ। দেখা যাচ্ছে সব জায়গাতেই মানুষ আছে, কিন্তু মনে হচ্ছে, তারা আসলে মানুষ নয়।
নিকিতা একটি হলুদ ফুলের উপর ঝুঁকে পড়ে। এই ফুলটি কে ? এক দৃষ্টিতে দেখতে গিয়ে নিকিতা দেখল, ফুলের ছোট্ট গোল মুখটি আস্তে আস্তে মানুষের মুখ হয়ে যাচ্ছে।  সে দেখতে পেল ছোটো ছোটো দুটি চোখ, একটি নাক আর ভেজা মুক্ত মুখ যা থেকে সতেজ নিঃশ্বাসের সুগন্ধ আসছিল।

‘আমি তো ভেবেছিলাম তুমি সত্যিকারের একটি ফুল।’ নিকিতা বললো, ‘তোমার ভেতরটা আমাকে একবার দেখতে দাও। কী আছে তোমার ভেতরে ?’

নিকিতা ফুলের বোঁটা ছিঁড়ে ফেললে দেখতে পেল, ফুলের শরীরের ভেতরটা জুড়ে কিছু দুধ জমে আছে। অবাক  হয়ে ও বলল, ‘আরে তুমি তো একটি ছোট্ট সোনাবাচ্চা, মায়ের দুধ খাচ্ছ চুকচুক করে।’

ও পুরনো গোসলখানার দিকে চলে আসে। ‘দাদিম্মা’ নম্রভাবে ডাকে নিকিতা, কিন্তু  বলিরেখাযুক্ত মুখে ফোকলা দাঁতের দাদিম্মা ওর দিকে হিংস্রভাবে তাকাল, যেন সে  অপরিচিত কেউ। তখন নিকিতা বুঝতে পারে, ‘তুমি কিছুতেই আমার দাদিম্মা হতে পারো না, তুমি আসলে অন্য কেউ !’’

বেড়ার খুঁটিগুলো ওর দিকে এমনভাবে তাকিয়েছিল, যেন তারা সবাই  ভিড় করে আসা অচেনা মানুষ, নিকিতা যাদের চেনে না। সবগুলো মুখই ছিল ওর অচেনা, এরা কেউই ওকে ভালোবাসে না। একজন রেগেমেগে হাসছিল  তো আরেকজন ওর সম্পর্কে ক্ষতিকর কিছু ভাবছিল, আর তিন নম্বর খুঁটিটি শুকনো ডালপাতা জড়ানো হাতে বেড়া ঠেলে নিকিতার দিকে তেড়েফুড়ে আসছিল।

‘এই যে তোমরা এখানে কী করছ ?’ জানতে চায় নিকিতা। ‘এটা আমাদের বাড়ি।’ কিন্তু সেখানকার সবকিছু কেমন অদ্ভুত, রাগী মুখে ওর দিকে স্থির এবং তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ও ভাঁটফুল গাছগুলোর দিকে তাকালো  –– এরা নিশ্চয় দয়ামায়া দেখাবে ? এমনকি ভাঁটফু্ল গাছগুলো গোমড়ামুখে তাদের বড় মাথাগুলো নাড়াচ্ছিল, ওকে ভালোবাসছিল না।

নিকিতা মাটিতে মুখ ঠেসে শুয়ে পড়ে । মাটির ভেতর থেকে প্রচুর গুঞ্জন শোনা যায়, ওই নিবিড় অন্ধকারে নিশ্চয় অনেক বাস করে। নিকিতা শুনতে পায়, দিনের আলোতে বেরিয়ে আসার জন্য তারা হাত দিয়ে আপ্রাণ চেষ্টা করছে। ভয়ে আতঙ্কে নিকিতা উঠে পড়ে। সব জায়গাতে মানুষ বাস করছে, সব জায়গা থেকে তারা অদ্ভুত চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। আর যদি কোথাও এমন কেউ থাকে যে ওকে দেখতে পাচ্ছে না, তারাও মাটির পাতাল থেকে বেয়ে, কেউ কেউ গোপন গভীর গহবর থেকে, আবার কেউ কেউ চালাঘরের কালো কার্নিশের নিচ থেকে বেরিয়ে তার পেছনে ছুটবে।

নিকিতা কুঁড়েঘরটির দিকে তাকায়। ওর মনে হল, ঘরটি যেন দূরের কোন গ্রাম থেকে লম্বা পথ পেরিয়ে আসা এক   বুড়ি ওর দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলছে, ‘ওহে অকম্মা বাচ্চা, এ দুনিয়াতে তোমার মতন এমন অনেকে আছে — তাদের কাজ হচ্ছে বিনাপয়সায় ভালো ভালো গমের রুটি খাওয়া।’

