গ্রন্থালোচনা: স্তব্ধতার কানে কানে যে মায়াবী কথক গল্প বলে যান // নাহার তৃণা

গল্প হলো বর্ণিত আখ্যান। একজন গল্পকার সেটি শব্দ বাক্যে উপস্হাপন করেন। আখ্যানের এই বর্ণনা ভঙ্গিতে এক লেখক থেকে অন্য লেখকের পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। যেকারণে আমাদের কথা সাহিত্যে গল্পকে দুভাবে উপস্হাপনের দৃষ্টান্ত দেখা যায়। একটি ধারায় মনে হয় লেখক বুঝি পাশে বসেই গল্পটি বলে যাচ্ছেন, পাঠক গল্পটি শব্দ-বাক্যের ভাঁজ খুলে পড়ছেন না ঠিক, শুনছেন। আর অন্য ধারায় শব্দ বাক্যের ভাঁজ খুলে খুলে গল্পের গন্তব্যে পাঠককে পৌঁছাতে হয়। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হাসান আজিজুল হক, শওকত ওসমান, সৈয়দ শামসুল হক, আবদুল মান্নান সৈয়দ, সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম প্রমুখেরা প্রথম ধারার সফল কথা সাহিত্যিক হিসেবে চিহ্নিত। গল্প বলিয়ে হিসেবে এখানে আরো একটি নাম সাড়ম্বরে জায়গা করে নিতে পারে বলে মনে করি। যাঁর লেখা পড়ে অধিকাংশ সময়ই পাঠকের মনে হবে গল্পকার তার পাশে বসেই তাঁর পরিশীলিত উচ্চারণ আর ধীরস্হির ভঙ্গিতে গল্পটি বলে যাচ্ছেন। গল্পকথকের নাম কুলদা রায়।

কুলদা রায় জাদুকরী শব্দে গল্প বলেন। যে গল্পটি তিনি পাঠককে শোনাতে বা বলতে চান, সেটির জন্য রয়েছে তাঁর নিজস্ব এক ধরন। এক মায়াময় গদ্য শৈলীর মাধ্যমে তিনি নির্মোহ এক ন্যারেটরের মতো গল্প বয়ান করেন। গল্পের ভাষায় আরোপিত কোনো চটকের বালাই থাকে না। সহজিয়া ভাষায় তিনি তাঁর গল্প পাঠককে বলেন বা বলতে চান। এটি কুলদা রায়ের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। তাঁর এই ভাষা বৈশিষ্ট্যের সাথে সঙ্গত করে যায় লেখকের ঋদ্ধ অভিজ্ঞতা। কুলদা রায়ের পাঠক মাত্রই জানেন, সম্পূর্ণ গল্প কাঠামো বা ন্যারেটিভে পরিব্যাপ্ত অভিজ্ঞতা কী দারুণ দক্ষতায় তিনি মিশিয়ে দিতে পারঙ্গম। আর এমন অভিজ্ঞতা মুঠোবন্দী বলেই তাঁর গল্পগুলো চলতে চলতে হোঁচট খায় না। বরং তাঁর এক একটি রচনা অনন্য এক ঘরোনার বৈশিষ্ট্যে স্বাতন্ত্র্য হয়ে ওঠে। তিনি জানেন গল্পে আকর্ষণ তৈরিতে বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা থাকা জরুরি।

জরুরি এই ব্যাপারটা কুলদা’র মধ্যে আসনপিঁড়ি হয়ে আছে। তিনি গল্প বুনবার সময় তার ছাপ ধরে ধরে এগিয়ে যান। বুঝতে কষ্ট হয় না হারুকি মুরাকামির সাথে এই জায়গাতে কুলদা রায়ের চমৎকার একটা মিল রয়েছে। মুরাকামি তাঁর গল্প সম্পর্কে একবার বলেছিলেন – “আমার ছোটগল্পরা অনেকটা এই দুনিয়ায় আমি যে আবছা-নরম ছায়াদের বিছিয়ে চলেছি তাদের মতো, ফেলে আসা প্রায় অদৃশ্য পদচিহ্ন সব। আমার পরিষ্কার মনে আছে তাদের প্রত্যেককে কাকে কোথায় ফেলে এসেছি, আর কেমন লেগেছিল সেই ফেলে আসার সময়। ছোটগল্পরা অনেকটা আমার হৃদয়ে পৌঁছনোর পথে পথনির্দেশ ফলকের মতো।”

কুলদা রায়ের বাস্তব অভিজ্ঞতার সাথে ইতিহাস, ঐতিহ্য, গ্রামবাংলার প্রকৃতি নিবিড় একাত্মতায় সঙ্গত করে যায়। সঙ্গতে সঙ্গ দেয় তাঁর সিগনেচার কুহকময়তার চমৎকারীত্ব। সম্মিলিত সেই তুখোড় অর্কেস্ট্রায় সৃষ্টি হয় মুক্তার মতো দ্যুতিময় ফসল। দ্যুতি ছড়ানো লেখাগুলোর পেছনে রয়েছে লেখকের গভীর যত্নের আয়োজন। যার আভাস পাওয়া যায় লেখকের বয়ানে- “এ বছরে আমি তিনটি গল্প লিখেছি। তার মধ্যে দুটো প্রকাশিত হয়েছে। আরেকটি প্রকাশ করিনি। কিছুদিন শুধু নিজে নিজে পড়ছি। পড়ে পড়ে তার কণ্ঠস্বরকে ঠিকঠাক করছি। সঙ্গে সঙ্গে আরো তিনটি গল্প লিখছি বেশ কয়েক মাস ধরে। কোনো গল্পলেখার শুরুতেই আমি প্লটিং করে নাম ঠিক করে নেই। তারপর সিকুয়েন্স ধরে ধরে ধীরে ধীরে লিখি। আর পড়ি। আবার পড়ি।”

