সিন্দাবাদের শহর: বদর শাকির আস সাইয়াব অনুবাদ: তুহিন খান

সিন্দাবাদের শহর: বদর শাকির আস সাইয়াব অনুবাদ: তুহিন খান

১.

খাদ্যহীন গোরে শুয়ে— ক্ষুধার্ত
বস্ত্রহীন বরফশয্যায়— উলঙ্গ
এই আমি, শীতের তীব্রতায় চিক্কুর দিয়া উঠি:
জাগায়ে তোল, হে বৃষ্টি
হাড়গোড়, তুষার আর ধুলাবালির এইসব বিছানা
জ্যান্ত কইরা তোল এই পাথরশয্যা
উপ্তবীজ অঙ্কুরিত কর, পাপড়ি মেলুক ফুলেরা
ঠাটা পইড়া ভস্ম হউক
ফসল মাড়াইয়ের এই বন্ধ্যা উঠান
শিকড়গুলি ছিন্নভিন্ন করে ঢুইকা পড় ভিতরে
আর তীব্র ঝাপটায় নোয়ায়ে দেও
বৃক্ষরাজির শাখা!

আহ, বৃষ্টি— তুমি আসলা!
তোমারে বরণ কইরা নিতে ভাইঙা পড়লো
আকাশ আর মেঘদল
পাথরগুলি চৌচির হয়ে
তোমার দানে উপচায়ে উঠলো
ঘোলা হয়ে গেলো ফোরাতের জল!
কবরগুলা চলতে লাগলো ধীরে ধীরে
লাশেরা কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়ালো
কঙ্কালগুলা চিল্লায়ে বলতে লাগলো—
‘মহান সেই প্রভু, যিনি এই খুনেবাদল ঝরাইতেছেন!’

আহারে বৃষ্টি!
নতুনভাবে আবার যদি ঘুমানো যাইত
হায়, আবার যদি মরা যাইত নতুন কইরা!
আমাদের ঘুমের ভিতরেই তো আছে
নবজাগরণের মুকুল
আমাদের মরণের তলেই লুকায়ে থাকে
নয়া যিন্দেগির দিশা!
হায়, প্রভু যদি আমাদের ফিরায়ে নিতেন
তার রহস্যঘন নিগুঢ় অন্তরে
পথ যদি আমাদের নিয়ে চলে যেত
তার সুদূর সূচনায়!

ল্যাজারুসরে কে জাগিয়েছিল, সেই গভীর ঘুম থেকে?
যেন সে বুঝতে পারে বিহান আর সাঁঝবেলার রহস্য
যেন তার হইতে থাকে গরম আর শীতের এহসাস
যেন তার ক্ষুধা পায়
যেন তার বুকে জ্বইলা ওঠে

গনগনে আগুনের ফোস্কাপড়া পিয়াস
যেন সে ভয় পায় মৃত্যুরে
আর গুণতে থাকে দ্রুত বয়ে চলা
ভারি মুহূর্তগুলি
যেন সে প্রশংসা করে ফালতু জিনিশপাতির

যেন সে, রক্তপাত করে!

কে আমাদের বারবার জীবন দেয়,
আমাদের ভয়গুলিরেও ফিরায়ে আনে বারবার?
আমাদের বসতভিটায় কে সেই মহাপ্রভু?
তার আগুন তো তাপ পায় আমাদের মোম থিকা
তার হিংসা তো বাঁইচা থাকে আমাদেরই চোখের জলে!

২.

এই কি তাইলে আদোনিস, এই ভয়াবহ শূন্যতা?
এই ম্লানিমা, এই খরা?
এইটাই কি আদোনিস? আলো কই?
কোথায় গোলাভরা ধান?
ভোঁতা কাঁচিতে ধান কাটতেছে না
ফুলেরা থমকায়েছে কুঁড়িতেই, ফুটতেছে না
কালো মাঠগুলায় পানি নাই!
এই তবে এত এত বছরের প্রতীক্ষার ফল?
এই পুরুষার্থের আর্তনাদ?
এই নারীদের চিৎকার?
আদোনিস, দ্যাখো বীরত্বের পরাজয়
মরণ, শেষমেশ মিসমার কইরা দিছে
তোমার সকল বাসনা!