‘মাগো তুমি বাড়ি ফিরে আসো’ দূরে কাজ করতে থাকা মাকে মিনতি করে ডাকে নিকিতা। ‘ওরা তোমাকে   অর্ধেক দিন কাজ করেছ বলে লিখে রাখুক।  কেমন সব অদ্ভুত লোকেরা এসে আমাদের বাড়ি ভরে ফেলেছে। এরা সবাই এখানে থাকতে  চাইছে। এদেরকে চলে যেতে বল।’ কিন্তু মা তার ছেলের কথা শুনতে পায় না। নিকিতা চালাঘরের পেছনে গিয়ে দেখতে চায়,  সেই গাছের গুঁড়ির মাথাটি মাটি ভেদ করে উঠে আসছে কিনা। অই গাছের গুঁড়িটির মাথায় বিশাল বড় মুখ আছে, যদি সে ওদের ক্ষেতের সমস্ত বাঁধাকপি খেয়ে ফেলে –  তাহলে শীতকালে ওর মা কী   করে বাঁধাকপির স্যুপ বানাবে?

দূর থেকে ভয়ে ভয়ে সবজিক্ষেতের মধ্যে গাছের গুঁড়িটির দিকে তাকাল নিকিতা। সেই দৃষ্টির প্রত্যুত্তরে গুঁড়িটির বুড়িয়া যাওয়া কোঁচকানো বাকলের আবরণে ঢাকা বিষন্ন, অপ্রসন্ন মুখে নিকিতার দিকে ফিরে অপলক চোখে ফিরে তাকাল। অনেক দূরে, গ্রামের ওপারের বন থেকে কেউ একজন জোরে চেঁচিয়ে উঠল, ‘ম্যাক্সিম, তুমি কোথায়?’

‘এই দুনিয়াতেই আছি’ গাছের গুঁড়ির মাথাটি গুমড়ে উঠে উত্তর দিল।

নিকিতা ঘুরে দাঁড়িয়ে ক্ষেতে কাজ করা ওর  মার কাছে ছুটে যেতে চাইল, কিন্তু পড়ে গেল। ভয়ে অবশ হয়ে গেল  নিকিতা। ওর পাদুটো এখন অচেনা মানুষের মতন হয়ে গেছে, ওর নির্দেশ শুনবে না। তাই পেটের উপর ভর দিয়ে এমনভাবে ছেঁচড়ে চলতে লাগল , যেন ও এখনও ছোট্টটি আছে, তাই হাঁটতে পারছে না।

‘দাদাভাই গো’ ফিসফিস করে ডেকে দয়াময় সূর্যের দিকে তাকাল নিকিতা। ওই  মুহুর্তে একটুকরো মেঘ আলোকে ঢেকে ফেললে সূর্যকে অনেকক্ষণ ধরে আর গেল না। ‘দাদাভাই, তুমি ফিরে এসো, আবার আমাদের সঙ্গে থাকো !’

সূর্যদাদাভাই মেঘের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল, সে তার মুখ থেকে তারাতাড়ি অন্ধকার ছায়া সরিয়ে ফেলে যাতে  সে দেখতে পায়, তার অসহায় নাতিটি কেমন করে মাটিতে হামাগুড়ি দিচ্ছে।  এখন দাদাভাই ওর দিকে তাকিয়ে আছে; ওকে দেখতে পাচ্ছে এটা মনে করে নিকিতা পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ায়, আর ছুটে যায় ওর মায়ের খোঁজে।

অনেকক্ষণ ধরে সে দৌঁড়ায়। গ্রামের মধ্য দিয়ে ধুলিময় ফাঁকা রাস্তা ধরে সে ছুটে গেল; তারপর গ্রাম পেরিয়ে গেলে   ক্লান্ত হয়ে একটি গোলাঘরের ছায়ায় বসে পড়ে। নিকিতা ওখানে বেশিক্ষণ বসে থাকতে চায়নি, কিন্তু মাটিতে মাথা এলিয়ে দিতেই কী  করে যেন ঘুমিয়ে পড়ল,  আর  সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত জেগে উঠল না। যৌথ খামারে কাজ পাওয়া নতুন রাখালটি ভেড়া চরাচ্ছিল। নিকিতা ওর মাকে খুঁজতে আবার দুরের মাঠে যেতে চাইলে,  রাখলটি জানাল যে, এখন বেশ দেরি হয়ে গেছে, ওর মা কাজ শেষ করে অনেক আগেই  মাঠ ছেড়ে বাড়ি  ফিরে গেছে।

