কাওড়ামঙ্গল (শেষ পর্ব) II রোমেল রহমান

৪৫

দমে যার নাম গাঁথা
তার টানে নড়ে পাতা,
সব ছেড়ে লুটেপুটে
তার দিকে যাই ছুটে।

ভোরে পাল তুলে নিয়ে সব গুছিয়ে চলে যাচ্ছে কাওড়ারা। রাস্তার পর রাস্তা পেরোচ্ছে। কখনো মাঠ পেরোচ্ছে। পথের দুইধারে নানান রকম জীবন, রঙ, মাটি।  হাঁটতে হাঁটতে একটা শূকরীর প্রসব হচ্ছে। মঙ্গল সর্দারের যেন ভূত ভর করে। আজকে আর পাল থামায় না সে।কাওড়ারা সবাই ক্লান্ত হয়ে যায়। পরস্পরের দিকে তাকিয়ে তারা নির্বাক ভাষায় ভাব বিনিময় করে যে, সর্দারের হল কি আজকে? দীর্ঘ দীর্ঘ একেকটা বিল যার আগামাথা ঠাওর করা যায় না, পাড়ি দিয়ে একটা বিলের মধ্যখানে মঙ্গলের পাল এসে থমকায়। হঠাৎ দৃষ্টির প্রান্তসীমানা থেকে একটা ক্ষুদ্র পাল দেখা যায়।  দিপেন চেঁচিয়ে বলে ওঠে,

দিপেন : কাকা ঐ আরেট্টা পাল দেহা যাচ্ছে। আমাগের দিকি আসতিছে মনে কয়।

স্বপন : ওডা মনে কয় কাওড়ার নিজির পাল।

মঙ্গল স্থির দাঁড়িয়ে যায়। চোখ বুজে থাকে। একটা কাঁপন টের পায় শরীরের মধ্যে। বাতাস শুঁকতে থাকে যেন। তারপর তাকায়। নিরিখ করে তাকিয়ে থাকে। বুকের মধ্যে তার কি এক টান প্রবল হয়। আচমকা মঙ্গল হাতের লাঠি আর টোপা ফেলে দৌড় দেয়।  সেই পালের দিকে।  সবার চোখে মুখে ভাঁজ পড়ে।  স্বপন বুঝতে পারে ব্যাপারটা।  হাত উঁচু করে সে অন্য কাওড়াদের নিস্তার করে সর্দারের পিছু নেবার ব্যাপারে।

দিনেশ : আরে আরে কি হল কাকা?

স্বপন : যাক।

হরিপদ : আমরা যাবো না?

স্বপন : নাহ। ঠাকুরের পাল মনে কয়।

দিপেন : আনন্দ ঠাকুর উদয় হইছে?

আনন্দ ঠাকুরের সামনে গিয়ে মঙ্গল হাফসাতে থাকে।

আনন্দ : আস্তে। শান্ত হও।জিরেয় নেও।

মঙ্গল : আবার তোমার দেহা পালাম?

আনন্দ : কই, দেহা তো প্রায় প্রায় হয়। হয় না?

মঙ্গল মাথা ঝাঁকায়,

আনন্দ : আমি তো তোর সন্ধানে বের হইছি এবার। উল্টো দিক দিয়ে নামিছি তোরে এই বিলির মদ্দি ধরবো বইলে।

মঙ্গল : কয়মাস আগে না তুমি আমার পালের মড়ক সারলা?

আনন্দ : তাই নাকি?

মঙ্গল দ্বিধায় কেঁপে ওঠে, চোখ বুজে দাঁড়িয়ে থাকে।  মঙ্গলের ভির্মি লাগে।  আকাশে প্রখর সূর্য। মঙ্গল চোখ খুলে দেখে সামনে কেউ নেই, কোন পাল নেই।  এক মরমী অনুরণন নিয়ে মঙ্গল পালে ফেরে আস্তে আস্তে হেঁটে।  যেন সব থেকেও তার কিচ্ছু নেই।

মঙ্গল : নাহ। কেউ না। ভুল দেখিছি।

স্বপন : কিন্তু আমরাও যে দেখলাম এট্টা পাল।

মঙ্গল : গেলো কই সিডা?

