পার্পল হিবিস্কাস (পর্ব-১) // চিমামান্ডা নগোজি আদিচে // ভাষান্তর: দিলশাদ চৌধুরী 

[অনুবাদ সাহিত্যের মাধ্যমে আমরা প্রতিনিয়ত পরিচিত হচ্ছি বিশ্বের নানান সংস্কৃতির সাথে। বিশ্বসাহিত্যের আদৃত বইগুলো সহজেই মাতৃভাষায় আমাদের হাতের নাগালে চলে আসছে। তবে এই দৌড়ে আফ্রিকান সাহিত্যের উপস্থিতি তুলনামূলক কম।
নাইজেরিয়ার ইনুগু শহরে এক ইবু নৃগোষ্ঠী পরিবারে ১৯৭৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন চিমামান্ডা। ছয় ভাইবোনের মধ্যে তিনি পঞ্চম। বাবা জেমস নওয়ে আদিচে ইউনিভার্সিটি অফ নাইজেরিয়ায় পরিসংখ্যানের অধ্যাপক ছিলেন। আর মা গ্রেস ইফিওমা ছিলেন একই ইউনিভার্সিটির প্রথম নারী রেজিস্ট্রার। নাইজেরিয়ান গৃহযুদ্ধে প্রায় সবকিছুই হারায় এই পরিবারটি। 
লেখক হওয়ার পথে আদিচের প্রধান এবং প্রথম অনুপ্রেরণা হয়েছিলেন চিনুয়া আচেবে। “থিংস ফল এপার্ট”-এর প্রতিটি পাতায় যেন আদিচে দেখতে পেয়েছিলেন নিজের জীবনের প্রতিচ্ছবি। ১৯৯৭ সালে আদিচে কিছু কবিতা প্রকাশ করেন এবং ১৯৯৮ সালে “ফর লাভ অফ বিয়াফিরা” নামের একটি নাটক রচনা করেন। ২০০২ সালে তার ছোটগল্প ” ইউ ইন আমেরিকা ” কেইন প্রাইজ লাভ করে এবং “দ্যাট হারমাটন মরনিং” যৌথভাবে বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস শর্ট স্টোরি অ্যাওয়ার্ড লাভ করে। ২০০৩ সালে তিনি ও’হেনরি অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন।
বর্তমান আফ্রিকান সাহিত্যের উজ্জ্বল নাম চিমামান্ডা নগোজি আদিচে। দ্যা টাইমস লিটারেরি সাপ্লিমেন্টের মতে, “সমালোচক দ্বারা বহুল প্রশংসিত তরুণ অ্যাংলোফোনিক সাহিত্যিক যারা নতুন প্রজন্মকে আফ্রিকান সাহিত্যের দিকে আকর্ষণ করছে, তাদের মধ্যে চিমামান্ডা বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে।”
তার প্রথম উপন্যাস “পার্পল হিবিস্কাস” সমালোচকদের নজর কাড়ে এবং ” বেস্ট ফার্স্ট বুক” ক্যাটাগরিতে  কমনওয়েলথ লেখক পুরস্কার লাভ করে। পার্পল হিবিস্কাস ফুলটি স্বাধীনতার প্রতীক। উপন্যাসটির পটভূমি রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিকভাবে অস্থির উপনিবেশোত্তর  নাইজেরিয়া। উল্লেখ্য যে, “পার্পল হিবিস্কাস” শুরু হয়েছে চিনুয়া আচেবের ” থিংস ফল এপার্ট”-এর একটি এক্সটেন্ডেড কোটেশন দিয়ে।
” পার্পল হিবিস্কাস” বইটির ক্রমশ প্রকাশ শুরু হলো। আফ্রিকান সাহিত্য এবং সংস্কৃতির প্রতি যাদের আগ্রহ আছে নিঃসন্দেহে তাদের বইটি ভালো লাগবে।]