এমন নিবিড় পরিচর্যায় গড়ে ওঠা গল্প নিয়ে এবারের অমর একুশে বইমেলা ২০২২ কুলদা রায়ের গল্পগ্রন্থ যে সুচিত্রা সেন কিডন্যাপ হয়েছিলেন নালন্দা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে। শিরোনামে লেখকের স্বকীয় স্বাতন্ত্র্য স্পষ্ট। উল্লেখ্য, একই শিরোনামে বইটি এ বছর পশ্চিমবঙ্গের গুরুচণ্ডালী প্রকাশনী থেকেও প্রকাশিত হয়েছে।

যে সুচিত্রা সেন কিডন্যাপ হয়েছিলেন বইটিতে মোট আটটি গল্প রয়েছে। শিরোনাম, আখ্যান, বয়ান ইত্যাদি শৈলী উপস্হাপনে রয়েছে লেখকের নিজস্ব জাদুকরী কৌশল আর অভিনবত্ব। এ বইয়ের এক গল্পের সাথে অন্য গল্পের সূক্ষ্ণ সাযুস্য লক্ষণীয়, একমাত্র ব্যতিক্রম আমেরিকান পটভূমিতে রচিত গল্প ‘লাদেনের জুতা’। বলাই বাহুল্য প্রতিটি গল্পের প্লটভাবনায় রয়েছে দারুণ বৈচিত্র্য।

‘দুটি হলুদ ইলিশের গল্প’ বইয়ের সূচনা গল্প। এটি আমার সবচেয়ে পছন্দের। শিরোনাম দেখে বহু পাঠকের মনে প্রশ্ন উঁকি দেওয়া স্বাভাবিক – ইলিশ তো রূপালি রঙের হয়- কুলদা রায়ের ইলিশ হলুদ বর্ণের কেন? নামকরণেই পাওয়া যাচ্ছে অন্য রকম এক ইলিশ আর তার সাথে ঘন হয়ে থাকা গল্পের আভাস। লেখক এ প্রসঙ্গে যা বলেছেন শুনি বরং-”হলুদ ইলিশ গল্পটি লেখার শুরুতেই নামটি দিয়েছিলাম। ইলিশ রুপোলী রঙের। হলুদ হয় না। কিন্তু আমার গল্পের ইলিশ দুটি হলুদ। মালতিপিসি হলুদ মাখিয়ে পাঠায়। সে ইলিশ হলুদ না হয় কী প্রকারে।”

কে এই মালতিপিসি? ইনি ঠাকুরদার পিসি, যিনি পাখিদের সাথে উড়ে কোথাও চলে গেছেন। মায়াজাল বিছিয়ে সেই পিসির গল্প করেন ঠাকুরদা। মালতিপিসির গল্প বলতে বলতে প্রায় তিনি নিজেদের পাতের দৈনতাকে দূরে ঠেলে দিয়ে পাশে বসা নাতিদের চোখে স্বপ্ন গুঁজে দেন। তারা আশায় থাকে একদিন ঠাকুরদার কথামতো তাদের দারিদ্র্যপীড়িত এই বাড়িতে অতিথি আসবে, তার জন্য ‘দীঘা ধানের ভাতের সঙ্গে ইলিশের পাতুরি হবে।’ আর সে জন্য তিনি রোজ বৌমাকে একমুঠো চাল কলসিতে তুলে রাখতে বলেন। অতিথি এলে যেন সমস্যায় পড়তে না হয়। সেই সুখাদ্যের ভাগ দিতে দরকার হলে আরো এক দুজন প্রতিবেশীকেও ডেকে নেওয়া যাবে। অভাবক্রান্ত সংসারের লক্ষ্ণীমন্ত বৌটি শ্বশুরকে প্রায় জানায় চাল সে তুলে রেখেছিল ঠিকই কিন্তু গতরাতে রেঁধে ফেলেছে। পরে আবার সে চাল তুলে রাখবে, এমন অলীক সান্ত্বনায় তাঁকে স্বস্তিতে রাখে। নাতিরা অপেক্ষা করে অতিথির। কিন্তু কেউ আসে না। অধৈর্য্য নাতিদের ঠাকুরদা প্রবোধ দেন, মালতিপিসি ঠিকই একদিন অতিথি পাঠাবেন। আশাই তো মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। কূলহীন দারিদ্র্যের ভেতর আকণ্ঠ ডুব দিয়ে ঠাকুরদার আশ্বাসে গুটি কয়েক শিশু আশায় বাঁচে। মা তাদের বাস্তবতায় টেনে আনতে চাইলেও সহসাই স্বপ্নের পলেস্তরা সরিয়ে তারা বাস্তবের মাটিতে না নেমে ঠাকুরদার সঁপে দেওয়া স্বপ্নে মন ডুবিয়েই বুঝি স্বস্তি পায়।

