ঘুম // ইনতেজার হুসেইন, উর্দু থেকে অনুবাদ: সালেহ ফুয়াদ

জুফর ওকে দেখে অবাক হয়—আরে সালমান, তুমি? তুমি ফিরে এলে? কিভাবে সম্ভব!
কিভাবে এসেছি জানতে চেয়ো না। একভাবে এসে গেছি।
জুফর বুঝতে পারছিল না কী বলবে—ওখান থেকে জীবিত ফিরে আসাটা তো অলৌকিক ব্যাপার।
হুঁ, ধরে নাও অলৌকিকই। হায়াত ছিল, ফিরে এসেছি।
তার ফিরে আসতে পারায় অবাক শুধু জুফরই নয়, সে নিজেও—আমি নিজেও ভেবে অবাক হই যে, ওখান থেকে কিভাবে বেরিয়ে আসতে পেরেছি।
জুফর অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। ওখান থেকে বেঁচে ফেরাদের মধ্যে ও-ই প্রথম যার সঙ্গে জুফরের সাক্ষাত হয়েছে। তার কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না, ওখান থেকে কিভাবে কেউ বেঁচে আসতে পারে। সে সালমানকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত ভালো করে একবার দেখে, সালমান তুমি ওখান থেকে বেরুলে কিভাবে?
আমি কিভাবে বের হয়ে এলাম—সে বিড়বিড় করে। ইচ্ছে হয় এক নিশ্বাসে তার পুরো ঘটনা শুনিয়ে দেয়। কিন্তু আশেপাশে তাকিয়ে থেমে যায়, দোস্ত, দু’চারটে শব্দে তো আর সব বলা যাবে না। এ এক দীর্ঘ কাহিনি। শুনলে তোমার মাথা খারাপ হয়ে যাবে।
ঠিকই বলেছ, আমরা মুখে মুখে শুনেই তো শিউরে উঠছি, আর তুমি তো সব কিছু চাক্ষুষ দেখে এসেছ।
সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, হুঁ, নিজের চোখেই সব দেখেছি।
সেসব যন্ত্রণাদায়ক দৃশ্যাবলি তার চোখে ভাসতে থাকে, এত এত দেখেছি… ছাড়ো, অনেক কিছুই দেখেছি।
কিছুটা তো শোনাও।
ফের তার ইচ্ছে হয় শুরু করে কিন্তু আবারো নিজেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে, শুনানোর মতো আমার কাছে অনেক কিছুই আছে কিন্তু এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী শোনাব?
জুফর জিজ্ঞেস করে, সন্ধ্যায় কী করছো?
সকাল কী সন্ধ্যা, আমার কাছে করার আর কী-ইবা আছে!
তাহলে সন্ধ্যায় আমার ওখানে চলে এসো।
হুঁ, চলে আসব।
আসলামকে ফোন করে দেবো, সে-ও চলে আসবে।
জিদ্দি আসলাম? বলো কি, ও এখানে?
এখানে না তো কপালপোড়া আর যাবে কই।
আর জাইদি? ও কোথায়?
ঠিক আছে, ওই বাচালটাকেও ডেকে নেব। শিওর আসবে তো?
হুঁ, শিওর।
জুফর বাসায় পৌঁছেই দ্রুত ডায়াল করে—হ্যালো আসলাম, জুফর বলছি, দোস্ত সালমান ফিরে এসেছে!
সালমান? …ধুর! কী বলছিস এসব?
আরে হ্যাঁ, ও চলে এসেছে।
ও ওখান থেকে জীবিত ফিরে এসেছে? কিন্তু কিভাবে?
সন্ধ্যায় এসো, তারপর নিজেই জিজ্ঞেস করে নিয়ো।
ঠিক আছে, আসছি।
এরপর সে জাইদির অফিসে ফোন করে—হ্যালো জাইদি, ভাই জাইদি সাহেবকে ফোনটা দিন তো… হ্যালো জাইদি… আরে আমি জুফর বলছি…আরে দোস্ত তোমাকে একটা দারুণ খবর দেবো।
বলো বলো।
সালমান চলে এসেছে।
সালমান… ধুর নাহ, এ-ও হয় নাকি!
