অর্চনা মাসিহ’র সাথে কথোপকথনে রমিলা থাপার ।। অনুবাদ অজিত দাশ ।। পর্ব এক

“হিন্দুত্ববাদ আমাদেরকে একশ বছর পিছিয়ে দিয়েছে” – রমিলা থাপার

 আপনার কী মনে হয় স্বাধীনতার পর থেকে আমরা সঠিক ইতিহাস শিক্ষা পাচ্ছি?  

কেউ যদি ইতিহাসের কথা বলে তাহলে তাকে দুটো ধাপের কথা বলতে হবে। একটা হলো তথ্য যা পুরোপুরি সঠিক হতে হবে আর দ্বিতীয়টা হলো সেই তথ্যের ব্যাখ্যা যা মূলত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের নিজেদের মত করে প্রতিষ্ঠা করে। স্বাধীনতার সময় আমাদের যে ইতিহাস ছিলো তা সঠিক ছিলো। কিন্তু সেই ইতিহাস বিশ্লেষণের মূল দিকটি ছিলো জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিকোণ যা উপনিবেশিক ইতিহাসগুলোর বিপরীত। তাই দেখা যাচ্ছে, ভারতীয় ইতিহাসের একটি বিশ্লেষণ হলো উপনিবেশিক বিশ্লেষণ আরেকটি হলো জাতীয়তাবাদী বিশ্লেষণ। প্রথমটি দ্বিতীয়টিকে প্রশ্নসন্মুখীন করেছে।

মূলত কী ঘটছে? আমরা ইতিহাসের সাম্প্রদায়িক বিশ্লেষণ এবং উন্নয়ন নিয়ে বিচলিত হই কেননা সেগুলো ঐতিহাসিকভাবে সমর্থনযোগ্য নয়। এধরনের বিশ্লেষণে তথ্যগত দৃষ্টিভঙ্গি জোর করে সংযোজন করে দেওয়া হয়। কিছু ঘটনা কাটছাঁট করা হয়, কিছু ঘটনা বাদ দিয়ে দেওয়া হয়-যেখানেই  মতাদর্শগত অমিল পাওয়া যায় সেখানেই পরিবর্তন আনা হয়। 

একটি উদাহরণ দিলে ব্যাপারটি স্পষ্ট হবে। মাধ্যমিক পর্যায়ে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির জন্য আমি একটি ইতিহাস বই রচনা করেছিলাম প্রায় ত্রিশ বছর আগে। সেখানে একটি ছোট অনুচ্ছেদ ছিলো গজনীর মাহমুদের উপর। আমি সেখানে উল্লেখ করেছি গজনীর মাহমুদ ছিলেন একজন প্রতিমা ভাংচুরকারী। তিনি ভারতের মন্দিরগুলো ভাংচুর করে সেখানে লুটতরাজ চালিয়েছিলেন। মন্দির এবং অন্যান্য আরো বিভিন্ন জায়গা থেকে লুট করা সম্পদ দিয়ে সমখন্ডে একটি সুপরিচিত গ্রন্থাগার এবং মধ্য সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন। বর্তমানে সাম্প্রদায়িক ইতিহাসবিদরা এই অনুচ্ছেদের সমালোচনা করে বলছে যে গজনীর মাহমুদকে প্রতিমা ভাংচুরকারী হিসেবে উল্লেখ করা যাবে না এবং তিনি মন্দির লুট করেছেন সেটিও উঠিয়ে নিতে হবে।  এটা উল্লেখ করা যাবে না যে তিনি এই লুটের সম্পদ দিয়ে একটি প্রসিদ্ধ গ্রন্থাকার, সৈন্যবাহিনী এবং সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন। আওরঙ্গজেবের ক্ষেত্রেও একইরকম। তার সকল খারাপ দিকগুলো উল্লেখ করা যাবে কিন্তু একথা উল্লেখ করা যাবে না যে,  তিনি ব্রাক্ষ্মণদের মন্দির নির্মাণে অনেক অনুদান দিয়েছিলেন।  তাই এগুলো হচ্ছে অত্যন্ত নির্বাচিত ইতিহাস। একদিক থেকে আমরা সকলেই জানি যে আমাদের ইতিহাসগুলো মূলত নির্বাচিত ইতিহাস কেননা কারো কাছে প্রতিটি মুহূর্ত দিনক্ষণ ধরে ঘটনার বিবরণ লিপিবদ্ধ নেই। তবে এই নির্বাচিত ইতিহাসগুলো যদি মতাদর্শগত জায়গা থেকে নির্বাচিত হয়ে থাকে তাহলে ইতিহাস বিকৃত হয়েছে। সাম্প্রদায়িক ইতিহাস রচনার সমস্যা হলো ঘটনাগুলোকে যে অতিশয় গুরুত্ব দিয়েই নির্বাচন করা হয় তা নয় ররং সেগুলোর বিশ্লেষণও দলগত দৃষ্টিকোণ থেকে হয়ে থাকে।

