পিঞ্জর (পর্ব ৭) // অমৃতা প্রীতম, অনুবাদ: জাভেদ ইকবাল

অধ্যায় ১১

ভোরের ঠিক আগের প্রহর। হামিদা তার অভ্যাসমতো প্রাতঃকৃত্য সারতে ক্ষেতের উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বেরোয়। ক্ষেতের দিকে, পায়ে হাঁটা আলপথ ধরে এগোয়। কিন্তু কয়েক কদম যাবার পর, আচমকা সে একটা গাছের আড়ালে পড়ে থাকা মানুষের পিঠের দিকটা দেখতে পায়। দূর্বল মনের মেয়ে সে ছিল না, তাই ভয় ভয় করলেও শেষপর্যন্ত সাহস সঞ্চার করে, পা টিপে টিপে, হেলান দেওয়া আধ-শোয়া দেহটার দিকে সে এগিয়ে যায়। হামিদার পাগলীকে চিনতে এক মুহুর্তও কষ্ট হলো না। পাগলী হেলান দিয়েমরে পড়ে আছে; ওর শরীর পাথরের মতো শক্ত হয়ে গেছে। আর ওর পায়ের কাছে একটা নবজাতকের শরীর পড়ে আছে। নবজাতকের নাড়ী তখনো পাগলীর অমরা’র সাথে যুক্ত হয়ে আছে।
আতঙ্ক মেশানো, কষ্টের একটা বুক দুমড়ানো গোঙ্গানি হামিদার গলা-বুক চিরে বেরিয়ে আসে। গভীর একটা শ্বাস টেনে নেয় সে; চোখের সামনে অন্ধকার ছেয়ে যায়। ওর পুরো শরীর দুলতে থাকে, এমন মনে হয়, এক্ষুনি জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যাবে। ঠান্ডা কাঁপুনি পুরো মেরুদণ্ডকে বিবশ করে ফেলে। তারপরও,হামিদা উল্টো ঘুরে, দৌড়ে দৌড়ে বাড়ি ফিরে যায়, আর রশিদকে সাথে নিয়ে পাগলীর কাছে আবার ফিরে আসে।
হামিদা একটা ছেঁড়া-ফাটা চাদর পাগলীর শরীরের ওপর ঢেকে দেয়। রশিদ পাগলীর নাড়ি পরীক্ষা করে দেখে। অবশ্য নাড়ী দেখার কোনো দরকার ছিল না, পাগলীর মুখমণ্ডলে মৃত্যুর স্পষ্ট ছাপ অঙ্কিত হয়ে গিয়েছিল। আর কি অদ্ভুত, কি অদ্ভুত! প্রকৃতি তার পুরোটুকু প্রাণ নিয়ে, নিশ্চেষ্ট স্পন্দনের সাথে বাচ্চার বুকের মধ্যে স্পন্দিত হয়ে চলেছে। বাচ্চাটা ডান হাতের বুড়ো আঙ্গুল চুষছিল।
‘ইয়া আল্লাহ’ বলে রশিদ ছুরি দিয়ে ছেলেটার নাড়ী কেটে দেয়। হামিদা বাচ্চাটাকে তার মাথার কাপড়ে মুড়িয়ে বাড়িতে নিয়ে আসে।
সকালের কুয়াশার সাথে সাথে গ্রামময়এখবর ছড়িয়ে পড়ে। যে গিন্নি রুটির জন্য আটা মাখছিল, সে আটা ওভাবেই রেখে উঠে পড়লো। যে কর্তী তাওয়ায় রুটি সেঁকছিল, সে রুটি তাওয়ায় রেখেই দলে দলে হামিদার বাড়িতে এসে ভীড় করলো; নবজাতককে দেখে যেতে লাগলো। ফর্সা, তুলতুলে বাচ্চাটাকে গোসল করিয়ে হামিদা,পরিষ্কার কাপড়ে জড়িয়ে নিয়ে, একটা খাটে শুইয়ে দেয়। একটুকরো কাপড় সামান্য গরম দুধে ডুবিয়ে হামিদা সেটা বাচ্চার মুখের কাছে ধরে। বাচ্চাটাও তার গায়ের জোর দিয়ে দুধ চুষতে থাকে। তুলোর স্তুপের মতো ধবধবে সাদা বাচ্চাটাকে জাভেদ ঘুরে ফিরে দেখতে থাকে, উবু হয়ে পড়ে তাকিয়ে থাকে।
‘রব তোমার মঙ্গল করুন!’
‘তোমার সন্তানের দীর্ঘায়ু হোক!’
‘আল্লাহ তোমার ঘর ভরে দিন।:
‘খুব পূণ্যের কাজ করেছো…. আল্লাহর নজরে কত উপরে উঠে গেলে!’
