একগুচ্ছ গ্রীক কবিতা।। ম্যানোলিস অ্যানাগ্নোসটাকিস ।। অনুবাদ-গৌরাঙ্গ হালদার

❀ কাব্যকৃতি
তুমি আমাকে বলবে,
মানুষের সবচেয়ে পবিত্র প্রকাশ, কবিতার সঙ্গে
আবার তুমি বেঈমানি করছো
তোমার পাপী উদ্দেশ্য হাসিলে
ভারবাহী একটা গাধা বা উপায় হিসেবে
তুমি তাকে ব্যবহার করছো আবার
নবীনের ক্ষতির কথা জেনেও তা করছো তুমি স্বজ্ঞানে
নিজের দৃষ্টান্তের ভেতর দিয়ে।

– আমাকে বলো, বছরের পর বছর ধরে
তুমি আর তোমার ধরণ
কীসের সাথে বেঈমানি করেনি
বিশ্ববাজারে, সাধারণ হাঁটে,
একের পর এক নিজের অবস্থান বদল করে,
কাজেই, তুমি রয়ে গেছো চোখ ছাড়া দেখতে
কান ছাড়া শুনতে, মুখে তোমার কুলুপ আঁটা
আর এখন কিছুই বলছো না তুমি।

কীসের জন্য তুমি আমাদের কাছে
মানুষের পবিত্র অধিকারের অভিযোগ নিয়ে এসেছো?
আমি জানি: তুমি বলবে, আবার কথা আর প্রচার।
বেশ, হ্যাঁ! কথা আর প্রচার।
কথা হতে হবে পেরেকে হাতুড়ির ঘায়ের মতো
যাতে তারা বাতাসে উড়ে যেতে না পারে।

✼✼✼ ✼✼✼ ✼✼✼

❀থিসালোনীকি –উনিশ শ উনসত্তুরের দিনগুলি
মিশরি রাস্তায় প্রথম ডানের মোড়
সেখানে এখন দাঁড়িয়ে আছে লেনদেনের ব্যাংক ভবন
ট্যুরিস্ট এজেন্সি আর ইমিগ্রেশন অফিস
গাড়ি চলাচলের ভিড়ে বাচ্চারা এখন আর খেলতে পারে না
যে করেই হোক, বাচ্চারা বড় হয়ে গেছে
যে সময়কে তুমি জানতে তা চলে গেছে
তারা এখন আর হাসে না
চুপিচুপি ফিসফিস কিংবা ভাগাভাগি করে না আস্থা
যারা বেঁচে গেল,
মানে, যখন থেকে ভয়াবহ অসুস্থ্যতা দেখা দিলো
বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, ভূমিকম্প, সশস্ত্র সৈনিক;
তারা কি তাদের বাবার মুখ মনে করে?
কথামালা : তুমি অভিজ্ঞতা পাবে ভালো দিনের
তারা যদি অভিজ্ঞতা নাও পায় শেষমেশ তা গুরুত্বের কিছু নয়
তারা তাদের সন্তানদের কাছে শিক্ষার পুনরাবৃত্তি করে
সর্বদা আশা করে, সম্ভবত তাদের সন্তানদের অথবা
তাদের সন্তানের সন্তানের সন্তানের কালে একদিন কেটে যাবে শিকল?
আর এখন, যেমন বলা হয়েছে, সেই পুরানো রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে লেনদেনের ব্যাংক।
আমি লেনদেন করি, তুমি লেনদেন করো, সে লেনদেন করে
ট্যুরিস্ট এজেন্সি আর ইমিগ্রেশন অফিসে
আমরা দেশান্তরি হয়েছি, তুমি দেশান্তরিত হয়েছ, তারা দেশান্তরিত হয়েছে
যেখানেই আমি ভ্রমি, গ্রীস আমাকে বিক্ষত করে
কবি যেমন বলেছিলেন –
মনোরম দ্বীপপুঞ্জ, চমৎকার অফিস, সুন্দর গির্জার গ্রীস,
গ্রীকদের গ্রীস।

