মাই ডিভাইন জার্নি II মূর্শেদূল কাইয়ুম মেরাজ

এক : মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার

পুরান ঢাকায় তখনো মহল্লা বিষয়টা টিকে ছিল। ছিল প্রত্যেক মহল্লার একটা নিজস্বতা। নানারকম মজার মজার চরিত্র যেমন ছিল তেমনি ছিল প্রতিটি ইটের ব্লকে প্রতিটি ঘাসের ডগায় এক একটি কাহিনী। সেই সব ঘটনা হয়তো কখনো বলবো তবে আজ শুরু করতে চাই একেবারে ভিন্ন একটা ঘটনা দিয়ে। যদিও এই ঘটনার সাথে পুরানো ঢাকা সে হিসেবে কোনো যোগসূত্র নেই। তবুও তাই দিয়েই শুরু করলাম। শহরে বেড়ে ওঠার গল্পে ধান ক্ষেত, নদী, মেঠোপথের মতো রোমান্টিকতা হয়তো থাকে না কিন্তু তারপরও এর পরতে পরতেও লুকিয়ে থাকে হাজারো স্মৃতিকথা। যাক সে কথা।

যে কারণে পুরান ঢাকার কথা দিয়ে শুরু করলাম সে কথায় আসি। পুরান ঢাকার আর দশটা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের মতোই সাদামাটা শৈশবে বেড়ে উঠছিলাম। সেই সময় ঢাকায় সুবেদারি-নায়েব-নাজিম-সরকার-জমিদারের আমল শেষ হয়ে চেয়ারম্যানের আমল শুরু হয়েছে বলা যায়। মহল্লায় মহল্লায় চেয়ারম্যানের পান্ডাদের মাস্তানি ছিল। এলাকার বয়োজ্যেষ্ঠদের শাসন ছিল। কলতলার ঝগড়া ছিল। কার ছেলে কার মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে গেলো সেই সব রস গল্প ছিল। কে কার সাথে প্রেম করছে সেই কানাঘুষা ছিল। প্রচুর গালাগালি ছিল মারামারি ছিল। ধনী ছিল দরিদ্র ছিল। বারো রঙের মানুষ ছিল। এতোশত দলাদলি-মারামারি-গালাগালির মধ্য গলাগলিও ছিল-প্রেম ছিল-মমত্ব ছিল। সবাই সবাইকে চিনতো। মহল্লায় কে ঝাড়ু দেয় তাও সবাই জানতো। আমরা যখন বেড়ে উঠছিলাম তখন চারপাশটা কিছুটা অস্থির হয়ে উঠছিল। রাজনীতির ঘোলাজল ঢুকে পড়েছিল মহল্লার চৌহদ্দির ভেতরেও। হয়তো আগেও ছিল তবে আমরা বয়সের দোষে তখন টের পেতে শুরু করছিলাম। রাস্তায় হাঁটতে হলে নিজের জায়গা করে নিতে হবে, স্বভাবে মাস্তানি বা মাস্তানি ভঙ্গিতে কি কি সুবিধা ততদিনে পরিবেশ-প্রকৃতি আমাদের জানিয়ে দিয়েছে। না চাইলে কিচ্ছুটি পাওয়া যাবে না তাও জেনে গেছি সময় মতো। বলা যায় বয়ো:সন্ধিকালেই একটা উগ্রতা ঢুকে পড়তে চাইছিল চারপাশের রীতি অনুযায়ী। যা হয় আর কি। প্রকৃতির সংস্কারকে পাশ কাটিয়ে পারিপার্শ্বিক সংস্কার ঢুকে পড়ছিল চরিত্রে।