দুটি হলুদ ইলিশের গল্পে দারিদ্রকে হীরণ্ময় চেহারায় উপস্হাপনের যে শিল্পীত রূপ, মানবিকতাকে তুলে ধরার যে একনিষ্ঠ আন্তরিকতা তা পাঠককের বুকে সুখের মতো ব্যথা হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। গল্পটি পড়তে পড়তে, ডাগর চোখের বাবরি দোলানো দুখুকবি ‘দারিদ্র্য তুমি মোরে করেছো মহান’ বলে বুঝি সামনে এসে দাঁড়িয়ে যান হুটহাট। মহত্ত্বের কথা বলা হয়ত সহজ কিন্তু তার আয়োজনে যে নিষ্ঠা প্রয়োজন সেটা আমরা দেখতে পাই এই গল্পের ঠাকুরদার ভেতর। নিজেদের পাতে খাদ্য উঠবে কী উঠবে না তার হদিশ না থাকলেও বাড়িতে আগত অতিথি যেন অভুক্ত ফিরে না যান, সেটা নিয়ে ঠাকুরদার তোড়জোড়ের ঘটাটি পাঠকের আত্মা স্পর্শ করে। বুঝতে কষ্ট হয় না একদা তাঁর অবস্হাপন্ন সময়ে তিনি ওরকম আচরণে অভ্যস্ত ছিলেন। একই সাথে পর্বটি চিরন্তন গ্রাম বাংলার অতিথিপরায়ণতার সাক্ষ্য হিসেবে উপসহিত হয়। আজকের চাকচিক্যময় ইট কাঠের শহুরে মানুষকে কিছুটা হলেও যা বিব্রত করবে হয়ত। কিন্তু বিব্রত করতে নয়- সহজিয়া গল্পগুলো সহজ ভাষায় বলতে ভালোবাসেন কুলদা। দারিদ্র্য এই পরিবারটির নিত্যসঙ্গী। কিন্তু পরিবারের মানুষগুলোর মানবিকবোধের শক্তি দারিদ্র্যকে ছাপিয়ে অনেক উঁচুতে উঠে গেছে। একই সুরের প্রতিধ্বনি শুনেছিলাম পঠিত প্রিয় একটি নভেলায়। কাহিনিটির কথা মনে পড়ে যায়।

গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের কর্নেলকে কেউ লেখে না। এই পাঠকের মনে হয়- সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিক এবং প্রেক্ষাপটের দুটি রচনা- অথচ রচনার আত্মা বলে যদি কিছু থেকে থাকে সেই জায়গাতে এই দুটির মধ্যে একটা যোগ রয়েছে। সেটি কী? দুই গল্পের পরিবার দুটি অভাবের সাথে যুঝতে থাকা সত্ত্বেও আশাবাদ নিয়ে জেগে থাকে, দারিদ্র্যের থাবায় তারা কেউ তাদের মানবিক শুভ্রতা হারিয়ে নিজেদের আত্মাকে মলিন হতে দেননি। কর্নেল আশায় থাকেন পেনশনের চিঠিটা এসে পৌঁছালেই তাদের যাবতীয় ভোগান্তির ইতি ঘটবে। তিনি স্বপ্ন দেখেন, মৃত ছেলে অগাস্টিন, যাকে তৎকালীন ল্যাটিন আমেরিকায় চলমান রাজনৈতিক অত্যাচারের অংশ হিসেবে হত্যা করা হয়, তার পেলেপুষে বড় করা মোরগটি লড়াইয়ে নিশ্চিতভাবে জিতে যাবে। ব্যবহার্য জিনিসপত্র বিক্রির মতো দুর্দশায় পৌঁছেও মলিনতায় লীন হতে দেন না নিজের রুচিবোধ। অন্যদিকে ‘দুটি হলুদ ইলিশ গল্পে ঠাকুরদা আশায় থাকেন তার বাড়িতে অতিথি আসবে, নিজের আশা তিনি নাতিদের ভেতর সঞ্চারিত করে দেন। অবস্হাপন্ন এক বাড়িতে আগত অতিথির সাথে ইলিশ খাওয়ার ডাক পেয়েও নাকচ করে দেন, তার রুচিবোধ বাধা দেয়। অতিথি আপ্যায়নের পুরনো রীতিতে অভ্যস্ত মানুষটি দারিদ্র্যে জর্জর থাকা সত্ত্বেও ছেলের বৌকে বলতে ভোলেন না অতিথি আপ্যানের জন্য সে যেন চাল তুলে রাখে। আশায় থাকেন মালতিপিসির সহৃদয়তার। যিনি পাখিদের সাথে উড়ে দূরদিগন্তে মিলিয়ে গেছেন ভেবে নেওয়া হলেও আদতে ডাকাতেরা তাকে তুলে নিয়ে যায়। বেঁচে আছেন কী মৃত্যু হয়েছে হদিশ নেই তার; সেই মালতিপিসি হলুদমেখে দুটো ইলিশ পাঠাবেন। তিনি তার তোরঙ্গে তুলে রাখা বাদশাহী পাঞ্চাবী আর ধুতি পরে অতিথি সৎকার করবেন। হামুখো অভাব দাঁড়িয়ে দুই গল্পের দুই পরিবারের আঙ্গিনায়, কিন্তু তা ঘিরে আহাজারির মাতম নেই। কল্যাণময় এক আশাবাদ মুঠোয় ভরে থাকে কেবল অপেক্ষা।

দারিদ্র্য মানেই শতেক অভিযোগে বাতাস ভারী করার আহাজারি, আত্মার শুভ্রতার জলাঞ্জলি এমন বাস্তবতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে এই দুই কাহিনির কল্যাণময় নির্মাণে মুগ্ধ পাঠকমন কুর্নিশ জানাতে নত হয়।