✼✼✼ ✼✼✼ ✼✼✼

❀ সিদ্ধান্ত
তুমি কি পক্ষে নাকি বিরুদ্ধে?
হ্যাঁ অথবা না বলে অন্তত উত্তর দাও
সমস্যা সম্পর্কে তোমার ভাবনা আছে
আমি বিশ্বাস করি এটি অবশ্যই তোমায় অত্যাচার করেছে
সবকিছুই জীবনে অত্যাচার করে
শিশু নারী পতঙ্গ
ক্ষতিকর গাছপালা হারানো ঘণ্টাগুলো
কঠিন প্যাশন ক্ষয়ে যাওয়া দাঁত
গড়পরতা সিনেমা। অতি অবশ্যই এগুলো তোমায় অত্যাচার করে।
তাহলে দায় ও কর্তৃত্বের সাথে বলো। অন্তত হ্যাঁ অথবা না’য়ের সাথে।
তুমি সিদ্ধান্তের অধিকারী।
তোমাকে আমরা আর বিরত হ’তে বলছি না
তোমার জীবনে সাময়িক ব্যঘাতে, যে জিনিস তুমি নিজেই নিজের এখতিয়ারে নিয়েছো
তোমার প্রিয় খবরের কাগজ, সেলুনের আলাপ;
স্টেডিয়ামে তোমার রবিবারের দিনগুলো।
একটি মাত্র কথা। তো, যাওয়া যাক:
তুমি কি পক্ষে নাকি বিরুদ্ধে?
ভালো করে ভাবো। আমি অপেক্ষা করবো।

✼✼✼ ✼✼✼ ✼✼✼

❀ সিদোনের যুবকেরা, ১৯৭০
আসলে আমাদের অভিযোগ করা উচিৎ নয়।
তোমার কোম্পানির তন্বী তাজা মেয়েরা, সুঠাম-দেহী ছেলেরা ভালো ও উপযুক্ত, তারুণ্যে ভরপুর
সকলের প্যাশন ও ভালোবাসা জীবন ও কাজের জন্য।
আর তোমার গানগুলোও অর্থে ও বুননে দারুণ
খুব মানবিক, খুব গতিশীল
অন্যান্য মহাদেশে যে নবজাত শিশুগুলো মরছে সে সম্পর্কে
আগের দিনে যেসব বীরেরা খুন হলো সে সম্পর্কে
সবুজ, হলুদ আর কালো বিপ্লবীদের সম্পর্কে
সকল ক্লেশভোগের মাঝে মানুষের বেদনা সম্পর্কে।
বিশেষত এ হলো তোমার নিজের জমাখাতা, যেখানে তুমি নিজেই নিজেকে জড়িয়েছ
আমাদের যুগের সংগ্রাম ও বিষয়গুলোর মাঝে
তুমি সরাসরি ও সক্রিয়ভাবে তৈরি করেছো নিজের উপস্থিতি –যা দেখলে
আমার মনে হয়, তুমি দু’জন অথবা তিনজনের চাইতে বেশির সঙ্গে খেলতে, প্রেমে পড়তে যোগ্য
এবং এমনতরো আয়াসের পরে, নিশ্চিত বন্ধুত্বের জন্য জটমুক্ত হ’তে।
(তারা অকালে আমাদের বুড়ো বানিয়েছে, ধরতে পারছো ইয়োরজেস?)

