‘ব্যাপারটা আর সাধারণ পর্যায়ে নেই! অনেক ওপরে পৌছে গেছে!’ ঘরে পায়চারি করতে করতে বলল শুভর বন্ধু রাশেদ।
‘এক্সেক্টলি!’ বলল চিন্তাগ্রস্ত সমীর,‘পুলিশ কেন এভাবে গুলি চালাচ্ছে? এর মানে কী! দেশে আইন নেই?’
‘পুলিশ তো আর নিজে নিজে করছে না! তারা তো শুধু গোলাম! পালের গোদা তো…আর নাই বা বললাম!’ বলল সবুজ।
‘দেখ ভাই আমার কিন্তু বেশ ভয় করছে। ব্যাপারটা বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে গেছে! আমাদের…আমার মনে হয়…যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঢাকা ছেড়ে নিজেদের বাড়ি চলে যাওেয়া উচিত!’ বলল রনি। তার চেহারায় ভয়ের ছাপ। শুভ এতক্ষণ একটা কথাও বলেনি। রনির কথা শুনে না বলে পারল না।
‘পালিয়ে যাবো! প্রাণের ভয়ে!’ ‘দেখ এতে ভয়ের কথা তো আসছে না!’ বোঝানোর চেষ্টা করল রনি,‘আমরা এখানে থেকে কিছু করতে পারব বল? উল্টে আমাদের জান যাবে! আমাদের কিছু হেলে আমাদের পরিবারের কী হবে! আমার কথাই ধর। আমি মা-বাবার একমাত্র ছেলে। আমার কিছু হলে তাদের কী হবে!’
‘এ কথা তো সাঈদ ভাইও বলতে পারতেন যে উনি উনার বাবা-মায়ের ছোট ছেলে, তিনি চলে গেলে তাদের বুক ভেঙে যাবে! মুগ্ধ ভাই তো বলতে পারতেন যে উনি উনার যমজ ভাইকে কষ্ট দিতে চান না! বলেছেন? বলেন নি! পুলিশের বন্দুকের সামনে বুক পেতে দিয়েছেন! শুধুমাত্র অধিকার লাভের জন্য! নিজের ভাইবোনেদের, বন্ধুদের জন্য!’ বলতে বলতে ঠোঁট কেপেঁ উঠল শুভর। সে মাথা নামিয়ে নিল।
‘জানি না, সরকারি চাকরী করতে গেলে কী হবে! হয়তো বা সেটা স্বপ্নই থেকে যাবে!’বলল সমীর। ‘অসহ্য! ভাবতেই পারছি না এমন একটা দেশে আছি যেখানে গণতন্ত্রের নামে স্বৈরাচারী হয়! অধিকার চাইতে গেলাম, আর উনি আমাদের রাজাকার বানিয়ে দিলেন! এর প্রতিবাদ করাই দরকার!’
‘তোরা যা খুশি কর আমি কুমিল্লা ফিরে যাব।’ বলে রনি উঠে চলেই যাচ্ছিল। শুভ নিজ মনে বলে উঠল,‘যেতে তো আমিও পারি। কিন্তু, বিবেক যে যেতে দেবে না! বারবার এই রিগ্রেট পীড়া দিতে থাকবে মনে!’
এসময়ে তার ফোন বেজে উঠল। তার বোন সুহানী ফোন করেছে। ‘হ্যালো?’ ‘হ্যালো শুভদা। তুমি..কোথায়?’
‘হলে। বল কী বলবি।’
‘আসলে…মা-বাবা বলছিল…তোমাকে কল করে যেন বলি…তাড়াতাড়ি কুমিল্লা চলে আসতে। ঢাকার অবস্থা ভালো না।’
শুভ কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থাকল। এরপর দৃঢ় কন্ঠে বলল,‘কাকা-কাকীকে বল, আমাকে নিয়ে যেন টেনশন না করে।’
‘তুমি আসবে না?’ উদ্বিগ্নভাবে জিজ্ঞাসা করে সুহানী।
শুভ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,‘কয়েক মাইলের ব্যবধানে আমার বয়সী ছেলেমেয়েরা অধিকারের লড়াই লড়তে দিন-রাত এক করে দিচ্ছে, বন্দুকের নলের সামনে বুক পেঁতে দিচ্ছে, আর আমি কুমিল্লায় গিয়ে বসে থাকবো?’