দ্বিতীয় গল্প ‘কাকচরিত’। কথকের মা, কাককে কেন কাউয়া বলেন কাক নয়, সে নিয়ে রসাত্মক বর্ণনার সূচনা দিয়ে গল্পের শুরু। মা কাউয়া বললেও, আজা মশাই(কথকের নানাজান) কাককে বায়সপক্ষী বলে সম্বোধন করেন। তিনি বিশ্বাস করেন এই পক্ষী ত্রিকালজ্ঞ- ঋষিপক্ষী। অতীত-ভবিষ্যৎ বর্তমান সব বলতে পারে। এই গল্পের বালবিধবা সরলাবালা বিধবা অবস্হাপন্ন- অসুস্হ বোনের আশ্রয়ে থাকেন, তিনি মোটেও কাক সহ্য করতে পারেন না। অথচ বাড়ির নতুন বউটি যে কাক সম্বোধন না করে কাউয়া ডাকে, খুব আন্তরিকতায় সে কাক বা কাউকাকে অর্ঘ্য দেয় যা দেখে ছোট ননদিনী তাকে সাবধান করে। অর্ঘ্য দেবার পরদিন জাদুমন্ত্রে সক্কাল সক্কাল বকুলগাছে একটি কাককে বসে থাকতে দেখা যায়– যে রা কাড়ে না। বাড়িতে কেন কাকটির আর্বিভাব ঘটলো সেটি রহস্যাবৃত। রহস্যময় পাখিটি শান্ত হয়ে চুপচাপ বসে থাকে। কাকটি দেখতে অদ্ভুত– পুরোপুরি কালো নয়- গলার কাছটিতে সাদা ছোপ। রোদ পড়লে রং বেগুনি দেখায়। আজা মশাই বর্ণ রহস্য ভেদের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন। চলে যান স্হানীয় পাবলিক লাইব্রেরির ময়েনউদ্দিন স্যারের কাছে যিনি কাক বিষয়ে সাহায্য করতে ব্রিটানিকা খুলে দেখান বেগুনি রঙের কাক ইন্দোনেশিয়ার ব্রুনেই বাস করে। তারা বলে- ভায়োলেট করভাসা। ভায়োলেট কারভাসাই হোক কিংবা নিছক মামুলি কাক, সে কিন্তু তাকে ঘিরে চলতে থাকা কর্মকাণ্ডেও আগাগোড়া নৈঃশব্দ্যে মগ্ন থাকে। কাকটি নিঃশব্দে থাকে বলে সরলাবালা টের পাননা। এই কাক বা বায়সপক্ষী ঘিরে চলে কাহিনির উত্থান পতন। ময়েনউদ্দিন স্যারের দ্বারস্হ হয়ে আজা মশাই বায়সপক্ষীর নানাবিধ ডাকের তরজমা অনুধাবনে সক্ষম হন। কাক যদি ক্রেন ক্রেন স্বরে ডাক ছাড়ে তবে বুঝে নিতে হবে কোনো সুন্দরী রমণীর সঙ্গে সম্পর্কের সমূহ সম্ভাবনা। আজা মশাই ক্রেন ক্রেন ডাক শোনার আশায় থাকেন। ঘটা করে সে কথা স্ত্রী অর্থাৎ আজুমা(নানিজান)কেও জানান। কাক ক্রো ক্রো সুরে ডাকলে শুভলাভ আসন্ন। ইত্যাদি ডাকের সুলুকসন্ধানের পাশাপাশি বকুলগাছের কাকটিকে ঘিরে চলে মানুষেরা নানাবিধ কর্মকাণ্ড।

রা কাড়তে না জানলেও কাকটির কেরামতিতে কয়েকদিনের ভেতর কতসব তেলেসমাতি ঘটে যায়। লোকসমাগম হতে থাকে। কাকচরিতের খোলসে চলে মনুষ্যচরিতের বয়ান। সে বয়ান বড় সুরেলা। সরলাবালা যিনি অসুস্হ বোনের বাড়ির দেখাশোনার দায়িত্ব নিয়ে এতদিন সর্বময় কর্ত্রী হয়ে ছিলেন তার আসন টলে যায় ভাগ্নে বিশুর তার প্রতি বিরাগ হওয়ায়- কারণ বিশু কাক ঘিরে লোকজনের মানত পুজো দেবার ঘটাকে ক্যাশ করে ব্যবসা ফেঁদে বসার মতলব এঁটেছিল– যা পক্ষীটি উড়ে যাওয়ায় ভেস্তে যায়। তার সন্দেহ সরলাবালা যেহেতু কাক পছন্দ করেননা তিনিই পাখিটি উড়িয়ে দিয়েছেন। তার সাফ জবাব পাখিটিকে ফিরিয়ে আনতে না পারলে তার এই বাড়ির পাট চিরদিনের জন্যেই ঘুচে যাবে। নিয়তির কী পরিহাস, যে সরলাবালা কাক সহ্যই করতে পারেন না মাথার উপর থেকে ছাদ হারানোর ভয় তাকে পাখিটির খোঁজে নামতে বাধ্য করে। অসহায় সরলাবালা বায়সপক্ষীর খোঁজে বেরিয়ে পড়েন। শেষমেশ কী সরলাবালা পাখির সন্ধান পেতে সক্ষম হন? সাত সকালে বাড়ির লক্ষ্ণী বৌটিই বা কেন ‘কাউয়া’ শূন্য বকুল গাছে চড়ে? আর তার নেমে আসবার পর ননদিনী(কথকের পিসি) বকুলগাছ থেকে কোন জাদুমন্ত্রে দিব্যি শুনতে পান বায়সপক্ষী ডাকছে- ক্রো ক্রো স্বরে! লেখক তাঁর জাদুবিস্তারী বর্ণনায় কাকচরিত গল্পে কাক নয় কোলাহল সর্বস্ব মানব চরিত্রের নানাদিকের নিদারুণ উন্মোচন ঘটিয়েছেন।