✼✼✼ ✼✼✼ ✼✼✼

❀ এখন আমি আবার বলছি
প্লেগ থেকে পালানো এক লোকের মতো, এখন আমি আবার বলছি
আমি আমার বন্ধুদের কাছে যাই; অনেককেই চিনি যারা রক্ষা পেয়েছিল
(সর্বদাই কিছু প্রস্থান থাকে), যেটা একসময় আমি বলেছিলাম
আবার আরেকবার একটা অজানা অসুস্থ্যতার কথা আমি বলেছিলাম –কে তা মনে রাখে?
তারা চলে গেছে, আর এখন, মৃত্যুর দিন, জানালাগুলো খোলা
ঝাড়ুদার খুশিমনে রাস্তার আবর্জনা ঝাড়ছে
আবার জেগে উঠছে জীবন, ক্লাব আর ইনস্টিটিউটগুলোতে শুরু হয়েছে রেজিস্ট্রেশন
তরুণ তরুণীরা জড়াজড়ি করে বসছে পার্কে, সিনেমা হলগুলোতে ছবি চলছে উরাধুরা
খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন; শয়তানের মত্তলীলা এখন আর নাই
মুখোশগুলো পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে, পুরানো নাম হয়েছে বিস্মৃত
আর গণ-পরিষদ রাস্তাগুলোর আবার নামকরণের শুনানি বসিয়েছে।
রাউল, তোমার সম্পর্কে আমি আবার ভাবছি।
আলাপ করতে, জিনিসগুলোর অন্যদিক দেখতে,
নীরব হ’তে জানতে, বিচক্ষণ হ’তে কীভাবে তোমার হাতে সময় ছিল না;
সম্ভাব্যতার কথা বলতে, উপসংহার টানতে এগুলো তোমার ভবিষ্যতের মাঝে ছিল না
ধারণার পাটিগণিত শেখাতে, এগুলো তোমার জন্য তোমার ভবিষ্যতেও ছিল না।

✼✼✼ ✼✼✼ ✼✼✼

❀ শীতকাল ১৯৪২
ক্যালেন্ডারে আরো একবার উদিত হল রবিবার।
সাত দিন
একটার পর আরেকটা
একসাথে বাঁধা
সব একরকম
জপমালার ঘনকালো গুটির মতো।

এক, চার, বাহান্ন
একটি দিনের জন্য পুরো ছ’টি দিন
ছয়দিন অপেক্ষা
ছয়দিন ভাবনা
একটি দিনের জন্য
ঠিক একটি দিনের জন্য
ঠিক একটি ঘণ্টার জন্য
দুপুর এবং বিকেল।

একইরকম
ঘণ্টাগুলো
সচেতনতা ছাড়াই
পৃষ্ঠার পটভূমিতে
শোকের রঙ পালিশের চেষ্টা করে।

একটি দ্বিধাগ্রস্ত আনন্দের দিন
সম্ভবত একটি ঘন্টা
কয়েকটি মাত্র মুহূর্ত।
সন্ধ্যায় আবার অপেক্ষা শুরু হয়
আবার আরেকটি সপ্তা
……………………………
আজ সকাল থেকে বৃষ্টি হচ্ছে
একটি চমৎকার তুষারবৃষ্টি।

✼✼✼ ✼✼✼ ✼✼✼

❀ সকালবেলা
সকালবেলা
পাঁচটার সময়
ট্রাকে মালবোঝাইয়ের পরে
একটা কর্কশ ধাতব প্রতিধ্বনি
ঘুমের দরজাটা ভেঙ্গে দিলো।
আর দিনের আগেই শেষ বিদায়
ভেজা মেঝেতে শেষ পা রাখা
আর তোমার শেষ চিঠি
তোমার শৈশব থেকে পাটিগণিতের খাতায়
ছোট একটা জানালায় একটি মেয়ের মতো
খুলে দেয় সকালবেলার উজ্জ্বল সূর্যের কুচকাওয়াজ
কালো খাড়া রেখার সাথে।

