পার্পল হিবিস্কাস (পর্ব ১১) // চিমামান্ডা নগোজি আদিচে, ভাষান্তর: দিলশাদ চৌধুরী

একটা ধুলোময় হালকা হাওয়ার বেগ উড়ে এলো, বাদামি চক্রে পাক খেতে খেতে প্যাচ খুলে যাওয়া স্প্রিংয়ের মত আর আমি জিভে ঠোঁটের ওপর বসে যাওয়া বালির স্বাদ পেলাম।

” তোমার কি মনে হয় কেন আমি এত কষ্ট করি তোমাকে আর জাজাকে শ্রেষ্ঠ জিনিসটা দেয়ার জন্য? এসব সুবিধা নিয়ে তো তোমাদের ভালো কিছু করে দেখাতে হবে। কারণ ঈশ্বর তোমাদের বেশি দিয়েছেন, তার আশাও তোমাদের ওপর বেশি। তিনি পরিপূর্ণতা চান। আমার এমন বাবা ছিল না যে কিনা আমায় শ্রেষ্ঠ কোনো স্কুলে পাঠাবে। আমার বাবা কাঠপাথরের ঈশ্বরের পূজা করে সময় কাটাত। আমি আজকের অবস্থানে কোনোদিন পৌঁছাতে পারতাম না যদি না মিশনের যাজক আর ভগিনীরা থাকত। আমি দুই বছর যাজকপল্লীর এক যাজকের বাড়ির কাজের ছেলে ছিলাম। হ্যাঁ, একজন কাজের ছেলে। কেউ আমায় স্কুলে দিয়ে আসত না। আমি প্রতিদিন আট মাইল হেঁটে নিমোতে যেতাম যতদিন না আমার প্রাথমিক শিক্ষা শেষ হলো। আমি সেন্ট গ্রেগরিস মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময় যাজকদের বাড়িতে মালির কাজ করতাম।

আমি এসব আগেও শুনেছি, কতটা কষ্ট সে করেছে, মিশনারির রেভারেন্ড ভগিনী আর যাজকেরা কতকিছুই না তাকে শিখিয়েছে, সেসব জিনিস যেগুলো সে কখনোই তার মূর্তিপূজক বাবার থেকে শিখতে পারত না, আমার দাদাজান নুকোউ। কিন্তু তবুও আমি মাথা নাড়তে থাকলাম এবং মনোযোগী ভাব করলাম। আশা করি আমার ক্লাসের মেয়েরা ভাবছে না যে কেন আমি আর আমার বাবা এত লম্বা কথোপকথন চালানোর জন্য স্কুলে এসে ক্লাসের সামনের অংশটাকেই বেছে নিলাম।

শেষমেশ বাবা থামলো আর আয়নাটা নিয়ে নিলো। ” কেভিন এসে তোমায় বাড়ির জন্য তুলে নেবে,”  বললো।

” আচ্ছা, বাবা।”

” আসি, ভালোভাবে পড়াশোনা করো।” সে আমায় জড়িয়ে ধরলো, একটা সংক্ষিপ্ত পার্শ্ব আলিঙ্গন।

” বিদায় বাবা।”

সমাবেশের ঘন্টা পড়ার আগ অব্দি আমি তাকে ফুলহীন সবুজ ঝোপ দিয়ে সীমানা করা পথ ধরে চলে যেতে দেখলাম। সমাবেশ ছিল যেন মাছের বাজার, আর মাদার লুসিকে শেষ পর্যন্ত বলতেই হলো, ” এখন মেয়েরা, সবাই একটু চুপ করি আমরা,” বেশ কয়েকবার। আমি সবসময়ের মত সামনের সারিতে দাঁড়ালাম। কারণ পেছনের সারি ছিল সেসব মেয়েদের জন্য যারা বিভিন্ন বন্ধুদলের অংশ, সেসব মেয়েরা যারা খিলখিল করে হাসত আর ফিসফিস করে কথা বলত আর একে অন্যকে শিক্ষকদের থেকে বাঁচাতো। শিক্ষকেরা উত্তোলিত মঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে গেলো দীর্ঘ ভাস্কর্যের মত তাদের নীল সাদা পোশাকে।

