জ্যাক আটালির লেখা ১৯৭৭ সালে প্রকাশিত নয়েজ: দি পলিটিক্যাল ইকোনমি অব মিউজিক (Noise: The Political Economy of Music by Jacques Attali) বইটির “মুখবন্ধ” (যা এখানে “সংগীতের রাজনৈতিক অর্থনীতি” শিরোনামে অনূদিত) লিখেছেন সমসাময়িক সময়ের গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যসমালোচক, দার্শনিক ও মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক ফ্রেডরিক জেমিসন (১৪ এপ্রিল ১৯৩৪- ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪)। বর্তমান সময়ে সংস্কৃতি (বিশেষত সংগীত) ও সমাজের মধ্যবর্তী সম্পর্কগুলো ঠিক কেমন, আর কেমন করেই বা এই সম্পর্কগুলো চলমান অর্থনৈতিক অবস্থাগুলো দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয়, সে সম্পর্কেই নয়েজ নামের বইটিতে বিশেষভাবে আলোকপাত করা হয়েছে। তবে, ফ্রেডরিক জেমিসন বইটির জন্য লেখা মুখবন্ধে বারংবার এই ইঙ্গিতই দিয়েছেন যে, রাজনৈতিক অর্থনীতি দ্বারা মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হলেও, সংগীতের জগতটি এখনও মুক্তির ইউটোপিয় চেতনাকে সযত্নে লালন করে।
নয়েজ নামের সংগীতের এই ইতিহাস গ্রন্থটিকে প্রথমত পড়তে হবে ইতিহাসের একটি সাধারণ পুনরুত্থান (Revival) আর ইতিহাস রচনার পুনরুজ্জীবিত চাহিদার প্রেক্ষাপট থেকে, যা উদ্ভূত হয়েছিল এমন একটি সময়ের পর যখন “ঐতিহাসিকতাকে” (historicism) সর্বজনীনভাবে পরিত্যাগ করা হয়েছিল (আলথুসার), আর ইতিহাস ও ঐতিহাসিক ব্যাখ্যাগুলোকে খুব সাধারণভাবে শুধুই “সময়ের সাথে ভাষার বিবর্তন ইংরেজিতে stigmatized as the merely “diachronic” ” (সোস্যুর), বা নিছক পৌরাণিক আখ্যান (লেভি-স্ত্রোস) বলে অপবাদ দেয়া হয়েছিল। বতর্মান সময়ে ইতিহাস রচনার যে ঐতিহ্য তা অবশ্য আর কোনভাবেই সাদাসিধা ইতিহাস অথবা ঘটনাপঞ্জিকে বর্ণনা করাতে ফেরত যাবার লক্ষণ প্রকাশ করে না। বরঞ্চ, ইতিহাস রচনার নতু ন ধরনের কাজটিকে দেখা যেতে পারে অনেকগুলো প্রচেষ্টার সমষ্টিগত ধারার একটি পুনরারম্ভ হিসেবে, যা শুরু হয়েছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে; সেটি ছিল এমন কিছুলেখার চেষ্টা, যা হবে সামাজিক জীবনের সমগ্র ইতিহাসের মত। আর সেটি এসেছিল জার্মান গাইসটেসগেশিকটে’র (Geistesgeschichte ইংরেজিতে বলা যেতে পারে history of idea বা intellectual history) “সুস্পষ্ট কার্যকারণের” (expressive causality) ধারণা থেকে, কিংবা, সরাসরি হেগেল থেকে শুরু করে স্পেংগ্লার, এবং এমনকি আওয়ারব্যাখ (Erich Auerbac, 1892–1957) was a German philologist and comparative scholar and critic of literature) পর্যন্ত গিয়ে—একজন ফুকো বা এন্যাল (Annales – a group of historians associated with a style of historiography to stress long term social history in 20th Century) স্কুলের “কাঠামোগত কার্যকারণের” (structural causalities) ধারণা পর্যন্ত।
সংগীত অবশ্য এই প্রেক্ষাপটে বিশেষ কিছু সমস্যার অবতারণা করেঃ সংগীত কোনভাবেই সামাজিক জীবনের অন্যান্য কাঠামো ও স্তরগুলো থেকে পুরোপুরিভাবে বিচ্ছিন্ন নয়, বরং সমস্ত সামাজিক বাস্তবতাগুলোর ভিতর থেকে সবচেয়ে বিমূর্ত যে বাস্তবতা— অর্থনীতি, তার সাথেই সংগীতের দৃঢ় সম্বন্ধ আছে বলে মনে হয়; আর, সংখ্যা হল সেই অদ্ভুত চূড়ান্ত জিনিস—অর্থনীতি ও সংগীত উভয়ই যার অংশী। তবে এই আপাত বৈপরীত্যের ব্যাপারটি তাৎক্ষণিকভাবেই আরও জোরালো হয়ে ওঠে যখন জানা যায় যে নয়েজের লেখক আসলে একজন পেশাদার অর্থনীতিবিদ। আবার অন্যভাবে, সংগীত ও গণিত এই দুই জগতে প্রায়শই বিস্ময়কর সব শিশু প্রতিভা দেখতে পাওয়া যাওয়ার ঘটনাটিও হয়ত সংখ্যা সংক্রান্ত বিশেষ সক্ষমতার বিষয়টিকেই নির্দেশ করে, যেখানে কিনা সামাজিক জীবন সম্পর্কে বাস্তব অভিজ্ঞতার তেমন কোনো প্রয়োজন পড়ে না, যেমনটা অন্য ক্ষেত্রগুলোতে পড়ে।
তবে, বহুল ব্যবহৃত মার্ক্সীয় তত্ত্বে অর্থনীতিকে সাধারণত “মূল কাঠামোর” বিজ্ঞান বলে মনে করা হয়, যেখানে কিনা সংগীতকে ঐতিহ্যগতভাবে “উপরিকাঠামোর” সাথে সম্পর্কিত সব কর্মকাণ্ডের মধ্যে সব থেকে গূঢ়, বিমূর্ত এবং বিশেষায়িতগুলোর মধ্যে একটি বলেই ধরে নেওয়া হয়। সেই কারণে এই দুটি সাংস্কৃতিক আর বুদ্ধিবৃত্তিক “ধারা” বা শ্রেণির মধ্যে অর্থপূর্ণ সংযুক্তি স্থাপনের জন্য এদের পরস্পরের মধ্যবর্তী সংযোগের ক্ষেত্রগুলোকে তৈরি করে নেবার প্রয়োজন পড়ে, যেই সংযুক্তি বা মধ্যস্থতাগুলো আবার অনেকক্ষেত্রেই ঠিক প্রত্যক্ষ বা স্পষ্ট নয়।
