রাগসংগীতে আলোকিত ময়মনসিংহ II ড. নুরুল আনোয়ার

পৃথিবীতে দু’রকম সংগীত  শুনতে পাওয়া যায়- বিশুদ্ধ ধ্বনি শিল্প আর বাণী ও ধ্বনির যৌগিক শিল্প। দু’শ্রেণীর সংগীতেই রূপ নির্মাণ প্রকাশিত। ধ্রুপদ, খেয়াল, সেতার, সরোদ বীণা এগুলো বিশুদ্ধ ধ্বনি শিল্প এবং গজল, ঠুমরি, লালনসগীতি, পল্লীগীতি, নাগরিক ও বাংলা গান এমনি শ্রেণীর গানকে বাণী ও সুরের যৌগিক শিল্প বলা হয়ে থাকে। কোন শ্রেণী প্রাচীনতম তা বলা সহজ নয়। তবে নৃতাত্ত্বিক-সংগীতবিদদের মতে, কথা ও সুরের উৎস একই। ডঃ ফেলবার বলেছেন, “Speech and music have descended from a common origin, in a primitive language which was neither speaking nor singing but something both.”

উচ্চাংগের সংগীত  শিল্প সব দেশেই আজ বিশুদ্ধ ধ্বনি শিল্প। তবে এক এক দেশে তার রূপ ও চরিত্র ভিন্ন। কিন্তু ধ্বনিই তার একমাত্র উপাদান। শাস্ত্রীয় কন্ঠসংগীত  ও যন্ত্রসংগীতের  একমাত্র লক্ষ্য ধ্বনির সহায়তা বিশিষ্ট রূপ নির্মাণ। কথা থাকলেও সে নিতান্তই অনুগামী বা অনুসঙ্গ হিসাবে ব্যবহৃত। এক ভারতীয় সংগীত -সংস্কৃতিতে তিনটি সুস্পষ্ট উচ্চাঙ্গ বা বিশুদ্ধ সংগীত , শিষ্ট সমাজের গান এবং লোকসংগীত  বা জনসমাজের গান। বাংলাদেশ বা উপমহাদেশে উচ্চাঙ্গসংগীতে প্রচলিত নাম রাগসংগীত বা ক্লাসিকেল সংগীত ।

বাঙালি সংগীত  গুণীদের রাগসংগীত  চর্চা বা হিন্দুস্থানী রাগ আশ্রয়ে বাংলা গান কোনো বিচ্ছিন্ন প্রয়াস নয়, তার অন্তর্নিহিত যোগসূত্র রয়েছে সর্বভারতীয় অনুশীলনের সঙ্গে। বাঙ্গালির রাগসংগীত চর্চা শাস্ত্রীয় ধারার সঙ্গে অচ্ছেদ্য নয়, অন্তর্গত। অষ্টাদশ শতাব্দীর ১ম থেকে শেষার্ধ পর্যন্ত বাঙ্গালীর রাগসংগীত  চর্চার প্রয়াস দুই পন্থায় আরম্ভ হয়েছিল-ক) ভারতের পশ্চিম থেকে বাঙ্গালী সংগীতজ্ঞরা সেখানে অবস্থান করে সেখানকার কলাবদদের অধীনে শিক্ষালাভ; খ) বাংলার কোন সংগীত  সভায় পশ্চিমা গুণীর আগমনের ফলে ও জমিদার/নবাবদের আনুকূল্যে বাঙ্গালী সংগীত জ্ঞদের শিক্ষার সুযোগ।

প্রাচীন ও মধ্যযুগ থেকেই বাঙ্গালিদের সংগীত ছিল মূলত প্রবন্ধ সংগীতের  ধারা। চর্যাগীতি, গীত-গোবিন্দ, শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন, বৈষ্ণব মহাজন পদাবলী এবং বিংশ শতাব্দীর ব্রক্ষ্মসংগীত, স্বদেশীগান, রবীন্দ্র-দ্বিজেন্দ্র-রজনী-অতুল-নজরুলের গানের ধারা দেখে তাই মনে হয়। কিন্তু এসব শ্রেণীর গানকে রাগ সংগীত  বলা হয় না। কন্ঠসংগীতে ধ্রুপদ, খেয়াল এবং ধ্রুপদ ও খেয়াল অঙ্গে সেতার, বীণা, সরোদ বাদন হল রাগসংগীত । বাংলাদেশে তার সূচনাকাল অষ্ঠাদশ শতাব্দীর শেষভাগে এবং সেটির পুষ্পিত পর্যায় উনবিংশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত। এ সময়কে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নবজাগৃতির কাল হিসাবে চিহ্নিত করা হয়।

মুক্তাগাছার সুবিখ্যাত জমিদার রাজা জগৎকিশোর মহান দানবীর হিসেবে বিখ্যাত ছিলেন। সংগীত  রসেও তাঁর মন ছিল সিক্ত।বেনারস ও দিল্লির বড়ো বড়ো গাইয়ে-বাজিয়েদের এনেছেন তাঁর দরবারে। নিজেও সংগীত চর্চা করেছেন এবং বেশ কিছু হিনুদস্থানী ধ্রুপদের সংগ্রহ তিনি করতে পেরেছিলেন। রাজা জগৎকিশোরের পৃষ্ঠপোষকতা ও সংগীতপ্রীতি তখনকার অবিভক্ত ভারতে কলকাতা ও অন্যান্য বড় বড় সংগীত কেন্দ্রিক শহরের সংগীত জ্ঞদের মাধে আলোচ্য বিষয় ছিল। কলকাতার বাগানবাড়ীর সংগীত ঐতিহ্যের সাথে রাজা জগৎকিশোর বিশেষভাবে জড়িত ছিলেন। তিনি যে সকল হিন্দুস্থানী গায়ক বাদকদের মুক্তাগাছা এনেছিলেন অথবা যাঁদের তিনি আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন, তাঁদের মধ্যে কাশীর বিখ্যাত তবলা বাদক উস্তাত মৌলভীরাম মিসির, আরো আগে সরোদী আহমেদ আলী খান, রাজপুতনার বিখ্যাত নাচিয়ে মোহন প্রসাদ, বজ্রমিসির, অন্ধ তবলা বাদক নান্নু সাহাইয়া, প্রসন্নকুমার বণিক, যাদুকর আজিম খান, উস্তাত আলাউদ্দিন খাঁ, হাফিজ আলী খাঁ ও অন্যান্যরা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

মুক্তাগাছায় বেনারসের উস্তাদ মৌলভীরামের দীর্ঘকাল অবস্থান (আনুমানিক ১৯২০-১৯৪০) ময়মনসিংহের উচ্চাঙ্গ সংগীত  চর্চার ক্ষেত্রে একটি বিশেষ অধ্যায়। মৌলভীরাম কাশীর কথক ব্রাক্ষ্মণ পরিবারের বংশধর। তাঁর দাদা দীনু মিসির এবং বাবা বিহারী মিসির বংশ পরম্পরায় তবলা চর্চা করতেন। বাবা বিহারী মিসির সংগীত  চর্চা করতেন এবং সেই সঙ্গে বীণা ও অন্যান্য যন্ত্র দক্ষতার সাথে বাজাতেন। মৌলভীরাম তবলাবাদক হওয়া সত্ত্বেও বহু ধ্রুপদচর্চা ও খেয়াল আয়ত্ত করেছিলেন। তবলার অপূর্ব নৈপুণ্য দেখিয়ে জগৎকিশোরের কাছ থেকে মূল্যবান উপহার পান। তারপর পরিপক্ক বয়সে কলকাতায় ভবানীপুর সংগীত  সম্মেলনে তবলায় দক্ষতার জন্য স্বর্ণপদক পেয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। সেই পরিণত বয়সে মৌলভীরাম এলেন মুক্তাগাছায় জগৎকিশোরের দরবারে। মৌলভীরামের তবলার বোলবাণীর সংগ্রহ ছিল প্রচুর এবং সেগুলো দক্ষতার সাথে তুলে সকলকে শিখিয়ে দিতেন। কন্ঠ ও যন্ত্রসংগীতে তিনি সমান দক্ষতার সাথে তবলা সংগত করতেন। স্বভাবে মৌলভীরাম ছিলেন উৎফুল্ল এবং নম্র, গড়ন ছিল বেশ দীর্ঘ। তাঁর ছোট ভাই মুনসিরামও একজন দক্ষা সারেঙ্গীবাদক ছিলেন।