ক্যাথলিক প্রশস্তিমালা থেকে একটা উদ্বোধনী গান গাইবার পর মাদার লুসি, ম্যাথু, পরিচ্ছদ পাঁচের এগারো নং স্তবক পর্যন্ত পড়লেন, আর তারপর আমরা জাতীয় সংগীত গাইলাম। জাতীয় সংগীত গাওয়া ডটার্স অফ দি ইমাকুলেট হার্টের তুলনামূলক নতুন সংযোজন। এটা শুরু হয়েছে গতবছর কারণ কিছু অভিভাবক চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন যে তাদের বাচ্চারা জাতীয় সংগীত বা শপথ সম্পর্কে জানে না। আমি গাইতে গাইতে ভগিনীদের দেখলাম। কেবল নাইজেরিয়ার রেভারেন্ড ভগিনীরাই গাইছিল, তাদের কালো ত্বকে ঔজ্জ্বল্য ছড়িয়ে দিচ্ছিল তাদের দাঁত। শ্বেতাঙ্গ রেভারেন্ড ভগিনীরা হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে ছিল, অথবা কটিদেশে ঝুলতে থাকা কাঁচের স্তবমালার দানাগুলো হালকা করে ছুঁয়ে, সাবধানতার সাথে লক্ষ্য করছিল যে প্রতিটি শিক্ষার্থীর ঠোঁট নড়ছিল কিনা।

তারপরে, মাদার লুসি তার মোটা চশমার আড়ালে চোখদুটো কুঞ্চিত করে সারিগুলো পর্যবেক্ষণ করলেন। তিনি সবসময় একজন শিক্ষার্থী বাছাই করে নিতেন শপথ শুরু করার জন্য, বাকিরা তার সাথে যোগ দিত। “কাম্বিলি আচিকে, দয়া করে শপথ শুরু করো,” সে বলল।

মাদার লুসি এর আগে কখনোই আমাকে বেছে নেয়নি। আমি মুখ খুললাম, কিন্তু কোনো শব্দই বেরিয়ে এলো না।

“কাম্বিলি আচিকে?” মাদার লুসি আর স্কুলের বাকিরা ঘুরে আমার দিকে তাকাতে লাগল। আমি গলা পরিস্কার করলাম, চেষ্টা করলাম যাতে শব্দগুলো বেরিয়ে আসে। আমি জানি শব্দগুলো, ওগুলো আমার মাথায় আছে, কিন্তু মুখে আসছে না। আমার হাতের নিচ ভেজা গরম ঘামে ভিজে উঠছিল।

“কাম্বিলি?” অবশেষে, তোতলাতে তোতলাতে, আমি বললাম, ” আমি শপথ করছি নাইজেরিয়ার প্রতি, আমার দেশ বিশ্বাসী, অনুগত এবং সৎ হয়ে ওঠার পক্ষে…” বাকি সবাই যোগ দিলো, আর আমি সাথে সাথে বলতে বলতে নিজের নিঃশ্বাস ধীর করার চেষ্টা করতে লাগলাম।

সমাবেশের পর আমরা ক্লাসরুমে ফিরলাম। আমার ক্লাস যে নিয়মে যায় তা হলো বসা, চেয়ার চাঁছা, ডেস্ক মোছা, বোর্ডে লেখা নতুন সাময়িকীর সময়সূচি খাতায় তোলা। “তোমার ছুটি কেমন কাটলো কাম্বিলি?” ইজিন পেছনের দিকে এলিয়ে জিজ্ঞেস করলো।

” ভালোই।”

” তুমি কি বিদেশে গিয়েছিলে?”

“নাহ,” আমি বললাম। আমি জানতাম না যে আর কি বলা যেতে পারে, কিন্তু আমি ইজিনকে জানাতে চাইছিলাম যে আমি অদ্ভুত এবং জিভ-জড়ানো জবুথবু মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও ও যে আমার সাথে সুন্দরভাবে মেশে, তাতে আমি অনেক খুশি হই। আমি বলতে চাইছিলাম যে ধন্যবাদ আমাকে নিয়ে হাসাহাসি না করার জন্য, আমাকে অন্য মেয়েদের মত “ঘরকুনো নাক উঁচু” না ডাকার জন্য। কিন্তু সেসবের বদলে বেরিয়ে এলো, “তুমি কি গিয়েছিলে বিদেশে?”

ইজিন হাসলো। “আমি? ও ঈশ্বর! বিদেশে যায় তোমার মত কিংবা গ্যাব্রিয়েলা, চিনউইর মত যারা আছে তারা, যাদের বড়লোক পরিবার আছে। আমি তো কেবল গ্রামে গেছি আমার দাদীর সাথে দেখা করতে।”

“ওহ”, আমি বললাম।

” তোমার বাবা আজ সকালে কেন এসেছিলেন?”

