একটি কালো শিশুর পরিচয় এবং অন্যান্য আফ্রিকান কবিতা II ভাষান্তর: মনজুরুল ইসলাম

মাইকেল উইন
একটি কালো শিশুর পরিচয়

আমি অনন্য,
উপহাস আমায় তাড়িত করতে পারে না।
আমি শক্তিমান,
প্রতিবন্ধকতা আমায় রুদ্ধ করতে পারে না।

আমার মস্তক আমি ঊর্ধ্বে তুলে ধরি,
অতীব গর্বভরে দাবী করি আমি আমার স্বকীয়তা।

আমি ধারণ করি আমার উতুঙ্গ গতিকে,
প্রতিকূলতা সত্ত্বেও এগিয়ে যাই সামনের দিকে।

উত্তরাধীকারীদের নিয়ে গর্বিত আমি,
আর এতটাই বিশ্বস্ত যে,
আমি অর্জন করতে সক্ষম হবো আমার প্রতিটি লক্ষ্যকে।

যা করবার সামর্থ্য আমার মাঝে অন্তরিত,
তার সবটাই করতে সক্ষম হবো আমি।

আমি কালো রঙের একটি শিশু,
সৃষ্টিকর্তার মহান এক সৃষ্টি।

[একজন ক্লান্তিহীন শিক্ষক এবং লেখক হিসেবে পরিচিত মাইকেল উইন। জন্ম, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আলবামা অঙ্গরাজ্যের একটি দরিদ্র্ গ্রামীণ পরিবারে। লেখালেখির পাশাপাশি সাম্য ও সমানাধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করছেন জর্জিয়ার একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠানে। নিম্ন আয়ের পরিবারের সন্তানরা যাতে কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পড়াশুনা করতে পারে সেটিই প্রতিষ্ঠানটির মূল উদ্দেশ্য। “ I am the black child’’ কবিতাটি কবির নিজ জীবনেরই কষ্টলব্ধ অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে রচিত। কবিতাটি ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত www.littlelights.org থেকে সংগৃহীত।]

কবি: অজ্ঞাত
আফ্রিকা

যে মুহূর্ত থেকে তুমি আস্বাদন করেছ ধূলিকণার স্বাদ,
এবং শুঁকে নিয়েছ আমাদের প্রথম বৃষ্টির ঘ্রাণ,
ঠিক সে মুহূর্ত থেকেই তুমি আফ্রিকার জীবনের সাথে একীভূত হতে
বেঁকে গিয়েছ বড়শির মতো।
এবং কখনোই তুমি আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না,
যতক্ষণ পর্যন্ত না দেখতে পাবে ডুবতে থাকা চাঁদ,
এবং শুনতে পাবে শেয়ালের গর্জন।
একই সাথে তুমি জানতে পারবে,
তারা সবাই তোমার চারিপাশে আছে,
অপেক্ষা করছে গভীর অন্ধকারে।

দূর হতে যখন তুমি দেখতে পাবে বিরাট হাতির পাল,
অথবা শুনতে পাবে কোকিলের সুর।
যখন উদীয়মান চাঁদ তোমার রক্তের প্রতিটি কণায়
জ্বালাবে প্রবল অগ্নিশিখা।
তখন তুমি চলে যাবে দীর্ঘ দূরত্বে।

তাই এখনই প্রকৃত সময়,
শিথিল হয়ে আসা কল্পনাগুলিকে হত্যা করো।
এবং মুক্ত পথের দিকে ধাবিত করো তোমার হৃদয়কে,
দিগন্ত বৃত্তেরও অনেক বাহিরে
যেখানে পৌঁছতে প্রতীক্ষা করে তোমার অন্তর্নিহিত শক্তি।

এসো!
আফ্রিকা তোমার জন্য গভীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে।
যতক্ষণ পর্যন্ত না স্পর্শ করতে পারো উন্মুক্ত আকাশকে,
ভালোবাসতে পারো ঝরঝর শব্দ করে বয়ে চলা তৃণলতাকে,
একই সাথে বুনো মাছের তীক্ষ্ণ আর্তনাদকে।

