সুর ভুলে যেই ঘুরে বেড়াই: পর্ব ১ // চয়ন মল্লিক

আজি তোমায় আবার চাই শুনাবারে
যে কথা শুনায়েছি বারে বারে॥
আমার পরানে আজি যে বাণী উঠিছে বাজি
অবিরাম বর্ষণধারে॥
কারণ শুধায়ো না, অর্থ নাহি তার,
সুরের সঙ্কেত জাগে পুঞ্জিত বেদনার।
স্বপ্নে যে বাণী মনে মনে ধ্বনিয়া উঠে ক্ষণে ক্ষণে
কানে কানে গুঞ্জরিব তাই
বাদলের অন্ধকারে॥

দেবব্রত বিশ্বাসের কণ্ঠে গানটি: https://www.youtube.com/watch?v=vrU2t_Fklt0

বর্ষা মানেই রবীন্দ্রনাথ। বৃষ্টি আছে আর বাঙালী আপনমনে “আজি ঝরোঝরো” কি “বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল” গুণগুণ করে ওঠেনি, এমনটি খুব কম। এই গানটিও বর্ষার। বেহাগ রাগের উপর। রবিঠাকুর বেহাগের উপর যত অপূর্ব সব মন-কেমন-করা সুর তৈরী করেছেন, তেমনটি অন্য কোন রাগে পাওয়া যায় না। তাঁর কাছের লোকেরা বলে গেছেন বেহাগই ছিল তাঁর প্রিয় রাগ। এতটাই প্রিয় যে অনেকে তাঁর সৃষ্ট বিভিন্ন গানে বেহাগের মেজাজটি পেলেই তাকে বলেছেন “রবীন্দ্র-বেহাগ”।

সেই রবীন্দ্র-বেহাগের এই গানটি লেখার পেছনের ছোট্ট গল্পটি বলে নিই এই ফাঁকে। তখন কবির বয়স ৭৮। ১৯৩৯ সাল। শান্তিনিকেতনের ‘বর্ষামঙ্গল’ অনুষ্ঠানের তালিম চলছে। শৈলজারন্জন মজুমদার (শিক্ষক, গায়ক, এবং রবীন্দ্রনাথের বেশ কিছু গানের স্বরলিপিকার) কবির কাছে আবদার করলেন নতুন কিছু বর্ষার গানের। তৈরী হল “ওগো, সাঁওতালি ছেলে”। পরদিন এল আরো একটি নতুন গান—“বাদলদিনের প্রথম কদম ফুল”। তৃতীয় দিন ভোরে শৈলজারন্জন ছোট একটা চিরকুটে “বেহাগ” লিখে কবির লেখার টেবিলে রেখে এলেন। পেলেন এই গানটি। এমনি করে সেযাত্রা কবি লিখেছিলেন ১৬টি আনকোরা বর্ষার গান। (গল্পের তথ্যসূত্র- শৈলজারন্জন মজুমদার: ‘যাত্রাপথের আনন্দগান’)

বর্ষণধারার সাথে মিলে চলা এ গানের সুরের দিকে একটু তাকাই। গানের প্রথম ছত্রটি শুরু হয়েছে গভীর প্রেমানুভূতি মাখা অনুরোধের সুরে। মুদারার সা থেকে পা-তে মৃদুপায়ে চলতে চলতে “আবার” বলতে গিয়ে হঠাত একটু কড়ি মধ্যমের তীব্রতা এমন করে গিয়ে মনে লাগে যে সেই অনুরোধে “না” বলতে পারা যায় না। এরপর যেন পরাণসখার অনুমতি পেয়েই গানের সুর তার আসনটি পাতে তারার তীক্ষ্ণতায়। মুদারার পা থেকে শুরু করে তারার গা ছুঁয়ে নেমে আসা সুরের কোণে কোণে পাই সেই বাণীটি বলতে চাইবার আকুলতা; যে বাণীতে বেজে চলে অবিরাম বর্ষণধারা ঝরবার সুরটি।

পুরো গানটি একবারে গাওয়া হয় বলে, অর্থাৎ প্রথাগত নিয়মে গাওয়া হয় না বলে এ গানটিতে শাস্ত্রমতে সঞ্চারী না থাকলেও সুর দিয়ে সেই পার্থক্য রচে গেছেন কবি। সেই সুর যেন আমার প্রিয়’র কানে কানে মনের কথা বলবারই সুর। এ গানটি যখনই আমি পড়ি, কিংবা গাই—মনে হয়, এ যেন শুধু বর্ষার কথাই নয়। বলছে প্রিয়জনের কানে কানে বলে ফেলা সেই কথাটির কথাও। ‘অবিরাম বর্ষণধারে’ যে সুর সৃষ্টি করেছে বাইরের প্রকৃতি, সেই সুরের উপর কথা বসিয়ে চলেছে মন। সে কথার কোন কারণ নেই, সে গানের কোন অর্থ নেই। শুধু বাদলমেঘের বেদন যেন জেগে ওঠে সেই সুরে। যে কথাটি এতদিন ছিল মনের অতল কোণে, স্বপ্নের গহীন গোপনে—আজ “বাদলের অন্ধকারে” সেই কথাটি তার কানে কানে আবার বলবার সময় হয়েছে। সময় হয়েছে তাকে “যে কথা শুনায়েছি বারেবারে”, সে কথাটি আরও একবার বলবার।

সহজভাবে ভাবলে মনে হয় প্রতিদিনকার বলে ফেলা কথা পাশের মানুষটিকে আবার কেন বলব? বারবার শুনবই বা কেন? কিন্তু রবিকবি সেইখানেও আমার—আমাদের একদম ভেতরকার অনুভূতিটিকেই তুলে এনে যেন সুরে বসিয়ে দিয়েছেন। ভালোবাসবার যেমন কোনো দিনক্ষণ নেই, সেই কথাটি বলবারও তেমনি কোনো শেষ নেই। তাই “যে কথা শুনায়েছি বারে বারে”, সেই কথাটিই আরও অনেকবার তার কানে কানে বলতে চাইবার ব্যাকুলতাও কমে না চিরবিরহের এই জীবনে। আর তাই হয়ত কবি ঘনবর্ষার এমন গানেও গভীর প্রেমের ব্যঞ্জনা এনেছেন বেহাগের তানে।।

Facebook Comments

comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top