রবীন্দ্রনাথ: বাল্যশিক্ষা ও শিক্ষককুল II ড. নুরুল আনোয়ার

 “He who has lost the child in himself is

 absolutely unfit for the great work of

 educating human children.”

                                        -Rabindranath Tagore

সভ্যতার মহামানব  

বাঙালি জীবনের এবং সাহিত্য, সঙ্গীত ও সংস্কৃতির পরতে পরতে রবীন্দ্রনাথ আত্মিক বন্ধনে বাঁধা। রবীন্দ্রচর্চা অব্যাহতভাবে বিস্তৃত হয়েছে স্বদেশে ও বিদেশে। রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পেরেছিলেন, সাহিত্যিকের পক্ষে নির্জনতার অবকাশ সুবিধাজনক। কিন্তু মানুষ ও তার সমাজকে গভীরভাবে জানতে এবং অনুধাবন করতে হলে সমাজ বিচ্ছিন্ন থাকা চলবে না। সমাজ ও তার অনিবার্য বিষয়গুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়া একান্ত প্রয়োজন। রবীন্দ্রনাথ মানুষের জীবনযাপন, আর্থসামাজিক চিত্র, শিক্ষা, কৃষি, সঙ্গীত ও শিল্প-সাহিত্য সকল বিষয়ে মানুষের মুক্তির জন্য অক্লান্ত পরিশ্রমে বহু কর্মকান্ড গড়ে তুলেছিলেন। এসব কিছুর আড়ালে রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পেরেছিলেন, এদেশের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং শিক্ষাদানের প্রণালীও পাঠক্রম আমাদের দেশের তরুণদের জন্য অন্ত্যন্ত অনুপযোগী। কেবলই ইংরেজের শাসন শোষণ পাকাপাকি করা হচ্ছে।

শিশু ও বালক বয়সে রবীন্দ্রনাথ গৃহ ও স্কুলে যে তিক্ত অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন, সে সম্বন্ধে তিনি বারবার উল্লেখ করেছেন বিভিন্ন গ্রন্থে ও স্মৃতিচারণে। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাজীবন ১৮৬৬ থেকে ১৮৮০ এই চৌদ্দ বৎসরব্যাপী ব্যাপৃত ছিল। মোট ৭টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠ নিয়েছিলেন। কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই তিনি লগ্ন হতে পারেন নি। এই রবীন্দ্রনাথই সমগ্র বিশ্বব্যাপী শিক্ষা পদ্ধতি অন্বেষণ করেছেন। পরে তিনি শান্তিনিকেতন আশ্রমিক স্কুল(১৯০১) এবং বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা করেন (১৯২১) এবং অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে তিনি জাতিকে মুক্তি ও জ্ঞানের পথ দেখিয়েছিলেন।

গৃহশিক্ষা ও স্কুলবাড়ি ব্যবস্থা, শিশু শিক্ষা

রবীন্দ্রনাথের জন্মের আগে ও পরে সরকারি বিদ্যালয় নানা জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হলেও শিশুশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কোন ব্যবস্থা ছিল না, গড়েও উঠেনি। শিশুশিক্ষার জন্য গৃহশিক্ষকরাই শিশুদের লেখাপড়া তদারকি করতেন। অবস্থা সম্পন্ন বাঙালির গৃহে গড়ে উঠেছিল স্কুলবাড়ি ব্যবস্থা। খগেন্দ্রনাথ চট্রোপাধ্যায়ের লেখায় দেখা যায়, ‘তখন সকল সম্ভ্রান্ত পরিবারে বাহির মহলে বালকদিগের পড়িবার জন্য স্বতন্ত্র একটি স্থান থাকিত। তাহাতে ঝুলানো থাকিত চাটাই এর পাখা, ব্লাকবোর্ড, মানচিত্র ও দুটি গ্লোব অর্থাৎ ভূমন্ডল ও নভমন্ডলের মানচিত্র। বাড়ির লোকে তাহাকে স্কুলঘর বলিত (রবীন্দ্রকথা)।’ প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়ও এমনি স্কুল বাড়ির ইঙ্গিত দিয়েছেন। ‘গুরুমহাশয় ঠাকুর দালানে পড়াইতেন, বাড়ির ও পাড়ার শিশুরা সকলেই একত্রে পড়িত (রবীন্দ্রজীবনী)।’