পাম রবিবার 
আমাদের সাংসারিক ব্যাপারগুলো এলোমেলো হয়ে উঠতে লাগল, যখন আমার ভাই জাজা প্রার্থনাসভায় গেল না এবং বাবা তার হাতের ভারী ধর্মগ্রন্থ ঘরের একদিকে ছুঁড়ে মেরে তাকের ওপর রাখা ছোট মূর্তিগুলো ভেঙে ফেলল। আমরা তখন সবেমাত্র গির্জা থেকে ফিরেছিলাম। মা পবিত্র পানিতে ভিজে থাকা পাম গাছের সতেজ পাতাগুলোকে খাবার টেবিলের ওপর রেখে কাপড় বদলাতে গিয়েছিলো। একটু পরে, মা পাতাগুলোতে গিঁট দিয়ে ঝুলিয়ে রাখার মত ক্রুশ তৈরি করবে, তারপর সেগুলো টাঙিয়ে দেবে দেয়ালে, আমাদের সোনালি ফ্রেমের পারিবারিক ছবিটার পাশে। ওগুলো ওখানে ঝুলবে সামনের ছাই বুধবার পর্যন্ত, তারপর আমরা ওগুলোকে চার্চে নিয়ে যাব আর পুড়িয়ে ছাই করে ফেলব।
বাবা, অন্যান্য কর্মী সন্ন্যাসীদের মতই, একটা লম্বা ধূসর আলখাল্লা পরে প্রতিবছর ছাই বিতরণ করতে সাহায্য করে। ছাই বিতরণের লাইনগুলার মধ্যে তার লাইন সবচেয়ে ধীরে এগোয়, কারণ বাবা তার ছাইমাখা বুড়ো আঙুল শক্ত করে সবার কপালে টিপে ধরে একটা যথাযথ ক্রস আঁকার চেষ্টা করে এবং “মাটি থেকে এসেছ আর মাটিতেই ফিরে যাবে” বাক্যটির প্রত্যেকটা শব্দ ধীরে ধীরে আলাদা আলাদাভাবে অর্থপূর্ণ ভঙ্গিতে উচ্চারণ করে। বাবা সব সময় চার্চে সবার সামনের কাঠঘেরা বসার জায়গাটার শেষপ্রান্তে বসত, যেখান থেকে মাঝখানের বসার সারি শুরু হয়। সাথে বসতাম আমি, মা আর জাজা। বাবা সবার আগেই প্রসাদ পেত। তার মত আর কেউ প্রসাদ নিতে পূর্ণায়ত মাতা মেরীর শুভ্র মূর্তির কাছের ওই মার্বেল বেদিতে ওভাবে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ত না। সে তার চোখদুটো এমনভাবে শক্ত করে এঁটে বন্ধ করে ফেলত যেন ভেংচি কাটছে আর তারপর জিভটাকে যতদূর সম্ভব বাইরে বের করে দিত। তারপর ফিরে গিয়ে জায়গায় বসে জমায়েতের বাকিদের প্রসাদ নেয়া দেখত। হাতের পাতাগুলো একসাথে করে সামনের দিকে এগিয়ে রাখত তারা, ঠিক যেন আড়াআড়ি করে কোনো অদৃশ্য পিরিচ ধরে রেখেছে। ফাদার বেনেডিক্ট ঠিক এমনটাই তাদের শিখিয়েছে।
যদিও ফাদার বেনেডিক্ট সাত বছর ধরে সেন্ট অ্যাগনেসে আছে, তবুও সবাই তাকে ‘আমাদের নতুন যাজক’ বলেই ডাকে। সম্ভবত, তিনি শ্বেতাঙ্গ না হলে কেউ এমন বলত না। গায়ের রঙ সাদা বলেই হয়ত তাকে এখনও নতুনের মতই লাগে। তার ত্বকের রঙ, যেন কনডেন্সড মিল্ক, যেন একটা অর্ধেক কাটা সরসোপ ফল, যাকে সাতটি নাইজেরিয়ান বছরের প্রচণ্ড তাপও একটুও ম্লান করতে পারেনি। আর তার ব্রিটিশ নাকটা এখনো ঠিক ততটাই সরু, ঠিক আগের মতই। প্রথম যখন এই লোক ইনুগুতে আসে, তার নাকে আদৌ বাতাস ঢুকতে পাচ্ছে কিনা সেটা নিয়ে আমি বেশ চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম৷