সুহানী মুখে কিছুটা চিন্তার ছায়া পড়ল। সে উত্তর দিতে পারল না। ‘তোর শুভদাকে তোর এমনই মনে হয়?’
সুহানী জবাব দেয়ার জন্য মুখ খুলতে যেতেই পেছন থেকে তার মা বললেন,‘কী বলছে শুভ? লাউড স্পিকারে দে।’ সুহানী লাউড স্পিকারে দিল।
বাবা বললেন,‘দেখ শুভ, এই বিপদে পড়তে যাস না। কথাটা শোন। তুই..কুমিল্লায় চলে আয়।’
শুভ বলল,‘আসতে তো পারি কাকা, কিন্তু..পালিয়ে গেলে…আমার মা-বাবা কী আমাকে ক্ষমা করবেন?’ ‘দেখ শুভ-’
‘আমি জানি তোমরা কেন চিন্তা করছো। কিন্তু আমি সব জেনেশুনে বসে থাকতে পারব না। আই এম সরি।’
কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থাকার পর সে বলল, ‘এর জন্য…যদি আমাকে আমার পরিবারের কাছে চলে যেতে হয়…তো তাই যাবো। তবু…বিবেকের দংশনে সারাজীবন ভুগতে আমি পারব না।সরি।’
সুহানীর চোখে পানি এল। সে কাঁদছে বুঝতে পেরে শুভ বলল,‘কেঁদে কিছু হবে না সুহানী। এই লড়াই আমাদের সবার। জি জেনারেশনের। মাঠে না নামিস, কিন্তু মুখ বন্ধ করে বসে থাকিস না। এটাই আমার অনুরোধ তোর কাছে।’ সুহানী বহু কষ্টে বলল,‘শুভদা…আমি…পাশে আছি তোমার। আমি এই আন্দোলনকে সাপোর্ট করি।…ডু…ইওর..বেস্ট। …সাহস দিয়ে…সফল হয়ে…এসো। আমরা…তোমার অপেক্ষায় থাকবো!’ বলে সে মুখ ফিরিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল। শুভর চোখেও পানি এল। সে সবসময়েই সুহানীকে পাশে পায়। তবে এক্ষেত্রে পাবে ভাবতে পারেনি। সুহানী যে যথেষ্ট বুঝদার মেয়ে, এটাই তার প্রমাণ।
বেশ কিছুদিন পর ভালোভাবে চোখ মেলল শুভ। আশেপাশে তাকিয়ে বুঝল, হসপিটালের বেডে শুয়ে আছে। তার ডান হাতে ব্যান্ডেজ। কী হয়েছে মনে করার চেষ্টা করল শুভ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল তারা পাঁচ বন্ধু। অন্যদের উৎসাহে রনিও এগিয়ে আসে। সবুজ, রাশেদ আর সমীর আন্দোলনের পোস্টার,ফেস্টুন তৈরি করার দায়িত্ব নেয়। সাথে মিছিলেও অংশ নেয়। অন্যদিকে রনি আর শুভ একটু ভিন্নরকমের প্ল্যান করে। সমন্বয়কদের সাথে কথা বলে তারা প্ল্যান করে যে, তারা সাধারণ মানুষের ছদ্মবেশে লুকিয়ে নজর রাখবে পুলিশ কোনদিক থেকে আসছে। দেখতে পেলেই কল করবে।