মা হওয়ার দুঃখ II অরবিন্দ রাজখোয়া, অসমিয়া থেকে অনুবাদ: বাসুদেব দাস

‘ম্যাডাম,আপনাকে কথাগুলো বলতে আমার খুব খারাপ লাগছে। কিন্তু আপনি একজন শিক্ষিতা এবং ধৈর্যশীলা মহিলা। আপনার ওপর আমাদের বিশ্বাস আছে। তাই বলছি এবং….দি ভিকটিম মে বি ইয়োর অনলি সন দীপক….’

পুলিশ অফিসারটি ভেবেছিলেন সেই খবর শোনার পরে মহিলাটি মুখ খুলে কিছু একটা বলতে চেয়েও বলতে পারবে না বা চিৎকার করে করে তাকে গালিগালাজ করবে বা জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে। কিন্তু তার ভাবা অনুসারে কিছুই ঘটল না। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় পুষ্ট অফিসারটি দেখলেন মহিলাটির মুখে কোনো ধরনের ভাবান্তর ঘটল না।মুহূর্তের জন্য চোখের কোণদুটি জ্বলে উঠল যদিও মহিলাটি খুব সহজেই তা সামলে নিল। যেরকম আশা করেছিলেন সেরকম কিছু না ঘটায় পুলিশ অফিসারটি অবাক হলেন। অসনাক্ত মৃতদেহ আবিষ্কার হলেই কত পুত্রহারা মা কাঁদতে কাঁদতে পাগলের মতো দৌঁড়ে আসে মৃতদেহের কাছে। চার বছর আগে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়া সোনাই কি এই ছেলেটি? দুই বছর আগে কিছু অপরিচিত লোক রাতের বেলা ঘুম থেকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া ছেলেটিই কি এই ছেলেটি? তন্ন তন্ন করে দেখতে চায়। সেই সমস্ত মায়েরা কাঁদতে কাঁদতে ফিরে যায়। চাকরি জীবনে সেই সমস্ত দৃশ্যের সঙ্গে অফিসারটিকে বহুবার মুখোমুখি হতে হয়েছে। সেইজন্যই তিনি এই মহিলাটির ব্যবহারে অবাক হতে বাধ্য হয়েছেন।

মহিলাটি পুলিশ অফিসারের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছেন। মহিলাটির পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা দুজন মহিলা চোখের জল মুচছে। তাদের মধ্যে একজন মহিলাটির কাছাকাছি চলে এসেছে। পুলিশ অফিসারটির মতো তিনিও হয়তো মহিলাটি জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটোপুটি খাবেন বলে ভেবেছিলেন। কিন্তু সে সবের কিছুই হল না।
মহিলাটি কাঁদলও না মূর্ছাও গেল না। তার পরিবর্তে পুলিশ অফিসারের দিকে তাকিয়ে বললেন-‘মে বি মানে?’

পুলিশ অফিসারটি থতমত খেলেন।‘অনুমানের ভিত্তিতে নয় কি?’ মহিলাটি নিজেই উত্তর দিলেন।

ম্যাডাম ডেডবডিটার শরীরে যতটুকু পোশাক রয়েছে, মানে প্যান্ট,শার্ট,জুতো এই সমস্ত দেখে দীপকের ঘনিষ্ট মানুষরাই দীপক বলেই সনাক্ত করেছে। কিন্তু মুখ দেখে শনাক্ত করার মতো মাথাটাই তো নেই। হত্যাকারী কেটে নিয়ে গেছে।

‘দাঁড়ান’। অফিসারটিকে কথা শেষ করতে না দিয়ে মহিলাটি বলে উঠলেন-‘আপনি জানেন কি আপনি মানব অধিকার খর্ব করেছেন? একটা মৃতদেহকে শনাক্তকরণ ছাড়াই একজন মায়ের বুকে আপনি আগুন জ্বালাতে এসেছেন। এই অধিকার আপনাকে কে দিয়েছে?’