‘যে গ্রামের সবাই ধর্ষিত হয়েছিল’- গল্পটি আমাদের স্তব্ধ করে দেয়। মনে করিয়ে দেয় সভ্যতা, ক্ষমতার দাপট আর উন্নয়নের নামে আমাদের যাবতীয় চেঁচামেচি কতটা ফাঁপা, অন্তসারশূন্য। এ গল্পের প্রেক্ষাপট ২০১৬ ফেসবুকের একটি ফটোশপকৃত ছবি কেন্দ্র করে নাসিরনগরে সংঘটিত নজিরবিহীন নৃশংস ঘটনা। যার পেছনে কলকাঠি নাড়ায় জনৈক রাজাকার পুত্র। যে ঘটনার জেরে পুড়েছিল নিরীহ সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ঘরবাড়ি, মন্দির। ধর্ষিত হয়েছেন বহু নারী এমনকি নাবালিকাও। কুলদা রায় তার সিগনেচার জাদুময়তা আর বাস্তবতার মিশেলে সেই গল্প শুনিয়েছেন আমাদের। যেখানে মনোপজ হওয়া সিভিলসার্জনের স্ত্রী মঞ্জেআরা বেগম পর্যন্ত তাণ্ডবের শিকার গ্রামটির রজঃস্বলা না হওয়া কিশোরীদের সাথে গর্ভবতী হন। টেস্ট রেজাল্ট তেমনটাই জানান দেয়। সত্যিকে মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্যি করা যখন ক্ষমতার লক্ষ্য হয়ে পড়ে তখন ত্রাসের রাজত্ব শুরু হতে বাধ্য। কিন্তু সেসব নিয়ে ট্যাঁ-ফোঁ করার উপায় নেই। বাস্তবের এমন ঘটনাগুলো চেপে রাখাই দস্তুর। বলতে গেলেই চোখ রাঙানি। ক্ষমতাধরের কেটে দেওয়া লক্ষণরেখার ভেতর থেকে সব কথা সপাটে বলা যায় না। কিন্তু কালের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই লেখক সাহিত্যিক তথা শিল্পসংস্কৃতির সাথে জড়িত মানুষই সমাজে চলমান নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে যার যার বৃত্তে দাঁড়িয়ে প্রথম আওয়াজ তোলেন- যে না অন্যায় হচ্ছে, আমরা আঁকা ছবি দিয়ে, লেখনী দিয়ে, সংলাপ দিয়ে তার প্রতিবাদ জানাচ্ছি। ‘যে গ্রামে সবাই ধর্ষিত হয়েছিল’ কুলদা রায়ের সপাট প্রতিবাদের এক অনন্য আখ্যান।

‘যে সুচিত্রা সেন কিডন্যাপ হয়েছিলেন’ গল্পটি এক চলমান চলচ্চিত্র যেন। যার চলন ভারী অন্যরকম। গতানুগতিক গল্পের সাথে এ গল্পের বিস্তর ফারাক। কী প্লট নির্মাণ বা আখ্যানে। কুলদা রায়ের অধিকাংশ গল্পই প্রচলিত গল্পকাঠামোকে ভেঙেচুরে এগিয়ে যায়। এটিও তার ব্যতিক্রম নয়। এতে শুধু গল্পকাঠামো নয় স্হান-কালের সীমা ভেঙে এগিয়েছে গল্প। যেমনটা তাঁর ‘মার্কেজের পুতুল’ গল্পে ঘটতে দেখা গেছে। নানা সংশয় আর ঘটনার হাত ধরে প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে অবলীলায় গল্পের আসা যাওয়া ঘটেছে। ইতিহাসের নানা ঘটনা আলতো পায়ে হেঁটে গেছে গল্প জুড়ে, কিন্তু কোথাও এতটুকু ছন্দপতন ঘটেনি। গল্পের কেন্দ্রে থাকা রমারাণী কিংবা সুচিত্রা সেন নামটিকে ঘিরেই ঘটেছে যাবতীয় আবর্তন। যার উদ্দেশ্যে একদা স্কুল পড়ুয়া বালকের হৃদয় গচ্ছিত রাখার আকুতি ঝরে পড়েছিল-
“রমা মেরা রমা
হৃদয় দিয়েছি জমা।”

শেষধাপে একটি বিয়ের ঘটনা এবং একজনের অনন্তযাত্রার দৃশ্য দৃশ্যায়িত হয়- ব্যাকড্রপে বেজে যায় অব্যক্ত কয়েকটি লাইন।

‘রমা আমার রমা
তুমি করিও মোরে ক্ষমা।
অনেক অশ্রু রইল পড়ে জমা।’

