একজন বিশ্বসভার কবি ও কবিতার মুক্তি প্রসঙ্গ II নাসিরুল ইসলাম

‘জীবন এক অপূর্ব দৃশ্য,

যা দেখে মানুষ

বাড়ি ফেরার কথা

ভুলে যায়।‘ (পাদটীকা)

যে কবি অনায়াসে,রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে,পরিত্যক্ত সিগারেটের প্যাকেট তুলে নিয়ে, সহচর বন্ধুর সাথে হাসতে হাসতে এমন কথা লিখে ফেলেন এবং লেখার এই-প্রক্রিয়াই যখন তাঁর সহজাত, নিত্যদিনের ব্যাপার হয়ে ওঠে, তখন তাঁকে বিশ্বসভার কবি অভিধা দিয়ে লেখা শুরু করলে বাড়াবাড়ি না-ও হতে পারে। ইয়েটসের উপর লেখা প্রবন্ধটির শুরুতে, ইংল্যান্ডের তৎকালীন আধুনিক কবিদের ইঙ্গিত করে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, এরা বিশ্বজগতের কবি নন, সাহিত্যজগতের কবি; তাঁর বলবার কথাটি এমন যে, ব্যথা হতে যখন কথা আসে না, কথা হতেই কথা আসে, তখন কথার কারুকার্য ক্রমশ জটিল ও নিপুণতর হয়ে উঠতে থাকে; আবেগ তখন প্রত্যক্ষ ও গভীরভাবে হৃদয়ের সামগ্রী না হওয়াতে সে সরল হয় না; সে নিজেকে নিজে বিশ্বাস করে না বলেই বলপূর্বক অতিশয়ের দিকে ছুটতে থাকে; নবীনতা তার পক্ষে সহজ নয় বলেই, নিজের অপূর্বতা প্রমাণের জন্য কেবলই তাকে অদ্ভুতের সন্ধানে ফিরতে হয়।

এ-কথা সত্যি, মানব সভ্যতার ইতিহাসে এখন পর্যন্ত শিল্প সাহিত্যের যে ইতিহাস মানুষ প্রামাণ্য বলে মেনে নিয়েছে, এবং যে ইতিহাসের সাথে মানুষ তার অন্বয় সাধন করেছে, সে ইতিহাস এক মহা-প্রপঞ্চের ইতিহাস। এবং ধীরে ধীরে তা আরও স্পষ্ট হচ্ছে। এবং এই প্রপঞ্চের যাঁতাকলে কত প্রতিভা নিজের শক্তির জায়গাটি স্থির করতে না পেরে প্রাণপাত করেছেন!

কবি নূরুল হক ষাটের দশক থেকে লেখালেখি শুরু করলেও তাঁর প্রথম বই বের হয় ২০০৭-এ, ‘সব আঘাত ছড়িয়ে পড়েছে রক্তদানায়’ । একটা দীর্ঘসময়। কবি তাঁর নির্জন সন্ন্যাসে ডুবে ছিলেন এতকাল! কবিতা লিখেছেন। কিন্তু বই বের করবার কোনও তাগিদ নেই। এ ব্যাপারটাও তাঁর কবিতার এবং কবিতা লেখার ধরনের সাথে যেন মিলে যায়। এবং এটা কোনও সচেতন প্রস্তুতি পর্বও নয়। সচেতন প্রস্তুতি পর্বও এক পোশাকি নাম, যেন একটা কোনও কাজের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে তোলা। কিন্তু কবির যাপিত জীবনের সমস্তটাই যখন কবিতার অনুষঙ্গ এবং কবিতার মধ্যে নিরন্তর নির্জন বাস এবং ব্যাপারটা আরও বিশেষ করে বললে, কবিতার বাইরে জীবনের আর সব রূপ তাঁর কাছে অনস্তিত্বমান, তখন প্রকাশের জন্য পোশাকি প্রস্তুতিপর্ব কবির কাছে এহো-বাহ্য বৈকি! কবি লিখলেন,

‘দেশটা এখন আমার কাছে ভীষণ ভারী লাগে।
এর জলধারা ভারী, গাছগাছালি ভারী
পালতোলা নৌকো ভারী, ঘরদরজাও ভারী
আর ভারী পাহাড়ের বুক।
আমি এ ভার বইতে পারি না।

যদি মাঠের দিকে যাও, দেখবে নীলছায়া ভারী।

পায়ের দাগ ভারী, দাঁড়-বাওয়া ভারী
চাষিমজুর ভারী, মাটি-ভঙ্গি ভারী
আর ভারী সমুদ্রের তল।
আমি এ ভার সইতে পারি না।

যদি ঘরের মধ্যে থাক, তবে বউ-শিশু ভারী।

স্বপ্ন-বোঝা ভারী, হারিয়ে আসা ভারী
সুখ-দুঃখ ভারী, জীবন মৃত্যু ভারী
আর ভারী মা-জননীর নাম।
আমি এ ভার টানতে পারি না। (ছায়া পাথর)

কবিতাটি প্রথম পড়েছিলাম নিরন্তর-এ। এটাই নূরুল হকের কবিতার সাথে আমার প্রথম পরিচয়। সেই থেকে কবিতাটি মনের মধ্যে রয়ে গিয়েছিল। একটা কবিতা যখন কোনোরকম ওকালতি ছাড়া পাঠকের মনে রয়ে যায়, এবং প্রতিবার অনাঘ্রাত ফুলের মতো তার কাছে ফিরে আসার অবচেতন তাগিদ তৈরি হয়, তাকে সার্থক কবিতা না-বলে যাই কী করে?

