দুপুর রোদের চিৎকার
[উৎসর্গ : এখনও যাঁরা ন্যায় ও সাম্যের সমাজের স্বপ্ন দেখেন]
বুকের বাগান তছনছ করে ইবলিশ
সহিষ্ণুতায় নেই তাই কোনো বিশ্বাস;
বুকের ওপরে দেখে ধ্বংস ও হাহাকার
দ্রæত ওঠানামা করে পৃথিবীর নিশ্বাস।
দগদগে পোড়া মাটি ভেদ করে জেগে ওঠে
তরুণের লাশÑ ঝেড়ে ফেলে ধুলো গাত্রের-
পৃথিবীর মাঠে দুপুর রোদের চিৎকারে
কানে তালা লাগে ক্ষয়িষ্ণু বুড়ো রাত্রের।
আগামি দিনের পথ দেখা যায় যদ্দুর-
চিৎ হয়ে শুয়ে ঝলমল করে রোদ্দুর।
নভেম্বর ১৯৮২
আমার কিছু কথা আছে
[উৎসর্গ : যাদের কোনো কথা নেই]
কিছু কথা সদ্যোফোটা ফুল ও নক্ষত্রের মতো নিস্পাপ-
প্রকাশ্যে বলা যায়;
কিছু কথা অদৃশ্য ইশ্বরের মতো একান্ত গোপন;
কিছু কথা আধাআধি- প্রকাশ্যগোপন- বিষন্ণ সন্ধ্যার মতো
প্রচ্ছন্ন কুয়াশায় মোড়া।
কিছু কিছু কথা আছে কবরের মতো বদ্ধ-অন্ধকারে
সূর্যমুখীর মতো প্রস্ফুটিত; প্রকাশযোগ্য নয় কারো কাছে-
না তোমাকে না আমাকে না কোনো বিশ^স্ত স্বজন-বন্ধুকে।
কুসুমের মতো হলুদ-সুন্দর এবং নরম পেলব
এমন কিছু কথা আছে, বলা যায় শুধু তোমাকেই
একান্তে; অন্যকে নয়- কাউকে কখনো নয়;
সবাইকে যায় না বলা, এমন অদ্ভূত অতলান্ত কথার
নেই কোনো শেষ।
ঘুমন্ত সকালের মতো কিছু কথা আছে
সবাইকে বলা যায় নিষিদ্ধ-সংগোপনে,
তোমাকে যায় না বলা,
রক্তজবা-সূর্যের মতো আমাকেও স্পষ্ট করে নয়।
জ্বলন্ত চিতার মতো কিছু কিছু কথা আছে, কাউকে যায় না বলা
বলা যায় শুধু নিজেকেই;
লজ্জাবতীর মতো নগ্ন কিছু কথা আছে, শুধুই তোমাকে বলা যায়-
নিজেকেও যায় না বলা স্পষ্ট করে।
আমার মনে, মগজে-মননে মৃত্যুকূপের মতো নিভৃতে জমা আছে
প্রজাপতির পাখার মতোন নানা বর্ণের নানা গন্ধের কথকতা;
নানা কিসিমের কথা; মেঘাচ্ছন্ন আলো-ঝলমল অস্পষ্ট-সরল-জটিল-
রঙিন ঘুড্ডির মতো ঘুরপাক খায় সকাল সন্ধে বিকেল,
ঝিঁঝিঁডাকা সন্ধ্যার গভীরে, স্বপ্নময় জীবন্ত ঘুমের ঘোরে
কৃষ্ণগহ্বরের মতো অন্ধকারে- অবচেতনের অন্তঃস্থলে।
অতৃপ্ত অভিসারের মতো কোনো কোনো অবাধ্য কথা আছে
উজ্জ্বল ফসলের মতো মায়াময় মানবজমিনে
জীবনের অন্তিম ক্ষণেও যা বলা হয়ে ওঠে না কখনো- না তোমার
না তোমাদের অথবা আমার।
নিঃসঙ্গ ছাদে ছন্দময়-ছন্দহীন হাঁটি- সন্ধ্যা হয় হয়
তোমার যাওয়ার পথে সূর্য যায় যায়, ভোরের শিশুর মতো
মেঘের বুক চিড়ে চাঁদ উঠি উঠি করে; উঠেও ওঠে না;
চাতক পাখির মতো দৃষ্টিবদ্ধ আমি- কথাবৃষ্টির কত গান ভাবি আর ভাবি-
