[মুন্সী প্রেমচন্দ (১৮৮০-১৯৩৬) আধুনিক উর্দু-হিন্দী কথাসাহিত্যের এক প্রতিভাবান পুরুষ। ডজনখানেক উপন্যাস এবং আড়াই শয়ের বেশি ছোটগল্পের রচয়িতা প্রেমচন্দ চিন্তায় ছিলেন তার সময়ের চেয়ে প্রাগ্রসর। কথাসাহিত্য ছাড়াও তিনি নাটক এবং প্রবন্ধ রচনা করেছেন। বিভিন্ন ব্যক্তিকে লেখা তার চিঠিপত্র সংকলিত হয়েছে যাতে প্রেমচন্দের সাহিত্যিক ভাবনার পরিচয় পাওয়া যায়। প্রগতিশীল হিসেবে তিনি আজীবন সমাদৃত হয়েছেন লেখকসমাজে। মূল হিন্দী থেকে অনূদিত বর্তমান প্রবন্ধটি ১৯৩৬ সালে লক্ষ্ণৌয়ে অনুষ্ঠিত প্রগতিশীল লেখক সংঘের প্রথম অধিবেশনের সভাপতির ভাষণ হিসেবে পঠিত।]
সুধিবৃন্দ
এই সম্মেলন আমাদের সাহিত্যের ইতিহাসে এক স্মরণীয় ঘটনা। আমাদের সম্মেলন এবং সংগঠনগুলোতে এখন অব্দি সাধারণভাবে ভাষা এবং তার প্রচারের ব্যাপারেই বিতর্ক চলেছে। এমনকি হিন্দি এবং উর্দুর যে প্রাথমিক সাহিত্য পাওয়া যাচ্ছে তাদের উদ্দেশ্য, বিবেচনা আর ভাবের উপর প্রভাব বিস্তার করা নয়, উদ্দেশ্য ছিল কেবল ভাষার নির্মাণ। তাও নিশ্চয়ই এক মহত্বপূর্ণ কাজ ছিল। যতক্ষণ পর্যন্ত ভাষা এক স্থায়ী রূপ গ্রহণ না করবে, তার মাঝে বিবেচনা আর ভাব ব্যক্ত করার শক্তিইবা কোথা থেকে আসবে। আমাদের ভাষার ‘পায়োনিয়ার’রা–পথ যারা তৈরি করেছিলেন–হিন্দুস্থানী ভাষা নির্মাণ করে জাতির যে উপকার করেছেন, তার জন্য আমরা যদি তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ না করি তবে সেটা আমাদের কৃতঘ্নতাই হবে।
ভাষা আসলে সাধন, সাধ্য নয়। এখন আমাদের ভাষা সেই রূপ লাভ করেছে যে আমরা এখন ভাষা থেকে সামনে এগিয়ে ভাবের দিকে খেয়াল দিতে পারি এবং এই কথা বিবেচনা করতে পারি, যে উদ্দেশ্যে এই নির্মাণকার্য শুরু হয়েছিল তা কিভাবে পূর্ণ করা যায়। সেই ভাষার শুরুতে ‘বাগোবাহার’ আর ‘বৈতাল-পচীসী’ রচনাই সবচেয়ে বড় সাহিত্য সেবা ছিল, আজ তা এমন যোগ্যতা অর্জন করেছে যে তাতে শাস্ত্র এবং বিজ্ঞানের বিবেচনা করা যেতে পারে আর এই সম্মেলন এই সত্যেরই সুস্পষ্ট স্বীকৃতি।
কথাবার্তার ভাষাও রয়েছে, রয়েছে লেখার ভাষাও। কথাবার্তার ভাষাতো মীর আম্মান আর লাল্লুলালের সময়ও ছিল। কিন্তু তারা যে ভাষা ব্যবহার করলেন, সেটা ছিল লেখার ভাষা এবং তাই সাহিত্য। কথাবার্তায় আমরা আমাদের কাছের লোকের নিকট বিবেচনা প্রকাশ করি—আমাদের হাসি-কান্নার ভাবের চিত্র আঁকি। সাহিত্যিক সেই কাজই করেন লেখনি দিয়ে। হ্যাঁ, তাঁর শ্রোতার পরিধি অনেক বিস্তৃত, আর যদি তার বয়ানে সত্য থাকে, তবে যুগব্যাপী, শতাব্দীব্যাপী তাঁর রচনা হৃদয়কে প্রভাবিত করতে থাকে।
কিন্তু আমার বক্তব্য এই নয় যে, যা কিছু লেখা হয় তার সবই সাহিত্য। সাহিত্য সেই রচনাকেই বলবো যার মধ্যে কোন সত্য প্রকাশিত হয়েছে, যার ভাষা পরিপক্ব, পরিমার্জিত এবং সুন্দর আর যার মধ্যে হৃদয় এবং মস্তিস্ককে প্রভাবিত করার গুণ রয়েছে। আর সাহিত্যের মধ্যে এই গুণ পূর্ণরূপে সেই অবস্থায় উৎপন্ন হয়, যখন তার মধ্যে জীবনের সত্য এবং অনুভূতি ব্যক্ত করা হয়। তেলেসমাতি কাহিনী, ভূত-প্রেতের কথা আর প্রেম-বিরহের আখ্যান এক জমানায় আমাদের যতই প্রভাবিত করে থাকুক না কেন এখন এসবের প্রতি আমাদের আগ্রহ খুবই কম। এতে সন্দেহ নেই যে মানবপ্রকৃতির মর্মজ্ঞ সাহিত্যিক রাজকুমারদের প্রেম-কাহিনী এবং তেলেসমাতি কাহিনীর মধ্যেও জীবনের সত্য বর্ণনা করতে পারেন আর সৌন্দর্যও সৃষ্টি করতে পারেন; কিন্তু এতে এই সত্য আরো পোক্ত হয় যে প্রভাবিত করবার জন্য সাহিত্যকে জীবনের সত্যের দর্পণ হয়ে ওঠা জরুরি। তারপর আপনি তাকে যে চৌকাঠে চান লাগাতে পারেন—চড়ুই পাখির কাহিনী বা গোলাপ-বুলবুলের গল্পও তার জন্য উপযোগী হতে পারে।
সাহিত্যের অনেক সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে; কিন্তু আমার মতে এর সর্বোত্তম সংজ্ঞা ‘জীবনের সমালোচনা’। প্রবন্ধ হোক, কাহিনী হোক কিংবা কাব্য তাকে আমাদের জীবনের সমালোচনা এবং ব্যাখ্যা করতেই হবে।
আমরা যে যুগ এইমাত্র পার করেছি, জীবনের সাথে তার কোনো সম্পর্ক ছিল না। আমাদের সাহিত্যিকগণ কল্পনার এক সৃষ্টি খাড়া করে তার মধ্যে মনের মত তেলেসমাতি দেখাতেন। কোথাও আজগুবি কাহিনী ছিল, কোথাও কল্পনার বাগান আর কোথাও চন্দ্রকান্তা সন্ততির গল্প। এইসব আখ্যানের উদ্দেশ্য ছিল কেবল মনোরঞ্জন আর আমাদের অদ্ভুত-রস-প্রেমের তৃপ্তি। জীবনের সাথে সাহিত্যের কোনো সম্পর্ক, এ ছিল কল্পনাতীত। কাহিনী কাহিনী, জীবন জীবন। দুটিকে পরস্পরবিরোধী বস্তু হিসেবে দেখা হতো। কবিদের মনে ব্যক্তিবাদের রঙ মাখানো ছিল। প্রেমের আদর্শ ছিল বাসনাকে তৃপ্ত করা, আর সৌন্দর্যের চোখকে। এইসব শৃঙ্গারজাত ভাবকে প্রকাশ করার মধ্যে কবিগণ নিজের প্রতিভা আর কল্পনাশক্তির চমৎকারিত্ব দেখাতেন। ওদের মধ্যে কোনো নতুন শব্দ-যোজনা, নতুন কল্পনা থাকাই প্রশংসা পাবার জন্য যথেষ্ট ছিল—বাস্তবতা থেকে যতই দূরে থাক না কেন তা। পাখির বাসা আর পিঞ্জর, বরফ আর খামারের কল্পনা, বিরহ দশার বর্ণনায় নিরাশা আর বেদনার বিভিন্ন অবস্থা এমনভাবে দেখানো হতো যে শ্রবণকারীর মন সহজেই জয় করে নিত। আর আজও এই ধরনের কবিতা কতটা লোকপ্রিয় তা আপনি আর আমি খুব ভাল করেই জানি।
