কালের সন্ততিঃমানবিক ইতিবৃত্তের দলিল (পর্ব-৩) ।। এদুয়ার্দু গ্যালিয়ানো ।। অনুবাদ- মুহম্মদ রফিকুল ইসলাম

এদুয়ার্দো গ্যালিয়ানো (১৯৪০-২০১৫) উরুগুয়ের প্রখ্যাত লেখক কবি ও সাংবাদিক। লাতিন আমেরিকার এই লেখকের মন-প্রাণ জুড়ে রয়েছে অফুরান ভালোবাসা ও বিস্ময়। ভালোবাসা মানুষের প্রতি আর বিস্ময় জীবনের। জীবনকেও ভালোবেসেছেন অন্তহীন কৌতূহলে, আনন্দে আর নিবেদনে। দেশ-কালের সীমানা পেরিয়ে মানুষের জন্য মানবতার জন্য নিবেদিত হয়েছে তাঁর সমস্ত সাহিত্যকর্ম, বক্তৃতা-ভাষণ, আন্দোলন প্রতিবাদ। নির্বাসনে থেকেছেন, মৃত্যুর পরোয়ানা পেয়েছেন একাধিকবার তবু থেমে যায়নি অদম্য এই প্রাণ ।

লাতিন আমেরিকার ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ নিয়ে লিখেছেন ‘ওপেন ভেইনস অব ল্যাটিন আমেরিকা’। তিনখন্ডে লিখিত মেমোরি অব ফায়ার’ আমেরিকা মহাদেশের আদিবাসী জীবন ও সংগ্রামের প্রাণবন্ত ইতিহাস। শিল্প-সাহিত্য ইতিহাস যুদ্ধ প্রতিরোধ স্বৈরশাসন বর্ণবাদ নারী-স্বাধীনতা প্রভৃতির অনবদ্য কাব্যিক উপস্থাপন তাঁর ‘ মিরর’ ও ‘চিলড্রেন অব দ্য ডেজ’ বই দুটি।

‘চিলড্রেন অব দ্য ডেজ’ ৩৬৫ দিনের দিনলিপি। জগতের কত অদ্ভূত ইতিহাসের কত অনন্য বিষয় নিয়েই-না তিনি লিখেছেন কিন্তু কী আশ্চর্য সবকিছুই মনে হয় আজকের – এই সময়ের – এই জীবনের আর কাঙ্ক্ষিত বুদ্ধিদীপ্ত প্রতিবাদের।

– মুহম্মদ রফিকুল ইসলাম
———————-

মার্চ ১
যে মাটির বুকে

শূন্যহাতে উন্মত্তের মতো মাটি খুঁড়ে যাচ্ছে এলিজা লিনচ। ওদিকে, অবজ্ঞায় অবহেলায় তামাশা দেখছে বিজয়দৃপ্ত সৈন্যরা। খামচাখামচির তোড়ে লাল মাটির ধূলো উড়ছে চারদিকে এবং এরিমধ্যে ঝাপসা দেখা যায় তাঁর স্বর্ণালি চুলের গুচ্ছ বিশৃঙ্খল এলোমেলো লুটিয়ে পড়ছে মুখে, ঘাড়ে।

পাশে নিথর পড়ে আছে ফ্রান্সিসকো সোলানো লোপেজ, দেশের প্রেসিডেন্ট! তাঁর স্বামী। নিঃসম্বল এলিজার কান্নার এখন সময় নেই, এমনকি শেষবারের মতো তাঁকে দেখার অবসরও নেই। একমনে উদ্ভ্রান্তের মতো কবরে ছুঁড়ে দিচ্ছে মাটি, আবর্জনা, লতাপাতা হাতের কাছে যা আছে সব। প্রাণপণ চাইছে এই মাটিতে এই দেশেই হোক তাঁর কবর।
যদিও তাঁর সাথে সাথেই অতলে ডুবে গেল দেশ, প্রিয় প্যারাগুয়ে। কিন্তু তিনি কী অদম্য মনোবল নিয়েই-না লড়ে যাচ্ছিলেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে, আগ্রাসনের প্রতিরোধে; শুধু দেশের জন্য, পারাগুয়ের জন্য। প্রতাপশালী ব্যাংকার ও ব্যবসায়ীদের নতজানু কুর্নিশ করেন নি – এই কী তাঁর অপরাধ! তাই কী পাঁচ বছরব্যাপী মরণপণ যুদ্ধ!