সবসময়ই তুমি ক্ষুধার্ত থাকবে
আফ্রিকার অকর্ষিত অরণ্যভূমি
ও সিংহের কর্কশ গর্জন শুনবার অভিপ্রায়ে,
তারকারাজির গহীন অন্তরালের অভিযাত্রী হতে
এবং আরো একবার শান্তির ছায়াতলে অবস্থান করতে।

সেগ হ্যাসন
একত্রিত হবার আকাঙ্ক্ষা

শত কোটি মানুষ আজ সংগ্রাম করছে,
নিমগ্ন থাকছে ভিন্ন ভিন্ন লক্ষ্যকে অর্জনের প্রয়াসে।
কিন্তু!
প্রকৃতপক্ষে সকলেই আমরা আজ অনুসরণ করছি,
একটি সামষ্টিক গন্তব্যের পথকেই।
আমাদের সকলেরই
আজ প্রয়োজন,
শুধুই একত্রিত হবার।
একটি স্বপ্ন,
একটি দিন,
একটি ঘণ্টা,
একটি মিনিট,
একটি সেকেন্ড,
একটি মুহূর্তের জন্য।

[নাইজেরিয়ার কাদুনা অঙ্গরাজ্যে জন্মগ্রহণ করেন সেগ হ্যাসন। কবিতা লিখবার পাশাপাশি সাংবাদিকতা পেশায় সম্পৃক্ত। নাইজেরিয়ার গীতিধর্মী কবিতার ((Spoken Word Poetry) জনক হিসেবে পরিচিত সেগ হ্যাসন। তার আলোচিত দুটি কাব্যগ্রন্থ যথাক্রমে The Poet এবং Tinkle Tinkle Super Star. ]

জুহুরা সেংএনগে
অতীতকে ভয় পেয়ো না

অতীতকে ভয় পেয়ো না
এটি কুৎসিত হলেও আমাদের।
তারুণ্যে যে বিষয়গুলি তোমায় হতাশ করেছিল
সেটি দেখে তোমারই মতো কাউকে আজ আর
মুখ বুজে সহ্য করতে বলো না।
তোমার পূর্বপুরুষের ইতিহাসকে জানো।
সত্যকে অন্বেষণ করো,
তোমারই আত্মাকে শত্রুর কবল থেকে মুক্ত করবার জন্য।
কোরআন পড়ো, বাইবেল পড়ো,
প্রকৃত অর্থ অনুসন্ধানের চেষ্টা করো ধর্ম ও জীবনের ।
অতীতকে ভয় পেয়ো না।
এটি কষ্টকর,
কিন্তু এটিই প্রকৃত।
রক্তপাত ঘটেছিল,
পতিতও হয়েছিল মুত্যুর দুয়ারে অজস্র মানুষ।
কিন্তু!
টিকে ছিল কেবল,
ভালোবাসা আর একতা।
আয়ত্ত্ব করো,
তোমার পূর্বপুরুষের কণ্ঠস্বর।
পূর্ণঃসম্পর্ক স্থাপন করো,
তোমার রক্তের শেকড়ের সাথে।
জ্ঞানকে অন্বেষণ করো,
যা চুরি হয়েছিল।
সেই জীবনকে অন্বেষণ করো,
যা আমাদের কাছ থেকে অপহৃত হয়েছিল।
অতীতকে ভয় পেয়ো না,
আলিঙ্গন করো এটিকে।
শিখতে দাও এটিকে,
তোমার প্রজ্ঞার প্রান্তর জুড়ে।
এর থেকে গ্রহণ করো প্রকৃত শিক্ষা,
এবং বেঁচে থাকো তাদের মাঝে।
স্বকীয়তাকে অর্জন করো
যা বিলীন হয়ে গিয়েছিল।
অতীতকে ভয় পেয়ো না,
ঘৃণা করো না এটিকে ।
অতীতকে ভয় পেয়ো না।
এটি সম্পর্কে জানো।
এটি থেকে শিক্ষা নাও।
পরিচর্যা করো নিজের মাঝে।
এবং এর মাধ্যমেই স্মরণ করার চেষ্টা করো,
তোমার প্রকৃত পরিচয়।