ইতিহাস শিক্ষাপদ্ধতি আগের চেয়ে কি অনেক পরিবর্তিত হয়ে গেছে বিশেষ করে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর থেকে?

হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শ গড়ে উঠেছে বিংশ শতাব্দীতে এবং সেটি ঘাপটি মেরে বসে আছে। গেল বিশ-ত্রিশ বছর সেটি স্কুলে-কলেজের পাঠ্যবইগুলোকে গ্রাস করেছে। সাম্প্রদায়িক ইতিহাসবিদদের দৃষ্টিতে হিন্দু-মুসলিম বিভাজন খুব বড় বিষয় হিসেবে ধরা দিয়েছে।

বিশেষ করে রাজস্থান এবং উত্তরপ্রদেশে?

যে রাজ্যে বিজেপি সরকার কিংবা তার জোট রয়েছে।

একজন শিক্ষক হিসেবে আপনি নিঃসন্দেহে জানেন আমাদের স্কুল পর্যায়ে শিক্ষা ব্যবস্থার কী হাল হয়ে আছে। উত্তর প্রেদেশে ইতিহাসের বইয়ে বাবরের রাজ্যনীতি নিয়ে ইতিহাস অনেকটা পরিবর্তন করা হয়েছে? 

উত্তর প্রদেশে বিজেপি সরকার চেষ্টা করেছে এবং এই পরিবর্তনের সূত্রপাত করেছে। তারা এমন কিছু ইতিহাস বই রচনা করেছে যেখানে বাবরের রাজ্যনীতিই নয়, আর্যতত্ত্বগুলোকে পরিবর্তন করছে। তাদের এই কার্যক্রম উত্তরপ্রদেশের অনেক ইতিহাসবিদদের সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছে। আমরা কজন শিক্ষকও সেই প্রতিবাদে অংশ নিয়েছিলাম। এবং স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছি এগুলো ইতিহাস বিকৃতি। ফলে তারা তাদের কার্যক্রমটিকে প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। বর্তমানে তারা আবার রাজনৈতিকভাবে অনেক শক্তিশালী হয়ে উঠেছে ফলে সেই কার্যক্রমগুলো আবার শুরু হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। দেখা যাক কী ঘটে।

এখনো কি স্কুলের পাঠ্য বইগুলোতে সেই বিকৃত ইতিহাসগুলো পড়ানো হচ্ছে?

এখনো কিছু কিছু পাঠ্যবইয়ের পরিবর্তিত ইতিহাসগুলো সংশোধন করা হয়নি। যদিও আমার ব্যক্তিগতভাবে সেই পাঠ্যবইগুলো দেখার সুযোগ হয়নি।

আপনি কি মনে করেন সমাজের একটি নির্দিষ্ট অংশ হিন্দু জাতীয়তাবাদের সাথে ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে এক করে দেখার চেষ্টা করছে?