ভুল করেও বলি না কাউকে
না চাঁদকে না জোসনাকে না মেঘাচ্ছন্ন কুয়াশাকে, না
নাম না-জানা গাছের ছায়াকে, না নিজের নিয়ন্ত্রণমুক্ত
অজ্ঞাত অবিশ্বস্ত বিবেককে- সেসব নিগূঢ় কথা
নিজেকেও বলব-বলব করে বলা হয়ে ওঠে না কখনো।
কিছু কথা কায়াহীন ছায়াময়- স্পষ্ট করে নিজেও জানি না
কিছু কথা অর্থহীন; মাথামুণ্ডু নেই।
বিষণ্ন বিকেলে অথবা গোধূলিলগ্নে সূর্যকে পেছনে ফেলে
বিষাদে স্নিগ্ধ হয়ে কী যেন বলেছিলে অস্ফুটে রহস্যময়;-
কিছুতেই মনে করতে পারি না কিছুই
সেসব কথার কথা; অথবা চাই-ই না সেসব কথা
ছুরির ফলার মতো ধারালো এবং প্রচ্ছন্ন স্মৃতিতে জাগাতে অন্তরে।
আঁধারের কুয়াশা হয়ে সেসব নীলাভ-সবুজ রিক্তকথা
বানের জলের মতো কোথায় হারিয়ে গেছে তুমিও জানো না;
আমিও না।
সেসব জীয়নকথা নিজের অজান্তেই বেহালা-ক্রন্দনের মতো
বুকের গভীরে কেন বেজে বেজে যায় অবিশ্রান্ত বিস্রস্ত-
বিভ্রান্ত পথিকের মতো আলোকময়-অমাবস্যার মতো
কিছুতেই মনে করতে পারি না কিছুই।
নিস্তব্ধ-নিশ্চল তারাভরা রাতের মতো কতবার ভাবি আমি
আর কোনো কথাই জাগাব না বিভ্রমে, ত্রিভুবনে অথবা সংগোপনে,
সাদা অথবা রক্তাভ বেদনানন্দের কথা-
না একা-একা, না দুজনে-দুজনে, না সর্বজনে।
তবু কথা কিছু কিছু তোমার চুম্বক-পায়ের মতো কিছুতেই পিছু ছাড়ে না;
ভাড়াটে নিয়োগ করে ছাইচাপা যত দিই আমি, আগুনের ফুলকি হয়ে
দিগ্বিদিক ছড়িয়ে পড়ে সেসব দগ্ধীভূত কথা। কেউ শোনে
কেউ কেউ নাট্যকুশলীর মতো শুনেও শোনে না-
কেউ বোঝে; কেউ কেউ ভণিতায় বুঝেও বোঝে না।
আমি-ই কি সব বুঝি মনের দোতারায় কড়ইপাতার মতো বেজে চলা
আমার না-বলা কথাসব
অথবা যেসব কুয়াশাকথা সুকান্তের দেশলাই কাঠির মতো
প্রায়শ মুখ ফসকে বলেই ফেলি, বলব-না বলব-না করেও;
কিছু কিছু কথা আছে, ধুরন্ধর ইঁদুরের মতো কেটে খায় হৃদয়নিলয়,
সাপের ফনা এবং তার পিচ্ছিল খসখসে লেজের মতো
মনে মনে চলাচল করে- নিজেকেও বলি না কখনো।
কিছু কথা রাষ্ট্রীয়, নিরেট গোপন;
কিছু কথা বিশ্বজনীন- একান্ত আপন নয়।
বলব-না বলব-না করে কত কথা বলেই ফেললাম-
মাকাল ফলের মতো এতসব বাচালতায় কী-যে ফল হলো
কেউ-কি বলতে পারে গোপনে, অথবা প্রকাশ্যে!
কে এত কানে নেয় এসব সারশূন্য নির্মূল্য কথা?
না তুমি, না কোনো রাষ্ট্র, না জাতিসংঘ-
নিজের কথা নিজেই কি কানে তোলে
তোমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র,
এবং জাতিসংঘ!
