সূর্য-স্বপ্ন II পঞ্চানন হাজরিকা II মূল অসমিয়া থেকে অনুবাদ -বাসুদেব দাস

সূর্য-স্বপ্ন II পঞ্চানন হাজরিকা II মূল অসমিয়া থেকে অনুবাদ -বাসুদেব দাস

বৈঠকখানার দেওয়ালে একটা পুরোনো ছবি ঝুলানো ছিল। গালে হাত রেখে,উদাস,নির্বাক চোখে জানালার সামনে বসে থাকা এক নারীর ছবি। ছবিটা অরণ্য এঁকেছিল। শিল্পী অরণ্য। বিপ্লবী হওয়ার জন্য চলে যাবার আগে অরণ্য এই ধরনের ছবি আঁকত-কোমল, মধুর ভাবনায় আবিষ্ট কবিতা কবিতা বলে মনে হওয়া ছবি। সেই ছবিগুলি খুঁটিয়ে দেখলে আমি কোথাও বিপ্লবী অরণ্যকে খুঁজে পাই না। সে এক অন্য অরণ্য। আত্মমুগ্ধ অরণ্য। জীবনমুগ্ধ অরণ্য।

আমি আজকাল চিত্রভানুর চোখের দিকে তাকিয়ে ভাবি –এভাবে হঠাৎ এই চোখের ভাষা বদলে গেল!এত দ্রুত চিত্রভানুর কণ্ঠস্বর পালটে গেল। চিত্রভানুকে আমি আবৃত্তি করতে শিখিয়েছিলাম। ও তখন দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ত। হাত এবং চোখের অঙ্গভঙ্গি করে দুদিন ধরে আমি তাকে জ্যোতিপ্রসাদের ‘ভুত-পোয়ালি’শিখিয়েছিলাম। মইনা পারিজাত আয়োজিত অনুষ্ঠানে শিল্পী দিবসে সে যখন প্রথম পুরস্কার হাতে নিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল,আমি তখন পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মায়েদের একজন।

বি কে বি অডিটোরিয়ামে অরণ্য একদিন আবৃত্তি করছিল-‘আমি বিপ্লবী,আমি তাণ্ডবী।‘অন্য একদিন তার কণ্ঠে গমগম করে উঠেছিল-‘ভাঙ ভাঙ ভাঙ লোহার শিকলি ভাঙ….।‘

সজোরে হাততালি পড়েছিল। আমার পাশে বসে থাকা হোস্টেলের কাজরি গায়ে খোঁচা দিয়ে কিছু একটা বলে খ্যাপাচ্ছিল। ব্যাগের ভেতরে রাখা গোলাপি রঙের ছাতাটার মতো আমি যেন হঠাৎ গোলাপি হয়ে উঠেছিলাম। সেদিন বিকেল পর্যন্ত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অরণ্য ভূপেন্দ্র সঙ্গীত গেয়েছিল-‘বিস্তীর্ণ পারে’,’বিমূর্ত আমার নিশাটি’এবং ‘জুয়ে (আগুন) পোর তিরাশীর…  । দর্শকের আসনের কোনো এক সারিতে বসে থাকা আমি হঠাৎ দুটো অরণ্যকে আবিষ্কার করে ফেলেছিলাম-’বিমূর্ত আমার নিশাটি’র অরণ্য আলাদা এবং ‘জুয়ে (আগুন) পোর তিরাশির অরণ্য আলাদা তার চোখে কৃষ্ণচূড়া ফুল দেখতে পেয়েছিলাম। আমি ভয় পেয়েছিলাম।

জালুকবাড়ি ছাড়ার সময় যত কাছে এগিয়ে আসছিল, ততই বুকের মধ্যে ভয় বাড়ছিল। অরণ্যকে হারিয়ে ফেলার ভয়। কত সহজে কথাগুলি বদলে যায়। কত সহজে কথাগুলির পুনরাবৃত্তিও হয়।

চিত্রভানু আমার সন্তান। আমার বাইশ বছরের যুবক পুত্র।একমাত্র পুত্র। আমি চেয়েছিলাম ও ছবি আঁকুক। ও আঁকত। আমি তাকে আবৃত্তি শিখিয়েছিলাম। সে শিখেছিল। সে তর্ক প্রতিযোগিতাগুলিতে পুরস্কার জিতে আনত। রাতেরবেলা মাঝে মধ্যে সে বাঁশিও বাজাত। আমার রাতগুলি চমকে উঠত-এরকম একটা বাঁশির শব্দ বহু বছর আগে আমি জালুকবাড়িতে ফেলে এসেছি। আর্টস ক্যান্টিনের পাশের সেই দোতালা ছাত্রাবাসে ফেলে এসেছি। আমার পুত্রের বাজানো বাঁশির শব্দে আমার অতীত ফিরে এসেছিল।

ওর বাবা চিৎকার করত-‘মধ্যরাতে বাঁশি বাজিয়ে সবাইকে জাগিয়ে রাখছে,পাগল হয়েছে নাকি?