আরে হ্যাঁ, ও বেরিয়ে এসেছে।
আচ্ছা, এখন তাহলে কোথায় আছে?
সন্ধ্যায় আমার এদিকে চলে এসো, ও আসবে।
ঠিক আছে, চলে আসব।
সন্ধ্যায় চার বন্ধু একত্রিত হলো। তিনজনই সালমানকে এবং সালমানও ওদের তিনজনকে অবাক হয়ে দেখল। আসলাম তাদের মাঝে এসে প্রথমে বিস্ময় তারপর ওদিককার অবস্থার ব্যাপারে দুঃখ প্রকাশ করে। এরপর তার রাগ উঠে যায়, এরা মানুষদেরকে কী নির্মম নির্যাতন করে হত্যা করেছে… বৃদ্ধ-নারী-শিশু-অবলা প্রাণী-পাখি… পারলে আমি এদেরকে… আসলাম দাঁতে দাঁত পেষে।
ওদের এটাই করার ছিল—জাইদি বলে।
এটাই করার ছিল!—আসলাম রাগে গজরাতে থাকে।
হ্যাঁ, পঁচিশ বছর আমরা তাদের সঙ্গে যা করেছি, এরপর এটাই তাদের করার ছিল।
আমারা তাদের সঙ্গে কী করেছিলাম। কী করেছিলাম আমরা তাদের সঙ্গে?—আসলাম ক্রোধে ফেটে পড়ে।
তারপর আসলাম সংবাদ-প্রতিবেদনের সূত্র দিয়ে দিয়ে তাদের অত্যাচারের ফিরিস্তি তুলে ধরে। এদিকে জাইদিও অসংখ্য পরিসংখ্যান দিয়ে স্বজাতির জবরদখল প্রমাণ করে। সালমান ঝিমুতে শুরু করে। জুফর ওর দিকে তাকিয়ে বলে, সালমান তুমি কী মনে করো? তুমি বলো।
সে জুফরের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে, হ্যাঁ, সালমানকে জিজ্ঞেস করো, ও তো সেখানে দীর্ঘদিন থেকেছে, সমস্ত কিছু দেখেছে। সালমান এ ব্যাপারে তোমার কী মত?
আমার মত?—সে চিন্তায় পড়ে যায়।
ওকে নীরব দেখে জুফর শেষে অধৈর্য হয়ে পড়ে। ধাক্কা মেরে বলে, দোস্ত, কিছু একটা তো বল।
কী বলব?
জাইদি বিদ্রুপের হাসি হেসে বলে, কমিটমেন্টকে ভয় পাচ্ছে।
কমিটমেন্ট?—সালমান জাইদির মুখের দিকে তাকিয়ে রয়।
আসলাম জোর দিয়ে বলে, অন্তত এটা তো জানা চাই, তুমি এ ব্যাপারে কী ভাবো।
সে সিদ্ধান্তহীনভাবে বলে, দোস্ত, কিছুই বুঝে আসছে না।
জুফর ক্রুদ্ধ হয়ে ওর দিকে তাকায়, গতবার যখন তুমি এসেছিলে তখন ওখানকার পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে করে আমার মাথা খেয়ে বসেছিলে।
সে জুফরের দিকে তাকিয়ে রয়, নিষ্প্রাণভাবে বলে, তখন আমার ধারণা ছিল আমি পরিস্থিতি বুঝে ফেলেছিলাম।
ঠিক আছে পুরনো কেচ্ছা ছাড়ো, তুমি বরং বলো সেখানে আসলে কী ঘটেছে?
হুঁ, তা আমি বলতে পারি—সে সহজ হয়ে বলে। সেখানে আমি অনেক কিছু দেখেছি। সব শুনালে ভয়ে তোমাদের লোম খাড়া হয়ে যাবে—এ কথা বলে সে এমনভাবে নীরব হলো যেন কোনো দীর্ঘ দাস্তান শোনানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। তিন বন্ধু তনুমন ঢেলে বসে। এই শুরু হলো বলে অপেক্ষা করতে থাকে। কিন্তু সালমান একেবারেই নীরব। সে যখন কিছুই বলছে না তখন জুফর তাকে ধাক্কা দিয়ে বলল, দোস্ত তুমি তো চুপ মেরে গেছ।
হ্যাঁ রে দোস্ত—সালমান বিধ্বস্ত ভঙ্গিতে বলে, কিছুই মনে পড়ছে না!
