লুই আলথুসারের সাক্ষাৎকার ।। অনুবাদ: আশানুর রহমান

[ফরাসী মার্কসবাদী দার্শনিক লুই আলথুসারের জন্ম ১৯১৮ সালের ১৬ অক্টোবর ফ্রান্স অধ্যুষিত আলজেরিয়ায়। ১২ বছর বয়সে তিনি আলজেরিয়া থেকে ফ্রান্সে আসেন। পড়াশুনা করেন প্যারিসের বিখ্যাত ইএনএস-তে (Ecole Normale Supurieure)। পরবর্তীতে তিনি  ইএনএস-তে সমাজবিজ্ঞান, নৃবিজ্ঞান এবং ভাষাতত্ত্বে কাঠামোবাদ বা ‘স্ট্রাকচারালিস্ট’ ঘারানার সাথে সম্পৃক্ত হন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি কিছুদিন জামার্নদের ‘কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে’ বন্দী ছিলেন এবং সে সময় তিনি কমিউনিস্ট সহবন্দীদের সংস্পর্শে আসেন এবং প্রভাবিত হন। নিজেও ফরাসী প্রতিরোধ আন্দোলনে অংশ নেন এবং ১৯৪৮ সালে ফ্রান্স কমিউনিস্ট পার্টিতে (পিসিএফ) যোগ দেন। কিন্তু দলে যোগ দিলেও দলের মধ্যে তিনি ভিন্নমতাবলম্বী হিসাবে পরিচিতি পান। তিনি ইএনএস-তে ৩৫ বছর শিক্ষকতা করেন। জ্যাঁক দেরিদা এবং মিশেল ফুঁকো ইএনএস-তে তাঁর ছাত্র ছিলেন। ১৯৫৩ সালে স্টালিনের মৃত্যু, ১৯৫৬ সালে রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির ২০তম কংগ্রেসর পর দুনিয়াব্যপী যে বিতর্ক শুরু হয় সেই বিতর্কে ফ্রান্স কমিউনিস্ট পার্টি ক্রুশ্চেভকে সমর্থন করলেও লুই আলথুসার দল থেকে থেকে পদত্যাগ না করেও লেখালেখির মাধ্যমে দলের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। এসময় তিনি কিছুটা মাও সে তুং বা চীন ঘেঁষা বলে বিবেচিত হতে থাকেন। একইসাথে তিনি ও তাঁর কিছু তরুণ শিক্ষার্থী মিলে মার্কসীয় তত্ত্বচিন্তায় মনোনিবেশ করেন এবং প্রচুর বিতর্কের জন্ম দেন।] 

লুই আলথুসার ১৯৪৭ থেকে ১৯৮০, এই দীর্ঘ সময় ধরে মানসিক রোগে ভোগেন। কেউ কেউ বলেন তাঁর এই মানসিক রোগের উৎস জার্মান শিবিরে তাঁর বন্দীত্ব ও নির্যাতন। মানসিক অসুস্থতা নিয়েই ১৯৮০ সালে তিনি তাঁর স্ত্রীকে বালিশ চাপা দিয়ে হত্যা করেন। পরবর্তীতে তিনি বলেছিলেন স্ত্রীর প্রতি ভালবাসা থেকেই এবং অসুস্থ স্ত্রীর অনুরোধে তিনি এমনটি করেছিলেন। তাঁর অসুস্থতা, দর্শনে তাঁর অবদান এসব বিবেচনায় নিয়ে তাঁকে মানসিক রোগ নিরাময় কেন্দ্রে পাঠানো হয়। ১৯৯০ সালের ২২ অক্টোবর তিনি মারা যান। ‘For Marx’ তাঁর বিখ্যাত রচনা। ‘Lenin and Philosophy’; Reading Capital’ এগুলো তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধ। রাষ্ট্র প্রশ্নে ভাবাদর্শভিত্তিক হাতিয়ার (Ideological State Apparatuses) এবং নিপীড়নমূলক হাতিয়ার (Repressive State Apparatuses) তাঁর মৌলিক সংযোজন-যেটাকে গ্রামসির রাষ্ট্রচিন্তার সম্প্রসারণও বলা যেতে পারে। যদিও রাষ্ট্র ভাবনায় তাঁদের দু’জনের মধ্যে অনেক বিষয়ে মতপার্থক্য আছে।

মোটাদাগে বললে বলা যায়-গ্রামসি যেখানে মার্কসের প্রথমদিকের লেখাগুলোর উপর গুরুত্বারোপ করে ব্যক্তির বিচ্ছিন্নতা এবং বিশ্ব সম্পর্কে মানুষের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে গুরুত্ব দিয়েছেন, সেখানে আলথুসার পরিণত মার্কসের লেখাগুলোর উপর বেশি গুরুত্বারোপ করে পুঁজিবাদের উত্থানের নিয়ম আবিস্কারক হিসাবে মার্কসের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাকে বিজ্ঞানের ‘তৃতীয় মহাদেশ’ আবিস্কারের সাথে তুলনা করেছেন।

অন্যদিকে গ্রামসি মার্কসবাদকে চিহৃিত করেছেন পুঁজিবাদের রাজনৈতিক ক্রিটিক হিসাবে, আলথুসার  মার্কসবাদকে দেখেছেন বিজ্ঞান হিসাবে।

আবার গ্রামসি যেমন মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা, ইতিহাসে তার ভুমিকা এবং মানুষের চেতনা ও ধারণাসমূহ সমাজ পরিবর্তনে ব্যক্তির ভূমিকার উপর গুরুত্ব দিয়েছেন, সেখানে আলথুসার ইতিহাস পরিবর্তনে কাঠামোগত কারণগুলিকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছেন। ব্যক্তিকে দেখেছেন ‘নিষ্ক্রিয় পুতুল’ হিসাবে যে কিনা ব্যক্তির ইচ্ছা নিরপেক্ষ কাঠামোগত মতাদর্শ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।