গ্রামের মহিলারা দলে দলে এসে বলে যায়।অনাথ বালকের ওপর দয়া করার জন্য সবাই সাবাশী দেয়, প্রশংসা করে যায়।ওদিকে গ্রামের চার-পাঁচজন লোক মিলে পাগলীকে কবর দিয়ে দেয়।
সন্ধ্যায় রশিদ কাঁচ পরিষ্কার করে হারিকেন বাতি জ্বালায়। ছোট্ট শিশুটা অলসতা ফেলে, মোটা মোটা চোখ করে হারিকেনের আলোর দিকে তাকায়। কিন্তু ওর চোখে এখনো দৃষ্টি ফোটেনি, তাই কিছুক্ষণ পর চোখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেয়। বাচ্চাটার মুখে তাকিয়ে হামিদা আপন চিন্তার জগতে ডুবে যায়। সে ভাবে, লোকটা কি নরাধম-ইনা ছিল, যে ঐ পাগলীর কংকালসার পোড়া দেহটাকেও ভোগ করতে ছাড়েনি।
এসব কিছু কি পাগলীর সম্মতিতে ঘটেছিল? নাকি ওকে জোর-জবরদস্তি করা হয়েছে, ধর্ষণ করা হয়েছে! সেই পশুটার মনে এক মুহূর্তের জন্যও কি এই খেয়াল হলো না যে, সে পাগলীর ওপর কি ভয়ানক একটা অন্যায় করে ফেলছে? পশুটাতো এটাও মাথায় আনেনি যে, যে বীজ সে ওর গর্ভে ছড়িয়ে দিলো, তার কি হতে পারে? আর পাগলী হয়তো জানতোই না যে, তার একটা বাচ্চা পয়দা হতে যাচ্ছে, একটা ছেলে সন্তানের জন্ম দিতে যাচ্ছে। প্রসবের এই ভয়ানক বেদনা মেয়েটা একা একা কিভাবে সয়ে নিলো? প্রচন্ড ব্যথায়, কষ্টে ও নিশ্চয়ই রাতের অন্ধকারে চিৎকার করে করে উঠেছে। খোলা আকাশের নীচে, ঠান্ডা বাতাস নিশ্চয়ই শূলের মতো ওর শরীরে বিঁধেছে, ঠান্ডা মাটিতে গড়িয়ে গড়িয়ে পাগলীটা হয়তো ব্যথা কমাবার চেষ্টা করেছে। কিন্তু প্রকৃতির নিজস্ব নিয়মের ওপর কারো হাত আছে নাকি? তাইতো বাচ্চাটার জন্ম হয়ে গেল। নিজ থেকে জন্মেই, মাটির ওপর পড়ে থাকলো শিশুটা। আর প্রচণ্ড বেদনা পাগলীর শরীরটাকে নিংড়ে নিতে নিতে, মুচড়ে দিতে দিতে, এসময় ওর জানটাও বেরিয়ে গেল। এরপর হামিদার ভাবনায় আসে যে, পাগলী বেঁচে থাকলেই বা কি লাভ হতো? ও কি কোনোভাবে নিজের সন্তানকে দেখভাল করে রাখতে পারতো? তারচেয়ে, এই ভালো হয়েছে যে, ও মরে গেছে। বাচ্চাটা কি সুন্দর ফুটফুটে! পুড়ে অঙ্গার, কংকালসার একটা শরীরের মধ্যে কিভাবে এতো সুন্দর একটা ছেলের জন্ম হতে পারলো? কি সুন্দর বড় বড় চোখ! হাত-পা’গুলোর গড়ন কি সুন্দর। পুরো মর্দ মানুষের ছোট্ট,নিখুঁত প্রতিরূপ যেন! কোন নরাধম এর পিতা, কে জানে?