‘তার জন্য আমি দুঃখিত ম্যাডাম। আমি আমার কর্তব্য করেছি। যেহেতু মৃতদেহ প্রত্যক্ষ করা প্রত্যেকেই দেহটি দীপক আকাশের মৃতদেহ বলে দাবি করেছে,যেহেতু মা অর্থাৎ আপনি ছাড়া দীপকের অন্য কোনো আপনজন নেই তাই নিতান্ত প্রয়োজনের খাতিরে অনিচ্ছা সত্ত্বেও আপনাকে এই দুঃখটুকু দিতে বাধ্য হয়েছি। ম্যাডাম আপনার ধৈর্য্যশক্তির প্রশংসা করছি। এখন আপনি যদি দয়া করে কিছুক্ষণের জন্য থানায় এসে মৃতদেহটাকে শনাক্ত করতে আপনি সাহায্য করেন….’

আমি কীভাবে শনাক্ত করব? মাথাটা থাকলে তো আপনারাও শনাক্ত করতে পারতেন….’

এবার মহিলাটির কণ্ঠস্বর বেড়ে গেল। না মানে ম্যাডাম,দীপক আকাশের শরীরে যদি কোনো বিশেষ চিহ্ন থেকে থাকে তাহলে মা হিসেবে একমাত্র আপনিই তা জানতে পারেন,সেভাবেও মৃতদেহটির শনাক্তকরণ হতে পারে

‘আচ্ছা,একথা। তাহলে তো আমি না গেলেও চলবে।

‘মানে বিশেষ কোনো….?

‘শুনুন আমি বলছি। ওর দুই উরুর সন্ধিস্থলে অশ্বত্থ পাতার মতো একটা বড় কালো দাগ আছে। লোকেরা যাকে কালো তুলসী বলে। বেশিরভাগ বাঁ উরুতে আর ডান উরুতে কম রয়েছে। নাভির এক আংগুল ওপরে তিলের মতো ছোট একটা মাংসপিণ্ড রয়েছে। যাকে আমরা তিল বলি।…. হবে তো?’

ধন্যবাদ ম্যাডাম।….ধন্যবাদ। কিন্তু আপনার হয়ে কোনো একজন আত্মীয় আমাদের সংগে যেতে হবে যিনি এই প্রমাণগুলি প্রত্যক্ষ করে মৃতদেহটা দীপক আকাশের বলে নিয়মানুসারে শনাক্ত করবে,যাতে আমরা বিভাগীয় কাজটুকু সমাধা করে ডেডবডিটা ওয়ারিশদের হাতে তুলে দিতে পারি।

পুলিশ অফিসারটি বলল। মহিলাটি পেছনে দাঁড়িয়ে ফোঁপাতে থাকা একজন মহিলাকে বললেন –‘মাইনুর মা নীলু কি অফিস গেছে?

‘যায় নি বোধহয়। পুলিশকে দেখে ওই আমাকে পাঠিয়েছে। ও তখন শেভ করছিল।‘

‘তাহলে ওকেই পাঠিয়ে দে।

তারপর অফিসারের দিকে তাকিয়ে বললেন—‘নীলু ইনকাম ট্যাক্স অফিসে কাজ করে। নীলু বরুয়া। চেনেন বোধ হয়….’

‘ওকে চিনি। উনি গেলেই হবে। আচ্ছা,আমরা আসছি।আপনাকে সকাল সকাল বিরক্ত করলাম

মহিলা কিছু বললেন না। পুলিশের টিমটা গিয়ে পদুলিতে রাখা জিপে উঠল। নীলু জিপে উঠল। উঠার আগে নীলু একবার সহানুভূতি আর সান্ত্বনার দৃষ্টিতে মহিলার দিকে ঘুরে তাকাল। সান্ত্বনার দ্বারা কেউ কি আর কাউকে শান্তি দিতে পারে!জিপটা ধুলো উড়িয়ে চলে গেল। মহিলাটি ভেতরে চলে গেলেন। বাঁ হাতের তালুতে নিজের বুকটা চেপে ধরে জোরে নিঃশ্বাস নিলেন। ব্যথাটা অনেকটা কমেছে।