” আমি… আমি…” এক মূহুর্ত থেমে আমি নিশ্বাস নিয়ে নিলাম কারণ আমি জানতাম যে তা না করলে তোতলানি আরও বাড়বে। ” বাবা আমার ক্লাস দেখতে চাইছিল।”

” তোমাকে দেখতে অনেকটা ওনারই মত। মানে, অমন বড় নয়, কিন্তু চেহারা আর রঙ একই রকম,” ইজিন বললো।

” হ্যাঁ।”

” শুনলাম চিনউই নাকি শেষ পরীক্ষায় তোমার প্রথম হবার জায়গাটা নিয়ে নিয়েছে, সত্যি?”

” হুম।”

” তোমার বাবা- মা নিশ্চয়ই কিছু মনে করেননি। আহ! আহ! তুমি তো সেই প্রথম থেকেই প্রথম হয়ে আসছ। চিনউই বললো ওর বাবা নাকি ওকে লন্ডন নিয়ে গিয়েছে।”

” ওহ।”

” আমি পঞ্চম হয়েছি, আমার জন্য যদিও এটা একটা উন্নতি, কারণ আমি তার আগেরবার অষ্টম হয়েছিলাম। জানোই তো, আমাদের ক্লাসটায় খুব প্রতিযোগিতা। আমার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আমি সবসময় প্রথম হতাম।”

চিনউই জিদেজে তারপর ইজিনের টেবিলে এলো। ওর কণ্ঠ ছিল জোরালো, পাখির মত। “আমি এ বছরেও শ্রেণি প্রতিনিধি থাকতে চাই। ইজি প্রজাপতি, ভোটটা আমাকেই দিও,” চিনউই বললো। ওর স্কুল স্কার্টটা ছিল কোমরের কাছে আঁটসাঁট যেটা কিনা ওর পুরো শরীরকে ইংরেজি আট সংখ্যার মত দুটো গোল ভাগে ভাগ করছিলো।

” নিশ্চয়ই,” ইজিন বললো।

চিনউই যখন আমাকে উপেক্ষা করে পরবর্তী ডেস্কের মেয়েটার কাছে গেল, আমি অবাক হলাম না। ওর ভেবে রাখা নতুন এক ডাকনাম লাগিয়ে ইজিনকে বলা কথাগুলোর পুনরাবৃত্তি করলো। চিনউই কখনোই আমার সাথে কথা বলেনি, এমনকি যখন আমাদের একই কৃষিবিজ্ঞান দলে দেয়া হয়েছিলো একটা অ্যালবামের জন্য আগাছা খোঁজ করতে, তখনও নয়। মেয়েরা ওর ডেস্কের সামনে ভিড় করে ছোট বিরতির সময়, প্রায়ই ওদের হাসির শব্দ ভেসে আসে। ওদের চুলের ধরনও সাধারণত চিনউইরই হুবহু নকল হতো — কালো, সুতোয় ঢাকা খন্ডচুল যদি চিনউই ওই সপ্তাহে ইসি ওউ করে, অথবা এলোমেলো কর্ণরো যেটা ঝুঁটিতে গিয়ে সমাপ্ত হয় যদি চিনউই ওই সপ্তাহে শুকু করে। চিনউই হাঁটতো যেন ওর পায়ের নিচে কোনো গরম কিছু রাখা আছে, এক পা মাটিতে দেয়ার সাথে সাথেই অন্য পা তুলে ফেলত। বড় বিরতিতে একদল মেয়ের সামনে লাফিয়ে নেতৃত্ব দিতে দিতে ও খাবারের দোকানের দিকে যেত বিস্কুট আর কোক কিনতে। ইজিনের মোতাবেক, সবার কোকের টাকা চিনউই দিত। আমি সাধারণত বড় বিরতি কাটাতাম লাইব্রেরিতে বই পড়ে।

” চিনউই চায় তুমি ওর সাথে আগে কথা বলো,” ইজিন ফিসফিস করে বলে। ” জানো, ও তোমায় ঘরকুনো নাক উঁচু ডাকা শুরু করেছিলো কারণ তুমি কারো সাথে কথা বলো না। ও বলে, শুধু তোমার বাবা একটা পত্রিকা আর ওই ফ্যাক্টরিগুলোর মালিক বলে তোমার নিজেকে এত বড় কিছু ভাবার উচিত না, কারণ ওর বাবাও যথেষ্ট বড়লোক।”

” আমি নিজেকে বড় কিছু ভাবি না।”

” যেমন আজকে, সমাবেশের সময়, ও বলছিল যে তুমি নিজেকে অনেক বড় কিছু ভাবো, তাই মাদার লুসির প্রথমবার ডাকতেই শপথ শুরু করোনি।”

” মাদার লুসির প্রথম ডাক আমি শুনতে পাইনি।”

(চলবে….)

Facebook Comments

comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top