তিনি চেয়েছিলেন,ও সায়েন্স পড়ুক। ছবি আঁকতে ভালোবাসে ছেলেটাও কথাটা মেনে নিয়েছিল। স্বামীর সিদ্ধান্তের বিপরীতে কথা বলার মতো সাহস আমার ছিল না। আমার মতের বিশেষ স্পষ্টতাও ছিল না,দৃঢ়তাও ছিল না। অথচ দুই বছর পরে কোনো একটি অনুষ্ঠানে সে যখন প্রণবকুমার বর্মনের ‘সুইসাইড নোট’কবিতাটি আবৃত্তি করছিল,আমি শিউরে উঠেছিলাম।

তার মেধার তুলনায় উচ্চ মাধ্যমিকের ফল ভীষণ খারাপ হয়েছিল। বাবা হতাশ হয়েছিল। ক্রুদ্ধ হয়েছিল। সে ঘরের দরজা বন্ধ করে কী একটা ছবি আঁকছিল। দুধের গ্লাসটা আমি তার টেবিলে রেখে আস্তে করে বলেছিলাম-‘তোর যা ভালো লাগে তাই পড়,আমরা কোনো রকম জোর করব না।‘

সিদ্ধান্ত নেবার স্বাধীনতা ওকে দিয়েছিলাম। সেই স্বাধীনতা দিতে অবশ্যই আমাদের দেরি হয়েছিল। সে অসমিয়া সাহিত্যে ভর্তি হয়েছিল। সেই দিনগুলিতে আমি ভেবেছিলাম,চিত্রভানু যদি অরণ্য এবং আমার সন্তান হত,তখন ?

আমি হৃদয়ানন্দের পত্নী। আমি হৃদয়ানন্দের সন্তানের মাতা। চিত্রভানু হৃদয়ানন্দ এবং আমার সন্তান। অরণ্য নামের একজন মানুষের প্রসঙ্গ,অরণ্য নামের অস্ত্রধারী একজন বিপ্লবীর প্রসঙ্গ কখনও আমাদের মধ্যে আসা উচিত নয়। অথচ আমার চেতনার দুয়ারে সঙ্গোপনে অরণ্য নামটি প্রায়ই টোকা দিয়ে যাচ্ছিল।

অরণ্যকে আমি কোথায় ঢুকিয়ে রেখেছিলাম? রাতগুলি বিদীর্ণ করা বাঁশির সুরে? যাবার আগে সে আমার কাছে রেখে যাওয়া জানালার পাশের নারীর ছবিটিতে? না কি আমি বুকের ভেতরে সবার অজান্তে পুষে রেখেছিলাম অরণ্য নামের একটি মানুষের প্রতি এক গোপন অভিলাষ?

অরণ্য কখনও বৃষ্টি হলে ছাতা নিত না। মার্কেটের সামনের রাস্তাটা দিয়ে আসার সময় একদিন মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল। আমি মেলে ধরা ছাতাটা সে জোর করে বন্ধ করে দিয়ে বলেছিল-‘বৃষ্টিকে যে মেয়ে ভালোবাসে সে কখনও ছাতা নেয় না।‘

ক্লাস টেনে পড়তে থাকা চিত্রভানু যখন একদিন স্কুল থেকে বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে বাড়ি এল,আমি ধমক দিয়ে উঠেছিলাম। আমার কিশোর পুত্র হঠাৎ যেন আমাকে অন্য এক ঝাঁক বৃষ্টির মধ্যে ঠেলে দিয়েছিল। বৃষ্টি স্মৃতির,বৃষ্টি আবেগের।

‘আমি বৃষ্টিকে ভয় করি না,বৃষ্টি আমার ভালো লাগে মা…। কথাটা কি চিত্রভানু বলেছিল না অরণ্য ? ঢেউ খেলানো চুলের,লাল চোখের অরণ্য? বিপ্লবী হওয়ার জন্য চলে যাওয়া এক সময়ের শিল্পী অরণ্য।

আগুন,পাহাড়,অরণ্য,শিল,নদী-এসবই অরণ্যের প্রিয় ছিল। তার বহু ছবিতে শিমূলে আগুন লেগেছিল। বহু ছবির গাছের ডালে ঝুলে ছিল উদাস,রিক্ত,বিষাদমগ্ন চাঁদ। তার ছবিতে সমস্ত নারী যেন উঠে এসেছিল করুণতার কোমল বৃষ্টিতে স্নান করে ….।

সেই নারী কি আমি ছিলাম ?