স্বপন : আমি তো ভাবলাম আনন্দ ঠাহুরের পাল।

দিপেন : আমি যে দেখলাম এট্টা পাল এগোয় আসতিছে তার দিকি তুমি দৌড়োয় গেলা।

মঙ্গল : যা দেহি তা কি আসল দেহি? ন্যে চল।

দিপেন : ভূতের পাল্লায় পরলাম না তো কাকা? বিলি তো ভূত লাগে।

স্বপন : কত কি লাগে কত কি দেহা দেয়।

সবাই ব্যস্ত হয় পালে। শুধু মঙ্গল স্বপনের দিকে আস্তে বলে,

মঙ্গল : বুইঝলে কাকা, আমার আর হবে নানে।  আমারে ধরিছে। বুইঝে ফেলিছি আমি।

স্বপন ভীষণ মায়া নিয়ে তাকিয়ে থাকে দৃঢ় মঙ্গলের এই নরম হয়ে আসার দিকে। দিপেন হা করে তাকিয়ে থাকে, সে এসবের কিছুই বুঝতে পারে না।

সেই দিনের পর থেকে মঙ্গলকে অন্যরকম লাগে।  দিনে দিনে যেন সে এক গভীর ঘোরের মধ্যে ডুবে যায় ক্রমে।  পালে জন্ম নেওয়া নতুন ছাউ গুলো বড় হতে থাকে।  পথে পথে হাটে বাজারে বেচাবিক্রি চলতে থাকে।  মঙ্গল পাল নিয়ে আগায় কিন্তু তাকে যারা চেনে তারা টের পায় সর্দারের মনের মধ্যে কি যেন একটা ঘটে যাচ্ছে! পালের মধ্যে থেকেও যেন সে নাই।  মঙ্গলের ঘুম কমে আসে।  প্রায় প্রায় ঘুমের মধ্যে লাফিয়ে উঠে কারো হাত ধরতে যায়! কিন্তু যখন টের পায় স্বপ্ন ছিল; তখন দীর্ঘশ্বাস ফেলে, চুপচাপ চোখ  মোছে।  শীতের কয় মাস পাড়ি দিতে দিতে পাল বড় হয়ে যায়।  ক্ষতি পুষিয়ে কয়েকগুণ লাভ না হলেও, কাওড়াদের পাওনা দিয়ে মহাজনের অন্তত দ্বিগুণ পয়সা আসবে সেটা নিশ্চিত হয়।  মঙ্গল শুধু স্বস্তি বোধ করে পালের দিকে তাকিয়ে যে, তার বদনাম হওয়া থেকে সে নিজেকে বাঁচাতে পেরেছে।  যদিও সে জানে মহাজনের সাথে তার ক্যাচাল লাগবেই।  কারণ মহাজনের ছেলে হিসেবের অংক বুঝলেও পালের রীতিনীতি জানে না।  স্বপন কাকা পালে যোগ দেয়ায় মঙ্গলের কিছুটা ভার সে নিজে তুলে নিয়েছে।  কাওড়াদের সবার মধ্যে একটা চনমনে ভাব।  কারণ সর্দার জানিয়েছে পাল আর দূরে নেবে না, বাড়ির দিকে ফিরবে।  বছর ঘুরে এসেছে প্রায়, চুক্তি আর বাড়াবে না নাকি।  এটা অবশ্য কাউকে কাউকে চিন্তায় ফেলে দেয়।  কারণ মঙ্গলের সাথে যারা দীর্ঘদিন কাজ করে অভ্যস্ত তারা অন্যদের সাথে কাজে যেয়ে আরাম পায় না।  তবে দিনেশের ধারণা হয় মঙ্গল সর্দার এবার মহাজন হয়ে স্বপন কাকাকে দিয়ে পাল নামাবে।  আবার এমনও হতে পারে সর্দার নিজেই হয়তো নিজের পাল নিয়ে নামাবে, তাই সে চুক্তি না বাড়াবার সঙ্কেত জানিয়েছে।

