শিন শিন মিং ।। সোসান-এর জেন কবিতা ।। অনুবাদ : দুলু সরকার

মহোত্তম পথ দুর্গম নয়
যারা বাছ-বিচার করে না তাদের কাছে
তৃষ্ণা ত্যাগ করো সাথে বিতৃষ্ণাও
পথ নিজেই খুঁজে নেবে তোমাকে

যদি সামান্যতম বিভেদও করো
পথ তোমার থেকে দূরে থাকবে যেমন পৃথিবী থেকে আকাশ
যদি সত্য উপলব্ধি করতে চাও
তবে মত পোষণ কোরো না কোনোকিছুর পক্ষে বা বিপক্ষে

অনুরাগ আর বিরাগ
মনের ব্যাধি‌ বিশেষ
পথের মর্ম না বুঝলে
ব্যাহত হয় মনের প্রশান্তি

অসীম শূন্যতার মতোই বিস্তৃত এই পথ
অভাবহীন ও স্বয়ংসম্পূর্ণ
তোমার আকর্ষণ আর বিকর্ষণের কারণেই
দেখতে পাও না সবকিছুর সঠিক রূপ

নিজেকে বাস্তবতায় জড়িয়ে ফেলো না
আবার হারিয়েও যেও না শূন্যতায়
বস্তুর একত্বে সুস্থির রাখো মন
নিজ থেকেই বিলুপ্ত হবে দ্বৈততা

স্থিরতা অর্জনের জন্য যদি অস্থিরতা ত্যাগের চেষ্টা করো
সেই প্রচেষ্টাও তোমাকে সক্রিয় করে রাখবে
যতক্ষণ বসবাস করবে বৈপরীত্যে
ততক্ষণ পাবে না পথের সন্ধান

যারা পথের মর্ম বোঝে না
তারা বস্তুর বাস্তবতা স্বীকার বা অস্বীকার করে
অস্বীকার করলে তুমি দেখতে পাবে না বস্তুর গভীর বাস্তবতা
স্বীকার করলে দেখতে পাবে না বস্তুর গভীরের শূন্যতা

এ নিয়ে চিন্তা করবে যত
সত্য থেকে তোমার দূরত্ব বাড়বে তত
চিন্তা করা ক্ষান্ত দাও
কিছুই আর অজ্ঞাত থাকবে না তোমার

মূলে ফিরে আসা মানে মর্ম খুঁজে পাওয়া
প্রকাশ্যের পশ্চাদ্ধাবন মানে মূল হারিয়ে ফেলা
যে মুহূর্তে তুমি আলোকপ্রাপ্ত হবে
অতিক্রম করে যাবে প্রকাশ্য আর শূন্যতা

জগতে যে পরিবর্তনশীলতা দেখা যায়
শুধু অজ্ঞতার কারণেই তা সত্য মনে হয়
সত্যের সন্ধান কোরো না
শুধু মতামত দেয়া ছেড়ে দাও

দ্বৈতবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ধরে রেখো না
সাবধানে ত্যাগ করো এমন স্বভাব
যদি ঠিক-ভুলের একটি চিহ্নও থাকে
তবে বিভ্রান্তিতে হারিয়ে যায় মন

যদিও সমস্ত দ্বৈততা একত্ব থেকেই উদ্ভূত
এমনকি সেই একত্বকেও আঁকড়ে থেকো না
যখন পথে সুস্থির থাকে মন
তখন আর কোনো ভুল-ত্রুটি হয় না

যখন কিছু আর ত্রুটিপূর্ণ হয় না, তখন যেন কিছুই থাকে না
যখন মন আর বিক্ষুব্ধ হয় না, তখন যেন মনও থাকে না
চিন্তার বিষয় বিলুপ্ত হলে থাকে না চিন্তক
মন বিলুপ্ত হলে থাকে না কোনো বিষয়

অপর উদ্ভূত হলে আত্ম’র জন্ম হয়
আত্ম’র জন্ম হলেই অপর উদ্ভূত হয়
এই দুটো আপাত প্রতীয়মানতা
জেনে রেখো— কেবলই শূন্যতা