আজ, ১৮৭০ সালে, কেরো কোরার জঙ্গলে আর কেউ নয় কিছু বুনো পাখি শুধু তাঁকে বিদায় সম্ভাষণ জানিয়েছে।
——————–

মার্চ ২
পাখির সুরে আমার ভাষা

‘লা গোমারি’ দ্বীপে মানুষের ভাষায় কোনো বাক্য নেই, শব্দ নেই, কোনো অক্ষরও নেই। কেননা তাঁরা ভাষার প্রচলিত রীতি মেনে কথা বলে না, তাঁরা শিস দিয়ে কথা বলে। ‘শিস ভাষা’ তাঁদের মাতৃভাষা।
১৯৯৯ সাল থেকে এই বিরল ভাষা কনোরি দ্বীপপুঞ্জের স্কুল-কলেজে পড়ানো হচ্ছে।
প্রাচীনকালে মেষপালকেরা পাহাড় থেকে পাহাড়ে, উপত্যকা থেকে উপত্যকায়, দূর থেকে দূরে শিস ধ্বনির মাধ্যমে, প্রতিধ্বনির মাধ্যমে বার্তা পাঠাতো। তাঁদের শিস ধ্বনিই জানিয়ে দিত কারো আগমনের বার্তা, আশঙ্কা-বিপদ বা আনন্দের সংবাদ। শিস ধ্বনি আজও সে-সংবাদ, সে-বার্তা পৌঁছে দিচ্ছে হাওয়ায় হাওয়ায় পাহাড়ে কন্দরে – যুগ থেকে যুগে।
বাতাসের মতো সমুদ্রের গর্জনের মতো এই শিস ভাষাকে আজও ঈর্ষা করে বনের পাখি, পাখির সুরেলা শিস।
——————–

মার্চ ৩
মাতৃশক্তি

১৭৭০ সালের এই দিনে, তেরেসা ডি বেঙ্গুয়েলার দোর্দন্ডপ্রতাপ, দৃপ্ত পরাক্রমের অবসান ঘটে “কোয়ারিতেরা” অরণ্যের গহীনে। এই কোয়ারিতেরা ছিল ব্রাজিলে পলাতক কৃতদাসদের অন্যতম নিরাপদ আশ্রয়, সত্যিকার অভয়ারণ্য। সুদীর্ঘ কুড়ি বছর ধরে সৈন্যদের রক্তচক্ষু ফাঁকি দিয়ে আসছেন অকুতোভয় তেরেসা।
কখোনোই তাঁকে জীবিত বন্দী করা সম্ভব হয় নি।
এইসব ঘনজঙ্গলের গভীরে লুকানো আস্তানায় নারীদের দায়িত্ব অনেক। শুধু রান্না বা সন্তান জন্মদানই যথেষ্ট নয়।তাঁদের কেউ কেউ যেমন – এসপিরিডো সান্তোর জাকিম্বা গাম্বা, রিও ডি জেনেরিও’র গহন অরণ্যের মারিয়ানা ক্রিওলা, বাহিয়ার জেফারিনা, তোকানতিনের ফিলিপ্পা মারিয়া আরানহা রীতিমত যোদ্ধা ও অধিনায়ক।
ত্রোম্বেতাস নদীর তীরে বিস্তীর্ণ পারা অঞ্চলে মে ডোমিঙ্গাসের নেতৃত্ব নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলে নি কখনো।
আলা- গোয়াসের পালমারি অভয় আশ্রমের বিশাল এলাকায় আফ্রিকান রাজকন্যা আকালতুনের দীর্ঘ দিনের রাজত্ব। ১৬৭৭ সালে ঔপনিবেশিক হানাদারদের অত্যাচার ও অগ্নিকাণ্ডের পূর্ব পর্যন্ত তিনি ছিলেন অনন্য উদার নিরাপদ মাতৃআশ্রয়।
১৮০২ সালে পানামবুকোতে এক স্বতন্ত্র গোত্রের জন্ম দেন আফ্রিকান পলাতক দুই কৃষ্ণ বালিকা-সহোদরা ফ্রান্সিসকা ফেরেইরা ও মেন্দেচা ফেরেইরা।
এরা ব্রাজিলে আফ্রিকান কৃতদাসদের মাতৃদেবী, নির্ভরযোগ্য আশ্রয় ও খাদ্যের উৎস।
আশেপাশে কৃতদাসদের পলাতক দল দেখলেই তাঁরা ছুটে যেত, কোঁকড়া চুলের কন্দরে যতখানি পারে গুঁজে দিত শস্যের দানা, বীজ ইত্যকার শুষ্ক খাবার। যাতে পালিয়ে গেলেও কিছুটা খাবার সাথেই থাকে!
——————–

মার্চ ৪
সৌদি মিরাকল

১৯৩৮ সালে সৌদি আরবে অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটে। মরুভূমি বিস্তীর্ণ প্রান্তরে তেলের এক মহাসমুদ্রের সন্ধান পায় স্ট্যান্ডার্ড অয়েল কোম্পানী।
দেশটি আজ বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী সন্ত্রাসীর জন্মদাত্রী আর মানবাধিকার অস্বীকার করার উৎসভূমি। পশ্চিমা শক্তির প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় আছে তাদের এইসব কর্মকান্ডে। কিন্তু নিজের স্বার্থে ব্যাঘাত ঘটলে প্রায়ই তারা বোমা ফেলার হুমকি দেয়। শেখ রাজ্যের পাঁচ হাজার যুবরাজ ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে।
অঢেল তেলের বিনিময়ে প্রভূত অস্ত্র ক্রয় করে বোমা-হুমকি সামলায় কোনোমতে!
——————–