মুক্তাগাছায় মৌলভীরামের অবস্থানের সময় তবলায় ময়মনসিংহের সর্বোচ্চ প্রতিভা শ্রীবিপিনচন্দ্র রায় তবলায় তালিম পেতে থাকেন মৌলভীরামের কাছে এবং পরে তবলা বিজ্ঞানে অত্যন্ত উচ্চস্তরে পৌঁছে ছিলেন। তবলায় পান্ডিত্যের জন্য শ্রীবিপিন চিরকাল ময়মনসিংহ ও বাংলাদেশে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণীয় হয়ে আছে। শ্রীবিপিন রায়ের শিক্ষায় গড়ে উঠেন শিক্ষক শ্রীরামকৃষ্ণ কর্মকার এবং তাঁর জ্ঞাতিভাই উপেন্দ্র রায়। ময়মনসিংহের তবলাবাজিয়েদের মধ্যে এঁরা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁদের শৈল্পিক তবলাসংগত মোহিত করেনি এমন সংগীত রসিক তখন খুব কমই ছিল। রামকৃষ্ণ কর্মকার একযোগে বিপিন রায় ও মৌলভীরামের কাছ থেকে তালিম পেয়েছেন এবং উচ্চাঙ্গসংগীতের সঙ্গে তবলা সঙ্গতে তিনি অত্যন্ত উচু মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছিলেন। শ্রীঅবিনাশ সরকার এ সময় মুক্তাগাছায় চাকরি করতেন এবং তখন মৌভীরামের কাছ থেকে তবলার দুরূহ বোল-বাণী সংগ্রহ করেন। যদিও তিনি তবলা সঙ্গতে তেমন খ্যাতিঅর্জন করতে পারেননি, তবুও তবলার বোলবাণী সংগ্রহ, তবলার বিজ্ঞান ও অন্যান্য বিষয়ে গভীর জ্ঞানলাভ করেছিলেন।

রাজা জগৎকিশোরের সময় উস্তাদ আলাউদ্দিন মুক্তাগাছায় আগমন ও তাঁর সংগীত  জীবনের সবচেয়ে নাটকীয় পরিবর্তন, সংগীত  মহলে একটা বিশেষ উল্লেখযোগ্য ঘটনা। বাল্যকালে গৃহত্যাগী আলাউদ্দিন তখন আলম নামে পরিচিত ছিলেন। নুলু গোপালের কাছে দীর্ঘদিন সংগীত শিক্ষার পর তিনি কুমিল্লার শিবপুরে নিজের বাড়িতে ফিরে এলেন এবং বাবা-মার চাপে বিয়ে করলেন কিন্তু বাসর রাতে আবার গৃহত্যাগী হলেন। সংগীতের  পিপাসায় আলাউদ্দিন হিন্দুস্থানের নাম-না-জানা দেশ ঘুরে ফিরে শেষে যোগ দিলেন নিউ থিয়েটার্স অর্কেষ্ট্রা বাজনার দলে। তাড়াতাড়ি সুনামও হল অর্কেষ্ট্রা বাজিয়ে। সেই সুনাম নিয়ে আলাউদ্দিন মুক্তাগাছায় পৌঁছালেন। কর্নেট ও বেহালা বাজিয়ে জগৎকিশোরকে আকৃষ্ট করবেন এই তাঁর পণ। কেননা, জগৎকিশোর বিখ্যাত সংগীত  রসিক। এক হাতে বেহালা, পিঠে পুঁটলি। এসে দেখলেন সামনের বাগানে এক বৃদ্ধ পায়চারী করছেনে এবং আলাউদ্দিনকে দেখে বললেন, কী চাই কোত্থেকে এসেছেন? আলাউদ্দিন জগৎকিশোরের সাথে সাক্ষাতের কথা এবং বেহালা ও কর্নেট বাজানোর বাসনাটি বৃদ্ধকে জানালেন (এই বৃদ্ধই রাজা জগৎকিশোর)। বৃদ্ধ বললেন, ‘সকালেই রাজার সঙ্গে দেখা হবে’। আলাউদ্দিনকে বলা হল বিশ্রাম ও খাওয়া দাওয়া করতে। আলাউদ্দিনের চোখে ঘুম নেই। কখন রাত শেষ হবে। শেষে সকাল হল এবং দরবারে যাবার ডাক পড়ল। খুশি হয়ে আলাউদ্দিন যন্ত্র হাতে সংগীত -ঘরে ঢুকেছেন, ঠিক এমন সময় দেখলেন একজন হিন্দুস্তানী যন্ত্রী কি-একটা বাদ্যযন্ত্রে সুর মিলাচ্ছেন। আলাউদ্দিন আর কখনও এ বাদ্যযন্ত্র দেখননি। ফরাসের উপর কর্নেট ও বেহালা রেখে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন যন্ত্রের তরফ মেলানোর দিকে। যন্ত্রটা ছিল সরোদ, বাজিয়ের নাম ছিলো উস্তাদ আহমেদ আলী খাঁ এবং বাজাচ্ছিলেন টোড়ী রাগ। মুহূর্তের মধ্যে আলাউদ্দিনের কি যেন একটা ঘটে গেল সমস্ত শরীর কাঁপতে লাগল সুরের অনুরণনে। বাজানো শেষে উস্তাদ চলে যাচ্ছে। হঠাৎ আলাউদ্দিন উস্তাদের পা জড়িয়ে ধরে বললেন, আমাকে এ যন্ত্র শেখান, নইলে আমি বাঁচব না। উস্তাদ কিছুতেই রাজি নন। বিরক্তির সাথে আলাউদ্দিনের বংশ পরিচয় জিজ্ঞাসা করেন এবং চলে যেতে চাইলেন। এসবই ঘটেছিলো জগৎকিশোরের সামনে। জগৎকিশোর প্রত্যক্ষ করেছিলেন আলাউদ্দিনের সংগীত  শিক্ষার গভীর আগ্রহ, তাই হিন্দুস্তানী উস্তাদকে বললেন, ‘ওর খানদান দেখছো কেন, সংগীতের  গভীর পিপাসা দেখতে পাচ্ছো না? আমি অনুরোধ করছি তুমি শেখাও’। শেষে উস্তাদ বললেন, আপ জো বোলা হ্যায়, তাবতো শিখানাই পড়েগা।’ আলাউদ্দিন শেখার অনুমতি পেলেন। কিন্তু উস্তাদের শিষ্যত্ব গ্রহণের কোনো উপকরণ তাঁর কাছে নেই, যেমন যন্ত্র, জামা, নতুন কাপড় ইত্যাদি। রাজার বড়ো ছেলে কুমার জিতেন্দ্রকিশোরের জন্য যে সরোদটি সদ্য এনেছিলেন, শেষ সেই যন্ত্রটি আলমকে (আলাউদ্দিনকে)দেওয়া হলো, সেই সাথে বিভিন্ন পোষাকও। আলাউদ্দিনের সংগীত  জীবনে এক বিচিত্র পটপরিবত্তন হল এবং সেই থেকে রাজা জগৎকিশোর তাঁর ধর্মপিতা এবং মুক্তাগাছা তাঁর সংগীত  বিদ্যাপীঠ। তিনি যখন খ্যাতির শীর্ষে এবং পঁচাত্তরের উপরে বয়স তখন ১৯৫৬ সালে শীতের শেষে মুক্তাগাছায় তাঁর প্রিয় সংগীত  বিদ্যাপিঠে এলেন। কয়েক সপ্তাহ থাকলেন মুক্তাগাছার জমিদার বাড়িতে। ময়মনসিংহের ভক্তমন্ডলীও গেলেন। সরোদ বাজালেন, গানের কথা বললনে এবং তাঁর জীবনের এই নাটকীয় ঘটনাটি বর্ণনা করলেন।