আমার পরিবারে ধর্মপরায়ণতা থাকলেও সেই অর্থে কোনো মৌলবাদীতা বা রক্ষণশীলতা দেখিনি। তবে দাদা বাড়িতে আসলে পুজা দেখে বাড়ি ফিরলে তিনি গরম পানি দিয়ে গোসল করাতেন। সেই সব গল্প আরেকদিন বলবো। তবে পরিবার কখনো মুক্তচিন্তা করতে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়নি। এইসব অস্থিরতার ভেতরে বই পড়ার নেশা ঢুকে পড়েছিল কোনো এক ফাঁকে। আর সবচেয়ে বড় সর্বনাশটা হয়েছিল যখন কানে লালন ফকিরের গান ঢুকে বাসা বাধতে শুরু করে। এলাকায় বন্ধু বা বড় ভাইদের মাস্তানি, বাড়ির পাশের বস্তির গালাগালি, পাশের বাড়ির আড় চোখে তাকানো মেয়েটি, মাদকের হাতছানির ভেতরে বড় হতে হতে কখন যে মাথার ভেতর লালন ঢুকে পড়েছিল তার সঠিক সময় বা দিনকাল এখন আর মনে পড়ে না। বা লালনের কোন্ গানে বা কোন্ লেখায় তার প্রেমে পড়েছিলাম তাও জানি না। সেটা কি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গোরা উপন্যাসের সেই বাউলের কণ্ঠে খাঁচার ভেতর অচিন পাখির গান? নাকি কোনো অডিও ক্যাসেটে শোনা বাড়ির পাশে আরশি নগর তাও মনে করতে পারি না আজ। তবে লালন মাথার ভেতরে বসে ছিল এটা ঠিক।

এভাবেই জীবনের পথে চলতে চলতে হঠাৎই এক বন্ধু ফোনে জানালো কাকা (সে সময় আমরা কোনো এক অজ্ঞাত কারণে বন্ধুদের একে অপরকে কাকা বলে সম্ভোধন করতাম) আমাদের গ্রামে চলে আসো লালন গানের অনুষ্ঠান আছে, সারারাত লালন গান হবে। তুমি তো লালন গান ভালোবাসো চলে আসো। কুষ্টিয়া থেকে বাউলরা আসতেছে। বহুবছর ধরেই কুষ্টিয়ায় যাওয়ার একটা বাসনা ছিল মনে কিন্তু কিভাবে যাব? কার সাথে যাব? কবে যাব? কত টাকা লাগবে যেতে? কোথায় থাকবো? কিছুই ঠিক করে উঠতে পারিনি। কুষ্টিয়া নিয়ে কারো কাছে কোন তথ্য জানতে চাইলেই আড় চোখে তাকিয়ে হাসি হাসি কণ্ঠে ব্যঙ্গাত্মক ভঙ্গিতে বলতো- কিরে গাজা খাইতে যাবি নাকি? এর জন্য আর বিশেষ কাউকে জিজ্ঞাস করার উৎসাহও পেতাম না। তখন ইন্টারনেট আজকের মতো ছিল না। তথ্য পাওয়া সহজ ছিল না। বা এভাবেও বলা যায় আমি তথ্য সংগ্রহ করতে পারিনি। অনেকবার পরিকল্পনা করা হয়েছে কিন্তু শেষ পর্যন্ত কেউ যেতে রাজি হয় নাই বা সঠিক তথ্যও ছিল না যে হুট করে চলে যাব। ভীতু স্বভাবের আমি নিজেও হয়তো সাহস করে উঠতে পারিনি। তবে বন্ধুবর যখন বাড়ির পাশে বিক্রমপুরে লালন গানের কথা বললো তখন আর থাকতে না পেরে চলে গেলাম বাস ধরে। সেই রাতে আমার সাথে প্রথম পরিচয় কুষ্টিয়ার রব ফকিরের সাথে। সেই রাতের অনেক অনেক ঘটনা। আজ সে গল্প বলছি না সময় সুযোগ হলে সেটাও বলবো। সেটাও অনন্য এক অভিজ্ঞতা। রব ফকিরের সাথে একটা গোটা রাতের গল্প না বললে আমার ডিভাইন জার্নির অনেক কিছুই অপূর্ণ থেকে যাবে। যাক সে কথা। মৌলবাদী আগ্রাসনে সেই রাতে লালন গান করতে দেয়া হয়নি মঞ্চে তবে একদিকে আমার ভালোই হয়েছিল। সারা রাত রব ফকিরের দলের সাথে সঙ্গ হয়েছিল। সেই রাতেই রব ফকির দোলের উৎসবে কুষ্টিয়ার নিমন্ত্রণ জানাল । খুব খুব করে বললো দাদা চলে আসেন ভালো লাগবে। আপনারে ভালো লাগছে চলে আসেন। তখনো রব ফকির প্রথিতযশা হয়ে উঠেননি। কুষ্টিয়ার মানুষের কাছ থেকে নিমন্ত্রণ পেয়ে সেটা ছেড়ে দিবো সেটা হবার ছিল না তখন।