আর তুমি আলগোছে তাকায়ে আছো ভবিষ্যতের দিকে
তোমার হাত খালি!
বজ্রমুঠি আর আলঅলা কাস্তে
—যার আঘাতে ষোল টুকরা হয় হাড়, আর ছিটকায়ে যায় খুন—
তেমন কাস্তে হাতে—
কখন তার জন্ম হবে?
কবে আমাদের জন্ম হবে?

৩.

সড়কে মাইয়েত সারি সারি
মড়কে ফসলের ধু ধু মাঠ
মরণ-শয্যায় প্রিয়জন
গৃহবন্দী এ জলঘাট!
পুকুর হাসফাঁস খরাতে
তাতার ছুটে আসে হন্যে
তাদের টকটকে তরবার
ঝরাছে রক্তের বন্যে

আমাগো সুরুজ ও সরঞ্জাম
রক্তদলা যেন বারকোষে
এতিম, আহারে, মুহাম্মাদ
জ্বলছে ইহাদের ধূপ-তুষে
তার লাশের ছাইয়ে গোধূলির
ম্লানিমা উঠতেছে ঝলসায়
রক্তে ভেসে গেছে তার হাত
রক্ত ঝরতেছে তার পায়!
তার চোখের পাপড়িতে পুড়ে
ভস্ম হয়েছেন ঈশ্বরে
মোহাম্মদ তোমায় আটকায়
রেখেছে মূর্খ হেরার ঘরে
দিনের আলোও মিলায়ে গেছে
তারে করেছে যেই বন্দী
অচিরে হয়তোবা ইরাকে
ঈসা হবেন ক্রুশবন্দী

কুকুরগুলা সব চাটতেছে
বোররাকের তাজা রক্ত!

৪.

বসন্ত
ও বসন্ত, কী হইলো তোমার?
তুমি আইলা— বাদল নাই
তুমি আইলা— ফুল নাই
তুমি আইলা— ফলও নাই
আইলা যেমন, গেলাও তেমন
মুচড়ে ফেলা জমাটবদ্ধ
রক্তপিণ্ড যেমন!

*

আমাগো গাঁয়ে গরম আইছে,
আন্ধার কালা মেঘ
দিনের বেলা থাকন লাগে
সজাগ, নিরাবেগ।
রাইতের বেলা জাইগা জাইগা
হাজার তারা গুনি
যতক্ষণ না ধানের শীষে
কাচির ফলা শুনি
গান গায়ে ধান কাটে চাষা
মাড়াই-উঠান ভরে।

গরিব-ভুখা ভাবে কি তখন
ফুলদেবি ইশতারে
মাইনশের কাছে ফিরায়ে দেবেন
আসামী সবারে?
ভাবে কি ভুখা ঈসা নবীর
মোজেজা কারামতে
পাথর গেছে সরে উনার
রওজা শরিফ হতে?
মরারে তিনি জ্যান্ত করবেন
কুষ্ঠ করবেন ভালো?
অন্ধচোখে হাত বুলাইয়া
ফিরায়ে দেবেন আলো?
কে নেকড়েদের মুক্ত করে
লোহার শিকল থেকে?
মেঘ থেকে কে ঝরান এত
রহমতেরই বারি
সেই বারিতেই লুকায়ে রাখেন
ব্যাপক মহামারী?