✼✼✼ ✼✼✼ ✼✼✼

❀ সে এখন এক সরল দর্শক
সে এখন এক সরল দর্শক
ভিড়ের মাঝে এক মামুলি লোক
সে এখন আর হাততালি দেয় না, তার জন্যেও কেউ হাততালি দেয় না
এক আগন্তক পথের ডাকে ঘুরে বেড়ায়।
বহুদূর থেকে এসেছে নতুন বাজনদার
ভবিষ্যতের মনোনীত শ্রেণি থেকে
তাদের কান্না ক্ষয়ে যাওয়া দেয়াল চূর্ণ করে দেয়
তারা প্রদীপ্ত স্রোতে মেশায় কাদা।
ধূর্ত সতীর্থ খাদক,
ভণ্ডামিহীন, অমান্যকারী, অ-জড়িত, নিষ্কলুষ,
এইসব নিষ্পাপ এবং আমাদের কালের প্রতিরোধী,
খাঁটিরা আসছে।
পরিস্রুত জলের স্রোতের মাঝে
বিশাল আগুন আসছে।

কিন্তু সে এখন এক সরল দর্শক
ভিড়ের মাঝে সামান্য নাম-না-জানা সাথী
হাতদু’টো তার বুকের ওপর নিয়ে
শুয়ে থাকা মৃত এক মানুষ
সে এখন আর হাততালি দেয় না, তার জন্যেও কেউ হাততালি দেয় না।
(সর্বদা জানুন কখন ও কীভাবে)

✼✼✼ ✼✼✼ ✼✼✼

❀ ১৩. ১২. ৪৩
আমায় মনে রেখ তোমাকে বলছি : লঞ্চ যখন ভেপু বাজায় বন্দরে থেকো না।
তবে চলে যাওয়া দিন ছিল আমাদের এবং আমরা তাকে কখনোই যেতে দিতে চাইনি
একটা তিক্ত রুমাল ফিরে আসার একঘেয়ে শুভেচ্ছা জানাবে
একটা ভঙ্গুর অস্পষ্ট শরৎগন্ধী আবহের সাথে
সত্যি খুব ভারি বৃষ্টি হচ্ছিলো, রাস্তা ছিল জনশূন্য
জানালাগুলো ছিল বন্ধ আর মানুষ ভুলে গেলো ঝুপ করে।
তারা সবাই আমাদের কেন ছেড়ে গেলো? তারা সবাই আমাদের ছেড়ে গেলো কেন?
আমি তোমার হাত ধরেছিলাম শক্ত করে
আর আমার কান্নায় আশ্চর্য কিছু ছিল না।
…একদিন আমরা নিঃশব্দে চলে যাবো
কিন্তু আমাদের ঠোঁটের ওপর একটি জ্বলন্ত বাসনা নিয়ে
গর্জনমুখর শহরের ভেতর দিয়ে, ঊষর সাগরের উপর দিয়ে ঘুরে বেড়াবো।
ভালবাসার জন্য আমরা চিৎকার করেছি আর তারা আমাদের প্রত্যাখ্যান করেছে
তুমি ভুলে গেছো আমাদের কান্না আর আনন্দ, ভুলে গেছো আমাদের স্মৃতি
যখন শুভেচ্ছা জানালে, বাতাসে পেখম তুললো পাল
আমাদের মনে রাখার জন্য এখানে হয়তো কিছুই আর বাকী নেই।

আমার আত্মায় কেন বেদনার ঝড় উঠলো
আমি শ্বাস টানি উপেক্ষা ও নিঃসঙ্গতার বাতাসে
আমি কড়া নাড়ি আমার কারাগারের ভেজা দেয়ালে, আর আমি কোনো উত্তর প্রত্যাশা করি না
কখনোই কেউ আমার ভালোবাসা ও দুঃখবোধের দিগন্ত ছুঁয়ে দেখেনি।

আর যে চিঠি আসে না তুমি অপেক্ষা করছো তার জন্য
তোমার স্মৃতিতে ঘুরে বেড়ায় বহুদূরের স্বর আর তা মিলিয়ে যায়
এরি মাঝে একটি আয়না অন্ধকারাচ্ছন্নভাবে মাপে তোমার মুখ
আমাদের হারানো নির্বুদ্ধিতা, আমাদের হারানো ডানা।