মার্চ ৫
স্বাস্থ্যসম্মত বিচ্ছেদ

১৯৫৩ সালে লুই বুনুয়েলের ‘এল’ মেক্সিকোতে মুক্তি পায়। স্প্যানিশ নির্বাসিত ঔপন্যাসিক মার্সিডিস পিন্তোর উপন্যাস অবলম্বনে এই চলচ্চিত্র। বিবাহিত জীবনের গ্লানি যন্ত্রণা অবিশ্বাস এই সিনেমার উপজীব্য বিষয়। টানা তিন সপ্তাহ ধরে বিভিন্ন সিনেমা হলে এই চলচ্চিত্র চলতে থাকে। মনোরম কমেডি হিসেবে দর্শক বেজায় উপভোগ করে সুক্ষ্ম মনস্তত্ত্বের এই শিল্পকর্ম!
ঔপন্যাসিক পিন্তো ১৯২৩ সালে স্পেন থেকে নির্বাসিত হন। কিন্তু তার আগে তিনি রীতিমতো ধর্মদ্রোহিতা রাষ্ট্রদ্রোহিতার সব কাজ করেন।
যেমন মাদ্রিদ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবাহ-বিচ্ছেদের স্বপক্ষে তেজোদৃপ্ত বক্তৃতা দেন।’স্বাস্থ্যসম্মত ডিভোর্স ‘ শিরোনামে সেই বক্তৃতা তাঁকে ব্যাপক আলোচিত সমালোচিত করে।
স্বৈরশাসক মিগুয়েল প্রিমো ডি রিভারা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন তাঁর কর্মকান্ডে। ক্যাথলিক চার্চ ও পবিত্র মায়ের নামে শপথ করে বলেন,’ এসব বন্ধ করুন, না-হয় দেশ ছাড়ুন। ‘
পিন্তো দেশ ছাড়েন।
সেদিন থেকে তাঁর সৃষ্টিশীল পদচারণা অন্তহীন উদ্যমে চলতে থাকে পৃথিবীর পথে পথে। যেখানেই গেছেন সেখানেই জাগিয়ে তুলেছেন সচেতনতা, প্রতিরোধ, মানবিক সব প্রতিবাদ।
প্রতিবাদের শিখা জ্বালিয়েছেন উরুগুয়ে, বলিভিয়া, আর্জেন্টিনা,কিউবা ও মেক্সিকোর শহরে শহরে, জনপদে জনপদে।
——————–

মার্চ ৬
কোন কাননের ফুল

শিল্পী জর্জিয়া ও’কিফ প্রায় শত বছর বেঁচে ছিলেন। জীবনভর ছবি এঁকেছেন এবং ছবি আঁকতে আঁকতেই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছেন।
কিন্তু এই পৃথিবীতে, নিঃসঙ্গতার ধূ ধূ মরুভূমিতে, তিনি চিত্রকর্মের এক অনন্য বাগান গড়ে তুলেছেন।
শিল্পিত তাঁর বাগানে থরে থরে ফুটে আছে অভিনব সবফুল – উন্মোচিত ক্লিটোরিস, প্রস্ফুটিত ভালভা, আরক্তিম ভ্যাজাইনা, অঙ্কুরিত স্তনবৃন্ত, উদ্ভাসিত নাভিমূল….
নারীজন্মের বিষণ্ণ সুন্দর প্রকাশ!
——————–

মার্চ ৭
তোমার মোহন রূপে

১৭৭০ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ‘চতুর রমনীদের শাস্তিবিধান’ আইন নিয়ে তুমুল বিতর্ক ওঠে।
আইনে বলা হয় – ‘অশিষ্ট নারীরা মহামান্য রাজার প্রজাদের বিভিন্নভাবে বিয়েতে প্রলুব্ধ করে থাকে। প্রলোভনের এই শয়তানী বুদ্ধিতে তারা ব্যবহার করে, সুগন্ধি, বাহারী রং, নানা তরল প্রসাধনী, নকল দাত, পরচুলা, স্প্যানিশ পশমি বস্ত্র, ইস্পাতের কাঁচুলি, হাই হিল জুতা আর বলিষ্ঠ নিতম্ব।’
আলোচ্য আইনে ছলচাতুরীর এইসব তরুনীদের ডাইনী-ডাকিনী হিসেবে দেখানো হয় এবং ডাকিনী-বিদ্যার শাস্তি এদের জন্যেও প্রযোজ্য বলে ঘোষণা করা হয়। কেউ এই ধূর্ত প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে বিয়ে করলে তার ‘বিবাহ’ বে-আইনী, বাতিল বলে গণ্য হবে।
আইন পাশের সেই সময় সিলিকন স্তন, প্লাস্টিক সার্জারী, বোটক্স ইনজেকশন, লিপোসাকশনসহ বিবিধ আধুনিক উপকরণ আবিষ্কৃত হয় নি। হলে, এগুলোও আইনের আওতায় চলে আসত!
——————–