আমিও সেই রাতের মতোই পকেটে কিছু টাকা নিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে রওনা দিলাম কুষ্টিয়ার পথে। মনে হচ্ছিল লালনের দেশে যাচ্ছি। এর বেশি মাথায় সম্ভবত আর কিছু ছিল না। সঙ্গে কাউকে না পেলেও সেটা বড় বিষয় ছিল না; ভাবনায় ছিল গেলে রব ফকিরের সাথে দেখা হবে। সেই চরম উত্তেজনা নিয়ে পৌঁছে গেলাম লালনের দেশে। উত্তেজনা এতোটাই ছিল পথে খাওয়া-দাওয়া করা পর্যন্ত হলো না। মেলায় প্রবেশ করতে যেয়েই দেখা হয়ে গেলো রব ফকিরদের দলের এক সাধুর সাথে। তিনি প্রচণ্ড ভীড়ের মধ্যেই আমাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাতে লাগলেন। সেদিন মেলার প্রথম দিন। তখন সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। আলোচনা শেষে মাত্র গান শুরু হয়েছে মূল মঞ্চে। মঞ্চের কাছাকাছি যাওয়ার পর দূর থেকেই চোখের ইশারায় রব ফকির কাছে ডাকলো। তখন আজকের মতো এতো বিশেষ ব্যবস্থা ছিল না। মঞ্চের উপর যেয়েই রব ফকিরের সাথে কুশল বিনিয়ম হলো। উনি একজনকে সাথে দিয়ে দিলেন বললেন দাদা ঘুরে ঘুরে দেখেন রাত দুইটার সময় মঞ্চ থেকে আমরা নামবো তখন মঞ্চের দিকে চলে আসবেন একসাথে ভোটন গুরুর বাড়ির দিকে যাব। সেই কথা মতো মেলায় ঘুরতে শুরু করলাম। আমি সবকিছু দেখেই মুগ্ধ হচ্ছিলাম। সত্যজিতের লালমোহন বাবুর ভাষায় “স্তব্ধবাক, রুদ্ধশ্বাস, বিমূঢ়,বিমুগ্ধ, বিস্ময়”। সেই বারই সাঁইজির বহু গান শুনেছিলাম যা আগে কখনো আমি শুনি নাই। মনে আছে মঞ্চ থেকে ভেসে আসছিল-

কবে হবে সজল বরষা?
রেখেছি মন সেই ভরষা..
আমার এই ভগ্ন দশা,
যাবে কত দিন পরে?

এবার যদি না পাই চরণ,
আবার কি পড়ি ফ্যারে..
রাখিলেন সাঁই কূপজল করে,
আন্ধেলা পুকুরে..

ঘুরে দেখতে দেখতে সঙ্গের সাধু বলে উঠলো দাদা গো এতো মানুষ তো মেলায় জন্মেও দেখি নাই। আমি আপনারে কি ঘুরায়া দেখাবো কি নিজেই তো উত্তর-দক্ষিণ খুঁজে পাইতেছি না। সেবারের ঘুরে বেড়ানো রব ফকিরের সঙ্গ সব কিছুতেই অসংখ্য গল্প বাসা বেঁধে আছে সময় সুযোগ হলে সে গল্প আরেক সময় বলবো। বাজানের সাথে কীভাবে পরিচয় হলো সেই গল্পটাও বলতে হবে। তবে তা এখন না। ফিরে আসি মাজার প্রাঙ্গণে ঘুরে বেড়ানোর কথায়।

