বাপের বেটা লাদেন যখন নেতা হলো সবাই অবাক হয়ে গেল। আশেপাশের দশ গ্রামে কেউ কোনোদিন নেতা হয়নি। নেতা তো দূরের কথা, পাতি মাস্তান হতে যেটুকু তেল দরকার, সে তেল নেতাদের পাছায় মারার চেয়ে যুগের পর যুগ ধরে হারিকেনে ঢালা বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে ওদিককার জনগণের। তাই লাদেন যখন নেতা হলো তখন সবাই ভেবেই কূল পেল না যে ওদের বাড়ির হারিকেনটা তবে কিভাবে জ্বলত।
ছয়টা বোনের পর যখন লাদেন হলো তখন লাদেনের বাপ খুঁজেই পাচ্ছিল না কিভাবে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করবে। মেয়েগুলো যখন একে একে হচ্ছিল মিলিয়ে মিলিয়ে বেশ নাম রাখতে শুরু করেছিল সে, হাসি, খুশি, রাশি ; তারপর গ্রামের ঝুনা বুড়ি চারবারের সময় বললো মেয়েদের নাম মিলিয়ে রাখলে নাকি মেয়েই হতে থাকে। বুড়ির ওপর বেশ রাগই হয় লাদেনের বাপের, এ কথা কি এত দেরীতে বলার মত কথা! পরের মেয়েটার নাম তাই হলো তুনা, তার পরেরটা নিশা, তার পরেরটা সেতু। ছয় ছয়টা মেয়ের ধাক্কা কম নয়, তাই এবার একটা বড়সড় মানত করে ফেলে সে। ন্যাংটা বাবার মাজারে গিয়ে সুতা বেঁধে আসে যে এবার ছেলে হলে এমন নাম রাখবে যেন ছেলে একদম সারাজীবন আল্লাহর রাস্তায় থাকে। ইসলামের শত্রু আমেরিকাকে কাঁপিয়ে দেয়া নামটা তার পছন্দের প্রথম দিকেই ছিল।
ছোট থেকেই লাদেনের মধ্যে বেশ একটা ভাব ছিল। বোনেদের কাউকেই সে মানত না। ধরে ধরে মারত। আরও মারত স্কুলের অন্য ছেলেদের। এতে অবশ্য লাদেনের বাপ বেশ খুশিই হত। পুরুষের মত পুরুষ তৈরি হচ্ছে ছেলে। একটু হাত না চললে তো মাইজ্ঞা বলবে সবাই। একটু বড় হতেই বোনেদের চলাফেরা হতে শুরু করে পড়াশোনা সবকিছুতেই শেষ কথাটা বলতে শুরু করলো লাদেন। ক্লাস এইটে উঠেই হুট করে সে ঘোষণা করলো বোনেদের বড় দুজনের বিয়ে তো হয়েছেই, বাকি চারটারও দ্রুতগতিতে বিয়ে দেয়া হোক, জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাচ্ছে। লাদেনের বাপ বিপুল উৎসাহে দুইবারে চার মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিল। নাইনে উঠে লাদেন দাবি করলো মোবাইল, টেনে উঠে মোটরসাইকেল আর ইন্টারে উঠে বউ।
প্রথম দুটো টেনেটুনে জোগাড় করে ছেলেকে দিলেও তিন নম্বরটার বেলায় একটু ঝামেলায় পড়ে গেল লাদেনের বাপ। ছেলে কামাই করে না, নিজেরও তেমন বিরাট কোনো জোলাজাতি নেই যে কারো বাড়ির মেয়ে নিয়ে আসতে পারে। তাই এবার লাদেনকে ডেকে বেচারা বাপ সবকিছু খোলাসা করে বলেই ফেলে। লাদেনও বুঝে নেয় যা বোঝার, কামাই করতে হবে।
