কথাসাহিত্যিক রশীদ করীমের ৯৬তম জন্মদিনে স্মৃতিকাহন ।। গোলাম ফারুক খান

আজ সকালে ঘুম থেকে উঠেই সুদূর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভগিনীপ্রতিম নাবিলা মুরশেদের একটি মন-ভালো-করা বার্তা পেলাম। নাবিলা আর আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একই বিভাগে পড়েছি। আমি আগে, নাবিলা আমার বেশ ক-বছর পর। অবশ্য তিনি ইতিমধ্যেই একজন সুখী মাতামহী বনে গেছেন। খুব ভালো মানুষ নাবিলা। তার চেয়েও বড় কথা, তাঁর পিতা রশীদ করীম (১৯২৫-২০১১) আমার খুব প্রিয় একজন কথাসাহিত্যিক। নাবিলা জানিয়েছেন, এবার ‘ঐতিহ্য’ নামের প্রকাশনী সংস্থা থেকে রশীদ করীমের রচনাবলি বেরোচ্ছে। খবরটা পেয়ে অত্যন্ত খুশি হয়েছি।
‘চন্দ্রশেখর’ উপন্যাসে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘বাল্যকালের ভালবাসায় বুঝি কিছু অভিসম্পাত আছে। যাহাদের বাল্যকালে ভালবাসিয়াছ, তাহাদের কয়জনের সঙ্গে যৌবনে দেখা সাক্ষাৎ হয়? কয়জন বাঁচিয়া থাকে?… বার্ধ্যক্যে বাল্যপ্রণয়ের স্মৃতিমাত্র থাকে, আর সকল বিলুপ্ত হয়। কিন্তু সেই স্মৃতি কত মধুর!’ আমি ভাবছিলাম, বঙ্কিমের এই মধুর অভিসম্পাত সাহিত্যপাঠের বেলায়ও হয়তো প্রযোজ্য। ছেলেবেলায় ভালো-লাগা সাহিত্যের আবেদন কখনো বুঝি কমে না। এই ভালো লাগার স্মৃতি অনেক ক্ষেত্রেই প্রৌঢ় বয়সে মধুর থেকে মধুরতর হয়ে ওঠে। বহমান জীবনের রোদ-বৃষ্টি-ঝড় কিংবা পরিণত বয়সের খুঁতখুঁতে মনও তাকে ঝেড়ে ফেলতে পারে না।
রশীদ করীমের সাহিত্য আমার জন্য এরকম বাল্য-প্রণয়ের মধুর অভিসম্পাত হয়ে আছে। জীবনের অনেক ঝড়জল পেরিয়ে এসেও তাঁকে আমি ভুলতে পারিনি। মাঝেমাঝে সমালোচকের বাঁকা চোখ দিয়ে দেখতে চাইলেও তাঁর গুরুত্ব আমার কাছে বিন্দুমাত্র কমেনি। অথচ তিনি মহানগর কলকাতার অত্যন্ত বিদগ্ধ পরিমণ্ডলে জাত ও লালিত একজন লেখক। তাঁর লেখালেখি আগাগোড়াই নাগরিক জীবনের নানা জটিলতা ও সংকট নিয়ে। আর আমি যখন তাঁর লেখা প্রথম পড়ি, তখন ছিলাম বৃহৎ বাংলার উন্মুক্ত নিসর্গের কোলে বাড়তে থাকা এক কিশোর। পড়ি সপ্তম শ্রেণিতে আর মনে মনে বিভূতিভূষণের অপুর সঙ্গে ঘুরে বেড়াই নিশ্চিন্দিপুরের পথেঘাটে ও বনেবাদাড়ে। কিন্তু অসুবিধা হয়নি রশীদ করীমের নাগরিক চরিত্রদের সঙ্গে একাত্ম হতে। এখানেই হয়তো উৎকৃষ্ট সাহিত্যের জিত। তা অনায়াসে পেরিয়ে যায় কাল-পটভূমির সীমা।