শিশু-রবীন্দ্রনাথের সর্বপ্রথম শিক্ষাদান শুরু

এমনি এক স্কুলবাড়িতে শুরু হয়েছিল শিশু রবীন্দ্রনাথের পাঠদান। খগেন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘পাঁচবছর পূর্বেই রবীন্দ্রনাথের বিদ্যাশিক্ষার আরম্ভ। কিন্তু ঠাকুরবাড়ির প্রথা ও বঙ্গদেশের প্রচলিত নীতি অনুসারে শুভদিন দেখিয়ে বাগদেবীর অর্চনাপূর্বক বালককে হাতেখড়ি ধরান হয় নাই। অন্য কোনো প্রকার আঞ্চলিক অনুষ্ঠানও এই উপলক্ষকে জয়যুক্ত করে নাই।’ খগেন্দ্রনাথের বর্ণনা থেকে আরও জানা যায়, ঠাকুরবাড়ির পূজোর দালানে ছিল ঠাকুরবাড়ির পাঠশালা বা ইস্কুলঘর। সম্ভবত এখানেই রবীন্দ্রনাথের পড়াশুনা শুরু। তার গৃহাশ্রিত গুরুর নাম ছিলো মাধবচন্দ্র  মুখোপাধ্যায়। তাঁর কাছেই রবীন্দ্রনাথের বর্ণপরিচয়। ঠাকুরবাড়ির ক্যাশবইয়ে পাওয়া যায় (১৭২৩’র ১৮ শ্রাবণ) ‘ছেলেবাবুদিগের পন্ডিত ‘খয়রাত’ বাবদ চার টাকা খরচা। মাধবচন্দ্রের অস্তিত্বকে মেনে নিলে রবীন্দ্রনাথের বলা যায় ২ বছরের বড় দাদা সোমেন্দ্রনাথ ও ভাগিনেয় সত্যপ্রসাদ এবং রবীন্দ্রনাথ এই তিনজনেই একত্রে ১৮৬৪ সালে কোন এক সময়ে মাধবচন্দ্রের পাঠশালায় বিদ্যাশিক্ষা আরম্ভ করেন। রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন তিন বছর চার মাস। মাধবচন্দ্রের স্কুলে মাস দুয়েক পড়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তারপর ১৮৬৪ তে ৩ বছর ১০ মাস বয়সে রবীন্দ্রনাথ ক্যালকাটা ট্রেনিং স্কুলে ভর্তি হন এবং কয়েক মাস পড়েছিলেন। সেখানকার অমানবিক শাসন প্রণালী রবীন্দ্রনাথ কখনো ভুলতে পারেননি। সংকীর্ণচিত্তমনস্ক শিক্ষকদের মনস্তত্বের ধারণা লেশমাত্র ছিল না। বিদ্যালয় এবং গৃহশিক্ষার শিক্ষকদের এই অযোগ্যতা রবীন্দ্রনাথ আজীবন মনে রেখেছেন।

১৮৬৫’র পরবর্তী স্কুল জীবন ও শিক্ষকবৃন্দ

ক্যালকাটা ট্রেনিং স্কুলের পরবর্তীকালে অর্থাৎ ১৮৬৫’র পূজার পর থেকে ১৮৬৬’র গোড়া পর্যন্ত আনুমানিক ৬ মাস রবীন্দ্রনাথের পড়াশোনা গৃহস্থ গুরুমশাইয়ের কাছেই হয়েছিল। এই গুরুমশাইয়ের সাক্ষাৎ পরিচয় কারো জানা নেই। তবে ‘রবীজীবনী’ লেখক প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় ইঙ্গিত দিয়েছেন- ‘১৮৬৬’র ২ আগস্ট বৃহস্পতিবারের হিসাব লেখা,  বং ব্রজেন্দ্রনাথ রায়। দং ছেলেবাবুদিগের/ পন্ডিতকে খয়রাত বিঃ / এক ভাওচার ৪ / এই ব্রজেন্দ্রনাথ রায় রবীন্দ্রনাথের মা সারদা দেবীর ভ্রাতা ছিলেন। তিনি ঠাকুরবাড়িতেই থাকতেন এবং হিসাবপত্র দেখাশোনা করতেন।