যার সময়কালে এমন পদ্ধতিগত বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা শুরু হয়, এবং এমনকি এই বিষয়গুলো এখন অবধি যার নিজের কাজের মধ্যে অতুলনীয় স্পষ্টতা নিয়ে ফুটে রয়েছে, সেই ম্যাক্সওয়েবার, এই গল্পটিকে পেশ করেছেন সম্পূর্ণভাবে পশ্চিমা হারমনিক সংগীতের পরিপ্রেক্ষিতে যেটির আবির্ভাবই কিনা একটি মজাদার ও কৌতূহলোদ্দীপক ঐতিহাসিক সমস্যার মধ্য দিয়ে। এই হারমনিক সংগীত কেনইবা প্রায় সর্বজনীন লোকসংগীতের ধারা থেকে জন্ম নিয়ে শুধু ইউরোপেই বিকশিত হল এবং তাও হল নির্দিষ্ট একটি সময়কালে যখন বিশ্বের অন্য সব জায়গায় সংগীত যৌক্তিকতার অন্য পথ অবলম্বন করছে—এবং যেটি সত্যিকার অর্থেই সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী একটি পথ, যেখানে সুরের বিরামগুলো (ইন্টারভ্যালস ইন হারমনি) সুরের বিভাজন (হারমনিক ডিভিশন) (পঞ্চম)১ দিয়ে নয় বরং বিভাজনগুলোর মধ্যকার ব্যবধান (সাধারণত চতুর্থ) দিয়ে গঠিত হয়? ওয়েবার এই প্রণালিটির জটিল সব নির্ধারকগুলোকে সংক্ষেপে বর্ণনা করেছেন:
সমাজতাত্ত্বিক প্রভাব ও ধর্মীয় ইতিহাসের ফলাফল হিসেবে বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রগুলোতে পশ্চিমা বিশ্বের চার্চগুলো যে সুস্পষ্ট বৈশিষ্ট্য ধারণ করেছিল তা এক রকমের যুক্তিবাদের জন্ম দিয়েছিল; যেটি ছিল পশ্চিমা সন্ন্যাসবাদের (Monasticism) ধারণার কাছে নতুন, এবং যেটি সংগীতসংক্রান্ত এই “কৌশলগত” সমস্যাগুলো তৈরি করেছিল। আবার অন্যদিকে, ছন্দময় নৃত্যের আবিষ্কার ও যৌক্তিকতা এবং সংগীতের বিভিন্ন ধরনের উৎপত্তি হওয়া থেকে শুরু করে যন্ত্রসংগীত (Sonata) পর্যন্ত বিকাশ, দুইই এসেছিল রেনেসাঁ সময়ের সামাজিক জীবনযাপনের নির্দিষ্ট কিছু রীতি থেকে। অবশেষে, আধুনিক সংগীতের বিকাশের ক্ষেত্রে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণপ্রযুক্তিগত উপাদানগুলোর মধ্যে একটি উপাদান হিসেবে পিয়ানোর আবিষ্কার, এবং বুর্জোয়ামহলে এর ব্যাপ্তি, এই দুটোই উত্তর ইউরোপীয় সভ্যতার “গৃহকেন্দ্রীকতার”(indoor) যে বিশেষ চরিত্র তা থেকে উদ্ভূত ।২
যুক্তিবাদের উত্থান নিয়ে করা ওয়েবারের এই বিশেষভাবে সুপরিচিত প্রবন্ধটি আদতে একটি গল্প, একটি কর্তৃত্বশীল আখ্যান (মাস্টার ন্যারেটিভ), যেটি ওয়েবারের করা সমস্ত গবেষণামূলক কাজকে স্বীকৃতি দেয়। তাই এমনটা আবিষ্কার করা আশ্চর্যের হবে না যে, ওয়েবারের এই প্রবন্ধে, পশ্চিমা সংগীতকে দেখা হবে এক অদ্ভুত এবং আনকোরা প্রভাব থেকে জোরপূর্বক সৃষ্ট বিশেষ সব উপাদানগুলোর একটি হিসেবে (যেটির উদ্ভব হয়েছে মধ্যযুগের আশ্রম-জীবনের যুক্তির কোটর থেকে [rational enclave of monastic life])। আবার, একই প্রবন্ধের আরেকটি জায়গায় তিনি একটি নতুন ধারা বা শিল্প অথবা মাধ্যমের জন্য প্রয়োজনীয় “বস্তুগত, প্রযুক্তিগত, সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক অবস্থাগুলো” নিয়েও কথা বলেন। তবে, উপরোক্ত অনুচ্ছেদটিতে এটি স্পষ্ট করেই বলা আছে যে, এই সমস্ত অবস্থাগুলোর মধ্যকার “বহুমুখী মিথস্ক্রিয়ার” (overdetermination) বিষয়টি আসলে বেশ জটিল: এই যেমন, সংগীতে প্রযুক্তির ব্যবহারের পুরো ইতিহাসটিই (এবং বিশেষ করে বাদ্যযন্ত্রের আবিষ্কার ও উৎপাদন) বস্তুগত বিষয়টি দ্বারা প্রভাবিত। আবার, ওয়েবার যেটিকে “প্রযুক্তিগত” বিষয় বলছেন সেটি আবশ্যিকভাবেই কোন লিপি অথবা স্বরলিপির সাথে সম্পৃক্ত ; তবে, সংগীতের ক্ষেত্রে, এই লিপি, ধ্বনির সাথে সংশ্লিষ্ট যেকোন সাধারণ প্রতিলিপি থেকে অনেক বেশি গুরুত্ব বহন করে; এবং এই প্রযুক্তিটির অন্যান্য শ্রেণিগুলো (যেমনঃ স্বর, সুর, ইত্যাদি) নিজে থেকেই সংগীতের নতুন রীতিউদ্ভাবন এবং পরিচালনা করতে পারে। তবে, একদিকে সামাজিক ক্ষেত্রগুলো যেমন সংগীতানুষ্ঠান আয়োজনের মধ্য দিয়ে একইসাথে শ্রোতাসাধারণ ও গীতবাদ্যকর তৈরি করে; তেমনই অন্যদিকে, সংগীতের “মনস্তাত্ত্বিক” দিকটি তার বিষয়বস্তু, মতাদর্শ এবং