তেমনিভাবে গ্রামসি মনে করেন সমাজতন্ত্র তখনই আসবে যখন মানুষ পুঁজিবাদ উৎখাতের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠবে, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে সেভাবে পরিচালনা করবে এবং বিশ্বাস করবে যে সময়টা বিপ্লবের জন্য খাসা। অন্যদিকে আলথুসার মনে করতেন সমাজতন্ত্র তখনই আসবে যখন পুঁজিবাদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব তার কাঠামোকে অনিবার্য পতনের দিকে টেনে নেবে।

ফলে মার্কসবাদ, রাষ্ট্র, বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা এবং কমিউনিস্ট পার্টির করণীয় নিয়ে আলথুসারের নীচের সাক্ষাতকারটি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্র নিয়ে যারা ভাবেন বাংলাভাষী সেসব পাঠকদের কথা বিবেচনায় রেখে সাক্ষাতকারটি অনুবাদ করা হলো। 

১৯৬৮ সালে লুই আলথুসারের এই সাক্ষাতকারটি গ্রহণ করেছিলেন মারিয়া এ্যান্টোনিয়েটা ম্যাকিওকিচি। সে বছরই ‘লা ইউনিটা’ পত্রিকায় সাক্ষাতকারটি প্রথম ছাপা হয়। ১৯৭১ সালে ‘নিউ লেফট’ পত্রিকায় এ্যান্ডি ব্ল্যানডেনের অনুবাদে ইংরেজিতে বের হয়। ইংরেজি থেকে বাংলায় সাক্ষাতকারটি অনূদিত হলো।]

:: :: ::

আপনি কী আপনার ব্যক্তিগত ইতিহাস আমাদের বলতে পারেন? আপনি কেন মার্কসবাদী দর্শনের দিকে ঝুঁকলেন?

১৯৪৮ সাল, আমার বয়স তখন ৩০, আমি দর্শনের শিক্ষক হিসাবে পিসিএফ-এ যোগ দিই। দর্শনের প্রতি আমার একটা আগ্রহ ছিল, আমি চেষ্টা করেছিলাম এটাকে পেশা হিসাবে নিতে। রাজনীতির প্রতিও একটা আবেগ ছিল, আমি চেষ্টা করেছিলাম একজন কমিউনিস্ট যোদ্ধা হতে।

দর্শনের প্রতি আমার আগ্রহের কারণ ছিল বস্তুবাদ এবং এর সমালোচনামূলক ক্রিয়াকলাপ-মতাদর্শিক জ্ঞানের সকল অতিন্দ্রিয়তার বিরুদ্ধে এর বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের কারণে। নিছক পৌরাণিক কাহিনী ও নৈতিক মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে তার যুক্তিসঙ্গত ও কঠোর সমালোচনার জন্য। রাজনীতির প্রতি আমার আবেগের পিছনে এর বিপ্লবী আকাঙ্ক্ষা, বুদ্ধিমত্তা, সাহস এবং সমাজতন্ত্রের জন্য শ্রমিক শ্রেণীর বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা ভিত্তি হিসাবে কাজ করেছিল। যুদ্ধ এবং দীর্ঘদিন বন্দীদশায় থাকার সময় শ্রমিক, কৃষক এবং কমিউনিস্ট যোদ্ধাদের সাথে সরাসরি যোগাযোগের সুযোগও তৈরি হয়েছিল।

এটা ছিল এমন এক রাজনীতি, যা সবকিছু নির্ধারণ করে। সাধারণ রাজনীতি নয়, মার্কসবাদী-লেনিনবাদী রাজনীতি।

প্রথম আমাকে তাদের খুঁজতে এবং বুঝতে হয়েছিল। যেটা একজন বুদ্ধিজীবীর জন্য সর্বদা কঠিন কাজ। পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকে এটা কঠিন ছিল, কারণগুলো আপনিও জানেন যে-ব্যক্তিপূজা, বিশতম কংগ্রেস, এরপর আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের সংকটগুলোর একটা প্রভাব ছিল। সর্বপরি, সমসাময়িক ‘মানবতাবাদী মতাদর্শের’ বিস্তার এবং মার্কসবাদের বিরুদ্ধে  বুর্জোয়া মতাদর্শের অন্য আক্রমণগুলো প্রতিরোধ করাটা সহজ ছিল না।

মার্কসবাদী-লেনিনবাদী রাজনীতিটা ভালভাবে বোঝার পর আমি দর্শনের দিকেও ঝুঁকে পড়ি। অবশেষে আমি মার্কস, লেনিন এবং গ্রামসির বিখ্যাত তত্ত্বগুলো বুঝতে শুরু করি; আর সেই দর্শনগুলো তো মৌলিকভাবে রাজনৈতিক।

প্রথমদিকে আমি যা কিছু লিখেছি, পরবর্তীতে তরুণ কমরেড এবং বন্ধুদের সহযোগিতায়, আমাদের প্রবন্ধগুলোর ‘বিমূর্ততা’ সত্ত্বেও বাস্তব প্রশ্নগুলিকে ঘিরেই সেগুলো আবর্তিত হচ্ছে।

আপনি কি আরো সুনির্দিষ্ট করে বলবেন-দর্শনে কমিউনিস্ট হওয়া কেন সাধারণভাবে কঠিন?