এই শূন্যতায় দুটোই অবিভেদ্য
আর প্রত্যেকেই নিজের মাঝে ধারণ করে সমগ্রতা
যখন এটি এবং ওটির মধ্যে কোনো বৈষম্য করা হয় না
তখন একটি পছন্দ আর অন্যটি অপছন্দ করা যায় না

মহোত্তম পথ সর্বাঙ্গীণ
না সহজ না কঠিন
যাদের দৃষ্টিভঙ্গি সীমাবদ্ধ তারা ভীতু আর অস্থিরমতি
যে যত বেশি তাড়াহুড়ো করে তত কম হয় তার গতি

বস্তুর আকাঙ্ক্ষায় তারা বহুদূরগামী হয়
এমনকি আলোকপ্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষাও করে বিপথগামী
সবকিছু যেমন চলছে তেমনই চলতে দাও
তাহলে থাকবে না যাওয়া বা আসার বিড়ম্বনা

পথের সাথে সদা থাকো সঙ্গত
তবেই থাকবে তুমি ঝামেলামুক্ত
চিন্তায় বাঁধা পড়ে থাকলে হারাবে সত্য
হয়ে যাবে দুর্বহ, নিস্তেজ আর অসুস্থ

সুস্থ না থাকলে মন হয় বিক্ষুব্ধ
তাহলে কেন এই আঁকড়ে ধরা বা প্রত্যাখ্যান
যদি সেই পথে চলতে চাও
ইন্দ্রিয় বা ধারণার জগৎকেও খারিজ কোরো না

আসলে সবকিছু সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ করাটাই
সত্য আলোকপ্রাপ্তির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ
প্রাজ্ঞদের কোনো লক্ষ্য থাকে না
কেবল অজ্ঞরা লক্ষ্যে বাঁধা পড়ে থাকে

ধর্ম তো একটাই বহুসংখ্যক নয়
অজ্ঞদের আকাঙ্ক্ষা থেকেই বিভেদ তৈরি হয়
মনকে মন্থন করার জন্য
মন ব্যবহার করাই সবচেয়ে বড় ভ্রান্তি

চিন্তা থেকেই উদ্ভূত হয় প্রশান্তি আর অশান্তি
আলোকপ্রাপ্তদের থাকে না কোনো অনুরাগ-বিরাগ
অজ্ঞান-অনুমান থেকেই
উদ্ভূত হয় সমস্ত দ্বৈততা

সেসব যেন স্বপ্ন বা বাতাসে ভাসমান ফুল
অজ্ঞরা ওসব ধরার চেষ্টা করে
লাভ আর ক্ষতি, ন্যায় আর অন্যায়
এ ধরনের ভাবনা করো একেবারে পরিত্যাগ

যদি চোখ কখনোই না ঘুমায়
তাহলে আর থাকে না কোনো স্বপ্ন
যদি মন কোনো বিভেদ না করে
তবে সবকিছুতেই ঐক্য দেখা যায়

এই ঐক্যের মর্ম বুঝতে চাইলে
মুক্ত হতে হবে সকল জট থেকে
যখন বিভেদ না করে সবকিছু দেখবে
মূলে ফিরবে তখন খুঁজে পাবে নিজেকে

স্থিরভাবে চলো আর গতিশীল অবস্থায় স্থির থাকো
সক্রিয়তা আর বিশ্রাম উভয়েই বিলুপ্ত হবে
যখন বিলুপ্ত হয় এই ধরনের দ্বৈততা
তখন এমনকি একত্বও বিলুপ্ত হয়

এই চূড়ান্ত অবস্থার
নেই কোনো নিয়ম বা বর্ণনা
পথের সঙ্গে বিলীন হয়েছে এমন সিদ্ধমনের
থাকে না কোনো দুর্ভাবনা

সংশয় আর অস্থিরতা বিলুপ্ত হলে
তোমার নিজের মাঝেই জেগে উঠবে সত্য
একটি মাত্র আঘাতে ঘটবে বন্ধন-মুক্তি
কিছুই আর তখন তোমাকে করবে না আকর্ষণ

সব শূন্য, পরিষ্কার আর স্ব-আলোকিত
মনকে ব্যবহারের নেই কোনো প্রয়োজন
চিন্তা, অনুভূতি, জ্ঞান ও কল্পনা
এসবেরও নেই কোনো মূল্য

