পার্পল হিবিস্কাস (৫ম পর্ব) চিমামান্ডা নগোজি আদিচে, ভাষান্তর// দিলশাদ চৌধুরী

পরিশোধিত গণতন্ত্র। বাবা যেভাবে বললো তাতে জিনিসটা গুরুত্বপূর্ণ কিছু মনে হচ্ছিল, কিন্তু তারপর দেখা গেল, বাবা যা বলছে বেশিরভাগই গুরুত্বপূর্ণ। শরীরটাকে পেছনে হেলিয়ে ওপরের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে বাবা পছন্দ করত, যেন বাতাসে কিছু খুঁজে বেড়াচ্ছে। আমি তার ঠোঁটের দিকে মনোযোগ রাখতাম, সেটার নড়াচড়া, মাঝেমধ্যে সব ভুলে যেতাম, ওভাবেই বসে থাকতে চাইতাম, বাবার গলায় শুনতে চাইতাম গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারগুলো। এই অনুভূতিটা তেমন ছিল যেমনটা বাবা হাসলে হত, তার মুখটা হাসলে ভাঙা নারিকেলের মত দুভাগ হয়ে যেত। তার মুখের ভেতরের অংশটা ভাঙা নারিকেলের ভেতরের মত দেখাত।
অভ্যুত্থানের পরদিন, সেন্ট অ্যাগনেসে সান্ধ্যকালীন প্রার্থনায় যাবার আগে, আমরা বসার ঘরে বসে খবরের কাগজ পড়ছিলাম। বাবার আদেশে পত্রিকাওয়ালা আমাদের বাড়িতে প্রতিদিন ভালো খবরের কাগজগুলো দিয়ে যেত, প্রতিটি চার কপি করে। আমরা প্রথমে পড়তাম দ্যা স্ট্যান্ডার্ড। একমাত্র দ্যা স্ট্যান্ডার্ডেই একটা সমালোচনামূলক সম্পাদকীয় ছিল, যেখানে নতুন সেনা সরকারকে আহবান জানান হয়েছে গণতন্ত্রে ফিরে আসার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য। বাবা নাইজেরিয়া টুডে হাতে নিয়ে একটা প্রবন্ধ জোরে জোরে পড়তে শুরু করে, প্রবন্ধটি একজন নামী লেখকের একটি মতামত, যেখানে তিনি জোর দিয়ে বলেছেন যে, এখনই সময় সেনা রাষ্ট্রপ্রধান কর্তৃক দায়িত্ব গ্রহণ করার কারণ রাজনীতিবিদরা একদম হাতের বাইরে চলে গেছে আর দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা পুরো লেজেগোবরে।

“স্ট্যান্ডার্ড কখনোই এসব ফালতু কথা লিখবে না,” কাগজটা নিচে নামিয়ে রাখতে রাখতে বাবা বললো। “এই লোককে ‘রাষ্ট্রপতি’ ডাকার তো প্রশ্নই ওঠে না।”

” রাষ্ট্রপতি বলার অর্থ এই দাঁড়ায় যে সে নির্বাচিত,” জাজা বললো। “এক্ষেত্রে বোধহয় রাষ্ট্রপরিচালক শব্দটা ব্যবহার করলে ভাল হয়।”

বাবার মুখে হাসি ফুটলো আর আমি ভাবছিলাম আমি কেন এই কথাটা জাজার আগে বললাম না।

” দ্যা স্ট্যান্ডার্ডের সম্পাদকীয়টা দারুণ হয়েছে,” মা বললো।

” আদে তো অপ্রতিদ্বন্দ্বী একেবারে,” বাবা অন্য আরেকটা কাগজ দেখতে দেখে প্রচ্ছন্ন গর্বের সাথে বলল। ‘অভিভাবক বদল’। কি আমার শিরোনাম! সবাই একদম ভয়ে কাবু হয়ে আছে। সবাই মিলে লিখছে বেসামরিক সরকার কতটা দুর্নীতিগ্রস্থ ছিল, যেন সেনা সরকার কোনদিন দুর্নীতি করবেই না। এই দেশটা পতনের দিকে যাচ্ছে, একদম নিচের দিকে।

” ঈশ্বর আমাদের পরিত্রাণ করবেন,” আমি বললাম, জানতাম বাবা আমার এটা বলা পছন্দ করবে৷
” হ্যা, হ্যা,” বাবা বলল আর মাথা ঝাঁকালো। তারপর এগিয়ে এসে আমার হাত ধরলো আর আমার মনে হলো যেন আমার মুখভর্তি করে চিনি গলে পড়ছে।

তার পরের সপ্তাহগুলোতে, পারিবারিক সপ্তাহে আমরা যে খবরের কাগজগুলো পড়তাম, প্রত্যেকটাই অনেক ভিন্নরকম হয়ে উঠছিল, যেন তাদের দমিয়ে রাখা হয়েছে। দ্যা স্ট্যান্ডার্ডও অন্যরকম হয়ে গিয়েছিল। ওটা আগের চেয়েও অনেক বেশি জটিল হয়ে আরও বেশি প্রশ্ন তুলে ধরছিলো। এমনকি স্কুলে যাওয়ার পথটুকুও অন্যরকম হয়ে গিয়েছিলো। অভ্যুত্থানের প্রথম সপ্তাহের পর, কেভিন প্রতিদিন সকালে গাছের সবুজ ডালপালা এনে গাড়িতে লাগিয়ে দিত, নাম্বার প্লেটের ঠিক উপরে যাতে গভর্নমেন্ট স্কয়ারের বিক্ষোভকারীরা আমাদের যেতে দেয়। সবুজ ডালপালার মানে ছিলো সংহতি। আমাদের ডালগুলো যদিও বিক্ষোভকারীদের হাতের ডালগুলোর মত উজ্জ্বল নয়, তবুও, মাঝেমধ্যে যখন আমরা ওদের অতিক্রম করে যেতাম, আমার মনে হতো, কেমন হত যদি ওদের সাথে যোগ দেয়া যেত, ” স্বাধীনতা” বলে বলে চলন্ত গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে জপ করা যেত।