দর্শনে কমিউনিস্ট হতে গেলে মার্কসবাদী-লেনিনবাদী দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের পক্ষাবলম্বী এবং তার কারিগর হতে হয়।

মার্কসবাদী-লেনিনবাদী দার্শনিক হওয়া সহজ না। অন্য ‘বুদ্ধিজীবীদের’ মত দর্শনের শিক্ষকও একজন পেটিবুর্জোয়া। যখন সে মুখ খোলে, সে পেটিবুর্জোয়াদের মত কথা বলে-এদের সম্পদ এবং ছলের কোন সীমা নেই।

আপনি জানেন যে ‘বুদ্ধিজীবী’ নিয়ে লেনিন কি বলেছেন। ব্যক্তিগতভাবে এদের কেউ কেউ শ্রেণীচ্যুত বিপ্লবী (রাজনৈতিক অর্থে)  হতে পারে, সাহসী হতে পারে। কিন্তু সাধারণভাবে, মতাদর্শগতভাবে তারা শোধরানোর অতীত পেটিবুর্জোয়া হিসাবেই থেকে যায়। লেনিন, যিনি গোর্কির প্রতিভায় মুগ্ধ ছিলেন মনে করতেন গোর্কি নিজেও একজন পেটিবুর্জোয়া বিপ্লবী। ‘শ্রমিক শ্রেণীর ভাবাদর্শী’ (লেনিন), সর্বহারা শ্রেণীর ‘অর্গানিক বুদ্ধিজীবী” (গ্রামসি) হতে গেলে বুদ্ধিজীবীদের তাদের ভাবাদর্শের বিরুদ্ধে মৌলিক বিপ্লবী লড়াই করতে হয়-একটা দীর্ঘ, কষ্টকর এবং কঠিন পূর্নঃশিক্ষা। ভিতর এবং বাহিরে এক অন্তহীন সংগ্রাম।

সর্বহারা শ্রেণীর একটি ‘শ্রেণী আকাঙ্ক্ষা’ আছে যা তাদেরকে সর্বহারা ‘শ্রেণী অবস্থানে’ নিয়ে যায়। তেমনিভাবে বুদ্ধিজীবীদের শ্রেণী আকাঙ্ক্ষা হল পেটিবুর্জোয়া, যা তাদেরকে শ্রেণীচ্যুত হতে বাঁধা দেয়।

সর্বহারা ‘শ্রেণী অবস্থান’ সর্বহারা ‘শ্রেণী আকাঙ্ক্ষার’ অধিক কিছু। এটা একটি চেতনা এবং অনুশীলন, যা সর্বহারা শ্রেণীর সংগ্রামের বাস্তব উদ্দেশ্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। ‘শ্রেণী আকাঙ্ক্ষা’ ব্যক্তিক এবং স্বতঃস্ফূর্ত; ‘শ্রেণী অবস্থান’ যুক্তিসিদ্ধ এবং নৈব্যক্তিক। সর্বহারা শ্রেণী অবস্থানে পৌঁছাতে গেলে সর্বহারা শ্রেণী আকাঙ্ক্ষাকে ‘শিক্ষিত’ করতে হবে; অন্যদিকে পেটিবুর্জোয়াদের শ্রেণীগত আকাঙ্ক্ষা এবং সেই সাথে বুদ্ধিজীবীদের বিপ্লবীতে রূপান্তরিত করতে হবে। মার্কসবাদী-লেনিনবাদী তত্ত্বের নীতির ভিত্তিতে পরিচালিত শ্রেণী সংগ্রামের সর্বশেষ বিশ্লেষণ দ্বারাই এই ‘শিক্ষা ও বিপ্লব’ নির্ধারিত হবে।

কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো বলে যে, এই তত্ত্বগত জ্ঞান কিছু বুদ্ধিজীবীকে সর্বহারা শ্রেণীর অবস্থানে যেতে সাহায্য করতে পারে।

মার্কসবাদী-লেনিনবাদী তত্ত্বে বিজ্ঞান (ঐতিহাসিক বস্তুবাদ) এবং দর্শন (দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ) দু’টোই অন্তর্ভুক্ত।

মার্কসবাদী-লেনিনবাদী দর্শন তাই সর্বহারার শ্রেণী সংগ্রামের জন্য অপরিহার্য দু’টি তাত্ত্বিক হাতিয়ার। কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের অবশ্যই তত্ত্বের নীতিগুলি আয়ত্ত্ব এবং ব্যবহার করা উচিত- বিজ্ঞান ও দর্শন হিসাবে। সর্বহারা বিপ্লবের জন্য যোদ্ধা প্রয়োজন, যারা একাধারে বিজ্ঞানী (ঐতিহাসিক বস্তুবাদী) এবং দার্শনিক (দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী) যারা তত্ত্বকে রক্ষা এবং বিকশিত করবেন।

এরকম দার্শনিক তৈরি হতে থাকলে দু’টো বড় সমস্যার বিরুদ্ধে লড়াই করা যাবে।

প্রথমতঃ রাজনৈতিক সমস্যা। পার্টিতে যোগদানকারী একজন পেশাদার বুদ্ধিজীবী মতাদর্শগতভাবে পেটিবুর্জোয়া থেকে যায়। দর্শনে সর্বহারা শ্রেণী অবস্থান নিতে হলে তাকে অবশ্যই তার চিন্তাধারা বিপ্লবী করতে হবে।