ভাবতে ভাবতে হামিদা খাটের পাশে ঘুমিয়ে পড়ে; একটা স্বপ্নও দেখে সে। হামিদা দেখে, একটা ঘোড়ার পিঠে ওকে আচমকা তুলে নিয়ে, রশিদ ওকে অপহরণ করছে। তারপর এক মালির কুঁড়েঘরে তিনদিন-তিনরাত ধরে ওকে আটকে রাখার পর বাইরে বের করে দেয়। হামিদা পাগল হয়ে যায়, গ্রামের রাস্তায় রাস্তায়, অলিতে-গলিতে উন্মত্ত চিৎকার আর বুনো হাসি হাসে, আরদৌড়ে দৌড়ে বেড়ায়। আর ওর পেটের মধ্যে একটা বাচ্চা বড় হয়ে উঠতে থাকে, ওর পেট ফুলতে থাকে। তারপর একদিন, একটা গাছের ছায়ায় বসে সে একটা ছেলের জন্ম দেয়, যার চেহারা-সুরত একেবারে অবিকল জাভেদের মতো। নবজাতক ছেলেটা দুধ টানার জন্য ওর বুকের সাথে লেগে-লেপ্টে থেকে কাঁদছে, কিন্তু হামিদার স্তন্য, দুগ্ধধারা বলে তখন কিছু নেই। কাঁপতে কাঁপতে হামিদাজেগে ওঠে। সামনে দোলনায় ওর নয়াপুত্র তারস্বরে কান্না করে চলেছে। হামিদা বাচ্চাটাকে কোলে তুলে, বুকের সাথে আলতো চেপে রাখে। এরপর ভয়ভয় দৃষ্টি নিয়ে সে জাভেদের দিকে তাকায়। পাশের চারপাইয়ের ওপর জাভেদ অঘোরে ঘুমাচ্ছে। তারপর ভয়ার্ত দৃষ্টি দিয়ে সে বাইরে, চুলোর কাছে বসে থাকা রশিদের দিকে তাকায়। ঐ তো রশিদ বসে! তাহলে রশিদ তাকে ছেড়ে ফেলে যায় নি, তাকে বের করে দেয় নি!হামিদা তাহলে তার নিজ ঘরেই সালামাত আছে, ভালো আছে। রশিদ ওর ভালোবাসার,মেহেরবান স্বামী। জাভেদ ওর কোঁকড়া চুলের,সুন্দর ছেলে। ওদের গলির সেই মেয়েটা, সেই কাম্মো- সেও মাঝেমধ্যে কাকীর সাথে লুকোচুরি করে হামিদার বাসায় চলে আসতো, গল্পগুজব করতো। পরিবারের সুখে-দুঃখে ভাগীদার হতো। এখন হামিদার সংসার আরো বড় হয়ে গিয়েছে। সৃষ্টিকর্তা আপনা-আপনিই তার ঘরে একটা পুত্র সন্তান পাঠিয়ে দিয়েছেন। হামিদা বাচ্চার মাথায় একটা চুমু খায়। এরপর রান্নাঘরে গিয়ে একমুঠো সাদা জিরা চাবিয়ে খেয়ে নেয়। জাভেদ পুরো দুই বছর ধরে তার স্তন্যপান করেছে। ছেলেটা দুধ ছেড়েছে বেশিদিন হয় নি। হামিদা শুনেছিল যে, সাদা জিরা খেলে মায়েদের বুকে নাকি দুধ তাড়াতাড়ি ফিরে আসে। সেই সাথে সে এক গøাস দুধও খেয়ে নেয়। এরপর নিয়মিত সে বাচ্চাটাকে তার স্তন চুষতে দেয়। আর দেখতে দেখতে তিনদিনের মাথায় সত্যি সত্যিই হামিদার স্তন্যধারা ফিরে আসে। হামিদাকে দেখে গ্রামের মেয়ে-মহিলারা আশ্চর্য হতে থাকে, ধন্য ধন্য করতে থাকে। আর হামিদা সাক্কাড় গ্রামের পাগলীর ছেলেটাকে আপন করে নিয়ে, নিজের বুকের দুধ খাওয়াতে থাকে;নিজের ছোট ছেলে হিসেবে প্রতিপালন করতে থাকে।

অধ্যায় ১২

চুলোর মধ্যে একটার ওপর রাখা আরেকটা গোবরঘুটায়, যেমন সামান্য একটু স্ফুুলিঙ্গ থেকেই ধীরে ধীরে আগুন ছড়িয়ে পড়ে, ঠিক তেমনি পাগলীর নবজাতক ছেলেটাকে নিয়ে পুরো গ্রামে গুজগুজ, ফুসফুস চলছিল-‘পাগলী হিন্দু ছিল, ওর বাচ্চাটা মুসলমানরা ছিনিয়ে নিয়েছে; পুরো গ্রামের সামনে দেখতে দেখেতে ওরা একটা হিন্দু বাচ্চাকে মুসলমান বানিয়ে ফেলেছে….’