সত্যিকার অর্থে, সংগীতের মান নিয়ে জটিল ও বিতর্কিত সব প্রশ্ন তৈরির মধ্য দিয়ে আমাদের সাথে সংঘর্ষেলিপ্ত হয়; আর এই সমস্যাটি খোদ ওয়েবারের নিজের ঐতিহাসিক বিশ্লেষণগুলোও স্পষ্টভাবেই বাতিলকরে দিতে চায় বা আড়াল করতে চায়। উদাহরণস্বরূপঃ ওয়েবারের “ক্রোমাটিককে”, “প্যাশন” বা “যীশু খ্রীস্টের ক্রুশারোহণ এবং মৃত্যুযন্ত্রণা সংক্রান্ত সংগীতের” সাথে সংযুক্তিকরণ; যদিও তিনি সেখানে যোগ করেন যে, প্রাচীন সংগীত আর ক্রোমাটিকের মধ্যকার পার্থক্যটি অভিব্যক্তির শৈল্পিক তাড়নার উপর ভিত্তি করে নয়, বরং, অভিব্যক্তির প্রযুক্তিগত পদ্ধতির উপর নির্ভরশীল, তিনি আরও বলেন যে, এই সেই “ক্রোমাটিক”, যেটিকে রেনেশাঁযুগের সংগীত বিষয়ক মহান সব পরীক্ষকরা তাদের নতুন আবিষ্কারের অদম্য ও যুক্তিযুক্ত বাসনা, এবং একইসাথে, “প্যাশনকে”৩ সংগীতধর্মী একটি রূপ দেবার ক্ষমতা থেকে সৃষ্টি করেছিলেন। তবে, ওয়েবারের একটি সংক্ষিপ্ত মন্তব্য দেখলে মনে হতে পারে যে, প্যাশন একটি সুনির্দিষ্ট আর ঐতিহাসিকভাবে সৃষ্ট আনকোরা মনস্তাত্ত্বিক অভিজ্ঞতার অভিব্যক্তি; আর তাই,প্যাশন নামক নতুন ধারার এই সংগীত মান প্রকাশের নিদর্শক নয়, বরং, খুব সাধারণভাবে, একটি ঐতিহাসিক ধরনকে পরিপূর্ণরূপে প্রকাশ করবার একটি উপাদান বা বৈশিষ্ট্য মাত্র।
এখন, সমস্যাটির এই যে দুটি ধরন সামনে উঠে আসতে শুরু করলো তাদের মধ্যকার পার্থক্য নির্ধারণ করা জরুরি: একটি হচ্ছে সংগীতের অর্থসংক্রান্ত দিক বা সিম্যান্টিকস, যা সংগীতের সূচক বা সিগনিফায়ারস, এবং ঐতিহাসিক, সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক সিগনিফাইডস বা সূচিতের মধ্যকার সম্পর্ককে নির্দেশ করে; আর, অপরটি হচ্ছে, সংগীতের নান্দনিক মান। এই দুটি বিষয়ের প্রথমটি নিয়ে থিওডর অ্যাডর্নো বলেছেন, “আমরা যদি বেটোফেন শুনি এবং বৈপ্লবিক বুর্জোয়াদের না শুনি—তাদের স্লোগানগুলোর প্রতিধ্বনি শোনা নয় বরং সেই স্লোগানগুলোর সম্পূর্ণতা পাবার বাসনায় করা চিৎকারকে শোনা, যেখানে যুক্তি ও বুদ্ধি দুইই থাকে; আর সেগুলোকে উপলব্ধি করবার প্রয়োজনীয়তা যদি আমরা অনুভব না করি—তাহলে বেটোফেনকে বুঝবার ক্ষেত্রে আমাদের পারদর্শিতা হয়ত তাদেরই মত যারা কিনা বেটোফেনের সৃষ্টিগুলোর মূল উপকরণগুলোকেই বুঝতে পারে না।”৪ এমন একটি মন্তব্যই হয়ত ততদিন পর্যন্ত যথেষ্ট সোজাসাপ্টা ছিল যতদিন না অ্যাডর্নো নান্দনিকতার “পথপ্রদর্শনকারী সূত্র” হিসেবে যেই ধারণাটি ফ্র্যাঙ্কফোর্ট স্কুলে (The Frankfurt School is a school of social theory and critical philosophy associated with the Institute for Social Research, at Goethe University Frankfurt in 1929) আগে থেকেই প্রচলিত ছিল তারই পুনরূক্তি করলেন, “সংগীত কোন বিশুদ্ধ এবং সাধারণ ভাবাদর্শনয়; এটি মেকী চেতনার মতন একটি ভাবাদর্শগত ধারণা”।৫ তবে, এই দুটি অবস্থানের মধ্যকার আপাত বৈপরীত্যটিকে সমন্বয় করা যেতে পারে হেবারমাসের করা বুর্জোয়াদের বৈপ্লবিক মতাদর্শের সর্বজনীন উপকরণটির (যেটি ভাবাদর্শগত নয়) এমন এক মূল্যায়ন থেকে যেখানে ব্যক্তিস্বাধীনতায় নান্দনিকতার নতুন এক যুগের আগমন নিয়ে কথা বলতে গিয়ে অ্যাডর্নো নিজেই আরও মজাদার উপায়ে পরিস্থিতিকে জটিল করে তোলেনঃ “বেটোফেন যদি বুর্জোয়া বিপ্লবের একটি সংগীতধর্মী প্রতিরূপ হয়ে থাকে, তাহলে একই সাথে তিনি এমন এক সংগীতেরও প্রতিরূপ যা সামাজিক নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত, যা নান্দনিকভাবে সম্পূর্ণ স্বশাসিত, এবং যা কারও দাস নয়।”৬
আর এমন একটি অনুসন্ধানকে আরো দীর্ঘকরতে গিয়ে যদি সত্যিই সংগীতের মানের প্রশ্নটি অনিবার্যহয়ে দাঁড়ায় তাহলে রুশ ফরমালিস্টদের সাথে তাল মিলিয়ে একটি নাটকীয় ও বিপরীতধর্মী পরিবর্তন আনা অসম্ভব কিছুনয়: যেমন, এমন কিছু সৃষ্টি করা (যেমন, “প্যাশন”—যা হবে একটি নতুন ধরনের সর্বজনীন বৈপ্লবিক ভাবাদর্শএবং উদ্দীপনার মত) যা আদতে নিজে থেকেই একটি নিয়মনিষ্ঠ উদ্ভাবনার ফলাফল হয়ে থাকবে। তবে, একটি নির্দিষ্ট সময়ের সংগীত সবসময়ই নতু ন ধরনের ভাবধারা ব্যক্ত করতে সক্ষম হয়, যার মধ্য দিয়ে সেই সংগীতের একটি সুস্পষ্ট উদ্ভব ঘটে; আর এই ব্যাপারটিকে ভাষাতত্ত্ব দিয়ে চাইলে তা স্যাপির-হোর্ফের হাইপোথিসিসের অদ্ভুত একটি সংস্করণ তৈরি করবে। এর কারণ হল, ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিকভাবে ভাষা তৈরিই হয় সুনির্দিষ্ট কিছু উপায়ে বিস্তৃত হবার জন্য যাতে আমরা নতুন সব ভাবনা ভাবতে (বা, সেই নতুন ভাবনা নিয়ে কথা বলতে) সমর্থ হই।