দ্বিতীয়তঃ তাত্ত্বিক অসুবিধা। আমরা জানি দর্শনে ‘শ্রেণী অবস্থান’ নিতে গেলে কোন দিক নির্দেশনা এবং কোন নীতির ভিত্তিতে আমাদের অবশ্যই কাজ করতে হবে। কিন্তু আমাদের অবশ্যই মার্কসীয় দর্শনকে বিকশিত করতে হবে; এটা জরুরি ভিত্তিতে-তাত্ত্বিক এবং রাজনৈতিকভাবে। এখন এই কাজটি বিশাল এবং কঠিন। মার্কসবাদী তত্ত্বের ক্ষেত্রে দর্শন ‘ইতিহাসের বিজ্ঞানের’ পিছনে পড়ে আছে।

আজ, আমাদের দেশে এটাই গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা।

আপনি কী এই জন্যই মার্কসবাদী তত্ত্বকে বিজ্ঞান এবং দর্শনে ভাগ করতে চান? আপনি জানেন যে এরকম বিভাজনে অনেকের আপত্তি আছে।

আমি জানি। কিন্তু এ ধরনের আপত্তি নতুন কিছু না।

সুনির্দিষ্ট করে বললে, এভাবে বলা যেতে পারে যে, মার্কসবাদী আন্দোলনের ইতিহাসে এই সব আপত্তি দমন শেষ পর্যন্ত ডান ও বাম বিচ্যুতিতে পর্যবসিত হয়েছে। ডান বিচ্যুতরা চায় দর্শনকে দমন করতে – তখন শুধু বিজ্ঞান থাকে (পজিটিভিজম)। বাম বিচ্যুতরা চায় বিজ্ঞানকে দমন করতে-তখন থাকে শুধু দর্শন (সাবজেকটিভিজম)। এর ব্যতিক্রমও আছে, কিন্তু সেটা উপরের নিয়মকেই নিশ্চিত করে।

মার্কস ও এঙ্গেলস থেকে শুরু করে মার্কসবাদী শ্রমিক আন্দোলনের আজকের মহান নেতারা সবসময় বলেছেন যে, এই বিচ্যুতিগুলি মার্কসবাদের উপর বুর্জোয়া মতাদর্শের প্রভাব ও আধিপত্যের ফল। তাদের দিক থেকে তারা সবসময় এই বিচ্যুতি থেকে মার্কসবাদকে (বিজ্ঞান ও দর্শন) রক্ষা করেছেন শুধুমাত্র তাত্ত্বিক দিক থেকেই নয়, গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কারণেও। ‘Materialism and Empirio-criticism’ অথবা ‘Left-Wing Communism’ এ লেনিনের কথা চিন্তা করুন। তাঁর কথাগুলোও এখনও সমানভাবে প্রযোজ্য।

মার্কসীয় তত্ত্বকে বিজ্ঞান এবং দর্শন- এই বিভাজনের পক্ষে আপনার যুক্তি কী?

আপনার প্রশ্নের উত্তরটি আমি কয়েকটি ধাপে সুনির্দিষ্ট করে দিতে চাই।

প্রথমতঃ মার্কসবাদী তত্ত্ব ও  শ্রমিক আন্দোলনের মেলবন্ধন শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাসে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, অর্থাৎ, প্রকৃতপক্ষে সমগ্র মানবজাতির ইতিহাসে (প্রথম প্রভাব-সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব)।

দ্বিতীয়তঃ মার্কসীয় তত্ত্ব (বিজ্ঞান ও দর্শন) মানুষের জ্ঞানজগতের ইতিহাসে একটি অভূতপূর্ব ঘটনা।

তৃতীয়তঃ মার্কস একটি নতুন বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠিত করেছেন; ইতিহাসের বিজ্ঞান (science of history)। একটা ছবি কল্পনা করতে দিন। যে বিজ্ঞানের সাথে আমরা পরিচিত তা আমাদের মনে অনেকগুলো বড় ‘মহাদেশ’ (continent) এর ছবি তৈরি করে থাকে। মার্কসের আগে এরকম দু’টো ‘মহাদেশ’ আমাদের বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের জগতকে উন্মুক্ত করে দিয়েছিল-গণিতের মহাদেশ এবং পদার্থ বিজ্ঞানের মহাদেশ। প্রথমটা গ্রিক (থ্যালস্), দ্বিতীয়টা গ্যালিলিও কর্তৃক। মার্কস বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের তৃতীয় ‘মহাদেশ’ টি তুলে ধরলেন-‘ইতিহাসের মহাদেশ’।

চতুর্থতঃ এই নতুন ‘মহাদেশটি’ উন্মুক্ত হওয়ায় দর্শনে একটা বিপ্লব ঘটে গেছে। এটা একটা নিয়ম যে দর্শন সব সময় বিজ্ঞানের সাথে সম্পর্কযুক্ত।

দর্শনের জন্ম হয়েছিল (প্লেটোর হাতে) গণিতের মহাদেশটি উন্মোচিত হবার পর। এটার রূপান্তর ঘটেছিল (দেকার্তের হাতে) পদার্থবিদ্যা নামক মহাদেশটি উন্মুক্ত হবার পর। আজকে মার্কস কর্তৃক ইতিহাসের মহাদেশ উন্মুক্ত হওয়ায় তার বৈপ্লবিক রূপান্তর ঘটেছে। এই বিপ্লবকে বলা হয় ‘দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ’।

সবসময় দর্শনের রূপান্তর ঘটে বিজ্ঞানের আবিস্কারের হাত ধরে। তাই অত্যাবশ্যকভাবে এটা ঘটে ঘটনার পরে। আর একারণে মার্কসীয় তত্ত্বে দর্শনও বিজ্ঞানের

অনুগামী হয়েছে। অন্যান্য কারণও আছে, আমরা সেগুলো জানি কিন্তু এটাই হল বর্তমানে গুরুত্বপূর্ণ কারণ।