বাড়ি ফিরে, নিকিতা ওর মাকে দেখতে পেল। মা টেবিলে বসে আছে।  আর একজন বয়স্ক সৈন্যের দিকে তাকিয়ে আছে, সৈন্যটি রুটি আর দুধ খাচ্ছিল।  সৈনিকটি নিকিতাকে দেখতে পেয়ে বেঞ্চ থেকে উঠে তাকে কোলে তুলে নিল।  সৈনিকটির শরীরে ছিল উষ্ণতার সুগন্ধ, রুটি এবং মাটির মত শুভসুন্দর, শান্তিপূর্ণ কিছুর সুবাস আসছিল। নিকিতা লজ্জায় কোনো কথাই বলতে পারছিল না।

‘হ্যালো, নিকিতা, সৈনিকটি বলল, ‘‘তুমি আমাকে ভুলে গেছ সোনা। অনেক বছর আগে, তুমি যখন এত্তোটুকু বাচ্চা ছিলে, তখন তোমাকে চুমু খেয়ে আমি যুদ্ধে চলে গিয়েছিলাম। আমি কিন্তু তোমাকে মনে রেখেছি। মৃত্যুর কাছাকাছি গিয়েও তোমাকে কখনও ভুলিনি আমি।’

‘নিকিতুশকা, তোমার বাবা, ও বাড়ি ফিরে এসেছে,’ এপ্রন দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে  মা জানাল। নিকিতা ওর বাবার দিকে ভালো করে তাকিয়ে—- তার মুখ, হাত,  বুকের উপর ঝুলিয়ে রাখা মেডেল— শার্টের উজ্জ্বল বোতামগুলো ছুঁয়ে দেখল।

‘তাহলে তুমি আবার দূরে চলে যাবে না তো ?’

‘না সোনা,’ বাবা বলল, ‘আমি সারাজীবন তোমার সাথে থাকব। আমরা শত্রুদের ধ্বংস করেছি, এবার সময় এসেছে তোমার আর তোমার মায়ের কথা ভাবার।’

সকালে নিকিতা উঠোনে বেরিয়ে, সেখানে  যারা বাস করত ­­–- সেই ভাঁটফুলগুলোকে, চালাঘরকে, বেড়ার খুঁটিগুলো  সবজি ক্ষেতে থাকা গাছের গুঁড়ির মাথা আর ওর দাদাভাইয়ের গোসলখানাকে, চেঁচিয়ে জানিয়ে দিল, ‘আমার বাবা বাড়িতে এসেছে, এবার থেকে চিরকাল আমাদের সাথে থাকবে।’

উঠানের সবাই নিশ্চুপ হয়ে ছিল – নিকিতা দেখতে পেল এরা সবাই একজন সৈনিক বাবাকে ভয় পেয়েছে – এমনকি মাটির নিচে যারা ছিল তারাও শান্ত হয়ে  গিয়েছিলে, তাদের কেউ আলোতে বেরিয়ে আসার জন্য আর হ্যাঁচোরপ্যাঁচোর করছিল না।

‘নিকিতা এখানে এসো। ওখানে কার সাথে কথা বলছ ?’
বাবা চালাঘরে ছিল। সেখানে যন্ত্রপাতিগুলোর উপর হাত বুলিয়ে পরখ করে নিচ্ছিলঃ কুড়াল, কোদাল, করাত, রেঁদা,  সাঁড়াশি, কাজের টেবিল, লোহার টুকরো এরকম আরো কত জিনিস যেগুলো তার ছিল। কাজ শেষ করে নিকিতার হাত ধরে বাবা  বাড়ির চারদিকে ঘুরে দেখতে লাগল;  কোথায় কী  ছিল, কী কী  জিনিস ভালো অবস্থায় আছে এবং কোনগুলি পচে গেছে, কী কী দরকার এবং কী কী  দরকার নেই সেগুলো।