*

ঘরে ঘরে জন্ম নেয় মৃত্যু।
মাটির গর্ভ আর জলের ঔরস থেকে
জীবনের বিনাশ ঘটাইতে
জন্ম নেয় কাবিল।
ফলে, আন্ধার হইয়া ওঠে ভবিষ্যত।
নারীরা কসাইখানায় গর্ভপাত করে
মাড়াই-উঠানে নাচতে থাকে আগুনশিখা
আর ল্যাজারুসের আগেই
মরণ হয় ঈসার!
তারে ঘুমাইতে দাও
ডেকো না, কারণ—
ঈসা তারে ডাকে নাই!
কী চাও তোমরা? ফালি ফালি করে
তার মাংশ কেটে শুকায়ে
বেচতে চাও পাপীদের লোকালয়ে?
ফাঁদ, খুন আর মদের শহরে?
বুলেট আর নুড়ি পাথরের নগরে?
কপার হর্সম্যান, ব্রোঞ্জ হর্সম্যান*
হইছে স্থানচ্যুত
ফলে তাদের আকাশ ছেয়ে আছে ঘুমে
পায়ে পায়ে আগায়ে আসছে বিষন্নতা
শহরের পথেঘাটে ঘুরতেছে
মানব অশ্বারোহী
খুন করতেছে নারীদের
দোনলাগুলা দোলাইতেছে রক্তের ছিটায়
আর সদম্ভে ঘোষণা করছে স্বর্গীয় আইন!

৫.

যেন আবার ফিরা আসছে
প্রাচীরবেষ্টিত সেই পুরান ব্যবিলন!
ফিরা আসছে সেইসব বিশাল লোহার গম্বুজ
যেখানে বেজে উঠতো তীব্র ঘন্টাধ্বনি,
যেন গোঙায়ে উঠত গোরের নির্জনতা
আকাশরে মনে হত কোন কসাইখানার চত্বর!

সে শহরের ঝুলন্ত উদ্যানে ঝুলানো হইতেছে
ধারালো কুড়ালের ঘায়ে কর্তিত মস্তক
কাকেরা ঠোকরাচ্ছে তাদের চোখ
সূর্য হেলে গেছে পশ্চিমে,
ডালে ডালে ঝুলতে থাকা
তাদের খিযাবমাখা রঙিন চুলের আড়ালে!

*

এই ধ্বংসযজ্ঞপুরি? এই তবে আমার শহর?
নিহতের খুনে যার রক্তফলকে আছে লেখা—
‘দীর্ঘ হোক, পৃথিবীর সকল জীবন দীর্ঘ হোক’।
এই শহরে কি নাই প্রভু, পানি, মাঠের ফসল?
এই কি আমার দেশ, এই তবে আমার সাকিন?
সিংহফটকে ঝোলে তাতারের কোষবদ্ধ খঞ্জর?
সড়কে সড়কে যার পিপাসায় হাঁপায় সাহারা
যার দিকে একবার ফিরাও দেখে না বাঁকা চাঁদ!
এই কি আমার ভূমি? এই গোরস্থান? কঙ্কাল?
প্রতিটি ঘরেই যার দেখি শুধু আন্ধারের রূপ?
আলকাতরাগোলা খুন, হারায়েছে টকটকে রঙ
পুত্র যেন আমার চিনতে না পারে এই খুন!
এই কি আমার দেশ? আহত গম্বুজের দেশ
জুদাস যেখানে লাল জামা পরে এসেছে আবার
ছোট ভাইর দোলনায় বসাইছে শিকারি কুকুর
…ঘরে ঢুকে ছিঁড়ে খায় আমার বন্ধুদের লাশ!

*

আর গ্রামে
দেবী ইশতার মারা যাচ্ছেন, পিপাসায়।
তার কপালে নাই কোন ফুলচন্দন
তার হাতের ঝুড়ি
ফলের বদলে পাথরে ভর্তি
যা তিনি ছুঁড়তেছেন প্রতিটা নারীর গায়
আর—
সাগরতীরে পামগাছগুলির ডালে ডালে
কী এক করুণ রোদনধ্বনি!