তবলার একনিষ্ঠ সাধক পূর্ববঙ্গ ও ঢাকার গৌরব শ্রীপ্রসন্নকুমার বণিক্য মুক্তাগাছায় রাজদরবারে প্রায়ই বিভিন্ন সময়ে তবলা বাজিয়েছেন। ঢাকার বিখ্যাত তবলা ও পাখোয়াজ বাজিয়ে গৌরমোহন বসাকের কাছে তবলা শেখা গুরু করার পর প্রসন্ন বণিক মুর্শিদাবাদে নবাব বাহাদুরের রাজদরবারে কণ্ঠসংগীত ও আতা হোসেন খাঁর কাছ থেকে তবলা শিখতে থাকেন। কিছুকালের মধ্যেই প্রসন্ন বণিক একজন নিষ্ঠাবান তবলা বাজিয়ে হিসেবে রাজা জগৎকিশোরসহ বহু সংগীত প্রিয় জমিদারদের স্বীকৃতি পেলেন। ময়মনসিংহের রামগোপালপুরের জমিদার হরেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীও তবলার একনিষ্ঠ সাধক ছিলেন। তিনিও প্রসন্ন বণিক্যের কাছ থেকে তবলায় তালিম গ্রহণ করেন। সারাজীবন প্রসন্ন বণিক সংগীত  সেবায় কাটিয়েছেন এবং সকলের কাছে অত্যন্ত প্রিয় ছিলেন। ১৯৩৬ সালের দিকে প্রসন্নকুমার লোকান্তরিত হয়েছেন। রাজা জগৎকিশোরের বড়ো ছেলে কুমার জিতেন্দ্রকিশোর আচার্য প্রকৃতপক্ষে সংগীতের ই এক আচার্য ছিলেন। হিন্দুস্তানী সংগীতচর্চায় ময়মনসিংহে ব্রজেন্দ্রকিশোর, বীরেন্দ্রকিশোর, জ্ঞানদাকান্ত, লাহিড়ী, ডক্টর সুরেশ চক্রবর্তী, হরেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী উপমহাদেশে দুর্লভ সুনাম অর্জন করেছিলেন। তাঁদের কেউ গাইয়ে, কেউ বাজিয়ে, কেউ লেখক, কেউ পৃষ্ঠপোষক। এ ধরণের উঁচু দরের পন্ডিতদের সমাবেশ খুব কম স্থানেই একত্রে পাওয়া যায়। এদের মধ্যে জিতেন্দ্রকিশোরের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। জিতেন্দ্রকিশোর হিন্দুস্তানী সংগীত  সম্মেলনে সভাপতির কাজ, দুরূহ ধ্রুপদ ও খেয়ালের অসংখ্য সংগ্রহ এবং ময়মনসিংহের প্রতিভাবান কন্ঠসংগীত শিল্পীদের তালিম দিয়েছেন, লালন করেছেন দীর্ঘকাল। তাঁর ব্যক্তিগত আকর্ষণ উপমহাদেশের বিখ্যাত সংগীত গুণী ব্যক্তিবৃন্দ মুক্তাগাছায় এসে উপস্থি হয়েছেন। অনেক সময় উচ্চাঙ্গসংগীত বিচারক হয়েও দায়িত্ব পালন করতেন।

জিতেন্দ্রকিশোরের আড্ডায় যে সমস্ত সঙ্গীগগুণীদের সম্মেলন ঘটত, বস্তুত তাঁরাই ছিলেন বাংলাদেশ ও ভারতের বিখ্যাত সংগীত তাত্ত্বিক ও কালোয়াত ও এমনকি চলচ্চিত্রের প্রমথেশ বড়ুয়া, কানন দেবী এবং নাচের জগতের শ্রদ্ধেয় উদয়শংকরও মুক্তাগাছায় এসেছিলেন। তাঁর সাধনা তাকে সংগীতের একজন বিশাল ব্যক্তিত্ব বানিয়েছিল। উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ এস্রাজ বাজিয়ে চন্দ্রিকাপ্রসাদ পূর্বে যদিও ধলার জমিদার বাড়িতে থাকতেন, তবুও প্রায়ই জিতেন্দ্রকিশোরের আড্ডায় হাজির হতেন। সুরলোকের এই মায়াজাল সৃষ্টিকারী মাস খানেক অবস্থান করেন। জিতেন্দ্রকিশোরের সাথে তখন তাঁর জমজমাট গানের আড্ডা হতো। সেদিন ছিলেন মৌলভীরাম ও অন্যান্য সংগীতগুণীরাও। ভীষ্মদেবের মেগাফোন রেকর্ডে গাওয়া ‘নবারুণ রাগে তুমি সাথী গো, যদি মনে পড়ে সেদিনের কথা’ এসব ভৈরবঈ মিশ্রিত (ইরানী ভৈরবী) রহস্যাবৃত সুরসৃষ্টিতে জিতেন্দ্রকিশোরের অনেক অবদান ছিল। ময়মনসিংহের সংগীতরসিকদের জন্য এ তথ্য কম গৌরবের কথা নয়। শ্রীভীষ্মদেব মুক্তাগাছায় থাকাকালীন কেউ কেউ জিজ্ঞেস করতেন যে, তিনি জিতেন্দ্রকিশোরকে গান শেখাচ্ছে কিনা। ভীষ্মদেব বিস্মিত হয়ে নম্রভাবে জবাব দিতেন, ‘আপনারা জানেন না হয়ত, জিতেন্দ্রকিশোরের দুর্লভ সংগীত সংগ্রহে প্রলোভিত হয়ে এসেছিলাম। ভীষ্মদেব সবসময় সুরের ধ্যানে থাকতেন এবং তাঁর অপূর্ব চেহারা ও নম্রভাব তাঁর কন্ঠের মতো সকলকে গভীরভাবে স্পর্শ করত। ১৯৩৭ সালের আগষ্ট মাসে ভীষ্মদেবের সমসাময়িক শ্রীতারাপদ চক্রবর্তী (নাকুবাবু) মুক্তাগাছায় এসে সংগীত  পরিবেশন করেছেন তাঁর সুমিষ্ট কন্ঠে। জিতেন্দ্রকিশোর জীবিতকালে মুক্তাগাছা দুর্লভ উচ্চাংগসংগীত  কেন্দ্র ছিল। অবশ্য দ্বিতীয় মহাসমরের ভেতরই জিতেন্দ্রকিশোর মারা যাবার পর মুক্তাগাছায় সংগীতের  দীপশিখা ধীরে ধীরে নিভে আসে।