অদ্ভুত ধরনের ব্যথা। ব্যথাটা প্রথমে বুকে আরম্ভ হয়। একটু একটু করে বাড়তে থাকে। তারপর মাথায় ছড়িয়ে পড়ে। মাথা ঝিমঝিম করতে শুরু করে। ভারী হয়ে পড়ে। কপালটা কুঁচকে ভুরু দুটোর ওপর স্তূপীকৃত হতে চায়। একটা সময়ে ব্যথাটা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। পা দুটো কাঁপতে থাকে। মানুষটার দাঁড়িয়ে থাকার মতো শক্তি থাকে না। তৃষ্ণায় গলাটা শুকিয়ে যায় বলে মনে হয়। কিন্তু খুব বেশি জল খেতে পারেন না।

দীর্ঘদিন ধরে মানুষটা এই ব্যথায় ভুগছেন। কখনও সাময়িকভাবে ব্যথাটা কমে। তখন খুব ভালো লাগে।আরোগ্য লাভ করেছেন বলে মনে হয়। মনে হয় ভবিষ্যতে বোধহয় ব্যথাটা আর কখনও হবে না। কিন্তু ব্যথাটা ভুলতে না ভুলতেই পুনরায় শুরু হয়ে যায়। আরম্ভ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই চিরাচরিত যন্ত্রণা। বুকে শুরু হয়ে সর্বশরীরে ছড়িয়ে পড়ে।

হ্যাঁ,আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে ব্যথাটা শুরু হয়েছিল।মানুষটার বয়স এখন পঞ্চাশের গন্ডি অতিক্রম করে তিন চার বছর বেশি হয়েছে। ব্যথাটা যখন আরম্ভ হয় তখন সম্ভবত বয়সটা ত্রিশের কাছাকাছি ছিল। এই সুদীর্ঘকাল ধরে বুকের ব্যথাটা সঙ্গে করে নিয়ে বেড়াচ্ছে।

‘কী হল দিদি,বৌ কি কেবল টাকা পয়সা খরচ করার জন্য এনেছেন?

‘সে তো বাড়িতে থাকেই না

‘কী বলছ হে? প্রতি মাসে টাকা রোজগার করে আনছে।

‘টাকা রোজগার করলে কি হবে। তার হাতেই ঘরের দায়িত্ব এখন।

মানুষটা স্কুল থেকে ফিরে এসেছিল। রান্নাঘরের ভেতর শাশুড়ি আর একজন প্রতিবেশীর কথা-বার্তা শুনে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াতে গিয়েও থেমে গিয়েছিল। বিএসসি পাশ করার এক বছর পরে সে চাকরিটা পেয়েছিল। কারোকে ধরাধরি না করেই চাকরিটা পেয়েছিল। সেইবছর এমই স্কুলগুলিতে সরকার গ্রাজুয়েট বিজ্ঞান শিক্ষকদের চাকরি দেবার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল। চাকরির অনুপাতে প্রার্থীর সংখ্যা কম ছিল।

চাকরি পাওয়ার এক বছর পরে সেই মানুষটার সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছিল। তার চেয়ে বয়সে যথেষ্ট বড় হলেও মানুষটাকে তার অপছন্দ ছিল না। ব্যবসায়ী মানুষ। মা আর ছেলে। দুটো বোন ছিল। কবেই তারা নিজের নিজের সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।