* ‘কপার হর্সম্যান’ বা ‘ব্রোঞ্জ হর্সম্যান’ রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে অবস্থিত রাশিয়ান শাসক পিটার দ্য গ্রেটের একটা স্ট্যাচু, যা সম্রাজ্ঞী ক্যাথরিন দ্য গ্রেটের আদেশে নির্মিত হয়। স্ট্যাচুর এই নামকরণ করা হয় আলেক্সান্দার পুশকিনের বিখ্যাত একটা কবিতার নামানুসারে। এই স্ট্যাচু সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরের অন্যতম প্রধান সিম্বল।

~
বদর শাকির আস সাইয়াব ১৯২৬ সালের ২৪ ডিসেম্বর বসরার কাছাকাছি ‘যাইকুর’গ্রামে জন্ম নেন। শুধু ইরাকেরই না, আরবি ভাষার সর্বকালের সেরা কবিদের একজন হিশাবে তারে গণ্য করা হয়। তিনি আরবি কবিতায় ‘ফ্রি ভার্স মুভমেন্ট’ এবং ‘তাম্মুযি মুভমেন্ট’র অন্যতম প্রধান কবি।

বদর শাকির আস সাইয়াব আরবি ও ইংরাজি সাহিত্য নিয়া পড়াশোনা করেন। ১৯৪৮ সালে বাগদাদের ‘হায়ার টিচার্স ট্রেনিং কলেজ’ থেকে তিনি গ্রাজুয়েশন শেষ করেন। কিছুদিন শিক্ষকতা করার পর, ইরাকি কম্যুনিস্ট পার্টিতে যোগ দেওয়ার দায়ে তিনি চাকরিচ্যুত হন।

১৯৫২ সালের ইরাকি ইন্তেফাদায় বদর শাকির সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। সেই সময় একদল বিদ্রোহীর সাথে মিলা, ইউএস ইনফরমেশন সার্ভিসের অফিস ভাঙচুর করেন তিনি, একটা বিদ্যুতের খাম্বার উপর উইঠা আগের রাতে লেখা একটা বিদ্রোহী কবিতা পড়েন। অভ্যুত্থান শুরু হইতেই ইরাক সরকার কম্যুনিস্ট পার্টির মেম্বারদের ধর-পাকড় শুরু করে। বদর শাকির ‘আলি আরতিনক’ ছদ্মনামে ইরানে পালিয়ে যান। ১৯৫৩ সালে আবাদান থেকে কুয়েতের উদ্দেশ্যে রওনা দেন তিনি। তার এই দেশছাড়ার কাহিনী ‘ফারার’ (পলায়ন) নামক কবিতায় উনি লিখছেন।

১৯৫৪ সালে দেশে ফেরার পর তিনি কম্যুনিস্ট পার্টি ছাইড়া দেন এবং সিভিল সার্ভিসে চাকরি পান। তৎকালীন শাসক আব্দুল করিম কাসিমের সমালোচনা কইরা কবিতা লেখায়, পুনরায় তিনি চাকরি হারান। ১৯৫৯ সালের কিরকুক ম্যাসাকারের পরে বদর শাকির ইরাকি কম্যুনিস্ট পার্টির তীব্র সমালোচনা কইরা ‘আমি কম্যুনিস্ট ছিলাম’ নামে একটা সিরিজ কলাম লেখছিলেন। বদর প্রথমে কম্যুনিস্ট পার্টি করলেও, পরে আরব ন্যাশনালিস্টে পরিণত হন। তবে যেকোন সন্ত্রাসের প্রতিবাদ করতে তিনি কখনো দ্বিধা করেন নাই।