এই বইয়ের সমস্ত কবিতা জুড়েই এক করুণ জনপদের গভীরে লুকিয়ে থাকা হাহাকার মানবিক সৌন্দর্যে ভাস্বর হয়ে উঠেছে। তার আড়ালে প্রেম, তার আড়ালে জীবন ও জন্মের আর্তি। দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘একটি গাছের পদপ্রান্তে’। বইটার প্রকাশকাল ২০১০। এই কবিতার বইটিতে তিনি বিশেষ হয়ে প্রকাশিত হলেন। জগতের সমস্ত তুচ্ছ অচ্ছুৎ বস্তুকণা আমাদের চারপাশে যে পড়ে রয়েছে এক অপার মিস্টিক বেদনার ইঙ্গিত ছড়িয়ে, এই বইয়ের কবিতাগুলির মধ্যে তার ইশারা।

‘চলে এসেছে মেহমান

দুটি পাখি

এবং একটি পিঁপড়ে।’ (আমার সংসারের হালচাল)

অথবা,

‘ব্রহ্মান্ড হাসছে একটি

ফুলের মধ্যে,

হাসছে ঈশ্বর,
এই ফুল সেই তরবারি

যার একখন্ড চাওয়া

কেটে ফেলে সমস্ত সংসার।’ (তরবারি)

এরপর তাঁর আরও তিনটি বই বেরিয়েছে। যথাক্রমে, ‘মুক্তিযুদ্ধের অসমাপ্ত গল্প ও অন্যান্য কবিতা (২০১২)’ , ‘শাহবাগ থেকে মালোপাড়া (২০১৪)’, ‘এ জীবন খসড়া জীবন (২০১৫)।’

বর্তমান প্রবন্ধটি কবি নূরুল হকের কবিতার বইয়ের সমালোচনামূলক কোনও প্রবন্ধ নয়, তাই বইগুলো বিস্তারিত পরিচয় এখানে অদরকারি। প্রবন্ধটির উদ্দেশ্য, যে কবিতার সমাজে নূরুল হক অপঠিত থেকে যান এবং যে কবিতার সমাজ নূরুল হকের মতো কবিদের প্রকাশিত হবার পথ রুদ্ধ করে বসে থাকে, সেই সমাজের স্বরূপ সন্ধান। তার কার্যকরণের গভীর খুঁজে বের করা।

কবিতা লেখা কি একটা কাজ?

আর দশটা কাজ যেমন থাকে মানুষের, সংসার করা,আলু-পটল কেনা, ব্যবসার হিসাব রাখা, তেমনি কবিতা লেখাও কি একটা কাজের মধ্যে পড়ে?

সংশয়টা বোর্হেসের, বললেন, ‘ব্যাপারটা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে, যেন কবিতা লেখা একটা কাজ। একজন মানুষ ঘাড় গুঁজে দিনের পর দিন গ্রহ নক্ষত্র নিয়ে কাজ করে গেলেন,কিন্তু একবারের জন্যও গ্রহ নক্ষত্রের দিকে তাকালেন না।’

যাঁরা সাহিত্য সভার কবি তাঁদের ক্ষেত্রে এ প্রশ্নটা সহজেই তোলা যেত, যদি জীবনানন্দ দাশের একটা পোক্ত ব্যাখ্যা আমরা না পেতাম। ‘কবিতার কথা’য় তাঁর বক্তব্যের নানা দিক থেকে একটা ব্যাপার উঠে এল, যেহেতু কবি সকলেই নন, এবং যিনি কবি, তাঁর মানস গঠন যেহেতু বিশেষ, সেহেতু কবির মনে একটা বিষয়ের অভিঘাত যেভাবে তৈরি হবে, যিনি কবি নন তাঁর মধ্যে সেটা হবে না।

সুতরাং সাহিত্য সভার কবি যাঁরা, তাঁদের কবিতা যদি প্রত্যক্ষ আনন্দ বেদনা প্রেমের অনুভূতি থেকে জারিত না হয়ে শব্দের ওম থেকে জারিত হয়, বিশেষ পাপ নেই তাতে। কিন্তু সেটাই যখন একমাত্র কাম্য প্রবণতা হয়ে ওঠে, তখন বিশেষ ক্ষতির যে ব্যাপারটা সভ্যতার জন্য ঘটে, তা এই যে, সমাজে লালন, হাছন রাজাদের জন্ম নেবার পথটা অসহজ হয়ে পড়ে। মনে পোনা-মাছের-ঝাঁক-এসেছে জানান দিয়েই গান গেয়ে ওঠার যে-সহজ-আনন্দের পথ ছিল লালনের, সেটা রুদ্ধ হয়ে যায়।

আধুনিকতাবাদের প্রপঞ্চ শুধু অপ্রস্তুত এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকারই ক্ষতি করেনি, ক্ষতি খোদ ইউরোপের কম নয়। প্রকাশ করে বলি। যে-ভদ্রলোককে কেন্দ্র করে এবং যে-‘অমঙ্গল বোধের’ দোহাই পেড়ে এমন একটা বিশেষ কবিতার ধরন মহামারির মতো সারা পৃথিবীর কবিতাকে সংক্রমিত করে তুললো, তার এবং তার কোনোটাই স্বাভাবিক এবং সহজাত নয়।

যেমন করে রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘ইনফ্লুয়েঞ্জা আজ হাজার হাজার লোককে আক্রমণ করলেও বলব না, ইনফ্লুয়েঞ্জাটাই দেহের আধুনিক স্বভাব। এহো বাহ্য। ইনফ্লুয়েঞ্জাটার অন্তরালেই আছে সহজ দেহ স্বভাব।’ বোদলেয়ারের মনস্তত্ত্ব যে স্বাভাবিক ছিল না সে দাবী এখন আর অমূলক নয়। তাঁর অমঙ্গল বোধের বিষয়টা অনায়াস নয় মোটেও। রীতিমত স্বেচ্ছা-সাধনার ব্যাপার। রীতিমতো সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি এ-সাধনায় নেমেছিলেন। অমঙ্গল পৃথিবীর কোনো-কালের থেকে কোনো এক কালে বেশি বা কম ছিল কি-না, তা নেহাত এক কূট তর্কের বিষয়। এবং সে দাবী ধোপে টেকানোও কঠিন।

তো, এমন এক বিশেষ কবিতার জন্য তিনি ইতিহাসে বিশেষ হয়ে থাকলেই হয়ত পৃথিবীর জন্য মঙ্গল হতো। কিন্তু সেটাই একমাত্র হয়ে উঠল, এবং সেটাই একমাত্র হয়ে আছে। সংক্রামক হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার অপ্রস্তুত সমাজে। পরিতাপ সেখানে!