আমার চোখে কেবলই বিস্ময়। লালন সাঁইজির মাজার চোখের সামনে দেখলাম। জীবনের একটা বাসনা পূর্ণ হয়ে গেলো। কখন যে সঙ্গের সাধুকে হারিয়ে ফেলেছি মনে নেই। এভাবেই রাত তখন একটা বাজে। তখন বুঝলাম সারা দিন কিছু খাওয়া হয়নি প্রচণ্ড ক্ষুধা অনুভব করতে লাগলাম। মাজার প্রাঙ্গণের ছোট্ট ছোট্ট হোটেলগুলোতে প্রচণ্ড ভিড়। একটা গুমট আবহওয়ায় দম বন্ধ করা পরিবেশ আমার শহুরে সংস্কার আমাকে কোথায় যেন আটকে দিচ্ছিল। মনে হচ্ছিল ফাঁকা কোনো জায়গায় যেয়ে যদি একটু ভাত মাছ খেতে পারতাম তাহলে খুব ভালো হতো। আমার অবস্থা তখন-

চাতক থাকে মেঘের আসে
মেঘ বর্ষাল অন্য দেশে ।।

বলো চাতক বাঁচে কিসে
ওষ্ঠা গত প্রাণ আকুল
হায়রে বিধি ওরে বিধি ।।

তোর মনে কি ইহাই ছিল
সমুদ্রের কিনারে থেকে
জল বিনে চাতকি মইলো

যাই হোক মেলার ভিড় ঠেলে মূল রাস্তায় এসে রিকসায় বসে বললাম মামা কোনো খাবার হোটেলে নিয়ে যাও ভাত খাব। রিকসাচালক একটু অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললো এতো রাতে দোকান তো খোলা পাইবেন না এইখানেই তো ভালো হোটেল আছে। আমি তাও বললাম বাসস্ট্যান্ডে দিকে নিয়ে যাও কোনো না কোনো হোটেল নিশ্চয়ই পাব।

আসলে আমি খাবারের জন্য দূরে যেতে চাইছিলাম নাকি এই ভিড়ের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না নাকি এতো অল্পসময়ে জীবনের এতো প্রাপ্তি আর ধারণ করতে পারছিলাম না তা এখন আর মনে নেই। তবে একটু একলা হতে চাইছিলাম। রিকসাচালক আমাকে না বুঝাতে পেরে শেষে এগিয়ে চললো অন্ধকার রাস্তা ধরে। এটা যে ঢাকা শহর না। রাজধানী না। একটা জেলা শহর তখনো সেটা আমার মাথার ভেতর ছিল না। রিকসা যত এগিয়ে চলছিল ততই বুঝতে পারছিলাম সমস্ত শহর ঘুমিয়ে পড়েছে। এখনকার মতো তখন সারা রাত লোকজনের তেমন ভিড় ছিল না। রাস্তায় পিনপতন নীরবতা। তারপরও রিকসায় ফাঁকা রাস্তায় চলতে চলতে আমার বেশ ভালোই লাগছিল। রিকসাচালককে বললাম আপনি গান করেন? চাচা পেছনে তাকিয়ে ফিক করে হাসি দিয়ে বললো আমরা কামলা মানুষ আমরা কি আর গান পারি। মেলায় অনেক শিল্পী আছে। লালনে না আইলে মনে শান্তি পাই না তাই এতো রাইতে রিকসা নিয়া চইলা আসছি। বাড়ির মানুষ পছন্দ করে না। তাও মন মানে না। এই বলে রিকশা চালাতে চালাতে অসামান্য কণ্ঠে গুণ গুণ করে গাইতে শুরু করলো-

আমার হয় না রে সে মনের মত মন ।।
কিসে জানবো সেই রাগের কারণ
আমি জানবো কি সে রাগের কারণ
আমার হয় না রে সে মনের মত মন ।।