নিঃসন্দেহে কাব্য-সাহিত্যের উদ্দেশ্য আমাদের অনুভূতির তীব্রতা বাড়ানো; কিন্তু মানুষের জীবন কেবল নারী-পুরুষের প্রেমের জীবন নয়। যে সাহিত্যের বিষয় কেবল শৃঙ্গারজাত মনোভাব এবং তা থেকে উৎপন্ন বিরহ-ব্যথা, নিরাশা ইত্যাদি অব্দি সীমিত—যাতে জীবন এবং জীবনের কঠিনতা থেকে দূরে পালানোর জীবনের সার্থকতা দেখানো হয়েছে তা কি আমাদের বিবেচনা ও বোধ সম্পর্কিত আবশ্যকতা পূর্ণ করতে পারে? শৃঙ্গারজাত মনোভাব মানুষের জীবনের একটি অঙ্গ মাত্র আর যে সাহিত্যের অধিকাংশ এর সঙ্গে সম্পর্কিত, তা সেই জাতি আর সেই যুগের জন্য গর্ব করবার মত বস্তু হতে পারে না, পারে না তার সুরুচির প্রমাণ হতে।
কি হিন্দি কি উর্দু—কবিতায় দুয়েরই একই অবস্থা ছিল। সেই সময়ে সাহিত্য আর কাব্যের বিষয়ে যে লোকরুচি ছিল তার প্রভাব থেকে মুক্ত থাকা সহজ ছিল না। প্রশংসা আর কদর পাবার বাসনা তো সবার মধ্যেই থাকে। কবিদের জন্য তাঁদের রচনাই জীবিকার উপায় ছিল। আর কবিতার কদর ধনী এবং অভিজাত ছাড়া আর কে করতে পারে? আমাদের কবিদের সাধারণ জীবনের সাধনা করা আর তার সত্যের দ্বারা প্রভাবিত হবার হয়তো উপায়ই ছিল না অথবা ছোট-বড় সকলের উপর এমন কিছু মানসিক বন্ধন চেপে ছিল যে মানসিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক জীবন অবশিষ্ট ছিল না।
আমরা এর জন্য সেই সময়কার সাহিত্যিকদের দোষ দিতে পারি না। সাহিত্য নিজের কালের প্রতিবিম্ব। যে ভাব ও বিবেচনা মানুষের হৃদয়কে স্পন্দিত করে, তাইতো সাহিত্যের উপর নিজের ছায়া ফেলে। এমন পতনকালে লোক হয় রোমান্স করে বা অধ্যাত্ম এবং বৈরাগ্যের দিকে ঝুঁকে পড়ে। যখন সাহিত্যের উপর জগতের নশ্বরতার রঙ চড়ে আর তার প্রতিটি শব্দ নৈরাশ্যের মধ্যে ডুবে থাকে, সময়ের প্রতিকূলতার কারণে কান্নায় ভরে থাকে, শৃঙ্গার যত ভাবের প্রতিবিম্ব হয়ে যায় তবে বুঝে নিতে হবে যে জাতি জড়তা আর ক্ষয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গেছে আর তার মধ্যে উদ্যোগ এবং সংঘর্ষের কোন শক্তি অবশিষ্ট নেই; সে উচ্চ লক্ষ্যের দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিয়েছে আর তার ভেতর থেকে দুনিয়াকে দেখার এবং বোঝার শক্তি লুপ্ত হয়ে গেছে।
কিন্তু আমাদের সাহিত্য-রুচি অনেক দ্রুত বদলে যাচ্ছে। এখন সাহিত্য কেবল মন ভুলানো জিনিস নয়, মনোরঞ্জন ছাড়া তার আরও উদ্দেশ্য আছে। এখন সাহিত্য কেবল নায়ক-নায়িকার মিলন-বিরহের কাহিনী শোনায় না; জীবনের সমস্যা নিয়েও বিবেচনা করে আর তার পথ বাতলায়। এখন সেই স্ফূর্তি আর প্রেরণার জন্য অদ্ভুত আশ্চর্যজনক ঘটনা খোঁজে না আর কেবল অনুপ্রাসের অন্বেষণ করে না। বরং তার রয়েছে সেইসব প্রশ্নে আগ্রহ, যাতে সমাজের মানুষ প্রভাবিত হয়। তার উৎকৃষ্টতার বর্তমান কষ্টিপাথর অনুভূতির সেই তীব্রতা যার দ্বারা সে আমাদের ভাব এবং বিবেচনায় গতি সৃষ্টি করে। নীতিশাস্ত্র আর সাহিত্যের লক্ষ্য একই নয়—কেবল উপদেশের বিধিতে পার্থক্য।
নীতিশাস্ত্র, তর্ক আর উপদেশ দ্বারা বুদ্ধি আর মনের ওপর প্রভাব ফেলতে চেষ্টা করে, সাহিত্য নিজের জন্য মানসিক অবস্থা আর ভাবের ক্ষেত্র বেছে নিয়েছে। আমরা জীবনে যা কিছু দেখি, অথবা যা কিছু আমাদের জীবনে ঘটে, সেই অনুভব আর সেই বেদনা কল্পনায় পৌঁছে সাহিত্য সৃজনের প্রেরণা দিয়ে থাকে। কবি বা সাহিত্যিকের মধ্যে অনুভূতির যত তীব্রতা হয় তার রচনা ততটাই আকর্ষণীয় এবং উচ্চশ্রেণীর হয়ে থাকে। যে সাহিত্য দ্বারা আমাদের সুরুচি জাগ্রত না হয়, আধ্যাত্মিক এবং মানসিক তৃপ্তি না পাওয়া যায় আমাদের মধ্যে গতি এবং শক্তি সৃষ্টি না হয়, আমাদের সৌন্দর্যপ্রীতি জাগ্রত না হয়—যা আমাদের সত্যিকারের সংকল্প এবং কঠিন পরিস্থিতি জয় করবার দৃঢ়তা না দেয় তা আজ আমাদের জন্য অকেজো, তাকে সাহিত্য বলার কোনো অর্থই হয় না।
পুরানো আমলে সমাজের লাগাম ছিল ধর্মের হাতে। মানুষের আধ্যাত্মিক এবং নৈতিক সভ্যতার আধার ছিল ধর্মীয় নির্দেশ আর সে কাজ করতো ভয় অথবা প্রলোভন দিয়ে—পুণ্য-পাপের শাসন ছিল তার সাধনা।
এখন সাহিত্য সে কাজ নিজের দায়িত্বে নিয়ে নিয়েছে আর তার সাধনা হলো সৌন্দর্যপ্রীতি। সে মানুষের মধ্যে সৌন্দর্যপ্রীতি জাগানোর চেষ্টা করে। এমন কোনো মানুষ নেই যার মধ্যে সৌন্দর্যের অনুভূতি নেই। সাহিত্যিকের মধ্যে এই বৃত্তি যতটা জাগ্রত ও ক্রিয়াশীল হয় তাঁর রচনা ততটাই প্রভাবশালী হয়ে থাকে। প্রকৃতি-নিরীক্ষণ আর নিজের অনুভূতির তীক্ষ্ণতার বদৌলতে তাঁর সৌন্দর্যবোধে এত তীব্রতা আসে যে, যা কিছু অসুন্দর, অভব্য, মনুষ্যত্বরহিত সেসব তাঁর জন্য অসহ্য হয়ে যায়। তার উপর সে শব্দ আর ভাবের সমস্ত শক্তি দিয়ে আক্রমণ করে। বলতে পারেন, সে মানবতা, দিব্যতা আর ভব্যতার বন্ধনে জড়িয়ে থাকে। যারা দলিত, পীড়িত, বঞ্চিত—হোক সে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী, তার পক্ষ নেয়া এবং তার ওকালতি করা সাহিত্যিকের অবশ্য কর্তব্য। সমাজ তাঁর আদালত। সেই আদালতের সামনে সে তার ফরিয়াদ পেশ করে,এর ন্যায়বৃত্তি আর সৌন্দর্যবৃত্তিকে জাগ্রত করে নিজের চেষ্টাকে সফল মনে করে।