✼✼✼ ✼✼✼ ✼✼✼

❀ চ্যারিস ১৯৪৪
আমরা সবাই একসাথে
আমাদের সময়কে অক্লান্তভাবে উন্মোচিত করেছিলাম
আমরা অনাগত দিনগুলোর গান গাইছিলাম অনুচ্চ স্বরে
বহুবর্ণ দূরদৃষ্টির টগবগে চ্যারিস গেয়েছিল গান
আমরা ছিলাম চুপ করে
তাঁর স্বর স্ফুলিঙ্গ ছড়ালো ছোট আগুনের
হাজার হাজার ছোট আগুন
আমাদের তারুণ্যে আগুন ধরিয়ে দিলো
দিন ও রাতে সে লুকোচুরি খেলেছে মৃত্যুর সঙ্গে
প্রতিটি চিপাগলিতে প্রতিটি কোণে
নিজের দেহের কথা ভুলে
সে চেয়েছে
অন্যের জন্য নবজীবন
আমরা সবাই ছিলাম একসাথে
কিন্তু তুমি বলতে পারো
সে ছিলো আমরা সবাই।

যে কথা প্রতিদিন আমরা শুনি
কেউ তাঁকে দেখেনি
এটা ছিল সন্ধ্যায়
বরাবরের মতো অবশ্যই সে তাঁর বজ্রমুষ্ঠি শক্ত করে রেখেছিল
তাঁর চোখে পরিষ্কার লেখা ছিল
আমাদের নবজীবনের আনন্দ
কিন্তু সেইসব ছিল সহজ
এবং সময় সংক্ষিপ্ত…
কেউ একে হুকুম দিতে পারে না…
এখন আর আমরা একসাথে নেই
দুই কি তিনজন দেশান্তরে
আরেকজন একটা অনিশ্চিত মনোভাবে
বহুদূরে নিয়েছে অবসর
আর চ্যারিস খুন হয়েছিল
একজন রয়ে গেল এলো অন্যরা
রাস্তাগুলো ভরে গেলো কানায় কানায়
নিয়ন্ত্রণের অসাধ্য এক জনতার ঢল নামলো
ব্যনারগুলো উড়লো আবার
ব্যানারে বাতাসের চাবুক
অতলে ভাসছে গান
যদি স্বরগুলোর মাঝে
অপ্রতিরোধ্যভাবে রাতের দেয়াল ভেদ করে যায়
তুমি একটি আলাদা করবে, এটা তাঁর
যে ছোট আগুনের স্ফুলিঙ্গ ছড়ায়
হাজার হাজার ছোট আগুন
যা আমাদের অদম্য তারুণ্যে আগুন ধরিয়ে দেয়
এটা তাঁর স্বর
যে স্বর জনতাকে ঘিরে সূর্যের মতো আওয়াজ তোলে
যে স্বর সূর্যের মতো আলিঙ্গন করে বিশ্বকে
যে স্বর দুর্দশায় আঘাত করে সূর্যের মতো
যে স্বর আমাদের কাছে প্রকাশিত সূর্যের মতো
প্রদীপ্ত শহরগুলো
আমাদের সামনে প্রসারিত হয়
সত্য ও ন্যায়ের আলোয় স্নান করে।

✼✼✼ ✼✼✼ ✼✼✼

❀ মিলো, আমি বলি
আমি খালি পায়ে হাঁটা মা’দের কথা বলি
যে আগুনে গিলে খাওয়া শহরের
ধ্বংসস্তুপের মাঝে থেমে থেমে চলছে,
রাস্তায় রাস্তায় মৃতদেহের স্তুপ আর
কূটনামি করা কবিদের কথা বলি
যারা রাতের বেলায়
তাদের দোরগোড়ায় বসে ভয়ে কাঁপে।

আমি শেষহীন রাতগুলোর কথা বলি
যখন আলো নিভে গেল
এলো দিন
অতিবোঝাই ট্রাকগুলো এবং
ভেজা পথে পা ফেলা’র কথা বলি।