বড় বাজারের রেললাইন পার হওয়ার পর দেখলাম একটা হোটেল। নীরব রাস্তায় একমাত্র খোলা দোকান। কিন্তু কাছে যেতে যেতে দেখলাম বাবরি চুলের দোকানী সাটার নামাবার আয়োজন করছেন। আমার রিকসা কাছাকাছি পৌঁছাতে আমি বললাম খাওয়ার কিছু আছে? ভাত খাওয়া যাবে? ভদ্রলোক আমার দিকে একবার তাকিয়ে কি ভালবেন কে জানে হাসি হাসি মুখে বললো আসেন। বলে অর্ধেক বন্ধ করে দেয়া শাটার আবার খুলে ভেতরে বাতি জ্বালিয়ে আমাকে বসতে দিলেন। এক কামরার ছোট্ট একটা স্যাঁতস্যাতে হোটেল; বসার জন্য তিনটা তেলতেলে টেবিল। একপাশে খাবার রাখার রেক। পেছনের দিকে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা। আর তার পাশে ছালা দিয়ে অর্ধেক ঢাকা আরেকটা প্রবেশপথ সেটাই রান্নাঘর। টেবিলের উপরে উল্টে রাখা চেয়ার মাটিতে রেখে ভদ্রলোক আমাকে বসার ব্যবস্থা করে দিলেন। বললেন ভাত খাবেন? তখন আমার মাথা খারাপ করা ক্ষুধা লেগেছে। এমনিতেই আমি ক্ষুধা সহ্য করতে পারি না। আমি মাথা নেড়ে কাঁধের ব্যাগটা নামিয়ে হাত মুখ ধুতে মনোনিবেশ করলাম।

চেয়ারে বসেই আমার শহুরে অহঙ্কারের সুরে কিছু একটা বললাম সেটা বেশ বিরক্তি ও আদেশের সুরে। সম্ভবত এতো দেরি হচ্ছে কেনো বা এখনো দিচ্ছে না কেন। এই জাতীয় কিছু একটা বলেছিলাম। রাতের নিস্তবতা খান খান করে দিলো আমার চিৎকার। রান্নাঘরে হাড়ি-বাসন নাড়াচাড়র শব্দ পাচ্ছিলাম। আমার উত্তেজনা দেখে ভদ্রলোক দৌঁড়ে এসে আমার পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বললো, “আরেকটু বসো লক্ষ্মী এখনি হয়ে যাবে”। হোটেলের একজন কর্মচারী আমার পিঠে হাত দিয়ে শহরে কিছু বললে সেই সময় আমি হয়তো অপ্রীতিকর কিছু করে বসতাম। আমার অহং আমাকে তাই বানিয়েছিল। আমি সেভাবেই বড় হয়ে উঠছিলাম শহুরে পরিবেশে। নিজেকে বড় করে জাহির করাই ছিল শহরের শিক্ষা। তবে মধ্যরাতে সেই ভদ্রলোকের এতো পরম মমতায় পিঠে হাত বুলিয়ে যখন আমাকে লক্ষ্মী সম্ভোধন করলো তখন ক্ষণিকের জন্য চোখে পানি চলে এসেছিল। মানুষ তার মনে এতো ভালোবাসা জমা করে রাখতে পারে সেটা আমার জানাই ছিল না। সব সময়ই দেখেছি হোটেলে ঢুকেই ধমকের সুরে অর্ডার করা ওয়েটার মাথা নিচু করে অর্ডার নেয় বা সুযোগ পেলে সেও খারাপ আচরণ করে থাকে। কিন্তু এই মধ্যরাতে প্রায় বন্ধ করা দোকান খুলে একজন অপরিচিত মানুষকে এতো ভক্তি নিয়ে ভালোবাসা দিয়ে কেউ খাওয়াতে পারে সেটা আমার অভিজ্ঞতায় ছিল না। এমন ভালোবাসায় চোখ বারবার ভিজে আসছিল। কি বলবো কি ভাববো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।