ময়মনসিংহের উচ্চাঙ্গসংগীত চর্চার ক্ষেত্রে গৌরীপুর জমিদারদের দরবার অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য। শ্রীব্রজেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী নিজে সংগীতের পন্ডিত ব্যক্তি ছিলেন এবং সারা জীবন উচ্চাঙ্গসংগীত চর্চা ও লেখায় কাটিয়েছেন। তার পৃষ্ঠপোষকতায় সেতারের শ্রেষ্ঠ উস্তাদ ও শিল্পী এনায়তে খাঁ (ভারতের বিখ্যাত উস্তাদ বিলায়েত খাঁর বাবা), তানসেনের শেষতম বংশধর বিখ্যাত রবাবী মোহাম্মদ আলী খাঁ এবং দিল্লীর সুরেলা তবলার উস্তাদ মাসিদ খাঁ (তবলাবাদক উস্তাদ কেরামাতুলা খাঁর বাবা), উস্তাদ উজির খাঁ (যিনি নমস্য আলাউদ্দিন ও হাফিজ আলী খাঁর উস্তাদ), হাফিজ আলী খাঁ, দবীর খাঁ ও অন্যান্যরা গৌরীপুরে এসে স্থায়ীভাবে উচ্চাঙ্গসংগীতের  চর্চা করেছেন। ব্রজেন্দ্রকিশোরের ছেলে বীরেন্দ্র কিশোর এনায়েত খাঁ ও মোহাম্মদ আলীর কাছে যন্ত্র সংগীতের  দুর্লভ তালিম পেয়ে তিনি তার কালের একজন অন্যতম সুরবাহার, সুরশৃংগার, এস্রাজ ও বীণা বাজিয়ে হিসাবে বিখ্যাত হয়ে উঠেন। শ্রীব্রজেন্দ্রকিশোর ও বীরেন্দ্রকিশোর ময়মনসিংহ ও বাংলার বিভিন্ন স্থানে সংগীত  সম্মেলন  ও সংগীত  চর্চার জন্য বিশেষ পদক্ষেপ নিয়েছেন। সংগীত  বিজ্ঞান প্রবেশিকায় (১৩শ বর্ষ, ১৩৪৩, মাঘ, ১০ সংখ্যা, ৫০ পৃষ্ঠা) রয়েছে নেত্রকোণায় ‘ব্রজেন্দ্রকিশোর সংগীত  সমাজ বেশ বড় করে তাঁদের ১ম বার্ষিকী সম্পূর্ণ করেঃ

“কিছুদিন পূর্বে নেত্রকোণা দত্ত হাইস্কুলে ব্রজেন্দ্রকিশোর সংগীত  সমাজের প্রথম বার্ষিক উৎসব মহাসমারোহের সহিত সম্পন্ন হইয়াছে। ঐ দিবস অপরাহ্ন সাড়ে চার ঘটিকায় স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের সংগীত  প্রতিযোগিতা আরম্ভ হয়। স্থানীয় মহকুমা ম্যাজিষ্ট্রেট মিঃ এ এইচ কোরেশী আই, সি এস, মহোদয় সভাপতির আসন গ্রহণ করেন এবং ময়মনসিংহ গৌরিপুর কুমার শ্রীযুক্ত বীরেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী মহোদয় অনুগ্রহপূর্বক সভায় উপস্থিত হইয়া সংগীত প্রতিযোগিতায় উত্তীর্ণ ও কৃতি ছাত্রছাত্রীগণকে পুরস্কার বিতরণ করিয়া উৎসাহ প্রদান করেন। কুমার শ্রীযুক্ত বীরেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী মহাশয় তাহার পিতৃদেবের আশীর্বাদ সভাসদগণ সমক্ষে জ্ঞাপন করিয়া সংগীত  শিক্ষা ও সমাজ গঠনের উপকারিতা সম্বন্ধে বক্তৃতা দেন। অতঃপর তিনি সুরশৃঙ্গার ও সেতার বাদন দ্বারা সভাস্থ শ্রোতামন্ডলীদিগকে মুগ্ধ করেন।

ময়মনসিংহ ও গৌরিপুরের কয়েকজন গায়ক ও বাদক আমাদের নিমন্ত্রণে যোগদান করিয়াছিলেন। তন্মধ্যে ময়মনসিংহের খস্রু হিন্দী গজল ও বাংলাগান এবং এসঙ্গে সুরেন রায়ের তবলা সংগত অতিশয় চিত্তাকর্ষক ও উপভোগ্য হইয়াছিল। শ্রীযুক্ত বিজয়কৃষ্ণ ভট্রাচার্যের হিন্দী ও বাংলাগান মধুর হইয়াছিল। উস্তাদ এনায়েত হোসেন খাঁ সাহেবের ছাত্র শ্রীমান বিপিনচন্দ্র দাসের সেতার বাদনও ঐ সঙ্গে শ্রীযুক্ত হরেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তীর তবলা সঙ্গত সুশ্রাব্য ও প্রশংসনীয় হইয়াছিল। রাত্রি প্রায় এগারোটার সময় সভা ভংগ হয়। ”

উচ্চাঙ্গ সংগীতের  ক্ষেত্রে তখনকার সারা বাংলাদেশে ও ভারতে জমিদার শ্রীবজেন্দ্রকিশোর অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব ও পন্ডিতব্যক্তি হিসাবে গৃহীত ছিলেন, তা আমরা দেখতে পাই সংগীত  বিজ্ঞান প্রবেশিকার একটি (১৩শ বর্ষ, ১৩৮৩, মাঘ, ১০ম সংখ্যা ৫০ পৃষ্ঠা) তথ্যের মধ্যে।

‘সুহৃদয় পাঠক পাঠিকাদিকগকে সানন্দ চিত্তে জানাইতেছি যে, সংগীত  বিজ্ঞান প্রবেশিকার অন্যতম তত্ত্বাবধায়ক শ্রীযুক্ত ব্রজেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী মহাশয় এবার হইতে ‘সংগীত  বিজ্ঞান প্রবেশিকায়’ প্রাচীন ও বর্তমান ভারতীয় সংগীত  সম্মন্ধে নিয়মিত আলোচনা করিবেন। এতদ্ব্যতীত তাঁহার ধারাবাহিক প্রবন্ধ ও নিয়মিত প্রকাশিত হইবে। সংগীত  শাস্ত্রে তাঁহার ন্যায় কৃতী ব্যক্তির নিকট সংগীতের  বহু লুপ্তপ্রায় তথ্য আমরা পাইব, ইহা আমরা নিঃসন্দেহে বলিতে পারি। গত ৬ই ফেব্রুয়ারী তারিখ তিনি আমাদের কার্যালয়ে শুভ পদার্পণ করিয়া এ বিষয়ে আমাদিগকে বিশেষ উৎসাহ প্রদান করিয়াছিলেন। তাঁহার এই বদান্যতার জন্য আমরা বিশেষ কৃতজ্ঞ।’

উচ্চাঙ্গসংগীতের ক্ষেত্রে বীরেন্দ্রকিশোর আর একজন শ্রেষ্ঠ পন্ডিত ব্যক্তি। তিনি সারা জীবন সংগীতের পৃষ্ঠপোষকতা, সংগীত  চর্চা ও সংগীত  লেখার মাঝে কাটিয়েছেন। ‘সংগীত  বিজ্ঞান প্রবেশিকা’ নামে পত্রিকাটিতে ব্রজেন্দ্রকিশোর ও বীরেন্দ্রকিশোর উভয়েই নিয়মিত লিখেছেন উচ্চাঙ্গসংগীত নিয়ে।

