মায়া ঘাট ।। নাসিরুল ইসলাম

মায়া ঘাট

১.
বাবাকে আমরা মৃত্যুর আগেই পুরনো আসবাবের মতো ঘরের কোনে কাফনে মুড়ে রেখেছি। সে নীল সমুদ্রের শব্দ শুনিয়ে শিথানে সবুজ ঘুম রেখে যেত প্রতিদিন। আমরা কিছুই টের পেতাম না। শুধু তার রাশভারি শব্দগুলো অভিশাপের মতো কানে লেগে থাকত রাত্রিদিন।

শীতের সকালগুলো ছিল একান্তই সজনে ফুলের।বাবা সেখানে ভিখিরির মতো দাঁড়িয়ে থেকে আমাদের জন্য নিয়ে আসত একেকটি সার্থক গোলাপ। আমরা ভাবতাম বয়স বাড়লেই বুঝি এমন সব গোলাপ মেলে বিনে পয়সায়।
ভুল আমাদের ভাঙল বটে, তবে গোলাপ মিলল না।

গোলাপ কিনেছে যে মেয়েরা তারা আর ফেরেনি গাঁয়ে।

২.
বিষণ্ণ বোতাম, তুমি যেদিন অদৃশ্য হলে
মায়ের শীত-ঘুম-স্বপ্নে ,মায়ের
আঙুলের গভীর থেকে অদৃশ্য হলে যেদিন তুমি,
সেদিনই
আমার জ্বর এল শহর কাঁপিয়ে।
সেই থেকে আমার বুকে কোনো
মঙ্গল চিহ্ন নেই।

শীত নেমে আসে, সমস্ত
সকালজুড়ে ঝরে পড়ে সজনে ফুল,
মনে পড়ে, সেইসব বালকের মুঠো ভর্তি
কুয়াশার নদী, আর আমাদের তেপান্তর।
সমুদ্রের আহ্লাদে ভেসে আসা একাকী
করুণ ঝিনুকের মতো দাওয়ায় মায়ের
মুখখানা মনে পড়ে!
একটি
আলতো হাতের গভীরে সুঁইয়ের বিনয়—
কীরকম গভীর! কীরকম গভীর!

বিষণ্ণ বোতাম,
আমাদের শীত মানেই তুমি—আর
মায়ের আঙুলের ফাঁকে ফুটে ওঠা কুয়াশার ফুল।

ওপাশে পোড়ো ভিটের পরেই ছিল যাদুর শহর।
সেখানে পৌঁছে, আর কোনোদিন
তোমাকে দেখতে পেলাম না।

সেই থেকে আমার জ্বর। সেইথেকে
এ শহরের
সমস্ত শরীরজুড়ে করুণ কম্পন।

৩.
আমরা ফুল দেখতে চাইলে,মা কেবলই তার রক্তাক্ত হৃদয়খানা দেখাতেন ।আমরা সমুদ্রের কথা জিজ্ঞেস করলে,মা নিয়ে যেতেন তেপান্তরের মাঠে। সবাই জানতো, তার সন্তানেরা অভিশপ্ত। শুধু মা জানতো, ওরা ফুটে আছে নক্ষত্র হয়ে।

সবাই জানতো, আমার শহরে এই ঘুটে কুড়োনি দাসির নাম। কিন্ত আমরা জানতাম একটি সামান্য প্রজাপতি নীল গ্রহের অধিশ্বর হয়ে আছেন।
মা জন্ম বধির সেই সব দেবতাদের সেবা দাসী। লোহার বরফ চুম্বন করে রাত্রিদিন।আর,এই সাত নলতের সংসারে একটি মাত্র পীলসুজ ঘিরে উড়ে উড়ে কাটিয়ে দেন জন্ম জন্মান্তর।

৪.
আমাদের গাঁয়ে নিনতাল নদীর গভীরে আরো এক নদী ছিল।বাবা তার খোঁজে কাটিয়ে দিলেন একজীবন!
কেমন তাঁর অচল স্বভাব, একদিন, নদী ভেবে নেমে গেলেন সমুদ্রে। সমুদ্র দেবতারা তার ঘুম নিয়ে কটাক্ষ করলেন বলে তিনি ঘুমিয়ে গেলেন জলে। তারপর কেউ তাকে দেখেনি।কিন্ত আমরা ক’ভাই জানি, তিনি এতদিন ঘুমিয়ে ছিলেন, এখন জেগে আছেন সমুদ্রে।

