মনের আয়না
আইকো একজন তরুণ সন্ন্যাসী। তিনি জাপানের পাহাড়ি একটি মন্দিরে থাকতেন। পাহাড়ের নিস্তব্ধতায় তার দিন কাটত ধ্যান আর মন্দির পরিষ্কার করে।
আইকো সবসময় কিছু না কিছু ভাবতেন। “পৃথিবীটা এত রহস্যময় কেন? আমার জীবনের মানে কী? আমি কে?”—এসব প্রশ্ন তার মনে ঘুরপাক খেত। তার ধারণা ছিল, এই প্রশ্নের উত্তর একদিন ধ্যানে পেয়ে যাবেন।
একদিন সকালে তিনি মন্দির পরিষ্কার করছিলেন। ঝাড়ু দিতে দিতে একটি পুরোনো আয়না খুঁজে পেলেন। আয়নাটি ধুলো মাখা ছিল। তিনি ধুলো মুছে পরিষ্কার করলেন।
হঠাৎই আয়নায় নিজের মুখ দেখে থমকে গেলেন। প্রথমে সাধারণ মনে হলো। কিন্তু একটু পরেই তার মনে হলো, এই আয়নায় শুধু তার মুখ নয়, যেন তার মনের কথাও ফুটে উঠছে।
তিনি বসে পরলেন। আয়নার সামনে নিজেকে পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করলেন।
একবার হেসে দেখলেন। আয়নায় হাসিমুখ প্রতিফলিত হলো।
একবার রাগ করে দেখলেন। আয়নায় তার রাগি মুখ ফুটে উঠল।
একবার কেঁদে দেখলেন। আয়নায় দেখা গেল, এক বিষণ্ণ মানুষ।
তারপর ভয় পেয়ে তাকালেন। আয়না তাকে এক ভীতসন্ত্রস্ত মানুষ হিসেবে দেখাল।
আইকো অবাক হলেন। তিনি বুঝলেন, তার মুখের পরিবর্তন তার চিন্তা আর আবেগের কারণে হচ্ছে।
তিনি নিজেকে প্রশ্ন করলেন, “আমার মনের চিন্তা যদি আমার মুখ বদলে দিতে পারে, তাহলে কি আমার জীবনও বদলাতে পারে? আমার মনই কি আমার জীবন নিয়ন্ত্রণ করছে?”
এই প্রশ্ন তার ভেতরে গভীরভাবে কাজ করতে শুরু করল। সেদিন থেকেই তিনি ধ্যানের একটি নতুন পদ্ধতি শুরু করলেন। এবার শুধু নিজের চিন্তাগুলোকে বোঝার চেষ্টা করতে লাগলেন।
প্রথমে কাজটা খুব কঠিন লাগল। তার মাথায় নানা রকম চিন্তা আসত। পুরোনো স্মৃতি, ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তা, ছোট ছোট ভয় সব কিছু একসাথে ভিড় করত।
কিন্তু ধীরে ধীরে তিনি শিখলেন কীভাবে নিজের মনের দিকে গভীরভাবে তাকাতে হয়। তিনি শ্বাস-প্রশ্বাসের প্রতি মনোযোগ দিলেন। তার শরীরের প্রতিটি অনুভূতি বুঝতে চেষ্টা করলেন।