আমি মনে করি না যে এটি হিন্দু জাতীয়তাবাদের সাথে ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে এক করে দেখার প্রয়াস। আমরা একটি জোরালো পার্থক্য তৈরি করেছি । আমরা এক মুহূর্তের জন্য বলছি না হিন্দু জাতীয়তাবাদ ভারতীয় জাতীয়তাবাদের মতই, কারণ ভারতীয় জাতীয়তাবাদ হিন্দু জাতীয়তাবাদ থেকে অপেক্ষাকৃত ধর্মনিরপেক্ষ । বিভিন্ন কারণে হিন্দুত্ব ও হিন্দু জাতীয়তাবাদের পুনরুত্থান ঘটেছে। একদিক থেকে এটা স্পষ্ট যে ক্ষমতালোভী একটি গোষ্ঠী  জাতীয়তাবাদের মতাদর্শ ব্যবহার করে ক্ষমতায় আসতে চায়। তারা মনে করে তাদের এই জাতীয়তাবাদী ধারণা তাদেরকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করতে সহযোগীতা করবে। উদাহরণস্বরূপ, ভারতীয় জাতীয়তাবাদ উপনিবেশ বিরোধী ছিল, যার ফলপ্রসূ ভারতীয় মধ্যবিত্ত শ্রেণির ক্ষমতায়নে নেতৃত্ব দেয়ার সুযোগ হয়েছে। অন্যদিকে হিন্দু জাতীয়তাবাদও একই সুর তুলে ধরছে। যদি সেটি সফল হতে পারে তাহলে আবার আরেকটি শ্রেণি ক্ষমতায় আসবে। এই দুই জাতীয়তাবাদের সামাজিক উপাদানগুলোও আবার ভিন্ন ভিন্ন। গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক পরিবর্তনগুলোর ক্ষেত্রে দেখা যায় সমাজের বিভিন্ন স্তরে থাকা গুরত্বপূর্ণ লোকজন নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে-তারা তাদের সিদ্ধান্তগুলোকে বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে পড়ে এবং সেটি কার্যকরের ক্ষেত্রেও সিদ্ধান্ত নিতে পিছিয়ে পড়ে। সুতরাং কিছু সহজ মতাদর্শ দ্রুতই বেশি সংখ্যক মানুষকে একত্রিত করার ফলে  হিন্দু জাতীয়বাদ সহজেই  সামনে দিকে এগিয়ে চলছে।

আরেকটি বিষয় হলো যখন বিশ্বায়নের মত অর্থনৈতিক নীতির মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে যেখানে সমগ্র বিশ্ব জড়িত থাকার ফলে বহুজাতিক কম্পানীগুলোর প্রতিনিয়ত প্রতিযোগীতা এবং অংশগ্রহণ একটি নিরাপত্তাহীন পরিস্থিতির সৃষ্টি করে যা স্বদেশী চিন্তা-চেতনার মধ্যে একরকম পরিবর্তন নিয়ে আসতে বদ্ধপরিকর। আর এই প্রক্রিয়াটি বিদ্যমান সমাজব্যবস্থা এবং সেটির অর্থনীতিকে প্রকৃত অর্থে আমলে না দিয়েই স্বদেশী অর্থনীতি এবং স্বদেশী রাজনৈতিক আলোচনার থেকে দূরে সরে যায়। নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল কিংবা গোষ্ঠীগুলোর ক্ষমতার পালাবদলের মধ্য দিয়ে আমরা কেবলমাত্র শিখতে পারি কীভাবে সম্পদের বন্টন করতে হয়, সামাজিক উদ্বেগগুলোকে বন্টন করতে হয় যেন সমাজ ক্রিয়াশীল থাকে। তা না হলে হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা সেদিকেই ধাবিত হবে যেখানে ভারতীয় জাতীয়তাবাদীরা পূর্বে ছিলো। ফলে ভারতীয় সংস্কৃতি এবং ইতিহাস বিকৃত হতেই থাকবে।

শেষ পর্ব পড়তে ক্লিক করুন

Facebook Comments

comments

১ Reply to “অর্চনা মাসিহ’র সাথে কথোপকথনে রমিলা থাপার ।। অনুবাদ অজিত দাশ ।। পর্ব এক”

  1. নানক ভট্টাচার্য বলেছেন:

    ভারতীয় জাতীয়তাবাদ ও হিন্দু জাতীয়তাবাদের সংঘর্ষ ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে ভিন্নভাবে প্রকাশিত হবে,তার প্রাথমিক উচ্ছাস এখন পশ্চিমবঙ্গে বিরাজ করছে।ভারতীয় জাতীয়তাবাদের অভূথ্বানে বাংলার যে অবদান ছিল তার কথা মনে রেখে বর্তমান রাজনৈতিক সংগ্ৰাম কিছুটা পরিবর্তিত হবে তা শুধু সময়েয় অপেক্ষায়।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top