চল্লিশের দশকে ইওরোপের কলোনিগুলা ভাইঙা যাওয়া এবং নয়া নয়া জাতিরাষ্ট্রের উত্থানের প্রেক্ষিতে, পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের মত আরবেও সোশাল, পলিটিকাল ও কালচারাল ফেনোমেনা হিশাবে ‘মডার্নিজম’র গুরুত্ব বাড়তে থাকে। আরবি কবিতায় এর প্রভাব চল্লিশের দশকের শেষদিকে বেশ তীব্র হয়। এই সময় মিশরের ‘এপোলো গ্রুপ’র কবিরা (খলিল মুতরান ও অন্যান্য কবিগণ) আরবি কবিতার ক্ল্যাসিক কাসিদা ফর্মের বাইরে গিয়া, নতুন ধরনের কবিতা লেখার কোশেশ করতে থাকেন। ১৯৪৭ সালে প্রকাশিত লুইস আওয়াদের ‘প্লুটোল্যাণ্ড অ্যান্ড আদার পোয়েমস’ আরবি কবিতায় এক নতুন ধারার সূচনা করে। ব্যক্তিগতভাবে কোন কোন কবির কিছু কিছু কবিতায় ফ্রি ভার্সের এক্সপেরিমেন্ট থাকলেও, ফ্রি ভার্সকে আরবি কবিতায় জনপ্রিয় ও ডমিনেন্ট কইরা তোলার কাজটা শুরু করেন মূলত ইরাকের পাঁচ কবি— নাযিক আল মালাইকা, বদর শাকের আস সাইয়াব, আব্দুল ওয়াহাব আল বায়াতি, বুলান্দ আল হায়দারি ও শাযিল তাকাহ। চল্লিশের দশকের শেষদিক, এই কবিদের হাতেই, আরবি কবিতায় মডার্নিজমের সূচনা হয়।

গ্রাজুয়েশন শেষ করার আগেই ১৯৪৭ সালে বদর শাকের তার প্রথম কাব্য, ‘আযহার যাবিলাহ’ (বাসিফুল) প্রকাশ করেন। এই বইয়ে প্রকাশিত ‘হাল কানা হুব্বান’ (ওটা প্রেম ছিল?) নামের কবিতাটা আরবি ভাষায় ফ্রি ভার্স মুভমেন্টের পথ প্রদর্শক কবিতা হিশাবে গন্য (অবশ্য এই নিয়া লিটারারি ক্রিটিকদের মধ্যে মতভেদ আছে। অনেকেই মনে করেন, ১৯৪৭ সালে প্রকাশিত নাযিক আল মালাইকার ‘আল কলেরা’ প্রথম সফল ফ্রি ভার্স কবিতা)। বদর শাকিরের নিজের মতে অবশ্য, মিশরি কবি আলি আহমদ বাকাছিরই (১৯১০-১৯৬৯) এ ব্যাপারে প্রথম পথপ্রদর্শক।

বদর শাকির শুরুর দিকে রোমান্টিক ও কলাকৈবল্যবাদী হিশাবে পরিচিত হইলেও, পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে তাঁর কবিতায় রিয়ালিস্টিক অ্যাপ্রোচ ও রাজনীতি স্থান পাইতে থাকে। ১৯৫৪ সালে প্রকাশিত ‘আল মু’নিছ আল উমইয়া’ (অন্ধ বেশ্যা) কবিতাটিরে তার এই সাহিত্যাদর্শ পরিবর্তনের সূচনা হিশাবে ধরা হয়। নিজের ৭টা কাব্যের পাশাপাশি, লুই আঁরাগ, নাজিম হিকমত, এডিথ সিটওয়েল, টি এস এলিয়ট ইত্যাদি কবির কবিতা অনুবাদ করেন। তার কবিতায় টি এস এলিয়টের ‘ওয়েস্টল্যাণ্ড’র প্রভাব বেশ স্বীকৃত।

১৯৬০ সালে প্রকাশিত হয় বদর শাকির আস সাইয়াবের সবচে বিখ্যাত ও সেলিব্রেটেড বই ‘উনশুদাতুল মাতার’ (বৃষ্টির গান)। এই বইয়ের জন্যে, ১৯৬০ সালে সিরিয়ান কবি আদোনিস ও লেবানিজ কবি ইউসুফ আল খাল সম্পাদিত কবিতাপত্র ‘মাজাল্লাতুশ শি’র’-র পক্ষ থেকে তিনি পুরষ্কৃত হন। এই বইয়ে, বদর শাকির আরবভূমিরে একটা বন্ধ্যা ভূমি হিশাবে দেখছেন, এবং প্রাচীন মিথ, পৌরাণিক চরিত্র ও লোকগাঁথা অবলম্বনে, আরবভূমিতে এক ধরনের নবজাগরণের প্রত্যাশা করছেন, যার কেন্দ্রীয় চরিত্র হল ‘তাম্মুজ’ (আদোনিস) দেবতা। পরবর্তীতে তার এই বইয়ের বিপুল জনপ্রিয়তার ফলে, আরবি কবিতায় ‘তাম্মুজি মুভমেন্ট’ নামে আলাদা একটা ধারার সূচনা হয়।