সময় গড়িয়ে গেল। একদিন তিনি বুঝতে পারলেন, তার মন আগের চেয়ে অনেক বেশি শান্ত। তার চিন্তাগুলো আর তাকে নিয়ন্ত্রণ করে না। বরং তিনি তার চিন্তাগুলোকে পর্যবেক্ষণ করতে পারেন।
তখন তার মনে হলো, “আমার মনই আমার জীবনের আয়না। যদি আমি মনের শান্তি আনতে পারি, তাহলে আমার জীবনও শান্ত হবে। এই আয়না আমাকে নিজের সত্তাকে বোঝার পথ দেখাচ্ছে।”
এরপর তিনি তার এই জ্ঞান অন্যদের সঙ্গে ভাগ করতে শুরু করলেন। যারা তার কাছে পরামর্শ চাইতে আসত, তাদের বলতেন, “নিজের মনের দিকে তাকাও। নিজের চিন্তা আর আবেগগুলোকে বোঝো। তুমি যদি নিজের মন শান্ত করতে পারো, তোমার জীবনও শান্ত হবে।”
মঠের অন্যান্য সন্ন্যাসীরাও তার এই অন্তর্দৃষ্টি থেকে উপকৃত হতে শুরু করে। তারা শিখে যে মন আর জীবন একে অপরের প্রতিচ্ছবি।
আইকো নিজের মনের আয়না দেখেই জীবন কাটিয়ে দিলেন। তিনি জানতেন, মনের শান্তি মানেই জীবনের শান্তি। তার এই জ্ঞান অনেক মানুষের জীবন বদলে দিল।
পুকুর আর নুড়ি পাথর
জাপানের এক ছোট গ্রামে দাইচি নামে এক বৃদ্ধ সন্ন্যাসী বাস করতেন। তিনি মানুষকে জীবন নিয়ে দীক্ষা দান করতেন। তিনি বলতেন, “সব কিছু বদলায়। কিছুই চিরস্থায়ী নয়।”
একদিন হিরো নামে এক যুবক তার কাছে এল। তার মুখে বিষণ্ণতা। সে বলল, “আমি আমার বাবাকে হারিয়েছি কিছুদিন আগেই। আমার মন এখন ভীষণ অস্থির। কিছুতেই শান্তি পাচ্ছি না।”
দাইচি বললেন, “চলো, তোমাকে কিছু দেখাই।”
তারা মন্দিরের পুকুরের কাছে গেল। দাইচি মাটি থেকে একটা ছোট নুড়ি পাথর তুললেন। বললেন, “আমাদের জীবন এই নুড়ির মতো। শক্ত, মজবুত কিন্তু অস্থায়ী।”
তারপর তিনি নুড়ি পাথরটি পুকুরে ছুঁড়ে ফেললেন। পুকুরের পানিতে জলতরঙ্গ তৈরি হয়। ছোট ছোট ঢেউগুলো ছড়িয়ে পরল। কিছুক্ষণ পরে সব মিলিয়ে গেল। পুকুর আবার শান্ত হয়ে গেল।
হিরো চুপচাপ দেখছিল। সে বলল, “গুরুজী, আমার জীবনের অস্থিরতাগুলো কি এভাবেই চলে যাবে?”
দাইচি মাথা নেড়ে বললেন, “হ্যাঁ, যেমন এই ঢেউ মিলিয়ে গেল, তোমার অস্থিরতাও একদিন শান্ত হয়ে যাবে। সময়ই সবকিছুকে বদলে দেয়।”
হিরো আবার জিজ্ঞেস করল, “তাহলে আমাদের জীবন কি ঢেউয়ের মতোই? অস্থায়ী আর গুরুত্বহীন?”
