সংগীতের প্রতি অন্তঃপ্রাণ যে কোন শ্রোতাই আবিদা পারভীনকে খুঁজে নেন নিজ তাগিদে। এটাই একজন শিল্পীর সার্থকতা। কে এই আবিদা পারভীন, যার সূরে সংগীত সমজদার মানুষ মাত্রই ব্যাকুল থাকেন- সেটা নিশ্চয় খোলাসা করে বলার অপেক্ষা রাখে না। সূফীবাদের প্রতি প্রেম ও ভালবাসাকে কথা, বাণী, সুর আর প্রদর্শনকলার মাধ্যমে দর্শক কিংবা শ্রোতার হৃদয়ের রন্ধে রন্ধে পৌঁছে দিতে পারেন যিনি, তাকে নামেই শ্রদ্ধা কিংবা তাজীমের আসনে বসান তার ভক্তরা।
পাকিস্তানের সিন্ধ অঞ্চলের লারকানায় এক সূফী পরিবারে ১৯৫৪ সালে তার জন্ম এবং সেখানেই বেড়ে উঠা। উর্দু, সিন্ধী, সারাইকী, পাঞ্জাবী আর পার্সিয়ান ভাষায় নানা সূফীবাদী গান ফেরী করছেন পৃথিবীর আনাচে কানাচে। সুরে সুরে পৃথিবীব্যাপি পরিচয় করিয়েছেন উপমহাদেশের বিভিন্ন সূফী সাধকদের কালাম। আবিদা পারভীনের মুখে বিখ্যাত সূফীসাধক হযরত বুল্লে শাহ’র কালাম শ্রোতাদের কাছে খুবই প্রসিদ্ধ।
এই স্বনামধন্য শিল্পীর গান আর পরিবেশনায় ধরা দেয় স্রষ্টা-সৃষ্টি, গুরু-শিষ্য, আশেক-মাশুকের মধ্যে সম্পর্কচর্চা ও প্রেম। সংগীতের মাধ্যমেই খোদার প্রতি তার স্তুতি, প্রার্থনা, ধ্যান, কাব্য পরিবেশনায় নিজেকে নিয়ে গিয়েছেন অন্যমাত্রায়। মাত্র তিন বছর বয়স থেকে গান পরিবেশন করা শুরু করেন তিনি, পিতা উস্তাদ গোলাম হায়দারই তার প্রথম সংগীতগুরু। পিতার সঙ্গেই বিভিন্ন মাজারে দরগাহে সংগীত আসরে গান করতেন। পরবর্তী কালে শাম চৌরাশিয়ার ঘরানার ওস্তাদ সালামত আলী খানের কাছে তালিম নেন।
মূলত তিনি কাফী, গজল, কাওয়ালী পরিবেশন করেন। উপমহাদেশে ‘কুইন অব সূফী মিউজিক’ হিসেবে শ্রোতাদের হৃদয়ে আসন গড়ে নিয়েছেন নিজের শক্তিমত্তা, আধ্যাত্মিক চেতনা, সংগীত সাধনার মাধ্যমে। আবিদা পারভীন মানে তীব্র এক আকর্ষণ, কয়েক বছর আগে ঢাকায় এক সঙ্গীত আসরে তাকে সরাসরি দেখতে ছুটে এসেছিলাম চট্টগ্রাম থেকে। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনেছিলাম তার সুরের কারুকাজ, কণ্ঠের শক্তিমত্তা ও প্রেমময় কালাম।
সিংগাপুরকেন্দ্রিক প্রবাসী পাকিস্তানী নারীদের পরিচালিত লাইফস্টাইল ম্যাগাজিন FUCHSIA’র তত্তাবধায়নে নেয়া এই সাক্ষাৎকারটিতে আবিদা পারভীনের সঙ্গে কথা বলেন আতিয়া কাজী। কথোপকথনটিতে উঠে এসেছে সংগীত চর্চায় আবিদা পারভীনের পারিবারিক ঐতিহ্য, সূফীবাদ ও সূফীবাদী সংগীত চর্চা নিয়ে নিজস্ব বয়ান।
একজন নারী সূফী সংগীতশিল্পী হয়ে উঠতে কেমন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীণ হয়েছিলেন আপনি?
পুরনো সূফী গানগুলোর প্রতি জীবনে প্রথম প্রেমে পড়ি, আমার তিন বছর বয়স থেকে যেগুলো আমি আমি গেয়ে চলেছি। আলাদাভাবে একজন নারী শিল্পী হয়ে উঠার ব্যাপারে গুরুত্ব দিইনি, আমার বাবা (উস্তাদ গোলাম হায়দার) ছিলেন একজন নামকরা সূফী গায়ক, তো পরম্পরা ছিল খুবই স্পষ্ট এবং সবাই এখানে সমানভাবে গুরুত্ব পেতেন। আমি আমার বাবা থেকে প্রচুর জিনিস শিখেছি।
গান করার সময় কোন চিন্তা আপনাকে আচ্ছন্ন করে রাখে? কার জন্য গান করেন?