একদিন হৃদয়ানন্দের সঙ্গে আমার বিয়ে হল। জালুকবাড়ির ঠিকানা ছেড়ে আসার দুই বছর পরে। বাবা ঠিক করে দেওয়া পাত্রের সঙ্গে। বিয়ের খবর অরণ্য পেয়েছিল। আসে নি। আসার প্রশ্নও ছিল না। অরণ্য অন্য এক পথের যাত্রী হয়েছিল। সহজ জীবনের মায়ায় বন্দি আমার মতো মানুষের কাছে সেই পথ খোলা ছিল না।

আমার জীৱনে চিত্রভানু এসেছিল। গোলাপ ফুলের সুগন্ধ আমার চারপাশ ভরিয়ে তুলেছিল। আমিই চিত্রভানু নামটা রেখেছিলাম। চিত্রভানু মানে সূর্য। উজ্জ্বল,অম্লান দিবাকর। চিত্রভানুর জন্মের সময় নতুন সূর্যের স্বপ্নে উদ্বেল হয়েছিল অরণ্যরা। সেইজন্যই বোধহয় আমি আমার সন্তানের নাম ‘চিত্রভানু’রেখেছিলাম। সন্তানের নাম রাখার ক্ষেত্রে হৃদয়ানন্দ বিশেষ আপত্তি করল না।

হৃদয়ানন্দ আমার স্বামী,আমার প্রেমিক নয়। এই কথা ধীরে ধীরে উপলদ্ধি করতে শুরু করেছিলাম না কি এরকম হয়েছিল -অরণ্য নামের মসৃণ স্বপ্নটিকে হৃদয়ানন্দ নামের কঠিন বাস্তবের মধ্যে হাতড়ে বেড়াতে গিয়ে আমি বারবার হোঁচট খাচ্ছিলাম।

বিয়ের পরে একবার হৃদয়ানন্দের সঙ্গে কাজিরাঙ্গায় গিয়েছিলাম। চিত্রভানু বড় হওয়ার পরে পবিতরায় গিয়েছিলাম। পিতা-পুত্র মিলে ঘুরে বেড়ানো গণ্ডারের ফোটো তুলেছে,গাছের ডালে বসে থাকা চিলের ফোটো তুলেছে,বিলের চারপাশে ঘুরে বেড়ানো হাড়গিলাদের ফোটো তুলেছে।

অথচ আমার কোথাও কোনো কিছুতে আগ্রহ নেই…। আমি সেই গভীর অরণ্যের বুকে কুড়ে কুড়ে ঢুকে যেতে চাইছি। অবুঝ শব্দে ভরা অরণ্যটির ভাষা শুনতে চাইছি,বুঝতে চাইছি। একটা গভীর,গহীন অরণ্য এবং অরণ্য নামের লাল চোখের,ঢেউ খোলা চুলের,গমগমে কণ্ঠস্বরের একটা মানুষ আমার স্বপ্নে,আমার চেতনায় একাকার হয়ে উঠেছে।

একদিন বিকেলে বৃষ্টি পড়ছিল। আমি গালে হাত দিয়ে জানালার সামনে বসেছিলাম। বৃষ্টির জন্য খেলা অর্ধসমাপ্ত রেখেই ক্রিকেট ব্যাট হাতে নিয়ে চিত্রভানু এসে ঢুকল।

‘মা,তোমাকে এই ছবিটার মতো দেখাচ্ছে।‘-আমার সন্তান বলেছিল। আমার বুকের ভেতর এক ঝাঁক বৃষ্টি খলখল করে উঠেছিল।

‘এটা তোমার মামার আঁকা ছবি।‘

‘কোন মামা?’