কিন্তু সাধারণ উকিলের মত সাহিত্যিক নিজের মক্কেলের তরফ থেকে উচিত-অনুচিত সকল রকমের দাবি পেশ করেন না, অতিরঞ্জনকে ব্যবহার করেন না, নিজে নিজেই কথা বানিয়ে তোলেন না। তিনি জানেন যে এইসব যুক্তির দ্বারা সমাজের আদালতের ওপর প্রভাব ফেলতে পারবেন না। এই আদালতের হৃদয় পরিবর্তন তখনই সম্ভব যখন তিনি সত্য থেকে খানিকটাও বিমুখ না হন, নইলে আদালতের ধারণা তাঁর ব্যাপারে নষ্ট হয়ে যাবে আর তাঁর বিরুদ্ধে ফায়সালা শুনিয়ে দেবে। তিনি কাহিনী লেখেন, কিন্তু বাস্তবতা বিষয়ে খেয়াল রেখেই লেখেন; তিনি মূর্তি বানান কিন্তু এমন মূর্তি যাতে সজীবতা থাকে আর থাকে ভাবব্যঞ্জনাও—তিনি মানব প্রকৃতিকে সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে অবলোকন করেন, মনোবিজ্ঞানের অধ্যয়ন করেন আর এই চেষ্টা করেন যেন তাঁর চরিত্রেরা সকল অবস্থায় আর সকল ক্ষেত্রে এমন আচরণ করে, যেমনটা করে রক্ত-মাংসের মানুষ। নিজের সহজ সহানুভূতি আর সৌন্দর্যপ্রীতির কারণে তিনি জীবনের সেই সূক্ষ্ম স্থান অব্দি পৌঁছান, যেখানে মানুষ নিজের মনুষ্যত্বের কারণে পৌঁছতে অসমর্থ হয়।
আধুনিক সাহিত্যে বাস্তবতার চিত্র অংকনের আকুতি এতটা বাড়ছে যে আজকের গল্প যথাসম্ভব প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার সীমার বাইরে যায় না। আমরা কেবলই এই ভেবে সন্তুষ্ট হই না যে মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে সকল চরিত্র মনুষ্য-সদৃশ। বরং আমরা এ কথা বিশ্বাস করতে চাই,তারা সত্যি সত্যি মানুষ, আর লেখক যথাসম্ভব তার জীবন-চরিত্রই লিখেছেন কেননা কল্পনায় গড়ে তোলা মানুষে আমাদের বিশ্বাস নেই; তাদের কাজকর্ম এবং বিবেচনা আমাদের প্রভাবিত করে না। আমাদের এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন যে লেখক যা সৃষ্টি করেছেন, সেই চেষ্টা অভিজ্ঞতার আধারে করা হয়েছে আর নিজের চরিত্রদের জবানিতে তিনি নিজে কথা বলছেন।
এজন্যেই সাহিত্যকে কোনো কোনো সমালোচক লেখকের মনোবৈজ্ঞানিক জীবন-চরিত্র বলেছেন।
একই ঘটনা বা পরিস্থিতি থেকে সকল মানুষ সমানভাবে প্রভাবিত হয় না। প্রত্যেক মানুষের মনোবৃত্তি বা দৃষ্টিকোণ আলাদা। রচনা কৌশল আছে তার মধ্যে লেখক যে মনোভাব বা দৃষ্টিকোণ থেকে কোন বিষয়কে দেখেন পাঠকও এ বিষয়ে তার সঙ্গে একমত হয়ে যায়। সেটাইতো লেখকের সফলতা। সেই সাথে আমরা সাহিত্যিকের কাছে এটাও আশা করি যে তিনি নিজের বহুজ্ঞতা এবং বিবেচনার বিস্তৃতি দিয়ে আমাদের জাগ্রত করবেন, আমাদের দৃষ্টি তথা মানসিক পরিধিকে বিস্তৃত করবেন—তাঁর দৃষ্টি যেন এতটা সূক্ষ্ম, এতটা গভীর আর এতটা বিস্তৃত হয় যে তার রচনা থেকে আমরা আধ্যাত্মিক আনন্দ এবং শক্তি পাই।
শোধনের যে অবস্থায় সে আছে, তার চেয়ে ভাল অবস্থায় যাবার প্রেরণা সকল মানুষের মধ্যেই মজুদ থাকে। আমাদের মধ্যে যে দুর্বলতা রয়েছে তা অসুখের মতো আমাদের সাথে লেপ্টে থাকে। যেমন শারীরিক স্বাস্থ্য একটা প্রাকৃতিক বিষয় আর অসুখ তার উল্টো সেরকম নৈতিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যও প্রাকৃতিক বিষয় আর আমরা মানসিক এবং নৈতিক বন্ধনে সেইরকম সন্তুষ্ট থাকতে পারিনা যেমন কোনো রোগী রোগ হলে সন্তুষ্ট থাকে না। যেমন সে সবসময়ই কোন চিকিৎসকের সন্ধানে থাকে, সেরকম আমরাও এই ফিকিরে থাকি যে কোনোরকমে আমাদের দুর্বলতাগুলোকে দূরে সরিয়ে ফেলে ভালো মানুষ হতে পারি। এজন্য আমরা সাধু ফকিরের সন্ধানে থাকি, পুজা-পাঠ করি, মুরব্বিদের কাছে গিয়ে বসি, বিদ্বানদের বক্তব্য শুনি আর সাহিত্য পাঠ করি।
আর আমাদের সকল দুর্বলতার জিম্মাদারী আমাদের কুরুচি এবং ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণের ওপর। যেখানে সত্য সৌন্দর্য-প্রীতি রয়েছে, যেখানে প্রেমের বিস্তৃতি রয়েছে, সেখানে দুর্বলতা কীভাবে বসবাস করতে পারে? ভালোবাসাই তো আধ্যাত্মিক ভোজন আর সমস্ত দুর্বলতা সৃষ্টি হয় এই ভোজন না মিললে অথবা দূষিত ভোজন মিললে। শিল্পী আমাদের মধ্যে সৌন্দর্যের অনুভূতির সৃষ্টি করে, সৃষ্টি করে প্রেমের উষ্ণতা। তাঁর একটি বাক্য, একটি শব্দ, একটি সংকেত এমনভাবে আমাদের ভেতরে গিয়ে বসে যে আমাদের অন্তঃকরণ আলোকিত হয়ে যায়। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত শিল্পী নিজে এই সৌন্দর্যপ্রীতির দ্বারা আপ্লুত না হন আর তাঁর আত্মা স্বয়ং এই জ্যোতিতে ভাস্বর না হয় তিনি আমাদেরকে আলো কী করে দিতে পারেন?