২৩.১১.২০১১
আত্মপরিচয়
অকস্মাৎ বজ্রপাতের মতো তোমার প্রশ্ন শুনে চমকে উঠেছি আমি
নিরিহ-সরল মন তোমার মতোই!
জানতে চেয়েছ বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে; ভীষণ কৌতূহলে-
‘আমি কি বাঙালি, না কি মুসলমান?
ইহুদি, না কি খ্রিস্টান না কি হিন্দু?’
সরলরেখার মতো সহজ প্রশ্ন কেন যেন ধোঁয়াশা ঠেকেছে
পিঁপড়ের মতো এই নগণ্য অধমের কাছে।
তোমার মনের মতো জবাব না হলে তুমি
অভিমানী শিশুর মতো দমিতক্ষুব্ধ হতে পারো,
তাই কোনো সহজ জবাব আমি দেইনি- তৎক্ষণাৎ।
আমি মুসলমানও হতে পারি, হিন্দু কিংবা খ্রিস্টানও;
এমনকি, কোনো ধর্মের ধ্বজাধারী না-ও হতে পারি।
আমি বাঙালি অথবা চাকমা অথবা গারো কিংবা ওরাঁও
যা-ই হই না কেন
আমার নৃতাত্বিক পরিচয় মুছে ফেলা যাবে না কখনো-
কারুরই সাধ্যি নেই; আমারও না।
আমাকে ধর্মান্তরিত করতে পারো প্রণোদনায় অথবা বলপ্রয়োগে
অথবা স্বর্গ বা জান্নাতের প্রলোভনে!
আমাকে ভারতীয় কিংবা পাকিস্তানি বানাতে পারো
নাগরিকতায় আমি বৃটিশ অথবা অস্ট্রেলিয়ান হতে পারি
কিন্তু আমার বাঙালিত্ব অথবা চাকমাত্ব
মুছে ফেলতে পারবে না তুমি
কোনোভাবেই; কখনোই না।
আমার জাতিতাত্ত্বিক পরিচয়- আমি বাঙালি অথবা মুণ্ডা।
আমার সংস্কৃতিতে বাতাসের মতো মিশে আছে
হিন্দু-মুসলমান আরবীয়-পারস্য মিসরীয়-মুঘলীয়
প্রাচ্য-পাশ্চাত্য আভরন-
তবুও আমি বাঙালি- সবকিছু নিয়েই আমি বাঙালি।
সূর্যের নিয়ত প্রদক্ষিণের মতো পূর্ব থেকে পশ্চিমে
উত্তর থেকে দক্ষিণ গোলার্ধে
মরুভূমি থেকে চেরাপুঞ্জিতে
ইযরাইল থেকে মদিনায়
রাশিয়া কিংবা ইউক্রেনে
রবীন্দ্রনাথ থেকে ফররুখে
ভূপেন হাজারিকা থেকে মেহেদি হাসানে
গজল কিংবা ভজনে
আমি সর্বত্র এবং সর্বদাই বাঙালি
অথবা চাকমা কিংবা গারো।
আমার বাঙালিত্ব অবিনশ্বর
আমার চাকমাত্ব অবিনশ্বর
আমার গারো পরিচয় অবিনশ্বর।
পাজামা-পাঞ্জাবি-টুপি-দাড়ি-থামি
লুঙ্গি-ধুতি-প্যান্ট-শার্ট-ফতুয়া বা কোর্ট-টাই
এসব জাতীয়-বিজাতীয় পোশাক ধারণ করেও
আমি উদ্ধত-নম্র বাঙালি, কমলে-কঠোরে জাগ্রত-
রোদেভেজা পহেলা বৈশাখের উৎসবে আমি বাঙালি
ইংরেজি নববর্ষে আমি বাঙালি
উর্দু কিংবা হিন্দি জবানে অথবা ইংরেজীতেও
আমি নিখাদ বাঙালি;
পাখির কাকলি এবং অকৃত্রিম গ্রামীণ সংস্কৃতি নিয়ে বাঙালি
মিশ্র এবং অম্লমধুর নগর সংস্কৃতি নিয়ে বাঙালি
খোল-করতাল তবলা-বাঁশিতে আমি বাঙালি
লালন-হাসন কিংবা শাহ্ আব্দুল করিমের গানে আমি বাঙালি
বিচিত্র শাড়ি ও বর্ণময় গয়নায় আমি বাঙালি
মঙ্গল শোভাযাত্রায় আমি বাঙালি
পান্তা-ইলিশে আমি বাঙালি;
মন্দিরে কিংবা মসজিদে, গির্জায় বা প্যাগোডায়
বর্ষা অথবা বসন্তে- খিচুড়ি ও ডিমভাজিতে আমি বাঙালি।