‘অরণ্য…।অরণ্য মামা …।‘

আমার ছেলেকে সেদিন আমি অরণ্যের কথা বলেছিলাম।‘আগুনে পোড়া তিরাশির নির্বাচনী আবহাওয়া‘ গেয়ে ভর্তি বি কে বি হলকে হঠাৎ কাঁদিয়ে ফেলা সেই অরণ্যের কথা বলেছিলাম।

আমার সন্তান মুগ্ধ হয়ে শুনছিল। দেওয়ালে ঝুলে থাকা ছবিটার দিকে তাকিয়েছিল-যে ছবির ভঙ্গিমায় জানালার কাছে তার মা বসেছিল।

গোপন আস্থানায় চলে যাবার আগে অরণ্য আমাকে ছবিটা দিয়ে গিয়েছিল। সেদিন খুব ব্যস্ততার সঙ্গে এসে দেখা করেছিল। দুদিন পরেই তার প্রশিক্ষণের জন্য কাচিন চলে যাবার কথা। ইস। অরণ্যের মতো ছেলেও হাতে অস্ত্র নিয়ে গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেবে। কোথায় যেন আমি আহত হয়েছিলাম। কেবল অরণ্যই গিয়েছিল কি? কত যুবক চলে গিয়েছিল। রুমমেট বিনীতাদির একমাত্র ভাই গিয়েছিল। আমার সহপাঠী সুবীর এবং গৌতম গিয়েছিল। সেটাই একমাত্র পথ। পরিবর্তন আনার সেটাই একমাত্র বিকল্প পথ। অরণ্যের হোস্টেলের রুমে আয়োজিত রাজনৈতিক আড্ডাগুলির কথা আমি জানতাম। কী ভয়ঙ্কর এবং বিচিত্র আবেগ ছিল সেটা। বছর দুয়েক পর্যন্ত অরণ্যের দুই একটি চিঠি পেতাম। কী এক উৎসাহ এবং টগবগ আবেগে সেই চিঠিগুলি ভরে থাকত। নিজের জাতি এবং মাটিকে ভীষণভাবে ভালোবাসা একটি মানুষের হৃদয়ের অর্গল খুলে গিয়েছিল চিঠিগুলিতে।

কেবল স্বপ্ন,স্বপ্ন আর স্বপ্ন। সূর্যসম উজ্জ্বলতায় ডুবে থাকা স্বপ্ন । খবরের কাগজগুলিতে ধীরে ধীরে খারাপ খবর বেড়েই চলেছিল। যেখানে সেখানে রক্তপাত শুরু হয়েছিল। ভাইকে খুঁজে না পেয়ে সেনাবাহিনি বিনীতাদিকে বলাৎকার করেছিল।

আমি এক সহজ,স্থির সরল রৈখিক জীবনের মায়ায় বন্দি ছিলাম। বিনীতাদির সঙ্গে দেখা করতে আমার যাওয়া হয় নি। বিনীতাদি অরণ্যের উদ্দেশ্যে,নিজের ভাইয়ের উদ্দেশ্যে সবসময় বলতেন-ওরা ভুল করেনি,ওরা ভুল করতে পারে না। সেই সংগঠনের আদর্শ এবং লক্ষ্যকে আমি কতটা গভীরভাবে বুঝতে পেরেছিলাম জানি না,কিন্তু অরণ্য নামের মানুষটিকে আমি শ্রদ্ধা করেছিলাম। এই শ্রদ্ধার জন্যই হয়তো এক ধরনের বিশ্বাস এবং আস্থাও জন্ম হয়েছিল।

সেইজন্যই হয়তো কখনও আমি চেয়েছিলাম নাকি আমার সন্তান অরণ্যের মতো হোক। অরণ্যের মতো যুক্তিবাদী? অরণ্যের মতো প্রগতিশীল? অরণ্যের মতো দৃঢ় এবং সাহসী? অরণ্যের মতো নির্ভীক এবং পৌরুষদীপ্ত?

হৃদয়ানন্দ সৎ কিন্তু বিশেষ আদর্শহীন। হয়তো সুবিধাবাদী বলা যেতে পারে। হৃদয়ানন্দ নিজে অফিসে ঘুষ নেয় না, কিন্তু অন্যের ঘুষ নেবার বিরোধিতাও করে না। হৃদয়ানন্দ পরম্পরায় আবদ্ধ মানুষ,প্রথাবদ্ধ মানুষ…। আমি হয়তো চাইনি চিত্রভানু তার পিতার মতো হোক। চিত্রভানু অরণ্যের মতো হোক এটাও কি আমি সত্যিই চেয়েছিলাম?