আসলাম এবং জাইদি দু’জনই তার দিকে রাগত চোখে তাকায়। এরপর ওকে ছেড়ে একজন আরেকজনের সঙ্গে নিজেরাই তর্কে জড়িয়ে পড়ে। তর্কাতর্কি তুঙ্গে ওঠে। বিদ্রুপ-তাচ্ছিল্য, রাগারাগি, অশ্লীল গালাগাল, কখনো এদিক থেকে কখনো ওদিক থেকে। জুফরের দিক থেকে কখনো এদিককার লোকদের প্রতি গালি ভেসে আসে তো আসলামের পক্ষ থেকে আসে ওদিককার লোকদের তাক করে। মাঝখান থেকে সালমান শুনে যাচ্ছে আর বন্ধুদের মুখের দিকে তাকাচ্ছে। তার চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে। ঝিমুনি পায়। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সে নিজেকে সামলে নিয়ে ঠিকঠাক হয়ে বসে। ওদের প্রতিটি কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতে থাকে। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই আবারো চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে এবং চোখ বন্ধ হয়ে যায়।
হারামজাদার দল, সাম্রাজ্যবাদী কুত্তা … জাইদি টেবিলের উপর জোরে চাপড় মারে।
শালার সবকটা গাদ্দার, ভারতের এজেন্ট… আসলাম ক্রুদ্ধ হয়ে বলে।
সালমান ঘুমঘুম চোখে দু’জনকে দেখে আবারো ঘুমিয়ে পড়ে।
তার ঘুম ভাঙল চা আসার পর, জুফর তাকে ধাক্কা দিয়ে বলে, সালমান চা নাও।
সে হুড়মুড় করে চোখ খোলে। ক্ষমাপ্রার্থীর দৃষ্টিতে বন্ধুদের দিকে তাকায়, ঠিকঠাক হয়ে বসে। চোখের উপর হালকাভাবে আঙুল কচলায়। চায়ের কাপ মুখে নেয়। চা পানের সঙ্গে সঙ্গে ঘুম তার গায়েব। চা তাকে একেবারে তাজা করে তোলে। মন-মগজের জট খুলতে শুরু করে। সে বলে, ঘুমানোর কারণে আমার সে দিনগুলোর একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে গেছে। সে রাতে এমন অবস্থা হলো যে, আমি এক ফোঁটাও ঘুমাতে পারি নি।
এ কথাগুলো বলতে না বলতেই কয়েকটি বীভৎস দৃশ্য ক্ষীপ্র গতিতে তার সামনে ভেসে ওঠে এবং একটি অমানবিক চিৎকার তার মস্তিষ্কের ভেতর গেঁথে যায়।
কোন রাতের কথা বলছ, তখন কি পরাজয় হয়ে গেছে?—আসলাম প্রশ্ন করে। সালমান কিছুটা ভেবে বলে, ঠিক মনে নাই ওটা কোন রাত ছিল। তাছাড়া ওইসব রাত একই রকম ছিল। তো হলো কী… —বলতে বলতে ও থেমে যায়। আসলাম, জাইদি, জুফর তিনজনই তার দিকে তাকিয়ে ছিল। সবাইকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সে বিব্রত বোধ করে। বলে, হায়! সব কথা ভুলে যাচ্ছি। তবে যাই হোক, এরপর আমি রাতভর ঘুুমুতে পারিনি। কিছুটা থেমে আবারো বলে, এরপর তো এমন হলো যে, ঘুম জিনিসটাই আর কপালে জোটে নি… অথবা হতে পারে কখনো হয়তো শুয়েওছিলাম।
আসলাম, জাইদি, জুফর তিনজনই উদ্বিগ্ন হয়ে তার কথা শোনে। এরপর আবার নিজেরা কাজিয়ায় জড়িয়ে পড়ে। ফের সেই তর্ক—এদিকওয়ালারা ওদের উপর জবরদখল করেছে, ওদিকওয়ালারা করেছে গাদ্দারি।