কট্টর হিন্দু হলেও আমি বাঙালি
গোঁড়া অথবা উদার মুসলমান হলেও আমি বাঙালি
৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে আমি বাঙালি।
বাঙালিবিদ্বেষী পাকিস্তান, আলবদর, মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাকে
যুদ্ধে ও কৌশলে পরাজিত-পরাভূত করে আমি বাঙালি।
৭৫-এ আমি বাঙালি
২০১৮-তে আমি বাঙালি
২০২৩-এও আমি বাঙালি
২০৭১ অথবা অনন্তকাল আমি বাঙালি
বাঙালি আমার আত্মপরিচয়; আদি ও অকৃত্রিম
মুছে ফেলা যাবে না কখনো-
যেমন সাঁওতাল, ওরাঁও এবং চাকমা অথবা
অন্য কোনো জাতির আত্মপরিচয়
মুছে ফেলা যাবে না কোনে শক্তিপ্রয়োগে, অথবা কৌশলে।
বেঁচে থাকলেও আমি বাঙালি-
৭১-এ পরাজিত পাকিস্তানের প্রেতাত্মা
মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ ও বাঙালি-বিদ্বেষীদের হাতে
চাপাতিআঘাতে
মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়লেও
আমি বাঙালি-
তারপর অন্য পরিচয়।
২০.৪.২০১৮ – নভেম্বর ২০২৩
আর একবার দেখা হতো যদি
[উৎসর্গ : নীলা ম্যাডাম]
৫২ বছর পর আরেকবার দেখা হতো যদি
৩০ বছর পর যদি একবার দেখা হতো
যদি হতো কুড়ি বছর পর
অথবা ৫-১০ বছর পর – এখন যদি আরেকবার
হরেকরকম পুষ্পশোভিত চিরহরিৎ বাগানের মতো
স্মৃতিমোহিত হয়ে অরও একবার একসাথে হতে পারতাম-
৭১-এ গুলিবিদ্ধ রিক্সাচালক মোস্তফার সাথে
একসাথে মার্বেল খেলার কিশোরবন্ধু আমার;
সাম্যবাদের অ আ ক খ হাতেখড়ি যার হাতে,
৭২-এ বুলেটবিদ্ধ প্রত্যয়দীপ্ত ছোটোমামা কমরেড হেলালের সাথে;
টিক্কা খানের পা-চাটা রাজাকার মান্নান বিহারির নির্দেশে নিহত
কৌতুকাভিনেতা ও সাম্যবাদী আযাদ মামার সাথে
যদি আর একবার দেখা হতো!
আজন্ম বেড়েছি আমি যার হাতে হাঁটি হাঁটি পা-পা
বাড়ির বাগান সাজাতে সাজাতে
হঠাৎ চলে যাওয়া সুক্ষতম বুদ্ধিদীপ্ত বড়ো মামার সাথে;
ক্যান্সার-আক্রান্ত হয়ে চলে গেছে
লালনীল শাড়িপড়া ‘নীলা ম্যাডাম’-
মুগ্ধকর জনপ্রিয় সফল শিক্ষক ও শিক্ষার্থীপ্রিয় ছোটোবোন-
সকলের হিতৈষী
যে ছিল আমার বন্ধু এবং পথের দিশা- পরামর্শক;
পুত্রশোকে বিধ্বস্ত বিছানায় পড়ে থাকা গুণী
চোখের সামনে ঢলেপড়া প্রাণপ্রিয় প্রজ্ঞাবান নানার সাথে;
নানীর সাথে আর কখনো কি দেখা হবে- কখনো,
যার সাথে করেছি পাড় জীবনের প্রথম ও মধ্যপ্রহর
যার বাণী বিক্রি করে এখনও জীবন চলে
জীবিকার পথ খুঁজে মরি,
যাঁর প্রশান্তিময় কবর আজও অচিহ্নিত, অজানা আমার।
ময়নাল নানার কথা মনে পড়ে যায়
চোখের সামনে ভাসে তার যত অদ্ভূত হিউমার
রসমালাইয়ের মতো রঙ্গরসে ভরা;
মতিন মামাও ছিলেন একাত্তরে- রামচন্দ্রপুর- শহর থেকে দূরে-
আমাদের ছয় মাস আশ্রয়দাতাÑ তার কথা ভুলেই গিয়েছি!