এখন প্রশ্ন হলো সৌন্দর্য আসলে কি বস্তু? দৃশ্যত এ প্রশ্ন প্রায় নিরর্থক বলে মনে হয় কেননা সৌন্দর্য বিষয়ে আমাদের মনে কোন শঙ্কা বা সন্দেহ নেই। আমরা সূর্য ওঠা এবং ডোবা দেখি, সকাল আর সন্ধ্যার লালিমা দেখি, সুন্দর সুগন্ধ ভরা ফুল দেখি, মিষ্টি গান করা পাখি দেখি, কলকল করে বয়ে যাওয়া নদী দেখি নাচতে থাকা ঝরনা দেখি—এইতো সৌন্দর্য।
এসকল দৃশ্য দেখে আমাদের মন কেন উল্লসিত হয়ে ওঠে? এইজন্য যে এদের মধ্যে রঙ বা ধ্বনির সামঞ্জস্য রয়েছে। বাদ্যের স্বরসাম্য অথবা তাল সংগীতের মোহনীয়তার কারণ। আমাদের রচনাই তত্ত্বের সমানুপাতিক সংযোগে সৃষ্টি হয়েছে; সেজন্য আমাদের আত্মা সর্বদা সেই সাম্য বা সামঞ্জস্যের খোঁজে থাকে। সাহিত্য শিল্পীর আধ্যাত্মিক সামঞ্জস্যের ব্যক্ত রূপ আর সামঞ্জস্য সৌন্দর্যের সৃষ্টি করে, এর বিনাশ করে না। সে আমাদের মধ্যে বিশ্বস্ততা, সত্য, সহানুভূতি, ন্যায়প্রীতি আর মমতার ভাব সৃজন করে। যেখানে এসকল ভাব, সেখানেই দৃঢ়তা আর জীবন; যেখানে এসবের অভাব, সেখানেই শত্রুতা, বিরোধ আর স্বার্থপরতা—হিংসা, দাঙ্গা আর মৃত্যু। এই মতভেদ, বিরোধ প্রকৃতিবিরোধী জীবনের লক্ষণ, যেমন অসুখ প্রকৃতিবিরোধী আহার-বিহারের চিহ্ন। যেখানে প্রকৃতির সঙ্গে অনুকূলতা এবং সাম্য রয়েছে সেখানে সংকীর্ণতা আর স্বার্থের অস্তিত্ব কেমন করে সম্ভব? যখন আমাদের আত্মা প্রকৃতির মুক্ত আলো-বাতাসে লালিত পালিত হয় তখন নীচতা আর দুষ্ট স্বভাবের পোকারা হাওয়া আর আলোর প্রভাবে আপনা-আপনি মরে যায়। প্রকৃতি থেকে বিযুক্ত হয়ে নিজেকে সীমিত করার ফলেই এইসব মানসিক এবং ভাবগত অসুখ তৈরি হয়। সাহিত্য আমাদের জীবনকে স্বাভাবিক এবং স্বাধীন বানায়। অন্যভাবে বলা যায়, তার কারণে এই মনের সংস্কার হয়ে থাকে। এই তার মুখ্য উদ্দেশ্য।
‘প্রগতিশীল লেখক সংঘ’, এই নামই আমার বিবেচনায় ভুল। সাহিত্যিক বা শিল্পী স্বভাবতই প্রগতিশীল। এটা যদি তাঁর স্বভাব না হতো, তাহলে সম্ভবত তিনি সাহিত্যিকই হতেন না। তাঁর নিকট নিজের ভেতরে এক ধরনের কমতি অনুভূত হয় এবং বাইরেও। এই কমতিকে পূর্ণ করবার জন্য তাঁর আত্মা ব্যাকুল থাকে। নিজের কল্পনায় তিনি ব্যক্তি এবং সমাজকে সুখ আর স্বাচ্ছন্দ্যের যে অবস্থায় দেখতে চান তা তিনি দেখতে পান না। এইজন্য, সমকালীন মানসিক ও সামাজিক অবস্থার প্রতি তাঁর মন তিতিবিরক্ত থাকে। তিনি এই অপ্রিয় অবস্থার অবসান ঘটাতে চান, যাতে এই দুনিয়া বেঁচে থাকবার এবং মরবার জন্য এর চেয়ে ভাল জায়গা হয়ে ওঠে। এই বেদনা আর এই ভাব তাঁর হৃদয় ও মস্তিষ্ককে সক্রিয় করে রাখে। তাঁর কষ্টে ভরা হৃদয় সহ্য করতে পারে না যে একটি শ্রেণী কেন সামাজিক নিয়ম আর উচ্চশ্রেণীর বন্ধনে পড়ে যাতনা ভোগ করছে? কেন আমরা সেই জিনিস সঞ্চয় করি না যার দ্বারা গোলামী আর গরিবী থেকে মুক্তি পাওয়া যায়? তিনি এই বেদনাকে যতটা অস্থিরতার সঙ্গে অনুভব করেন, তাঁর রচনায় ততটাই জোর এবং সত্যতা সৃষ্টি হয়। নিজের অনুভূতিকে তিনি যে ক্রমানুসারে ব্যক্ত করেন তাই তার কলা-কুশলতার রহস্য। কিন্তু সম্ভবত এই বিশেষত্বের উপর জোর দেয়ার প্রয়োজন হয়েছে এই জন্য যে প্রগতি বা উন্নতির অর্থ প্রত্যেক লেখক বা গ্রন্থকার একইভাবে গ্রহণ করেন না। যে অবস্থাকে একশ্রেণী উন্নতি ভাবেন, অন্য শ্রেণী তাকে নিঃসন্দেহে অবনতি বলতে পারেন; এজন্য যে সাহিত্যিক নিজের শিল্পকে কোন উদ্দেশ্যের অধীন করতে চান না তাঁদের বিবেচনায় শিল্প কেবল মনোভাবের ব্যক্তিকরণের নাম, সেই ভাব থেকে ব্যক্তি বা সমাজের উপর যে কোন প্রভাব পড়ুক না কেন।
আমাদের নিকট উন্নতির তাৎপর্য হলো এই, যা থেকে আমরা দৃঢ়তা এবং কর্মশক্তি পাই, যা থেকে আমরা নিজেদের দুঃখের পরিস্থিতির ধারণা পাই, আমরা দেখতে পাই কোন অন্তর্গত কারণে আমরা এই নির্জীবতা আর অবনতির অবস্থায় পৌঁছে গেছি, আর যার দ্বারা আমরা এইসব অবস্থা দূর করবার চেষ্টা করতে পারি।