ফাদার বেনেডিক্ট যাজকপল্লীর কিছু ব্যাপারে পরিবর্তন এনেছে। যেমন, ক্রেডো আর কাইরি ধর্মবাণীগুলো শুধুমাত্র লাতিনে বলতে হবে, ইগবু ভাষায় গ্রহণযোগ্য হবে না। এছাড়াও হাততালি দেয়া যতটা সম্ভব কমাতে হবে, ওটা ধর্মসভার গাম্ভীর্য নষ্ট করে। তবে তিনি প্রার্থনাগীতি ইগবু ভাষায় গাওয়ার অনুমতি দিয়েছেন। ওগুলোকে তিনি বলেন ‘পল্লীগীতি’ আর বলার সময় তার সরলরেখার মতো ঠোঁটটাকে এমনভাবে নিচে নামান যেন বন্ধনী কমার মধ্যে আটকানো ইংরেজি ইউ অক্ষর। সাধারণত ধর্মোপদেশ দেয়ার সময় ফাদার বেনেডিক্ট যথাক্রমে পোপ, বাবা আর যিশুর উল্লেখ করতেন। গসপেলের পূণ্য ঘটনার ব্যাখ্যায় তিনি বাবার উদাহরণ দিতেন।
“যখন আমরা আমাদের ভেতরের আলোকিত দিক মানুষের সামনে তুলে ধরি, তখন তাতে যিশুর বিজয় প্রতিবিম্বিত হয়,” তিনি বলছিলেন পাম রবিবারে।
” আমাদের ইউজিন ভাইয়ের দিকেই তাকিয়ে দেখুন। তিনি চাইলেই দেশের অন্যান্য বড় মানুষদের মত অভ্যুত্থানের পর চুপচাপ ঘরে বসে থাকতে পারতেন যাতে সরকার তার ব্যবসার জন্য হুমকি হয়ে না দাঁড়ায়। কিন্তু না! তিনি সত্যের পথ ছাড়েননি। তিনি সত্য বলার সাহস দেখিয়েছেন, যদিও তার পরে তার পত্রিকা অনেকগুলো বিজ্ঞাপন হারিয়েছিলো। তবুও আমাদের ইউজিন ভাই স্বাধীনতার পক্ষে বলেছেন। আমাদের মধ্যে কতজনই বা সত্যের জন্য এভাবে দাঁড়িয়েছে? কতজনের মধ্যে যিশুর সেই বিজয়ী রূপ দেখা গেছে?”
জমায়েত থেকে ‘হ্যাঁ’, ‘ঈশ্বর মঙ্গল করুন’, ‘আমিন’ ইত্যাদি শব্দ শোনা যাচ্ছিলো, যদিও খুব জোরে নয়। কারণ নইলে আবার তাদের আচরণ হয়ে যাবে মাশরুমের মত দেখতে ওই পেন্টিকোস্টাল গির্জার অমার্জিত অনুসারীদের মত। তারা শুনতে লাগল চুপচাপ মনোযোগ দিয়ে। এমনকি ছোট বাচ্চাগুলো কান্নাও বন্ধ করে দিলো, যেন তারাও মন দিয়ে শুনছে। কোন কোন রবিবারে তো ফাদার বেনেডিক্ট সেসব ধর্মোপদেশ দিত যেগুলো সবার জানা, কিন্তু তবুও জমায়েত মনোযোগ দিয়েই শুনত। ফাদার বলত কিভাবে বাবা পিটার্স পেন্স আর সেন্ট ভিনসেন্ট দা পলে সর্বোচ্চ অনুদান দিয়েছিলো অথবা প্রসাদের বাক্সভর্তি ওয়াইনের মূল্য পরিশোধ করেছিলো। এছাড়াও টাকা দিয়েছিলো কনভেন্টের নতুন চুলাগুলোর জন্য যেখানে রেভারেন্ড সিস্টারেরা অতিথিদের জন্য খাবার তৈরি করে অথবা সেন্ট অ্যাগনেস হাসপাতালের নতুন সংযোজনের ক্ষেত্রে যেখানে ফাদার বেনেডিক্ট বাবাকে অসম্ভব তোষামোদ করেছিলো।