একটা সমাজ, যেখানে তাদের নিজস্ব জলবায়ু, জনপদ, তাদের জীবনধারণ, হাসি কান্না প্রেম বেদনার নিজস্ব রকমফের আছে, এবং তা গড়ে উঠেছে হাজার হাজার বছরের এক মানবিক সাধনার মধ্য দিয়ে; সেখানে মানুষের শব্দ-স্বর, গান-গায়কি, প্রকাশ, প্রাণ-প্রাচুর্য, সবই আলাদা এবং একেবারেই নিজস্ব, তাদের অর্থনীতির ধরনও একেবারেই আলাদা।

সে দেশের আধুনিকতার ধারণা সে দেশের মাটি থেকে তৈরি হবে সেটাই কাম্য। যেভাবে পারস্যে হয়েছে এবং সেখানে হাজার হাজার মহৎ কবির জন্ম হয়েছে। আফ্রিকায় আফ্রিক্যানিটি আন্দোলনের সাথে যাঁরা যুক্ত ছিলেন, সেঙ্ঘর সহ অন্যান্য আরও বড় কবিরা, তাঁরা সবাই ইউরোপ থেকে বেরিয়ে এসেছেন, এবং নিজেদের কবিতা লিখেছেন। ওঁরা বলতেন, যেসব বিষয় তাঁরা ভালোবাসতেন, সেসব বিষয় তাঁরা প্রকাশ্যে বলতে পারতেন না। সংশয় এবং সংকোচ মর্মে বিঁধে থাকত। ভালো বলতেন, যা তাঁদের বলতে বাধ্য করা হতো, শিখিয়ে দেয়া হতো।

৩.

জীবনান্দ দাশ যখন লিখলেন,
‘ফিরে এসো সুরঞ্জনা;
নক্ষত্রের রূপালি আগুন ভরা রাতে;’

আমাদের ভালোবাসা সংক্রমিত হলো। শুধু তাই নয়, বারবার এই শব্দবন্ধের কাছে ফিরে ফিরে যেতে হলো, এবং এই ফিরে-ফিরে-যাওয়া শব্দবন্ধের শক্তিকে ক্লিশে করে তুলতে পারলো না।

আবার রবীন্দ্রনাথ যখন বললেন,

‘বেলা বহে যায়,পালে
লাগে বায়—
সোনার তরণী কোথা
চলে যায়,…’

অথবা রুমি’র “The Garden Of Soul” থেকে যদি একটু পড়ি,

“Come back my soul,how much longer
will you linger in the garden of deceit?
I have sent you a hundred messages
I have shown you a hundred ways
either you never read them
or you ignore my advice
Come back my soul,don’t waste
time with cold hearted
they don’t know your worth,
Why do you seek water
when you are the stream?…”

এই দুটো কবিতাও আমাদের ভালোবাসাকে সংক্রমিত করলো, বার বার ফিরে যাবার টান তৈরি করে রাখলো। কিন্তু এই তিনটি কবিতা ভিন্ন-ভিন্ন ভাবে আমাদের কাছে অনির্বচনীয় হয়ে উঠেছে। ভিন্ন-ভিন্ন ভাবে আমাদের ভালোবাসাকে সংক্রমিত করেছে। প্রথম কবিতাটি যদি সোস্যুরের ভাষা-দর্শন অনুযায়ী বিচার করি, অর্থাৎ সব শব্দ ও তার অর্থই এক গভীর অনির্ণেয় সম্পর্কে জড়িয়ে আছে, এবং এই সম্পর্ক আর্বিট্যারি।

তবে দেখব, ‘নক্ষত্র, রূপালি, আগুন, ভরা, রাত’-এ সবই আমাদের কাছে অতি পরিচিত শব্দ। কবি তাকে সাজিয়ে তুললেন। এবং শব্দ হয়ে উঠল ব্রহ্মময়ী! শক্তিময়! কী অপরূপ দ্যুতিময়! কী অসামান্য কল্পনা-জাগানিয়া! প্রতিটি শব্দ নতুন করে প্রাণ পেল। নতুন অর্থ তৈরি হয়ে উঠল তার। এমনতর-কবিতায় আলাদা কোনও ইঙ্গিত না-থাকলেও, জীবনানন্দ দাশের কবিতার ভাবনা অনুযায়ী, তা আমাদের কল্পনার ও সৌন্দর্যবোধের পরিতৃপ্তি ঘটাচ্ছে।

কিন্ত এটা যখন মহৎ শক্তিমান, রূপ-তপস্বীর হাতে না-পড়ে আনাড়ি খোদাইকরের হাতে পড়ছে, তখন তা হয়ে উঠছে শব্দের জঞ্জাল। যেহেতু যেকোনও শব্দের সাথে যেকোনও শব্দ যুক্ত করে দেবার অধিকার তাঁর আছে, এবং আলাদাভাবে কবিতায় গভীর কোনও ইঙ্গিত সঞ্চারের দায় থেকেও তিনি মুক্ত, নতুন এই নৈরাজ্যের চরাচরে তিনি হয়ে উঠছেন একজন শব্দদানব। এবং শব্দের সাথে শব্দের এতসব বিয়ের আয়োজন অন্তে তাঁকে দেখাচ্ছে আত্মবিশ্বাসী, সদা-স্মিতহাসির সফল ঘটকের মতো। কিন্তু তাতে এ জগতে কার ক্ষতি? এ-প্রশ্ন করা যেতেই পারে। যেহেতু অসফল শব্দ-ঘটকের সংখ্যাই বেশি এবং তাঁদের উৎপাদনই বেশি পরিমাণে দৃশ্যমান, দ্বান্দ্বিকতার সূত্র অনুযায়ী, পরিমাণগত পরিবর্তন গুণগত পরিবর্তন নিয়ে আসছে বৈকি। এটাই হয়ে উঠছে কবিতার একমাত্র মার্গসাধনার পথ। অন্তত নতুন লিখিয়েরা তাই ভেবে নিচ্ছে। এভাবে চলছে এক অচ্ছেদ্য দুষ্টু-চক্র।

তলস্তয় তাঁর ‘What is art?’র শুরুতেই যে প্রশ্ন করেছিলেন, সে প্রশ্ন, বিশেষ করে, এখন, এসব কবিতার শব্দ-জঞ্জাল সম্পর্কে করা যায়,‘যে শিল্পের বেদীতে লক্ষ লক্ষ লোকের শ্রম, মানুষের জীবন, সর্বোপরি মানুষের পারস্পরিক ভালোবাসা সবই বিসর্জিত হয় সে শিল্পই ক্রমশ অস্পষ্টতর এবং মানুষের বুদ্ধির কাছে বিভ্রান্তিকর হয়ে উঠছে।’

এবং আরো বিশেষ করে বললে, প্লেটোর ‘Allegorical cave’এর সেই মানুষদের মতো একটা ছায়া-সত্যকে সত্য জেনে কাটিয়ে দিচ্ছে প্রজন্মের পর প্রজন্মের লিখিয়েরা। কত মহৎ প্রতিভার সীমাহীন অপচয়! ‘কী ফুল ঝরিল বিপুল অন্ধকারে!’ এবং ইতোমধ্যে আমরা জেনে গেছি, এই দুষ্টু-চক্র কীভাবে সভ্যতার এই সময় গ্রন্থিতে প্রধান স্থান অধিকার করে নিলো। এর পেছনে সমাজের পুঁজি-ব্যবস্থা কী গভীর ভাবেই না জড়িত!