তবুও সংগীতের উপকরণ নিয়ে করা অর্থসংক্রান্ত প্রশ্ন এবং তার নান্দনিক মান সংক্রান্ত সমস্যার মধ্যে একটি ফাঁক রয়েই যায়—এমন একটি ফাঁক যেটিকে ওয়েবারের গবেষণা কাজগুলো অকপটেই স্বীকার করে নেয়, যদিও, এর পরবর্তীকালের ঐতিহাসিকতাবাদের ধারণাসমূহে এই ফাঁকটিকে ঢাকতে গিয়ে বেশ দুর্ভোগ পোহাতে দেখা যায়। আবার, ওয়েবারের যৌক্তিকতার প্রক্রিয়া সংক্রান্ত সংগীতের বিবর্তনের ব্যাখ্যা আর স্পেংগলারের সংস্কৃতির রূপবিদ্যা বিষয়ক প্রকল্পের মধ্যে একটি মৌলিক পার্থক্য থাকলেও নিশ্চিতভাবেই একটি আধ্যাত্মিক সম্পর্কও আছে-
কলার রীতি প্রায়শই যুদ্ধরীতি এবং রাষ্ট্রনীতির সাথে সংযুক্ত। একই সংস্কৃতির রাজনৈতিক এবং গাণিতিক রূপরেখার মধ্যে গভীর সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায়; সম্পর্কপাওয়া যায় ধর্মীয় এবং প্রযুক্তিগত ধারণাগুলোর মধ্যে; গণিত, সংগীত এবং ভাস্কর্যের মধ্যে; আর, অর্থনীতি এবং জ্ঞানের রূপরেখাগুলোর মধ্যেও। পদার্থবিজ্ঞান এবং রসায়নবিজ্ঞানের অত্যাধুনিক তত্ত্বগুলো যে মৌলিকভাবে আমাদের জার্মান পূর্বপুরুষদের পৌরাণিক ধারণাগুলোর উপরেই নির্ভরশীল সেটি আদতে সুস্পষ্ট ও নির্ভুল; একইভাবে, ট্রাজেডির শিল্প-সঙ্গতি আর ক্ষমতার কলাকৌশল এবং আধুনিক অর্থনীতি, একটি আরেকটির সাথে সম্পর্কিত; আবার, আরও একটি বাস্তবতা আছে (যা শুরুতে উদ্ভট মনে হলেও খুব দ্রুতই প্রকট হয়ে ওঠে) যেটি অনবরত প্রমাণ করতে থাকে যে, একদিকে যেমন তৈলচিত্রের দৃশ্যপট, ছাপাখানা, ক্রেডিট-সিস্টেম, দূরপাল্লার অস্ত্রশস্ত্র এবং “কন্ট্রাপান্টাল মিউজিক” (একই সাথে স্বাতন্ত্র্য এবং সুরের অন্ত্যমিল আছে এমন লাইন সমৃদ্ধ সংগীত) একে অপরের সাথে সম্পৃক্ত ; অন্যদিকে, নগ্ন মূর্তি, নগররাষ্ট্র, এবং মুদ্রার প্রচলন (যা গ্রীকদের আবিষ্কার) সবই একটি একক এবং অভিন্ন আধ্যাত্মিক নীতিরই ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশ।৭
ঐতিহাসিকতার পরিচিত সব নমুনা অনুসারে, নীতি ব্যাপারটি আপেক্ষিক; আর সংগীতের ক্ষেত্রে নীতির প্রকাশ তখনই ঘটে যখন সেটি একটি বৃহত্তর আর সমষ্টিগত ঐতিহাসিক পুনর্গঠনে ভূমিকা রাখে, এবং যখন সংগীতকে একটি মৌলিক সাংস্কৃতিক রূপের অভিব্যক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। (আবার, বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিশেষ কোন গুরুত্ব না রাখলেও স্পেংগলার কিন্তু কিছু মৌলিক সংস্কৃতির ভাবাদর্শগত মূল্যায়নও করেছিলেন, যেমন, পশ্চিমা বিশ্বের ক্ষণকালীন গতিময়তা—এবং সেই সাথে সর্বোপরি সংগীত!—আর স্পেংগলারের জন্য এটি সুস্পষ্টভাবেই, স্থানিক এবংযেকোনো অ্যাপোলোনিয় গ্রীক সংস্কৃতির রীতিনীতি থেকে “উচ্চতর”)।
ফ্র্যাঙ্কফোর্ট স্কুল এবং বিশেষভাবে অ্যাডর্নো নিজে, এমন আপেক্ষিকতাবাদ থেকে নিষ্কৃতি পেতে ধরনা দিয়েছেন হেগেলের নান্দনিকতা ও বিধিসম্মত আত্ম-সচেতনতার ধারণার কাছে। এইসব লেখকের জন্য আদর্শ (ইউটোপিয়) নীতিতত্ত্বটি নির্ভর করে আছে স্বাধীনতার ধারণা, আর, সংগীত যে “নিয়তির শত্রু”, সেই ধারণার উপরে। আবার, অ্যাডর্নোর জন্য মুল্যায়নের অন্য কায়দাটি হল প্রযুক্তিগত দক্ষতার মূল্যায়ন, যেখানে একজন হিন্ডামিট (Paul Hindemith, 1895–1963 was a German composer, music theorist, teacher, violist and conductor) অথবা একজন সিবেলিয়াসের (Jean Sibelius, 1865 – 1957, was a Finnish composer widely regarded as his country’s greatest composer, and his music is often credited with having helped Finland develop a national identity during its struggle for independence from Russia) কাজের থেকে বেশি একজন শোয়েনবার্গের (Arnold Schoenberg 1874 – 1951, was an Austrian-American composer, music theorist, teacher, writer, and painter considered one of the most influential composers of the 20th century) কাজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা পায়—শোয়েনবার্গের মাহাত্ম্যের জায়গাটি অবশ্য তিনি নিজে যেই ঐতিহাসিক অবস্থা থেকে নিজের কাজের মৌলিক উপাদানগুলোকে আবিষ্কার করেছেন সেই ঐতিহাসিক অবস্থার সর্বশেষ নৈর্ব্যক্তিক ফলাফল বের করে আনবার জন্য যে সংকল্প তার ছিল, সেটির উপরেই ন্যস্ত। যাহোক, এই দুই রকমের তত্ত্ব ইতিহাসের নির্দিষ্ট মুহূর্তগুলোতে একে অপরের সাথে বিরোধিতায় সক্ষম, এবং অ্যাডর্নোর মতে, বার-স্বর পদ্ধতির শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের চূড়ান্ত মুহূর্তেও সেই বিরোধ রয়েই যায়:
এই কৌশল-দক্ষতার আদর্শকে আধিপত্য বলে গণ্য করে; যার অন্তহীনতা সেই ধরনের বাস্তবতার ভিতরে নিহিত যার কৌশলের ধারাবাহিকতার মধ্যে যেকোনো ভিন্নধর্মী বিষয়ও লুপ্ত হয়ে যায়।আবার, প্রকৃ তির আধিপত্যের ক্ষেত্রে এটা একটা দমনমূলক মুহূর্ত, যা নিজে থেকেই হঠাৎ করে ব্যক্তির স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীনতার বিরুদ্ধবাদী অবস্থান গ্রহণ করে, আর এরই মধ্য দিয়ে এই আধিপত্য তার পূর্ণতা পায়।৮
শোয়েনবার্গের “সত্যের মুহূর্তটি” একটি দমনমূলক, আমলাতান্ত্রিক, এবং বিশেষ ব্যক্তিবর্গকর্তৃক নিয়ন্ত্রিত সমাজব্যবস্থার স্বরূপকে এতটাই পরিপুর্ণ আর নিখুঁতরূপে প্রতিবিম্বিত করে যে, এটিকে সেই সমাজব্যবস্থার একটি নান্দনিক প্রতিকৃ তি বা “মিরর ইমেজ” বলে মনে হয়। ওয়েবার নিজে অবশ্য সংগীতের যৌক্তিকতাকে পশ্চিমা বিশ্বের সামাজিক বিবর্তনের অন্তর্গত নিয়মকানুনগুলোর একটি বিধিবদ্ধ সচেতনতা হিসেবে দেখতে নারাজ। কিন্তু এই সংগীত, ওয়েবারের জন্য যা ছিল শুধুই অনেকগুলো ঐতিহাসিক নির্ধারকের মধ্যে একটি, অ্যাডোর্নোর জন্য এটি ছিল শিল্পকলার এক জ্ঞানতাত্ত্বিক কাজ।
তবে, সংগীতের জগত নিয়ে এমন কিছু তত্ত্ব যেগুলোকে আমরা সংগীতের ঐতিহাসিকতা বলতেই পারি, সেগুলো বড় জোর কোনো একটি নির্দিষ্ট সফল কাজকে আঁকড়ে ধরে রচিত হয়, যেমনঃ বেটোফেন বা শানবার্গ; যেন এরাই সমসাময়িক সমাজব্যবস্থার গতিশীলতাকে প্রতিফলিত (এবং আলোকিত বা উন্মোচিত) করে। তবে সংস্কৃতি জগতের বিশেষ এই মানুষগুলো খুবই সাধারণভাবে সমাজের গতিশীলতার প্রতিফলন বা প্রজনন ঘটায়, নাকি, একরকম দূরত্ব তৈরির মধ্য দিয়ে এর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং এর সমালোচনা করে, সেই তত্ত্বগত প্রশ্নটি কিন্তু অপেক্ষাকৃতভাবে গৌণ হয়ে ওঠে—যেটির ভিত্তি নিজেই সমস্যাযুক্ত আর অনিশ্চিত; মার্ক্সীয় মতবাদ অনুযায়ী যেটি মূল কাঠামো আর উপরিকাঠামোর মধ্যকার সম্পর্ক। তবে যে যাই বলুক, এঙ্গেলস কিন্তু ঐতিহাসিক বস্তুবাদ নিয়ে লেখা তার পরবর্তী সময়ের গুরুত্ত্বপূর্ণচিঠিগুলোতে অর্থনীতি এবং উপরিকাঠামোর মধ্যকার পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার উপরে জোর দিয়েছেন। তিনি বলেছেন যে, উপরিকাঠামোগুলো কোনো না কোনোভাবে অর্থনীতিকেই প্রতিফলিত করে বা অর্থনীতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণহয়ে ওঠে; অথবা, অন্ততপক্ষে, বস্তুগত সামাজিক উন্নয়নগুলো থেকে পেছনে পড়ে থাকে। আর তাই, বেটোফেনই বুর্জুয়াদের বৈপ্লবিক ভাবাদর্শকে সব থেকে জমকালো রূপে প্রকাশ করেছিলেন (যদিও সেই প্রকাশ ঘটেছিল তেমনই এক ভাবাদর্শের বিজয় এবং একইসাথে তার ব্যর্থতার পর) এমন এক প্রণালীতে যাআরো বস্তুনিষ্ঠ , সমষ্টিগতআর ভাবাদর্শগত রীতিনীতির অন্তর্বতীকরণে সাহায্য করে। জ্যাক আটালির লেখা বইটির অভিনবত্ব তাই সুস্পষ্ট: তিনিই প্রথম “পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া”(reciprocal interaction) সংক্রান্ত তত্ত্বটির একটি ভিন্ন কিন্তু সম্ভাব্য পরিণতির কথা ভাবতে পেরেছেন–বলতে পেরেছেন একটি উপরিকাঠামোর পক্ষে ঐতিহাসিক উন্নয়নগুলোকে পূর্বানুমান করতে পারার সম্ভাবনার কথা, এবং ভবিষৎবাণী আর প্রচারণামূলক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে এই উপরিকাঠামোর নতুন ধরনের সামাজিক নির্মাণগুলোর পূর্বাভাস দেবার সম্ভাবনার কথা। নয়েজ বইটির মূল যুক্তি হল এই যে, সংগীত, সকল শিল্পকলার মধ্যে অনন্য, আর তার কারণ হল এর নির্দিষ্ট অতিলক্ষগুলো এবং এর প্রচারণামূলক কর্মকাণ্ডগুলো। বর্তমান সময়ের সংগীত একদিকে যেমন নতুন একটি প্রতিশ্রুতি নিয়ে আসে, আর উৎপাদনের পদ্ধতি থেকে নিজেকে মুক্ত করে নেয়; একইভাবে, এটি নিজেই সেই উৎপাদন প্রণালীটিরই একটি অস্বস্তিকর কিন্তু নান্দনিক প্রতিকৃতিতে (মিরর ইমেজ) পরিণত হয় যা কিনা একটি ডিস্টোপিয় সম্ভাবনার হুমকির সমতুল।