জনগণের মধ্যে একমাত্র সর্বহারা বিপ্লবীরাই মার্কসের বৈজ্ঞানিক আবিস্কারকে, বৈপ্লবিক সুযোগকে অনুধাবন করতে পেরেছে। তাদের রাজনৈতিক অনুশীলনও এটার দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছে।

আর এখানেই আমাদের সমসাময়িক ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ তাত্ত্বিক অভিষঙ্গটি চলে আসে।

সাধারণ অর্থে, বুদ্ধিজীবীরা, এমনকি যাদের ‘পেশাগত’ স্বার্থ (মানববিজ্ঞানে পারদর্শী, দার্শনিক) আছে, তারাও সত্যিকার অর্থে মার্কসের বৈজ্ঞানিক আবিস্কারের অভূতপূর্ব সুযোগটি উপলব্ধি করতে পারেনি, অথবা উপলব্ধি করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে, বরং তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছে বা নিন্দা করেছে, এবং যখন তারা আলোচনা করেছে, সেটা করেছে বিকৃতভাবে।

কতিপয় ব্যতিক্রম ছাড়া, তারা এখনও রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্র, সমাজবিজ্ঞান, নীতিশাস্ত্র, নৃবিজ্ঞান, সামাজিক মনোবিজ্ঞানে দারুণভাবে ডুবে আছে, এমনকি আজকে ‘পুঁজি’ প্রকাশের একশ’ বছর পর, যেমন গ্যালিলিও’র পঞ্চাশ বছর পর এ্যারিস্টোটেলিয়ান পদার্থবিজ্ঞানীরা ডুবে ছিল। তাদের ‘তত্ত্বগুলো’র  আদর্শিক অনাক্রম্যতাগুলোকে (ideological anachronisms) বুদ্ধিবৃত্তিক তনুতা এবং অত্যাধুনিক গাণিতিক কৌশল দিয়ে পুনঃজীবিত করে থাকে।

কিন্তু তত্ত্বগত এই সব বিতর্কগুলো সত্যিকারের কোন অভিষঙ্গ নয়। এগুলো আদর্শগত শ্রেণী সংগ্রামের প্রভাব-এটা বুর্জোয়া ভাবাদর্শ, বুর্জোয়া সংস্কৃতি; যারা  ক্ষমতা আছে, তাদের আধিপত্যে কায়েম করে।

সাধারণভাবে, বুদ্ধিজীবীরা-কমিউনিস্ট এবং মার্কসিস্ট বুদ্ধিজীবীসহ কতিপয় ব্যতিক্রম বাদে বুর্জোয়া ভাবাদর্শ দ্বারা প্রভাবিত। ব্যতিক্রমবাদে একই ঘটনা ঘটে মানবিক বিজ্ঞানেও।

ষষ্ঠতঃ একই কথা প্রযোজ্য দর্শনের ক্ষেত্রেও। মার্কসের আবিস্কার যে বিস্ময়কর দার্শনিক বিপ্লব সেটা কয়জনই বা বুঝতে পেরেছে? শুধু সর্বহারা যোদ্ধা এবং নেতৃত্ব ছাড়া। অন্যদিকে সাধারণভাবে, পেশাদার দার্শনিকরা এমনকি অনুমানও করেননি। যখন তারা মার্কসকে উল্লেখ করে, তখন সর্বদা বিরল ব্যতিক্রমবাদে, তাকে আক্রমণ করে, নিন্দা করে, আত্মভূত করে, সুযোগ গ্রহণ করে বা বিকৃত করে।

এঙ্গেলস এবং লেনিন, যাঁরা দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন, তাঁদেরকে দার্শনিকভাবে গুরুত্বহীন ভাবা হয়। আসল সংকট হল কিছু মার্কসবাদী দার্শনিকও ‘অন্ধবিশ্বাস বিরোধীতার’ নামে এ ধরনের সংক্রমণের শিকার। কিন্তু এই এখানেও কারণ সেই একই- শ্রেণী সংগ্রামের আদর্শিক লড়াই। এটাও সেই বুর্জোয়া মতাদর্শ, বুর্জোয়া সংস্কৃতি, যারা ক্ষমতায়।

সপ্তমতঃ তত্ত্ব নিয়ে কমিউনিস্ট আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ করণীয়গুলিঃ

-মার্কসবাদী-লেনিনবাদী বিজ্ঞান ও দর্শনের বৈপ্লবিক তাত্ত্বিক কাজের সুযোগগুলোকে জানা ও স্বীকৃতি প্রদান।

-বুর্জোয়া ও পেটিবুর্জোয়া বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে লড়তে হবে-যেগুলো আজকের দিনেও সবসময় মার্কসবাদী তত্ত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ। এই বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গির সাধারণ রূপ হল ‘অর্থনীতিবাদ’ (টেকনোক্রাসি) এবং তার আধ্যাত্মিক পরিপূরক ‘নৈতিক আদর্শবাদ (আজকের মানবতাবাদ)। অর্থনীতিবাদ এবং নৈতিক আদর্শবাদ আবার বুর্জোয়াদের উত্থানপর্বে গড়ে ওঠা তাদের মৌলিক ভাবাদর্শবিরোধী। এই বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গির বর্তমান দার্শনিক রূপ হল-neo-positivism এবং এর আধ্যাত্মিক পরিপূরক ‘অস্তিত্ববাদী মহাকাব্যগত বিষয়ভিত্তিকতা’ (existential phenomenonlogical subjectivsm)।