এ সময়কার গৃহশিক্ষকদের মধ্যে যাকে অস্তিত্বশুদ্ধ অনুভব করা যায়। তিনি হলেন নর্মাল স্কুলের নীলকমল ঘোষাল। গুরুমশাই হিসাবে মাধবচন্দ্র বা ব্রজেন্দ্রনাথ রায় রবীন্দ্রনাথের কাছে অনুমান মাত্র। কিন্তু নীলকমল ঘোষালের প্রত্যক্ষ উপস্থিতি ঠাকুরবাড়ির ক্যাশবহি, রবীন্দ্রজীবনী গ্রন্থ সর্বত্রই লক্ষ্য করা যায়। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন- ‘তখন নর্মাল স্কুলের একটি শিক্ষক শ্রীযুক্ত নীলকমল ঘোষাল মহাশয় বাড়িতে পড়াইতেন। তাঁহার শরীর ক্ষীণ শুষ্ক ও কন্ঠস্বর তীক্ষ্ম ছিল। তাঁহাকে মনুষ্যজন্মধারী একটি ছিপছিপে বেতের মত বোধ হইত। সকাল ছয়টা হইতে সকাল নয়টা পর্যন্ত আমাদের শিক্ষাভার তাঁহার উপর ছিল।’

তথ্যাদি এবং এসব লেখা থেকে বোঝা যায়, ১৭২৩’র ১লা কার্তিক (১৭ অক্টোবর ১৮৬৬) থেকে মাসিক ১০ টাকা বেতনে নীলকমল বাবু গৃহশিক্ষক হিসাবে নিযুক্ত হন এবং ১২৭৮’র মাঘ মাস থেকে (ফেব্রুয়ারি, ১৮৭২) পর্যন্ত (৪ বছর তিন মাস) তিনি বালক রবীন্দ্রনাথকে ছাত্র হিসাবে পেয়েছিলেন। নীলকমল বাবু হয়তো স্কুলের নির্দিষ্ট পাঠক্রমের বাইরে বহু বিষয়ই ঠাকুরবাড়ির ছেলেদের পড়াতেন। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘চারুপাঠ বস্তুবিচার, প্রাণীবৃত্তান্ত হইতে আরম্ভ করিয়া মাইকেলের মেঘনাথবধ কাব্য পর্যন্ত ইহার কাছে পড়া।’ এছাড়া পড়েছেন বর্ণপরিচয়, বোধোদয়, ভূগোল, ইতিহাস ইত্যাদি। লক্ষণীয় নীলকমল বাবুর তত্ত্বাবধানে ইংরেজী ভাষা শিক্ষার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। তাই ইংরেজী ভাষা শিক্ষার জন্য ব্যবস্থা হলো রাখালদাস দত্তকে নিয়োগ করে (৭ অক্টোবর ১৮৬৮)।

রবীন্দ্রনাথ রাখালবাবুর কাছে ইংরেজী পড়েছিলেন ১৮৬৯’র ২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অর্থাৎ মাস পাঁচেক। রবীন্দ্রনাথ বর্ণ পরিচয়ের মত গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পন্ন করে রাখালদাস দত্ত চলে গেলেন। রাখালদাস বাবুর চলে যাওয়ার পর ১৮৬৯’র ৫ মার্চ থেকে রবীন্দ্রনাথসহ তিন বালককে ইংরেজী পড়ানো দায়িত্ব পেলেন মেডিকেল কলেজের ছাত্র অঘোরনাথ চট্রোপাধ্যায়। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর তিনি পড়াতে আসতেন। একে সন্ধ্যা, শরীর ক্লান্ত, আবার ইংরেজীর মত একটি বিজাতীয় বিষয়। ফলে শিক্ষক অঘোরবাবুর সমস্ত চেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘অঘোরবাবু যে কঠোর মাষ্টারমশাই জাতের মানুষ ছিলেন, তাহা নহে। তিনি ভুজবলে আমাদের শাসন করিতেন না। মুখেও যেটুকু গর্জন করিতেন, তাহার মধ্যে অর্জনের ভাগ বিশেষ কিছু ছিল না বলিলেও হয়। মাষ্টারমশাই মিটমিটে আলোয় পড়াতেন প্যারী সরকারের ফার্স্ট বুক। প্রথমে উঠত হাই, তারপর আসত ঘুম। তারপর চলত চোখ রগড়ানি(ছেলেবেলা)। প্যারীসরকারের ফার্স্ট বুক, সেকেন্ড বুক, ইংরেজী গ্রামার ইত্যাদি পড়তে পড়তে রবীন্দ্রনাথের মনে হয়ত ইংরেজী ভীতির সৃষ্টি হয়েছিল। তবে শেখানোর ক্ষেত্রে অঘোরবাবুর চেষ্টার ত্রুটি ছিল না। ঠাকুরবারির অভিবাবকদের কাছে তাই অঘোরনাথের একটা উচ্চাসন ছিল।