আমাদের জন্য কবিতার সেই ভাব নিরর্থক, যা থেকে সংসারের নশ্বরতার আধিপত্য আমাদের হৃদয়ে আরও দৃঢ় হয়ে যায়, যার দ্বারা আমাদের হৃদয় নৈরাশ্যে ছেয়ে যায়। সেই সব প্রেম-কাহিনী যার দ্বারা আমাদের মাসিক পত্রিকার পৃষ্ঠা ভরে থাকে, আমাদের জন্য অর্থহীন, যদি সেগুলো আমাদের মধ্যে গতি আর উত্তাপ সৃষ্টি করতে না পারে। যদি আমরা দুজন যুবক-যুবতীর প্রেম কাহিনী বলি কিন্তু তা আমাদের সৌন্দর্যপ্রীতিতে কোনো প্রভাব না ফেলে আর কেবল আমরা তাদের বিরহব্যথায় কাঁদি তবে তার দ্বারা আমাদের মধ্যে কোন মানসিক বা রুচি-সম্বন্ধিত গতি সৃষ্টি হবে? এইসব ব্যাপারে কোনো এক সময় আমাদের মনে ভাবাবেশ তৈরি হয়েছে তো হয়েছে কিন্তু আজকের জন্য এই সব বেকার। এইসব ভাবোত্তেজক শিল্পের জমানা এখন আর নেই। এখন আমাদের সেই শিল্পের প্রয়োজন, যাতে কর্মের বার্তা আছে। এখনতো কবি ইকবালের সাথে আমরাও বলি:
রমজে হায়াত জোই জুয দর তপিশ নয়াব
দরকুলজুম আরমীদন তংগস্ত আবে জুরা।
ব আশিয়াঁ ন নশীনম যে লজযতে পরওয়ায,
গহে বশাখে গুলম গহে বরলবে জুয়ম।
(যদি তুমি জীবনের রহস্যের খোঁজ করতে চাও, তবে তা তুমি সংঘর্ষ ছাড়া আর কোনো ভাবে পাবে না—সাগরে গিয়ে বিশ্রাম করা নদীর জন্য লজ্জার কথা। আনন্দ পাবার জন্য আমি কখনো পাখির বাসায় গিয়ে বসি না,—কখনো ফুলের শাখায় কখনো নদীর তীরে যাই।)
সুতরাং আমাদের পথে অহংবাদ বা নিজের ব্যক্তিগত দৃষ্টিকোণকে প্রাধান্য দেয়া সেই বস্তু, যা আমাদের জড়তা, পতন আর দায়িত্বহীনতার দিকে নিয়ে যায় এবং সেই শিল্প আমাদের জন্য না ব্যক্তিগতভাবে না সমষ্টিগতভাবে উপযোগী হয়।
এ কথা বলতে আমার দ্বিধা নেই যে আমি অন্য বস্তুর মতো শিল্পকেও উপযোগিতার মানদণ্ডে দেখতে চাই। নিঃসন্দেহে শিল্পের উদ্দেশ্য সৌন্দর্যবোধের পুষ্টিসাধন এবং তা আমাদের আধ্যাত্মিক আনন্দের উপায়। কিন্তু এমন কোনো ব্যক্তিগত বা আধ্যাত্মিক আনন্দ নেই, যার মধ্যে উপযোগিতার বিষয় থাকে না। আনন্দ নিজে থেকেই এক উপযোগিতাপূর্ণ বিষয় আর উপযোগিতার দৃষ্টিকোণ থেকে একই বস্তু থেকে আমরা সুখও পাই দুঃখও পাই। আকাশে চেয়ে থাকা লালিমা নিঃসন্দেহে সুন্দর দৃশ্য, কিন্তু আষাঢ় মাসে যদি আকাশ এরকম লালিমায় ছেয়ে যায়, তবে তা আমাদেরকে প্রসন্নতা দিতে পারেনা। ওই সময় তো আমরা আকাশে কালো কালো বাদল দেখেই আনন্দিত হই। ফুল দেখে আমাদের এজন্য আনন্দ হয় যে তা থেকে ফলের আশা জাগে। প্রকৃতির সঙ্গে নিজের জীবনের সুর মিলিয়ে চলতে আমাদের এই জন্য আধ্যাত্মিক সুখ মেলে যে তাতে আমাদের জীবন বিকশিত আর পুষ্ট হয়ে ওঠে। প্রকৃতির বিধান বৃদ্ধি এবং বিকাশ, আর যেসকল ভাব, অনুভূতি এবং বিবেচনা আমাদের আনন্দ দেয়, সেসব এই বৃদ্ধি আর বিকাশের সহায়ক। শিল্পী নিজের শিল্প দিয়ে সৌন্দর্য সৃষ্টি করে পরিবেশকে বিকাশের উপযোগী করে তোলেন।
কিন্তু সৌন্দর্যও অন্যসব পদার্থের মতো স্বরূপস্থ এবং নিরপেক্ষ নয়, তার অবস্থানও সাপেক্ষ। একজন অভিজাতের জন্য যে বস্তু সুখের সাধন তাই অন্যের জন্য দুঃখের কারণ হতে পারে। একজন অভিজাত তার সুরক্ষিত সুরম্য উদ্যানে বসে যখন পাখির কলতান শোনেন তাঁর স্বর্গীয় সুখ প্রাপ্তি ঘটে; কিন্তু অন্য একজন সজ্ঞান মানুষ বৈভবের এই সামগ্রীকে ঘৃণিত বস্তু মনে করেন।
বন্ধুত্ব এবং সমতা, সভ্যতা আর ভালোবাসা সামাজিক জীবনের শুরু থেকেই আছে, এ ছিল আদর্শবাদীদের মনোহর স্বপ্ন। ধর্মপ্রবর্তকেরা ধার্মিক, নৈতিক এবং আধ্যাত্মিক বন্ধন দ্বারা এই স্বপ্নকে সত্য বানাবার জন্য সতত কিন্তু নিষ্ফল চেষ্টা করেছেন। মহাত্মা বুদ্ধ, হযরত ঈসা, হযরত মুহাম্মদ প্রমূখ পয়গম্বর এবং ধর্মপ্রবর্তকেরা নীতির ভিতে এই সমতার ইমারত খাড়া করতে চেয়েছেন; কিন্তু কেউই সফলতা পাননি আর ছোট-বড় ভেদ যে নিষ্ঠুর রূপে আজ প্রকট হচ্ছে, অন্য কোন সময় বোধ করি এতটা হয়নি।