৪৬

ঘড়া ভেঙে মুক্ত হল
বন্দি মনের পাখি,
নগদ-বাকির দুনিয়াদারীর
সবই যেন ফাঁকি।

ভর দুপুরবেলা পাল ফিরে আসে কাওড়া পাড়ায়।বাচ্চারা হল্লা করে ওঠে।  মহাজনের আঙ্গিনায় বিরাট এক পাল নিয়ে থামে মঙ্গল সর্দার। মঙ্গল বুঝিয়ে দেয় হিসেব।  সুমিত আর তার বাপ মনোরঞ্জন দুটো চেয়ারে বসা। সুমিতের সামনে হিসেবের খাতা।

মহাজন : শুনলাম তুই নিকি এইবারে সর্দারি কইরে আর কাজ করবি নে?

মঙ্গল : সিরামই ইচ্ছে ছিল! সারাজীবন তো কল্লাম! কিন্তু ভগবানের কৃপা হল না।ভাবিলাম নিজে কয়ডা শুয়োর ন্যে পাল চালাবো!

মহাজন : মহাজন হবি আমার মতন? টাহা জমাইছিস কত?

মঙ্গল : সারাজীবন আপনার নুন খাইছি! আপনারে ডিঙ্গবো কিরাম কইরে?

মহাজন : দেহা যাক কপালে কার কী আছে। নে হিসেব মিটে।

সুমিত : মঙ্গল কাকার তো কোন হিসেব নেই। সব ক্লিয়ার।

অন্য কাওড়ারা সবাই তাকিয়ে পড়ে। মহাজন মুচকি হাসে।

মঙ্গল : তাও একবার শুনোয় দেও। তোমার বাপ আছে তারও জানা দরকার কিরাম মহাজন রাইখে যাচ্ছে সে।

সুমিত : সর্দার হিসেবে তোমারে যে দরশটা শুয়োর দিইলাম তা নিয়ে নিলাম আমরা ক্ষতিপূরণ হিসেবে।  তোমরা জানাইছ কয়ডা শুয়োর চান্দা হিসেবে লুইটে নিয়ে গেইছে গুন্ডোরা। যদিও আমার বিশ্বাস হয় না।গোপনে বেইচে দিয়ে ভুলভাল খবর দিইছো।

মঙ্গল : এডা কলাম বেশি কচ্ছ ছোট মহাজন।

দিপেন : আমারে মাইরে ভচকায় দিয়ে গেইলো গুন্ডোরা।

সুমিত : কিডা কারে মারিছে তা কি আমরা দেখতি গেইলাম?

স্বপন : কি কচ্ছ এইসব ছোট মহাজন। বেচা বিক্কিরের পর দেহিছো কি অবস্থা পালের। কয়ডা দিইলে আর ফিরিছে কি বিরাট পাল।  তাকায় দেহো একবার!

সুমিত : এহ্‌। তুমি আবার কথা মারাচ্ছ ক্যান? ভাগ পাইছো?

মঙ্গল : আচ্ছা ছোট মহাজন, দেলাম তোমারে আমার ঐ দশটা শুয়োর ক্ষতিপূরণ হিসেবে। এহন বাকি হিসেব কও।সবাইর সামনে শুনোয়ে কও।

সুমিত : মড়ক লাইগে মরিছে তিরিশটা শুয়োর।তা সর্দার হিসেবে ঐ শুয়োরের দায়িত্ব তুমার।তুমি নিদানের ব্যবস্থা নিতি পারো নি।  দোষ তোমার।

