গুচ্ছ কবিতা ।। সেলাই করা দুলদুল ঘোড়া ।। বদরুজ্জামান আলমগীর

♦  পা-কাটা লোকটা ♦
যে চলে যায়, অথবা যে জানে তার চলে
যাবার সময় এসেছে ঘনিয়ে
তার কাছে মনে হতে থাকে-
বাথানের ওপার থেকে
চাঁদটা কেন এতো সাথে সাথে আসে?
এভাবে ধরতে গেলে মনেই হবে,
মনে হতে পারে- চাঁদটা কী তাহলে
পোস্ট অফিসবিহীন
এক বাড়ির ঠিকানায় চিঠি বিলি করার ডাক পিয়ন?
হতে তো পারেই, হবেও হয়তো বা!
যদিবা তা-ই হয়- চিঠি কী নিয়ে এসেছে তার
খোয়াযাওয়া পায়ের শিকড় শিকল- দাগ খতিয়ান?
চিঠি পড়লেই জানা যাবে- পাঁচটি আঙুল
ছিল না-কী পাঁচটি থেঁৎলে যাওয়া লাল জবাফুল?

যে চলে যাচ্ছে এভাবেই কারুর পক্ষে
চলে যাচ্ছে সে- এই তো শেষমেশ সে-ও দাঁড়িয়েছে
উঁচু পাহাড়ের নিচু কিনারায়!

সবখানেই কীসের এমন দাগ লেগে আছে-
কথার, স্পর্শের, আওয়াজের দাগ লেগে থাকে,
একটা মা-হারা গরুর বাছুর কেবল
হাম্বা হাম্বা ডাকে!

যে চলে যায় সে-কী পা-কাটা লোকটার কাটা পা-
যে ফেলে আসা পায়ের আকার তালাশ করে?

হবে হয়তো কাটা পা- নয়তো হবে মা-হারা বাছুর
দু’জনেই কেন যে এমন হাম্বা হাম্বা ডাকে!

♦ একদানা মহাকাব্য ♦
আমার চোখে জল টলটল করে
কিন্তু টপটপ করে মাটিতে পড়ে না।

চোখের নিচে বাড়িয়ে ধরা একজোড়া হাত কোথায়?

চোখের জল মাটিতে ফেলতে নেই;
চোখের পানি তাই চোখেই টলমল করে।

চোখের জল বুঝি কোরানের আয়াত-
তাকে মাটিতে ফেলতে নেই
নদী বা সাগরের বড় বড় ঢেউয়ের
গতির মুখে ফেলতে হয়,
না হয় তুলে রাখতে হয় তুলসীগাছের গোড়ায়।

চোখের জল ফেলতে আপাতত আমি যাই না সমুদ্রের কাছে;
একবার এতোবড় জলে মিলিয়ে গেলে
তোমাকে আর পাবো না, খুঁজেই পাবো না-
এই জলের ফোঁটায় ঘন হয়ে তিরতির করো যে তুমি!

উপরে জলের ফোঁটা নিচে থাকে ফাটাফাটা ভূমি
মাঝখানে মাথা নুয়ে ধ্যান করে জালালউদ্দিন রুমি!

♦  সঞ্জীব দাস ♦
নীরবতা নীরবতা সঞ্জীব দাস
ঘোড়াউত্রা খলবল ভাঙা রাজহাঁস।

হাওয়া থরোথর ওই কাল মহাকাল
গাঙ বয় পায়ে পায়ে মায়ের কপাল।
বুক পেতে কেন হও নিরাশ নিরাশ
নীরবতা নীরবতা সঞ্জীব দাস।

ঘোর লাগে মেঘে মেঘে চিতার পাশে
দেবতা বরুণ নাচে পানির ত্রাসে।
ঘর ভাসে দোর ভাসে শাবাশ শাবাশ
নীরবতা নীরবতা সঞ্জীব দাস।।

♦ মুজালি ফকির ♦
কেউ কোনদিন মুজালি ফকিরকে পরিপূর্ণভাবে হাসতে দেখে নি। হাসির কথা বললেই ফকির রহস্য করে একটুখানি হাসে, আর বলে, সব হাসি সেইদিনের জন্য তুইলা রাখচি; সে-দিনই হাসবো যেদিন আমার রাই-এর দেখা পামু।

অবশেষে মুজালিকে সবাই হাসতে দেখে।

মুজালি ফকির আরাম করে হাসে- যেদিন মরণ তার সামনে এসে দাঁড়ায়!

♦ কবি এমন ♦
সবাইকে ঘুম পাড়িয়ে রাত্রি জেগে থাকে,
একজন কবি এমন-
সবার পক্ষে ক্রুশবিদ্ধ হন যিশুখ্রিস্ট যেমন।

সমুদ্রের অসীম একোরিয়ামে
নুন থৈথৈ পানির আত্মায়
সেলাই করে চোখের জলে নকশিকাঁথা,
প্রাণের তারানা ক্ষণ-

ঢালুর দিকে হেঁটে যাওয়া কবিটি এমন।

♦অকারণ হাঙ্গামা♦

তুমি পাতা। আমি হাওয়া।
আমি কারণ ছাড়া তোমাকে তিরতির কাঁপাবো!

তুমি হরিণ। আমি জঙলা।
কখন ভয় পাবে তার আশায় আমি ফকির হয়ে র’বো।

তুমি পাড়। আমি ঢেউ।
কারণ ছাড়া তোমার পায়ে আছড়ে আছড়ে জড়াবো।

তুমি বৃষ্টি। আমি ময়ূর।
আমি কারণ ছাড়া বসন্ত হয়ে বনের কিনারে নাচবো।

তুমি রাত্রি। আমি তারা।
আমি কারণ ছাড়া তোমার উপর ঝরে ঝরে পড়বো।।

♦ সাতপুরুষের ঘড়া ♦
শ্যাম অঙ্গে তোলো নারী দ্বিধাকাঞ্চন ভরা
সঙ্গোপনে মেলে ধরো সাতপুরুষের ঘড়া।

পানপাতা মহুয়া নারী চন্দ্রাবতী কলা
ধানদুর্বা বিন্নিনিধির মঙ্গাজল তোলা।

শ্রাবণে সে ঘোরলাগা রহস্য শহর
কোশা নৌকায় ধ্যান করে তোমার নাগর।

অনিয়ম পায়ে এসো মৎস্যগন্ধা মায়া
নুন্নির মূলে খাড়া ভাটি গাঙ্গের নাইয়া।

নিদারুণে আশা এই লগ্নির ভাগ লৈয়ো
শস্যবতী হাতের কড়ি দুঃখসমান আয়ু।

আকালের হাওয়া বসে বিরান খামার
আনো ঘরে দুধভাত কিষাণী আমার।।

♦ ওয়াস কোরনি ♦
একবার তোমার রূপ দেখেছি, তারপর থেকেই দৃষ্টিহীন-
তারপর থেকেই আমি স্মৃতিভুক, অন্ধতায় ভরসা করি।

ওই স্মৃতিটুকুই আমার সমূহ দৃষ্টির কাসিদা-
মনে হয়, দেখার কথা ছিল, কিন্তু দেখা হয়নি।

ওয়াস কোরনি জীবনভর ফেলে আসা এক ওয়াক্তের
কাজা নামাজ পড়ে।

আমিও তোমাকে দেখার অনড় মুহূর্তের খোঁজে কাজা নামাজ পড়ি।

সারাজীবন ওয়াস কোরনি-
তোমাকে প্রথম দেখার মুহূর্তকে সিজদা করে যাই।

Facebook Comments

comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top