ওরা বিপ্লবী নয়,সন্ত্রাসবাদী।

ওরা সংগ্রামী নয়,নরহত্যাকারী।

ওরা নির্ভীক নয়,কাপুরুষ।

ওরা প্রগতিশীল নয়,পলায়নবাদী।

সমালোচনা ক্রমশ বেড়েই চলছিল।  অরণ্যরা বারবার একই ধরনের ভুল করতে শুরু করেছিল। প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের শেষে যখন একটা সহজ,সাধারণ স্বীকারোক্তি খবরের কাগজে প্রকাশিত হয়েছিল,লোকেরা ক্রোধে কাঁপছিল।‘এরা জাতি রক্ষার নামে জাতিকে নরকের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।‘-লোকেরা বলাবলি করছিল।

শতশত বিনীতার সৃষ্টি হয়েছিল। পঙ্গু যুবক ছেলেদের জড়িয়ে ধরে গ্রামবাসীরা কাঁদছিল। সন্ত্রাস এবং সন্ত্রাস …।কোথাও বিপ্লবের তৈরি সন্ত্রাস। কোথাও বিপ্লব দমনের নামে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। এই সন্ত্রাসের মধ্য দিয়েই চন্দ্রভানু বড় হয়েছে। এই সন্ত্রাসের মধ্যেই একটি প্রজন্ম তিল তিল করে বেড়ে চলেছে। কোথাও কখনও স্বপ্নগুলি শেষ হয়ে গেছে বা স্বপ্নের দীর্ঘ রশিটা পাকানোর সময় গিঁট লেগে গেছে কিন্তু স্বপ্নের কি মৃত্যু আছে? স্বপ্ন সূর্যের মতো। সব সময় নতুন নতুন বেশে তেজস্বী-নতুন ধরনে উজ্জ্বীবিত।

চিত্রভানুর রুমের মিউজিক সিস্টেমে একদিন নচিকেতার গান বাজছিল। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের কবিতা আবৃত্তি করতে সে ভালোবাসত। আমি আমার ছেলেকে আড়চোখে দেখতাম -কী এক আত্মপ্রত্যয় এবং দৃঢ়তা তার উজ্জ্বল চোখে মুখে ফুটে উঠেছিল।

দেওয়ালের ছবিটা পুরোনো হয়েছিল। আর আমরা? আমরাও পুরোনো হয়ে আসছিলাম। একদিন বুঝতে পেরেছিলাম -একটা পরিবর্তনের স্বপ্নের পেছনে আমার সন্তান ও দৌঁড়াতে শুরু করেছে। ওর বাবা আমাকে বকাবকি করতেন-‘আদর দিয়ে দিয়ে,বাইরের বইপত্র পড়তে দিয়ে তুমি ছেলের মাথাটা নষ্ট করেছ।‘দুই বছর পরে সে সায়েন্স ছেড়ে দিয়েছিল। বাবার রাগ কমেনি। মেনে নিয়েছিলাম। একমাত্র সন্তানকে নিয়ে তাঁরও নিজস্ব কিছু প্রত্যাশা ছিল। সেই প্রত্যাশা পূর্ণ না করতে পারার হতাশা তাকে ক্রোধী করে তুলেছিল।

‘আপনি রাগ করবেন না। আমি ওর সঙ্গে কথা বলব…।‘ হাই প্রেসারে কাবু করা,অস্থির ক্লান্ত মানুষটিকে আমি কোমল স্বরে বলেছিলাম। বাইশ বছর ধরে একসঙ্গে রয়েছি। প্রেম নামের সেই ব্যাখ্যাহীন অনুভূতি মন আচ্ছন্ন না করতে পারে,তাঁর কথায়,তাঁর স্পর্শে শিহরিত না হয়ে উঠতে পারি,তাঁর হাতে হাত রেখে সাগরের তীরে দাঁড়ানোর দুর্বার আশা মনে না জাগতে পারে,কিন্তু মানুষটার প্রতি দায়বদ্ধতা রয়েছে। অনুরাগ না থাকলেও,আত্মার টান আছে। পবিত্র আমকাঠের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হোমের গুড়োর তেজস্বী মন্ত্রোচ্চারণের মধ্য দিয়ে আমার পিতা তাঁর হাতে আমার হাত তুলে দিয়েছিলেন। তিনি আমার সন্তানের জন্মদাতা পিতা।