বিশেষ বিশেষ দিনে রাজনৈতিক দলগুলোর বিরাট সমাবেশ হয়। একদিন কলেজের তিনবার ফেল বড়ভাই ডেকে বলে সমাবেশে যাওয়ার কথা। কোক, সিঙারা আর নগদ দুশো টাকা। সমাবেশে এত এত মানুষ, লাদেন ভেবেই কূল পায় না এত টাকা আসে কোত্থেকে। পরে সে লাইনঘাট বুঝে নেয় আস্তে আস্তে। নিজে গেলে দুশো, কিন্তু আরও দশজন নিয়ে গেলে দুই হাজার টাকা শুধু নিজেরই। লাদেন নিজের দিকে মানুষ টানা শুরু করে, ছোটবড় মিলিয়ে জন পঞ্চাশেক হয়েও যায়। এদের সে দেয় একশ করে, মাথাপিছু বাকি একশ মেরে দিয়ে পাঁচ হাজার টাকা পকেটে, আর সাথে পঞ্চাশ জন এনে নিজের ভাগের দশ হাজার তো আছেই। সেও খুশি, বাকিরাও খুশি। লাদেন মিছিল করে, মিছিল করে নেতার কাছে যায়, পঞ্চাশজন লোক দেখায়, ছবি তোলে, উপরে লেখে প্রিয় অভিভাবক, বিশ হাজার টাকা আনে, পনের তার, পাঁচ বাকিদের।
এরমধ্যে লাদেন ফেলের পর ফেল করতে থাকে। নিয়ম তো নয় এভাবে পরে থাকার, তবু পঞ্চাশজন নিয়ে গিয়ে দাঁড়ালে প্রিন্সিপালের নানাও ভয় পাবে। তাই কোনোমতে জানটা হাতে নিয়ে প্রতিবারই প্রিন্সিপাল তাকে পরীক্ষায় বসতে দেয়। দেখেটুকে শেষমেশ পাসও করে নেয় সে। এরপর? এরপর কী?
লাদেন গিয়ে নেতাকে ধরে। নেতা, এরপর কী? নেতাও খুঁজে পায় না এরপর কী। লাদেন তখন বলেই বসে, আরও বড় জায়গায় রাজনীতি করতে চায়, আরও বেশি লোক যাতে ওর কথায় জড়ো হয়। নেতাকে সে ভাবতে বলে, নেতাও ভাবে, কেন্দ্রীয় রাজনীতি করা একটা কর্মী তার থাকলেই বা সমস্যা কোথায়। সব জায়গার খবরাখবরই তো তার প্রয়োজন। বেল্ট গড়ে তুলতে হবে, রাজকীয় বেল্ট, যাতে তার সীমানা এড়িয়েও কেউ ঢুকতে না পারে, পেরিয়েও কেউ ঢুকতে না পারে।
নেতা প্রস্তাব দিল, মুক্তিযুদ্ধ কোটা? না, বয়সে মেলে না। তাহলে ভিসি কোটা। এটার কোনো মেলামেলি লাগে না। নোটে- হাতে মিললেই হলো। নেতা লাদেনের জন্য কিছু নোট খসালো, তার বদলে লাদেন তাকে চারটা ট্রলার ঘাট আর দুটো রাইসমিল দখল করে দিল।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পা দিয়ে লাদেন প্রথম যখন যদুর হোটেলে গেল তখন পুরাতন কমিটি যাই যাই করছে। সে দেখে সাদা পাঞ্জাবি পায়জামা পরে পদপ্রত্যাশীরা সব বসে আছে, এ ওকে ঠেলছে। নারী কর্মীদের অবস্থা আরও ভালো। বারো হাত দূর থেকে তাদের ভাইয়ায়ায়ায়ায়ায়া ডাক যেন লাদেনের বুক অব্দি বাঁশের হাক্কা তৈরি করছে। লাদেনের হঠাৎ মনে পড়ে যায় গ্রামের মরা খালের ওপর হাক্কার জায়গায় পুল তৈরি করার জন্য নেতাকে ভীষণ চাপাচাপি করেছে সে। নেতাও একপ্রকার রাজি। বরাদ্দ যা আসবে তিনভাগের দুইভাগ নেতার, একভাগ যা বাকি থাকবে তার চারভাগ হবে। মেম্বার, চেয়ারম্যান, সে আর কন্ট্রাকটার। পুল দেখা যাক, আল্লাহ চাইলে হবে, না চাইলে কিভাবে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক রকম নেতা। অনুষদে এক নেতা,হলে এক নেতা, ব্লকে এক নেতা, রুমে এক নেতা — আবার পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে নেতা, তারও আছে নেতা। এত নেতার ভিড়ে লাদেন কিছুটা হাবুডুবু খেয়ে যায়। কিন্তু সে থৈ হারায় না। জোরেশোরে রাজনীতি শুরু করে দেয়। রাজনীতি আর কি, সদা প্রস্তুত থাকা। কিসের জন্য প্রস্তুত থাকা সেটা অবশ্য আজ অব্দি কেউ জানে না। কারণ যার জন্য প্রস্তুত হয়ে থাকতে বলা হয়, তারা সত্যি সত্যিই এলে দেখা যায় যে কারোই কোনো প্রস্তুতি নেই, শুধু যে প্রস্তুতি নেই তা নয়, তাদের কোনো পরিকল্পনাও নেই যে প্রস্তুতিটা আসলে কি কাজে খাটানো হবে।