শহীদ মুকুর কথা মনেই পড়ে না আর
না-পাকি সেনাদের সাথে সম্মুখসমরে যার আত্ম-বলিদান;
চারুশিল্পি চারুমামা আর পাখিশিকারি মতিনানার চোখ
দোয়েল পাখির মতো বুকের ভেতরে বাসা বেঁধে আছে;
চামেলি খালার সাথে দেখা নাই কতদিন; হবেও না আর-
কখন যে চলে গেছে বয়োজ্যেষ্ঠ বাল্যসাথী
আমার তত্বাবধায়ক
খবরই রাখিনি তার!
পাড়ার হাস্যোজ্বল প্রাণখোলা তরুণ শেখ সাদি,
কোনো নোটিশ ছাড়াই বাস অ্যাক্সিডেন্টে চলে গেল অকস্মাৎ!
সামাদ নানা ছিলেন প্রাজ্ঞজন
আমার গুণমুগ্ধ, শেখাতেন ইংরেজি বিকেলে সন্ধ্যায়
গৃহস্থালি কাজের ফাঁকে- চলে গেলেন কবে
আজ আর মনেই পড়ে না সেই দিন।
রাস্তার ওপারে বাড়ি সোলেমান মামা-
তাঁর মা,
বিশুদ্ধ বাংলাবচনে যাঁর ছিল সুনিপুণ গাথা
আমার নিত্যদিনে শিক্ষক- শেখাতেন অংক বিজ্ঞান;
শরৎচন্দ্র আর বিমল মিত্র ছিল নিত্যসঙ্গী তাঁর-
যাঁর ক্ষীর-জমানো পায়েস ছিল
দুই ঈদে আমাদের জীবনের সাধ আর স্বাদ
যদি একবার তার সাথে দেখা হতো
আর একবার!
পাড়ার মামারা ছিল বন্ধু আমার
গলায় গলায় ছিল মিল ও অমিল
কে আছে আর কে কে নেই ঠিকঠাক মনেই পড়ে না আর-
টিপুমামার কথা মনেই পড়ে না
শফিমামার কথা মনে পড়ে যায় মাঝে মাঝে
মনসুরমামা কি তবে এখনো বর্তমান?
মধু হাজি- পাবনার একমাত্র হাজি-অভিনেতা
দেখতে ছিলেন ঠিক সিনেমার নায়কের মতো,
এখনও কি আছেন তিনি?
২
জীবনসাথীর বাবা মোখলেসুর রহমান
আর প্রাজ্ঞজন মহসিন মোল্লার কথা মনে পড়ে যায়
বন্ধু ছিদ্দিকের কথা মনে পড়ে যায়
বড় বোনের বান্ধবি বন্ধুর ছোটো বোন
জহুরার কথা মনে পড়ে যায়
এখনও কি আছে ওরা বর্তমান;
নাকি চলে গেছে অন্যদের মতো?
(খবর পেলাম ওরা বেঁচে আছে এখন-অবধি)
আব্বাও তো ছিলেন ঠিক ৩৯ বছর আগে চলমান
এই পৃথিবীতে, সদাহাস্য সামাজিকতায়;
সর্বক্ষণ তসবিহ্ হাতে জায়নামাজে পড়ে থাকা
আল্লার কৃপাপ্রার্থী আমাদের মা গেছেন বছর ছয়েক-
রোগভোগে কমতি ছিল না তাঁর;
যাওয়ার আগেও তিনি ভুগেছেন পক্ষাঘাতে- কী বিষাদ মুখে
বছর তিনেক ধরে আল্লার অশেষ কৃপায় দুকূলপ্লাবী
কষ্টের সীমানা ছুঁয়ে অচল সজ্জায় পড়ে থেকে!
একবার, যদি আর একবার দেখা হতো
ওইসব গতসব প্রিয়দের সাথে;
শুধু একবার…..