স্বামী-স্ত্রীর সহজাত ঝগড়া কখনও কখনও হয়েছে,কখনও অতিষ্ঠ হয়েছি,বিরক্ত হয়েছি। কিন্তু সেই মানুষটা না আসা পর্যন্ত ডাইনিং টেবিলে ভাত বেড়ে আমি বসে থেকেছি।

কী আশ্চর্যজনকভাবে আমরা সম্পর্কগুলিতে নিবিড়ভাবে বাঁধা পড়ে যাই।

‘বাবা,তুই এসব কী কাজে জড়িয়ে পড়ছিস?’ কলেজ থেকে রাত আটটায় বাড়ি ফেরা ছেলেকে আমি কিছুটা রাগের সঙ্গেই জিজ্ঞেস করেছিলাম।

‘আমি কোনো খারাপ কাজ করছি না।‘-ছেলের গমগমে কণ্ঠস্বর আমার কেমন যেন অপরিচিত মনে হয়েছিল।

‘কিন্তু এখন তো পড়াশোনা করার সময়। তোর বাবা তোকে নিয়ে এত চিন্তা করে…।‘ ‘আমরা পরিবর্তনের কথা ভাবছি, মা …।‘সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম আমার ছেলে বড় হয়েছে। আমাদের অজান্তে,ভাবনার অগোচরে,নিপীড়িত,অবহেলিত মানুষের জন্য চিৎকার করার সঙ্কল্প সে গ্রহণ করেছে।

তার পড়ার টেবিলে ক্রমশ বেড়ে চলা শক্ত শক্ত বইগুলি আমাকে অনেক কথা ভাবতে বাধ্য করেছিল। আমি ভয় পেয়েছিলাম। আমার সন্তানকে হারানোর ভয়? একদিন আমি অরণ্যকে হারিয়েছিলাম। অরণ্য নামের মানুষটি আমাকে কখনও খোলাখুলি ভাবে ভালোবাসার কথা বলেনি। কেবল বলেছিল –‘তুমি ভালো থেক,সুখে থেক।আমি যে পথ বেছে নিয়েছি,সেই পথে তুমি চলতে পারবে না। নিজে সুখী হওয়ার মতো একটা জীবন বেছে নিয়ো।

অরণ্যের এই চিঠির টুকরো হয়তো এখনও আমার পুরোনো ডায়রির পাতায় রয়েছে। চিত্রভানু একদিন সেই নগরের বাসিন্দা হল-যে নগরের প্রতিটি কৃ্ষ্ণচূড়া তার মায়ের পরিচিত ছিল। যে নগরে,সে মায়ের মুখে শুনেছে অরণ্য মামা বিপ্লবের প্রথম পাঠ নিয়েছিল। কৃ্ষ্ণচূড়া আগের চেয়ে কমে গিয়েছিল। বাবার সঙ্গে তাকে প্রথমে হোস্টেলে রেখে আসতে গিয়ে আমি আগ্রহ সহকারে গাছগুলি,বাড়ি ঘরগুলি দেখছিলাম…। সমস্ত কিছুই যেন গাঢ় কুয়াশার মাঝখান থেকে জেগে উঠছিল। এই জায়গাটিতে অরণ্য আমাকে ছাতাটা বন্ধ করতে বলেছিল, এই গাছটার নিচে আমরা শেষবারের মতো দেখা করেছিলাম। এই ‘মেঘালী’তে কোনো এক বিকেলে একটা মোটর সাইকেলে চড়ে একটি ছেলে এসে বিনীতাদিকে ভাইয়ের হাতের একটা চিঠি দিয়েছিল। চিঠিটা ভাই সংগঠনে যোগ দেবার খবর এনেছিল। কারেন্ট ছিল না,একটা মোমবাতি জ্বলছিল। আমার সামনেই বিনীতাদি চিঠিটা ঝুকে ঝুকে পড়ছিল। বিনীতাদি কাঁদেননি। হেসে বলেছিলেন –‘ও দেশ রক্ষা করতে গেছে।‘

অনেকদিন পরে সেই শহরে এসে আমি আড়চোখে সেই হোস্টেলটার দিকে তাকিয়েছিলাম-যে হোস্টেলে একদিন অরণ্য থাকত। অরণ্যদের খোঁজে যে হোস্টেলে প্রতি রাতে মিলিটারি টহল দিত। হোস্টেলের মাঠে কিছু ছেলে ফুটবল খেলছিল। বিনীতাদির ভাইও ভালো ফুটবল খেলত। ভারতীয় সেনা বিনীতাদিকে বলাৎকার করার দুই বছর না তিন বছর পরে সংঘর্ষে নিহত ভাইয়ের সনাক্ত করতে না পারা মৃতদেহটি বাড়ি ফিরিয়ে আনা হয়েছিল।