তারপর ভদ্রলোক আমাকে ডিম ভেজে দিয়েছেন। আমি ডিম যখন গোগ্রাসে খাচ্ছি সেই সময় তিনি ভাত চড়িয়ে দিয়েছেন। তার সাথে সকালের রান্নার জন্য রাখা মুরগির মাংস ভেজে দিয়েছেন। কোথা থেকে লেবু আনছে খুঁজে খুঁজে কাচামরিচ দিচ্ছে। আমি কেবল দেখছি আর দেখছি ভদ্রলোকের মমতা। এর আগে মা ছাড়া অন্য কেউ এতো পরম মমতায় আমাকে এভাবে কেউ বলেছিল কিনা আমি মনে পড়েনি। আমার সকল অহংকার-সংস্কার-আমিত্ব ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছিল সেই রাতে সেই ভদ্রলোক। আজ যদি তাকে পেতাম তার চরণে ভক্তি দিতাম। আমি মাথা নিচু করে খেয়ে যাচ্ছিলাম। আমি তার চোখের দিকে তাকাতে পারি নাই। চোখের জল আড়াল করে নীরবে খেয়ে গেছি। সেই আমার কুষ্টিয়ার মানুষের প্রেমে পড়া। তারপর কতবার প্রেমে পড়েছি তা বলতে গেলে আরব্য রজনী হয়ে যাবে। সাঁইজির দেশের লোকের ভেতরে সাধুতা তো জন্মগত। সেই মাটিতে আমি জন্মাইনি কিন্তু যা কিছু জীবন থেকে শিখে মনে রাখার চেষ্টা করেছি তার সবই সাঁইজির চরণ ধুলি।

“আমি ঐ চরণে দাসের যোগ্য নই।
নইলে মোর দশা কি এমন হয়।।

ভাব জানিনে প্রেম জানিনে
দাসী হতে চাই চরণে।
ভাব দিয়ে ভাব নিলে মনে
সেই সে রাঙ্গা চরণ পায়।।”

যখন হোটেল থেকে বেড়িয়ে রিকসা চড়ে মাজারে ফিরছিলাম। তখনকার আমি আর যে আমি মাজার থেকে বের হয়েছিলাম সেই আমি কি এক আমি? এই প্রশ্নটা আজও আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। বই পড়ে যে শিক্ষা আমি নিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম মহান সব কথা বাণী বইতেই লেখা থাকে। সেই রাতে সবকিছু মিথ্যা হয়ে উঠেছিল আমার কাছে। জীবনের বড় বড় শিক্ষা মানুষের কাছ থেকেই নিতে হয় আমি সেই রাতের অন্ধকার রাতে রিকশা করে মাজারে ফিরতে ফিরতে একটু একটু করে বুঝতে শিখছিলাম-

ভবে মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার
সর্বসাধন সিদ্ধ হয় তার।।
নদী কিংবা বিল বাওড় খাল
সর্বস্থলে একই এক জল।
একা মেরে সাঁই ফেরে সর্ব ঠাঁই
মানুষে মিশিয়ে হয় বেদান্তর।।
নিরাকারে জ্যোতির্ময় যে
আকার সাকার হইল সে।
যেজন দিব্যজ্ঞানী হয়
সেহি জানতে পায়
কলি যুগে হলো মানুষ অবতার।।
বহুতর্কে দিন বয়ে যায়
বিশ্বাসে ধন নিকটে পায়।
সিরাজ সাঁই ডেকে বলে লালনকে
কুতর্কের দোকান খুলিস নে আর।।

মানুষের কাছ থেকে জ্ঞান নেয়ার যে ক্ষমতা আর সবার মত আমার হয়তো এর আগে ছিল না। আমি বুক টান টান করে বলতে পারি আমি সে রাতেই শিখেছিলাম। এতে আমার কোনো লজ্জা নেই। বরং চোখ ভিজে যাওয়া ভালোবাসা আছে, প্রেরণা আছে; আছে গভীর ভক্তি।