সালমান বসে বসে মনে করতে চেষ্টা করছিল, ওই রাতগুলোর কোনোটিতে সে শুয়েছিল নাকি শোয়নি। তার কিছুই মনে পড়ে না। আর এখানে আসার পর, এখানে আসার পরের ঘুমের হিসাবও সে ঠিকঠাক করতে পারে না।
এই হিসাব ছেড়ে সে আসলাম, জাইদি এবং জুফরের বাহাসে মনোযোগ দেয়। শুনতে থাকে, শুনতেই থাকে। শুনতে শুনতে সে হাই তোলে এবং ঢুলুঢুলু চোখ নিয়ে জুফরকে বলে, দোস্ত আমার বড্ড ঘুম পাচ্ছে।
জুফর বিরক্তি নিয়ে তার দিকে তাকায়। তারপর মায়া নিয়ে বলে, ঠিকাছে, তাহলে ঘুমিয়ে পড়ো।
হুঁ, আমি ঘুমাতে চাই—সে বুজে আসা চোখ নিয়ে ঘুমজড়ানো কন্ঠে বলে। সামনের সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে পা দু’খানা টেবিলের উপর ছড়িয়ে দেয়। তার একটা জুতো ছিল আসলামের বিপরীত দিকে, দ্বিতীয় জুতোটা ছিল জাইদির মুখোমুখি। সালমান নাক ডাকাতে থাকে।

[ইনতেজার হুসেইন: কথাসাহিত্যিক ইনতেজার হুসেইনকে তুলনা করা হয় প্রখ্যাত উর্দু ছোটগল্পকার সাদত হাসান মান্টোর সঙ্গে। কেউ কেউ তাকে মান্টোর চেয়েও শক্তিশালী গল্পকার বলে দাবি করেন। মান্টোপরবর্তী উর্দু ছোটগল্পের সবচে’ শক্তিমান ¯্রষ্টা ইনতেজার হুসেইন প্রথম কোন পাকিস্তানি লেখক হিসেবে ম্যানবুকার পুরস্কারের সংক্ষিপ্ত তালিকায় স্থান করে নিয়েছিলেন। বিখ্যাত উপন্যাস বাস্তি এর জন্য ২০১৩ সালে ম্যানবুকার শর্টলিস্টের চতুর্থ নামটি ছিল তার। পৌরাণিক আখ্যান, এরাবিয়ান নাইটস্ ও কাফকাকে ছেনে সৃষ্টি করেছেন ছোটগল্পের নিজস্ব স্টাইল। তার গল্পের প্লট, চরিত্র কিংবা ভাষা সবই প্রতীকি। এছাড়াও দেশভাগের সময় ভারত ছেড়ে আসা এই লেখকের লেখায় বারবার ঘুরেফিরে এসেছে নস্টালজিয়া।
ইনতেজার হুসেইন উর্দু ছাড়াও ইংরেজিতে লেখালেখি করেছেন। পেশাজীবনে পাকিস্তানের বিখ্যাত ইংরেজি দৈনিক ডন-এ কাজ করেছেন। অনুবাদ করেছেন চেখভসহ বিশ্বসাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ নানা লেখাজোখা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষের এই কথাসাহিত্যিক আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও লিখেছেন একাধিক অসাধারণ ছোটগল্প। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার বিখ্যাত তিনটি ছোটগল্প হচ্ছে, নিঁদ , আসির এবং শেহরে আফসোস। এ ছাড়াও তার বিখ্যাত উপন্যাস বাস্তি এর একটি বড় অংশ জুড়েই রয়েছে সাতচল্লিশ, ঊনসত্তর এবং একাত্তরের দিল্লি, ঢাকা এবং লাহোর। ২০১৬ সালের দুসরা ফেব্রুয়ারি উর্দু সাহিত্যের এই শক্তিমান লেখক মারা যান। ]

ঘুম ১৯৭১ এর মুক্তিসংগ্রামকে কেন্দ্র করে লেখা ইনতেজার হুসেইনের একটি বিখ্যাত ছোটগল্প।

Facebook Comments

comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top