‘বাবা,তুই প্রাইভেট হোস্টেলে থাকলে ভালো হয় নাকি?’-ইউনিভার্সিটিতে পড়তে যাওয়া চিত্রভানু বাবার প্রস্তাব অগ্রাহ্য করেছিল। সকাল বিকেল দুবার করে ছেলেকে ফোন করতাম। আমাদের একমাত্র ছেলে। চিন্তা ছিল,দুশ্চিন্তাও ছিল। চিত্রভানু নিজের পৃ্থিবী নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। পরিবর্তনের জন্য শ্লোগান দিতে বেরিয়ে আসা একদল সংগ্রামী মানুষের শোভাযাত্রায় সামিল হয়েছিল।

অরণ্য অথবা আমি অন্য এক প্রজন্মের মানুষ ছিলাম। চিত্রভানু অথবা তার সতীর্থরাও ছিল একটা অন্য প্রজন্মের মানুষ। মাঝখানে কেবল মৃত সময় ভাসছিল। গণআন্দোলনের ছোট বড় খবরগুলি খবরের কাগজে বের হত। নিজেদের মাটির ওপরে,নিজেদের জলের ওপরে অধিকারের দাবিতে একদল মানুষ চিৎকার করতে শুরু করেছিল। হয়তো অতীতের চিৎকারগুলির সঙ্গে আদর্শের ভিন্নতা ছিল। কিন্তু স্বপ্নগুলির মধ্যে সাদৃশ্য ছিল।

চিত্রভানুরা সেই স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল। চিত্রভানু,ইকবাল,অন্তরা,হিমাংশু,রোহিতরা। কখনও কথাগুলি চিত্রভানু ফোনে বলত। কখনও আমাকে মেইল করত। বেশিরভাগ পুত্র সন্তানের পিতার সঙ্গে এক ধরনের ব্যবধান গড়ে উঠে। চিত্রভানু এবং হৃদয়ানন্দের সম্পর্কও এই ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিল না।

চিত্রভানুরা একঝাঁক যোদ্ধা পাখিতে পরিণত হয়েছিল। মা হিসেবে কথাটা মেনে নিতে কষ্ট হয়েছিল,কিন্তু কখনও এটাও ভাবতাম-‘ওদের এই যুদ্ধ,ওদের এই সংগ্রাম ছিল সময়ের দাবি। আমি আমার সন্তানের সুরক্ষিত ভবিষ্যৎ চাই। সহজ সরল-রৈখিক পূর্ণাঙ্গ জীবনের মায়ায় বন্দি আমি সাধারণ নারী। এই ধরনের জীবনের প্রতি থাকা অপার মোহের জন্যই আমি অরণ্যের পৃ্থিবীর অংশীদার হতে পারলাম না। আমি কারও পত্নী হলাম,কারও মা হলাম। কিন্তু তার পরেও হয়তো নিজের অজান্তে আমি একজন বিপ্লবীর প্রেয়সী হয়েও রইলাম।

অরণ্যদের সংগ্রাম হয়তো সফল হয়নি। একটা অসার্থক যুদ্ধের সেনাপতি হয়েই থেকে গেল অরণ্য। কিন্তু তাতে কি অরণ্যের প্রতি আমার শ্রদ্ধা কমে গেল? আর ভালোবাসা?

আমি বিকেলে টেলিভিশনের সামনে অনেক আগ্রহ নিয়ে বসে পড়ি। দীঘলিপকুরের পারে অনশনে ব্যতিব্যস্ত চিত্রভানু এবং তাঁর সতীর্থদের দেখি। সচিবালয়ের সামনে আত্মবিসর্জন দিয়ে শহিদ হওয়া ভূমিহীন মানুষটিকে দেখি।ওদের চিৎকারগুলি শুনতে পাই। তিন দশক পরে আজ যেন অরণ্য চিৎকার করছে। ইউনিভার্সিটিতে পড়তে গিয়ে জাতি রক্ষার স্বপ্নে মশগুল হয়ে পড়া একটা পুরোনো প্রজন্ম চিৎকার করছে। না কি হারানো অধিকার ছিনিয়ে আনার দৃঢ় সঙ্কল্পে একেবারে নতুন একটা প্রজন্ম চিৎকার করছে।

‘এত টাকা পয়সা খরচ করে ওকে গুয়াহাটি পাঠিয়েছি এইসব করে বেড়ানোর জন্য?’হৃদয়ানন্দ ক্রোধে গড়গড় করে উঠে।

একজন কৃ্ষক নেতার তেজস্বী ভাষণে টিভির পর্দা গমগম করতে থাকে।

‘ওরা পরিবর্তনের কথা ভাবছে।‘-হঠাৎ আমি বলে উঠি। আমার দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে হৃদয়ানন্দ ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। অরণ্য ভুল করেছিল না ঠিক করেছিল?