৫.
সে বছর আমাদের উঠোনে কোনো কামিনি ফোটেনি , সে বছর বাবা ভুলে গেলেন বাড়ির পথ । দক্ষিণের দরজা অপ্রস্তুত। আমরা সাপ লুডু গুটিয়ে চেয়ে রইলাম এ-ওর দিকে। ও-পাশে কেউ নেই, তবু আমাদের কানজুড়ে বাবার কড়া-নাড়া। আমাদের উঠোনে যে পাখিদের নিমন্ত্রণ ছিল গত শীতে, তারা আর এল না। বিষ্টুর মা, যার কোনো নাম নেই নক্ষত্রে, সে-ও তার মস্ত চাঁদখানা বেচে গেল জলের দামে।
কুশই সূত্রধর পালিয়ে বাঁচল; পড়ে রইল তার অসমাপ্ত সোনার খাটিয়া, ক্ষণিকের কৃপায়। মা মনে মনে বললেন, ভাবনা কী? তার আছে
না-ফোঁটা কামিনি আর সাত সাতটি চম্পা!

নিরঞ্জন, প্রভু আমার, তুমি এই দূরগামী ঘোড়ার খুঁড়ের শব্দ কোনোদিন পৌঁছে দিওনা মায়ের কানে। সে জানুক তার সন্তানেরা ফুটে আছে চম্পা হয়ে।
৬.
হায়! শীতের শরীর থেকে কে খুলে নিল বাবার গায়ের শাল! তার শ্রীমন্ত মধুর মায়া। তুমি অশ্ব খুড়ের খেদ থেকে বানিয়েছিলে মায়াপুর, আজ কোনদিকে তোমার চৌতাল বাজে, বেহাগ বাজে, বলো, আমি নগরের সুগন্ধ ধুপের সন্ধ্যা ছেড়ে চলে যাব সেই নির্বাসনে। আমাকে ভৎসনা করো পাখি, পিঙ্গল পানিণি, আমাকে মৃত্যু দাও। আমি কোন সোনার রথ ছেড়ে পড়ে আছি ধুলোয়!

৭.
যেখানেই পা রাখো, সে আমার দেশ,
আমার ঘর;
ঘরের গভীরে হাজার মহল,
তার গভীরে —
নিযুত নিমগ্ন আমি।
কোথায় লুকাবে নদী?
কোথায় লুকাবে তার মায়া ঘাট?

যেখানেই পা রাখো,
সে আমার সবুজ দ্বীপ,
যতবার বধ করো সবুজ সারস,
নেমে আসে ডানা নিযুত হয়ে।

যেখানেই রাখো পা, সেখানেই
মায়া ঘাট, সেখানেই আমার নদী, নিরঞ্জনা।

৮.
সেইসব শীতের সকাল থেকে আমরা শুধুই স্বপ্ন কুড়োতাম। মা ভাবতো, আমাদের ডালা ভরে উঠছে দুপুরের সজনে ফুলে। আমাদের অসময়ের স্নানজুড়ে থাকত সবুজ রাজহাঁস, তার দুপুরগুলি।
মা ভাবত, আমরা বুঝি সবুজ দুপুরের সন্তান!

মায়ের কান্নাকে আমরা চিরকাল ভেবে এসেছি সংসারের মিহি খুন্তি-কড়াই টুংটাং। অথচ সেখানে শীতের সমুদ্র ছিল, ছিল তার একান্ত জলের জাহাজ—– স্বপ্ন বোঝাই করে ভেসে চলেছে—- সেইসব সুগন্ধ এলাচ দ্বীপে।

আমাদের গোলাপ বনে, আমাদের রক্তজবার বনে সে শুধু ক্ষণকাল পাখি এক, উড়ে যাবে চঞ্চল, পায়ে তার কেবল কম্পন, থরহরি মতি তার,
চোখে সমুদ্র সাম্পান, আর মায়া ঘাটে জ্বলে ওঠা
টুপ-টাপ আদিম লণ্ঠন।

উড়ে যাবে, উড়ে যাবে হীরামন এই আধোচেনা ফুল থেকে,ফুলের বাগান থেকে ।

কিন্ত কোথায় সে উড়ে যাবে, জানেনা নীলকণ্ঠ,
জানেনা সবুজ হাঁস, শীতের সমুদ্র, সেকথা জানেনা একলা জলের জাহাজ।