এবার আমরা পরীক্ষা করে দেখব, রবীন্দ্রনাথ এবং রুমির লাইনগুলির শক্তি কোথায়? অর্থাৎ কোন বিশেষ কারণে ওঁদের লাইনগুলি অনির্বচনীয় হয়ে উঠলো। এই লাইনগুলি অনির্বচনীয় হয়ে ওঠার পেছনে, ঠিক শব্দের সজ্জাকে একমাত্র কারণ হিসাবে মেনে নেয়া যাচ্ছে না। রবীন্দ্রনাথের লাইনটার হাহাকার জেগে উঠছে ‘সোনার তরণী কোথা ভেসে যায়’ এই শব্দ-বন্ধে এসে। কেন? বা রুমির লাইনগুলি থেকে যদি এসেন্সটা বের করে আনি,তবে দেখা যাবে, রুমি কী প্রত্যক্ষ বিশ্বাসে নিজের ভেতরের গভীরতম সত্ত্বা, যে সত্ত্বা তাঁর সবচেয়ে গভীর আনন্দের উৎস, যে সত্ত্বার দর্শন অদর্শন সমস্তের প্রতি তার ব্যাকুলতা, যেখানে তাঁর মুক্তি, অথচ এই কেজো ছেদো পৃথিবীর বিবর্ণমুখ তাকে অদৃশ্য করে রেখেছে, তাঁকে ফিরে আসতে বলছেন,বলছেন এই প্রতারণার বাগান থেকে তাঁকে ফিরে আসতে, বলছেন, কেন তিনি জল খুঁজে বেড়াচ্ছেন, যেখানে তিনি নিজেই একটা প্রকাণ্ড জলাধার!

কারণটা ব্যাখ্যা করবার আগে, জিজ্ঞেস করি, কেন পৃথিবীতে,কবিতার ঊষালগ্ন থেকে যদি ধরি, কিছু কবিতা সেই হাজার হাজার বছর আগে লিখিত হওয়া সত্ত্বেও মহাকাল এত যত্ন করে পাঠকের শিথানে রেখে দিয়েছে, আর কিছু কবিতা একটা নির্দিষ্ট সময়কে শাসন করবার পর হারিয়ে গেছে পাঠকের অনাগ্রহের আড়ালে। এবং, ধরা যাক, একজন কট্টর ক্লাসিকপন্থী কবিও যখন রবীন্দ্রনাথের হাজার বার শোনা কোনো গান শুনছেন, তখনও কেন আটকে গেলেন মুহূর্তের জালে; এবং তিনি, চেতনে অবচেতনে, কোনো ভাবেই কেন বিবেচনায় আনছেন না এটা রোম্যান্টিক কি মিস্টিক? এর কারণ খুঁজতে আমাদের যেতে হবে মানব চৈতন্যের গভীরে। মানুষ সদা-যুক্তিবোধ দ্বারা তাড়িত কোনো প্রাণি নয়, তার চৈতন্যে নানা ধরনের বিপরীতের সমাহার। তিনি একমনে ক্লাসিক,অন্যমনে রোম্যান্টিক, অথবা মিস্টিক, একদিকে তিনি যৌক্তিক, অন্যদিকে তিনি একই সাথে যুক্তির বাইরে আরও এক অতীন্দ্রিয় মরমি জগতের বাসিন্দা।

হয়ত কারো মধ্যে কোনোটা প্রবল, কারো মধ্যে কোনোটা প্রচ্ছন্ন। এবং রোম্যান্টিক, ক্লাসিক-এই শ্রেণি বিভাজনের সোশ্যাল ও রাজনৈতিক কন্টেক্সট একটা আছে বৈকি, কিন্তু বাস্তবতা এই যে,ওয়াল্টার পিটার যেভাবে বললেন, ‘রোম্যান্টিসিজম কোনো বিশেষ যুগের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটা একটা বিশেষ ধরনের প্রবণতা মাত্র যেটা সব যুগেই কিছু কিছু দেখা যায়।’

আমরা যদি ইয়েটসের পরিণত কবিতাগুলি লক্ষ্য করি, তবে দেখব, সেগুলোও রোম্যান্টিক নন্দনের ওম থেকে জাত। হালে,এলিয়টের ‘Waste land’ এর মধ্যেও অনেকে রোম্যান্টিসিজমের ছায়া আবিস্কার করেছেন। যাঁরা দাবি করেন ১৯২২ সালেই রোম্যান্টিক ধারার কবিতার মৃত্যু ঘটে গেছে তাঁদের এ ধারণাটাই এক ধরনের রোম্যান্টিক ধারণা।

এলিয়ট তাঁর ‘Tradition and the individual talent’ এ আমাদের জানান, কবিতা তাঁর কাছে আবেগের বাঁধন আলগা করা নয়, বরং আবেগ থেকে মুক্তি। এলিয়টের এই ধারণার সাথে মানব চৈতন্যের গভীর মনস্তত্ত্বের এক সুস্পষ্ট বিরোধ আছে। আমরা যে পরীক্ষায় নেমেছিলাম, উপরোক্ত শব্দ-বন্ধ কীভাবে আমাদের ভালোবাসাকে সংক্রমিত করল, তা নিয়ে। উপরোক্ত শব্দ-বন্ধ, চেতনে অবচেতনে,আমাদেরকে এক মিস্টিক জগতে নিয়ে ছেড়ে দেয়। যেখানে আমরা মূক বিবশ হয়ে পড়ি। এই মিস্টিক জগত ধর্ম অধর্মের বাইরের জগত। যেখানে মানুষ অন্তর্জগতে লীন হয়ে মুক্তি পায়।

৪.