দিপেন : এহ্‌ আনন্দ ঠাকুররে খুইজে আইনে নিদান নিছি আমরা পালে।  সবাই সাক্ষী।

সুমিত : ফট ফট কইরে লাফায় উঠিস ক্যান সাইয়ো?  কাজ দেবো নানে তহন না খায়ে মরবিনি কলাম।

স্বপন : কথা কলাম সত্যি মহাজন।  আনন্দ ঠাকুর আইলো।

সুমিত : কোন ঠাহুর আইলো তা দ্যে আমি করবো কি? আমার শুয়োর যে গোপনে বেইচে দিয়ে তুমরা মড়ক লাগিছে কয়ে বেড়াচ্ছ না সেডা কবে খিডা? এইসব ঠাহুর ফাহুরের গলফ দিয়ে না আমারে!

মনোরঞ্জন : আহা। আস্তে সুমিত।  আনন্দ ঠাকুররে বোঝার বয়স এহনো তোর হই নি। তারে ছাড়।

সুমিত প্রচণ্ড রেগে যায় দুলতে থাকে।

সুমিত : ওসব আমি জানি নে বাবা।  আমার দরকারও নেই। মহাজন যহন আমি তালি আমার কথা এগের মানতি হবে।

মঙ্গল : কয়ে যাও ছোট মহাজন। আমি তো না কইনি তোমার অভিযোগে।

সুমিত : তিরিশটা শুয়োরের ক্ষতিপূরণ বাবদ মঙ্গল সর্দার কোন পাওনা পাবে না।আমি তার বাকি টাকার থে কাইটে নিলাম।উল্টো আমি আরো টাকা পাবো।

সব কাওড়াদের মধ্যে এট্টা গজগজ স্বর ওঠে।

মঙ্গল : দেবো সব মিটেয় দেবো। তোমারে তো বইলে কোন লাভ নেই।  বোধচোদ নেই তোমার।  খালি তোমার বাপরে এট্টু জিজ্ঞেস করতি চাই যে, মহাজন আপনি কি বিশ্বাস করেন না মড়কের কথা? আমি তো আইজ তিরিশ বচ্ছরের বেশি কাজ করি আপনার পালে।

দ্বিধা নিয়ে মনোরঞ্জন গলা খাকারি দিয়ে বলে,

মনোরঞ্জন : দেহো আমি তো বইলেই দিছি এহন থে ব্যবসা সুমিত দেখপে।  তাছাড়া তোর নামে কথা উঠিছে যে, তুই পাল নামাবি আগামী বচ্ছর।  এহন কার মনে কি তাকি সবসময় বুঝা যায়? সারা জীবন তো সবাই এক রকম থাহে না। সুমিতের কথাই আমার কথা।

মঙ্গল : বুঝিছি মহাজন। এইডে জানতি চাচ্ছিলাম। আচ্ছা আমি বাকি টাকাও দিয়ে দেবো আমার গাট্টির থে। বিশ্বাস নিয়েই যহন টানাটানি।

মনোরঞ্জন : এক কাজ কর মঙ্গল, তুই সন্ধ্যায় আয়। এট্টা সমাধানের রাস্তা করবানি।

মঙ্গল : না মহাজন। আর আটকায় রাইখেন না। সারা জীবন কাজ করিছি। বদনাম হইনি আমার। শেষবারে নিজেরে বিক্কির করবো ক্যান? আমি টাকা মিটেয় দ্যে যাচ্ছি। আর আমি আজকের থে আপনার পাল ছাড়লাম।

সুমিত : দেখিছো? বলিছিলাম না টাহা আছে ওর কাছে।

মঙ্গল : আমার তো খরচই নেই, তাই জমাও বেশি নেই। তোমাগের খরচ বেশি জমাও বেশি।

সুমিত : কি কতি চাচ্ছ তুমি?