লাদেনের নেতার নাম গভীর ভাই। গভীর ভাইয়ের বুদ্ধি কতটা গভীর তা নিয়ে সংশয় থাকলেও তার চিকন বুদ্ধির গভীরতা নিয়ে কারো কোনো সংশয় নেই। লাদেন তারই পেছন পেছন থাকে। গভীর ভাইয়ের সমস্ত ফাইফরমাশ খাটে, তার খাবার এনে দেয়, সিগারেট এনে দেয়,কাপড় ধুয়ে দেয়, তার প্রেমপত্র বিভিন্ন হলে পৌঁছে দেয়, কোন ভাই তার নামে কি বলে সেসব তথ্য খুঁজে আনে, বিশেষ বিশেষ জায়গা থেকে মাসোহারা তুলে আনে এইসেই আরও কত কি! তার কাজ অন্তহীন, তবে এসবের মধ্যে পড়াশোনার অস্তিত্বটা ঠিক নেই।
তার ডেডিকেশনে অবশ্য গভীর ভাই সন্তুষ্ট হয়। তাকে একটা চার সিটের রুম দুই সিট করে দেয়। সে তার একটা বন্ধু নিয়ে ওখানে ওঠে আর লেগে থাকে আগের মতই। গভীর ভাই একদিন আরও অনেকের সাথে তাকে নিয়ে যায় বিরাট ভাইয়ের কাছে। বিরাট ভাই ক্যাম্পাসের প্রধান নেতা, প্রেসিডেন্ট। গভীর ভাই তার রাজনীতি করে। সে তার সামনে বসে বসে কতক্ষণ ধরে চিকন ভাইয়ের বদনাম করে। চিকন ভাই ক্যাম্পাসের সেক্রেটারি। তার আস্ফালন দেখে বিরাট ভাই খুবই বিরক্ত। তিনি চিকন ভাইকে কম পানির চিংড়ি মাছ বলে আখ্যায়িত করেন।
ঈদে বাড়ি গিয়ে লাদেন বিরাট ভাই আর গভীর ভাইর জন্য আস্ত খাসির রান নিয়ে আসে। সাথে আনে দুধপুলি একশ পিস। মাকে রীতিমতো মানসিক চাপ প্রয়োগ করে এগুলো তৈরি করিয়েছে সে। গভীর ভাই খুবই খুশি হয়, বিরাট ভাই খুশি কিনা বোঝা যায় না, যেটা বোঝা যায় সেটা হলো এ ধরনের আপ্যায়ন তার জন্য নতুন কিছু নয়, এসব তিনি আরও দেখেছেন। লাদেন তবু হতাশ হয় না, বড় নেতা, হালকা কিছু তো নয়।
এভাবেই চলতে থাকে, দিন এগোয় পাহাড়ি হাতির মত।
হঠাৎ একদিন কেন্দ্রীয় নতুন কমিটি তৈরি হয়। গভীর ভাই খুবই খুশি, যে এসেছে সে তার বেল্টের লোক। খুশির ধাক্কায় সে লাদেনকে হল প্রতিনিধি বানানোর ঘোষণা দিয়ে দেয়। লাদেন আরও জোরেশোরে লেগে পড়ে। প্রতিটি প্রোগ্রামে দলবল নিয়ে সে উপস্থিত হয়। ক্যাম্পাসে, হলে তার একটি আলাদা নাম তৈরি হয়। তাকে সাধারণে ভয় পেতে শুরু করে। সে যখন প্রথমবার প্রেসিডেন্টকে কাছ থেকে দেখে, তার ঘোর লেগে যায়। কোট প্যান্ট পরা অসাধারণ সুন্দর একটা মানুষ, যেন উত্তম কুমার। কালো চশমাটা খুললে যেন সেই ধারণাটা আরও পোক্ত হয়। হ্যা, উত্তম কুমারই বটে।