মার্চ ৮
নিগূঢ় শ্রদ্ধাঞ্জলি

আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবস।

যুগে যুগে ইতিহাসের সেরা চিন্তাবিদ, পুণ্যাত্মা মুনিঋষি সবাই ছিলেন পুরুষ। তাঁদের নারী বিষয়ক চিন্তার কিছু মহার্ঘ্য নমুনা:
শরীর নিয়ে যৎকিঞ্চিৎঃ
মহামহিম অ্যারিস্টটল, ” নারী হলো অসম্পূর্ণ পুরুষের প্রতীক।”
সেইন্ট থমাস অ্যাকুইনাস,” পুরুষ-উপাদানের ত্রুটিযুক্ত ভ্রান্তসৃষ্টি নারী।”
মার্টিন লুথার, “পুরুষের আছে প্রশস্ত কাঁধ ও সরু কোমর তাই তাঁরা বুদ্ধিমান স্থিতধী। আর নারীর আছে ঠিক বিপরীত, সরু কাঁধ ও বিশাল নিতম্ব তাই তারা ঘরকন্না আর সন্তান লালন-পালন উপযোগী।”
তাঁহাদের প্রকৃতি-বিচারঃ
ফ্রান্সিসকো ডি কুইভেদো, “মুরগী যেমন ডিম দেয় নারীও তেমনি সন্তান জন্ম দেয়।”
সেইন্ট জন দামাস্কাসের দম্ভোক্তি, “নারী হল অসুস্থ মাদী-গর্দভ।”
আর্থার শোপেনহাওয়ারের উক্তি, “নারী হল লম্বা চুল আর নগন্য দূরদৃষ্টি সম্পন্ন জীব।”
তাঁদের অদৃষ্টঃ
বাইবেলে জেহোভা নারীদের বলেছেন, “আর আজ তোমাদের উপর তোমাদের স্বামীর হক প্রতিষ্ঠিত করা হলো।”
আল্লাহ কোরানে মোহাম্মাদ কে বলেছেন, “স্বামীর অনুগত নারীই সহজ সরল সঠিক পথে আছে।”
——————–

মার্চ ৯
প্রতিরক্ষা ও হলি ট্রিনিটি

১৯১৬ সালের এই দিনে, মেক্সিকান আঞ্চলিক সেনানায়ক -‘পাঞ্চো ভিয়া’ – সীমান্ত অতিক্রম করে আমেরিকার কলোম্বিয়া শহর আক্রমণ করেন। বেশকিছু সৈন্য হত্যা করে শহরে আগুন লাগিয়ে দেন। পরদিন শত্রুবাহিনীর কিছু ঘোড়া-বন্দুক ছিনিয়ে নিয়ে মেক্সিকোতে ফিরে আসেন রসিয়ে গল্পটি বলার জন্য।
ইংল্যান্ড থেকে স্বাধীন হওয়ার পর, এই ঝটিতি হামলা যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে একমাত্র বহিঃশত্রুর আক্রমণ – প্রথম ও শেষ অনুপ্রবেশ।
বিপরীতে, যুক্তরাষ্ট্র বাস্তবিকই বিশ্বের সব দেশেই আগ্রাসন চালিয়ে আসছে, যথেচ্ছা অনুপ্রবেশ করে চলছে!
১৯৪৭ সালে “ডিপার্টমেন্ট অব ওয়্যার” নাম পাল্টে হয়ে যায় “ডিপার্টমেন্ট অব ডিফেন্স”। বাজেট খরচ হতে থাকে অলীক শত্রুর প্রতিরোধে, ডিফেন্সে।
‘হলি ট্রিনিটি’র মতো এমন নামকরনের অর্থ আজও কেউ উদঘাটন করতে পারে নি!
——————–

মার্চ ১০
কী রাগিনী বাজালে হৃদয়ে

১৭১২ সালে আজকের রাতে জুসেপ্পে তারতিনি স্বপ্নে দেখলেন স্বয়ং ডেভিল তাঁকে বেহালা বাজিয়ে শোনাচ্ছে।
সুরে বিভোর জুসেপ্পে মনেপ্রাণে চাইছেন এই অতুল সঙ্গীত যেন শেষ না হয়। কিন্তু ঘুম ভাঙ্গার সাথে সাথেই মিলিয়ে যায় সেই অপার্থিব সঙ্গীত, রেখে যায় মোহনীয় সুরের অন্তহীন বিস্ময়।
হারিয়ে যাওয়া অলৌকিক সেই সুর খুঁজে বেড়িয়েছেন তিনি সারাজীবন।
বিমূঢ় বিস্ময়ে রচনা করেছেন দুইশ নয়টি অসাধারণ “সোনাটা”, ধরতে চেয়েছেন স্বর্গীয় সুরের মায়াবী স্পন্দন।
তন্ময় একনিষ্ঠ তারতিনি বরাবরই নিপুণ বাজিয়েছেন শয়তানের সুর খুঁজে ফিরে। কিন্তু তাঁর মতে, স্বপ্নের সেই একক সিম্ফনি তিনি বাজাতে পারেন নি কখনোই!
হাজার হাজার ভক্তশ্রোতা তবুও তাঁর উদযাপিত ব্যর্থতায় তালি দিয়েছে উল্লাস করেছে! মুগ্ধ বিস্ময়ে শুনেছে তারতিনির স্বাপ্নিক সঙ্গীতের মূর্ছনা।
——————–