অতি শৈশবেই বীরেন্দ্রকিশোর (জন্ম ১৯০৪ সাল, গৌরীপুর, ময়মনসিংহ) অভিজাত সংগীতের  সংস্পর্শে আসেন সংগীত প্রেমী বাবা ব্রজেন্দ্রকিশোরের পৃষ্ঠপোষকতায়। গৌরীপুরে তখন ছিলেন এস্রাজবাদক শীতল মুখোপাধ্যায়, তাঁর কাছেই এস্রাজের তালিম নিয়ে বীরেন্দ্রকিশোরের সংগীতের জীবন শুরু। শীতল মুখোপাধ্যায় উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ও স্বামী বিবেকানন্দের ভাই হাবু দত্তের শিষ্য। খেয়াল ও ঠুংরী গানেও শীতল মুখার্জী দক্ষ ছিলেন। বীরেন্দ্রকিশোরও ছিলেন সুকন্ঠের অধিকারী; তিনি কন্ঠের তালিম নিতে ভুলেননি। কুমারবীরেন্দ্রকিশোর লেখা পড়ার দিক দিয়ে অবহেলা করেন নি। এনায়েত খাঁ ও আমীর খাঁ তাঁর সংগীত  গুরু। ওদের কাছে তখন তিনি ছোট সুরবাহার নিয়ে সংগীত চর্চা শুরু করেন। তানসেন-বংশধর রবাবী মোহাম্মদ আলী খাঁ বীরেন্দ্রকিশোরকে উপদেশ দিতেন যে ধ্রুপদী শিক্ষা ছাড়া আলাপ শেখানো যায় না। তারপর সুরশৃংগার শেখার সাথে সাথে বীরেন্দ্রকিশোর একশ ধ্রুপদ এবং দশ-বারোটি রাগের আলাপও শিখলেন। ১৯২৭ সালে মোহাম্মদ আলী খাঁ অসুস্থ হয়ে গৌরীপুর ছেড়ে যাবার পর বীরেন্দ্রকিশোর সেনী ঘরানার সরোদিয়া উস্তাদ হাফিজ আলী খাঁর (এখনকার সরোদিয়া আমজাদ আলী খাঁর বাবা) শিষ্যত্ব গ্রহণ করলেন। রামপুরের উস্তাদ সগীর খাঁকেও আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে এলেন বীণার তালিমের উদ্দেশ্য। সগীর খাঁ মূলতঃ গায়ক বলে সেনী ঘরানার অনেক দুর্লভ ধ্রুপদ সংগ্রহ করে ছিলেন। তারপর উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ও দবীর খাঁ তালিম নেয়ার সুযোগও বীরেন্দ্রকিশোর ছাড়লেন না। এ ছাড়া বীরেন্দ্রকিশোরের জীবনে রেডিওর অডিশন কমিটি সদস্য নিয়োগের ক্ষেত্রে ডাঃ কেনাকারের ভূমিকা এবং সংগীত -নাটক একাডেমীতে তাঁকে বাংলাদেশের প্রতিনিধি নির্বাচিত করেছিলেন মৌলানা আবুল কালাম আজাদের সাহায্যেও বিশেষভাবে স্মরণীয়। ১৯৫৬ সালে বীরেন্দ্রকিশোর রবীন্দ্রভারতীয় অধ্যাপক পদে নিযুক্ত হন এবং ভারতের রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে ফেলো অব দি অকাদেমী’ সম্মান লাভ করেন ১৯৬৪ সালে। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার বছর তিনেক পর বীরেন্দ্রকিশোর কলকাতায় লোকান্তরিত হন। ময়মনসিংহ ও সর্বভারতীয় উচ্চাঙ্গ সংগীতচর্চার ক্ষেত্রে এবং তাত্ত্বিক হিসেবে এক সমৃদ্ধ ঐতিহ্য রেখে গেছেন বীরেন্দ্রকিশোর।

তাত্ত্বিক হিসেবে এবং হিন্দুস্থানী গানের সংগ্রহ ও স্বরলিপি করার বিষয়ে ময়মনসিংহের কালীপুরের শ্রীজ্ঞানদাকান্ত লাহিড়ী একটি অতি শ্রদ্ধেয় নাম। তাঁকে দেখলে হিন্দুস্তানী উস্তাদরা সংগীত  পরিবেশনে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করতেন। কেননা, এই অমূল্য সংগীত সম্পদ শ্রীজ্ঞানদা গোপনে স্বরলিপি উস্তাদরা সংগীত পরিবেশনে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করতেন। কেননা, এই অমূল্য সংগীতসম্পদ শ্রীজ্ঞানদা গোপনে স্বরলিপি করে নেবেন তাঁর তীক্ষ্ম কানের সাহায্যে। ফলে কোন মাইফেলে বা জলসায় শ্রীজ্ঞানদাকান্ত উপস্থিত থাকলে পশ্চিমা গায়কবৃন্দ অস্বস্তিবোধ করতেন। শ্রী জ্ঞানদাকান্তও তানসেন-বংশধর রবাবী মোহাম্মদ আলী খাঁর কাছে তালিম নিয়েছেন এবং নিজেও সংগীত চর্চা করেছেন দীর্ঘকাল। পন্ডিতের বিষ্ণুনারায়ণ ভাতখন্ডে ভারতীয় সংগীতের দুর্লভ সংগ্রহ প্রচার এবং প্রকাশের জন্য যেমন ‘সংগীত  গান্ধী’ উপাধি পেয়েছেন তেমনি শ্রীজ্ঞানদাকান্ত বহু পন্ডিত প্রশংসা পেয়েছেন। তাঁর অসাধারণ কৃতিত্বের জন্য তিনি ‘দ্বিতীয় ভাতখন্ডে’ বলে অনেক গুণীর কাছে পরিচিতি হয়েছেন। তাঁর ছোটভাই নীরদাকান্ত লাহিড়ী (টুনাবাবু) ছিলেন একজন শ্রেষ্ঠ সেতারী। এদেশে তখন এতবড় সেতারী আর কেউ ছিলেন না।

ময়মনসিংহের ত্রিশাল থানার অন্তর্গত কানিহারী একটি অত্যন্ত বর্ধিষ্ণু এলাকা। সংগীত -আচার্য ডঃ সুরেশ চক্রবর্তী এ গ্রামের লোক। ময়মনসিংহ শহরে পৌরসভার কাছে তার বাসা ছিল। ওকালতি করতেন। কিন্তু বেশ বয়স হয়ে যাবার পর আবিষ্কৃত হল তিনি আসলে প্রতিভাবান এস্রাজ বাজিয়ে এবং শোনা যায় তার শিক্ষাও ব্রজেন্দ্রকিশোরের দরবারে শীতল মুখার্জীর কাছে। ময়মনসিংহের বহু সংগীত গুণী ডঃ সুরেশ চক্রবর্তীর সংগীত  পিপাসা ও গভীর তত্ত্বের কথা আলোচনা করতেন। প্রকৃতপক্ষে শ্রীসুরেশ চক্রবর্তী অত্যন্ত আধুনিক ও বাস্তব জ্ঞানসম্পন্ন উচ্চাঙ্গসংগীত জ্ঞানী। কেননা, তিনি রাগসংগীতের  অনেক আলো-আধারি ও রহস্যময় তত্ত্বের মুক্তি দিতে চেয়েছিলেন। ‘রাগ’ ও ‘রাগিণী’ কে পুরুষ ও স্ত্রী হিসাবে রাগের সুররেখাকে চিহ্নিত করা তিনি অপবিজ্ঞান মনে করতেন। আজকে অবশ্য সবাই ‘রাগ’ কথাটির ব্যবহার করছেন রেডিও অনুষ্ঠান ও সংগীত  সম্মেলনে। এটা ডঃ সুরেশ চক্রবর্তীর কৃতিত্ব। তাছাড়া যখন বুঝলেন সংগীত প্রশিক্ষণের জন্যে শিক্ষার্থীদের জন্য চাই বিজ্ঞান সম্মত কিছু পাঠ্যপুস্তক, তখন লিখলেন, ‘সংগীত প্রবেশিকা’ ১ম থেকে ৫ম খন্ড। এই গ্রন্থ দুই বাংলাদেশের সকল সংগীত শিক্ষক ও বিদ্যার্থীদের বিশেষ সাহায্য করে থাকে আজও। এই গ্রন্থ বাংলার উচ্চাঙ্গসংগীত চর্চায় বিকাশ বিস্তারের ক্ষেত্রে ময়মনসিংহের  ডঃ সুরেশ চক্রবর্তীর রয়েছে বিশাল অবদান। তিনি সংগীত  সম্পর্কে বহু লেখা লিখেছেন, বক্তৃতা দিয়েছেন এবং দুয়েকটি চমৎকার গ্রন্থ লিখেছেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগে ময়মনসিংহ শহরে শ্রীসুরেশ চক্রবর্তী ‘সংগীত  বিদ্যালয়’ নামে একটি উচ্চাঙ্গ সংগীত  স্কুল খুলেন। শ্রী সুরনাথ মজুমদার ও মুহাম্মদ হোসেন খসরু এ সংগীত বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। বহু উচ্চাঙ্গসংগীত  পিপাসু এ বিদ্যালয়ের সংস্পর্শে এসেছিলেন। ১৯৫৬ সালের দিকে ডঃ সুরেশ চক্রবর্তী কলকাতায় মারা যান।