এই সমস্ত জগতের গভীরে যে ইঙ্গিত, বয়ে চলেছে ক্ষুদ্র থেকে বৃহতের দিকে,তার সুরটা মূলত মিস্টিক। একথা সত্যি, জগতের সৃষ্টি বিলয় সব কিছুই আশ্রয় করে আছে দুঃখের পানপাত্রে। তার শুরুতে অন্তে সমস্ত ব্যাপারটা মধ্যেই এক মহা ট্র্যাজিক সিম্ফনি বেজে চলছে নিরন্তর। সব আনন্দেরই লেজবিন্দুতে থাকে দুঃখ।

‘কোথায় ব্যথা নেই এ-পৃথিবীতে!’ (জীবনানন্দ দাশ)

কিন্তু ক্লাসিকদের সাথে মিস্টিকদের অন্যতম পার্থক্য, মনে হয়, দুঃখকে দেখবার ও গ্রহণ করবার সত্যে নিহিত রয়েছে। মিস্টিকরা দুঃখকে দুঃখের বাইরে নয়, গভীরে নিয়ে যেয়ে এক অন্তর্হিত সত্যেও, আনন্দের মুখোমুখি করে দেয়। তাই সমস্ত জগত তাঁদের কাছে এক নির্নিমেষ আনন্দের ছায়া।

ক্লাসিকপন্থীরা দুঃখের এই সত্যকে গ্রহণ করেন প্রত্যক্ষভাবে। প্রত্যক্ষের শক্তি আছে, মূক ও বিবশ করে তোলার সামর্থ্য নেই। কিন্তু নির্নিমেষ ট্রমার মধ্যে মানুষের, সমস্ত সৃষ্টির, এই-সরল-স্বাভাবিক প্রাণ এই-যে এমনভাবে বয়ে চলছে,যার শুরু থেকে অন্ত অব্দি পাতা রয়েছে এক মহা প্রপঞ্চের ফাঁদ, তাকে নৈর্ব্যক্তিকভাবে, নিরাসক্তভাবে দেখার দায়টা যেমন জরুরি, তেমনি জরুরি আসক্তভাবে তাকে উপভোগের ও উদযাপনের। এই উদযাপন এ-কারণে নয় যে তাতে বেঁচে থাকাটা সহজ ও সহনীয় হয়ে ওঠে, সে উদযাপনের প্রধানতম দায়, জগতের সকল শব্দ ও বস্তুর আড়ালে দৃশ্যমান সত্যের বাইরে আরও এক সত্য বিদ্যমান। তা প্রকাশের মাধ্যম যে-ভাষা, তা শুধু সীমাবদ্ধই নয় । সোস্যুরের ভাষা-দর্শন অনুযায়ী তা, শব্দ ও অর্থের দিক থেকে এক গভীর অনির্ণেয় সম্পর্কে জড়িয়ে আছে,এবং এই সম্পর্ক আর্বিট্যারি।

সেটা অনুভবের মাধ্যম যে-আমাদের-চর্মচক্ষু তার সীমা শুধু নির্দিষ্টই নয়, আর তার-চেয়েও বেদনার ব্যাপার এই-যে, তা সর্বমানস-অগম্য। এই মিস্টিসিজম ধর্ম অনুষঙ্গের বাইরের মিস্টিসিজম,যেখানে সর্ববস্তুই যে-সত্যে বাঁধা পড়ে আছে, সেটা তার দৃশ্যমান অস্তিত্বকে উজিয়ে। জীবনান্দ দাশ লিখেছিলেন,‘খুব গভীরতম বিশ্বাস ও অবিশ্বাস দুইই আমাদের ক্ষতি করে গেছে। ’

নূরুল হকের কবিতা, সংসারে তুচ্ছ এবং অচ্ছুতের গভীরেও যে অমেয় মিস্টিক সুর বেজে চলছে নিরন্তর, তা দৃশ্যমান করে তোলে আমাদের চোখে, মননে। একটা পরিত্যক্ত ডাবের খোলাও একটা মিস্টিক ইঙ্গিত দিয়ে পড়ে থাকে আমাদের অদরকারের সংসারে। কে তার মর্মবস্তু শুষে নিয়েছে!

‘সবুজ সতেজ ডাব

পড়ে আছে

মুখোমুখি

মাঠের শয্যায়।
যেন কোনো আরদ্ধ জীবন

এইখানে

শেষ হয়ে গেছে,
যেন কেউ নির্জনে চুমুক দিয়ে
পান করে গেছে তার মর্মটুকু,
বেহেশতি শরাব। ’ (ডাব)

এই যে ক্ষুদ্র তুচ্ছ অচ্ছুৎ বস্তুসমূহ, যা আমাদের চারপাশের, আমাদের সমস্ত জীবনকে জেনে না জেনে এক গভীর ইঙ্গিত নিয়ে পড়ে আছে চারপাশে,কবি-মানস ছাড়া আর কে তার সুন্দরকে, তার বেদনাকে আমাদের মাঝে সংক্রমিত করবার ক্ষমতা রাখে! শব্দগুলো যেমন অসুন্দর হয়ে পতিত প্রাণ থেকে কবির কাছে প্রার্থনা করে সুন্দর করে তোলবার জন্যে, তেমনি,এইসব অচ্ছুৎ জড়ও প্রাণ পাবার জন্যে,তাদের বেদনাকে গ্রন্থিত করবার জন্যে কবির দ্বারে এসে প্রার্থনা করে। একটা মৃত শালিখও, এই হাওয়ায়, পৃথিবীর কন্দরে কী এক গভীর বেদনা রেখে যায়!