এক না হয়ে ওঠা প্রেমের মর্মস্পর্শী অনুরণন ছড়িয়ে দিয়ে কী অসাধারণ মুন্সিয়ানায় কুলদা রায় ‘যে সুচিত্রা সেন কিডন্যাপ হয়েছিলেন’ গল্পের ইতি টেনেছেন। গল্পের নানা বাঁকের ভুলভুলয়াইতে পড়ে অমনোযোগী পাঠক খাবি খাবেন হয়ত। কিন্তু মনোযোগী পাঠকমাত্রই পাবেন সুখপাঠ্যের অমূল্য রত্ন। শিরোনামের এ গল্পটি একটি অসাধারণ প্রেমের গল্প হিসেবে পাঠক মনে রাখবেন।

‘লাদেনের জুতা’ গল্পের প্লটের জন্য লেখককে প্রথমেই সাধুবাদ জানাতে হয়। এমন একটি ইউনিক গল্পভাবনা তাঁর মাথায় কীভাবে এলো সেটা ভেবে অবাক লাগে। পাকিস্তানি শফি যে কিনা জীবিকার টানে আমেরিকায় এসেছিল। কর্মসূত্রে কথকের পরিচিত। আরেক চরিত্র আকন ভাই তিনিও একই অফিসে কাজ করেন। আকন ভাই পাকিস্তানি লোকজন একেবারেই পছন্দ করেন না। নাইন ইলেভেনের ঘটনার সময় সেই তিনিই শফির প্রাণ রক্ষায় এগিয়ে আসেন। ‘লাদেন’ আমেরিকারই তৈরি ফন্দিফিকিরের এক নাম বলে ভাবেন তিনি। শফি হিন্দি সিনেমার ভীষণ ভক্ত। কারিনা কাপূরকে তার ভীষণ পছন্দ। আটপৌরে ছেলে শফি কল্পনা করে সে কারিনার মতো কাউকে বিয়ে করবে। কল্পনায় নানাকিছু ভেবে নেবার বাতিকগ্রস্ত শফি। এক সময় সে বিয়ে করে। বন্ধুদের জানায় তার বউ দেখতে কারিনার মতো। ঠিক হয় পাকিস্তান থেকে বউ এলে বন্ধুদের দাওয়াত করবে। এক সময় শফির স্ত্রী তার চাচা সমেত আমেরিকায় চলেও আসে। বন্ধুরা দাওয়াতের আশায় থাকে। শফি তার নতুন সংসার গোছগাছের পাশাপাশি স্ত্রী কে কারিনার মতো বানানোর প্রকল্প হাতে নেয়। তারই মধ্যে ঘটে যায় এক অবিশ্বাস্য ঘটনা। যে ঘটনার হোতা আর কেউ নয় শফি। ধর্মান্ধতা এমনই এক ধাঁধা যা দুটো বাঁধাকপিকেও শক্তিশালী বিস্ফোরক ভাবতে সাহায্য করে। আর বাকিতগ্রস্ত হলে তো কথাই নেই। এ গল্প পড়া শেষে পাঠক হয়ত ভাবতে বসবেন– লাদেনের জুতা তো সীমান্ত পেরিয়ে শফির চাচা শ্বশুরের সাথে চলে গেছে গন্তব্যে– সে আবার কবে কোন অঘটন ঘটায় কে জানে!

‘অন্ধ শওকত আলী ও তার মেয়ের গল্প’, এ গল্পটিও অভিনব প্লট আর বর্ণনায় সমৃদ্ধ। কুলদার প্রায় সব গল্পেই থাকে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞার ছোঁয়া- এটিও তার ব্যতিক্রম নয়। এ গল্প বাবা আর মেয়ের চিরায়ত ভালোবাসার গল্প। গল্পের মেয়েটির সৌন্দর্য শহরময় চর্চার বিষয়। তাকে নিয়ে লোকের নানা কথা বাতাসে ভেসে বেড়ায়। বাবা শওকত আলী জানতে পারেন মেয়েটি তার বাড়িতে না থাকার সুযোগ নিয়ে প্রেম করছে। মেয়ের প্রেমিকটি কে সেটি অজানা। শওকত আলী মেয়ের অজানা প্রেমিককে নিজস্ব বুদ্ধি প্রয়োগ করে হত্যার আয়োজন করেন। ঘটনার পর অনুশোচনায় দগ্ধ হতে থাকেন তিনি। মেয়েটিকে নিয়ে বাতাসে উড়তে থাকা গালগল্প ‘হতে পারে আবার নাও পারের বিভ্রান্তিতে বাবাটির মতো পাঠকও পড়ে যান। কুলদা রায় তাঁর নিজস্ব ভঙ্গির যাবতীয় জাদু প্রয়োগ করে গল্পটিকে নানা অলিগলি ঘুরিয়ে তার চমৎকার সমাপ্তি টেনেছেন।