বেড়াল যেমন তার সদ্যজাত শিশুকে লোকচক্ষুর আড়ালে নিয়ে, সতর্ক হয়ে থাকে,হামিদাও তেমনি বাচ্চাটাকে তার বুকে চেপে ধরে উঠোন থেকে একেবারে ভিতরের ঘরটাতে নিয়ে যায়। অন্দর মহলের এই চার দেয়ালে আবদ্ধ থেকেও,বাচ্চাটাকে নিয়ে, বাচ্চার মৃত মা পাগলীটাকে নিয়ে যেসব গুজগুজ-ফুসফুস চলে, হামিদার কানে তা ঠিকই পৌঁছে যায়।
প্রথম প্রথম দুই-এক হিন্দুর ঘরে বসে আলোচনা হলো:‘আমরা কি নিশ্চিত জানি যে, পাগলী হিন্দু ছিল?’ একজন বলে।
আরেকজন উত্তর দেয়,‘আমি নিজ কানে শুনেছি, লালা-মুসা এলাকার মস্ত এক ব্যবসায়ীর মেয়ে ছিল ঐ পাগলী। ওর সতীন ওর খাবারের সাথে বিষ মিশিয়ে খাইয়ে দিলে, মেয়েটা পাগল হয়ে যায়।’
আরেকজন বলে, ‘শুনেছি পাগলীকে ওর পরিবারের লোকজন ঘরে আটকে রাখতো। কিন্তু কি করা, ওর কিসমতেই অমন দৌড়ে বেড়ানো লেখা ছিল!’
‘আরে, এসব তো মামুলী কথা। আমি তো পাগলীর বামহাতে উল্কি করা ‘ওঁম’ লেখা নিজ চোখে দেখেছি!’ মাটি থাপড়ে উঠে, চূড়ান্ত রায় দেবার মতো করে একজন বলে।
‘ভাইসব, এ কেমন বিশ্বাসঘাতকতা হলো! আমাদের এতোগুলো খোলা চোখে ওরা ধুলো দিয়ে গেল! ধিক্কার আমাদের ওপর! একটা হিন্দুর বাচ্চাকে ওরা নিমিষেই মুসলমান বানিয়ে ফেলল?’
কেউ কেউ অবশ্য ব্যাপারটা ভুলে যাবার পক্ষে মতদিলো:‘আরে বাদ দাও তো, কোন্ অমঙ্গল যে বাচ্চাটা বয়ে এনেছে, কোন্ বেটা মানুষের পাপ, কে জানে?এই জারজটাকে নিয়ে এখন আমরা কোথায়, কার কাছে ছুটোছুটি করব?’
এই কথায় একজন প্রবীন হিন্দুলোক বলে উঠলো, ‘নালায়েক, বিষয়টা এখন আমাদের ধর্মের! আজকে চুপচাপ বসে থাকলে কালই ওরা গ্রামসুদ্ধ সব লোককে মুসলমান বানিয়ে ফেলবে; আর তুই চুপচুাপ আঙ্গুল চুষতে থাকবি।’
দুই-একজন ক্ষিপ্ত, উন্মত্তবৎ হয়ে বলে ওঠে, ‘দেখতে পাচ্ছিস না, কি বাড়টা বেড়েছে মুছলাদের?’
বন্ধ দরোজার পেছনে এসব কথাবার্তায় ওদের মন বিষিয়ে ওঠে, ঘৃণায় ভরে যায়।
‘ছেলেটাকে আমরা গিয়ে নিয়ে আসবো; দেখি কোন শালা আমাদের বাধা দেয়।’
‘এতো আসলে, দুই-চার পয়সারই তো ব্যাপার, তাই না! তা, চাঁদা তুলে জলওয়ালী বাঈ’কে দিয়ে দেয়া যাবে, ও এই বাচ্চাটাকে পেলে দেবে।’
নিজের জায়গা ছেড়ে আবেশে এগিয়ে এসে কেউ একজন বলে, ‘আমরা তো আর এমন অকম্মাহয়ে যাইনি যে, পুরো গ্রামের হিন্দুরা মিলে এই এইটুকুন একটা বাচ্চাকে পালতে পারবো না?’
‘কে বলতে পারে বাচ্চাটা ওর পাগল মা’র মতো বোবা-কালা হয় নাকি?’ মধ্য থেকে আরেকজন ফোঁড়ন দিয়ে ওঠে।
‘তাতে সমস্যাটা কি?বড় হয়ে না হয় মন্দিরে ঝাড়ু দেবার কাজ করবে। দু’বেলা একটু পেট পুরেই তো শুধু খাবে! তা ওটা আমরা নিশ্চয় ব্যবস্থা করতে পারবো।’
এরপর ওরা একে অপরের সাহসিকতাকে সাধুবাদ জানায়। আত্মশ্লাঘা, হামবড়াই, পিঠ চাপড়ে সাবাশি দেওয়াও চলে কিছুক্ষণ। তারপর একজন বলে, ‘তা জলওয়ালী বাঈকেও তো আগেভাগে জিজ্ঞেস করা দরকার যে, সে বাচ্চাটাকে পালতে রাজী আছে কি না।’
‘আরে বলে কি? আমাদের কথা ফেলে দেবে মানে? আগে তো রূপোর জুতো ওর মাথায় রাখবো, তারপর কথাটা পাড়বো।’
‘আরে ভাই, ছেলে একটু বড় হয়ে গেলে আর সমস্যা কি? মন্দিরে ঢোল-ঢাক বাজানো থেকে শুরু করে এতো এতো কাজ! তা কাজের জন্য বিনা-বেতনে একজন মানুষ তো জুটবে।’
‘ওসব নিয়ে আগেভাগে এতো দুশ্চিন্তা কিসের? আগে লাড়কা বড় হয়ে উঠুক তো…. এর মধ্যে যদি ওর মুছলমানী করিয়ে দেয়…. তো?