মাত্র একদিন আগে দেখা, উঠানের প্রতিটি প্রাণীর মুখের দিকে তাকাল নিকিতা, কিন্তু এখন তাদের মধ্যে  লুকিয়ে থাকা কোনো ব্যক্তিকে আর দেখতে পেল না; কারও চোখ, নাক, মুখ কিংবা  ঘৃণাময় জীবন নেই। বেড়ার খুঁটিগুলো ছিল শুকিয়ে যাওয়া মোটা কাঠের লাঠি, অন্ধ এবং মরা, দাদাভাইয়ের গোসলখানাটিকেও দেখাচ্ছিল ছোট্ট একটি  কুটিরের মতো, বয়সের ভারে পচে যাওয়া কুটিরটি ধীরে ধীরে মাটিতে দেবে যাচ্ছিল।  নিকিতার গোসলখানাটির জন্য মন খারাপ হচ্ছিল, সেটি মরে যাচ্ছে, এবং কিছুদিনের মধ্যেই সেটি একেবারেই হারিয়ে যাবে। বাবা চালাঘর  থেকে কুড়াল নিয়ে সবজি ক্ষেতে থাকা গাছের গুড়িটিকে জ্বালানী কাঠের জন্য কাটতে শুরু করে। গুঁড়িটি তৎক্ষণাৎ ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যায়, পুরোটাই পচে গিয়েছিল, কাটার সময় ওর বাবার কুড়ালের নিচ থেকে সেটার  শুকনো ধূলোকণা গোলাপী  ধোঁয়ার মত বাতাসে ভেসে উঠছিল। যখন গাছের গুড়ির আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না, নিকিতা বাবাকে বললঃ ‘জানো তুমি যখন এখানে ছিলে না, তখন এটা বেঁচে ছিল আর কথা  বলত। এটার পাগুলো মাটির নিচে আছে আর একটা পেটও আছে।’
বাবা ছেলেকে নিয়ে কুঁড়েঘরে ফিরে এল। বাবা বলল, ‘না,  বাবা বলল, ‘এটা বহুদিন আগেই মারা গেছে। আসলে তুমি—-তুমি খুব দয়ালু মনের বলে সবকিছু বাঁচিয়ে রাখতে চাও। এমনকি এক টুকরো পাথরও তোমার কাছে জীবন্ত মনে হয়, তুমি ভাব, তোমার মৃত দাদিমা চাঁদে বাস করে।’

নিকিতা বলে ওঠে, ‘আর দাদাভাই থাকে সূর্যের ভেতর !’
বিকেলে চালাঘরে বসে ঘরের জন্য একটি নতুন মেঝে বানাবে বলে কাঠের বোর্ডগুলোকে মসৃণ করছিল বাবা, নিকিতাকেও একটি কাজ দিল সে—- হাতুড়ি দিয়ে বেঁকে যাওয়া পেরেকগুলোকে সোজা করার কাজ। বড়দের মত প্রচন্ড আগ্রহ নিয়ে নিকিতা  কাজে নেমে পড়ল।  যখন প্রথম পেরেকটি ও সোজা করে ফেলল, তখন পেরেকের  মধ্যে ছোট্ট একজন দয়ালু মানুষকে দেখতে পেল। লোকটি তার ছোট্ট লোহার টুপির নিচ থেকে ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে। নিকিতা এটা ওর বাবাকে দেখিয়ে বলল, ‘অন্য সবাই কেন এত দুষ্টু ছিল ? ভাঁটফুলগুলো দুষ্টু ছিল, গাছের গুঁড়ি, জলের মানুষও দুষ্টু ছিল, কিন্তু এই লোকটি কত ভালো আর দয়ালু।’

ছেলের উজ্জ্বল সুন্দর চুল ছুঁয়ে বাবা বলল, ‘ওদের সবাইকে তুমি কল্পনা থেকে তৈরি করেছিলে নিকিতা। ওরা কেউ সেখানে ছিল না, কেউ বাস্তবে সত্য নয়। এই কারণে ওরা দুষ্টু ছিল। আর তুমি তোমার নিজের পরিশ্রমে এই ছোট্ট মানুষটিকে তৈরি করেছ – সে কারণে সে ভালো এবং দয়ালু হয়েছে।’

নিকিতা ভাবতে শুরু করে, ‘বাবা তাহলে চলো আমরা নিজেরা পরিশ্রম করে সবকিছু বানাই। তাহলে সবকিছু জীবন্ত হয়ে উঠবে।’

‘হ্যাঁ, ঠিক বলেছ বেটা !’ বাবা ওর সঙ্গে একমত হয়, “ আমার ভালোমানুষ ‘কিত’, চলো আমরা শুরু করি।’’
যুদ্ধের সময় নিকিতাকে স্মরণ করে বাবা মনে মনে তাকে ‘ভালোমানুষ কিত’  বলে ডাকত। বাবা নিশ্চিত জানত,  নিকিতা যেমন একটা দয়ালু হৃদয় নিয়ে জন্মেছে, জীবনভর সেরকমই স্নেহসিক্ত দয়ালু মানুষ হয়েই থাকবে।

* রুশ থেকে রবার্ট চ্যাডলার, এলিজাবেথ চ্যাডলার ও অ্যাঞ্জেলা লিভিংস্টোন-কৃত ইংরেজি থেকে অনুবাদ

Facebook Comments

comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top