গুচ্ছ কবিতা II হাসনাইন হীরা

পাঠ্যসূচির ঘড়ি

ঘুমের ভেতর কূটিলঝড়ে চাঁদ ডুবে যায়, শৈলান্দ্র চাঁদ
হাঁটুজলে নৌকা ভাসায় বর্ষাপতি মেঘের বালক,
শ্লেষভরা সিলেবাসে অপমানের দাঁত ভেঙে যায়
চাঁদ কি তবে আইসক্রিম! শরীরভরা হিমের পালক!

ঘড়িতে ঝুলে আছে শীতকাল, মগজে ডাহুকের ডিম। আমরা তার ভার ও ভারিক্কি নিয়ে বসে আছি অভূক্ত পৃথিবীর ডেরায়। হঠাৎ একজোড়া পা উধাও হলে- রক্তাক্ত জুতো পড়ে থাকে সিথানে। হঠাৎ একজোড়া হাত উধাও হলে- রক্তাক্ত নোট বই পড়ে থাকে টেবিলে।

এভাবে উধাও হবে চোখ, দৃষ্টি পড়ে থাকবে ড্রয়িং খাতায়!
উধাও হবে কান আর শ্রবন পড়ে থাকবে মেঘবাড়িতে!
মগজ উধাও হবে আর স্বপ্নযাত্রা থেমে যাবে অন্ত্যষ্টিক্রিয়ায়!

দাঁড়িয়ে আছি বিরান দুপুরের পাশে। বাতাসে উচ্চাকাক্সিক্ষ ক্ষুধার মৃত্যু-শ্বাস। অভ্যাসবশত সত্যের ভাড়াবাড়ি দখল করে আছে স্পষ্টত পরিহাস। অভিলাসের দুঃখবাদ ছাড়া কিছুই লেখা যাচেছ না। পোয়াতি চশমাটা ঝুলে পড়ছে সন্ধ্যার আলনায়। আমরা তাকে একা রেখে ঘুমাতে পারছি না। মেঘছায়া বাসা বেঁধে আছে রক্তের টবে-

অথচ ঘুম একটা নিজের কেনা বাঁশি, আমরা তাকে বাজাবো কবে?

ছায়া ও ছাপচিত্র

বিকেলে এসেই দীর্ঘ হয় ছায়া ও ছাপচিত্রের গল্প

যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, সেও এক জংশন
হাওয়াপাতায় ভরে আছে চারপাশ।

শ্বাস নিতে পারছি না, দূরত্ব মুছে
এ কোন দূরত্ব সংকীর্ণতার জামা পড়ে আছে!

অস্পষ্ট অনুমান, অস্থিরতা ও অনুকম্পার সাথে
এককাপ চা এলে টের পাই

সেখানে দাঁড়িয়ে আছি, সেও এক জংশন বটে।

তবুও; অস্থিরতা

একটা শীতপাখি উড়ে যেতে দেখে-
দৃশ্য হারাবার ভয় ও ভীমরুল জড়ো হতে থাকে।
অপেক্ষারত সবুজবাতির পিছু পিছু হাঁটতে গিয়ে
ছিঁড়ে গেছে সম্পর্কের সুতো।

ঘুমের গর্ত থেকে কুড়িয়ে পাওয়া নৌকা নিয়ে
বেশি দূর যেতে পারছি না।
স্বরহীন অচেনা আলো ঝাপটে আছে।
ভাঙা যাচ্ছে না এই ছিকল ও ছায়া।

যদিও ছায়া সূর্যপত্নী আর ছিকল সমূহ সম্পর্কের সর্বনাম।

ধোঁকা

পাখনা ভাঙা একটা পাহাড়কে দ্যাখ-
আতস্থ কর তার রক্তপাত।
ধ্যানি ঈগলের মনে যতটা না উদেশ্য থাকে
তারও অধিক থাকে ক্ষুধা।
এমনই আদ্রতায় ঘুরে ঘুরে ফিরতে হয় পৃথিবীতে
ইচ্ছে করলেই ঘাতক বাসের নামে
উইল কারা যায় না এই ভাষা-বাক্যের জীবন।

অথচ এমনই ধোঁকায় পড়ে আছি;
অদৃশ্য এক পোকা খেয়ে চলেছে শেকড়-বাকড়
যদিও জানি- এই চোগলখোর
একটা মিথ্যাবাদী, যার কোন অর্থমূল্য নেই।

ঝাউফোটা চিঠি

আমাদের স্কুল বরাবর তোমরা একটা চিঠি লিখেছিলে
ঝাউফোটা চিঠি। আমরা কি তা পড়তে পেড়েছি!
পেখমভরা অহম ও অক্ষমতা ফণা তুলে আছে
দুঃখ নিভানোর মোমবাতি জ্বালাতেই পারছি না।

আত্মপ্রেমের বাঁশি হাতে বেরিয়ে পড়ি ভাঙাচুড়া দিগন্তের দিকে
চাঁদবাড়ি বসে থাকে উড়ালগামী ফড়িংয়ের মন
দাঁতে কাটা কুয়াশার পাতা উল্টে বসে দোয়েলের শিস।