[জুহুরা সেঞ্জেনগি স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন তাঞ্জানিয়ার দারুস সালাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। স্নাতক সম্পন্ন করবার পর তরুণ এই কবি কাজ করছেন আফ্রিকার সাংস্কৃতিক অঙ্গনের উৎকর্ষ সাধনে। কবিতার প্রতি তার আগ্রহ শৈশব থেকেই। প্রথম কবিতাটিও সৃজন করেন মাত্র বারো বছর বয়সে। শিল্পকে ব্যবহার করে আফ্রিকার মানুষ যাতে জীবনের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌছতে পারে সে লক্ষ্যেই কাজ করছেন তিনি। ]

আমা নুআমা
শোষিতদের বাঁধ ভাঙ্গার স্বপ্ন

শিশুদেরকে আমরা বলি
আমাদের ভবিষ্যৎ।
আমরাই বলি,
যাদের সামর্থ্য নেই
সেই শিশুদের পায়ে জুতো পরিয়ে দেবার।
যাদের এতটুকু খাবার নেই,
তারাই আহাজারি করি
সেই শিশুদের মুখে খাবার তুলে দেবার।
আমরাই,
যারা বিশ্বাস করি
কিছু অমূলক প্রত্যাশায়।
কিন্তু!
এখনো সাহস করি
মুক্ত ও স্বাধীনভাবে স্বপ্ন দেখার।

উদ্দীপিত হও!
সাধারণ মানুষের দিকে তাকাও
যারা বিপদে পথ দেখায়।
যারা অজানা পৃথিবীকে জানবার অভিপ্রায়ে
অন্বেষণ করে চারিদিক।
আদৌ কি তারা সফল হবে?
একটি বাসস্থান,
হতেও পারে, নাও হতে পারে।
তবু আমরা অপেক্ষা করি,
অপেক্ষা করি নির্ভয়ে।
সমুচিত একটা শিক্ষা আমরা পেয়ে গেছি।
সবকিছুই তুমি নিয়েছো
এবং সরিয়ে রেখেছ আজ অবধি অনেক কিছুই।
ফাঁসি কাষ্ঠে ঝুলিয়ে রেখে তুমি সরে গিয়েছো।
আমরা কি সেই প্রস্থানের জন্য অনুতপ্ত?
এখনো আমরা দীর্ঘ পথের বিড়ম্বনাকে গ্রহণ করতে প্রস্তুত আছি,
যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা আমাদের প্রতিবাদী কণ্ঠে কিছু উচ্চারণ করতে পারি।

উল্লাস করো!
যারা এই প্রচেষ্টাটি সৃষ্টি করেছিল
বিভ্রান্তির পরিবর্তে এনেছিল প্রশান্তি।
হতাশার পরিবর্তে এনেছিল আশা।
কষ্ট ও উৎসর্গের ফাঁদে জড়িয়ে দেখিয়েছিল বিরোধিতা করবার স্পর্ধা।
যাতে সকল অনৈক্যের সুর বিলীন হয়ে সৃষ্টি হয় সুন্দর জীবনের সুর।
এখন সময় সকলের সুখ কামনা করা।
সবার জন্য যারা যুদ্ধ করেছিল এবং এখনো যারা যুদ্ধ করছে।
তাদের জন্য যারা উৎফুল্ল ভাব নিয়ে প্রস্তুত ছিল রণক্ষেত্রে।
তাদের জন্যই যারা ক্ষণস্থায়ী সময়ে আদায় করেছিল সুবিধে।
আমাদের ওপর যে অন্যায় করা হয়েছিল,
তার সুবিচার পেতে এখনো আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাবো,
জেগে উঠবো শোষকদের বিরুদ্ধে।

[তাঞ্জানিয়ান কবি আমা নুআমা লেখালেখি করেন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন সময় থেকে। পেশায় প্রকৌশলী হলেও কবিতাই তার প্রথম ভালোবাসা। বিখ্যাত কবি মায়া এ্যাঞ্জেলাসহ সমসাময়িক কবিদের উৎসাহ এবং অনুপ্রেরণায় তার কবিতায় আগমন বলে জানা যায়। অনূদিত কবিতাটি ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দে বিশ্ব কবিতা দিবস উপলক্ষে পঠিত আফ্রিকা মহাদেশীয় কবিদের সম্মেলনে পঠিত হয়। ]

Facebook Comments

comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top