‘পরীক্ষিত কে পরীক্ষা করা মূর্খতা’ এই প্রবাদ অনুসারে যদি আমরা এখনও ধর্ম আর নীতির আশ্রয় নিয়ে সাম্যের উচ্চ লক্ষ্যে পৌঁছতে চাই তবে বিফলই হবো। আমরা কি এই স্বপ্নকে উত্তেজিত মস্তিষ্কের সৃষ্টি ধরে নিয়ে ভুলে যাব? তবে তো মানুষের উন্নতি আর পূর্ণতার জন্য কোন আদর্শই বাকি থাকবেনা। এর চেয়ে তো মানুষের অস্তিত্বই মিটে যাওয়া ভালো। যে আদর্শকে আমরা সভ্যতার প্রথম থেকে লালন করেছি, ঈশ্বর জানেন, মানুষ তার জন্য কত কোরবানী দিয়েছে, যার পরিণতির জন্য ধর্মের আবির্ভাব হয়েছে , মানবসমাজের ইতিহাস যে আদর্শ-প্রাপ্তির ইতিহাস, তাকে সর্বমান্য মনে করে, তাকে অনপনেয় সত্য মনে করে আমাদেরকে উন্নতির ময়দানে পা রাখতে হবে। আমাদেরকে এমন সর্বাঙ্গপূর্ণ সংগঠন বানাতে হবে যেখানে সমতা কেবল নৈতিক বন্ধনের ওপর আশ্রিত না থেকে এক মজবুত রূপ ধারণ করবে। আমাদের সাহিত্যকে সেই আদর্শ নিজের সামনে রাখতে হবে।
আমাদেরকে সৌন্দর্যের কষ্টিপাথর বদলাতে হবে। এখন অব্দি এই কষ্টিপাথর বড়লোক এবং বিলাসিতার ঢঙের ছিল। আমাদের শিল্পীরা ধনীদের পাল্লা ধরে থাকতে চাইতেন, তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতার ওপর শিল্পীর অস্তিত্ব নির্ভরশীল ছিল এবং তাঁদেরই সুখ-দুঃখ, আশা-নিরাশা, প্রতিযোগিতা আর প্রতিদ্বন্দ্বিতার ব্যাখ্যা করা শিল্পের উদ্দেশ্য ছিল। তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল অন্তঃপুর আর বাংলো বাড়ির দিকে। ঝুপড়ি আর পোড়ো বাড়ি তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেনি। এদেরকে শিল্পীরা মনুষ্যত্বের পরিধির বাইরে মনে করতেন। যদি কখনো তাদের বিষয়ে চর্চা করতেনও, তো তাদের নিয়ে মজা করবার জন্য, গ্রামের মানুষের গ্রাম্য বেশভূষা আর আদব-কায়দায় হাসার জন্য। তাদের বোলচাল চোস্ত না হওয়া বা বাগবিধির ভুল প্রয়োগ শিল্পীদের ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের স্থায়ী সামগ্রী ছিল। সেও মানুষ, তারও হৃদয় আছে এবং তাতেও আকাঙ্ক্ষা আছে—এইসব শিল্পের কল্পনার বাইরের ব্যাপার ছিল।
শিল্প নাম ছিল এবং এখনও আছে, সংকীর্ণ রূপ-পূজার, শব্দ যোজনার ভাব-বন্ধনের। তার জন্য কোনো আদর্শ নেই, জীবনের কোনো উচ্চ উদ্দেশ্য নেই,—ভক্তি, বৈরাগ্য, অধ্যাত্ম আর দুনিয়ার বাস্তবতায় লাগাম টানা তাদের জন্য উচ্চ কল্পনা। আমাদের এ সকল শিল্পীর বিবেচনায় জীবনের চরম লক্ষ্য এটাই। তাঁদের দৃষ্টি এখন অব্দি এমন ব্যাপক নয় যে জীবন-সংগ্রামের মধ্যে সৌন্দর্যের পরম উৎকর্ষ দেখতে পায়। উপবাস আর নগ্নতার মধ্যেও সৌন্দর্যের অস্তিত্ব সম্ভব, এ কথা তারা কখনো স্বীকার করে না। তাদের জন্য সৌন্দর্য সুন্দর নারীর মধ্যে রয়েছে—সন্তানবতী গরীব রূপহীন নারীর মধ্যে নেই, যে বাচ্চাকে ক্ষেতের পাশে শুইয়ে ঘাম ঝরাচ্ছে। তারা নিশ্চিত ভেবে নিয়েছে যে রাঙা ঠোঁট, কপোল আর ভুরুর মধ্যেই নিশ্চিতভাবে সৌন্দর্যের বাস,—তার এলোমেলো চুল, শুকনো ঠোঁট আর মলিন গালের মধ্যে সৌন্দর্য কোথা থেকে আসবে?
কিন্তু এটা সংকীর্ণ দৃষ্টির দোষ। যদি তাঁর সৌন্দর্য দেখার দৃষ্টিতে বিস্তৃতি আসে তবে সে দেখবে যে রাঙা ঠোঁট আর কপোলের আড়ালে রূপের অহংকার আর নিষ্ঠুরতা লুকিয়ে আছে, আর ওই কুকড়ে যাওয়া ঠোঁটে মলিন হয়ে যাওয়া গালের অশ্রুতে শ্রদ্ধা এবং কষ্টসহিষ্ণুতা রয়েছে। হ্যাঁ, এদের মধ্যে ঔজ্জ্বল্য, দেখানো ভাব আর সুকুমারতা নেই।
আমাদের শিল্পীরা যৌবনের প্রেমে পাগল আর এটা জানে না যে যৌবন বুকের ওপর হাত রেখে কবিতা পড়া, নায়িকার নিষ্ঠুরতায় কাঁদা,তার রূপের অহংকার এবং ছলাকলায় মাথা কুটবার মধ্যে নেই।যৌবন আছে আদর্শবাদ,সাহস আর কঠিনতার সাথে মোকাবেলার মধ্যে,আছে আত্মত্যাগের মধ্যে।তাঁকেতো ইকবালের সাথে বলতে হবে:
অয দস্তে জুনুনে মন জিব্রোল যবুঁ সৈদে,
ইয়াযদাঁ বকমন্দ আওয়ার ইয়ে হিম্মতে মরদানা।
(আমার উন্মত্ত হাতের জন্য জিব্রাইল এক নিম্নমানের শিকার।ওহে পুরুষের হিম্মত, নিজের ফাঁদে তুমি খোদাকেই ফাঁসিয়ে নাও না কেন?)