‘যেতে যেতে দেখলাম

পথের ধারে পড়ে আছে

একটি শালিখের ছানা।
মৃত।
শরীর তার এত লন্ডভন্ড

এবং এত সর্বস্বান্ত

এবং এত পোকা মাকড়ের আক্রমণে ভরা
যে,
জীবনের সাজসজ্জা বলতে

ছিটেফোঁটাও

আর নেই।

কে জানবে আর কে-ই বা বুঝবে
কোন ক্ষতি হয়ে গেল

এ-জগতে,

কোনখানে,
কার? (সর্বনাশের অভিসার)

সামান্য খড়কুটো, কত তুচ্ছ, অনুচ্চ স্বরে পৃথিবীর এই মগ্ন গহন সুরের মধ্য পড়ে থাকে,সংসারে তার অপেক্ষা বিলয়ের ডাক পড়বার অপেক্ষা,আর কিছু নয়।পাখির ঠোঁটে সে যখন স্থান করে নিল, তখন কি তুচ্ছ জড়ের মধ্যে বৃহত কোনো প্রাণের ইংগিত খেলে গেল, নাহলে কবি কেমন করে আমাদের পৌঁছে দিলেন এমন এক মরমী জিজ্ঞাসায়,

‘হায়,বাসা বাঁধবে–

এরই জন্য নিয়ে যাচ্ছে

এক টুকরো খড়।

মলিন

ছোট্র

নোংরা।
কী হয় এ বাসা বেঁধে,

কে বলতে পারে? ’… (বাবুই)

 

সব তরঙ্গ, সব জল, সব ধুলোবালি হাওয়ার স্রোত,কোন গোপন রহস্যের উদ্দেশ্যে ছুটে চলছে নিরন্তর

‘এত যে দিন চলে গেল

পাখি হয়ে

সুদূরে,
এত আকাশ খোলা হলো

উচ্ছ্বাসে,

এত যে রোদ পাতা হলো
দিগন্তে,

কী লক্ষ্যে?(কী লক্ষ্যে?)

অথবা আমাদের সেই অগম রাত্রিগুলির কথা,

‘রাত কাত হয়ে গেছে একদিকে
আমি হামাগুড়ি দিয়ে খুঁজছি

ভোরবেলার পথ।’ (ক্রান্তি)

একটি ডালে উবু হয়ে পড়ে থাকার মধ্যেও মরমি সুর শুনতে পেলেন কবি,

‘যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত সৈনিকের মতো

পড়ে আছে

একটি ডাল।

উবু হয়ে।
মনে হচ্ছে ফুসফুস এখনো নড়ছে।’ (একটি ডাল)

অথবা এক বিন্দু শিশিরের কথাই ধরা যাক,এই বিশ্বসংসারে, সূর্যে, অনন্তে মেলে রাখা তার ইশারা অকিঞ্চিৎকর নয় মোটেও,

‘তাকিয়ে দেখলাম

এক ফোঁটা শিশির

কোলের মধ্য গ্রহণ করে ফেলেছে সূর্যকে।
তাকে জামাই করে

নামিয়ে এনেছে

মৃত্তিকায়।’ (জামাই)

 

একটি বিনম্র ভোর কী সুন্দর! কী অপূর্ব উপহার!

‘ ভোরবেলাটা আমার শাকভাত,

প্রতিদিন পাই

গরিবের ঘরে। ’ (শাকভাত)

একটি গাঙচিল উড়ে আসে। তার উড়ে আসার আকাশ জুড়ে কীসের সংবেদনা ছড়িয়ে পড়ে,অনন্তে!

‘কোন পরবাসী এসেছ,আহা,

দূরের ঝিনুক নিয়ে,…..’ (গাঙচিল)

নিজের সাথে নিজের দেখা হবার কালে, যে সংশয় আমাদের চিরকালের হয়ে ওঠে,সামান্য বসে থাকার মধ্যেও তার ইংগিত পেলেন কবি,

‘বসেছিলাম পার্কে

রোদে ও ছায়ায়

কে বসেছিল কে জানে!’ (কে জানে)

অপাংক্তেয় সব দৃশ্যাবলীও, প্রতিদিনের এই বেঁচে থাকার জীবনে, কত অকিঞ্চিৎকর অভিঘাত রেখে যায়!

‘প্রপাতের মতো নেমে এল কাক।

কোন উচ্ছ্বল লক্ষের দিকে

উদ্যত এখন।
হায়! এক টুকরো ময়লা নিয়ে

উড়ে চলে গেল। ’ (কাক-পদ্ধতি)

 

আরেকটা উদাহরণ দিই,

‘ধুলোতে উড়িয়ে দিই

পোকার বাসরঘর

উস্কে দিই ক’টি ঝরাপাতা
তা-ও যদি নিয়ে যায়

গরিবের চিঠি

যুগান্তরে। ’ (ধুলোর ডাকঘর)

 

সামান্য ক’টি শব্দ যখন প্রকাশ করে আমাদের সত্ত্বার গভীরে সদা-ধ্বনিত হতে থাকা সেই অসামান্য জিজ্ঞাসা,

‘জীবন ও মৃত্যুর মাঝখানে

যে বস্তু ডুবে যায়

সে কি আমি? ’ (আমি)

অথবা স্বগতোক্তি,

‘শিউলি থোকার গন্ধের ভেতরস্থানে

যেতে চেয়ে আমি

একদিন পথ হারিয়েছিলাম
নিজের মধ্যে। ’ (একদিন)

 

‘হৃদয়ের চারপাশ ঘিরে
বিনি-পয়সায় জ্বলছে অন্ধকার
এ শরীর চুপচাপ জাগে। ’ (একাকিত্ব)

 

‘সমুদ্রের পিঁপড়ে আমি।

কলাপাতায় চড়ে

ভাসছে
আমার জীবন,

অনন্তের দিকে।’ (কলাপাতায় চড়ে)

‘একদিন এই নিশি-আঁকা পৃথিবীতে

চাঁদ উঠবে,

তাই গলাজলে

দাঁড়িয়ে রয়েছি আজীবন। ’ (গলাজলে)

কবিতার অনবদ্যতা নিয়ে জীবনানন্দ দাশের উত্তর যথার্থ। কবিতায় যা প্রকাশ করা যায় অন্য কোনোভাবে তা যেহেতু প্রকাশযোগ্য নয়, সুতরাং শিল্প হিসাবে কবিতা অনবদ্য। কবির দায় থাকতে পারে একটা কবিতাকে কবিতা করে তোলার দায়,দায় থাকতে পারে তাঁর কবিতা দিয়ে মানুষের ভালোবাসাকে সংক্রমিত করবার, তাকে অনির্বচনীয় করে তোলবার,শব্দ এবং স্বরের ব্যাপারে সময়ের ক্লিশেগুলি থেকে বেরিয়ে আসার,কিন্ত তাঁকে কেন আধুনিক হবার দায় বহন করতে হবে? কেন তাঁকে পশ্চিমের এই তকমাবাজির পিছে ছুটতে হবে? কেন তাঁকে তত্ত্বের অনুগামী হয়ে অধ্যাপকের গবেষণার টেবিলে মালার্মের কবিতার মতো মৃতপ্রাণ কবিতা হিসাবে টিকে থাকার রাজনীতি করতে হবে?

৫.