‘আরে, এখুনি পিঠটান দেবার মওকা খুঁজছো তোমরা? নিজ ধর্মের খাতিরে যদি এতটুকুও করতে না পারো, তাহলে অন্ধ কুয়ায় লাফিয়ে পড়ো, ডুবে মরো তোমরা। তোমার ক্ষেতের পানি অন্য কেউ যদি নালা কেটে নিজের ক্ষেতে নিয়ে নেয়, তাহলে তো রাগে,ক্রোধে অন্ধ হয়ে তার মাথা ফাটিয়ে দাও; আর আজ, এক হিন্দুর ছেলেকে মুসলমানরা তুলে নিয়ে গেল, তাতে তোমার মুখে তালা পড়ে গেল?’
এভাবে কথায় কথায়, ঘৃণার বাষ্প, পাথুরে কয়লা-পোড়া ধোঁয়ার মতো ঘরটাতে ভরে ওঠে।
এরপর থেকে রশিদ যখনই ক্ষেতের দিকে যেত, ওর পাশ নিয়ে যাওয়া হিন্দুরা রশিদের দিকে কড়া চোখে তাকাতে শুরু করল। রশিদ ওদের চোখের সেই কঠোর চাইনি উপেক্ষা করে আপন মনে চলে যেতো, এক-দুইবার কথায় কথায় রশিদ হামিদাকে বলে, ‘গ্রামের বাতাস তো ভালো ঠেকছে না। এই ঝগড়ার মধ্যে পড়ে আমাদের দরকারটা কি? ঝামেলা বরং তাতে বেড়ে যাবে। ছেলেটাকে ওদের যদি মর্জি হয়, তো নিয়েই যাক। ওর ভাগ্যে যা আছে তা তো হবেই।’ রশিদের কথায় হামিদা মুখে কিছুই বলতো না, কিন্তু ভীষণ ব্যাকুল হয়ে উঠতো। হাড্ডিসার একটা ছোট্ট কঙ্কালকে দিন-রাত নিজের বুকে লাগিয়ে রেখে সে ছয়টা মাস পার করে দিয়েছে। এখন তো ছেলেটা জাভেদের মতোই হৃষ্টপুষ্ট হয়ে উঠেছে। বাচ্চাটার চোখ হামিদাকে চিনতে শুরু করেছে, রশিদকে দেখে হাত বাড়িয়ে কোলে যেতে চায়। হামিদা ভেবে আকুল হয় যে, হিন্দুরা একেবারে প্রথম দিন বাচ্চাটাকে নিয়ে নিজেদের মতো পালবার চিন্তা কেন করলো না। সেই প্রথম দিনই তোরা ওকে নিয়ে যেতিস, লালনপালন করতিস, মায়ের কোলের ভালোবাসা দিতিস, পিতার স্নেহ দিতিস! হামিদা ছয়টা মাস রাত জেগে জেগে ছেলেটাকে বড় করছে, জিরা চাবিয়ে, গিলে গিলে স্তনে দুধ ফিরিয়ে এনেছে, রক্তকে দুধে পরিণত করেছে। ছেলেটার মলমুত্র, জামাকপড় ধুতে ধুতে হাতের নখ পর্যন্ত ঘঁষে ঘঁষে গেছে। হামিদার মনে পড়ে, গ্রামের মুসলমানদের বাড়িতে বাড়িতে সে পাঞ্জিরি হালুয়া পাঠিয়েছিল, যাতে বাচ্চাটা বড় হয়ে এটা মনে না করে যে, তার জন্ম উপলক্ষে কোনোকিছুই করা হয়নি। কিন্তু এতোসব তাকে কেন করতে হলো? কেন? কেন?