আমি দুই হাঁটু একত্র করে জাজার পাশে যথাসম্ভব ভাবলেশহীন মুখে বসে থাকার চেষ্টা করতাম। যাতে চেহারায় অহংকার ফুটে না ওঠে কারণ বাবা বলেছে বিনয়ী হওয়া জরুরি। বাবা নিজেও গম্ভীরভাবে বসে থাকত, যতবার আমি তাকাতাম দেখতে পেতাম। এমন একটা ছবিই ছাপা হয়েছিলো, এমন নির্লিপ্ত মুখের, যেবার অ্যামনেস্টি ওয়ার্ল্ড বাবাকে একটা মানবাধিকার পুরস্কার দিয়েছিলো। সেই একবারই বাবা তার ছবি পত্রিকায় ছাপানোর অনুমতি দেয়। তার সম্পাদক, আদে কোকার, জোর করছিলো অনেক। বলছিলো, বাবা এটার যোগ্য, আরও বলছিলো, বাবা অনেক বেশি বিনয়ী। বাবা অবশ্য কখনোই এসব নিয়ে আলোচনা করত না, আমাকে আর জাজাকে এসব মা বলেছিলো। তার চেহারার নির্লিপ্ত ভাবটা সে ধরে রাখত যতক্ষণ না ফাদার বেনেডিক্ট ধর্মোপদেশ শেষ করছে আর প্রসাদ বিতরণ শুরু করছে। প্রসাদ নেয়ার পরে বাবা পেছনে বসে বেদিতে যাওয়া জমায়েতের প্রত্যেকটা মানুষের দিকে লক্ষ্য রাখত। তারপর উদ্বেগের সাথে প্রার্থনাসভার শেষে ফাদার বেনেডিক্টকে জানাত যদি কেউ পরপর দুই রবিবার গির্জায় অনুপস্থিত থেকে থাকে। বাবা সবসময় ফাদার বেনেডিক্টকে উৎসাহিত করত কেউ অনুপস্থিত থাকলে তাকে ডেকে আবার ধর্মের পথে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করার জন্য। নশ্বর জীবনের পাপ ছাড়া আর কিছুই নেই যা মানুষকে পরপর দুই রবিবার প্রার্থনাসভায় আসা থেকে দূরে রাখতে পারে।
সুতরাং, সবকিছু বদলে দেয়া ওই পাম রবিবারে  যখন জাজা প্রার্থনাসভায় গেলো না, বাবা ধড়াম করে তার লাল সবুজ ফিতা বেরিয়ে থাকা ধর্মগ্রন্থটা টেবিলের ওপর রাখল। আমরা তখন মাত্রই বাড়িতে ফিরেছিলাম। ভারী কাচের টেবিলটা নড়ে উঠেছিল, সাথে কেঁপে উঠেছিলো ওটার ওপরে থাকা পাম গাছের পাতাগুলো।
“জাজা, তুমি প্রার্থনাসভায় যাওনি,” বাবা শীতল গলায় বলল, কিন্তু সেটা প্রশ্নের মতই শোনালো।
জাজা টেবিলে রাখা ধর্মগ্রন্থটার দিকে তাকিয়ে, যেন ও ওটার সাথেই কথা বলছিলো এমনভাবে বলল, “ওয়েফারটা খেলে আমার মুখে দুর্গন্ধ হয়।”