কেন কবিতার এই বিশেষ প্রবণতাটি প্রধান হয়ে উঠল, তার উত্তর আমাদের খুঁজতে হবে, আধুনিকতার সাথে যে বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতি এক গভীর অন্বয়ে বাঁধা পড়ে আছে, সেখানে। আধুনিকতার এই তথাকথিত প্রবণতার লক্ষ্য আর কর্পোরেট পুঁজির লক্ষ্য অভিন্ন। দুটোই অর্জন করতে চায়, সংস্কৃতির সব বৈচিত্র্যের বিলোপ করে দিয়ে, সর্বোচ্চ সাধারণ এক-রঙা সংস্কৃতি। পৃথিবীর এতসব বিচিত্র জাতিগোষ্ঠী-এতসব বিপুল বিস্ময়কর সংস্কৃতি, সংগীত, সুর আর আনন্দ নিয়ে যারা তাদের মতো করে সুন্দর হয়ে ছিল, কর্পোরেট পুঁজি সেখানে যেয়ে তাদেরকে হীনম্মন্য করে তুললো। তারা তাদের-সুন্দরকে লুকিয়ে রেখে শেখানো-সুন্দরকে সুন্দর বলতে শিখল। পৃথিবীর মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে থাকল অযুত অযুত বিস্ময়কর বৈচিত্র্য-কি ভাষায়, কি কবিতায়, কি সংস্কৃতিতে-সর্বত্র।

পারস্যের কবিরা কবিতা বলতে বুঝেছিলেন, ‘কিভাবে বলা হচ্ছে,কী বলা হচ্ছে,এবং তা মানুষকে খুব গভীরে কোথায়ও যুক্ত করছে কি-না। ’ এবং পারস্যে এই যে হাজার হাজার মহৎ কবির জন্ম এবং তাঁদের মহত্তম কবি এবং কবিতার সংখ্যা এত বিপুল, সেখানে কোনও জাতীয় কবির ধারণাই তৈরি হতে পারল না। এবং গ্যেটে থেকে শুরু করে পাউলো কোহেলো পর্যন্ত ঋণ স্বীকার করেছেন পারস্যের কবি ও কবিতার কাছে। পূর্ব য়ুরোপ,তুরস্ক,আলবেনিয়ার অনেক বড় বড় কবিদের ওপর ছিল তাঁদের প্রত্যক্ষ প্রভাব।

আর ভারত উপমহাদেশের গালিব, ইকবালের উপর পারস্যের প্রভাব তো সর্বজনবিদিত। হোমারের ইলিয়াড ওডেসি’র দু’য়ে মিলে যে আয়তন, ফেরদৌসের শাহনামা তার তিনগুণ বড় এবং উপস্থাাপনায় ঢের আকর্ষক। ও রুমি’র ‘মসনবি’ কবিতার ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া বই।

হাফিজের ‘ডিভান (কবিতার বই)’ ছিল গ্যেটের কাছে ‘পবিত্র গ্রন্থ’। সাদির ‘গুলিস্তাঁ এবং বুস্তাঁ’ ছিল সর্বজন পাঠ্য। এবং এ প্রশ্ন অনেকেই করে গেছেন, নিজামি’র ‘শিরি ফরহাদ’ কেন ‘রোমিও জুলিয়েট’ থেকে মহত্তর নয় ?

আরবি এবং ফার্সি কবিতার এতসব প্রাচুর্য বাদ দিয়ে আমরা যদি শুধুমাত্র আঙ্গিকটাও দেখি, কত বিচিত্র আর অসামান্য আঙ্গিক সেখানে! হাজার বছর ধরে মানুষ তন্নিবিষ্ট হয়ে ছিল সেসব আঙ্গিকে। রুবাই, কাসিদা, গজল, মসনবি, কিতা, বিনো রাইম, মুখাম্মাস এবং আরও অনেক উজ্জ্বল ধরন ছিল কবিতার। রুবাই ছিল চার লাইনের কবিতা। প্রথম তিন লাইন হচ্ছে চতুর্থ লাইনের প্রস্তুতি।

চতুর্থ লাইনটাতে থাকত জীবনের কোনো এক বিস্ময়ের সাথে মানুষকে যুক্ত করে দেবার লাইন। চিনের কবিতার ইতিহাস আরও সুপ্রাচীন। খ্রিষ্টের জন্মের কত শত বছর আগে থেকে ওদের ওরাল ট্র্যাডিশন শুরু! আজকের দুর্দৈবের কালে যে বিষয়টা মানুষের প্রধান মনোযোগ পাবার কথা, চিনের প্রাচীন কবিরা তাকেই তাঁদের কাব্যসাধনায় ধ্যানের বিষয় করে তুলেছিলেন।

তাঁরা এই মহাবিশ্ব, মানুষের চৈতন্য এবং ভাষার মধ্যে এক অখণ্ড ঐক্যের সুর খুঁজে পেয়েছিলেন। ধ্যান যেমন মানুষের আত্মদর্শন ঘটায়, একটা সার্থক কবিতার পাঠও মানুষকে আয়নায় দাঁড় করিয়ে দেয়, যেখানে নিজের সাথে নিজের সত্যিকারের এক যোগ তৈরি হয়, এই ছিল তাঁদের কবিতার নন্দন।

আফ্রিকার কবিতার আদলটা ছিল পশ্চিম থেকে একেবারেই আলাদা । আফ্রিকানরা শিল্প বলতে, পশ্চিমের মতো, প্রকৃতির অনুকৃতিকে বোঝেননি। তাঁরা বুঝেছিলেন, জগতের গভীরে যে সত্য রয়েছে, তার সাথে শিল্পীর সংবেদনার প্রত্যক্ষ যোগ, এবং তার মধ্যে দিয়ে জগতকে বুঝে ওঠা এবং ব্যাখ্যা করা। এবং দেখা যায়,আফ্রিকার পরাবাস্তববাদ ইউরোপের পরাবাস্তববাদ থেকে আলাদা, অনেকটা আরবি ফার্সি সাহিত্যের মিষ্টিসিজমের মতো। সেঙ্ঘর বললেন, ‘ইউরোপের সুররিয়ালিজম হচ্ছে অভিজ্ঞতাবাদের সুররিয়ালিজম, আফ্রিকার সুররিয়ালিজম মিস্টিক।’