নর্মাল স্কুল, বেঙ্গল একাডেমি ও বিদ্যাসাগর স্কুল

ঠাকুর বাড়ির অভিবাবকেরা রবীন্দ্রনাথসহ তিন বালকের শিক্ষা নিয়ে ক্রমশ বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন। নর্মাল স্কুলের পর বেঙ্গল একাডেমি তারপর বিদ্যাসাগর স্কুল বা মেট্রোপলিটন স্কুলে ভর্তি হলেন সোমেন্দ্র, সত্যপ্রসাদ ও রবীন্দ্রনাথ। সেখানেও ক্রমাগত স্কুলে অনুপস্থিত থাকা বালকদের স্কুল বিমুখতা নিয়ে অভিভাবকরা দুশ্চিন্তা ও বিব্রত অবস্থায় পড়েছিলেন। এই সময়ে সর্বজ্যেষ্ঠ দ্বিজেন্দ্রনাথ বালকদের দেখাশোনা করতেন। ১৮৭৪’র ৬ ফেব্রুয়ারি শ্রী দ্বিজেন্দ্রনাথ শর্ম্মণ জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে জানিয়েছেন, ‘জ্যোতি স্কুলে বালকেরা টেকিতে পারিলনা, আমি দুই প্রহর হইতে ৪টা পর্যন্ত এবং পন্ডিত সকাল বেলায় তাহাদিগকে পড়াইতেছে। তাহাদের স্কুল অপেক্ষা ভাল পড়া হইতেছে।’

জ্ঞানচন্দ্র ভট্রাচার্য’র শিক্ষাদান

এই সময় ঠাকুরবাড়িতে একজন গৃহশিক্ষক ছিলেন। যার নাম জ্ঞানচন্দ্র ভট্রাচার্য। জ্ঞানচন্দ্র শিক্ষক হিসাবে সঠিক ভূমিকা পালন করেছিলেন- তিনি ইংরেজী পড়াতে আসতেন সকালে, বালকদের জন্য সুবিধা হলো। স্কুলের পাঠ্যতালিকাভুক্ত বইগুলো অবলম্বনে জ্ঞানচন্দ্র ভাষা শেখানোর ব্যবস্থা করলেন। Doglus Series এর Poetical Selection। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ জ্ঞানচন্দ্রেরও সকল চেষ্টা ব্যর্থ করে দিলেন। তখন জ্ঞানচন্দ্র স্কুলের পাঠ্যতালিকাভুক্ত বইগুলো বাদ দিয়ে সাহিত্যচর্চার ভেতরে নিতে চাইলেন রবীন্দ্রনাথকে। সংস্কৃত শিক্ষক না হয়েও ‘কুমারসম্ভব’ পড়াতে লাগলেন এবং ‘ম্যাকবেথ’ মানে করে বুঝিয়ে তাঁর ছন্দোবদ্ধ বাংলা অনুবাদ করাতে শুরু করলেন। রবীন্দ্রনাথ ‘জীবনস্মৃতিতে’ লিখেছেন, ‘ইস্কুলের পড়ায় যখন তিনি কোনোতেই আমাকে বাঁধতে পারলেন না, তখন হাল ছাড়িয়া দিয়া অন্যপথ ধরিলেন।’ তবে ইংরেজী ভাষা শিক্ষক হিসাবে জ্ঞানচন্দ্র রবীন্দ্রনাথের মনে স্থায়ী আসন পেয়েছিলেন। জ্ঞানচন্দ্রকে শিক্ষক হিসাবে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল তা নয়। তিনি মাসিক ২০ টাকা বেতনে ইংরেজী শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন এবং মেট্রোপলিটন ইন্সটিটিউশনের সুপারিনডেন্টও ছিলেন।