মানুষটা খুব স্নেহশীল ছিলেন। শাশুড়িও প্রথম প্রথম ভালোবাসতেন। শিক্ষিতা এবং উপার্জনক্ষম বধু পেয়ে নিজেদের ধন্য মনে করেছিলেন। সংসারে বধুর চাকরি করার কোনো প্রয়োজন ছিল না যদিও তার স্বামী তাকে কোনোদিন বাধা দেয় নি। দুটো বছর হাসি স্ফুর্তির মধ্য দিয়ে কেটে গিয়েছিল। তিন বছর,চার বছর পার হয়ে গেল। সেও কিছু একটার অভাব অনুভব করছিল। সেই অভাব পূর্ণ করার জন্য তার একার চেষ্টা যথেষ্ট নয়।অভাব পূর্ণ করার জন্য ও হয়তো কিছু একটার অভাব ছিল। তাই স্বামীকে খোলাখুলিভাবে কথাটা বলতে পারে নি। ম্বামী হয়তো বুঝতে পারেনি বা বুঝেও না বোঝার ভান করে চলেছিল। কিন্তু ব্যাপারটা শাশুড়ি ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি তাঁর নিজস্ব ভঙ্গিতে সেটা প্রকাশ করেছিলেন। শাশুড়ির তার প্রতি ব্যবহার এবং কথা বার্তায় ফুটে উঠেছিল বিদ্রূপ আর ঘৃণা। ক্রমশ তা বেড়েই চলছিল। সেও সেইসব না বোঝার ভান করে চলছিল। আর,সেদিন স্কুল থেকে ফিরে এসে বারান্দায় পা রাখতেই কিছু কথা তার কানে আসায় সে থমকে দাঁড়িয়েছিল। বুকের মধ্যে কী যেন একটা ধাক্কা মেরেছিল। শাশুড়ির কটূক্তি এবং নিজে অনুভব করতে থাকা অভাববোধটা, দুটো মিলে বুকের ভেতরে একটা অপরিচিত ব্যথার জন্ম দিয়েছিল। মাথাটা কেমন যেন ঘুরছিল। পা দুটো যেন শরীরের ভার বহন করতে পারছিল না। সমস্ত শরীর পুড়ে যাচ্ছিল। টলমল পায়ে সে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়েছিল। সেই শুরু। সেই ব্যথা বুকে নিয়েই মানুষটা আরও দুটো বছর পার করেছিল। শাশুড়ি ছেলেকে পুনরায় বিয়ে করার জন্য চাপ দিচ্ছিল। ছেলে সে কথায় কান দেয়নি। বুড়ি অন্যের মাধ্যমে ছেলের ওপর চাপ সৃষ্টি করছিল।

একদিন সে বুঝতে পারল তার ব্যথাটা কমেছে। নিজের ওপর নির্ভর না করে সে ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল।ডাক্তারও তাকে নিশ্চিন্ত করেছিল। বিয়ের ছয় বছর পরে সে মা হতে চলেছিল।

শাশুড়ির মধ্যে ভীষণ পরিবর্তন দেখা গিয়েছিল। আদর যত্নে ভরিয়ে তুলেছিল তাকে। বংশরক্ষার জন্য আগমন হওয়া ‘পুরুষ’টির শাশুড়ি নিজে নামকরণ করেছিল।দীপক। কুলের দীপক। সে নামের সঙ্গে আকাশ শব্দটি জুড়ে দিয়েছিল। শিশুটির আগমন তাকে মাথা তুলে উপরের দিকে তাকানোর শক্তি জুগিয়েছিল। তাই আকাশ।দীপক আকাশ নামে ছেলে ধীরে ধীরে বড় হচ্ছিল।

একদিন শাশুড়ি মারা গেলেন। যাবার আগের মুহূর্তে শীর্ণ হাত দুটো তার মাথায় রেখে আশীর্বাদ করে গেলেন। দীপক আকাশ যে বছর স্কুল ফাইন্যাল দেবার কথা সে বছর উচ্চ রক্তচাপে ভুগতে থাকা স্বামীও আকস্মিকভাবে মারা গেলেন।