গভীর ভাইয়ের সাথে সেও উত্তম কুমারের রাজনীতি শুরু করে। উত্তম কুমারের কাছে বেশ কয়েকবার আসা যাওয়াও করেছে। সালাম দিয়েছে। উত্তম কুমার তাকে ভালোমতোই চিনেছে। বিভিন্ন সমাবেশে উত্তম কুমারের জ্ঞান – প্রজ্ঞা – ভাষায় সবাই বিমোহিত। উত্তম কুমার গান গায়, কবিতা বলে, আড়ংয়ের পাঞ্জাবি আর খাদির চাদর গায়ে দেয়। উত্তম কুমার বলে ফুলের রাজনীতি, পাতার রাজনীতি, পাখির রাজনীতির কথা। উত্তম কুমার বলে বই পড়ার কথা, গান শোনার কথা, ভালো ফলাফলের কথা, চরিত্রে দৃঢ়তার কথা, আকাশ পাতাল জয় করার কথা। সবাই উত্তম কুমারের ভক্ত, লাদেন উত্তম কুমারের দাস। সেও শুরু করে উত্তম কুমার হওয়া। চলনে বলনে পোশাকে — চুমু খাওয়ার মত করে কোমলভাবে কথা বলায়। গভীর ভাই তাকে দেখে হাসে। উত্তম কুমারের সাথে দেখা করতে গিয়ে লাদেনকে এগিয়ে দেয়, বলে তার জন্য বিশ্বাসী কর্মী খুঁজে এনেছে।
সেই থেকে শুরু, লাদেন হয়ে যায় গভীর ভাইয়ের থেকে উত্তম কুমারের। উত্তম কুমারের সকল ফরমায়েশের দায়িত্ব তার। লাদেন আগে কাজ করত স্বার্থে, এখন কাজ করতে থাকে মুগ্ধতায়৷
দিন যায়, অবস্থা জটিল হতে থাকে। আন্দোলন দানা বাঁধে। লাদেনদের প্রস্তুতি কাজে লাগানোর এই সময়। কিন্তু লাদেন লক্ষ্য করে তার আসলে কোনো প্রস্তুতিই নেই। তার মতো আরও হাজার হাজার কর্মী, তাদেরও কোনো প্রস্তুতি নেই। তারা জানে না এ ধরনের অবস্থা তৈরি হলে কী করতে হয়। তারা দলের ইতিহাস জানে না, দল আগের দিনগুলোতে কিভাবে বিভিন্ন পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছে তাও জানে না — এমনকি এও জানে না যে দল আসলে কোন মত সমর্থন করে — এই যে আন্দোলন হচ্ছে — দলের কি এর পক্ষে থাকার কথা নাকি বিপক্ষে — কর্মীরা জানে না!
অতঃপর কর্মীরা অপেক্ষায় থাকে। হাই কমান্ডের অপেক্ষায়। কর্মীরা না জানুক, হাই কমান্ড তো জানবে। লাদেন হল থেকে বের হচ্ছিল, উদ্দেশ্য উত্তম কুমারের কাছে যাওয়া, প্রতিদিনই যায়, তবে এই কঠিন সময়ে দিনরাত তাকে আরও জোরেশোরে প্রোটোকল দেয়া প্রয়োজন। বের হবার সময় দেখা হয় মোস্ট জুনিয়র বাব্বার সাথে। বাব্বা পলিটিকাল ব্লকের সবচেয়ে কম বয়সী কর্মী। একটু তোতলা, একটু ভীতু, তবে দুর্দান্ত স্লোগান দেয়। বাব্বা লাদেনকে দেখে একটা সালাম দিয়ে স্লিপ কেটে একপাশে চলে যায়। লাদেন মাথা নেড়ে এগিয়ে গেলে পেছন থাকে ডাক শোনে।
– ভা হায়াই… ভাই।
তাকিয়ে দেখে বাব্বা এখনো দাঁড়িয়ে আছে।
– ভাই, হামি ভারি ছলে ঝেতে চাচছিলাম। ভাইরা বলিলো হাই কমোড থেকে নির্দেশনা আসিবেক। আমার হাই কমোডের নির্দেশনা লাগিবেক লাই। হামি ছলে ঝোবো। হাপনি বলেন।
লাদেন কিছু বলে না। এভাবে চলে যেতে চাইলে সব, সমস্যা হবে। ইশারায় বলে যে যাওয়া যাবে না, ওপরে চলে যেতে বলে, তারপর বেরিয়ে যায়। উত্তম কুমারের বাসার সামনে ভিড়, সবার মুখ চিন্তিত। লাদেনেরও ভয় করে, তবে কি আসলেই সব শেষ হয়ে যাচ্ছে!