একদিন গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধানরা রশিদকে ডেকে পাঠালো। হামিদারগলা-ঠোঁট-বুক শুকিয়ে যায়। সে ভাবনায় পড়ে যায় যে, বাচ্চাটাকে লালপালন করার দায়িত্ব তো সে নিজ থেকে নিয়ে নিয়েছিল; কিন্তু ওরা তো এখন রশিদকে একগাদা কথা শোনাবে, তার স্বামীকে অপমান-অসম্মান করবে। হামিদা তাকেও সাথে করে নিয়ে যেতে স্বামীর কাছে আর্জি জানায়; সেনিজে ওদের সকল কথার সম্মুখীন হবে, জবাব দেবে। ওদের কাছ থেকে ছেলেটাকে ভিক্ষা চেয়ে নেবে। কিন্তু রশিদ সে কথা শুনলো না। যে বাড়িতে ওরা রশিদকে ডেকে পাঠিয়েছিল, সেখানে রশিদ একাই গিয়ে হাজির হলো।
গ্রামের এক সম্ভ্রান্তÍ হিন্দু বাড়ির উঠোনে তিন-চারটা চারপাই রাখা ছিল। সেগুলোর ওপর এখন গ্রামের বিশিষ্ট কিছু হিন্দু লোকজন বসে আছে। এদের সিদ্ধান্ত ছিল এমন যে, রশিদ হয়তো তার কিছু মুসলমান বন্ধু নিয়ে এখানে আসবে অথবা একেবারেই আসবেনা। যদি না-ই আসে, তাহলে রশিদের সাথে আঙ্গুল বাঁকা করে হলেও ব্যাপারটার সুরাহা করবে বলে তারা একমত হয়েছিল। কিন্তু রশিদ একেবারে একা ওদের মধ্যে গিয়ে হাজির হলো, সকলকে সালাম জানিয়ে, স্বাস্থ্যের খোঁজ-খবরকরে,ওদের সামনে বসে পড়লো। সবাই বেশ একটু অবাক হয়ে গেল।
‘তা, ভাই, তোমার কি সিদ্ধান্ত? ছেলেটাকে ফিরিয়ে দেবে, নাকি না?’হুক্কা থেকে মুখ সরিয়ে,গম্ভীর কন্ঠে একজন জিজ্ঞেস করে।
‘দেয়া-নেওয়ার অধিকার আর আমাকে কে দিয়েছে বলেন, এসবই তো আল্লাহর হাতে। দেনেওয়ালা তো তিনিই, আমি কে? এক হাতে মাথা ছুঁয়ে, উত্তর দিতে দিতে আকাশের দিকে তাকায় রশিদ।
‘এসব তো মিষ্টি মিষ্টি কথা, টালবাজির কথা। ওসব ফালতু কথা বাদ দিয়ে সোজা কথা বলো,’ ক্রুদ্ধ এক হিন্দু লোক বলে উঠলো।
‘আল্লাহর রহমত ছিল বলেই আমি বাচ্চাটাকে জীবিত উদ্ধার করতে পেরেছিলাম। ঐ সময় না গিয়ে, যদি অল্প কিছুক্ষণ পর ওখানটায় যেতাম, তাহলে কি হতো আমি জানিনা- হয়তো কোনো কুকুর, বেড়াল বাচ্চাটাকে খেয়ে ফেলতো, আল্লাহ ছেলেটাকে আয়ু দিয়েছেন বলেই তো বেঁচে আছে….’
‘ঠিক আছে, ঠিক আছে! ভগবান যদি ওকে লম্বা আয়ু দিয়েই থাকেন, তাহলে কেউ তো আর সেটা খন্ডাতে পারে না। কিন্তু একটা কথা তোমার পরিস্কার বুঝে রাখা দরকার- ছেলের মা কিন্তু একজন হিন্দু মহিলা ছিল। আর তুমি একটা হিন্দু বাচ্চাকে তুলে নিয়ে যাবে এটা আমরা কোনোভাবেই সহ্য করবো না।’
‘না, জ্বী ; আমার তো জানা নেই যে, মহিলা হিন্দু ছিল, নাকি মুসলমান। পাগলী তো হিন্দুদের ঘরের দেওয়া খাবারও খেতো, মুসলমানদের দেওয়া খাবারও খেতো।
‘ওতো পাগলী ছিল। কিন্তু তুমি তো আর পাগল নও, তাই না?’ কথার মধ্যে আরেকজন বলে।
‘আচ্ছা বুঝলাম। তা আপনারা একেবারে প্রথম দিন ছেলেটাকে নিয়ে নিতেন, প্রতিপালন করতেন, আমি কি মানা করেছিলাম? একমুঠো হাড় ছিল বেচারা। ঘরে আমার বিবি দিন-রাত এক করে, প্রাণান্ত চেষ্টায় ছয় মাস ধরে বড় করে তুলেছে, বাঁচিয়ে তুলেছে। আর এখন, যখন বাচ্চাটা বেঁচেই গেছে তখন আপনাদের টনক নড়েছে। খোদার ক্রোধকে তো একটু ভয় করুন। রবের নামে আপনারা ওকে পালবেন বলে ভাবছেন, আর রবের নামে আমি ওকে পেলেপুছে বড় করে যাচ্ছি। নাকি আমার অন্য কোনো লাভের মতলব আছে বলে আপনাদের মনে হয়?’