বহু শতাব্দীর পর আজ এই শতাব্দী শেষে
কোন সংযোজনই আমরা পাঠ্যবইয়ে তুলে রাখতে পারিনি
বের করতে পারিনি টমেটো ফুলের আত্মকথা, মুক্তির পথ;
অথচ তোমরা আমাদের হৃদয় বরাবর একদিন চিঠি লিখেছিলে।

বীজবিদ্যার ম্যাজিক

ভূমিকার মতো বলি, মগ্নতা চাই; মগ্নতার মতো বলি, অন্তিমে মানুষের গল্প খুলে বসো। যে কোন নির্জনতার পাশে হেসে ওঠার আগে-তোমার জানা থাকা দরকার, মানুষের কোন ঋতু নেই, সময় নেই, ছায়া নেই। আর এভাবেই একদিন কবিতার মতো বলেই ফেলি-কথা ও কাঁন্নার ফারাক আছে বলেই বেজে ওঠে বীজবিদ্যার ম্যাজিক। যার স্বরভাষ্যে মানুষকে চয়ন করে মানুষ, মিলিয়ে নেয় বিঘাপতি ফসলের হিসাব। মুদ্রিত স্বপ্নের ভেতর মানুষের মুখ আর মুখ দিয়ে ভরে যায় খাতা। অতপর হাওয়াশূন্য মানুষের ভারে খাতাও শূন্য হয়ে ওঠে। আমিও ব্যাসবাক্যহীন মানুষের সমতলে এসে-মানুষের হাততালি দেখে ভাবি- মানুষের জগতে মানুষ কত বোকা।

মনসংযোগের সড়ক

অনাস্থার ছোরা হাতে দৌড়ে আসে গুজবের ঘোড়া । ট্রেডমার্ক খুরে আমাদের হাতীসুলভ দাঁত ভেঙে যায়। নিস্তরঙ্গ পাঁজরে সাজিয়ে নেই বিনয় বিষয়ক পাতা। অস্তগামী সাপের লেজ কেটে হাতঘড়ির আকাশ টাঙ্গিয়ে দেই টাইমলাইনে। আমাদের মন খোলা বন্ধুরা একেকজন এক একটি স্টেশন। আমাদের বুকের উপর ভাঁজ খুলে দাঁড়ায় দূরগামী ট্রেন। অন্ধবিড়ালের ফোরলেন প্যাঁচালগুলো উষ্ঠা মেরে ফেলে দেই। ধার্মিক সময় থেকে মেপে নেই রক্ত ও রক্তিম রেখার দৌড়। ভ্রমণের পরাগ খুলে কেশবতী বগিগুলো ক্রমশ গর্ভবতী হয়।

আরো একবার সফেদাফুলের গল্প নিয়ে হেসে উঠি সমন্বিত বিকেলে। এরকম ফিরে আসা সুন্দর ও সুগন্ধির নোট করা হাসির মগ্নতায় মিলিয়ে নেই বিবেচ্য জীবন, পরিব্রাজক সাবানের ফেনা। অহংকারের ফণাতোলা মেঘের মতো কোনো চালাকি নেই। হাইতোলা দূরত্বেরও নেই নিজস্ব প্রাচীর। গন্তব্যের নামে আমাদের ব্যক্তিগত আড্ডাগুলো ক্রমশ পাখি হয়ে গেলে- ডানায় পোষ্ট করে দেই উড়ালমুখি দিন।

মাপজোক 

ভেতর থেকে বাহির দেখতে দেখতে অজ¯্র পাথরবিদ্যা
গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ে;  যাদের কোন ওজন নেই।

চাহিদার বিপরীতে ধাড়ি বিড়ালটিও
খুলে বসে কান্নার ডাকবাক্সো
যার ভেতরে সে মরতেও পারে, বাঁচতেও পারে।

আমিও প্রকাশ্যে খুঁজে চলেছি একজোড়া জুতোর ফিতা
আর মনে পড়ছে, মানুষেরই একজোড়া পা আছে
যার মাপ নিতে নিতে ভেঙে যায় আড়াল, মুখাগ্নির চিতা।

নিয়তির মতোই ভেসে বেড়ায় বাঘডাক- অস্পষ্ট বনে;
যার ডোরাকাটা ছায়ার প্রতিটি বিষাদ ছুঁয়ে মনে হয়,
আমার ভেতরে আমি দশাঙুলের ছাপ- বিস্তর পরানে।

সাঁকো 

কেবলি পেরিয়ে যাই যতিচিহ্নের মাঠ,
ধ্যানি বকের শব্দপ্রবাহ আর
শীতকাল ভাসানো গল্পসমগ্রের উঠোন।

একদিন বড় বড় চোখ করে
তাকিয়ে ছিল যে দহনকাল!
তাকেও আজ কাশফুলের সাথে ভাসিয়ে দিয়েছি
হাওয়াকাঠের নৌকায়।

একদিন তোমাকেও পেরিয়ে যাব
উপযুক্ত ভাষায়…
আটকাবার কোন গল্পই থাকবে না উপসংহারে।

Facebook Comments

comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top