৩.৮.২০১৯
পার্থক্য করতে পারি না
[উৎসর্গ : যাঁরা পার্থক্য করতে পারেন]
১.
সকালে ও সন্ধ্যায় দেখি দু’জনকেই- প্রতিদিন;
তবুও পার্থক্য করতে পারি না-
শিউলি ও শেফালির মধ্যে
সিদ্ধহস্ত জহুরির মতো আমি কোনো পার্থক্য করতে পারি না।
সকালে শিউলি ঝরে
সন্ধ্যায় শেফালি?
না-কি সন্ধ্যায় শিউলি হয়ে
সকালে শেফালি?
আমি আজও নিঃসংশয়ে নিশ্চিত হতে পারি না কিছুতেই।
ঘরের আঙিনায় ঋদ্ধ কর্তৃত্বকারিণী এক রক্তগোলাপ
কতবার চিনিয়েছে-‘ওই দেখ!
রাতে ফোটে, আর সকালে ঝরে যায়- এইতো শিউলি;
সকালে ঝরে যায়, আর সন্ধ্যায় ফোটে- ওইতো শেফালি।’
তবুও পার্থক্য করতে পারি না-
শিউলি ও শেফালির কোল ঘেঁষে বহুকাল কাছাকাছি থেকেও
আজও আমি মুগ্ধদৃষ্টি- তবুও পার্থক্য করতে পারি না।
ফুল ও পাঁপড়ির কাছে সমর্পিত আমি এক পুষ্পান্ধ মানুষ!
আমি এক বর্ণান্ধ মানুষ-
বর্ণ-গোত্র আর কাছাকাছি রঙের মধ্যে পার্থক্য করতে পারি না।
নীল ও সবুজের মধ্যে বেগুনি ও নীলের মধ্যে পার্থক্য করতে পারি না
লাল ও গোলাপির মধ্যে পার্থক্য করতে পারি না
আকাশি ও নীলের মধ্যে পার্থক্য করতে পারি না।
রংধনুর সাত রং আমি গুলিয়ে ফেলি; পৃথক করতে পারি না।
সাদা ও কালো ছাড়া আমি কোনো বর্ণ চিনি না।
সাদাকে সাদা-ই দেখি; কালোকে কালো
শুধু এটুকুই শিখেছি জীবনে-
সাদার রং ‘সাদা’ আর কালোর রং ‘কালো’।
সাদার মুগ্ধতা শীতোষ্ণ গোধূলির শুভ্রতার মতোন,
আর কালোর সৌন্দর্য্য রাধার চোখের মণি কৃষ্ণের মতোন।
সাদা আর কালো ছাড়া
আর কোনো বর্ণ আমি স্পষ্ট করে চিনতে পারি নাÑ
আমি এক বর্ণান্ধ মানুষ!
সাপ ও নেউলের মতো জাতিতে জাতিতে আমি পার্থক্য করতে পারি না
বাঘ ও হরিণের মতো ধর্মে ধর্মে আমি ভেদাভেদ করতে পারি না
শাসক ও শাসিতের মতো গোত্রে গোত্রে কোনো ফারাক করতে পারি না;
নারী ও পুরুষের মধ্যে পার্থক্য করতে পারি না
মানুষে মানুষে আমি জাতপাত বিভেদ করতে পারি না।
যখন কৈশোর ছিল আমার হৃদয়ে
মানুষে-অমানুষে ছিল পার্থক্য তখন!
এখন জীবনাকাশে পশ্চিমের ক্লান্তসূর্য পড়ন্ত বেলা-
মানুষ-অমানুষ সব মানুষ-এর রূপ ধরে আসে!