অথবা
চূঁ মৌজ সাজে সাজূদ বজূদম জে সৈল বেপরওয়াস্ত,
গুমাঁ মবর কি দরী বহর সাহিলে জোয়ম।
(তরঙ্গের মতো আমার জীবন-তরীও প্রবাহ দেখে বেপরোয়া। একথা মনে করোনা, সমুদ্রের মাঝে আমি কিনারা খুঁজছি।)
আর এই অবস্থা সেই সময় তৈরি হবে, যখন আমাদের সৌন্দর্য ব্যাপক হয়ে যাবে, যখন সমস্ত সৃষ্টি তার পরিধির মধ্যে চলে আসবে। তা কোনো বিশেষ শ্রেণী অব্দি সীমিত থাকবে না, তার উড়বার জন্য কেবল বাগানের চারদেয়ালী হবে না, সেই বায়ুমণ্ডল থাকবে যা সমস্ত ভূমণ্ডলকে ঘিরে আছে। তখন কুরুচি আমাদের সহ্য হবে না, তখন আমরা তার মূল উৎপাটনের জন্য কোমর বেঁধে তৈরি হয়ে যাব। আমরা যখন এ অবস্থা সহ্য করতে পারবো না যে, হাজার হাজার মানুষ কিছু অত্যাচারীর গোলামী করুক, তখনই আমরা কেবল কাগজের পৃষ্ঠার ওপর সৃষ্টি করেই সন্তুষ্ট হয়ে যাব না, বরং সেই বিধান সৃষ্টি করব, যা সৌন্দর্য, সুরুচি, আত্মসম্মান এবং মনুষ্যত্বের বিরোধী হবে না।
সাহিত্যিকের লক্ষ্য কেবল মেহফিল সাজানো এবং মনোরঞ্জনের সামগ্রী যোগানো নয়—তাঁর স্থান এতটা নিচে নামাবেন না। সে দেশভক্তি আর রাজনীতির পেছনে চলার মতো সত্যও নয়, বরং তাদের সম্মুখে মশাল নিয়ে পথ দেখাতে থাকা সত্য।
আমরা প্রায়ই এ নালিশ করে থাকি যে সাহিত্যিকের জন্য সমাজে কোন স্থান নেই,—অর্থাৎ ভারতীয় সাহিত্যিকদের জন্য। সভ্য দেশগুলোতে তো সাহিত্যিক সমাজের সম্মানিত সদস্য, আর বড় বড় ধনকুবের এবং মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা তাদের সঙ্গে দেখা হওয়াকে গৌরবের বিষয় মনে করে; কিন্তু ভারত তো এখনও মধ্যযুগের অবস্থাতেই পড়ে আছে। যদি সাহিত্য ধনীদের উপযাচক হওয়া জীবনের উপায় বানিয়ে নেয়, আর সেই সব আন্দোলন, হালচাল এবং বিপ্লবের ব্যাপারে বেখবর থাকে যা সমাজে ঘটে যাচ্ছে—নিজের দুনিয়া বানিয়ে তার মধ্যে কাঁদতে এবং হাসতে থাকে, তো এই দুনিয়ায় তার জন্য জায়গা না হলে কোন অন্যায় হবে না। যখন সাহিত্যিক হবার জন্য অনুকূল রুচি ছাড়া আর কিছুর বাধ্যবাধকতা নেই, যেমন মহাত্মা হবার জন্য কোন প্রকার শিক্ষার আবশ্যকতা নেই, আধ্যাত্মিক উচ্চতাই যথেষ্ট, তো মহাত্মাগণ যেমন দরজায় দরজায় ঘুরে ফিরছে, সেরকম সাহিত্যিকরাও বেরিয়ে আসুক না।
এতে সন্দেহ নেই যে সাহিত্যিক তৈরি হয়, বানানো যায় না; কিন্তু আমরা যদি শিক্ষা এবং জিজ্ঞাসা দ্বারা প্রকৃতির এই দানকে বাড়াতে পারি, তবে নিশ্চয়ই সাহিত্যের অধিক সেবা করতে পারব। দার্শনিক আরস্তু এবং অন্য বিদ্বানেরাও সাহিত্যিক হবার জন্য কড়া শর্ত আরোপ করেছেন এবং তার মানসিক, নৈতিক, আধ্যাত্মিক ও ভাগবত সভ্যতা আর শিক্ষার জন্য সিদ্ধান্ত এবং বিধিমালা নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন; কিন্তু আজকাল তো হিন্দিতে সাহিত্যিকের জন্য কেবলমাত্র প্রবৃত্তিকেই লক্ষণ মনে করা হয়, তাঁর আর কোন প্রস্তুতির আবশ্যকতা নেই। তিনি রাজনীতি, সমাজবিদ্যা কিংবা মনোবিজ্ঞানের সাথে একেবারে অপরিচিত থাকুন, তবুও তিনি সাহিত্যিক।
সাহিত্যিকের সামনে আজকাল যে আদর্শ স্থাপিত হয়েছে, সেই অনুসারে এইসব বিদ্যা তার বিশেষ অঙ্গ হয়ে উঠেছে এবং সাহিত্যের প্রবৃত্তি অহংবোধ কিংবা ব্যক্তিবাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, বরং তা মনোবৈজ্ঞানিক এবং সামাজিক হয়ে উঠছে। এখন তিনি ব্যক্তিকে সমাজ থেকে আলাদা করে দেখেন না বরং তাকে সমাজের এক অঙ্গ রূপেই দেখেন। এই জন্য নয় যে সে সমাজকে শাসন করে, তাকে আপন স্বার্থসিদ্ধির উপায় বানায়, যেন তার আর সমাজের মধ্যে সনাতন শত্রুতা রয়েছে, বরং এইজন্যে যে সমাজের অস্তিত্বের সাথে তার অস্তিত্ব টিকে রয়েছে এবং সমাজ থেকে আলাদা হয়ে তার মূল্য প্রায় শূন্যের সমান হয়ে যায়।
আমাদের মধ্যে যাঁদের সর্বোত্তম শিক্ষা এবং সর্বোত্তম মানসিক শক্তি মিলেছে, তাঁদের ওপর সমাজের ততবেশি দায়িত্বও অর্পিত। আমরা সেইসব মানসিক পুঁজিপতিকে পূজার যোগ্য মানবো, যারা অর্থের চেয়ে অধিক উচ্চ শিক্ষা অর্জন করে তাকে সামাজিক স্বার্থ সাধনের জন্য কাজে লাগায়। সমাজের নিকট থেকে নিজের স্বার্থসিদ্ধি এমন কাজ যাকে কোন সাহিত্যিক কখনো পছন্দ করবে না। সেই মানসিক পুঁজিপতির কর্তব্য হলো, তিনি সমাজের লাভকে নিজের লাভের চেয়ে অধিক প্রয়োজন মনে করবেন—নিজের বিদ্যা আর যোগ্যতার দ্বারা সমাজের অধিক উপকারের চেষ্টা করবেন। তিনি সাহিত্যের যেকোনো শাখায় প্রবেশ করেন না কেন, সেই শাখার সাথে বিশেষভাবে এবং অন্যান্য শাখার সাথে সাধারণভাবে পরিচিত হবেন।
যদি আমরা আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনের রিপোর্ট পাঠ করি তবে দেখব যে এমন কোন শাস্ত্রীয়, সামাজিক, ঐতিহাসিক এবং মনোবৈজ্ঞানিক প্রশ্ন নেই, যে বিষয়ে সেখানে মত-বিনিময় হয় না। এর বিপরীতে, আমরা যদি আমাদের জ্ঞানসীমাকে দেখি তবে নিজেদের অজ্ঞতা বিষয়ে আমাদের লজ্জা হয়। আমরা ধরে নিয়েছি যে সাহিত্য রচনার জন্য আমাদের স্বাভাবিক বুদ্ধি এবং গতিশীল কলমই যথেষ্ট। কিন্তু এই বিবেচনাই আমাদের সাহিত্যিক অবনতির কারণ। আমাদেরকে নিজেদের সাহিত্যের মানদণ্ড উঁচু করতে হবে যাতে আমরা সমাজের অধিক গুরুত্বপূর্ণ সেবা করতে পারি, যাতে সমাজে তার সেই স্থান মিলে যে স্থান তার পাওনা, যাতে সে সমাজের প্রত্যেক বিভাগ বিষয়ে সমালোচনা-বিবেচনা করতে পারে আর আমরা অন্যান্য ভাষার অর্থাৎ সাহিত্যের এঁটো খেয়ে সন্তুষ্ট না থাকতে পারি বরং নিজেরাই সেই পুঁজিকে বাড়িয়ে তুলি।