বাসায় ঢুকে সে দেখে উত্তম কুমার ভাত খাচ্ছে। তার মুখ হাসিহাসি। চারিপাশে কিছু নেতাকর্মী, বসার ঘরেও আছে কিছু। উত্তম তাদের সাথে মশকরা করছেন আন্দোলন নিয়ে।
— এই যে, কাশেম, এদিকে তাকাও, এইযে ভাতটা দেখেছ? এই রাখলাম, এই টিপ দিলাম, শেষ! এইযে চিকরা পাকরা, এগুলোরও এই অবস্থা। আমরা রাখলে আছে, টিপ দিলেই শেষ। আর টিপ দিতে তো জানোই, আমার এই বুড়া আঙুলটাই যথেষ্ট!
ঠিক নেতা, ঠিক ঠিক। — একত্র কিছু সম্ভাষণ শোনা যায়। লাদেন ইশারায় সালাম দেয় নেতাকে। উত্তম কুমার বলে, আরে খাবার সময় সালাম দিচ্ছ কেন! লাদেন মুগ্ধ হয়ে যায়, কি সুন্দর তুমি তুমি করে কথা, সবসময়ই, মানুষ এত ভালো কিভাবে হয়, এই মানুষটাকে কেউ থামায়না কেনো, এত ভালো কি হতে আছে!
নেতা খাওয়ার সময় প্রথমে খাঁটি গাওয়া ঘি আর লবন মিশিয়ে ভাত খায়, দুই তিন গ্রাস হলেও, নিয়মের মতই কিছুটা। তারপর টেবিলের অন্যান্য পদগুলোর দিকে তাকায়, দেখে মনে হয় কিছুই পছন্দ হচ্ছে না।
— একটু কুমড়ো খেতে চেয়েছিলাম, ভালো ইলিশ দিয়ে!
জানা গেলো ভালো ইলিশ পাওয়া গেছে, ছাব্বিশটা বিভিন্ন সাইজের তাজা ইলিশ। মাওয়া থেকে সরাসরি দিয়ে গেছে উনপঞ্চাশ নং ওয়ার্ডের উপ কর্মসংস্থান বিষয়ক সম্পাদক। বদলে তার বাবার কর্মসংস্থানের একটা ব্যবস্থা করে দিতে হবে। বাবাটি তার জেলে, করতে চায় মাছের আড়ত, তার আবডালে হয়ত আরও কিছু। তা দিয়ে দরকার নেই, চোখটা ইলিশের কানকোতে রাখাই ভালো। কিন্তু কুমড়ো কই!
জানা গেলো ভালো কুমড়ো পাওয়া যাচ্ছে না। কিছু পাওয়া গিয়েছিল, কিন্তু কাঁচা। ও দিয়ে ইলিশ ভালো লাগবে না। নেতার মুখটা দেখে লাদেনের খারাপ লাগলো। একটা মোটে কুমড়ো, তাও পাওয়া যাচ্ছেনা। যাবে কি করে! বাংলা ব্লকেড টকেড করে কি বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা! মানুষের কোনো জ্ঞান নেই আসলে। আরে, কারো তো কুমড়ো খেতেও মন চাইতে পারে!