আমার চেখের সামনে অদৃশ্য যাদুকরের মায়াবি হাতের খেলে
এ দু’য়ের ভেদাভেদ একাকার লীন হয়ে গেছে-
আজকাল মানুষ ও অমানুষ আমি
পদ্মা-গঙ্গার মতো আলাদা করতে পারি না।
আমি উড়ন্ত পাখি আর বন্দুকের গুলির মধ্যে
সুশোভিত ফুল আর সংলগ্ন কাঁটার মধ্যে পার্থক্য করতে পারি।
পুষ্পস্পর্শে আমি কণ্টকাকীর্ণ হই চলমান জীবনসমাজে-
তাই তরতাজা পুষ্পঘ্রাণ আর সুস্পষ্ট কাঁটার আস্বাদ
আমি আলাদা করতে পারি।
গোলাপের সাথে সুবর্ণজয়ন্তি ছুঁয়ে বসবাস করে
কাঁটার রমণীয় ভালোবাসায় আমি বিভ্রান্ত-শিহরিত হই-
আমি মানুষের সাথে আজন্ম পলে পলে সময় যাপন করে
জান্তব অমানুষ চিনতে শিখি;
কিন্তু তরতাজা মানুষকে পড়তে পারি না!
আজকাল ভালো ও মন্দের মধ্যে ব্যবধান করতে পারি না
নির্ভেজাল ভালো বলে যা কিছু চিনতাম আগে
অমৃতমন্দ এসে করতলে তিক্ত জলে নিয়ে গেছে তাকে;
সময়ের ভারসাম্যে ভালো ও মন্দের মধ্যে কোনটা বেছে নেব
আর কোনটা শেখাব, তা আমি শিখতে পারি না-
আগামি প্রজন্মের কাছে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারি না।
আমি নিষ্কাম প্রেম আর জীবন্ত ঘৃণার মধ্যে,
নির্লোভ স্নেহ ও আর চতুর করুণার মধ্যে পার্থক্য করতে শিখেছি
শৈশব-কৈশোর আর বাড়ন্ত বেলায়
অনুভবে-যাতনায়।
আমি নিখাদ প্রেম অথবা ভালোবাসার জন্য
জীবন উৎসর্গ করতে শিখিনি-
আজন্ম কাঙাল তাই, ভালোবাসা পাওয়ার জন্য
গান আর সুর সেধে গেছি-
পূর্ণচন্দ্রের মতো কাউকে উজাড় করে ভালোবাসতে শিখিনি এখনো,
তাই, ভালোবাসার মর্ম বুঝিনি!
আমি এক প্রেমান্ধ মানুষ। তবু
মানুষকে যথাযথ ভালোবেসে
জীবন উৎসর্গ করতে শিখিনি-
মানুষের সাথে আমি ঘৃণা-কষ্ট-অমর্যাদা
বিনাসুদে বিনিময় ভাগাভাগি করে করে
জীবন করেছি পার-
জীবনকে চিনতে পারিনি
জীবন-ও চেনেনি আমাকে।
২.
বন্ধুবলয়ে বসে চকমকি আড্ডা দিই অনিয়ম মেনে।
পারিজাতিকার মতো
বন্ধুত্বের ঘ্রাণ পেতে কান পেতে জেগে থাকি- আপ্রাণ;
প্রকৃত বন্ধু চিনি না-
বন্ধুত্ব কাকে বলে যাচাই করার জন্য হিরণ্ময় আয়না চিনি না।
বন্ধু অ-বন্ধুর মধ্যে ফারাক শিখিনি
নিজে কারো বন্ধু কি না
আজ-অবধি পড়তে পারিনি
শিখিনি যাচাই করতে কষ্টিপাথরে।
আমি পানি ও পানীয়’র মধ্যে পার্থক্য করতে পারি না।
আমি মানবিক মাতাল আর
অ-মাতাল পরার্থপর মানুষের মধ্যে
কোনোরূপ ফারাক দেখিনি;
আমি মোমিন মুসলমান আর ধার্মিক হিন্দুর মধ্যে
বিন্দুমাত্র বিরোধ দেখি না।
আমি ধর্মপ্রাণ আস্তিক আর মহৎপ্রাণ নাস্তিকের মধ্যে
পার্থক্য করতে শিখিনি;
আমি খুনি আস্তিক আর প্রতিবাদহীন নাস্তিকের মধ্যে
পার্থক্য করতে পারি না।
আমি সহিষ্ণু-অসহিষ্ণুর মধ্যে পার্থক্য করতে শিখেছি।