‘উনশুদাতুল মাতর’ বিভিন্ন কারণেই আরবি কবিতায় একটা ঘটনা ছিল। কবিতায় মিথের ব্যবহারে শুরু থিকাই সিদ্ধহস্ত ছিলেন বদর শাকির। কিন্তু ‘উনশুদাতুল মাতার’-এ মিথ ও পুরাণের ব্যবহার, প্রয়োগকুশলতা এবং এরে মানবজীবনের আশা, আকাঙ্ক্ষা ও সংগ্রামের সাথে রিলেট করতে পারার যে বিপুল সাফল্য, তা বাঙলা কবিতার স্মরণীয় কাব্য ‘সোনালি কাবিন’র সাথে তুলনীয়। কবিতার প্রত্যেকটা শব্দ আর চিত্রকল্পে রক্তে আগুন ধরানো মেজাজ তৈরি করার এক অদ্ভুত কুশলতা ছিল এই কবির। ফিলিস্তিনের জাতীয় কবি, মাহমুদ দারবিশের উপর ইরাকি এই কবির প্রভাব ছিল সবচে বেশি।

বদর শাকির আস সাইয়াবের অন্যান্য কবিতার বইয়ের মধ্যে আছে— আ’য়াসির (ঝড়, ১৯৪৮), ‘আযহার ওয়া আসাতির’ (ফুল ও কিংবদন্তি, ১৯৫০), ‘ফাজরুস সালাম’ (শান্তির ভোর, ১৯৫১), ‘হুফফারুল কুবুর’ (গোরখোদক, ১৯৫২), আল আসলিহাতু ওয়াল আতফাল (অস্ত্র ও শিশুরা, ১৯৫৫) ইত্যাদি।

মাত্র ৩৮ বছর বেঁচে ছিলেন বদর শাকির আস সাইয়াব। ৩৮ বছরের এই স্বল্প সময়ে আরবি কবিতায় তিনি হয়ে আছেন চিরস্মরণীয়। শুধুমাত্র ইরাক না, গোটা আরবি ভাষার সর্বকালের সেরা কবিদের একজন ধরা হয় তারে। মৃত্যুর পরে দুই খণ্ডে তার কাব্যসমগ্র প্রকাশিত হয়, যথাক্রমে ১৯৭১ ও ১৯৭৪ সালে। ২০১৪ সালে রিয়াদ ইন্টারন্যাশনাল বুক ফেয়ারে, সৌদি সরকার বদর শাকির আস সাইয়াব ও মাহমুদ দারবিশের বেশকিছু বই ব্যান করে।

দারিদ্র‍্য, দ্রোহ আর কবিতা— এই ছিল বদর শাকির আস সাইয়াবের ৩৮ বছর বয়সী জীবনের সংক্ষিপ্ত পরিচয়। আরবি কবিতায় তার অবদান সম্পর্কে আরবি কবিতার ইতিহাস গবেষক ড. ঈসা বুল্লাতা বলেন, ‘আরবি কবিতা বদর শাকিরের পরে আর আগের মত থাকে নাই।’ ইরাক এই মহান কবিরে ভোলে নাই। বসরা শহরের প্রাণকেন্দ্রে, শাতিল আরবে, আজও ঋজু ভঙ্গিতে দাঁড়ায়ে আছে বদর শাকির আস সাইয়াবের স্ট্যাচু। নিজের ৩৮ তম জন্মদিনেই, ১৯৬৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর কুয়েতের আমিরি হসপিটালে এই মহান কবির মৃত্যু হয়।

Facebook Comments

comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top