মার্চ ১১
সমাজতন্ত্রঃ পুঁজিবাদের বিশ্ববিদ্যালয়

আজ, ১৯৩১ সাল। রুপার্ট নামে একশিশুর জন্ম হয় অস্ট্রেলিয়ায়। বছর বিশেকের ব্যবধানে রুপার্ট মার্ডক বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী মিডিয়া টাইকুনে পরিনত হন।
ব্যবসায়িক কূটকৌশল প্রয়োগের বিচক্ষণতাই তাঁর ঈর্ষনীয় সাফল্যের একমাত্র কারণ নয়। অক্সফোর্ডে ছাত্রাবস্থায় কার্ল মার্কসের নিবিড় পাঠ নিয়েছেন তিনি। লেলিন ছিলেন তাঁর আদর্শ, আর পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার নাড়ী-নক্ষত্র ভালোই জানা ছিল তাঁর।
জীবনভর শুধু মোক্ষম টোপ ফেলেছেন তিনি।
——————–

মার্চ ১২
স্বপন-পারের ডাক শুনেছি

জাপানের ফুজিয়ামা সেদিন রক্তিম জ্বলে ওঠে।
আকাশের মেঘমালা প্লুটোনিয়ামের রঙে লাল, স্ট্রনটিয়ামের রঙে হলুদ, সিজিয়ামের বেগুনি আভায় রঙিন হয়ে আছে। বাহারি রঙিন এইসব ধাতব মৌলের প্রত্যেকটিতে আছে মরণব্যাধি ক্যান্সারের উপাদান।
ছয় ছয়টা পারমাণবিক চুল্লীর বিস্ফোরণ ঘটে সেদিন।
মানুষ পাগলের মতো পালাচ্ছে কিন্তু যাওয়ার কোনো জায়গা নেই! শুধু নিরুপায় আর্তনাদ ভেসে আসে, ‘ সব ধোঁকা, সব মিথ্যা ফাঁকি!’
উদভ্রান্তের মতো ছুটছে সবাই, সাগরে ঝাপিয়ে পড়ছে কেউ কেউ, উপর থেকে লাফিয়ে নামছে অগণিত মানুষ – প্রাণে বাঁচতে নয়- বরং তাৎক্ষণিক মৃত্যুর প্রত্যাশায়! নারকীয় যন্ত্রণা সহ্য করতে পারছে না কেউ!
২০১১ সালের এইদিনে জাপানে পারমাণবিক দুর্ঘটনা ঘটে।
ঠিক কুড়িবছর আগে, আকিরা কুরোসাওয়া এরই জান্তব দুঃস্বপ্ন দেখেছিলেন এবং বিশ্ববাসীকে দেখিয়েছিলেন।
তাঁর স্বপ্নময় ‘ড্রিমস’ – শিল্পীর এক অমোঘ ভবিষ্যৎচিত্র!
——————–

মার্চ ১৩
ন্যায় অন্যায় জানিনে

২০০৭ সালের এই দিনে “চিকিতা ব্রান্ডস” ” ইউনাইটেড ফ্রুটস” এর উত্তরসূরি হিসেবে কলা ব্যবসার একচেটিয়া দায়িত্ব গ্রহণ করে। সেই দিনই প্রতিষ্ঠানটি কলোম্বিয়ার প্যারামিলিটারিকে সাত বছরের জন্য নিয়মিত অর্থের যোগান ও প্রয়োজনে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার চুক্তিপত্রে সই করে।
বিনিময়ে প্যারা মিলিটারি, কলা কোম্পানিতে শ্রমিক আন্দোলন হরতাল ও যেকোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতি সামাল দেবে। দক্ষতার সাথেই তারা সবকিছু সামল দেয়, শ্রমিক সংগঠনগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে। মাত্র একশ তিয়াত্তর জন শ্রমিকনেতা তাদের হাতে জীবন হারায়, নিখোঁজ ও গুম হয়!
এদের জন্য ক্ষতিপূরণ বাবদ বরাদ্দ ছিল পঁচিশ মিলিয়ন ডলার। হতভাগা এই শ্রমিকদের পরিবার পঁচিশটি পয়সাও কখনো পায় নি!
——————–

মার্চ ১৪
‘ক্যাপিটালে’র মুনাফা

১৮৮৩ সালে লন্ডনে কাল মার্কসের জানাজায়, সর্বসাকুল্যে এগারোজন মানুষ জমায়েত হন – গোর খোদক সহ!
এপিটাফে সেদিন লেখা হয় তার বিখ্যাত উক্তি, “দার্শনিকগণ বিভিন্নভাবে জগতের ব্যাখ্যা দিয়ে আসছেন, কিন্তু ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ নয় – দরকার এখন দুনিয়াকে পাল্টে দেওয়া ।”
সমাজ পরিবর্তনের এই অগ্রদূত তাঁর জীবন কাটিয়েছেন পালিয়ে পালিয়ে- পুলিশ থেকে -পাওনাদারদের থেকে। তাঁর শ্রেষ্ঠকীর্তি নিয়ে তিনি বলেন, ” পকেটে কানাকড়ি না-নিয়ে, অর্থ ও পুঁজি বিষয়ে এত বিস্তর কেউ কখনোই লেখেন নি। ‘ক্যাপিটাল’ লিখতে আমি যত চুরুট ফুঁকেছি, তার দামও এই বই জোগাতে পারবে না।”
——————–