গৌরীপুর ও ময়মনসিংহ শহরের সেতারী শ্রীবিপিন দাসের জীবন ১৯৩০ এর দশকে শুরু। তাঁর প্রতিভাময় সেতার বাদনের জন্য গৌরীপুর জমিদার শ্রীব্রজেন্দ্রকিশোরের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি এনায়েত খাঁর কাছে সেতার শিখতে থাকেন। তিনি এস্রাজের তালিমও পেয়েছেন। বিশ দশকের শুরুতেই বিপিন দাস ও জিতেন সেন সেতার বাজানোতে ব্যাপক দক্ষতা লাভ করেন। সেতারে বিপিন দাস সুরের বিস্ময়কর মাধুর্য সৃষ্টি করতেন বেশী। তবে জিতেন সেন পান্ডিত্যে বিপিন দাসের চেয়ে অধিক সুনাম অর্জন করেন। এনায়েত খাঁর ইন্দ্রজালের উত্তরাধিকারী বিপিন দাস সত্যি এক অদ্ভুদ ক্ষমতা অর্জন করেছিলেন। তাঁর সংগীতচর্চা ময়মনসিংহের বাইরে খুব একটা যায়নি। যদিও বীরেন্দ্রকিশোর তাঁকে ময়মনসিংহ থেকে বাইরে নেয়ার ব্যাপারে যথেষ্ট চেষ্টা করেছেন। তবু তিনি যে উপমহাদেশের একজন শ্রেষ্ঠ সেতার বাদক এ বিষয়ে কার ও সন্দেহ নাই। গৌরীপুরের ব্রজেন্দ্রকিশোর ও তাঁর যোগ্য ছেলে বীরেন্দ্রকিশোর বিপিনদাসকে বিভিন্নভাবে লালন করেছেন জীবনের শেষদিন পর্যন্ত।

রামগোপালের জমিদার হরেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী ময়মনসিংহের আরেকজন অন্যতম সংগীত শাস্ত্রী। তিনি বিভিন্ন হিন্দুস্তানী উস্তাদের কাছে তবলার তালিম নিয়ে অল্পকালের ভিতরেই প্রচুর পান্ডিত্য অর্জন করেন। বিভিন্ন হিন্দুস্তানী কিংবদন্তী উস্তাদদের সংক্ষিপ্ত জীবনী নিয়ে তার গ্রন্থ এবং ত্রিশের দশকে লিখিত তবলাশাস্ত্র নিয়ে বিভিন্ন মূল্যবান প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে। এনায়েত খাঁ এবং রবাবী মোহাম্মদ আলী খাঁ বীরেন্দ্রকিশোরসহ বিপিন দাস, জিতেন সেন, নীরদাকান্ত লাহিড়ী, কিশোরগঞ্জের হীরণ দাসগুপ্ত, বিমলাকান্ত, মনোরঞ্জন ভট্রাচার্য্য, জ্যোতিষ চক্রবর্তী এবং তিনু বাবুকে যন্ত্রসংগীতের দুর্লভ প্রশিক্ষণ নিয়ে ময়মনসিংহের যন্ত্রের এক সমৃদ্ধ ঐতিহ্য গড়ে তোলেন। তাদের মধ্যে বীরেন্দ্রকিশোর, জিতেন সেন বাদনের সঙ্গে পন্ডিত ও তাত্ত্বিক হয়ে উঠেছিলেন।

কৃষ্টপুরের রামবাবু ভালো এস্রাজ বাজাতেন এবং গুণীদের মুখে তার কথাও প্রচুর শোনা যায়। যন্ত্রসংগীতে শ্রীগঙ্গাচরণ উল্লেখযোগ্য নাম। বেহালা বাজিয়ে দীর্ঘদিন ধরে তার সুনাম অক্ষুন্ন রাখেন। গঙ্গাচরণ বাবুর চেয়ে ভালো বেহালা বাদক এখনো ময়মনসিংহে দেখা যায় না। ময়মনসিংহ শহরে সংগীতের  প্রধান শিক্ষক যামিনীপাল এস্রাস, বেহালা, সেতার ও বিদ্যুৎবীণ বাজিয়ে যথেষ্ঠ সুনাম অর্জন করেছেন। যন্ত্রসংগীতে ময়মনসিংহের সমৃদ্ধি ঘটেছিলো গৌরীপুরের বিশিষ্ট হিন্দুস্তানি উস্তাদদের আগমনের ফলে। এমনকি সুমিষ্ঠ সরোদ বাজিয়ে হাফিজ আলী খাঁও এখানে হাজির হয়েছেন। এনায়েত খাঁর স্মৃতি ময়মনসিংহের সকল প্রবীণ গুণীদের এক আলোচ্য বিষয়। ত্রিশের দশকে খয়েরউদ্দিন ও মুহম্মদউদ্দিন নামে দুজন হিন্দুস্তানী গাইয়ে শেরপুরের জমিদার বাড়ীতে (ময়মনসিংহ শহরে) দরবারী রাগে খেয়াল গেয়ে অপূর্ব নৈপুণ্য দেখান। ময়মনসিংহের প্রধান সংগীতরসিকরা খয়েরউদ্দিন, মুহম্মদউদ্দিনের দরবারী রাগে খেয়ালের স্মৃতি আজও ভুলতে পারেনি। অনেকের ধারণা দরবারী এর চেয়ে ভালো গাওয়া সম্ভব নয়।

শ্রীপূর্ণচন্দ্র নন্দী বা পচাবাবু উচ্চাঙ্গসংগীতের সবচেয়ে প্রতিভাবান খেয়াল ও ঠুমরী গায়ক। শাস্ত্রে যাকে শ্রুতিধর বলা হয়। সকল শ্রেণীর শ্রোতা ও রসিকদের মোহিত করতেন পচাবাবু। বিশেষ করে ঠুমরী গাওয়ার ব্যাপারে পচাবাবু এক অনন্য শিল্পী। আশ্চর্যের বিষয় পচাবাবু স্থায়ীভাবে কোন বিখ্যাত উস্তাদদের কাছে তালিম পাননি এবং তার কোন স্কুল শিক্ষাও ছিল না। আদি বাড়ী ঢাকার কাশিমপুরে হলেও ময়মনসিংহে বিয়ে করে নওমহলের খোয়াড় এলাকার দিকে বাসা করে থাকতেন। মনে হয় কৈশোরে তিনি কাশিমপুরের জমিদার বাড়ী ও ভাওয়ালের জমিদার বাড়ীর সংস্পর্শ এসেছিলেন। সেখানে এসেছিলেন তখনকার দিনে শ্রেষ্ঠ কালোয়াত উস্তাদ কালে খাঁ এবং উস্তাদ মইজুদ্দিন খাঁ। ওদের গান নিঃসন্দেহে কিশোর পচাকে আকৃষ্ট করেছে। পচাবাবুর গানের নৈপুণ্যের গল্প রূপকথার গল্পের মতই ছড়িয়ে আছে সারা ঢাকা-ময়মনসিংহে। হিন্দুস্তানী উস্তাদরা তার বিস্ময়কর দক্ষতা দেখে বিস্মিত হয়েছেন। অপূর্ব সুরেলা কন্ঠ ও তাল-লয়ের অবিশ্বাস্য ক্ষমতা দিয়ে পচাবাবু ময়মনসিংহের সকলের মন জয় করেছেন। রেকর্ডে আবদুল করিম খাঁর গাওয়া “যমুনাকে তীর’ শুনে কদিন পরেই হুবহু সেই রকম গেয়ে সবাইকে বিস্মিত করেন। পচা-উপেন খসরু ছিলেন পরস্পরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। পচাবাবু ছিলেন একান্তই নম্র স্বভাবের এবং মার্কিন থানের ধুতি জামা পরিহিত ছোট আকৃতির মানুষ। দেখতে সাদামাটা কিন্তু সংগীতের  ক্ষমতায় তিনি সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন। পচাবাবু মারা যান ১৯৪৭ সালে। তিনি জীবদ্দশাতে বেশ কিছু ছাত্র-ছাত্রীকে উচ্চাঙ্গসংগীতে শেখাতেন। তার মধ্যে লতিকা সোম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কুমিল্লায় জন্ম উস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খসরু অধিকাংশ সময় কাটিয়েছেন ময়মনসিংহে। তিনি পচাবাবুর আমরণ সঙ্গী। জনাব খসরু যেমন ছিলেন গাইয়ে তেমন তাত্ত্বিক। দেখতে ফর্সা, তখনকার দিনের বিএ পাশ এবং আরবী, ফারসী, ইংরেজী এবং বিভিন্ন হিন্দুস্তানী ভাষায় বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। সংগীতে তিনি এক আদর্শ পন্ডিতব্যক্তি। খেয়াল ধ্রুপদের অপূর্ব সংগ্রহ ছিলো খসরু সাহেবের। তিনি একজন তীক্ষ্ম তাত্ত্বিক এবং সংগীতের  উস্তাদ ছিলেন। গান গাওয়া এবং শাস্ত্র ব্যাখ্যার ব্যাপারে বিশুদ্ধতার দিকে সুনজর রাখতেন। খসরু সাহেবের জীবন ছিলো সহজ ও সাদাসিধা ধরণের। আপনভোলা সুরপাগল মানুষ। গান প্রিয় কাউকে রাস্তায় দেখলেই তাকে ডেকে আড্ডায় বসে যেতেন। গানের আড্ডায় ভুলে যেতেন দুপুরের স্নান-খাওয়া, এমনকি রাতেরও। খসরু সাহেবের বহু সংগীত শিষ্য আজও বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে উচ্চাঙ্গসংগীত চর্চা করছেন। উস্তাদ খসরু ১৯৫৪ সনের দিকে মারা যান।