জগতে যেটি যেমন সেটি তেমনই
নেই আত্ম বা অপর বিভেদ
এর সাথে দ্রুত সঙ্গতি জানাতে
অদ্বৈত-ভাবে দেখো সবকিছু

এই অদ্বৈততায় কিছুই আলাদা নয়
কিছুই নয় এর বহির্ভূত
সব দেশের সব কালের প্রবুদ্ধগণ
স্বয়ং উপলব্ধি করেন এই সত্য

সত্য সময় ও স্থানের অতীত
এক সদা-বর্তমান-মহাকাল
এখানেও নয় সেখানেও নয়
সর্বদা সবার চোখের নাগাল

বৃহৎ ও ক্ষুদ্রের মাঝে নেই কোনো ভেদ
যদি বিলুপ্ত হয় সংজ্ঞায়ন
অস্তিত্ব আর অনস্তিত্বের মধ্যেও
করা যায় না কোনো সীমা নির্ধারণ

অধরাকে ধরার প্রচেষ্টায়
সময় নষ্ট কোরো না তর্ক বা আলোচনায়
এক এবং বহু নিজেদের মধ্যেই বিচরণশীল
বিভেদহীন আর নিজেদের মধ্যেই মিশ্রিত

এই উপলব্ধিতে বেঁচে থাকতে চাইলে
পরিপূর্ণতা বা অপূর্ণতা নিয়ে ভেবো না
পথে আস্থা রাখা মানে বেঁচে থাকা বিভেদহীন
আর এই অদ্বৈততায় তুমি পথের সঙ্গে বিলীন

শব্দ! শব্দ! পথ ভাষার অতীত
শব্দ কখনো দিতে পারেনি পথের বর্ণনা
এখনো পারে না, কখনোই পারবে না।

—————————

শিন শিন মিং একটি জেন কবিতার বই। রচয়িতা— চীনা জেন সাধু জিয়ানঝি সেংচ্যান। আধুনিক বিশ্বে তিনি কানচি সোসান নামে পরিচিত। তৃতীয় জেন প্যাট্রিয়ার্ক সোসান গৌতম বুদ্ধের শিষ্য মহাকাশ্যপের সিলসিলার একজন প্রখ্যাত ভিক্ষু। তাঁকে বোধিধর্মের শিষ্য দাজু হুইকের উত্তরসূরী মনে করা হয়। শিন শিন মিং এর আক্ষরিক অর্থ— মনের উপর বিশ্বাসের শিলালিপি। আলোচ্য বিষয়— বৈপরীত্যের ঐক্য এবং শূন্যতার প্রকৃতি। কবিতাটিতে আলোচিত হয়েছে মানবজীবনের আনন্দদায়ক ও অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতাগুলিকে সমতার সঙ্গে দেখার প্রয়োজনীয়তা, অদ্বৈততার প্রয়োগ এবং তার ফলাফল। প্রায় দেড় হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে জেন সাধকদের অত্যন্ত প্রিয় এই বইটি আধুনিককালে প্রাচ্যের পাশাপাশি পাশ্চাত্যের জেন সার্কেলগুলিতেও গুরুত্বের সঙ্গে অধ্যয়ন করা হয়। তথাকথিত সভ্যতার কর্ণধারদের নানারকম মেকি কল্যানমুখী উদ্যোগের যাঁতাকলে পিষ্ট মানুষের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকট এবং জগৎ ও জীবনের অর্থহীনতা প্রতিপন্ন হওয়ার দার্শনিক সংকটের এই যুগেও দুঃখ-কষ্টে জর্জরিত ও বিক্ষিপ্তচিত্ত নিরূপায় অথচ সচেতন পাঠকের মনে কবিতাটি কোনো না কোনোভাবে সুভাব আনয়নে সক্ষম হতে পারে বলে অনুমিত হয়‌। আমি সোসান এর শিন শিন মিং এর ভাষান্তর করেছি রিচার্ড বি. ক্লার্ক, দুসান পাজিন, ডি.টি. সুজুকি, ক্রিসমাস হামফ্রেস প্রমুখের ইংরেজি অনুবাদ অবলম্বনে এরিক পুটকোনেন কৃত ইন্টারপ্রিটেশন থেকে।

Facebook Comments

comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top