তাহলে তারাও রেডি হয়ে যাবে। বেশ কিছুদিন এরকমভাবেই কাজ করে তারা। এরপরও আহত ও নিহত হয় অনেকে। তাই এবার আরও কঠোর হয় সকলে। প্রজ্ঞাপন দিয়ে মেধা কোটা দেয়া হয় ঠিকই, কিন্তু এরপর শুরু হয় অন্যায়ভাবে গ্রেফতার ও হত্যা। তাই এবারে শুরু হয় ১ দফা দাবি, সরকার পতনের দাবি। কুমিল্লার পুলিশ লাইনের মিছিলে অংশ নিতে কুমিল্লায়ে যায় তারা। তবে বাড়িতে কেউ যোগাযোগ করে না। সেখানে কয়েকটি ছোট ছেলেমেয়ের দিকে পুলিশ বন্দুক তাক করলে রনি, শুভ ও তাদের বাকি বন্ধুরা ছেলেমেয়েগুলোরর সামনে দাঁড়িয়ে যায়। সংঘর্ষ ঘটে যায়। পুলিশ গুলি চালালে তারা পাঁচজনই আহত হয়। শুভর ডান হাতে গুলি লাগে। মিছিলের ছাত্ররা শুভর ফোন থেকে তার বাড়িতে ফোন করে। রক্তপাতের কারণে বেশ কিছুদিন ভালোভাবে জ্ঞান ছিল না শুভর। অবশেষে ৫ই আগষ্ট বিকেলে পুরোপুরি জ্ঞান ফেরে তার। জ্ঞান ফিরলে পাশে তাকিয়ে দেখে তার চার বন্ধু রনি, সমীর, রাশেদ, সবুজ একে অপরকে জরিয়ে ধরে কাঁদছে। আর তার বোন সুহানী তার মা-বাবাকে ধরে অঝোরে কাঁদছে। সে অবাক হয়ে গেল। ধীরে ধীরে জিজ্ঞাসা করল,‘সু..সুহানী। কী..হয়েছে?’
সকলে তার দিকে তাকাল। সকলের ঠোঁটে হাসি ফুটল। সে আবার জিজ্ঞেস করল,‘কাঁদছিস… কেন?’
সুহানী এগিয়ে এসে শুভর কাঁধে হাত দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল,‘শুভদা..শুভদা আমরা জিতে গেছি! আমরা জিতে গেছি! তোমাদের…কষ্ট বৃথা যায়নি! তোমাদের গুলিবিদ্ধ হওয়া বৃথা যায়নি! আবু সাঈদ, মীর মুগ্ধর রক্ত বৃথা যায়নি!’
‘কী..কী হয়েছে?’ উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করল শুভ।
সুহানী কাঁদার মধ্যে হেসে খুলে রাখা টিভির দিকে দেখাল। শুভ ব্রেকিং নিউজে দেখল, ‘‘প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়েছেন শেখ হাসিনা।’’
শুভ চুপ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল টিভির দিকে। নিজের চোখকেই যেন বিশ্বাস করতে পারল না। চোখের পানি ধরে রাখতে পারল না সে। চোখ থেকে খুশির অশ্রু বের হতে শুরু করল তারও। রনি এগিয়ে এসে বলল,‘ আজ থেকে আমাদের নতুন বিজয় দিবস, ৫ই আগষ্ট, ২০২৪। আমরা জিতে গেছি। আমরা বিজয়ী।’
শুভ কিছু সময় পর সুহানীর দিকে তাকাল। তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘থ্যাঙ্কস সুহানী। জানিস, কখনো কখনো কথাও অনেক বড় কাজ করতে পারে। তুই আমাকে বলেছিলি না, সাহস দিয়ে সফল হও? এই কথা মনে রেখেই, সাহস দিয়ে আমরা লড়েছি, গুলি লেগে জ্ঞান হারানো পর্যন্ত।’ একে অপরেকে জড়িয়ে ধরল দুই ভাইবোন। খুশির অশ্রুতে ভিজে উঠল দুজনের কাঁধ।