গুচ্ছকবিতা // নাজমুল হুসাইন ঝড়

এয়ার ফিল্টার

দমবন্ধ হয়ে যাওয়া এই বাতাসে আমাকে পরে নাও মাস্কের মতন,
তোমার রক্তে বয়ে চলা নদীর নাম দাও আমার নামে।
তোমার ফুসফুসে জমে থাকা কার্বন চুষে আমাকে হতে দাও সেই চিমনী
যার ধোঁয়া ওজন স্তর পেরিয়ে পৌঁছে গেছে সূর্যের কাছে।

হে বুড়িয়ে যাওয়া প্রেম, তোমার নাভীর কাছে শ্যাওলা হয়ে জমে থাকা অভিমানকে বাঁচতে দাও।
চলো দু’জন মিলে ঝাঁপিয়ে পড়ি অগভীর কোনো কুয়োর জলে
আমাদের অভিমান খেয়ে বেঁচে উঠুক বুভুক্ষু মাছের ঝাঁক।
চলো খুঁটে খাই আমাদের দু’জনের শরীরে জমে আছে যত খুদ
পৃথিবীর এই চরম দুর্ভিক্ষের দিনে কিছুই নষ্ট করতে নেই।

নিউক্লিয়ার পৃথিবী থেকে অনেক দূরে

রোদের আলোকে বিষ্ফোরণের ঝলকানি ভেবে ভয় পেয়েছিলাম
পর্দা সরাতেই দেখি পেয়ারা গাছে হলুদ পাখি বসে আছে।
পাখির মতো আকাশে উড়তে উড়তে আমাদের ভেঙে গেছে ডানা
ব্যবিলনের শূন্য মরুভূমি হতে বালু হাতড়ে এসেছি এখানে,
হাওয়াই কিংবা মরুভূমির জাহাজ
কেউই আসেনি তুলে নিতে।
বিছানায় শুয়ে মনে হয় পিরামিডের ভেতর শুয়ে আছি অনন্তকাল
বাহিরে রোদের আলোয় শুকিয়ে যাচ্ছে
পৃথিবীর রক্ত মাংস জল।

বিকিনি পরিহিতা কোনো নারী নেই এখানে
তবু সুদূর বিকিনি দ্বীপের ছবি ভাসছে চোখে।
কি এক গভীর মায়াজালে আটকে পড়েছিলো আমাদের হৃদয়নগর
তাই পৃথিবীর সবচেয়ে অশান্ত সমুদ্রের নাম দিয়েছি
প্রশান্ত মহাসাগর।
এখানে সূর্য কবে উঠেছিলো মনে নেই
কিংবা অস্ত যাওয়ার বালাই নেই;
জানালার ফাঁক দিয়ে এখনো আসছে রোদ
শীতের সকালে গুড় মুড়ি মাখা রোদ
যেন তোমার চোখের জলের মতো রেড ওয়াইন
এখানে বিছানায় শুয়ে আর বিষ্ফোরিত হয়নি
বুকের ভেতর পুতে রাখা অচল মাইন।

মরুভূমির পেঙ্গুইন

কতকাল মাংস খাই না তাই
শরীরের ভেতর জমে থাকা মেদ গলে
ঝর্ণার সাথে এক নদীতে গিয়ে মিশেছে।
সে নদীর মাছেদের নাম বুনো হাঙর ১.. বুনো হাঙর ২ ..
সে নদীর জল এতটাই পিচ্ছিল যে,
গোধূলির আগেই
তন্দ্রাগ্রস্ত সূর্য
পিছলে গিয়ে কোনো গিরিখাতের নীচে আশ্রয় নেয়।
মরুভূমিতে একদা আটকা পড়া জাহাজ
আলোর অভাবে হারিয়ে যায় বালুর সমুদ্রে;
বেদুইনের ঘর নেই বলে
যে জাহাজ
তাদের নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলো
এস্কিমোদের বরফের পাহাড়ের দিকে।