এই কথায় কয়েকজন হিন্দুলোক, বিষয়টা রশিদের হাতেই ছেড়ে দিতে বললো। রশিদ যদি এই ঝামেলা, মুসিবত নিজ থেকে সামাল দিতে চায়, তা দিক না, অসুবিধা কি?
এবার বয়স্ক এক হিন্দুলোক শান্তস্বরে বললো, ‘দেখো, শুধু শুধু এভাবে কথা আগে বাড়িয়েকি লাভ? বাচ্চাটা তোমারও কেউ লাগে না, আমারও কেউ লাগে না। বিষয়টা এখন ধর্মের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর তোমার এর মধ্যে কাটা হয়ে দাঁড়ানো একদম উচিত না। অকারণ নিজের জীবন সংকটে ফেলে তোমার লাভ কি হবে? এখন কেউ যদি তোমার কোনো ক্ষতি করে ফেলে, তাহলে কিন্তু বলতে পারবে না যে, তোমাকে আমরা সাবধান করিনি। তার চেয়ে ভালোয় ভালোয় সোজা রাস্তায় আসো, আর ছেলেটাকে আমাদের হাতে তুলে দাও…. আর হ্যাঁ, এই কয়দিন বাচ্চার লালন-পালনে তুমি যে দুই-চার রুপিয়া খরচ করেছ, চাও তো তা-ও দিয়ে দেই।’
‘বেশক, বেশক,’বাকি সবাই বলে ওঠে।
‘আল্লাহ্ ! আল্লাহ্ !’ রশিদ তার দুই হাতে দুই কান চেপে ধরে বসে থাকে।
জলওয়ালী বাঈ দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের সাথে আর দুই-তিনজন লোক চলুক তোমার বাসায়, ছেলেটাকে নিয়ে আসা যাক। আমরাই ওকে শুদ্ধ করে নেব, হিন্দু ধর্মে দীক্ষিত করব।’
‘আমি শেষবারের মতো আপনাদের কাছে মিনতি করছি,’ বলে রশিদ দু’হাত প্রার্থনার মতো জোড় করে, ‘বাচ্চা ছেলেটার পর এতটুকু রহম করুন, দয়া করুন। ছেলেটা যেখানে আছে সেখানেই থাকতে দিন। আমার ঘরওয়ালী ওকে নিজের পেটের সন্তানের মতো প্রতিপালন করছে।’
‘আমার তো তোমাকে সিধা রাস্তা বাতলে দিলাম। তা, ভালো যদি চাও, তাহলে সোজা উঠে পড়ে, আমাদের সাথে চলো। আমরাও কিন্তু জানি, সোজা আঙ্গুলে ঘি ওঠে না।
দুই-তিনজন হিন্দুলোক চারপাই ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। চাদর গায়ে-মাথায় তুলে দিতে দিতে,ঘরের ভিতর থেকে জলওয়ালী বাঈ বেরিয়ে আসে। রশিদকে উঠে দাঁড়াতে হয়। এরপর সবাই রশিদের বাড়ির দিকে হেঁটে রওনা দেয়।
সদর দরোজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে হামিদা গলির দিকে উন্মন হয়ে তাকিয়ে ছিল। যেই মুহুর্তে সে রশিদকে মাথা নিচু করে চার পাঁচজনের সাথে হেঁটে আসতে দেখতে পেলো, ওর জান-প্রাণ-কলিজা সব শুকিয়ে গেল। ওর চোখের সামনে অতীতের সেই দিনটা ভেসে উঠলো, যেদিন ওর মা ওর থেকে আলাদা হয়ে গেল, যেদিন ওর বাবা ওর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল, যেদিন ওর ভাই-বোন সবাই ওর থেকে দূর হয়ে গেল। এই বাচ্চা ছেলেটা এখন তার নিজ রক্তমাংসের, নিজ আত্মার একটা অংশ হয়ে উঠেছে, ওকে হারানোর আশংকায়হামিদার সেই সেদিনের মতো যন্ত্রণা হতে লাগলো। হামিদা দৌড়ে ঘরের ভেতরে যায়, বাচ্চাটাকে তুলে নিয়ে, জোরে নিজ বুকের সাথে চেপে-আঁকড়ে রাখে।
রশিদ বাড়ির উঠোনে ঢুকে পড়ে এমন ঢিলা শরীরে দাঁড়িয়ে থাকলো, যেন ওর বোধবুদ্ধি সব লোপ পেয়েছে। রশিদের অবশ্য একটা কথাও বলার দরকার পড়লো না;হামিদারও দরকার পড়লো না একটা কোনো প্রশ্ন করার। জলওয়ালী বাঈও এক মুহুর্তের জন্য থমকে দাঁড়ালো। হামিদার বুক থেকে বাচ্চাটাকে নিজের হাতে তুলে নেওয়াটা তার খুব কঠিন একটাকর্মবলে মনে হলো।
‘আরে জলদি কর, বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে নে, দেরী হয়ে যাচ্ছে তো!’ রশিদের সাথে আসা হিন্দুরা তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে ওঠে, ‘আমাদেরও তো অন্য কাজ আছে, নাকি?’