উপেন-পচা-খসরু ত্রয়ীর তবলাবাদক শ্রীউপেন্দ্র রায়। ফুলবাড়ীয়া থানার পুটিজানার জমিদার শ্রীউমেশ রায়ের ছেলে। ঢাকা কলেজ থেকে এন্ট্রাস পাশ করে পড়াশুনায় আর অগ্রসর হননি। সংগীতে মন আকৃষ্ট। বাবা তবলা বাজাতেন। ছোটভাই সুরেন রায়ও। সবচেয়ে বড় কথা তাদের জ্ঞাতি ভাই বিপিন রায় (মৌলভীরামের শিক্ষাপ্রাপ্ত) তবলার একজন শ্রেষ্ঠ গুণী ব্যক্তি। স্বাভাবিকভাবেই উপেন রায় তবলার দুরূহ প্রশিক্ষণ বড় ভাইয়ের কাছ থেকে পেতে থাকেন। উপেন্দ্র রায় তবলা বাদনে এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছিলেন, যেখানে এদেশে তার সমকক্ষ আর কেউ ছিল না। পচা-উপেন-খসরু যখন কন্ঠসংগী পরিবেশ করতেন তখন উপেন বাবুর তবলা সংগত বিশেষ করে ডান হাতের দক্ষতায় যে কোন বিচারে সবাইকে ছাড়িয়ে যেতেন। উপেন রায়ের বাসা ছিল একটি সংগীত কেন্দ্রিক বাসা। ছোট ভাই সুরেন রায় তবলা বাজাতেন এবং তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল বাংলার বিখ্যাত গায়ক শ্রী সুধীরলাল চক্রবর্তী (গিরিজা শংকরের ছাত্র), পান্না লাল ঘোষ (উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ বাঁশী বাজিয়ে), অনিল বিশ্বাস এবং খেয়াল গায়ক বীরেশ রায় (গিরিজা শংকরের ছাত্র)। এরা প্রত্যেকেই উপেন রায়ের বাসায় ঘনিষ্ঠ আড্ডায় দিন কাটিয়েছিন। শ্রীঅনিল বিশ্বাস (পরবর্তীকালে বোম্বের চলচ্চিত্রের সংগীত  পরিচালক) ‘ঝুলনে ঝুলিছে শ্যামরাই’ গানখানি ময়মনসিংহের বিভিন্ন মাইফিলে প্রায়ই গাইতেন এবং সকলকে আনন্দ দিতেন। সুরেলা কন্ঠের গায়ক শ্রীসুধীরলাল চক্রবর্তী খেয়াল-ঠুমরী অতি উচুদরের শিল্পী। যদিও বাংলা গানে তার পরিচয়, তবুও তিনি উচ্চাঙ্গসংগীত  উল্লেখযোগ্যভাবে চর্চা করেছেন। একবার ময়মনসিংহের পন্ডিতপাড়া ক্লাবের গানের আসরে বসেছেন। সবাই তাকে ঠুমরী গাইবার জন্য অনুরোধ করেছে। কিন্তু সামনে পচাবাবু বসে আছেন। নম্রভাবে বললেন, ‘আমি পচাদার ঠুমরী শুনতে এসেছি, আমার নিজের নয়।’

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলাকালীন মুক্তাগাছার জিতেন্দ্রকিশোর আচার্য মারা যাওয়ার পর (১৯৪১ সালে) মুক্তাগাছার দরবারে ক্রমশই ক্ষীণ হয়ে আসে। এমনকি সমগ্র ময়মনসিংহেও সংগীত  চর্চা কিছুটা ফিকে হয়ে আসে। পাকিস্তানোত্তরকালে উচ্চাঙ্গসংগীত চর্চা মর্মান্তিক দশায় পৌঁছল। শশীকান্তের ‘শশীলজে’ উচ্চাঙ্গসংগীতের দু’একজন উস্তাদ তখনও সংগীত  চর্চায় নিয়োজিত ছিলেন। শশীলজের মহারাজ শশীকান্তের বড়ছেলে শ্রী সিতাংশকান্ত আচার্য সংগীতচর্চা করতেন ও সংগীতের বিভিন্ন প্রাচীন গ্রন্থ অধ্যায়ন করতেন। বাংলা ১৩৫১ সালে ‘সুরের পূজা’ ও ১৩৫৩ সালে ‘সংগীত দর্পণের বঙ্গানুবাদ’ ময়মনসিংহের বিভিন্ন পন্ডিতব্যক্তিদের সাহায্যে লিখিয়ে ও সম্পাদনা করে বই দুটি প্রকাশ করেন। সংগীত শাস্ত্রের প্রধান ধ্যান-ধারণা ও নিয়ম-কানুন এ বই দুটিতে ছড়িয়ে আছে। উচ্চাংগসংগীতে বই দুটী শ্রেষ্ঠ অবদান রেখেছে। এ সময়ে ময়মনসিংহের জনজীবনে সংগীতের  একটা ভাটা স্পষ্ট হয়ে উঠে। এই ক্রান্তিলগ্নে ত্রিশ দশকের বিখ্যাত খেয়াল ও কন্ঠসংগীত শিল্পী শ্রীবিজয়কৃষ্ণ ভট্রাচার্য উচ্চাঙ্গসংগীতের মর্মান্তিক অবস্থা দেখে ময়মংসিংহে বিভিন্ন সংগীত সম্মিলনী, সংগীত বিদ্যালয় ও সংগীত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উচ্চাঙ্গসংগীতের  উন্নতির পদক্ষেপ নেন। শ্রীবিজয় ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী সংগীতশিল্পী। ক্রীড়া, নাটক এবং সংগীত সহ বিভিন্ন শাস্ত্রে তাঁর ছিল অগাধ জ্ঞান। জিতেন্দ্রকিশোর ১৯৩৬ সালে প্রতিভাবান বিজয়কে মুক্তাগাছার দরবারে নিয়ে যান লালনের জন্যে এবং উচ্চাঙ্গসংগীতের তালিম দেয়ার জন্য। উদ্দাম স্বভাবের বিজয় হিন্দুস্তানী উস্তাদদের পরিবেশে অতি সময়ের মাঝে এক অনন্য কন্ঠশিল্পী হয়ে উঠলেন এবং একজন সঙ্গীতশাস্ত্রী হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত হলেন। সংগীতে শ্রীবিজয় বিচিত্র অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন। উস্তাদ মুহাম্মদ হোসেন খসরু ও ডঃ সুরেশ চক্রবর্তী শ্রীবিজয়ের সংগীত সাধনার পথে রাগসঙ্গীতের বিভিন্ন তালিম ও শাস্ত্র শিক্ষা দিয়ে তাকে মননশীল সংগীতজ্ঞ বানিয়ে তোলেন। শ্রীবিজয় কানিহারী বংশধর, কিন্তু নেত্রকোণার সুখহারী জমিদার শ্রীবিহারীলাল ভট্রাচার্যের দত্তক পুত্র ছিলেন। বাংলা ১৩৪৩ সালে নেত্রকোণার ব্রজেন্দ্রকিশোর সংগীত সমাজের ১ম বার্ষিকীতে সংগীত পরিবেশন করেও শ্রীবিজয় বিশেষ খ্যাতি অর্জন করে। ১৯৪৬-৪৭ সালে নেত্রকোণার উচ্চাঙ্গসংগীত সম্মেলনে দবির খাঁ, রাধিকামোহন মৈত্র, বীরেশ রায় ও অন্যান্য বিখ্যাত গাইয়ে বাজিয়েদের উপস্থিতিতে শ্রীবিজয় ‘হেমক্ষেম’ রাগে খেয়াল গেয়ে সকলকে বিস্মিত করেন। তাঁর সঙ্গে তবলা সংগত করেন শ্রীমিথুন দে, যিনি তবলার বিলম্বিত সঙ্গতে অপূর্ব নৈপুন্য দেখান। তারও আগে শ্রী বিজয় বাংলার বিখ্যাত খেয়ালগায়ক শ্রীজ্ঞানেন্দ্র গোস্বামীর  সাথে একই আসরে (পুরী ও নীলাচল) খেয়াল গেয়ে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। শ্রীবিজয় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগে ঢাকা বেতারের খেয়াল সংগীতের শিল্পী ছিলেন। দ্বিতীয় মহাসমরের পর তিনি টাংগাইলের ভারতেশ্বরী হোমসে সংগীত শিক্ষকতাও করেন।