আমি জেলখানার আঙ্গিনার কথা বলি
কথা বলি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের অশ্রুর
আর সর্বোপরি বলি
জেলেদের কথা
যারা তার পদাঙ্ক অনুসরণ করে
তাদের জাল পরিত্যাগ করেছে
এবং যখন সে কাপুরুষ প্রমাণিত হলো
তারা ক্ষান্ত হলো না
সে যখন তাদের সাথে বেঈমানি করলো
তারা কখনোই ঘোষণা করলো না
আর সে যখন মহিমান্বিত হয়েছিল
তারা তাদের চোখ সরিয়ে নিয়েছে অন্যদিকে
তারা থুতু ছিটালো তাদের মুখে
তারা তাদেরকে ক্রুশে চড়ালো
কিন্তু তারা সবসময় ছিল শান্ত
অবগুণ্ঠিত হয়ে বা নুয়ে পড়ে
শিরদাঁড়া সোজা রেখে ও একা হয়ে
জনতার ভয়াবহ নিঃসঙ্গতার মাঝে
কোনো দূরদৃষ্টি ছাড়াই
তারা একটি শেষহীন রাস্তা নিলো।

[ম্যানোলিস অ্যানাগ্নোসটাকিসের জন্ম ১০ মার্চ ১৯২৫ সালে। থিসালোনীকি, গ্রীস। পড়াশোনা করেন অ্যারিস্টটল ইউনিভার্সিটি অফ থিসালোনীকি’তে। চিকিৎসাবিদ্যায় প্রশিক্ষণ নেন মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটি অফ ভিয়েনা’য়।
গ্রীসে ১৯৪০ এর দশকের শেষদিকে, মার্কসবাদী এবং অস্তিত্ববাদী কাব্য আন্দোলনের আবির্ভাব ঘটে। গ্রীস তখন গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত। ম্যানোলিস ছিলেন এই আন্দোলনের অগ্রগণ্য একজন কবি ও সমালোচক। ম্যানোলিস তাঁর পরের প্রজন্মের কবিদের প্রভাবিত করেছেন। তাঁর কবিতা গ্রীসের জাতীয় পুরস্কারে সম্মানিত। সমকালীন সঙ্গীতকারগণ তাঁর কবিতায় সুর দিয়েছেন, গান হিসেবে গেয়েছেন। কবি ফিলিপ র‍্যাম্প বলেন, গুরুত্বপূর্ণ অর্জন সত্ত্বেও “ইংরেজিভাষী দুনিয়ায়, ম্যানোলিস তাঁর প্রজন্মের প্রধান কবিদের মাঝে সবচেয়ে কম পরিচিত।” তিনি আরো বলছেন “গ্রীসের বাইরে তাঁর স্বল্প পরিচিতির কারণ তাঁর কবিতা রাজনৈতিকভাবে “অঙ্গীকারাবদ্ধ”। গ্রীক কবি ও অনুবাদক Nassos Vagenas বলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী গ্রীক কবিতা মার্কসবাদী, অস্তিত্ববাদী ও পরাবাস্তববাদী ঘরানায় বিভক্ত। তিনি ম্যানোলিসের স্থান নির্দেশ করেন অস্তিত্ববাদী কাব্য আন্দোলনের মাঝে। তবে সমালোচকরা স্বীকার করেন, তাঁর কবিতা পরাবাস্তববাদ প্রভাবিত নয়।