৯.
আমাদের শহরে শীত এলে পরে
সাদা হাঁসের দল
উড়ে যেত কুয়াশায়, সে ঈশ্বর ছিল
শুধু মায়ের চোখে৷
আমাদের বোন পারুল, কিংবা
আমরা সাত ভাই
কোনোদিন দেখতে পাইনি।
জিজ্ঞেস করলেই, মা আমাদের
অবিশ্বাসে
বাতাবি লেবুর আশ্চর্য গন্ধ ছড়িয়ে
মন দিতেন উল বোনায়।
সমস্ত শীতজুড়ে
অসমাপ্ত সংসার, সবুজ
সমস্ত শীতজুড়ে
মায়ের উলবোনা ,আর
বাতাবি লেবুর সুঘ্রাণ!

আমরা পড়ে থাকি ধুলোয়,
মাঝে মাঝে ফুল হয়ে ফুটি,
এটা-ওটা করে সময় কাটাই।
কখনো নক্ষত্র,
কখনো হাড়ি-খুন্তির সংসার,
কখনো মায়ের
পায়ের কাছে পড়ে থাকা অসমাপ্ত চাদর!

যেদিন মা মুখ তুলে তাকালেন,
আমাদের চোখেও নেমে এল ঈশ্বর,
শীতের কুয়াশায় উড়ে যাচ্ছে
শত শত সাদা হাঁসের দল!

সেই থেকে
আমাদের অবিশ্বাসে
আর কোনো বাতাবি লেবুর
ঘ্রাণ মেলেনি!

১০.
কাঠবাদামের বনে যে গোলাপী
হরিণ পালিয়ে গেল , সেই
আমার একমাত্র অসুখ।
তার পথজুড়ে মহুয়া বিভ্রম।
যতবার সুগন্ধ পাই, অসুখ
বেড়েই চলে , আমার রাত থেকে
খসে পড়ে যত
জারুল নির্জনতা। নদী পার হয়ে,
নির্নিমেষ
হাওয়ার পাহাড় ডিঙিয়ে,
কতকাল ধরে হেঁটে চলেছি,
শুধু এইখানে,
এই বিভ্রমে দাঁড়িয়ে থাকব বলে।

১১.
মায়া ঘাটজুড়ে বৃষ্টি নামে, ছোট্ট নৌকা আমার।
এমন দেবতা স্বভাব নদীর কাছে সন্ধ্যেটুকু চাইতে পারি শুধু, তার চেয়ে বেশি কোনও নির্জনতা মানায় না মৃত্যুকে । জানি, স্বপ্নে লিখেছে সে, আনমনে, এইসব মৃত্যুর মুখ। এও জানি,
যে আমাকে নিয়ে যাবে ঘরে, সে কোথায়ও নেই, কোথায়ও নেই বসে।
১২.
আমাদের যেদিন সবুজ বাড়িটা কেনা হলো, ভুল বসন্তের দিনে, তুমি সন্ধ্যা স্বভাবের কিছু জারুল এঁকে অদৃশ্য হয়ে রইলে সমস্ত বাড়ি জুড়ে।
এখন ঘরে ফিরি সন্ধ্যেবেলা, খোলা দরজা, ডোর বেল বাজাই তবু। সমস্ত ঘর জুড়ে, বিষণ্ণ করবী, শুধু তোমার গুঞ্জন!

১৩.
জানালা থেকে সরিয়ে নাও
শীতের রাত্রিগুলি,এখন
চাঁদ উঠবে, আমাদের নির্জন
দ্বীপে, সমুদ্রের কিনারে।
সেখানে আদিম অন্তিম
বালিকার কালো ফুল
থেকে নাকফুল
খসে পড়েছে সমুদ্রে।
আমি নির্ভার নাবিক এক,
এই সমুদ্রে,সমস্ত জাহাজ ডুবিয়ে
দিয়েছি
সেই নাকফুল ভালোবেসে।
এমন হীরের দ্বীপে
দীন হয়ে আছি প্রভু!
নিরর্থক নাকফুল ছাড়া,
আর সব নেই হয়ে আছে
এই
নৈ:শব্দ্যে!

Facebook Comments

comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top