জলওয়ালী বাঈ দুই হাত আগে বাড়িয়ে দিয়ে হামিদার কাছ থেকে বাচ্চাটা নিজ কোলে তুলে নেয়। কিন্তু ছেলেটা হামিদার ওড়না মুঠ করে ধরে রাখে। হামিদার মনে হতে থাকে ওই মুঠোয় ভরে, ছেলে তার জান নিয়ে যাচ্ছে। হামিদার ওড়নায় টান ধরে। জলওয়ালী বাঈ তখন বাচ্চাটার মুঠো খুলে দিয়ে ওড়নাটা ছাড়িয়ে দেয়। ছেলেটা জোরে জোরে কেঁদে ওঠে। কি জানি, হাতের স্পর্শটা তার হয়তো অচেনা লাগছে বলে।
হামিদা ভেঙ্গে পড়া ডালের মতো, দেয়াল আঁকড়ে ধরে মাটিতে বসে পড়লো। গলির মোড় থেকে বাচ্চার কান্নার শব্দ তার কানে আসতে থাকে। অন্ধকার নেমে আসার আগেই স্তন্যের ধারায় হামিদার জামা ভিজে যায়। ওর মন বলে ওঠে, ‘ছেলেটা নিশ্চয়ই ক্ষুধার জ্বালায় তড়পাচ্ছে, কাঁদছে। তাই তো তার বুক ফেটে দুধের ধারা বয়ে যাচ্ছে।’
রাতে রশিদ-হামিদার বাড়িতে চুুলো জ¦ললো না, কিছু রান্না হলো না; সবাই না খেয়ে থাকলো। জাভেদ তার স্বভাবমতো যখন ভাঙ্গা ভাঙ্গা, আধো আধো বুলি জুড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘আব্বা, আমার ভাই কোথায় গেছে?…. আব্বা, ভাই কবে আসবে?’ রশিদ আর হামিদাজাভেদের মুখে নিরুত্তর তাকিয়ে থাকে; এরপর লজ্জায় মাথা ঝুঁকিয়ে চুপচাপ বসে থাকে।
হামিদার চোখের সামনে কাম্মোর চেহারাটা ভেসে ওঠে। এরপর, থেকে থেকে তার ছোট ছেলেটার চেহারা ভাসতে থাকে। হামিদা ভাবে, ‘পড়ে থাকা যে ফুল অন্যরা ফেলে দিয়েছে, পাশ কাটিয়ে গিয়েছে, সেই ফুল আমাকে গলায় করে রাখার কি আছে? ছিঁড়ে ফেলা ফুলকলিকে, পানি ছিটিয়ে ছিটিয়ে সজীব করে রাখার কি আছে? সবাই তো ওর পর ছিল, কেউই তো ওর আপন বনে যাবার ছিল না। এক রশিদের বিষয়টা আলাদা। রশিদকেই আস্তে-ধীরে সে ভালোবেসেছে, রশিদই একমাত্র তার সাথে সাথে থেকেছে। অথচ হামিদার সকল সম্পর্ক নষ্ট করার মূলেই কিন্তু তার এই স্বামী! তারপরও রশিদই তার সবচেয়ে আপন, তার জাভেদের পিতা।
তিনদিন পার হলো। চতুর্থ দিন, সারাটা দিন জুড়ে পুরো গ্রামে একটা কথারই চর্চা চলতে লাগলো, ‘ছেলেটা আর বাঁচবে না, বাচ্চাটা তো মরার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। খুবই করুণ অবস্থা ওর। হয়তো আর কয়েক ঘন্টার ব্যাপার। গলা দিয়ে একফোঁটা দুধ ছেলেটা নীচে যেতে দিচ্ছে না, সাথে সাথে ঠেলে বের করে দিচ্ছে।’

পিঞ্জর (পর্ব ৬) // অমৃতা প্রীতম, অনুবাদ: জাভেদ ইকবাল

Facebook Comments

comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top