সমালোচকরা ম্যানোলিসের কবিতাকে “বাহুল্যবর্জিত” হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর প্রথম দিককার কবিতা, ক্যাবাফে’র দুই স্তবক বা কয়েক লাইনের প্রশস্তি রচনার ধরণের সঙ্গে তুলনীয় হতে পারে। তবে এর মাঝে এক শব্দে এক লাইন বা এক লাইনের ভার্স প্যারাগ্রাফও রয়েছে। ম্যানোলিসের কবিতায় ‘সাবলীল সংলাপের সুর’ স্পষ্ট। কবিতায় “পষ্ট কথার জোর” খাটে না। কিন্তু দেশ বা সংস্কৃতিভেদে চর্চার ধরণে ভিন্নতা খুব স্বাভাবিক বিষয়। ম্যানোলিসের কবিতায় পষ্ট কথা প্রবল হলেও কাব্যিকতার ঘাটতি আছে তা বলা চলে না। বরং তাঁর বলার ধরণে শক্তি অনুভব করা যায়। একটি ঝঞ্ঝাবিক্ষুদ্ধ দুনিয়ায়, ম্যানোলিসের এই সরাসরি ও সহজ করে বলার স্টাইল তাঁর প্রজন্মের অন্যান্য বামপন্থী কবিরাও অনুসরণ করেছেন। ম্যানোলিসের কবিতায় খ্রিষ্টীয় চিত্রকল্পের ব্যবহার রয়েছে। তবে সামগ্রিকভাবে তাঁর কবিতায় রাজনৈতিক উপাদান প্রবল।
বামপন্থী ও কমিউনিস্ট রাজনীতির সঙ্গে ম্যানোলিসের যোগাযোগ ছিল। এই যোগাযোগ তাঁকে প্রতিরোধ আন্দোলনে যোগ দিতে উৎসাহিত করে। ফলস্বরূপ, ১৯৪৬ সালে গৃহযুদ্ধের সময় মিলিটারি আদালতে মৃত্যুদণ্ড পেতে যাচ্ছিলেন। ১৯৪৮ সালে ইউনিভার্সিটি অফ থিসালোনীকি’র ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার হন। পাঠানো হয় ইপ্তাপিরজিও’র কারাগারে। ছাড়া পাওয়ার পরের বছরই কমিউনিস্ট পার্টি অফ গ্রীস থেকে বহিষ্কৃত হন। একই সঙ্গে আদালত মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করে। তবে শেষপর্যন্ত বেঁচে যান। আন্দোলন, কারাবাস আর মৃত্যু পরোয়ানা মাথায় নিয়েই তাঁর প্রথম সিরিজ কবিতার বই Epoches বা ‘সিজনস’ প্রকাশ সম্পন্ন হয়। উল্লেখযোগ্য কাজের তালিকায় রয়েছে, সিজনস, সিজনস ২, সিজনস ৩, (যথাক্রমে, ১৯৪৫, ১৯৪৮, ১৯৫১), দি কন্টিন্যুয়েশন (১৯৫৪),দি কন্টিন্যুয়েশন ২ (১৯৫৫), দি পোয়েমস ১৯৪১-১৯৫৬ (১৯৫৬), দি কন্টিন্যুয়েশন ৩ (১৯৬২), দি টার্গেট (১৯৭১), দি পোয়েমস ১৯৪১-১৯৭১ (১৯৭১) প্যারেনথিসিস (১৯৭২), অ্যান্টি ডগম্যাটিক পিসেস (১৯৭৮) এবং দি মার্জিন (১৯৭৯)।
কাজের স্বীকৃতি আসে ১৯৮৫ সালে। ম্যানোলিস’কে ‘গ্রীক স্টেট প্রাইজ ফর পোয়েট্রি’ প্রদান করা হয়। ২০০১ সালে অ্যাকাদেমি অফ অ্যাথেন্স থেকে লাভ করেন ‘আওরানি অ্যাওয়ার্ড’। জীবনব্যাপী কাজের স্বীকৃতি হিসেবে অর্জন করেন ‘গ্রেট ন্যাশনাল লিটেরেচার অ্যাওয়ার্ড’। ২০০২ সালে। মহান এই কবি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ২০০৫ সালের ২৩ জুন।