দাইচি হেসে বললেন, “না, তা নয়। দেখো, ছোট্ট নুড়ি পুকুরে ঢেউ তুলেছে। ঠিক তেমনই আমাদের জীবনও চারপাশে প্রভাব ফেলে। আমরা সাময়িক কিন্তু আমাদের কাজ দীর্ঘস্থায়ী।”
হিরো গভীর চিন্তায় পড়ল। সে বুঝতে পারল, জীবনের শূন্যতা আর অস্থিরতা যেমন সত্যি, তেমনই আমাদের কাজের প্রভাবও সত্য।
দাইচি বললেন, “জীবন নুড়ির মতো। অস্থায়ী, কিন্তু সম্ভাবনায় ভরা। সময়কে কাজে লাগাও। এমন কিছু করো, যাতে পৃথিবীতে ভালো কিছু রেখে যেতে পারো।”
হিরো ধীরে ধীরে মাথা নত করল। তার মন শান্ত হলো। সে বুঝল, জীবন শুধু দুঃখ আর অস্থিরতা নয়। এতে সম্ভাবনারও শেষ নেই।
বাঁশ বন
উঁচু পর্বতমালার পাদদেশে একটি গ্রাম। গ্রামের পাশেই ছিল একটি ঘন বাঁশ বন। বনটি গ্রামবাসীর কাছে ছিল শান্তির প্রতীক। সেখানে তারা প্রায়ই যেতেন। কেউ ধ্যান করতেন আবার কেউ শুধু বসে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতেন।
একদিন বিকেলে আকাশ কালো হয়ে এলো। বাতাস শুরু হলো, তারপর মুষলধারে বৃষ্টি। ঝড় এতটাই ভয়ানক ছিল যে বাঁশের বন যেন কাঁপতে কাঁপতে আর্তনাদ করছিল।
ঝড় একটা সময় থামল। গ্রামবাসীরা বেরিয়ে এলেন। তাদের চোখে ধ্বংসের চিত্র। বাঁশের বন যেন একেবারে মাটিতে মিশে গেছে। ভাঙা গাছ, ছড়িয়ে থাকা পাতা আর শিকড়ের ধ্বংসাবশেষ।
গ্রামবাসীরা শোকাহত, তাদের প্রিয় বন যে শেষ।
কিন্তু হিরো গ্রামের প্রবীণ সন্ন্যাসী, অন্যভাবে বিষয়টি দেখলেন। তিনি বললেন, “বাঁশ কখনো হারে না। এটি মাটির নিচে শক্তি সঞ্চয় করে আবার উঠে দাঁড়ায়। আমাদের একটু ধৈর্য ধরতে হবে।”
হিরো গ্রামবাসীদের নিয়ে কাজে নেমে পড়লেন। সবাই মিলে বন পরিষ্কার করতে শুরু করলেন। মাটি প্রস্তুত হলো। সার দেওয়া হলো। নতুন করে শিকড় লাগানো হলো।
মাসের পর মাস চলে গেল। কেউ কেউ হতাশ হয়ে পড়ল। “কিছুই হচ্ছে না,” বলল একজন।
হিরো শান্ত স্বরে উত্তর দিলেন, “বাঁশ ধীরে ধীরে শুরু করে। একটু সময় দাও।”
একদিন সকালে মাটির ওপর ছোট্ট সবুজ অঙ্কুর দেখা দিল। এক টুকরো বাঁশ। গ্রামবাসীরা দৌড়ে এসে দেখল। সবার মুখে হাসি।
ধীরে ধীরে বাঁশেরা মাথা তুলে দাঁড়াতে শুরু করল। প্রথমে ধীরগতিতে, তারপর দ্রুত। কয়েক বছরের মধ্যেই পুরো বন আবার গড়ে উঠল। আগের চেয়ে লম্বা, শক্তিশালী আর সুন্দর।
গ্রামবাসীরা বিস্মিত হলেন। তারা বুঝতে পারলেন, বাঁশ শুধু একটি গাছ নয়। এটি জীবনের এক বড় শিক্ষা।
হিরো বললেন, “দেখলে? বাঁশ হারতে জানে না। এটি পড়ে, আবার উঠে দাঁড়ায়। আমরাও বাঁশের মতো। প্রতিকূলতা আসবেই, কিন্তু আমরা যদি স্থিতিশীল থাকি, তাহলে আগের চেয়ে আরও শক্তিশালী হয়ে ফিরতে পারব।”
গ্রামবাসীরা মাথা নত করল। তারা শিখল, জীবনের ঝড় যত বড়ই হোক, যদি ধৈর্য আর বিশ্বাস থাকে, তাহলে আবার নতুন করে শুরু করা যায়। বাঁশের বন তাদের জীবন বদলে দিল।