তাঁদের কবিতার মধ্যে ছিল এক আশ্চর্য সংগীতময়তা! যেমন ছিল তিরিশ-পূর্ব বাংলা কবিতায়। সেক্সর বলতে চাইলেন, একটা কবিতা তখনই সম্পূর্ণ হয়ে ওঠে, যখন, একাধারে, কবিতাটি সংগীত, বাণী এবং সুরের ব্যঞ্জনা তৈরি করতে সক্ষম হয়। ইউরোপ প্রভাবিত আধুনিক কবিতাকে তিনি এন্টি-পোয়েম হিসাবে ঘোষণা করলেন। তিনি বললেন,‘কবিতাকে তার উৎসে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে,যখন কবিতা গীত হতো এবং মানুষ তার সাথে নাচত; যেমনটা দেখা গেছে গ্রিসে, ইসরায়েলে, ফারাওদের মিশরে এবং আমাদের আফ্রিকায়।’ এবং আফ্রিকাতে কবিতার ব্যাপারে সবচেয়ে প্রচলিত বক্তব্যটা ছিল এমন, ‘যে বাণী-বন্ধ হৃদয় এবং কর্ণকে আনন্দিত করে, তা-ই কবিতা।’

আর লাতিন আমেরিকার কবিতা তো সুঘ্রাণে ভরা এক রক্তজবার বাগান, যে-জবা কণ্টকাকীর্ণ। একটা মহাদেশের দেশগুলোর সীমারেখার যখন ভারচুয়াল বিলুপ্তি ঘটে শুধু একারণে যে, সেখানকার সব মানুষ প্রজন্মের পর প্রজন্ম অকহতব্য শ্রীহীন রক্তাক্ত এক অপমানের জীবন বয়ে চলেছে, তার যোগসূত্র ধরে, তখন সেখানকার কবিতা ও কবিতার নন্দন যে, দেশের সীমা ছাড়িয়ে, মহাদেশের সীমা ছাড়িয়ে,পৃথিবীর সমস্ত মানুষের কবিতা হয়ে উঠবে, সেটা মোটেও বিস্ময়কর নয়। যেমন হয়ে উঠেছে ওদের কথাসাহিত্য। আর লাতিন আমেরিকার কবিতা হয়ে উঠেছে,খনি শ্রমিক থেকে শুরু করে রাস্তায় দাঁড়িয়ে শসা ফেরি করা ছেলেটির মুখের গান। সারাক্ষণ গাইবার গান। এমনও হয়েছে,ফুয়েন্তেসের এক অভিজ্ঞতা থেকে জানা যায়, খনি শ্রমিকরা কাজ শেষে গোল হয়ে বসে যে গান গাইছে, সে-গান পাবলো নেরুদার গান অথচ তারা জানেই না এ-গান কেউ লিখতে পারে। তারা জানে এ-গান তাদের গান। এ-গান তারাই গায়। এর বাইরে রয়েছে সেইসব আদিবাসী বা বেদুইনদের গান, যেখানে সভ্যতার আলো তারা স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় স্তিমিত করে রেখে নিজেদের গান গেয়ে চলছে, সে’সব কত বিপুল, বিচিত্র এবং অনবদ্য!’

এই-যে এত বিপুল বিচিত্র কবিতা ও তার নন্দন,সারা বিশ্বব্যাপী এত উজ্জ্বল এত দ্যুতিময় হয়ে মানুষকে, তার বেঁচে থাকাকে,তার সীমাহীন বেদনার জীবনকে, অপার আনন্দের জীবনকে, অপমান ও নিরানন্দের জীবনকে এক গভীর বিস্ময়ের সাথে যুক্ত করে রেখেছে, সেখান থেকে যদি ক্ষমতা ও পুঁজির রাজনীতির কারণে ইতিহাসের কোন এক বিশেষ অঞ্চলের বিশেষ কবিতার লক্ষণ সারা বিশ্বময় এক বিশেষ তকমার আড়ালে পড়ে প্রধান হয়ে ওঠে এবং বিশ্ব-শাসন করতে থাকে, তবে,নিশ্চিত করে বলা যায়,তাতে করে সমস্ত পৃথিবী শুধু যে এক অপরিমেয় ক্ষতির সম্মুখীন হয় তাই নয়, সত্যিকারের কবি-প্রাণ প্রকাশিত হবার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। নূরুল হকের মতো বিশ্বসভার কবিরা সে-সমাজে থেকে যায় অপঠিত। নতুন কোনো লালন, হাসন রাজার জন্ম লাভের সম্ভাবনা হয়ে ওঠে শূন্য।

কবিতার বিস্তীর্ণ প্রান্তর ভরে ওঠে শব্দের জঞ্জালে। জাতকের সেই বিখ্যাত গল্পটা উলটো করে তখন লিখতে হয়, একদিন এক পাহাড়ে অনেক ধরনের পাখি বসে ছিল। সূর্যের আলোয় তাদের সবাইকে সোনালী লাগছিল। তারা আলাদা করে, নিজের রঙে প্রকাশিত হবার তাগিদে পাহাড় ছেড়ে গেল উড়ে। এই ছিল জাতকের গল্প।

আমাদের বাস্তবতা এখন উলটো। এতসব বিচিত্র পাখি আকাশে উড়ছিল আনন্দে। তারা সবাই পাহাড়ের গায়ে লেগে থাকা সোনালী রঙ পাবার জন্য আকাশ ছেড়ে, নিজেদের রঙ ছেড়ে পাহাড়ে এসে বসল। সোনালি রঙে ঢাকা পড়ে গেল তাদের প্রত্যেকের নিজস্ব সুন্দর। শুরু হলো আকাশের দুঃখের দিন,পাখিদের দুঃখের দিন।

Facebook Comments

comments

৩ Replies to “একজন বিশ্বসভার কবি ও কবিতার মুক্তি প্রসঙ্গ II নাসিরুল ইসলাম”

  1. Hasnain Hira বলেছেন:

    চমৎকার লিখেছেন । একদম অনুপম কথাভাষ্য। একজন আড়ালে থাকা কবির চেতনাবিশ্ব উম্মোচন করেছেন সারল্যতায়, অথচ ভীষণ গভীর।

    1. নাসিরুল ইসলাম বলেছেন:

      অনেক ধন্যবাদ। প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানবেন।

  2. রেখা বলেছেন:

    চমৎকার সাবলীল লেখা। সহজ করে কবির কবিচেতনার উন্মেচন।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top