আমি গান করি আমার খোদার জন্য। আমি যখন গান করি, আমার মনে এটা স্পষ্টভাবে গেঁথে থাকে যে খোদায়ী মাহাত্ম ছাড়া প্রত্যেক চিন্তাই নিঃশেষ হয়ে যায়। তখন পরমাত্মার অংশ হয়ে সৃষ্টির প্রত্যেক কিছু যেন আমাকে ঘিরে ঘুরতে থাকে।
সূফীবাদ নিয়ে আপনার ভাষ্য কি রকম?
সূফীবাদ হচ্ছে খোদার পক্ষ থেকে মানবতার জন্য বিশালতর তোহফা স্বরূপ। এটা এক পবিত্রময় কাব্য, আমাদের এবং তাঁর (খোদার) মধ্যকার যোগাযোগসূত্র। নিজের শক্তিমত্তা আর মাহাত্ম আমাদের কাছে পৌছে দেয়ার খোদার পন্থা এটা, যাতে প্রতিটি দিন আমরা তাঁর আরো নিকটবর্তী হতে পারি।
আপনি অসংখ্য কনসার্ট করেছেন– আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিকভাবে। কোথায় আপনি সবচেয়ে বেশি অন্তরঙ্গ, যথেষ্ট মূল্যায়নকারী এবং সমঝদার দর্শক পেয়েছেন?
যেখানেই আমি গিয়েছি, খোদার অনুগ্রহে, মানুষ আমার প্রতি অপরিমেয় ভালবাসা আর মমত্ব দেখিয়েছে। একটা বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা যুক্ত করব। একবার আমি ইয়োরোপ ভ্রমণ করছি, আমাদের কনসার্ট ছিল ডেনমার্কে। কনসার্ট শুরু হবার সময় ছিল সন্ধ্যা সাতটা, তো প্রস্তুতির জন্য আমি ভেন্যুতে পৌঁছলাম বিকাল চারটায়, শব্দযন্ত্র ঠিক আছে কিনা দেখার জন্য। আমি দেখলাম অনেক সূফী সংগীতপ্রেমী গেটের বাইরে লাইন ধরে আছে। তারা সবাই শব্দযন্ত্র ঠিকঠাক করাটাও দেখলো এবং পরে কনসার্টও উপভোগ করলো ভালমত।
কে আপনার মশালবাহী (উত্তরসূরী) হবে? এই সূফী ঐতিহ্য চালিয়ে নিতে আপনি কি কাউকে অভিজ্ঞসম্পন্ন করে যাচ্ছেন?
এখন পর্যন্ত আমি নিজেকে একজন শিক্ষার্থী হিসেবে অনুভব করি, তো আসলেই আমি এখনো পর্যন্ত কাউকে অভিজ্ঞসম্পন্ন করে তুলতে পারিনি। ভারত পাকিস্তানে অনেক তরুণগোষ্ঠী আমার কালামের মাধ্যমে যাত্রা শুরু করেছে, যেটা সূফী সংগীতের জন্য নতুন এক অধ্যায়।
সাধারণ জীবনযাপন থেকে একেবারেই ভিন্নতর আপনার সামাজিক বা পেশাগত অবস্থান, ব্যক্তিত্ব এবং আচরণ, এর সঙ্গে পরিবারের অন্যান্যরা মানিয়ে চলে কীভাবে?
পরিবারের সবাই সবসময় আমার জন্য সহায়ক। আমার সৌভাগ্য আমার জন্মই হয়েছে এক সূফী ঘরানা পরিবেশে। আমরা এমন এক পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠেছি যেখানে সূফী সংগীত ছাড়া কিছুই ছিল না। আমার পরিবার বুঝতে পারতো আমার অবস্থান, সাধনা আর খোদার সঙ্গে আমার সম্পর্কসূত্রটা।
শ্রোতাদের কাছে থেকে আপনি কোন ধরনের অনুভূতি আশা করেন যখন তারা আপনাকে শুনে?
আমি কে যে, কাউকে কোন অনুভূতি জাগরণের? আমি তো মাধ্যম মাত্র। মহামান্বিত খোদাকে স্মরণ করার মাধ্যমে এ উপলব্ধি আমার হয়। তিনিই একমাত্র, যিনি সবাইকে আমন্ত্রিত করেন এক জায়গায় সম্মিলিত হতে এবং তার ভালবাসার অনুভূতি নিতে। তার কার্যক্রম এবং পরিকল্পনা বুঝে উঠতে আমাদের না আছে কোনো জ্ঞান, না আছে যথেষ্ট অনুভূতি। আমার শ্রোতাদের মধ্যে আমি লক্ষ্য স্থির করি খোদার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ঘটিয়ে দিতে। এটাই হল আমার হৃদয়ের ব্যাকুলতা এবং আমি গাই অন্য জগতের সাথে এই পৃথিবীর যে বিচ্ছেদ সেটার মিলন ঘটাতে।