মার্চ ১৫
মরিবার হলো তার সাধ

খ্রিস্টপূর্ব ৪৪ অব্দে এই দিন ভোরবেলা কাঁদতে কাঁদতে ঘুম থেকে জেগে উঠেন ক্যালপার্নিয়া।
তিনি স্বপ্নে দেখেন তার স্বামী উপর্যুপরি ছুরির আঘাতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন। সকালে ক্যালপার্নিয়া তার স্বামীকে স্বপ্নবৃত্তান্ত খুলে বললেন এবং অশ্রুসজল নয়নে মিনতি করে বললেন, ‘আজ অন্তত বাইরে যাবেন না, দয়া করে আমার কাছে ঘরে থাকুন, প্রিয়তম। বাইরে আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি কবরের বিভীষিকা আর মৃত্যুর হাতছানি।‘
মহাপরাক্রমশালী শাসক, অপরাজেয় দেবতা, জগতের শ্রেষ্ঠতম বীর সামান্য নারীর তুচ্ছতম স্বপ্নের কথায় কর্ণপাত করলেন না, কোন গুরুত্বই দিলেন না।
জুলিয়াস সিজার তাকে পাশে ঠেলে রোমান সেনেটের দিকে – মৃত্যুর পথে পা বাড়ালেন!
——————–

মার্চ ১৬
কথকঠাকুর

অনাদিকাল থেকে মানুষ উৎসবে-পার্বণে নানা গল্প-গাথা বলে আসছে। দীর্ঘ সময় ধরে গল্প-গান রচিত হয়েছে কন্ঠে কন্ঠে, ভেসে বেড়িয়েছে হাওয়ায় হাওয়ায়, কাগজে বন্দী হওয়ার আগে।
গল্প কথকদের বিভিন্ন দৈব-প্রেরণা বা কিংবদন্তি চরিত্র থাকে যা তাদের নতুন নতুন আখ্যান কথনে সাহায্য করে।
তেমনি এক দৈব-পুরুষের নাম ” রাফুয়েমা”। বুড়ো দাদু ‘রাফুয়েমা’ কলোম্বিয়ার আরাকুয়ারা অঞ্চলের “হিতোতো” নৃগোষ্ঠীর জন্ম ইতিহাসের গল্প বলতেন।
রাফুয়েমার কেচ্ছাকাহিনীর মূল কথা হলো – “যখন কোনো গল্প বলা হয় – হিতোতো শিশু সেই গল্পের শব্দরাজী থেকে জন্ম নেয়।”
যতবার রাফুয়েমা এই গল্প বলতেন, ততবার ‘হিতোতো’ জনগোষ্ঠীর নতুন সদস্যের জন্ম হতো।
——————–

মার্চ ১৭
কার্লোস ও গুডরন ল্যাঙ্কার্সডফ-এর জন্ম ও বেড়ে ওঠা জার্মানিতে।

১৯৭৩ সালে এই দুই নামজাদা অধ্যাপক মেক্সিকোতে আসেন। তাঁরা মায়া জনগোষ্ঠীর তোজোলাবাল গোত্রে নিজেদের পরিচয় করিয়ে দেন এভাবে – ‘আমরা আপনাদের কাছে শিখতে এসেছি।‘আদিবাসী মায়ান ইন্ডিয়ান জমায়েত নিশ্চুপ নির্বাক। কেউ একজন নীরবতা ভেঙ্গে বলে উঠলেন, ‘এমন কথা আমরা এই প্রথম শুনলাম, তাই ঠিক বুঝতে পারছি না কি বলবো।‘
তারপর তাঁরা, গুডরন ও কার্লোস, বছরের পর বছর সেখানে শিখলেন অভিনব সব বিদ্যা আর জীবনের নব নব তাৎপর্য! তারা শিখলেন মায়ান ভাষায় কর্তা-কর্মের কোন ভেদ নেই। তাঁদের ভাষায় ‘আমি পানি পান করি‘ অবলীলায় হয়ে যায় ‘পানিও পান করে আমাকে‘ আর ‘আমাকে সবাই দেখছে‘ মানে ‘আমি দেখছি‘।
তাঁরা আরো শিখলেন মায়ান রীতিতে সম্ভাষণ –

-‘আমিই তুমি‘
-‘তুমিই আমি‘
——————–

মার্চ ১৮
আনাল হক

আন্দিজে আগ্রাসনবাদী স্প্যানিশরা আদিবাসীদের সকল দেবতাকে নির্বাসনে পাঠায়! সব ধরনের দেব-দেবী, প্রতিমা পুত্তলিকা পদদলিত ভূলন্ঠিত করে।
কিন্তু ১৫৬০ সালের দিকে দেবতারা ঠিকই ফিরে আসে । পঙ্খিরাজের ডানায় ভর করে তারা উড়ে আসে পেরুর আয়াকুচু অঞ্চলে – নেমে আসে বলিভিয়ার ওরুরু শহরে। কোথা থেকে যে তারা আসে তা কেউ জানে না। উড়ে এসে তারা বসে আগ্রাসীদের উত্তরপুরুষের বুকের ভেতর। বুকের মধ্যে তারা তাথৈ তাথৈ নৃত্য জুড়ে দেয়। এই নাচ বিদ্রোহের নাচ, নাচের মুদ্রা বন্ধন মুক্তির মুদ্রা, নাচের ধ্বনি অস্বীকারের স্পর্ধিত ধ্বনি! তাই যারা নাচে, নেচে নেচে বিদ্রোহ করে তাদের জন্য আছে কঠিন শাস্তি – চাবুক আর কঠিন ফাঁসের বিভীষিকা!
কিন্তু বুকের লুকানো দেবতা নিরন্তর নাচতে থাকে, নাচের মুদ্রায় মুদ্রায় ঘোষণা করে নির্যাতনের প্রতিবাদ, অপমানের প্রত্যাঘাত।
আন্দিজের কেচুয়া ভাষায় নাউপা শব্দের অর্থ ‘ছিল‘এবং এর আরেক অর্থ ‘থাকবে‘!
‘নাউপা’ তাদের দেবতা!
——————–