পরের সপ্তাহগুলোতে, যখন কেভিন ওগুই রোড দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যেত, রাস্তা আটকে বাজারের ধারে সৈন্যদল দাঁড়িয়ে থাকতো, পরম আদরে তাদের বন্দুকগুলো নিয়ে পায়চারি করত। ইচ্ছামত কিছু গাড়ি দাঁড় করিয়ে তল্লাশি চালাতো। একদিন আমি দেখলাম এক লোক রাস্তায় দুই হাত উপরে তুলে তার পাজেরো ৫০৪ এর পাশে হাঁটু গেড়ে আছে।

কিন্তু বাড়িতে কিছুই বদলালো না। জাজা আর আমি আগের মতই যার যার সময়সূচি অনুযায়ী চলছিলাম আর আগের মতই সেসব প্রশ্ন একে অপরকে করছিলাম যার উত্তর আমাদের আগে থেকেই জানা। একমাত্র বদল হচ্ছিল মায়ের পেটে, ওটা ফুলে উঠছিল, নরম হয়ে, ধীরে ধীরে। প্রথমে ওটাকে দেখাচ্ছিল একটা হাওয়া বেরিয়ে যাওয়া ফুটবলের মত। কিন্তু পেন্টেকোস্ট রবিবার আসতে আসতে ওটা তার লাল আর সোনালি কাজ করা গির্জায় যাবার বিশেষ চাদরটাকে এমনভাবে ফুলিয়ে রাখছিল যে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল যে শুধু কাপড়ের স্তর বা চাদরের প্রান্তের গিঁটের কারণেই ওটা অমন উঁচু হয়ে নেই। প্রার্থনা বেদির সাজটা একদম মায়ের চাদরের লাল রঙের সাথে মিলে যাচ্ছিল। লাল পেন্টেকোস্টের রঙ। অতিথি যাজক একটা লাল আলখাল্লা পরে সবার উদ্দেশ্যে ধর্মবাণী উচ্চারণ করলেন। আলখাল্লাটা তার শরীরের তুলনায় ছোট মনে হচ্ছিল। তিনি তরুণ ছিলেন, গসপেল থেকে পড়তে পড়তে মাঝেমধ্যেই উপরের দিকে মুখ তুলছিলেন, তার বাদামী চোখ জমায়েতকে বিদ্ধ করছিল। শেষ করার পর আলতোভাবে চুমু খেয়ে তিনি বাইবেলটা গুটিয়ে রাখলেন। অন্য কেউ হলে ব্যাপারটা বেশ নাটকীয় মনে হত, কিন্তু এক্ষেত্রে তেমন কিছু মনে হলো না। ব্যাপারটা বরং অনেক বেশি বাস্তব লাগল। তিনি সম্প্রতি সন্ন্যাসী হিসেবে যোগ দিয়েছেন, কোনো গির্জায় নিযুক্ত হবার জন্য অপেক্ষা করছেন, তিনি আমাদের বললেন। তিনি আর ফাদার বেনেডিক্ট এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মাধ্যমে সংযুক্ত ছিলেন আর তিনি খুবই খুশি হয়েছেন যখন ফাদার বেনেডিক্ট তাকে আমন্ত্রণ জানান জমায়েতে ধর্মবাণী শোনানোর জন্য। তিনি একবারও বললেন না যে আমাদের সেন্ট অ্যাগনেসের বেদিটা কতটা সুন্দর যদিও এর সিঁড়িগুলো এমনভাবে চমকায় যেন পলিশ করা বরফ টুকরো। অথবা, এই বেদিটা ইনুগুর, মতান্তরে পুরো নাইজেরিয়ার শ্রেষ্ঠ বেদি। তিনি অন্যান্য অতিথি যাজকদের মত করে বললেন না, যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব সেন্ট অ্যাগনেসে অনেক বেশি অনুভূত হয়, যে মেঝে থেকে ছাদ অব্দি সাধুসন্তদের চিত্রাভ জানালা ঈশ্বরকে সেন্ট অ্যাগনেস ছেড়ে যেতেই দেয় না। আর তার ধর্মোপদেশের মাঝপথে তিনি হঠাৎ একটা ইগবু গান গাইতে শুরু করে পুরো জমায়েতকে যেন ভাসিয়ে নিয়ে যান, “বুনি আ এনু… তাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরো…”

জমায়েতের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেল, কেউ দীর্ঘশ্বাস ফেলল, কেউ হতভম্ব হয়ে মুখ গোল করে বসে রইলো। ফাদার বেনেডিক্টের একঘেয়ে, হালকা পাতলা, জোর করে শোনা ধর্মবাণীতেই সবাই অভ্যস্ত ছিল। আস্তে আস্তে তারা গানের সাথে যোগ দিল।

আমি দেখলাম বাবা বিরক্তিতে তার ঠোঁট কোঁচকালো। সে পাশে তাকিয়ে দেখল যে, আমি বা জাজা গান গাইছিলাম কিনা, আর যখন দেখলো যে আমরা দুজনেই মুখ বন্ধ করে আছি, প্রশ্রয়ের ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দিলো যে, আমরা সঠিক কাজটাই করছি।

(চলবে…)

Facebook Comments

comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top