মানুষটা বড় শক্ত হাতে সেই সব পরিস্থিতি সামলে নিলেন। তার প্রতি মানুষের সহানুভূতি থাকতে থাকতে মানুষটা যতটুকু প্রয়োজন তা করে নিলেন। শহরের মাঝখানে থাকা দোকানটা বিক্রি করে দিলেন। ভাড়াঘরের কাগজপত্রগুলিও নিজের নামে করে নিলেন। এলআইসি,ফিক্সড ডিপোজিট,ক্যাশ ডিপোজিট ইত্যাদির ক্ষেত্রে কোনো অসুবিধা নেই বলে রিনিউ করে নিলেন। তার নিজের চাকরি তো রয়েছেই। তার একটাই মাত্র লক্ষ্য- দীপক আকাশকে মানুষ করে তুলতে হবে।

শহরের এপারে তাদের ঘর,ওপারে কলেজ। কিন্তু দীপকের কলেজে যাবার জন্য নাকি বাইক চাই। অনেক ভাবে বোঝানো সত্ত্বেও সে তার জিদ থেকে সরে এল না। তার নতুন মোটর সাইকেলের মিহি ঢপ ঢপ শব্দ তার বুকের ভেতরেও একটা ধপ ধপ শব্দ সৃষ্টি করল। সে অনেক যত্ন করে শব্দটাকে অস্বীকার করতে চেয়েছিল। নানা অজুহাত দেখিয়ে তাকে এদিকে ওদিকে ঘুরে বেড়াতে হল। বন্ধুর সংখ্যা বেড়ে চলল। একদিন ঘরভাড়ার টাকা আনতে গিয়ে মানুষটা জানতে পারল যে দীপক ইতিমধ্যে টাকা তুলে নিয়েছে।

‘ভাড়াঘরের দায়িত্বটা আমাকে দিয়ে দাও মা। আমারও তো হাতখরচের প্রয়োজন হয়।‘

মানুষটা ছেলেকে অনেক বুঝিয়েছিল। একটা ফুলদানি মেঝেতে আছড়ে ফেলে দীপক বেরিয়ে গিয়েছিল। বংশের কথা ভেবে তবু মানুষটা ছেলেকে মানুষ করার জন্য চেষ্টা চালিয়েছিল।

‘খুড়ি,দীপক একজন মানুষকে ধাক্কা মেরেছে। পুলিশ ওকে খুঁজছে।‘

‘দিদি,দীপকদা হাসপাতালের সামনে মারপিট করেছে।

‘আপনার ছেলে দুই হাজার টাকা নিয়েছিল,দুইমাস হল আজ ও ফিরিয়ে দেয় নি।

‘প্রফেসার বরুয়ার মেয়ের সঙ্গে দীপক বাজে ব্যবহার করেছে। বাবা ওকে পুলিশে দিয়েছে।…..’

‘দিদি দীপক……’

‘না,আমাকে বলিস না। ওর কথা বলিস না। শেষের দিকে মানুষটা দীপকের কথা শুনতেই চাইতেন না। চিৎকার করে করে নিষেধ করতেন। নারী হিসেবে একটি সন্তান সেও আশা করেছিল। তাই দীপককে ভালো করার আশা সে ছেড়ে দেয় নি। থানায় টাকা ভরতে হয়েছে,ভরেছে। কারও চিকিৎসা করা দরকার,করা করেছে। কম্প্রোমাইজশনের জন্য কারও কাছে হাত জোড় করা দরকার,করেছে। কেবল মাত্র দীপক,তাঁর অনেক আশার সন্তান দীপক মানুষ হোক এটাই ছিল তাঁর একমাত্র কামনা।

সেই আশাও ধূলায় মিশে গেল। একদিন রাতে দরজা খুলে দেবার সঙ্গে সঙ্গে টলতে টলতে ভেতরে প্রবেশ করে দীপক মানুষটার শরীরের ওপর বমি করে দিল। প্রচণ্ড আক্রোশে সেদিন মানুষটা দীপককে সজোরে কয়েকটি চড় কষিয়েছিল।

সেই মুহূর্তে বুকের ভেতরের ব্যথাটা তীক্ষ্ণ হয়ে বুক থেকে মাথায় ছড়িয়ে পড়েছিল।রমাথাটা ভারী হয়ে গিয়েছিল।কপালটা কুঁচকে গিয়েছিল। পা থেকে মাথা পর্যন্ত ঝিনঝিন করছিল। টলোমলো পদক্ষেপে মানুষটা বাথরুমে ঢুকেছিল। তারপর থেকে ব্যথাটা চিরকালের সঙ্গী হয়ে পড়ল।