মঙ্গল : তোমার বাপ যা কতি পাল্লো না তাই।

সবাই থতমত খেয়ে যায়। সুমিত হা হয়ে তাকিয়ে থাকে ক্রোধে।  মনোরঞ্জন মহাজন হাত ইশারায় বেরিয়ে যেতে বলে মঙ্গলকে। মঙ্গল সেটা দেখে ফোঁস ফোঁস করতে করতে বেরিয়ে যায়।

মঙ্গল ক্ষিপ্র গতিতে ঘরে ঢোকে। তার চোখেমুখে ক্রোধ। মঙ্গলের মেয়ে শিখা বাবাকে দেখে খুশি হতে গিয়ে টের পায় বাবা ক্ষেপে আছে কোন ব্যাপারে। শিখা তাকিয়ে দেখতে থাকে।  ঘরে ঢুকেই তছনছ করে, চালের ড্রামের মধ্য থেকে একটা মুখ বাঁধা ঘটি বের করে মঙ্গল।  তার মধ্যে রাখা কয়েক হাজার টাকা গুনে বেরিয়ে যাবার সময় শিখা বলে ওঠে।

শিখা : কি হলো বাবা?

মঙ্গল : মুক্তি হলো আমার।

৪৭

আমি কান্দি তোমার জন্যে
তুমি কান্দ ক্যান?
দুঃখে আমারা জোড়া শালিক
দুঃখ যেন ধ্যান!

পাড়ার বাচ্চারা হল্লা করে বাবারা ফিরে আসায়।  মহিলারা ব্যস্ত হয় গোছগাছ করতে।  কেউ একটু কাজল দেয় কেউ শারি পাল্টে নতুন শারি পরে।  কেউ রান্নার জোগাড় করে।  দূর থেকে এইসব দেখে নীলে।  তার জন্য কেউ ফেরে নি।

বাচ্চাকাচ্চারা : পাল ফিরিছে। পাল ফিরিছে। হেঁই হেঁই হেঁই।

পালের সাথে বাপ ফিরিছে বাপ ফিরিছে। হেঁই হেঁই হেঁই।

দিপেন এসে উঁকি দেয় দরজার একপাশে দাঁড়িয়ে। দেখে আয়নায় তাকিয়ে চোখে কাজল পড়ছে কালি। পা টিপে টিপে ঢুকে ফট করে জাপটে ধরে।  কালি হাসিতে গড়াগড়ি খায়।

সেদিন সন্ধ্যায় কালি ঘরের মধ্যে বিছানা ঠিক করছে। পেছন থেকে নীলে ঢুকে কালিকে জাপটে ধরে ঘাড়ে চুমু খায়।

কালি : নীলে দিদি।

নীলে : তোর ভাতার কই?

কালি : বাজারে গেইছে।

নীলে : ভালোমন্দ রান্দিস আজকেরে।

কালি : তুমি খাবা আমাগের সাথে?

নীলে : না রে।

কালি : এই কমলাডা নেও দিদি। খাও।

নীলে : এতো ছোট কমলা আমি খাই না।

কালি : সব কয়ডাই এইরাম।

নীলে : না রে সবারডা না।

নীলে হেসে ফেলে। দুজনে হাসে।

নীলে : সেদিন সালিসে মিথ্যে কথা কলি ক্যান?

কালি মুখ গুঁজে থাকে।

কালি : তুমি এট্টা বিয়ে করো দিদি।  আর কয়দিন একা একা থাকপা।  আবার সংসার নেও।

নীলে : ক্যান রে? ভাতার ছাড়া কি থাহা যায় না?

কালি : আমার জম্মের মায়া লাগে তোমার জন্নি।

নীলে : ওরে বাবারে এ দেহি আমার মা। তা আগে কবি না। তায় আর কয়ডা দিন থাকতাম তোর সাথে।

কালি : কালি যাচ্ছ কই তুমি?

নীলে : মেম হতি যাচ্ছি।  কালকের থে আর নিচু জাতের মানুষ থাকপো নানে আমি। দেখিসকেনে খেলা। সাহেবও বিয়ে কইরে ফেলাতি পারি। তারপর পাটরানী সাইজে আস্প তোগের পাড়ায়।

কালি : কি কচ্ছ দিদি?