‘ক্রসফায়ারের পর যা যা ঘটেছিল’ গল্পটি এক সভ্য সমাজে চলমান অসভ্য আচরণের দলিল। যে গল্প পাঠে পাঠক অক্ষম এক ক্রোধে আক্রান্ত হবেন। গল্পটি এক সময় আর গল্পে আটকে থাকে না- আমাদের অনেকের অভিজ্ঞতার জীবন্ত স্বাক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। মন্নান মণ্ডল, মর্জিনা, ফেলা মোল্লা, রহিম শেখ প্রমুখ আতঙ্কিত গ্রামবাসী আমাদের প্রতিনিধি হয়ে বুঝি নলবনে আবিষ্কার করে ভাসমান কারো পা। অবশ্য নিরীহ গ্রামবাসী মন্নান মণ্ডল বা তার স্ত্রী মর্জিনার প্রতিনিয়ত পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত ক্রসফায়ারে দোষী নির্দোষ নির্বিশেষে লাশ হয়ে এদিক-সেদিক ভেসে যাওয়ার খবরাখবর পাঠের অভিজ্ঞা নেই। আর সেটা নেই বলেই প্রাথমিক পর্যায়ে তারা ভাসমান পায়ের অংশটি দেখে “ঠিক মানুষের পা নাও হতে পারে’র দ্বন্দ্বে পড়ে যায়। যা এক পর্যায়ে পুলিশের উপস্হিতিতে মৃত মানুষ, আর সেটি ক্রসফায়ারেই মৃত এমন একটা ধারণা গ্রামবাসীর ভেতর চাউর হয়ে পড়ে। ঘটনাটি থানা পুলিশ ছাড়িয়ে এলিট ফোর্স পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছায়। মৃতদেহটি ঘিরে কল্পনা-জল্পনার পাখাপ্রাপ্তি ঘটে। মৃত হিসেবে সম্ভাব্য অনেকের নাম উঠে আসে।

শেষমেশ দেখা যায় আদৌও ওটা কোনো মৃত দেহই নয়- তিন গ্রাম দূরের নয়াগ্রামে পুতুল নাচের দল এসেছিল- তাদেরই একটি পুতুল নলবনে ভেসে এসেছে। কী করে সেটি সম্ভব হলো সেই যৌক্তিক প্রশ্ন তখন খুব জরুরি নয়। জরুরি বিষয়টা হলো এলিট ফোর্সের কাছে ক্রসফায়ারের ভুয়া খবর দিয়ে পুলিশ বাহিনির মুখ ছোট হয়েছে। তৈরি রিপোর্ট তাদের বদলাতে হবে। এলিট ফোর্স এক তুড়িতে সমস্যার সমাধান দিয়ে যে ঘটনা আদৌও ঘটেনি সেটাই ঘটবার পথ তৈরি করে দেয়। ওখান থেকে গল্প আবার চলতে শুরু করে– যা শব্দ-বাক্যে কুলদা লিখেননি বটে কিন্তু পাঠকের বুঝে নিতে সমস্যা হয়না। গল্পটি পড়ে আমরা আতঙ্কগ্রস্ত হই। কারণ এটি সত্যিই ভয়ের গল্প। স্বয়ং লেখক এটিকে ভয়ের গল্প হিসেবে অকপটে স্বীকার করেছেন–

“এই গল্পগুলো ভয়েরই গল্প। আতঙ্কের গল্প। কবরের স্তব্ধতার মতো এই রকম আতঙ্কের মধ্যেই ডুবে আছে সবাই। এটাই বাস্তবতা। ক্ষমতা এই বাস্তবতার ঘটনাগুলো মানুষের স্মৃতি থেকে মুছে ফেলতে চায়। একজন লেখকের কাজ হলো মুছে ফেলার আগেই লিখে ফেলা। মানুষের স্মৃতির মধ্যে এ ঘটনাগুলোকে ফিরিয়ে আনা। এটাই হলো ক্ষমতার বিরুদ্ধে এ সময়ের মানুষের লড়াই।”

গ্রামে একজনের অযাচিত মৃত্যু এবং পাশাপাশি মেরী নামের মেয়েটির দুই বছর পর গ্রামে ফেরার কাহিনি নিয়ে বইয়ের শেষ গল্প ‘গুলাবগুলি’। খুব প্রাণবন্ত ভাবে গল্পের সূচনা। পাঠক জানতে পারেন মেরী গ্রামে একা ফিরেনি, স্বামী রূপকুমার তার সঙ্গে এসেছে। এতদিন সে নরসিংদীতে পিসির কাছে ছিল। সে থাকা মোটেও স্বস্তিময় ছিল না। যেকারণে তার গ্রামে ফেরাটা বাবা যাদব হালদারের জন্য খুব আবেগের। গ্রামীণ আচার আচরণের মধ্য দিয়ে বর-কনেকে বরণ করার রীতি চলে অনেকটা অংশ জুড়ে। গল্পময় তাহাদের উৎসবে জেগে ওঠে পাড়া’র আমেজে পাঠকও সিক্ত হতে থাকেন। গ্রামীণ হিন্দু পরিবারের অচেনা অনেক আচার রীতির সাথে পরিচয় ঘটে। এই বরণকে কেন্দ্র করে আচার অনুষ্ঠানের সাথে পাল্লা দিয়ে চলে পালাগান, মুখে মুখে তৈরি পদ বা ছড়ার বয়ান। ভারী আনন্দ, আনন্দ একটা পরিবেশের মধ্যেও মেরী কেন তার স্বামীকে “গুলাব বাগানে যাবা না” বলে সাবধান করে দেয় সেটি ভেবে সামান্য হলেও পাঠকের ভ্রুতে ভাঁজ পড়ে। গুলাবগুলি এক ধরনের গুটি বা ফল যেটি ভেঙে তেল বের করা হয়। সেই তেলে গ্রামের মানুষ প্রদীপ বা পিদিম জ্বালিয়ে থাকেন। আলো বিলাতে কাজে লাগে এমন একটি বাগানে কোন গূঢ় অন্ধকার থাকার সম্ভাবনা যা নিয়ে গ্রামের কৃতি কন্যাটি ব্যতিব্যস্ত থাকে!