-বিজ্ঞান এর উপর জয়লাভ করতে মানবিক বিজ্ঞানের অধিকাংশ, এবং সর্বপরি সমাজবিজ্ঞানসমূহ, ব্যতিক্রমবাদে যা আবরণে ‘ইতিহাসের মহাদেশ’ জুড়ে আছে, যে মহাদেশের চাবি মার্কস আমাদেরকে দিয়েছেন তাকে দখল করতে হবে।

-সাহস ও কঠোরতার সাথে নতুন বিজ্ঞান ও দর্শনকে বিকশিত করতে হবে এবং সেগুলোকে বিপ্লবী শ্রেণী সংগ্রামের অনুশীলন এবং উদ্ভাবনের সাথে সংগতিপূর্ণ করতে হবে।

তত্ত্বগতভাবে, এ যুগে সেই নির্ধারক সংযোগ স্থাপন করতে পারে একমাত্র মার্কসবাদী-লেনিনবাদী দর্শন।

আপাতদৃষ্টিতে দু’টি পরস্পর বিরোধী বা ভিন্ন বিষয় নিয়ে আপনি কথা বললেন; এক-দর্শন মূলতঃ রাজনৈতিক; দুই-দর্শন রাজনীতির সাথে সম্পর্কযুক্ত। আপনি কীভাবে এই দ্বৈত সম্পর্ককে ধারণ করেন?

এবারও আপনার প্রশ্নের উত্তরটি আমি কয়েকটি ধাপে সুনির্দিষ্ট করে দিতে চাই।

এক। শ্রেণী সংগ্রামের মধ্যে সংঘর্ষে শ্রেণী অবস্থানগুলি নির্ধারিত হয় পরস্পরবিরোধী প্রবণতাগুলোর বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গির বাস্তব মতাদর্শগত লড়াইয়ে জায়গাগুলোতে (ধর্মীয়, নৈতিক, আইনি, রাজনৈতিক, নান্দনিক মতাদর্শ); শেষ পর্যন্ত ভাববাদ (বুর্জোয়া) এবং বস্তুবাদের (সর্বহারা) মধ্যে। প্রত্যেকেরই স্বতঃস্ফূর্তরূপে একটি বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি আছে।

দুই। দর্শন, বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি তত্ত্বকে (বিজ্ঞান + তত্ত্ব বিজ্ঞানীর মতাদর্শ, যা বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীদের চারপাশ ঘিরে থাকে) প্রতিনিধিত্ব করে। দর্শন, তত্ত্বের মধ্যে শ্রেণী সংগ্রামকে প্রতিনিধিত্ব করে। একারণে দর্শন একটা সংগ্রাম (Kamf, বলেছেন Kant), এবং মূলতঃ রাজনৈতিক সংগ্রাম-শ্রেণী সংগ্রাম। স্বতঃস্ফূর্তভাবে সবাই দার্শনিক হতে পারে না কিন্তু প্রত্যেকের হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

তিন। তত্ত্বগত ক্ষেত্রের অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকলে দ্রুত দর্শনের অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়। বিজ্ঞান ছাড়া দর্শন নেই-শুধুমাত্র বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি। যুদ্ধ এবং যুদ্ধক্ষেত্রের অংশগ্রহণকারীদের চিহ্নিত হতে হবে। দার্শনিক সংগ্রামের চূড়ান্ত অংশ হল বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গির দুই বিরাট প্রবণতাগুলোর (বস্তুবাদী ও ভাববাদী) মধ্যে আধিপত্যের সংগ্রাম। এই সংগ্রামের প্রধান যুদ্ধক্ষেত্র বৈজ্ঞানিক জ্ঞান-হয় পক্ষে, নয় বিপক্ষে। ফলে প্রধান দার্শনিক লড়াই বাঁধে বৈজ্ঞানিক এবং ভাববাদী ক্ষেত্রগুলোতে। আদর্শবাদী দর্শন যা বিজ্ঞানকে আশ্রয় করে বস্তুবাদী দর্শন, যে কিনা বিজ্ঞানের স্বার্থ রক্ষা করে তার বিরুদ্ধে লড়াই করে। দর্শনের সংগ্রাম বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গিগুলোর মধ্যে শ্রেণী সংগ্রামেরই একটি ক্ষেত্র। অতীতে বস্তুবাদ সবসময়ই ভাববাদ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়েছে।

চার। মার্কস প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানটি তাত্ত্বিক ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন ঘটিয়েছে। এটা একটা নতুন বিজ্ঞান, ইতিহাসের বিজ্ঞান। তাই প্রথমবারের মতো এটা আমাদের বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি জানতে সাহায্য করেছে, যেখানে তত্ত্বে দর্শন প্রতিনিধিত্ব করে- আমাদের দর্শন বুঝতে সক্ষম করে। এটা বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর সংগ্রামের উপায় সরবরাহ করে (মার্কসবাদী তত্ত্বের নীতির অনুসারে পরিচালিত বিপ্লবী সংগ্রাম)। ফলে দর্শন দ্বিগুণভাবে বিপ্লবাত্মক হয়েছে। যান্ত্রিক বস্তুবাদ, ‘ইতিহাসের আদর্শবাদ’ দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ হয়ে ওঠে। শক্তিসমূহের ভারসাম্য উল্টে যায়-এখন দর্শনে বস্তুবাদ ভাববাদকে নিয়ন্ত্রণ করে, এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতি সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারলে এটি বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে আধিপত্যের জন্য শ্রেণী সংগ্রাম পরিচালনা করতে পারে।

মার্কসবাদী-লেনিনবাদী দর্শন বা দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ সর্বহারার শ্রেণী সংগ্রামে তত্ত্বকে প্রতিনিধিত্ব করে। মার্কসবাদী তত্ত্ব ও শ্রমিক আন্দোলনের ( তত্ত্ব ও অনুশীলনের একাত্বতা) মেলবন্ধন সম্পর্কে মার্কস বলেছেন, ‘ জগৎকে ব্যাখ্যা করো’। এটাই একটা অস্ত্র হয়ে ওঠে, যা দিয়ে ‘পরিবর্তন করো’- বিপ্লব।

এটাই কী তবে সেই কারণ যার জন্য আপনি বলেছেন আজকে ‘পুঁজি’ পড়া অপরিহার্য?  