মার্চ ১৯
চলচ্চিত্রের জন্ম

১৮৯৫ সালের লুমিয়ের ভাতৃদ্বয় – লুই ও অগাস্ট – কারখানা থেকে শ্রমিকদের বের হয়ে যাওয়ার একটি দৃশ্য চলচ্চিত্রায়িত করেন। ইতিহাসের প্রথম সেই সিনেমা দেখার সুযোগ পান মাত্র কয়েকজন দর্শক। ডিসেম্বরের ২৮ তারিখ সবার জন্য উন্মুক্ত প্রদর্শনী চালু করেন তাঁরা। প্যারিসের গ্র্যান্ড ক্যাফের হলরুমে ম্যাজিক লন্টনের এই নবজাতক শিশু, চলন্ত জীবনের রহস্যভরা চাকা আর আলো-ছায়ার মায়াবী জগতের উদ্বোধন হয় সেদিন।
প্রদর্শনী ছিল হাউসফুল! কানায় কানায় পূর্ণ ৩৫ জন দর্শক ছিল সেই হলরুমে। প্রতিটি টিকিটের মূল্য ছিল ১ ফ্রা। সেদিন দর্শকসারিতে উপস্থিত ছিলেন জর্জ মিলিয়্যে। তিনি আজব এই ক্যামেরা তখনই কিনে নিতে চাইলেন। লুমিয়ের ভাইয়েরা রাজি হননি।
জর্জ মিলিয়্যে নিজেই তাই আবিষ্কার করলেন অভিনব এক মুভি ক্যামেরা।
এরপরই শুরু হল চলচ্চিত্রের সত্যিকার অগ্রযাত্রা।
——————–

মার্চ ২০
এমন যদি হতো

২০০৩ সালের মার্চ মাসের ২০ তারিখ। ইরাকি বিমানবাহিনী যুক্তরাষ্ট্রে বোমা হামলা শুরু করে। বোমা হামলার মধ্যে দিয়ে ইরাক আমেরিকার মাটিতে অনুপ্রবেশ করে। ফলে, ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের শিকার হয় আমেরিকা। অসংখ্য বেসামরিক নাগরিক যাদের অধিকাংশ নারী ও শিশু বোমা হামলায় নিহত ও পঙ্গু হয়ে যায়। হতাহতের প্রকৃত সংখ্যা কেউ জানে না, কারণ হানাদার বাহিনীর ক্ষয়ক্ষতির হিসাব ঐতিহ্যগতভাবেই লুকিয়ে রাখা হয় আর আক্রান্ত দেশের হতাহতের তালিকা তো একান্তই নিষিদ্ধ বিষয়!
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের গণবিধ্বংসী অস্ত্রের মজুদ ইরাক ও সমগ্র মানবতার জন্য হুমকি স্বরূপ। যুদ্ধ তাই অনিবার্য হয়ে পড়ে। ইরাক আলাস্কার তেলের নিয়ন্ত্রণ নিতে চায় এমন প্রতারণামূলক গুজবের কোন ভিত্তি নেই। ইরাক চায় আমেরিকার গোপন মারনাস্ত্র থেকে মানবতার মুক্তি, বিশ্ববাসীর হেফাজত।
——————–

মার্চ ২১
দুনিয়া এমনই

গণহত্যার কদর্য ইতিহাসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেই সবচেয়ে বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে! কিন্তু গণনায় বা লিখিত তালিকায় মৃতের সংখ্যা অনেক কম দেখানো হয়। কারণ ঔপনিবেশিক দেশগুলো থেকে যেসব সৈন্য নিহত হয়েছে তাদের নাম এই তালিকায় নেই। তাঁরা হয়তো অস্ট্রেলিয়ান আদিবাসী ভারতীয় বারমিজ ফিলিপিনো আলজেরিয়ান সেনেগালিজ ভিয়েতনামিজ অথবা অন্য কোন দেশের কৃষ্ণাঙ্গ কিংবা বাদামী চামড়ার মানুষ।
তাঁরা তাঁদের প্রভুর মহার্ঘ পতাকার জন্য লড়েছেন, জীবন দিয়েছেন। জীবনে তাঁরা তৃতীয় অথবা চতুর্থ শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে দয়া দাক্ষিণ্য পেয়েছেন মরনেও তাই।
চাই কি তার থেকেও কম!
——————–