মানুষকে দেখবার দৃষ্টি কি আমার আসলেই সেই রাতে খুলেছিল? বা আদৌ খুলেছে কিনা সেটাও একটা প্রশ্ন। আর সেদিনই কি আমি বুঝেছিলাম মানুষের মানে? নাকি বহুদিন পর যখন আমি মনে মনে খুঁজতে গিয়েছিলাম আমার ভাবনা কবে কখন থেকে পাল্টাতে শুরু করেছিল তার স্মৃতি হাতড়াতে হাতড়াতে আমি পৌঁছে গিয়েছিলাম সেই দোলের রাতের সেই এক কামরার হোটেলে। যেখানে আমি জল জল চোখ নিয়ে মধ্যরাতে ভাত খাচ্ছিলাম?

বুদ্ধ যেদিন নির্বাণ পেয়েছিল সেদিন কি তাঁর চোখে জল জমে ছিল? নাকি জল সেই মায়া যা ছাড়িয়ে যে নির্বাণের পথে অগ্রসর হতে হয়? লালন সাঁইজির জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছেও কি মনের মানুষের সন্ধান পেয়েছিলেন? হেলমক বিষ পানের সময় সক্রেটিস কি ভাবছিলেন? ফাঁসির ঝুলে পড়ার সময় ক্ষুদিরাম কি স্বপ্ন দেখেছিল? প্রেয়সীর চোখের দিকে তাকিয়ে আমি কি ভাবি? এসব প্রশ্নের সঠিক উত্তর বা সম্ভাব্য উত্তর নির্ণয় করা প্রায় অসম্ভব। তারপরও অনুসন্ধানী মন উত্তরের পেছনে দৌঁড়ায়। জীবন মানেই তো যাত্রা। এক খোঁজের যাত্রা। এই যাত্রায় কে কি খোঁজে সেটা একান্তই ব্যক্তিগত। কিন্তু এই খোঁজ যখন সার্বজনীন হয় তখন তা প্রকাশ্যে আসে। নতুন ভাবনার জন্ম দেয়। আগে পরে অনেক অনেক ঘটনা ঘটেছে জীবনে এবং প্রতিনিয়ত নিজেকে জানার আমার যাত্রা পথে নতুন নতুন অভিজ্ঞতা ঘটনা যেমন যুক্ত হয় তেমন নতুন নতুন সাধু গুরুর সাথেও মিলনমেলায় কত কত স্মৃতি-কাহিনী জন্ম হয়। তবে পেছন ফিরে যখন ভাবি তখন আমার বারবার মনে হয় সেই রাতেই আমার এই ডিভাইন জার্নির সুচনা হয়েছিল। সময় সুযোগ হলে আমার এই ডিভাইন জার্নির এক একটি ঘটনা এক একটি চরিত্রের কথা বলবো। সাধু-গুরু সর্ব চরণে ভক্তি রেখে “মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার” যাত্রা আপাতত এখানেই বিরতি।

“ক্ষম অধীন দাসের অপরাধ
শীতল চরণ দাও হে দ্বীননাথ
লালন বলে ঘুরাইও না,
হে মায়াচারী”
………………………………………..

সেই সময়ের কোনো ভিডিও নেই… তবে কুষ্টিয়ার লালন উৎসবের গানের ভিডিও লিংক দিলাম
ভিডিওটি দেখতে ক্লিক করুন

Facebook Comments

comments

২ Replies to “মাই ডিভাইন জার্নি II মূর্শেদূল কাইয়ুম মেরাজ”

  1. ব্রাহ্মময় চট্টরাজ বলেছেন:

    অসাধারণ…..
    পড়তে পড়তে আবেগ চোখ ভিজে গেল….
    জয়গুরু জয়গুরু…..
    আরো লিখুন , আমরা সমৃদ্ধ হই…
    জয়গুরু জয়গুরু

  2. আফরোজা লীনা বলেছেন:

    অসাধারণ লাগলো লেখাটি। চোখে ভাসছিল প্রতিটি মুহূর্ত। শুভকামনা ?

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top