নীলে : এক যায়গায় চাকরি পাইয়ে গেইছি আমি। এট্টা খেরেস্তান এঞ্জিওতে।  উরাই ন্যে যাবে।

কালি : তালি এহেনে থাকপে খিডা?

নীলে : আমার ভূত।

কালির চোখ বেয়ে জল নামে।

নীলে : আমি খিরিস্টান হয়ে যাচ্ছি কালি। আর আমারে কাওড়া মাগী কতি পারবি না ন্যে।

কালি : হা ভগবান। কচ্ছ কি?

নীলে : এই-ই ভালো। মরতি যহন পারিনি বাঁইচে তো থাহা লাগবে।

কালি কাঁদতে থাকে নীলে তাকে জড়িয়ে ধরে কানে কানে বলে,

নীলে : আমি ছিমড়া হলি তোরে নিয়ে ভাইগে যাতাম। তারপর তোরে চুইষে খাতাম দিপেন যিরাম খায়।

কালি কাঁদতে কাঁদতে হেসে ফেলে।  নীলে বেরিয়ে যায়।

 

৪৮

আমি যাই দূর দেশে
তুমি থাকো ভালোবেসে
দেখা হবে দিন শেষে
মায়া রেখে যাই ভেসে।

কাওড়া পাড়ায় উৎসবের ঢল যাচ্ছে।  ঘরে ঘরে পুরুষেরা ফিরেছে।  দিনেশ তার বউকে বিছানায় পিষে ধরেছে। হরিপদের বউ রান্না করছে, পাশে হরিপদ বসা। দিপেন বউয়ের পেটে কান লাগিয়ে কথা বলছে অনাগত সন্তানের সাথে।

দিপেন : হেঁই খিডা তুই পেটের মদ্দি? হেঁই কাওড়া। কবে আস্পি তুই? কাওড়াগের রাজা হবি? হেঁই কাওড়া, তুই সর্দার না মহাজন? হেঁই কাওড়া বিটা কিরাম আছিস তুই?

আবছায়ার মধ্যে একটা পোটলা নিয়ে বেরিয়ে যায় নীলে।  যাবার আগে পাড়ার দিকে ভীষণ মমতা নিয়ে একবার তাকায়।

৪৯/১

তার শিসে ঘুম ভাঙে
জেগে দেখি রাত,
তার ঘ্রাণ টের পাই
হাতে তার হাত।

মঙ্গল ঘুমাচ্ছে। স্বপ্ন দেখছে একটা দীর্ঘ প্রান্তরের মধ্যে একপাল শুয়োর ঘোঁত ঘোঁত শব্দ করে হেঁটে যাচ্ছে।কিন্তু পালে কোন কাওড়া নেই।  শুয়োর পালটা ছড়িয়ে যাচ্ছে।মঙ্গল ধড়ফড় করে উঠে বসে হাঁপাতে থাকে। অনেকক্ষণ খিঁচ মেরে বসে থাকে। হঠাৎ উঠে দাঁড়ায়। তার টোপা আর লাঠিটা নিয়ে বের হবার প্রস্তুতি নেয়।উন্মাদের মতো মনে হয় তাকে।  শিখা ঘুম থেকে উঠে বলে।

শিখা : কি হল বাবা?

মঙ্গল : যাচ্ছি।ডাক আইছে।

শিখা : কই যাচ্ছ?

মঙ্গল কোন উত্তর দেয় না। ছলছল চোখে তাকিয়ে থাকে।

৪৯/২

আমার ঘুম তুমি
শান্তি তুমি
তুমি যন্ত্রণা,
আমারে মুক্ত করো
শেষ করো
দাও মন্ত্রণা!