হ্যাঁ, পুঁজি পড়া এবং অধ্যায়ন করা অপরিহার্য।

-সত্যিকারভাবে এর সমস্ত সুযোগ এবং তার বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক পরিণতি, দীর্ঘ অনুশীলনে সর্বহারা শ্রেণী কি বুঝলো-মার্কসবাদী তত্ত্বের বিপ্লবী চরিত্র বোঝার জন্য পুঁজি পড়া জরুরি।

-বুর্জোয়া ও পেটিবুর্জোয়াদের ব্যাখা থেকে তত্ত্বকে রক্ষা করার জন্য, বর্তমানে যা বিশাল ঝুঁকির মধ্যে আছে-প্রথমতঃ অর্থনীতিবাদ/মানবতাবাদের দিক থেকে।

-মার্কসীয় তত্ত্বকে বিকশিত এবং আজকে আমাদের দেশে ও সর্বত্র শ্রেণী সংগ্রাম ব্যাখায় বৈজ্ঞানিক ধারণাগুলো অপরিহার্যতা তুলে ধরতে।

পুঁজির অধ্যায়ন ও পাঠ অপরিহার্য। আমার যোগ করা উচিত, লেনিন এবং অন্যান্য নতুন ও পুরাতন মহৎ লেখাগুলোর পাঠ এবং অধ্যায়নও জরুরি, প্রয়োজনীয়- যে সব লেখা আন্তর্জাতিক শ্রমিক আন্দোলনের অভিজ্ঞতাকে তুলে ধরে। বিপ্লবী শ্রমিক আন্দোলনের বাস্তব অভিজ্ঞতা, তাদের দ্বন্দ্ব ও সমস্যাগুলি, তাদের অতীত এবং সর্বপরি বর্তমান ইতিহাসে বাস্তব কাজগুলি অধ্যায়ন জরুরি।

আজ আমাদের দেশগুলোতে বিপ্লবী শ্রেণী সংগ্রামের জন্য প্রচুর সম্পদ রয়েছে। কিন্তু শোষিত জনগণের মধ্যে তাদের অবস্থানটি ঠিক কোথায় সেটা তাদের অবশ্যই খুঁজে দেখতে হবে। জনগণের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছাড়া, মার্কসবাদী-লেনিনবাদী তত্ত্বের হাতিয়ার ছাড়া তারা সেটা ‘আবিষ্কার’ করতে পারবে না। ‘শিল্প সমাজ’, ‘নব্য পুঁজিবাদ’, ‘নতুন শ্রমিক শ্রেণী’, ‘সমৃদ্ধ সমাজ’, ‘বিচ্ছিন্নতা’ এবং ‘tutti quanti’ সংক্রান্ত বুর্জোয়া মতাদর্শিক ধারণাসমূহ বিপ্লব ও মার্কসবাদ বিরোধী- এগুলো বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য নির্মিত।

তাই আমার আরো একটি মন্তব্য যোগ করা উচিত-সেটা সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ।

এই তাত্ত্বিক, রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক কাজগুলো কোন একজন কীভাবে পড়ছে বা অধ্যায়ন করছে সেটা বোঝার জন্য একজনকে সরাসরি নিজের দু’টি বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হবে; যার মাধ্যমে নির্ধারিত হবে-বাস্তব জীবনে তত্ত্ব প্রয়োগের অভিজ্ঞতা (বিজ্ঞান ও দর্শন); জনগণের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ; বাস্তব জীবনে বিপ্লবী শ্রেণী সংগ্রামের অভ্যাসের বাস্তবতা। যদি তত্ত্ব আমাদের ইতিহাসের নিয়ম বুঝতে সক্ষম করে তবে সেটা বুদ্ধিজীবীও নয়, তাত্ত্বিকও নয়, এটা সেই জনসাধারণ, যারা ইতিহাস তৈরি করে। তত্ত্বের সাথে শেখাটাও জরুরি- কিন্তু একই সাথে জনগণনের কাছ থেকে শেখাটা অধিক গুরুত্বপূর্ণ।

আপনি শক্তিশালী শব্দভান্ডারসহ কঠোর পরিশ্রমকে অধিক গুরুত্ব দেন। কেন?

একটি একক শব্দ দার্শনিক প্রয়োগের প্রধান কাজকে প্রকাশ করতে পারে-‘বিভাজন লাইন আঁকো’ সত্য এবং মিথ্যা ধারণাগুলোর মধ্যে। কথাটা লেনিনের।

কিন্তু একই শব্দ শ্রেণী সংগ্রামের অনুশীলনের দিক থেকে অপরিহার্য ক্রিয়াকলাপগুলোকে তুলে ধরে-শত্রুভাবাপন্ন শ্রেণীগুলোর মধ্যে ‘একটি বিভাজন লাইন আঁকতে’-আমাদের শ্রেণী বন্ধু এবং শ্রেণী শত্রুর মধ্যে।

এটা একই শব্দ। সত্য ধারণা এবং মিথ্যা ধারণার মধ্যে একটি তাত্ত্বিক বিভাজক। মানুষের মধ্যে একটি রাজনৈতিক বিভাজক লাইন (সর্বহারা ও তার সহযোগীরা) এবং জনগণের শত্রুরা।