লাদেন সিদ্ধান্ত নেয় কুমড়া আনতে গ্রামে যাবে। দরকার হলে কুমড়ার বাজার বসিয়ে দেবে। একটা সামান্য কুমড়া, তাও যদি নেতা খেতে না পারে! লাদেন পেছন থেকে নেতার পাশে গিয়ে নেতার কানের কাছে মুখ নেয়।
— নেতা, আপনি ভাববেন না। আমি গ্রাম থেকে আপনার জন্য পিওর মিষ্টি কুমড়া নিয়ে আসতেছি, একদম ফরমালিন মুক্ত।
নেতার মুখ উজ্জ্বল হয়ে যায়।
— বাহ, সত্যি! গ্রামের সোঁদা মাটির স্বাদ, সে তো অমৃত… পদ্মার ইলিশ, আর বাংলার কুমড়ো, কি অসাধারণ গাঁটবন্ধন! নিয়ে এসো ভাই, নিয়ে এসো।
— নেতা, আমি কুমড়া নিয়ে আসার আগে কিন্তু আপনি ইলিশ খাবেন না।
সবাই হায় হায় করে ওঠে, নেতা ইলিশ খাবেনা একটা পাতি কর্মীর জন্য। তবে উত্তম কুমার সকলকে থামিয়ে দেয়। সে কুমড়ো আসার আগ অব্দি ইলিশ খাবে না।
লাদেন রাতের গাড়ি ধরেই গ্রামে চলে যায়। সারাদিন রাস্তা ব্লক, রাতের গাড়িই ভরসা, যার কারণে অসম্ভব ভিড়। অনেকটা ঝুলে ঝুলেই যেতে হয় তাকে। সাত ঘন্টার ধাক্কা, পা ব্যথা তো আছেই, মানুষ পা মাড়িয়েও দিল বেশ কয়েকবার। গ্রামে পৌঁছে সকালে বেরিয়ে গেল কুমড়ার খোঁজে। বাজারে কুমড়ো দেখা গেল না, বলল আর কয়দিন পর উঠবে। সব জায়গা খুঁজে দুপুর নাগাদ বাড়ি ফিরল। সারাদিন ঘুরে যা বুঝল ঢাকায় কি হচ্ছে তার প্রভাব এখনো গ্রাম অব্দি আসেনি। যাই হোক, দুপুরে ভাত খেতে খেতে তার মনে পড়ে মনসুর কাকার কথা। মনসুর কাকার বাড়ির পেছনে একটু জমি আছে, যেখানে তিনি নিজের মত করে শাকসবজি লাগান। শখের সবজি বাগান আর কি। বিকেলের দিকে হাঁটতে হাঁটতে লাদেন সেখানে চলে যায়। মনসুর কাকা সব শুনে জানান, মিষ্টি কুমড়া তিনি দিতে পারবেন বৈকি। তবে অন্তত ১২ থেকে ১৫ দিন তাকে সময় দিতে হবে।
— এতদিন!
— দেখো বাবা, মিষ্টিকুমড়ার বীজ বোনার সময় গেলো মার্চে। ফসল তুলতে অন্তত ৮০ দিন সময় তো দিতে হইব। নইলে কুমড়া ভালো হয়না।
লাদেন সময় দিল। ভালো মিষ্টি কুমড়া নিতে হলে একটু তো অপেক্ষা করতেই হবে। সে তার পুরনো নেতার সাথে দেখা করতে যায়। নেতা ঢাকার ব্যাপারে শুনেছে, আরও জানতে চায়। লাদেন উত্তম কুমারের ভাত টেপা নকল করে দেখায়। নেতা খুশি হয়। তার আশেপাশের কর্মীরা খুশি হয়। সব ঠিক আছে, সব আন্ডার কন্ট্রোল।
লাদেন প্রতিদিন মনসুর কাকার কাছে যায়। মিষ্টি কুমড়া দেখে, অন্যান্য সবজি দেখে। মাঝেমধ্যে সাহায্যও করে, পানি দিতে, মাটি খুড়তে। ভালোই লাগে তার। কয়দিন যায়, তার ফোনে কল আসে একদিন, কি যেন করতে হবে রাতে, চারিদিকে চিৎকার, চেনা স্লোগান, একশন একশন। নেটওয়ার্ক সমস্যার কারণে কথা শুনতে পায় না পুরোটা, কিন্তু এসএমএসে জানিয়ে দেয় যে উত্তম কুমারের বিশেষ কাজের দায়িত্ব নিয়ে সে গ্রামে এসেছে। আরও কিছুদিন যায়। দেশ নাকি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, সব বন্ধ। লাদেন অবাক হয়। এতদূর যাচ্ছে কেন ঝামেলা। তবে ভরসা রাখতে হবে, সবই দমনযোগ্য।
মাসের শেষের দিকে মিষ্টি কুমড়ায় পাক ধরলো। ততদিনে ঢাকা ঢোকার পথ বন্ধ, কারফিউ। লাদেনের আর কোনো উপায় রইল না। উত্তম কুমারের জন্য তার মনটা খারাপ হয়ে গেল। লোকটার ইলিশ মাছ খাওয়া হলো না। খবরও দিতে পারেনি, যতদিন ফোন দিয়েছে ফোনটা বন্ধ। আশেপাশের কর্মীদেরও হদিস নেই।
কয়েকদিন পর ঢাকা ঢোকার একটা উপায় পায় সে। মনসুর কাকা বলে সবাই নাকি লংমার্চ করে ঢাকা যাচ্ছে।
– সবাই?