ঠাকুরবাড়ি অভিভাবকেরা বাড়ির ছেলেদের শৈশবেই সংস্কৃত ভাষা সাহিত্যের পরিচয় করাতে চেয়েছেন। এ বিষয়ে শিক্ষক ছিলেন হেরম্ব তত্ত্বরত্ন, রামসর্বস্ব পন্ডিত, হরিনাথ ভট্রাচার্য এবং দীননাথ ন্যায়রত্ন। রবীন্দ্রনাথ ‘জীবনস্মৃতি’র নানা বিদ্যার আয়োজন অংশে হেরম্বচন্দ্র তত্ত্বরত্ননের কথা উল্লেখ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ উল্লেখিত সূত্র অনুযায়ী হেরম্ব তত্ত্বরত্ন তাঁকে (রবীন্দ্রনাথকে) সংস্কৃত পড়াতেন। রবীন্দ্রনাথ মাধবচন্দ্রের পাঠশালায় পড়াশোনা করেছেন ১৮৬৬ তে। এরপর চার বছর পরে ১৮৬৯-এ ইংরেজী চর্চার শুরু। অন্যদিকে সংস্কৃতচর্চা শুরু হয় ১৮৭১-এ। রবীন্দ্রনাথ বিদ্যারম্ভে মাতৃভাষা, চারবছর পর দ্বিভাষা এবং পরে ত্রিভাষা নীতি গ্রহণ করায় প্রকারান্তরে তিনটি ভাষায় বুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন। নীলকমলবাবু মাতৃভাষায় ভাব প্রকাশের সেই বুনিয়াদটি রচনা করে দিয়ে গিয়েছিলেন বলেই পরবর্তী সময় জ্ঞানচন্দ্র ভট্রাচার্য বা রাম সর্বস্ব পন্ডিতের মত শিক্ষকেরা ইংরেজী বা সংস্কৃত ভাষা চর্চার প্রতিভা বিকাশে সাহায্য করতে পেরেছিলেন।

সেন্ট জেভিয়ার’স স্কুল এবং ইংল্যান্ডের পড়াশোনা

১৮৭৫ সালে রবীন্দ্রনাথ সেন্ট জেভিয়ার’স স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন। বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের প্রিয় মানুষটি ছিলেন Reverend Alphonse de Parranda । এই শিক্ষককে রবীন্দ্রনাথ সব সময় মনে রেখেছেন এবং বলেছেন শুধু পান্ডিত্য নয় পান্ডিত্যের সঙ্গে ধৈর্য, সহিষ্ণুতা আর ভালবাসাই একজন মানুষকে প্রকৃত শিক্ষক করে তোলে। এই স্কুলে রবীন্দ্রনাথ মানিয়ে নিতে পারেননি। ১৮৭৬ সালে সহপাঠী সোমেন্দ্রনাথ ও সত্যপ্রসাদ এন্ট্রান্স ক্লাশে পৌঁছে গেলেও রবীন্দ্রনাথ ফিফথ ইয়ার ক্লাসে রয়ে গেলেন। অভিভাবকরা অনুধাবন করলেন রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে আর বিদ্যালয় শিক্ষা সম্ভব নয়। খরচের বোঝা না-বাড়িয়ে অভিভাবককুল রবীন্দ্রনাথকে ১৮৭৮ সালে অক্টোবর মাসে ইংল্যান্ডের ব্রাইটনে পাঠালেন সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে। ব্রাইটন থেকে আবার চলে এসেছিলেন লন্ডনে। প্রথাগত শিক্ষা গ্রহণের জন্যই। এখানে ডাক্তার স্কটের বাড়িতে কিছুদিন কাটানোর পর তারকনাথ পালিতের উদ্যোগে ১৮৬৯’র ১৩ নভেম্বর University College, London এর  Faculty of Arts and Laws বিভাগে কেবল মাত্র ইংলিশ Class এর জন্য ভর্তি হন। মাত্র ৩ মাস পাঠের পর তাঁর ছাত্রজীবন শেষ হয়। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাজীবনের পরিধি হয়ে থাকল ১৮৬৬ থেকে ১৮৮০ পর্যন্ত (চৌদ্দবৎসর)।

[ডক্টর নুরুল আনোয়ার প্রাক্তন প্রফেসর, বাকৃবি, ময়মনসিংহ; সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ, ঢাকা। ]

Facebook Comments

comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top