আমাদের নিজের রুচি এবং প্রবৃত্তি অনুসারে বিষয় নির্বাচন করা উচিত এবং সে বিষয়ের ওপর দখল অর্জন করা উচিত। আমরা যে অর্থনৈতিক অবস্থায় জীবন কাটাচ্ছি, তার মধ্যে এ কাজ কঠিন নিশ্চয়ই, কিন্তু আমাদের আদর্শ উঁচু থাকা উচিত। আমরা পাহাড়ের মাথায় পৌঁছতে না পারি, কোমর অবধি পৌঁছে যাবই, তাহলে মাটিতে পড়ে থাকা নিশ্চয়ই ভালো কিছু নয়। যদি আমাদের হৃদয় প্রেমের জ্যোতিতে আলোকিত হয় এবং সেবার আদর্শ আমাদের সামনে থাকে, তবে এমন কোনো কাঠিন্য নেই যাকে আমরা জয় করতে পারবো না।
বিত্তবৈভব যার প্রিয়, সাহিত্য-মন্দিরে তার জন্য স্থান নেই। এখানে তো সেই উপাসকদের প্রয়োজন, যাঁরা সেবাকেই নিজের জীবনের সার্থকতা হিসেবে মেনে নিয়েছেন, যাদের হৃদয়ে বেদনার তড়পানি রয়েছে এবং ভালোবাসার উচ্ছ্বলতা রয়েছে। নিজের সম্মান তো নিজের হাতে। যদি আমরা সত্য হৃদয়ে সমাজের সেবা করি তবে সম্মান, প্রতিষ্ঠা আর প্রসিদ্ধি সবাই আমাদের পদচুম্বন করবে। তবে মান প্রতিষ্ঠার চিন্তা কেন আমাদের যন্ত্রণা দেয়? আর তা না পেলে কেন আমরা নিরাশ হয়ে যাই? সেবায় যে আধ্যাত্মিক আনন্দ আছে, সেই তো আমাদের পুরস্কার—সমাজে আমাদের বৃহত্ব দেখানো কিংবা তার ওপর প্রভাব প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা কেন আমাদের? অন্যদের চেয়ে অধিক আরামে থাকার ইচ্ছা কেন আকুল করে? আমরা ধনী শ্রেণীর মধ্যে নিজেদের গণনা কেন করাতে চাই? আমরা তো সমাজের ঝাণ্ডা নিয়ে চলা সৈনিক এবং সাধারণ জীবনের সাথে উচ্চ দৃষ্টি আমাদের জীবনের লক্ষ্য। যে মানুষ সত্যিকারের শিল্পী, তিনি স্বার্থময় জীবনকে ভালবাসতে পারেন না। তার নিজের মনস্তুষ্টির জন্য লোক-দেখানোর আবশ্যকতা নেই—তাতে তো তাঁর ঘৃণা হওয়ার কথা। তিনি তো ইকবালের সাথে বলেন:
মর্দুম আযাদম আগুনা রায়ূরম কি মরা,
মীতওয়াঁ কুশ্তও ইয়েক জামে জুলালে দীগরাঁ।
(আমি স্বাধীন এবং এতটাই লজ্জাশীল যে অন্যের থিতানো পানির এক পেয়ালা পান করার লজ্জায় মরে যেতে পারি।)
আমাদের পরিষদ এ ধরনের কিছু সিদ্ধান্ত সাথে নিয়ে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করেছে। সাহিত্যের শরাব-কাবাব আর রাগ-রংয়ের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকা পরিষদ পছন্দ করে না। পরিষদ সাহিত্যকে উদ্যোগ এবং কর্মের সংবাদবাহক বানাতে আগ্রহী। ভাষা নিয়ে তার কোনো বিতর্ক নেই। আদর্শ ব্যাপক হলে ভাষা নিজে নিজেই সরল হয়ে যায়। ভাবসৌন্দর্য এবং সাজ-শৃঙ্গারের সাথে বেপরোয়া ভাব দেখাতে পারে। যে সাহিত্যিক ধনীদের মুখাপেক্ষী তিনি অভিজাত রচনাশৈলী গ্রহণ করেন; যিনি জনসাধারণের তিনি জনসাধারণের ভাষায় লেখেন। আমাদের উদ্দেশ্য দেশে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করা যাতে অভীষ্ট প্রকারের সাহিত্য উন্নত হতে পারে এবং পুনরায় স্বাস্থ্যবান হয়ে উঠতে পারে। আমরা চাই সাহিত্যিক কেন্দ্রগুলোতে আমাদের পরিষদ স্থাপিত হোক এবং সেখানে সাহিত্যরচনার প্রবৃত্তি বিষয়ক চর্চা নিয়মিত হোক, প্রবন্ধ পাঠ করা হোক, বিতর্ক হোক, আলোচনা-সমালোচনা হোক। তবেই সেই পরিবেশ তৈরি হবে। তবেই সাহিত্যে নতুন যুগ আবির্ভূত হবে।
আমরা প্রত্যেক প্রদেশে, প্রত্যেক ভাষায় এরূপ পরিষদ স্থাপন করতে চাই; যেখানে সকল ভাষায় আমরা আমাদের বার্তা পৌঁছাতে পারবো। একথা মনে করা ভুল হবে যে এটা আমাদের নতুন কোনো কল্পনা। না, এতে দেশের সাহিত্য-সেবকদের হৃদয়ের সামগ্রিক ভাবনা বিদ্যমান। ভারতের প্রত্যেক ভাষাতে এই বিবেচনার বীজ প্রকৃতি এবং পরিবেশ আগে থেকেই বপন করে রেখেছে, স্থানে-স্থানে তার অঙ্কুরও বিকশিত হতে শুরু করেছে। তাতে জলসিঞ্চন এবং তার লক্ষ্যকে পুষ্ট করা আমাদের উদ্দেশ্য।
আমরা যারা সাহিত্যিক তাদের মধ্যে কর্মশক্তির অভাব। এটা একটা অপ্রিয় সত্য; কিন্তু তার দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিতে পারি না। এখন অব্দি আমরা সাহিত্যের যে আদর্শ আমাদের সামনে রেখেছি, তার জন্য কর্মের আবশ্যকতা ছিলনা, কর্মভাবই ওর গুণ ছিলো কেননা প্রায়শই কর্ম নিজের সাথে পক্ষপাত আর সংকীর্ণতাকে নিয়ে আসে। যদি কোনো মানুষ ধার্মিক হয়ে নিজের ধার্মিকতার ব্যাপারে গর্ব করে তবে এর চেয়ে অনেক ভালো যে সে ধার্মিক না হয়ে ‘খাও দাও ফূর্তি করো’ ভাবের দাস হয়ে যায়। এমন স্বচ্ছন্দচারী ঈশ্বরের দয়ায় অধিকারী হয়েও যেতে পারে; কিন্তু ধার্মিকতার অহংকার করে যে তার জন্য সেই সম্ভাবনা একেবারেই নেই।
যাই হোক, যখন অব্দি সাহিত্যের কাজ কেবল মন ভোলানো জিনিস যোগানো, কেবল ঘুমপাড়ানি গান করা, কেবল চোখের জল ফেলে মন হালকা করা ছিল তখন অব্দি তার জন্য কর্মের আবশ্যকতা ছিল না। সে এক দেওয়ানা ছিল যার দুঃখ অন্যরা ভোজন করতো। কিন্তু আমরা সাহিত্যকে কেবল মনোরঞ্জন আর বিলাসিতার সামগ্রী মনে করি না। আমাদের কষ্টিপাথরের পরীক্ষায় তাই সাহিত্য হিসেবে উতরাবে যাতে উচ্চ চিন্তা আছে, স্বাধীনতার চেতনা আছে, সৌন্দর্যের সার আছে, সৃজনের আত্মা আছে, জীবনের সত্যের প্রকাশ আছে—যা আমাদের মধ্যে গতি, সংঘর্ষ আর অস্থিরতা সৃষ্টি করে, ঘুম পাড়িয়ে দেয় না কেননা এখন আরো বেশি শুয়ে কাটানো মৃত্যুরই লক্ষণ।