– আরে না। ছেলেছোকরাগুলো।
– কেন?
– জানি না। সমাবেশ শুনেছি। ঢাকার অবস্থা ভালো না। সবাই নাকি খুব ক্ষেপে আছে। সরকারের হাতে আর কিছু নেই।
এ আবার কেমন কথা। লাদেনের ঘরে টিভি নেই, আর মানুষের বাড়ি যাওয়ার তার অভ্যাস নেই। আর এই কয়দিন সে মিষ্টি কুমড়া নিয়েই বেশি ব্যস্ত ছিল। আর বাজারের টিভিতে তো খবর দেখেছে সে কয়েকদিন আগে। কারফিউর খবর, ভাঙচুর, আগুন…. সরকার তো এসবে দমার কথা নয়। হচ্ছেটা কি আসলে!
লংমার্চের দিন লাদেন ঢাকায় গিয়ে নামে, হাতে একটা বিশাল মিষ্টিকুমড়া, শক্ত বোঁটা, মেটে রঙ, সম্পূর্ণ ফরমালিন মুক্ত। বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবার উপায় নেই, আসার পথে বাসেই সে জেনেছে যা জানার। এখন কোনোমতে উত্তম কুমারের কাছে পৌঁছাতে পারলেই হলো। উনিই তো অভিভাবক, এই সংকটের সময়ে কর্মীদের দায়িত্ব তো ওনারই। কোনোমতে ভিড় ঠেলে কিছুটা হেঁটে, কিছুটা রিকশায় উত্তম কুমারের বাসা অব্দি যায় সে। গিয়ে দেখে বাসার নিচে ভিড়, সিঁড়িতেও মানুষ, গুঞ্জন ভেসে আসছে, পালিয়েছে, নেতা পালিয়েছে, উত্তম কুমার পালিয়েছে।
লাদেনের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। সে বুঝতে পারে না এর মানে কি। তারা তো একজন নয়, এত এত কর্মী, এত স্লোগান, এত ত্যাগ, পৃথিবী একদিকে রেখে বছরের পর বছর ধরে যে জুতো পরিস্কার রেখেছে, সে তো সেই জুতো পায়ে কর্মীদের পথ দেখাতে, পালিয়ে যেতে নয়।
এক বুড়ো রিকশাওয়ালা তার ঘোর ভাঙায়।
– কী হইছে মামা?
– হ্যা? না, নেতা নাকি পালাইছে।
– নেতার ট্যাকা আছে, পলানের জায়গা আছে, নেতা পলাইছে। আপনের থাকলে আপনিও পলান। আর পলানের মত না হইলে ওইযে ভিড় যাইতাছে, মিশ্যা যান। ভিড়ের লগে যান গিয়া। সবাই নেতা হইব না, কারো কারো হইতে হইব ভিড়।
লাদেন তাকিয়ে থাকে, তারপর ভিড়ের মধ্যে মিশে যায়। ভিড়ের সাথে হেঁটে চলে আসে বহুদূর, সকলের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে। মানুষ দৌড়ে ঢুকে যায় বাড়ির ভেতর, যা পারে নিয়ে আসে ; শাড়ি, ব্যাগ, খাবার, ফুল, পাতা যে যা পায়। এক লোক বেড়িয়ে আসে গোটা দুই ইলিশ মাছ নিয়ে, লাদেন তাকিয়ে থাকে। হতাশায় তার চোখ জ্বালা করে ওঠে। সবুজ ঘাসের লনের ওপর হাতে মিষ্টিকুমড়া নিয়ে বিষন্ন সে দাঁড়িয়েই থাকে। কখন যেন একটা ফটোগ্রাফার এসে ছবিও তুলে নিয়ে যায়।
পরেরদিন সকালের কাগজে সেই ছবিটা ছাপা হয় — সাথে লেখা “গণ লুটপাটের মধ্যে কেবল একটা মিষ্টিকুমড়া পেয়ে মন খারাপ করেন একজন সাধারণ জনতা।”