শ্রীবিজয়ের স্মৃতি ও উচ্চাঙ্গসংগীতে তাঁর অবদান বলে শেষ করা যাবে না। পাকিস্তানোত্তর কালে তার সৃষ্ট ‘বানু সংগীত বিদ্যালয়’ ময়মনসিংহ শহরে বহু শিক্ষার্থীকে আকর্ষণ করেছে। তিনি ১৯৫১ সালে মৃত্যুঞ্জয় স্কুল মাঠে এবং ১৯৫২ সালে মৃত্যুঞ্জয় স্কুলের ব্যায়ামাগার সংলগ্ন মাঠে এ দেশীয় বিভিন্ন উচ্চাঙ্গসংগীত শিল্পী দিয়ে সংগীতের  দু’টি সম্মেলন করেন। এ দুটি সম্মেলনে ময়মনসিংহের নিভে যাওয়া সংগীতে আলোড়ন সৃষ্টি করে। এরপর ১৯৫৩ সালে শ্রী বিজয় এই উদ্যমকে ক্রমাগত কাজে লাগানোর জন্য সুসঙ্গের (বর্তমান মুকুল ফৌজ প্রাঙ্গন) জমিদারদের মাঠে বাংলাদেশের বিখ্যাত সংগীত শিল্পীদের নিয়ে এক বিশাল সংগীত সম্মেলনের আয়োজন করেন। ভুরি বেগম ও কানীজ বেগম এই সম্মেলনে সংগীত  পরিবেশনে করে যথেষ্ট আলোড়ন সৃষ্টি করেন। ময়মনসিংহের ছোট বড় বহু শিল্পী প্রতিযোগী হিসাবে এই সংগীত সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। বস্তুতঃ এই সংগীত  সম্মেলনটি ময়মনসিংহের উচ্চাঙ্গসংগীত চর্চার পূর্বেকার অবস্থা অনেকটা ফিরিয়ে আনে এবং উচ্চাঙ্গসংগীত চর্চা ময়মনসিংহের মধ্যবিত্ত মুসলমান পরিবারগুলিতেও শুরু হয়। এরপর আরও সম্মেলন এবং সংগীতের  জলসা অনুষ্ঠীত হয়। ১৯৫৮ সালে ক্রমাগত তিন রাত ছায়াবানী হলে সংগীত প্রতিযোগিতা চলল। ময়মনসিংহের বহু সংগীত শিল্পী প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন। এই সময় বা এর দুয়েক বৎসর আগে কলকাতার আধুনিক গানের সুবিখ্যাত গায়ক শ্রী সতীনাথ মুখোপাধ্যায় ও উৎপলা সেন ময়মনসিংহ সফর করে যান এবং আধুনিক সংগীত পরিবেশন করে সবাইকে আনন্দ দান করেন। কলকাতার গাইয়ে বীরেশ রায়ও এই সময় একবার খেয়াল গাইতে আসেন। জীবনের শেষ দিকে এসে আর্ট কাউন্সিল পরিচালিত ‘সংগীত  বিদ্যালয়টি’ স্থাপন করেন সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৭৩ সালে। ১৯৭৪ সালের অক্টোবর মাসে শ্রী বিজয় অকস্মাৎ দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হন এবং বাইশ নভেম্বর কলকাতা চলে যান ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য। ১৯৭৫ সালের ৩০শে মার্চ পশ্চিবঙ্গের চাকদহে তাঁর বড়ছেলে শ্রী ভীষ্মদেব ভট্রাচার্যের বাড়ীতে শ্রী বিজয় মারা যান। কিন্তু শ্রী বিজয়ের স্মৃতি এবং তাঁর অনন্য চরিত্র ময়মনসিংহের সবার কাছে অম্লান থাকবে। শ্রী বিজয়ের কাছ বহু শিক্ষার্থী শিখেছেন। তাদের মাঝে উল্লেখযোগ্যভাবে উচ্চাঙ্গসংগীত গেয়েছেন তাঁর বড় ছেলে শ্রী ভীষ্মদেব ভট্রাচার্য এবং শ্রীমতি পারুল রানী সিনহা। এ প্রবন্ধের লেখকও শ্রী বিজয় ভট্রাচার্যের দীর্ঘদিনের ছাত্র ছিলেন (১৯৬৩-৭৪)।

আজকের নবপ্রজন্ম ও সংগীতের  নব সম্প্রদায় এক মহাস্খলনের মধ্যেদিয়ে চলছে। জীবন, কর্ম, খেলা, গান যাই হোক না কেন, বিষয়ের গভীরতা থেকে আমরা দূরে। তরুন সম্প্রদায়ের জীবন এমন গড়ে ওঠার জন্যে আমরা প্রবীণরাই দায়ী। উচ্চশিক্ষা নিয়েও সমাজ ও দেশের প্রতি আমাদের নিবেদন নেই। তার মধ্যে লুটপাট নামান্তর বাংলাদেশের এক রাজনীতি সবকিছুকে ছারখার করে চলছে। সে আগুনে অনেক কিছু পুড়ে ছাই হয়েছে। উচ্চতর গান, কলাবতী রাগসংগীত  তার থেকে বাদ পড়েনি। তরুন সম্প্রদায়ের প্রত্যাশায় থাকব যারা বাপ দাদা সংগীতের  মণিমানিক্য ও দুর্লভ ধনকে উদ্ধার করবে গর্ব ভরে, প্রেমে ভালবাসায় জাগ্রত করবে মধুর চিরসংগীত।

 

Facebook Comments

comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top