আমি জাজার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকালাম। ওর কি মাথাটা পুরো খারাপ হয়ে গেল! বাবা বারবার বলেছে পবিত্র রুটিটাকে ‘ধারক’ বলতে কারণ আশ্রয়দাতার মত ওটা যিশুর শরীরের ঘ্রাণ আর পবিত্রতা ধারণ করে। ওয়েফার সেই তুলনায় একটু বেশিই হালকা শব্দ। ওয়েফার তো বাবার ফ্যাক্টরিতে বানানো হয়, চকলেট ওয়েফার, ব্যানানা ওয়েফার। বাচ্চাদের হাতে বিস্কুটের চেয়েও একটু ভালো কিছু দেয়ার জন্য যেগুলো লোকেরা কেনে।
” আর ফাদার লোকটা খালি মুখের মধ্যে হাত দেয়, ওতে আমার বমি পায়,” জাজা বলল। ও জানত আমি ওর দিকে তাকিয়ে আছি, ও জানত আমার ভয়ার্ত চোখ ওর কাছে ভিক্ষা চাইছিলো মুখটা বন্ধ রাখার। কিন্তু ও একবারও আমার দিকে তাকালো না।
“ওটা আমাদের প্রভুর শরীর”, বাবা গলাটা একদম খাদে নামিয়ে চেপে চেপে বলল। এমনিতেই পুঁজে ভরা ঘামাচির কারণে বাবার মুখটা ফুলে থাকত, এখন সেটা যেন আরও ফুলে উঠছিলো। “তুমি ঈশ্বরের প্রসাদ নেয়া বন্ধ করতে পারো না, এটা মৃত্যুর সমান, তুমি জানো।”
” তাহলে আমি মৃত্যুকেই বেছে নেব,” জাজার চোখ ভয়ে আলকাতরার মত কালো হয়ে উঠেছিলো, তবুও সে বাবার চোখে চোখ রেখে বললো, “আমি মরব, বাবা।”
বাবা দ্রুতগতিতে ঘরের চারিদিকে দেখছিলো, যেন সে প্রমাণ খুঁজছিলো আকাশ থেকে ঘরের মধ্যে কিছু পতনের, এমন কিছু যার জন্য সে স্বপ্নেও প্রস্তুত ছিলো না। সে ধর্মগ্রন্থটা তুলল আর ঘরের অন্যধারে জাজাকে লক্ষ্য করে তা ছুঁড়ে মারলো। ওটা জাজার গায়ে লাগলো না ঠিকই কিন্তু কাঁচের তাকটার গায়ে লাগলো যেটা মা প্রায়ই মুছে ঝকঝকে করে রাখত। তাকের ওপর তলাটা ভেঙে গেলো, ওটার মধ্যে সাজিয়ে রাখা ধূসর রঙের বিভিন্ন ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা আঙুল সমান ব্যালে নাচিয়েদের সিরামিকের মূর্তিগুলো শক্ত মেঝের ওপর ফেলে ধর্মগ্রন্থটা ওগুলোর পেছন পেছন, অথবা বলা যায় ওগুলোর ছিন্নভিন্ন টুকরোগুলোর ওপর পড়ল।  গির্জার বাৎসরিক তিন জমায়েতের সকল তথ্যসম্বলিত চামড়ায় বাঁধানো মোটা ধর্মগ্রন্থটি অসার হয়ে মেঝের ওপর পড়ে রইল।
জাজা নড়ল না। বাবা ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে লাগল। আমি দরজায় দাঁড়িয়ে ওদের গতিবিধি দেখতে লাগলাম। মাথার ওপর সিলিং ফ্যানটা বনবন করে ঘুরছিলো আর ওর সাথে লাগানো বাল্বগুলো একটা আরেকটার সাথে ঘষা খাচ্ছিলো।
একটুপর মা এলো। তার রাবারের স্লিপার মার্বেলের মেঝেতে চপচপ শব্দ করছিলো। সে তার কাজ করা রোববারের বিশেষ ঘাঘরা আর হাতা ফোলানো ব্লাউজ বদলে এসেছে। এখন সে পরে আছে একটা সাধারণ টাইডাইয়ের ঘাঘরা যেটা আলতোভাবে তার কোমর থেকে ঝুলছে আর সেই সাদা টিশার্টটা যেটা সে প্রায় প্রতিদিনই পরে। বাবার সাথে একটা আধ্যাত্মিক সভায় গিয়ে স্মারক হিসেবে সে ওটা পেয়েছিলো। ওর ওপরের “ঈশ্বর সর্বশ্রেষ্ঠ” লেখাটা তার ঝুলে যাওয়া দুই স্তনের সাথে যেন নেচে নেচে ওঠে।