আটালির ভাবনার এই ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার দিকে নজর দেবার পেছনে সামাজিক ও ঐতিহাসিক দুই প্রকার কারণই রয়েছে। আবার, অ্যাডর্নোর মত চিন্তকদের অতীতের প্রতি নীরস পক্ষপাতও আরেকটি কারণ হয়ে আছে, যাদের সামাজিক ও ঐতিহাসিক হতাশাবাদ নথিভুক্ত হয়ে আছে নেগেটিভ ডায়ালেক্টিক্সে। আটালির মধ্যে শুধুই যে সমসাময়িক সংগীতের প্রতি মারাত্মক সহানুভূতি আছে তা নয়, এমনকি জনপ্রিয় এবং গণ-সাংস্কৃতিক উৎপাদনের পুরো জগৎটার প্রতিই তিনি সহানুভূতিশীল, যেগুলোকে অ্যাডর্নো বেশ বিতৃষ্ণভাবেই “সরল/লঘু”, “জ্যাজ”, এবং সংস্কৃতি-শিল্পের গণ-উৎপাদনের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও রসাতলে যাওয়া পণ্য হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন। তবে, আমাদের অবশ্যইআটালির অর্থনীতিসংক্রান্ত ভাবনারকথাখেয়াল রাখতেহবে; একথা ভু লে গেলে হবে না যে, আটালি পেশায় একজন অর্থনীতিবিদ, এবং রাষ্ট্রপতি মিতেরাঁর একজন ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা, আর, ফ্রান্সের চলমান সমাজতান্ত্রিক পরীক্ষানিরীক্ষাগুলোর একজন কেন্দ্রীয় সদস্য। আটালি বিশিষ্ট একজন পণ্ডিতও বটে, রাজনৈতিক অর্থনীতি থেকে শুরু করে ইচ্ছামৃত্যু (euthanasia) পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়ের উপরে তিনি অন্তত ডজনখানেক বই লিখেছেন। কিন্তু এই সব বইয়ের বিষয়বস্তুআপাতদৃষ্টিতে যতই আলাদা দেখাক না কেন, এদের সবার আলোচনার বিষয়বস্তুএবং অনুসন্ধানের জায়গাটি একঃ এমন একটা বোধ, যেন আমাদের চারপাশে নতুন একটা কিছুর আবির্ভাব ঘটতে চলেছে, একটি নতুন অর্থনৈতিক অবস্থা, যেখানে পুরনো অর্থনৈতিক গঠনতন্ত্রের ফাটলগুলোর দরুণ নতুন ধরনের সামাজিক সম্পর্কগুলোকে উপলব্ধি করা যাবে, এবং যেখানে নতুন ধরনের সাংস্কৃতিক উৎপাদনগুলো আমাদেরকে ভবিষ্যৎবাণীমূলক ঘোষণা না দিলেও, গুরুত্ত্বপুর্ণপূর্বলক্ষণগুলো নিশ্চয়ই দেবে।
আটালির বৈচিত্র্যময় আর জটিল চিন্তাগুলো তাই একীভূত হয়ে ওঠে একটি অনন্য পরিপ্রেক্ষিতে (যেটি আটালির রাজনৈতিক ভূমিকাটিকে তত্ত্ব এবং অনুশীলনের সংগতি দিয়ে সমৃদ্ধ করেছিল) যেটি বর্তমান সময়ের পুজিঁবাদের পুরাতন রূপ (বাজার পর্যায়, একচেটিয়া পর্যায়) থেকে নতুন রূপে উত্তরণের যাত্রাটিকে চিহ্নিত করবার জন্য সুদূরপ্রসারী একটি প্রয়াস। এটি পুজিঁবাদের এমন একটি নতু ন ধারা, যেখানে গণমাধ্যম আর বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো মূখ্য ভূমিকা পালন করে, যেখানে প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে দ্বিতীয় যন্ত্র-বিপ্লবে শিল্প-উৎপাদনের পুরনো পদ্ধতিগুলো বদলে গিয়ে তৃতীয় যন্ত্র-বিপ্লবের উপকরণ, যেমন: নতুন ধরনের সাইবারনেটিক ও পারমাণবিক তথ্য প্রযুক্তির আগমন ঘটে। এই নতুন “বিরাট পরিবর্তনের” সময়কালের তাত্ত্বিকগণের মধ্যে আছেন মার্ক্সবাদ বিরোধী তাত্ত্বিক ড্যানিয়েল বেল থেকে শুরু করে মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক আরনেস্ট ম্যান্ডেল পর্যন্ত (যাদের লেট ক্যাপিটালিজম, পুজিঁর এই নতুন তৃতীয় স্তরকে নিয়ে লেখা সব থেকে বিস্তারিত এবং মৌলিক মার্ক্সীয় মডেল)।
জঁ বোদ্রিয়ার এবং জঁ-ফ্রঁসোয়ালিয়তারের মত ফরাসি উত্তর-কাঠামোবাদীদের প্রচেষ্টাগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সামাজিক উন্নয়নের স্বতন্ত্র পর্যায়গুলোকে অনিবার্যভাবেই একেকটি ঐতিহাসিক ধাপ হিসেবে ব্যাখ্যা করবার চেষ্টা করেন; যদিও, এই সামাজিক উন্নয়নের পর্যায়গুলোকে যথাযথভাবে প্রকাশ করা যায় কেবল বিবর্তনের ধারাবাহিকতা, অথবা, বিরতি, বিচ্ছিন্নতা এবং আকস্মিক রূপান্তর দিয়ে। আটালির নিজের সব কাজও যে এমন একটি প্রলোভন এড়াতে পেরেছিল তেমন নয়; কিন্তু এর তেমন কোনো গুরুত্বও নেই; যেমন: লূতোয়া মদ (দি থ্রি ওয়ার্ল্ডস) শীর্ষক তার সাম্প্রতিক গবেষণামূলক বইটি স্বতন্ত্র সামাজিক