কতকাল পাহাড়ে চড়ি না তাই
ঝরে পড়া মৃত তারাদের ভারে
নূয্য হয়ে আছে পিঠ।
তাই ভেবে পাথরের উপর দাঁড়ানো পেঙ্গুইনের মতো
গা ঝারা দিয়ে উঠতেই,
ঝরে পড়লো সব পালক ।
আর কোট টাই পড়া একদল বানর
চেঁচাতে লাগলো… ‘ন্যাড়া পাখি ন্যাড়া পাখি
কোথা যাও নাচি নাচি
একবার দাঁড়াও না ভাই’।

জনস্রোত কমে গেলে
নদীতে জলস্রোত বেড়ে যাবে।
তারই সাথে গা ভাসিয়ে
ভেসে যাবো সূর্যের চারণভূমিতে ।
সেখানে মধ্যরাতে ঘোড়াদের সাথে ঘাস খাবো
একই মাঠে ,
বিশ্রি ঢেকুরের গন্ধে পাবো
পৃথিবীর সবচেয়ে সুগন্ধি ফুলের সুবাস ।
গলায় থাকবে না কোনো দড়ি,
যা দিয়ে মানুষ তোমায় টেনে নেয় ধ্বংসের দিকে
কিংবা তুমি সটান হয়ে ঝুলে পড়ো সিলিং থেকে।

শুনেছি নরওয়ের পাহাড় সবচেয়ে বেশি দুঃখ বোঝে সূর্যের,
গভীর রাত অব্দি
তারা সূর্যের পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়।
তোমাদের চোখে আলো নেই বলে
মুদ্রার ঝনঝন শব্দে মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায় ওদের;
পাহাড় আর সূর্যের প্রেম সুলভ মূল্যে বেঁচে দিতে
তোমরা ওদের নিশীথ সূর্যের দেশ বলে ডাকো।

লিটলবয়

মুক্তির গান গাইতে এসে
হাতকড়া পরে বসে আছে কবি,
কাঠগড়ায় দাঁড়ানো ছিলো যারা
তাদের মুখে ছিলো দাত কেলানো হাসি;
মুহুরিরী ভূমিকায় যে
তার ডেস্কে কাগজের বদলে
অঁতুরঘরের রক্ত মাখানো অসংখ্য ছেঁড়া ন্যাকড়া।

রেসলিং এর রিং এর ভেতর বসে
মাইক হাতে গাইছে কবি,
কন্ঠ থেকে বেরিয়ে আসা দুর্গন্ধে নাকাল সবাই।
দর্শকসারি থেকে
দু একজন অনুরোধ করছে,‘গান বন্ধ করুন মহাশয়’।

গান গাওয়া বন্ধ হলো
কবি চললেন কাশ্মীরের পাহাড়ে,
যেখানে কৃষকের শোকে
গাছতলায় পঁচে গেছে অসংখ্য আপেল।
কবি চললেন ফ্লোরিডার উপকূলবর্তী অঞ্চলে,
যেখানে ঘাসের উপর শুয়ে আছে
বৃন্তহীন ফুলের দল।
এবার কোথায় যাবে চলো—

যেখানে ঝড়ের নাম তিতলি আর বুলবুল?
যেখানে ঘরের নাম নষ্টনীড় আর ইসকুল ?
যেইখানে প্রলয়ংকারী বোমার নাম লিটলবয়?

সেইখানে
সেইখানে তোমার হৃদয়,
প্রতিদিন নিয়ম করে হচ্ছে ক্ষয়।

কুয়োবাস

আমরা ছিলাম একটা কুয়োর ভিতর,
লোকে তাই দেখে আমাদের সোনালী ব্যাঙ বলে ডাকতো;
অথচ আমাদের গায়ে সারাক্ষণ লেগে থাকতো মানুষের গন্ধ।
ডাঙার শরীর
জলের হৃদয় পেয়ে কেমন জেলির মতো পিচ্ছিল পায়ে হেঁটে চলে
তাই দেখতে ভীড় জমিয়েছিলো অসংখ্য শকুন,
শকুনের নখে মৃত্যুর গন্ধ পেয়েও
আমরা সাবধান হইনি সেদিন।
কেবল সচ্ছল হৃদয়ে
প্রেতের শুকনো কঙ্কাল দেখে
ভয় পেয়েছিলে তুমি।
তোমাকে সেইসব হৃদয়হীন প্রেতের ভয় থেকে
মুক্তি দিতে
আমাদের এই আজন্ম কুয়োবাস।

Facebook Comments

comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top