কিছুক্ষণ মূর্তির টুকরোগুলোর দিকে তাকিয়ে থেকে হাঁটু গেড়ে বসে খালি হাতেই ওগুলো তুলতে শুরু করে মা। ঘরের মধ্যকার পাথরের মত স্থির বাতাসকে কেটে কেটে নৈঃশব্দকে ভেঙে দিচ্ছিলো শুধু ওই সিলিং ফ্যানের পতপত আওয়াজ।
যদিও আমাদের বিরাট খাবার ঘরের সাথেই লাগোয়া তার চেয়েও বিরাট ড্রইংরুম ছিলো, তবু আমার দম আটকে আসতে লাগলো। ধূসর সাদা দেয়াল, যেখানে দাদাজানের ছবি ঝুলছে, এগিয়ে আসতে লাগলো, আমায় চেপে ধরতে লাগলো। এমনকি ভারী কাচের খাবার টেবিলটাও যেন এগিয়ে আসতে লাগলো।
” ননে, নগওয়া। যাও, কাপড় বদলে ফেলো,” মা আমাকে বিস্মিত করে দিয়ে বলল। যদিও তার ইগবু শব্দগুলো ছিলো মৃদু তবুও কথাগুলো একটা শান্তি শান্তি অনুভব দিচ্ছিলো। একই নিঃশ্বাসে, একবারও না থেমে সে বাবাকে বলল, “তোমার চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে,” আর জাজাকে, “এসো, আমাকে সাহায্য করো, বিকু।”
বাবা টেবিলে বসে প্রান্তে গোলাপি ফুল আঁকা চিনামাটির চা-দানি থেকে চা ঢেলে নিলো। আমি অপেক্ষা করলাম কখন বাবা আমাকে আর জাজাকে তার থেকে এক চুমুক চা খেতে বলবে, যেটা সে সব সময় করে। ভালোবাসার চুমুক, সে বলে। কারণ আমরা যাদের ভালোবাসি তাদের সাথে আমাদের ভালোবাসার জিনিসগুলোও ভাগ করে নেই। একটা ভালোবাসার চুমুক দাও, বাবা বলত। জাজা সবার আগে দৌড়ে যেত, তারপর আমি দুহাতে পেয়ালাটা তুলে ঠোঁটে ছোঁয়াতাম। একটা চুমুক। পেয়ালার চা সবসময়ই খুব গরম থাকত, আমার জিভ পুড়ে যেত। আর যদি দুপুরের খাবারে মসলাদার কিছু থাকত, তবে পোড়া জিভটা পুরো জ্বলে যেত।
কিন্তু তাতে আমার খারাপ লাগত না। কারণ আমি জানতাম, যখন চা আমার জিভ পুড়িয়ে দেয়, সাথে দিয়ে দেয় বাবার ভালোবাসাও। কিন্তু আজ বাবা বললো না, “এসো, ভালোবাসার এক চুমুক নিয়ে নাও।” আমি চায়ের পেয়ালাটা তার ঠোঁট অব্দি উঠতে দেখলাম, কিন্তু আজ সত্যিই আর সে কিছুই বললোনা।
(চলবে…)

পার্পল হিবিস্কাস (২য় পর্ব) // চিমামান্ডা নগোজি আদিচে // ভাষান্তর: দিলশাদ চৌধুরী
পার্পল হিবিস্কাস (৩য় পর্ব) // চিমামান্ডা নগোজি আদিচে, ভাষান্তর: দিলশাদ চৌধুরী

Facebook Comments

comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top