মায়ের চড় খেয়ে পরের দিন সকালবেলা দীপক বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। এক সপ্তাহের মধ্যে ফিরে এল না।পুনরায় এল। আবার গেল। মাঝখানে একটা তেলের ডিপোতে মারপিট করায় ছয়মাস জেলে কাটাল। একবার কোনো এক উগ্রপন্থী দলের নামে চিঠি দিয়ে টাকা আদায় করতে গিয়ে ধরা পড়ে গিয়ে ভীষণ মার খেল। কয়েকদিন হাসপাতালে পড়ে থাকতে হল। তখনও মানুষটা দেখা করতে গেল না। নীলুর ভাইয়ের হাতে টাকা দিয়ে পাঠাল।ব্যথাটা মানুষটার সঙ্গে একেবারে নাছোড়বান্দা হয়ে লেগে রইল। বুক থেকে মাথায়। মাথা থেকে পায়ে।

চারদিন হল দীপক আকাশ কোথায় আছে কেউ বলতে পারে না। মানুষটা মাথা নিচু করে স্কুলে যাওয়া আসা করছে। যার জন্য এক সময় মানুষটা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সাহস করেছিল তার জন্যই আজ তাকে মাথা নিচু করে চলাফেরা করতে হচ্ছে।

ইতিমধ্যে আশপাশ থেকে অনেক লোকজন এসে ভিড় করেছে। গাড়ি,স্কুটার যে যা পেয়েছে তা নিয়ে কিছুলোক থানায় চলে গেছে। মহিলারা মানুষটার কাছেই রয়েছে। এক ঘন্টা পরে নীলু এসে উপস্থিত হল। সংগে প্রতিবেশীদের কেউ কেউ। নীলুকে দেখে বসে থাকা অবস্থাতেই মানুষটা নীলুর দিকে তাকালেন। নীলুকে অপ্রস্তুত দেখে তিনি নিজেই জিজ্ঞেস করলেন-‘নীলু ওই কি’

নীলু মাথা নাড়ল।

‘আমার বলা চিহ্নগুলি ভালো করে দেখেছিলে?’

‘হ্যাঁ,কাকিমা। সেসব কথাতো আমিও জানি। নীলু আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে বলল। মানুষটার ব্যথা কিছুক্ষণের মধ্যেই নাই হয়ে গেল বলে মনে হল। শরীরটাও অনেক হালকা বলে মনে হতে লাগল।

——

লেখক: ১৯৮২ সনে অসমের লক্ষ্মীম্পুরে অরবিন্দ রাজখোয়ার জন্ম হয়। ডিব্রুগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অসমিয়া সাহিত্যে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ২০০৫ সনে উত্তর লক্ষ্মীমপুর মহাবিদ্যালয়ে অধ্যাপক রূপে যোগদান করেন। প্রকাশিত গল্প সংকলন  খেল পথারত কানাইকান্ত আরু অন্যান্য,অলপ নির্জনতা,কাকৈ হাবির ভূত আরু অন্যান্য কাহিনী।

অনুবাদক: ১৯৫৮ সনে অসমের নগাঁও জেলার যমুনামুখে বাসুদেব দাসের জন্ম হয়।শৈশব কেটেছে গুয়াহাটি শহরে। ১৯৮২ সনে গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়  থেকে বাংলা সাহিত্য ও ভাষা তত্ত্বে এম এ করেন। আজ পর্যন্ত অসমিয়া অনূদিত গল্পের সংখ্যা তিনশো ষাটের ও বেশি।সম্প্রতি NEINAD এর পক্ষ থেকে অসমিয়া ভাষা-সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসারের জন্য Distinguished Life Membership এর দ্বারা সম্মানিত করা হয়।

Facebook Comments

comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top