শৈশবে আমাদের বাড়িতে পড়াশোনার কোনো বাঁধাধরা গণ্ডি ছিল না। বড়দের বইও ইচ্ছেমতো পড়ার স্বাধীনতা দিয়েছিলেন আমার পিতা। তিনি ছিলেন কবি সিকানদার আবু জাফর সম্পাদিত বিখ্যাত সাহিত্যপত্র ‘সমকাল’-এর নিয়মিত গ্রাহক। সেখানে ধারাবাহিকভাবে রশীদ করীমের প্রথম উপন্যাস ‘উত্তম পুরুষ’-এর একটা বড় অংশ প্রকাশিত হয়েছিল। বাড়িতে জমে থাকা ‘সমকাল’-এর পুরনো সংখ্যা ঘাঁটতে ঘাঁটতে আমি এ উপন্যাসের অনেকটাই পড়ে ফেলি। যথারীতি বাকিটুকু পড়ার তৃষ্ণা প্রবল হয়ে ওঠে। খবর পেয়ে যাই, ‘উত্তম পুরুষ’ ১৯৬১ সালেই বই হিসেবে বেরিয়ে গেছে এবং সে বছরই আদমজি সাহিত্য পুরস্কারও পেয়েছে। সৌভাগ্যক্রমে ১৯৬৯ সালে আমার বড়ভাই ঢাকা থেকে অন্য অনেক বইয়ের সঙ্গে ‘উত্তম পুরুষ’ এবং লেখকের দ্বিতীয় উপন্যাস ‘প্রসন্ন পাষাণ’ (১৯৬৩) কিনে নিয়ে যান। প্রথম সুযোগেই একটা ঘোরের মধ্যে আমি দুটি উপন্যাস পড়ে ফেলি। প্রথম উপন্যাসটির নায়ক শাকের আর দ্বিতীয় উপন্যাসটির নায়ক কামিল। দুজনই কিশোর — প্রায় আমার বয়সী। তাদের জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাত, বিশেষ করে বয়ঃসন্ধির নানা স্বপ্নিল অনুভূতি ও যন্ত্রণা আমাকে আবিষ্ট করে ফেলে। ‘প্রসন্ন পাষাণ’-এ ব্যবহার করা হয়েছিল শামসুর রাহমানের কিছু কবিতা। সে কবিতা এখনো আমার স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করছে। বিশেষ করে এই পঙক্তিগুলো:
‘এই পৃথিবীর ছায়া আর রোদ
অবুঝ মনকে দিচ্ছে প্রবোধ:
জীবনের সব জটিল প্রশ্নে
ওরে হঠকারী অধীর হোসনে!
পিতৃহন্তা ভাগ্যের তূণ
জীবনে ছড়ায় নিদারুণ ঘুণ
প্রেম বটে এক ব্যঙ্গ অপার
লোক-হাসানোই সমারোহ তার।…’
নায়ক কামিলের জীবনের সংকটের সঙ্গে এই পঙক্তিগুলো দারুণভাবে মিলে গিয়েছিল।
এর আগে আমি বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্রের লেখার পাশাপাশি কিছু মুসলিম-রচিত উপন্যাসও পড়েছিলাম। তার মধ্যে ছিল নজিবর রহমান সাহিত্যরত্নের ‘আনোয়ারা,’ ও ‘প্রেমের সমাধি,’ আবুল ফজলের ‘রাঙ্গা প্রভাত,’ কাজী আফসার উদ্দীন আহমদের ‘চর ভাঙ্গা চর’ ইত্যাদি। কিন্তু রশীদ করীমের উপন্যাস দুটি পড়ে সেই অল্প বয়সেই আমি বুঝতে পারলাম তাঁর ভাষা, প্রকরণ এবং বিষয় পূর্ববর্তী মুসলিম লেখকদের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। এ ধরনের কথাসাহিত্যকে পৃথক কোনো বর্গে চিহ্ণিত করা হয় কিনা কিংবা তার আঙ্গিকের কোনো স্বতন্ত্র উৎস আছে কিনা, সেটি আমি তখনো জানতাম না। সাহিত্যে আধুনিকতা ও অনাধুনিকতার বিতর্ক সম্পর্কেও স্বাভাবিকভাবেই আমার কণামাত্র ধারণা ছিল না। কিন্তু বুঝতে পারছিলাম, পাঠক হিসেবে এক ভিন্ন জগতে আমি পা রেখেছি।