চিত্রভানু? ‘আমরা একটা বিকল্প পথের সন্ধান করছি মা…।‘চিত্রভানু বলে। অন্য অনেকের মতো এবার আমি বললাম না—এটা বয়সের ভুল…!বয়সের জোশ…!

‘একটি বিকল্প পথের অনুসন্ধান,এই সময়ের আহ্বান…।‘

-জীবন অভিজ্ঞ সাহসী নারীর কান্তিতে আমি আমার সন্তানের পাশে দাঁড়াই। এক ধীর,ঋজু,সরল জীবনের স্বপ্ন আমাকে আমার মনে বিরক্তির সঞ্চার করে। অরণ্যও হয়তো একদিন চেয়েছিল,কোমলতার পোশাক খুলে আমি তার কঠিন আঙ্গুলগুলিকে সজোরে খামছে ধরি। আমি ধরিনি। আজ আমার সন্তানও একটি স্বপ্ন দেখছে। আমার রক্ত মাংসে,আমার চিন্তা চেতনার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠা আমার সন্তান।

ওরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে চিৎকার করছে। রাষ্ট্রযন্ত্রের শোষণ আর অবদমনের বিরুদ্ধে শ্লোগানে উত্তপ্ত করে তুলছে রাজপথ। একটা ইউনিভার্সিটির ভেতরে চলা দুর্নীতি এবং অন্যায়-অনিয়মের বিরুদ্ধে চিৎকার করে ওরা কর্তৃপক্ষের রোষে পড়েছে। রোদে পোড়া রাজপথে ওরা বসে পড়ে শার্টগুলি খুলে ফেলেছে। ঘামে ভেজা খালি গায়ে লিখে নিয়েছে ন্যায়বিচারের প্রার্থনা। ওরা চাইছে -আমাদের নদীগুলিকে যেন নদীর মতো বইতে দেওয়া হয়।

কেউ বলছে -ওরা স্ফুলিঙ্গ। ওরা বরদৈচিলা। ওরা মানেই একটা হতাশ,বিভ্রান্ত প্রজন্মের মূল্যহীন অস্থিরতা।

আর আমি বলছি-ওরা আগুন। ওরা সূর্য।

ওরা শিল্পী। বিপ্লবী। ওরা জাতি এবং মাটিকে ভালোবাসা সংগ্রামী। আমি একদা এক বিপ্লবীর প্রেয়সী। আজ আমি অন্য এক বিপ্লবীর মাতৃ। আমি ওদের চোখের ভাষা বুঝতে পারি। ওরা কখনও ভুল করতে পারে,কিন্তু ভণ্ডামি করে না।

আমি জানালার কাছে বসি। দেওয়ালে ঝুলে থাকা পুরোনো ছবিটির ভঙ্গিমায়। একেবারে অবিকল রূপে।

এটা বূষ্টিস্নাত বিকেল নয়,বাইরে সূর্যের ঝলমলে হাসি।

——–

টীকা:

ভুত-পোয়ালি-শিশুদের জন্য লেখা জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালার কবিতা।

বরদৈচিলা-বৈশাখমাসে অনুষ্ঠিত প্রচণ্ড তুফান।

লেখক পরিচিতি -১৯৯২ সনের ২৪ অক্টোবর যোরহাট জেলার তামুলি ছিগায় পঞ্চানন হাজরিকার জন্ম। ২০০৫ সনে অগ্রদূত পত্রিকায় প্রথম গল্প ‘আরধির পৃ্থিবী’প্রকাশিত হয়। অসমের পত্রপত্রিকায় নিয়মিত গল্প প্রবন্ধ লিখে থাকেন। প্রকাশিত গদ্য সংকলন ‘অন্তহীন আলাপ’। ২০১২ সনে গরীয়সী পত্রিকা আয়োজিত চন্দ্রপ্রসাদ শইকীয়া ছোটগল্প পুরস্কার লাভ করেন।

Facebook Comments

comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top