গল্পের সুতো যত গড়াতে থাকে ধোয়াশা কেটে কাহিনি স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়। ওই গ্রামের হিন্দু-মুসলমান আগে কতটা সুন্দর দিন কাটাতো সেই বাস্তবতা মেরী আর তার বরকে বরণের ছুতোয় সামনে আসে। একদা হঠাৎ একটি মৃত্যুর ঘটনায় যার ছন্দপতন ঘটে যায়। মেরীর জীবন থেকে দুই বছর হারিয়ে যায়। নিজগ্রামের আলোছায়া- বাবা, জ্যাঠা, জ্যাঠির স্নেহ জ্যাঠাতো বোন সোনার বেড়ে ওঠা, অনেক কিছু থেকে তাকে বঞ্চিত হতে হয়। যার পেছনে ছিল গ্রামের দুই দুষ্টকীট ছক্কু ও রঞ্জিতের কারসাজি। এমন কারসাজিগুলো বার বার অভিশাপ হয়ে সম্প্রীতিতে ভাঙন ধরিয়েছে উপমহাদেশীয় রাষ্ট্রগুলোতে, ইতিহাস তার সাক্ষী। কী এমন ঘটেছিল যার জন্য গুলাবগুলির বাগান মেরীর মনে আতঙ্ক ছড়ায়? কার মৃত্যু ঘটেছিল- কীভাবে? তার জের হিসেবে ব্যাপারী জেঠীমাই বা কেন নিজেকে অপরাধী ভেবে অনুশোচনায় ভুগে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছেন? সব প্রশ্নের উত্তর আছে গুলাবগুলি গল্পে। এই গল্পটিতে কুলদা রায় যেন তাঁর যাবতীয় রসের ধারা উপুড় করে দিয়েছেন। ধারাটি সনাক্ত করতে হলে ‘গুলাবগুলি’ না পড়ে উপায় নেই।

যে সুচিত্রা সেন কিডন্যাপ হয়েছিলেন বইটির প্রায় প্রত্যেকটি গল্প নিয়ে আলাদাভাবে আলোচনার সুযোগ আছে। গল্পের অভিনব প্লট, আখ্যান বর্ণনা, ভাষা ও বয়ানভঙ্গি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা চালানো যায়। কুলদা রায়ের লেখালিখি বিস্তারিত পাঠের যেমন দাবি রাখে, তেমনি রাখে বিশ্লেষণের দাবি। পাঠ প্রতিক্রিয়ার স্বল্প পরিসরে সেটি সম্ভব না। আশা করবো নিশ্চয়ই এই কাজটি কেউ করবেন। পাঠক হিসেবে মনে করি এই বইয়ের কিছু গল্প নিছক গল্প নয়। রাষ্ট্র, শাসকগোষ্ঠী কিংবা সময়ের ঘা খেয়ে ওঠে আসা ভিন্নধর্মী এক একটি প্রতিবাদ। শব্দ ফুঁড়ে যা বলতে চায় যা হচ্ছে ঠিক হচ্ছে না- ‘বড়ো অন্যায় হচ্ছে।’ কিন্তু সেই প্রতিবাদও খুববেশি উচ্চকিত নয়। মারমার কাটকাটের হুল্লোড় নেই তাতে। বড় মোলায়েম ভাষায়, কল্যাণময় এক আশাবাদ আর মমতা নিয়ে কুলদার গল্পেরা উপস্হিত হয়েছে। সেগুলো পড়তে পড়তে গায়ে যেমন কাঁটা দেয়, সময়ে কিছু গল্প পাঠকের চোখ ভরে জলও আনে। গল্পগুলো পাঠ শেষে পাঠক মনে দ্রোহের জন্ম হয়, বিপন্ন বিস্ময়ে ‘মানুষ বড় কষ্টে আছে’র মর্মবেদনা হাহাকার তোলে। পাঠকমনে চলমান আনন্দ-বেদনার অনুভূতিকে লেখকের প্রতি পাঠকের কুর্নিশ ধরে নেওয়া যায়। যে সুচিত্রা সেন কিডন্যাপ হয়েছিলেন বইটির গল্পগুলো সম্পূর্ণ আউটসাইড দ্য বক্স ধাঁচের গল্প। দু একটি গল্পের বিস্তার সংক্ষিপ্তের সুযোগ ছিল। কুলদা রায়ের গল্পপাঠের অভিজ্ঞতা থেকে এমন ধারণা জন্মেছে তিনি শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় ঘরানার লেখক। যে কারণে ‘গল্প বুঝি শেষ’ এমন সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিয়ে তাঁর গল্প চলতে থাকে লেখকের উদ্দিষ্ট গন্তব্যে। মনে রাখা প্রয়োজন কুলদা রায় টি টোয়েন্টি ম্যাচের নন টেস্ট ম্যাচের নির্ভরযোগ্য মিডল অর্ডার ব্যাটস ম্যানের মতো কলম চালাতে ভালোবাসেন। পাঠককে তাড়াহুড়ো ছেড়ে হাতে সময় নিয়ে মনোযোগ সহকারে তাঁর গল্প পাঠের আয়োজনে বসতে হয়। হলফ করেই বলা যায় তাঁর অন্যান্য গল্পের মতো এ বইয়ের অধিকাংশ গল্প পাঠের পর পাঠক খানিকক্ষণের জন্য হলেও স্তব্ধ হবেন।

ঋণ স্বীকার: অমিতাভ চক্রবর্ত্তী

Facebook Comments

comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top