বাংলা অনুবাদের উৎস পোয়েম হান্টার ডট কম প্রকাশিত ইংরেজি অনুবাদ। গ্রীক থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন ডেভিড জন কনোলি, ইভা জোহানোস, ও ফিলিপ র‍্যাম্প। তবে, poemhunter.com এ প্রকাশিত দু’টি কবিতার অনুবাদকের নাম পাওয়া যায়নি। কবিতা দু’টি যথাক্রমে – মিলো, আমি বলছি এবং চ্যারিস ১৯৪৪। কনোলি’র ইংরেজি থেকে অনূদিত কবিতা– কাব্যকৃতি, থিসালোনিকি –উনিশ শ উনসত্তুরের দিনগুলি, ও সিদোনের যুবকেরা, ১৯৭০। ইভা জোহানোসের ইংরেজি থেকে অনূদিত কবিতা – এখন আমি আবার বলছি ও সিদ্ধান্ত। ফিলিপ র‍্যাম্পের ইংরেজি থেকে অনূদিত কবিতা – শীতকাল ১৯৪২, সকালবেলা, সে এখন এক সরল দর্শক এবং ১৩. ১২. ৪৩।

ডেভিড কনোলি: গ্রীক থেকে ইংরেজি’র খ্যাতনামা অনুবাদক। প্রাচীন, মধ্য এবং আধুনিক গ্রীক ভাষা ও সাহিত্য অধ্যয়ন করেছেন ইউনিভার্সিটি অফ ল্যানচেস্টার, ট্রিনিটি কলেজ এবং অক্সফোর্ডে। অ্যাথেন্সে ব্রিটিশ কাউন্সিলের অনুবাদ বিভাগের প্রধান হিসেবে কাজ করেছেন। এছাড়া অ্যারিস্টটল ইউনিভার্সিটি অফ থিসালোনীকি, আয়োনিয়ান ইউনিভার্সিটি এবং ইউনিভার্সিটি অফ অ্যাথেন্স’এ অধ্যাপনা করেছেন।

ইভা জোহানোস: একাধারে শিক্ষক, শিল্পী, অনুবাদক, অ্যাক্টিভিস্ট এবং আন্তঃসাংস্কৃতিক অ্যাম্বাসেডর। পড়ালেখা করেছেন ইউনিভার্সিটি অফ হাওউই অ্যাট মানোয়া, ন্যাশনাল স্কুল অফ ফাইন আর্টস, স্কুল অফ পেইন্টিং, অ্যাথেন্স গ্রীস এবং ইয়েল কলেজ, ইয়েল ইউনিভার্সিটি’তে।

ফিলিপ র‍্যাম্প: জন্ম ১৯৪০ সালে। ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেন ইউনিভার্সিটি অফ মিশিগানে। তরুণ বয়স থেকেই অনুবাদ ও কবিতা লেখায় যুক্ত। ১৯৬৪ সালে স্ত্রী’কে নিয়ে গ্রীসে যান এবং সেখানেই স্থায়ী আবাস নির্বাচন করেন। বেশ কয়েকজন খ্যাতনামা গ্রীক কবিদের কবিতা অনুবাদ করেছেন। এর মাঝে ম্যানোলিস অ্যানাগ্নোসটাকিস, তাসোস দেনেগ্রিস এবং নিকোস কাজানজাকিস অন্যতম। এছাড়া তাঁর নিজস্ব কবিতার বই রয়েছে।]

Facebook Comments

comments

২ Replies to “একগুচ্ছ গ্রীক কবিতা।। ম্যানোলিস অ্যানাগ্নোসটাকিস ।। অনুবাদ-গৌরাঙ্গ হালদার”

  1. তৈমুর খান বলেছেন:

    অসাধারণ কবিতাগুলি। একসঙ্গে এতগুলি প্রাপ্তি যেকোনো কবিতা পাঠকের কাছে খুবই মূল্যবান। কবি কে ধন্যবাদ জানাই।

    1. গৌরাঙ্গ হালদার বলেছেন:

      কবিতাগুলি পড়েছেন জেনে ভালো লাগছে। যে কোনো লেখকের কাছে পাঠ ও পাঠক সর্বাপেক্ষা মূল্যবান। শুভেচ্ছা জানবেন।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top