পর্যায়গুলোর “রৈখীকরণকে” ভেঙ্গে ফেলে, এবং সেগুলোর প্রত্যেকটিকে একেকটি ভিন্ন “প্রতিনিধিত্বমূলক জগতের” নকশা হিসেবে উপস্থাপন করে এমন উপায়ে যেন সেই তিনটিই আমাদের নিজেদের সময়েই অবস্থান করে, পুরাতনের অবশিষ্টাংশ এবং নতুনের আগমনের সমকালীন এবং যুগপৎ ঘটনা হিসেবে। আর তাই, আটালির বইটির শিরোনামের এই তিন বিশ্ব কিন্তু আমাদের পরিচিত ভৌগোলিক স্থানগুলো নয় (পুজিঁবাদী ও সমাজবাদী রাষ্ট্রগুলোর মাঝখানে অবস্থিত তৃতীয় বিশ্ব); বরং তিনটি আলাদা তত্ত্বগত ধারণা। এই তিনটি ধারণার প্রথমটি হল রেগুলেশন যেটি নিয়ন্ত্রণবাদ ও পরিবর্তনীয়তার মত প্রায়োগিক শব্দ দিয়ে বুঝতে হয় এবং যেটি মূলত শাস্ত্রীয় বাজারব্যবস্থার সাথে সম্পৃক্ত একটি তত্ত্ব। দ্বিতীয়টি উৎপাদন, সুস্পষ্টভাবে শাস্ত্রীয় মার্ক্সবাদই যার দৃঢ় গঠন দান করেছে। আর তৃতীয়টিকে আটালি বলেছেন ভাষার মধ্যে অর্থএবং সংকেতের সংগঠন ।
মার্ক্সবাদকে তুলনামুলকভাবে পুরনো একটি বিশ্বের নকশা বা প্যারাডাইম হিসেবে নির্ণয় করার কাজটি আটালির উত্তর-কাঠামোবাদী ও উত্তর-মার্ক্সবাদীদের সাথে সুস্পষ্ট সম্বন্ধকেই নির্দেশ করে; শুধুতাই নয়, আটালির এমন একটি অবস্থান নেওয়া একইসাথে ফরাসী সমাজতান্ত্রিক দলটির তার নিজের মার্ক্সীয় ঐতিহ্যের সাথে বজায় রাখা জটিল সম্পর্কটিকেও প্রকাশ করে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের “শিল্পায়ন পরবর্তী সমাজের” বেশ কয়েকজন আত্মতুষ্ট গুণকীর্তনকারীদের থেকে আলাদা হয়ে গিয়ে সমাজতান্ত্রিক ফ্রান্সের একজন অর্থনীতিবিদ হিসেবে আটালি বরং নিজের দেশকে (ফ্রান্সকে) এই নতুন (আমেরিকা) বহুজাতিক ক্রমবিন্যাস, এবং পুরাতন নগররাষ্ট্রগুলোকে ছাপিয়ে যাওয়া বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকটের একটি নিষ্ক্রিয় শিকার বলেই মনে করেন; এবং নিজে মূলত একজন রাজনৈতিক চিন্তাবিদ হিসেবেই থেকে যেতে চান যিনি কিনা এই নতু ন অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্যে ঘটতে থাকা সম্ভাব্য সামাজিক রূপান্তরগুলোকে উদ্ঘাটন ও তাত্ত্বীকরণে আগ্রহী। তার কল্পরাষ্ট্রের (ইউটোপিয়া) ধারণাও তাই বস্তুবাদী এবং আসন্ন, ঠিক যেমনটা ছিল মার্ক্সে; যিনি দেখতে পেয়েছিলেন যে, ১৮৭১ সালের প্যারিস কমিউনের বিপ্লবীদের “কোন ধারণাই ছিল না যে তারা নতুন একটি সমাজ গঠনের উদ্দেশ্যে তেমন সব উপকরণগুলোকেই মুক্ত করে দিচ্ছে যেগুলো সে সময়ের প্রায় ধ্বসে পড়া বুর্জোয়া সমাজ তার গর্ভেঅনেক আগে থেকেই চুপিসারে লালন করে আসছিল। তবে, আটালির চিন্তাভাবনাগুলোর মধ্যকার সব থেকে সমস্যাপূর্ণবৈশিষ্ট্য হয়ত এই দ্ব্যর্থতার সাথে তার অনমনীয় ও দৃঢ় একাত্মতা, অথবা তার থেকেও বেশি তার দোদুল্যমানতা—এই সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংগঠনিক সমস্যাগুলো নিয়ে, যেগুলোকে তিনি প্রায়শই স্বয়ংক্রিয় নজরদারি হিসেবে অভিহিত করেন। একটি দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এই স্বয়ংক্রিয় নজরদারি বলতে বোঝায় স্বতন্ত্র ব্যক্তির শরীর ও মনে তথ্য-প্রযুক্তির অনুপ্রবেশ: যা কম্পিউটারের সর্বজনীন ব্যাপ্তিকরণকে বোঝায়, এবং ব্যক্তিসাধারণ কর্তৃক এর প্রোগ্রামগুলোর নিষ্ক্রিয় প্রতিলিপিকরণকে বোঝায়—যা শিক্ষা ও চিকিৎসাক্ষেত্রে সব থেকে বেশি দৃশ্যমান। আর এই স্বয়ংক্রিয় তত্ত্বাবধানের পদ্ধতিতে পুজিঁ বা রাষ্ট্র “আপনার” সাথে কিছু ই করে না কারণ “আপনি” শিখে গেছেন কি করে নিজেই নিজের সাথে তা করবেন।
“কিন্তু নিজের সাথে নিজেই করা” বলতে “নিজের জন্য করাও” বোঝায়, এবং এই নতু ন প্রযুক্তি অন্ততপক্ষে এমন দৃষ্টিকোণ সম্পর্কেনিরপেক্ষ যে, “নিজের জন্য করা” ব্যাপারটি মুক্তিলাভের একটি সমষ্টিগত রাজনৈতিক প্রকল্প হিসেবেও ব্যবহৃত হতে পারে। নতু ন এই সম্ভাবনাগুলো তাই ডিস্টোপিয়া আর ইউটোপিয়া উভয়কেই ধারণ করতে পারে তবে দুটোর কোনটি বাস্তবায়িত হবে সেই সিদ্ধান্ত কেবল রাজনৈতিক প্রথাগুলোই নিয়ে থাকে। আটালির সামাজিক রূপান্তরের এই ধারণা আসলে একটি আমূল পরিবর্তনের ধারণা সম্পর্কেঅবগত, তবে, মৌলিকভাবে নতুন রকমের এই সামাজিক সম্পর্কগুলোর আগমন সম্ভব হয়ে ওঠে শুধু তিনটি প্রধান উপকরণের প্রাক-অস্তিত্ব এবং কাকতালীয় উপস্থিতির ফলাফল হিসেবে, “ প্রথমত, একটি নতুন প্রযুক্তি, যেটি পুনর্গঠনের অর্থব্যয় কমিয়ে আনতে সামর্থ্য, দ্বিতীয়ত, আর্থিক সম্পদ (অথবা, নতুন পুজিঁ র সঞ্চয়), এবং তৃতীয়ত, বিশেষ এক সামাজিক শ্রেণি, যেটি এই আর্থিক সম্পদকে ব্যবহার করবার মধ্য দিয়ে নতুন প্রযুক্তিটিকে কার্যকর করবার আগ্রহ আর ক্ষমতা দুইই রাখে।”