কুয়াশাচ্ছন্ন একটা বিরাট মাঠের মধ্যে মঙ্গল উন্মাদের মতো এইদিক ওদিক খুঁজতে থাকে কিন্তু কোথাও শুয়োরের কোন পাল নেই।  অসহায়ত্বে ভেঙে পড়ে মঙ্গল।  বিভ্রান্তিতে কুণ্ঠিত হয়ে পড়ে মাঠের মধ্যে।  হঠাৎ দূরে দেখা যায় একটা ছোট্ট পাল নিয়ে একজন কাওড়া এগিয়ে আসছে তার দিকেই। মঙ্গল হতভম্ব চোখে তাকিয়ে থাকে। একটু পর স্পষ্ট হয় আনন্দ ঠাকুর।  মুখে শব্দ করছে –  হুই হুই। হুট হুট। যাহ্‌ যাহ্‌।  মঙ্গল উন্মাদের মতো ছুটে যায় সেইদিকে।

আনন্দ : কিরে সব শেষ?

মঙ্গল হুহু স্বরে কাঁদতে থাকে।

মঙ্গল : আমার ঘোম নেই চোহে। শুই কিন্তু ঘুমোতি ভয় হয়।  খালি স্বপ্নে হাবিজাবি দেহি।

আনন্দ : কোন্ডা স্বপ্ন?

মঙ্গল : আমি জানি না। তুমি এট্টা বিধান করো।

আনন্দ : তুই তো কাওড়াগের আশীর্বাদ মঙ্গল। অনেক কাজ তোর। এবার থে তোর মহাজনী। সর্দারি তো করলি অনেককাল এবার ভার নে।

মঙ্গল : এসব কি কচ্ছ ঠাকুর? বুঝতিছি না কিছু।

আনন্দ মিটিমিটি হাসে। মঙ্গল বোকার মতন তাকিয়ে থাকে। আনন্দ নিজের পাল দেখিয়ে বলে,

আনন্দ : আজকের থে এই পাল তোর। তুই মহাজন। তোর সর্দারি শেষ, আজকের থে তুই মঙ্গল মহাজন। তোর মতন কাওড়া কয়জন আছে যে বুকির মদ্দি বরাহ লালন করে। তুই ছাড়া এই ধারা কেউ বয়ে নিতি পারবে না।

মঙ্গল বোবা হয়ে থাকে কিছুক্ষণ।

মঙ্গল : আমি পারি নি নিজেরে যোগ্য করতি।

আনন্দ : তুই একলা কি পারিস? সময় তোরে ভাইঙ্গেচুইরে পারায়। ঘর কাইড়ে নিয়ে মাঠ দেছে তোরে। মাঠেই তোর শেষ। নে ।

আনন্দ তার হাতের কাওড়া লাঠিটা মঙ্গলের এক হাতে তুলে দেয় অন্য হাতে তার টোপাটা। মঙ্গল অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকে।

মঙ্গল : তুমি যাবা কই ঠাকুর?

আনন্দ : আমার এবার অন্য খেলা। এর বেশি জানি ন্যে।

আনন্দ বেরিয়ে যায়।  শূকর পালের মধ্যে দিয়ে।

মঙ্গল : আর দেহা পাবো না তোমার?

আনন্দ ফিরে তাকিয়ে শুধু মিটিমিটি একটা হাসি দিয়ে চলে যায়। দীর্ঘ বিলের মধ্যে সে ক্রমে হারিয়ে যায় সূর্যের তীব্র আলোর অপার্থিব সৌন্দর্যের মধ্যে। মঙ্গল মুখে শব্দ করে শুয়োরদের তাড়া দেয়। শুকরেরা নড়েচড়ে ওঠে।  মঙ্গল তাদেরকে নিয়ে দিগন্তের দিকে যাত্রা করে ক্রমে ।  তার সকল ফেরা শেষ।  সে এখন কাওড়াদের মুখে মুখে গল্পে গল্পে মহাজনী করে যাবে জ্যান্ত কিংবা মরা অথবা নিরুদ্দেশ এক রহস্যের মতো!

-*-

মে ২০২১

কাওড়ামঙ্গল (পর্ব ৯) II রোমেল রহমান

Facebook Comments

comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top