ঘোর অমানিশার মতো জাতিভেদ প্রত্যক্ষ করেছি আমি একাত্তরে-
বাঙালি ‘বদর’ আর অবাঙালি খানসেনার মধ্যে
নরহত্যার নিষ্ঠুরতায় বিন্দুমাত্র পার্থক্য দেখিনি;
নরাধম রাজাকার আর নিরিহ মানুষের মধ্যে
দেশপ্রেমের পরাকাষ্ঠায় ব্যবধান দেখেছি আমি
আসমান-জমিন।
আমি ধর্ম-স্বদেশপ্রেম আর মানবতা ভূলুন্ঠিত
দেখেছি আমার এই শৃঙ্খলিত শ্যামল দেশেÑ
আমি পরম ধর্মের নামে রক্তাক্ত অধর্ম দেখি
আমার এই প্রাণবন্তÍ সবুজ জমিনে।
আমি প্রবন্ধ ও নিবন্ধের মধ্যে
ছন্দময় গদ্য এবং গদ্যকবিতার মধ্যে
কবিতা ও গানের মধ্যে পার্থক্য করতে পারি না
তাই আমি-
আজও কোনো ক্লাসিক কবিতা বা গান লিখতে পারিনি।
আমি গীত ও সংগীতের মধ্যে
ধর্মের মর্মবাণী আর মরমী সাধকের মধ্যে
সুরসূধা ও সাধনার মধ্যে
জীবন ও জগতের মধ্যে পার্থক্য করতে পারি না;
ইহকাল ও পরকালের মধ্যে সীমারেখা আঁকতে পারি না।
আমি
জাহান্নাম ও জান্নাতের মধ্যে পার্থক্য করতে পারি
পুরষ্কার ও শাস্তির মধ্যে পার্থক্য করতে পারিÑ
কিন্তু জান্নাত ও পুরষ্কারের লোভে অক্লান্ত হতে পারি না;
প্রাচীন ও জীবন্ত কোনো দগদগে ঘায়ের মতো আশৈশব লালিত ভয়
অবচেতনে বিদ্ধ হয়ে অরুদ্ধ প্রবহমান জাহান্নামের অগ্নিকুণ্ড
বিশ্বাস-অবিশ্বাসে পেন্ডুলামের মতো আমাকে দোদুল্যমান করে দেয়-
অবদমিত করে দেয় মুক্তচিন্তা আর সমাজ-প্রগতি।
মানুষের আবাল্যলালিত স্বপ্নসাধ নদীর ভাঙনের মতো
ভেঙে যেতে দেখেছি আমি বারংবার
জ¦লন্ত চোখের সামনে- তবু
মানুষের জন্য আমি বাজি রাখতে শিখিনি জীবন।
নিয়ত বহমান সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো জীবন মৃত্যুর দিকে,
না কি আমার ছায়ার মতো মৃত্যু জীবনের পিছে ধাবমান-
আজও আমি সিদ্ধান্তে আসতে পারিনি।
তাই, আমি জীবন ও মৃত্যুর মধ্যে
সুক্ষতম পার্থক্য করতে পারি না।
আজন্ম দ্বিধায় কেটে জীবন করেছি পার
প্রান্তিকের প্রারম্ভে এসে এখনও সিদ্ধান্তহীন-
নিজেকেই এখনও আমি সুক্ষতায় চিনতে পারিনি।
কাঠঠোকরার তীক্ষ্ণ ঠোঁটে
গুপ্তচরের মতো আমার ভেতরে থাকে একজন,
আর বাইরে আরেক-
বাইরের ‘আমি’কে চেনে অন্য মানুষ
নিজে তাকে পুরোপুরি ত্রিনয়নে চিনতে পারি না;
মাঝেমাঝে ব্যবচ্ছেদ করি ভেতরের ‘আমি’-কে আমি
তাকে দেখে কুঁকড়ে উঠি; ভয়ার্ত শামুকের মতো ক্রমাগত কুঞ্চিত হই-
ভেতরের আমাকেও আমি নিশ্চিত চিনতে পারি না
দু’জনের পার্থক্য দেখি; কিন্তু ‘নিজে’কে দেখি না।
সকালে শিউলি ঝরে
সন্ধ্যায় শেফালি?
না-কি সন্ধ্যায় শিউলি হয়ে
সকালে শেফালি?
আমি আজও নিঃসংশয়ে নিশ্চিত হতে পারি না কিছুতেই।
আমি শিউলি ও শেফালি’র মধ্যে আজও কোনো
পার্থক্য করতে পারি না।
২৫.১২.২০১৬