৯ আর এই নতু ন সমাজতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক উপকরণটি, যাকে অন্যভাবে প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের স্বপ্নও বলা যায়, তা আরও বেশী নিশ্চিত হয়ে যায় যখন নতু ন এই ঐতিহাসিক শ্রেণি বা গ্রুপ মোটর (groupe m) অস্তিত্বশীল ও কার্যকর অবস্থায় থাকে।
তবে আপাতদৃষ্টিতে একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্রবিন্দু থাকলেও, নয়েজের আলোচনা কোনভাবেই আটালির অন্যান্য কাজগুলোর বিষয়বস্তুহিসেবে যে প্রায়োগিকরাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সমস্যাগুলোর কথা চলে আসে তা থেকে দূরে নয়। এই বইটির সব থেকে কৌতূ হলোদ্দীপক বৈশিষ্ট্য হল এটির ইতিহাস এবং সমাজ জীবনকে একটি জোট হিসেবে দেখবার দৃঢ় সংকল্প, যার মধ্য দিয়ে বইটি আমাদেরকে এমন একটি সামাজিক নকশা প্রস্তাব করে যেখানে অর্থনীতি, প্রযুক্তি, রাজনৈতিক প্রথা, এবংসাংস্কৃতিক চর্চাগুলো সুপরিকল্পিতভাবে আন্তঃসম্পর্কিত। বর্তমান সময়ের এই সামাজিক, রাজনৈতিক আর ঐতিহাসিক বিভ্রান্তিতে,—যখন সামাজিক রূপান্তরের পুরাতন কৌশলগুলো, আর একটি মৌলিকভাবে স্বতন্ত্র ইউটোপিয় ভবিষ্যতে পৌঁছাবার পুরনো পথগুলো সেকেলে/ অচল অথবা অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়—তখন আটালির লেখার এই ভবিষ্যৎ সংক্রান্ত প্রকৃতিটি আরও বেশী সঙ্কেতপুর্ণহয়ে ওঠে, যেটি আমাদেরকে বর্তমানের ভিতরেই একটি ভবিষ্যতের খোঁজ করতে উদ্বুদ্ধ করে, এবং সেইসাথে, বর্তমান পরিস্থিতিকে শুধু কিছু নিশ্চল এবং পীড়াদায়ক অসঙ্গতির একটি বান্ডিল হিসেবেই নয়, বরং একইসাথে নতুন বাস্তবতার আগমনের একটি উৎসস্থল হিসেবে দেখতে সাহায্য করে—যেই বাস্তবতাগুলো সম্পর্কে আমরা এখনও খুব সামান্যই সচেতন। তাই, জ্যাক আটালির বিচার-বিশ্লেষণের খুঁটিনাটি সম্পর্কে আমাদের ভাবনা যাই হোক না কেন, সংগীত যে মূলগতভাবে পরিবর্তিত একটি সমাজে উদ্ভূত সামাজিক, রাজনৈতিক, এবং অর্থনৈতিক অবস্থাগুলোর ভবিষ্যৎবাণী করতে পারে, তার এমন ধারণাটি বেশ উদ্দীপনার সৃষ্টি করে। নয়েজ নামের এই বইটিতে আমরা বেশ ব্যতিক্রমধর্মী উপায়েই সংস্কৃতি ও সমাজের মধ্যবর্তী সম্পর্কগুলো নিয়ে—বিশেষ করে সমসাময়িক চিন্তার জগতে—তৈরি একটি নতুন কাঠামোর খোঁজ পাই যা বর্তমান সময়ের উৎপাদিত পণ্যকে বৈধতা দেয় এবং একইসাথে শক্তি হারিয়ে দুর্বল হয়ে পড়া একটি ইউটোপিয় স্বপ্নকেও পুনরুজ্জীবিত করে।
ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া অ্যাট সান্টা ক্রুজ
ফেব্রুয়ারি ১৯৮৪
টীকা
১. Max Weber, “Value-judgements in Social Science,” in Max Weber: Selections in Translation, edited by W. G. Runciman (Cambridge: Cambridge University Press, 1978), p. 95. See also Weber’s lengthier discussion in The Rational and Social Foundations of Music, trans. Martindale, Riedel, and Neuwirth (Carbondale: Southern Illinois University Press, 1958).
২. “Value-judgements,” p. 96.
৩. Ibid., p. 96.
৪. Theodor W. Adorno. Introduction to the Sociology of Music, trans. E. B. Ashton (New York: Seabury, 1976), p. 62.
৫. Ibid., p. 63.
৬. Ibid., p. 209. On the question of the autonomous status of art, see also in this series, Peter Burger. Theory of the Avant-Garde, introduction by 10chen Schulte-Sasse, trans. Michael Shaw, vol. 4 (Minneapolis: University of Minnesota Press, 1984).
৭. Oswald Spengler, The Decline of the West, vol. I (New York: Knopf, 1939), p. 47.
৮. Theodor W. Adorno, Philosophy of Modern Music, trans. Mitchell and Blomster (New York: Seabury, 1973), p. 66.
৯. Jacques Attali, Les Trois mondes (Paris: Fayard, 1981), p. 270