ইতিমধ্যে মুক্তিযুদ্ধ হলো, বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। ‘সাপ্তাহিক বিচিত্রা’ নামে নতুন একটি পত্রিকা বাড়িতে আসতে শুরু করল। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমিও তো বড় হচ্ছিলাম। পাঠ-পরিধি একটু-একটু করে বাড়ছিল। ‘বিচিত্রা’য় পড়লাম রশীদ করীমের সাড়াজাগানো কলাম ‘মানুন আর নাই মানুন।’ এতদিন পরে নামটা নিয়ে আমার একটু সংশয় হচ্ছে। নাবিলা বলতে পারবেন ঠিক লিখেছি কিনা। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ‘সচিত্র সন্ধানী’ পত্রিকায় তাঁর আরো একটি কলাম পড়লাম যার নাম এখন বেমালুম ভুলে গেছি। তবে এসব কলামের স্বাদ এবং পাঠের মুগ্ধতা কখনোই ভুলতে পারি না। নিঃসঙ্কোচে স্বীকার করি, আমার সাহিত্যশিক্ষা ও রুচিগঠনে রশীদ করীমের এই কলামগুলোর অনেক অবদান আছে।
এর পর একে একে পড়লাম তাঁর উপন্যাস ‘আমার যত গ্লানি,’ ‘প্রেম একটি লাল গোলাপ,’ ‘সাধারণ লোকের কাহিনী,’ ‘শ্যামা,’ ‘বড়ই নিঃসঙ্গ,’ ‘মায়ের কাছে যাচ্ছি’ ইত্যাদি। এইসব উপন্যাস রশীদ করীমের পরিণত বয়সের কাজ। প্রতিটি লেখায়ই অনেক বড়মাপের একজন কথাসাহিত্যিকের হাতের ছাপচিহ্ণ লেগে আছে। আবু সয়ীদ আইয়ুবের আত্মীয় এবং স্নেহধন্য এই লেখক ছিলেন অত্যন্ত বিদগ্ধ। স্কুলে পড়ার সময়েই আইয়ুব তাঁকে পড়তে বলেছিলেন ‘থ্রি মেন ইন আ বোট,’ ‘আ পোর্ট্রেট অব দি আর্টিস্ট য়্যাজ আ ইয়াং ম্যান’ এবং আরো কিছু বিখ্যাত বই। তাঁর অগ্রজ আবু রুশদও আমাদের একজন অগ্রণী কথাকার। পরিবারের এইসব দীপ্তিমান মানুষের প্রভাব তো রশীদ করীমের উপর ছিলই, তাছাড়া ছেলেবেলা থেকেই গভীর অভিনিবেশ নিয়ে তিনি সাহিত্য, বিশেষ করে ইয়োরোপীয় সাহিত্য, পাঠ করেছিলেন। ফিওদর দস্তইয়েভস্কি, জোসেফ কনরাড, জেমস জয়েস, ফ্রাঞ্জ কাফকা, ডি এইচ লরেন্স প্রমুখ লেখকের জীবনবোধ ও আঙ্গিক থেকে নেওয়া শিক্ষা গভীরভাবে চারিয়ে আছে রশীদ করীমের লেখায়।
অনেকদিনের ইচ্ছে, আমাদের সাহিত্যে রশীদ করীমের অবস্থান ও গুরুত্ব নিয়ে আমার সাধ্যমতো একটু বিস্তৃতভাবে লিখব। ফেসবুকের সীমিত পরিসরে নয়, তার বাইরে। এখনো তা হয়ে ওঠেনি। নাবিলাকে দু-একবার বলেওছি, কিন্তু কথা রাখতে পারিনি।
আজ রশীদ করীমের ৯৬তম জন্মদিনে চটজলদি গেঁথে-তোলা এই সামান্য স্মৃতিকাহন দিয়েই তাঁকে গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। স্বীকার করছি অসীম কৃতজ্ঞতার ঋণ।

Facebook Comments

comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top