তাত্ত্বিকভাবে দর্শন জনগণের শ্রেণী সংগ্রামকে প্রতিনিধিত্ব করে। পরিবর্তে এটা তত্ত্ব ও সব  ধারণাগুলির মধ্যে (রাজনৈতিক, নৈতিক, নান্দনিক, ইত্যাদি) পার্থক্য এবং সত্য ও মিথ্যা ধারণাগুলোর মধ্যে পার্থক্য করতে সাহায্য করে। মূলতঃ সত্য ধারণা সবসময় মানুষের স্বার্থ রক্ষা করে আর মিথ্যা ধারণা সবসময় জনগণের শত্রুদের স্বার্থ রক্ষা করে।

কেন দর্শন শব্দ নিয়ে লড়াই করে? শ্রেণী সংগ্রামের বাস্তবতাগুলি ‘আইডিয়াকে’ প্রতিনিধিত্ব করে, আর যেটা শব্দের উপর দাঁড়িয়ে আছে। বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক যুক্তিতে, শব্দগুলি জ্ঞানের ‘কলকব্জা’। কিন্তু রাজনৈতিক, মতাদর্শিক ও দার্শনিক সংগ্রামে শব্দগুলোও অস্ত্র, বিস্ফোরক, বা ট্রানকুইলার বা বিষাক্ত। মাঝে মাঝে পুরো শ্রেণীর সংগ্রামকে, অন্য শব্দের বিরুদ্ধে একটি শব্দের সংগ্রামে সংকলিত করা যেতে পারে। কিছু শব্দ শত্রুর মতো নিজেদের মধ্যেই লড়াই করে। অন্য শব্দগুলো অস্পষ্ট হতে পারে-কিন্তু এটা নিস্পত্তিমূলক এবং অনিশ্চিত যুদ্ধের অংশ।

উদাহরণস্বরূপ, কমিউনিস্টরা শ্রেণী শোষণের বিরুদ্ধে এবং সাম্যবাদী সমাজের জন্য লড়াই করে- যে সমাজে একদিন মানুষ মুক্ত হবে এবং পরস্পরের ভাই হবে। যাইহোক, শাস্ত্রীয় সব মার্কসীয় ঐতিহ্য বলতে অস্বীকার করেছে যে মার্কসবাদ ‘মানবতাবাদ’। কেন? কারণ, বাস্তবে এবং প্রকৃতপক্ষে ‘মানবতাবাদ’ শব্দটি একটি মতাদর্শ দ্বারা ব্যবহৃত-যারা শব্দটিকে ব্যবহার করে যুদ্ধের জন্য, অর্থাৎ হত্যার জন্য-তাই শব্দ সর্বহারা শ্রেণীর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ শ্রেণী সংগ্রাম।

উদাহরণস্বরূপ, বিপ্লবীরা জানে যে, শেষ পর্যন্ত সব কিছু কৌশল, অস্ত্র ইত্যাদির উপর নির্ভর করে না; করে যোদ্ধাদের উপর, তাদের শ্রেণী চেতনার উপর, তাদের নিষ্ঠা এবং সাহসের উপর। যাইহোক, সমগ্র মার্কসীয় ঐতিহ্য বলতে অস্বীকার করে যে একটা ‘মানুষ’ ইতিহাস তৈরি করেছে। কেন? কারণ বাস্তবে অর্থাৎ আসলে এই অভিব্যক্তি বুর্জোয়া মতাদর্শ দ্বারা চর্বিত জিনিষ-যা ব্যবহৃত হয় যুদ্ধের জন্য-খুন করতে। সর্বহারার জন্য সত্য হল- এটা সেই জনগণ, যারা ইতিহাস সৃষ্টি করে।

একই সাথে, দর্শন এমনকি লম্বা কাজগুলোতে যেখানে এটা সবচেয়ে বিমূর্ত এবং কঠিন, শব্দের উপর জোর দেয়-মিথ্যা কথাগুলোর বিরুদ্ধে, অস্পষ্ট শব্দগুলির বিরুদ্ধে, সঠিক শব্দের জন্য। এটা মতামতের ছায়ার বিরুদ্ধে লড়াই।

লেনিন বলছেন- শুধুমাত্র স্বল্প দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ দ্বন্দ্ব বিরোধী হতে পারে এবং মতামতের ছায়া বা অপ্রয়োজনীয় মতামতের মধ্যে কঠোর বৈপরীত্য বিবেচনা করতে পারে। অনেক বছর ধরে রাশিয়ার স্যোসাল ডেমোক্রেটদের ভাগ্য হয়তো এক বা অন্য ‘ছায়া’র শক্তিশালীকরণের উপর নির্ভর করে (‘কী করিতে হইবে?’)।

শব্দের জন্য দার্শনিক যুূ্দ্ধ রাজনৈতিক যুদ্ধেরই অংশ। মার্কসবাদী-লেনিনবাদী দর্শনটি শুধুমাত্র এর বিমূর্ত, কঠোর ও পদ্ধতিগত তাত্ত্বিক কাজটি সম্পন্ন করতে পারে এই শর্তে যে এটা খুব ‘ভন্ডামীপূর্ণ’ শব্দগুলি (ধারণা, তত্ত্ব, দ্বান্দ্বিক,  বিচ্ছিন্নতা, ইত্যাদি) এবং সাধারণ শব্দগুলি (মানুষ, আমজনতা, জনগণ, শ্রেণী সংগ্রা) উভয়ের বিরুদ্ধে লড়াই করে।

Facebook Comments

comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top