মার্চ ২২
আজ বিশ্ব পানি দিবস

পানি থেকেই আমাদের উৎপত্তি।
জীবনের সূচনায় ছিল পানি। রক্তবাহী শিরা-উপশিরার মত শত সহস্র জলবতী নদী পৃথিবীর পুষ্টি যোগাচ্ছে অনাদিকাল থেকে। আমাদের প্রাণ ও চিন্তার উৎসকেন্দ্র – জৈবিক কোষ – আসলে পানির রহস্যময় জটিল আবাস।
অশ্রু – যা আমাদের কান্না ও স্মৃতির স্মারক তা-ও তো পানিই। স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়, আজকের ধূ-ধূ মরুভূমি ছিল গতকালের সবুজ উদ্যান। স্মৃতি আমাদের আরো স্মরণ করিয়ে দেয়, সেই দূর অতীতে সিক্ত পৃথিবী তার অফুরান পানির প্রবাহ নিয়ে ছিল একা – পানিতে কারো একক অধিকার ছিল না অথবা পানি ছিল সবার – সকল প্রাণের। তাহলে কে এই জলের ধারার অধিকার নিল!
পূর্বপুরুষ বানরই কী প্রথম দখল করে নিল জলের শক্তি! সেই কি ছড়ি ঘুরালো সবার উপর! যেমন ‘২০০১ আ স্পেস ওডিসি’ – সিনেমার শুরুতে দেখা যায়, পানির জন্য বানরকে পিটিয়ে হত্যা করা হচ্ছে!
আর ২০০৯ সালে যেদিন চাঁদের বুকে পানির সন্ধান পাওয়া গেল, চাঁদ দখলের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল সেদিনই!
দুঃখিত, প্রিয় চাঁদ মামা!
——————–

মার্চ ২৩
কেন আমরা গুম করি হত্যা করি

শুভ দিনের প্রত্যয় নিয়ে ১৯৮২ সালে, জেনারেল ইফ্রেইন মন্ট অন্য এক জেনারেল কে উৎখাত করে গুয়েতেমালার প্রেসিডেন্ট হয়ে বসেন।
এই প্রেসিডেন্ট পূর্বে যিনি ক্যালিফোর্নিয়ার এক চার্চের পাদ্রী ছিলেন ঘোষণা করেন, ‘ধর্মযুদ্ধে শেষ পর্যন্ত তাঁদের জয় হয়েছে। পবিত্র আত্মার সরাসরি সাহায্য ছাড়া এ-বিজয় সম্ভব ছিল না। পরমাত্মা তাঁর গোয়েন্দা বাহিনীকে যথাযথ দিকনির্দেশনা দিয়েছিল বলেই চারশ চল্লিশটি আদিবাসী গোত্রকে নিশ্চিহ্ন করা গেছে।‘
প্রেসিডেন্টের আরেক আধ্যাত্মিক উপদেষ্টা ফ্রান্সিসকো বিয়ানচি নিউ ইয়র্ক টাইমসকে বলেন,
‘অনেক আদিবাসী রাষ্ট্রবিরোধী গেরিলা যোদ্ধাদের সাহায্য-সহযোগিতা করে থাকে, তারা কি দুর্বৃত্ত নয়? তারা কি নাশকতা করছে না? এই নাশকতার শেষ কোথায়? এসব থামাতেই হবে। এই দুর্বৃত্তায়ন থামাতে গিয়ে দরকার মৃত্যুর মতো কঠিন শাস্তি। আর এটা করলেই মানুষ বলাবলি শুরু করে আমরা নিরপরাধ মানুষ হত্যা করছি।
আসলে তারা কি নিরপরাধ ধোয়া তুলসীপাতা? ‘
——————–

মার্চ ২৪
গুমের হদিশ গুম করি

১৯৭৬ সালের এই দিনে আর্জেন্টিনায় মিলিটারি স্বৈরশাসনের যাত্রা শুরু হয়, কালক্রমে যারা হাজার হাজার মানুষকে গুম ও হত্যা করবে।
কুড়ি বছর পর জেনারেল হোর্হে রাফায়েল নাদেলা ব্যাপক গণহত্যা ও গুমের অভিযোগের উত্তরে বলেন-
“না না ওদের গুলি করে করে মারা যাবে না। যেমন যেকোনো একটা সংখ্যাই ধরুন না কেন – ধরুন পাঁচ হাজার! আর্জেন্টাইন সুশীল সমাজ এত হত্যা মানতে পারবে না। বুয়েনেস আয়ার্সে গত কাল দুইজন, কর্ডবাতে আজ ছয়জন, রোজারিও তে আগামী কাল চারজন – এভাবে পাঁচ হাজারে পৌঁছে যাওয়া বেশ কঠিন। ব্যাপারটা বাস্তবসম্মতও নয়, এভাবে কী কাজ হয়? আমরা কী ধরে ধরে বলব নিহতদের দেহাবশেষ কোথায় আছে? আর একবার যদি নিহতদের তালিকা প্রকাশ পায় তাহলে হাজারো প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়- কে এদের হত্যা করেছে কখন কিভাবে কতজনকে মারা হয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি ।
তারচেয়ে বরং সমুদ্র বা নদীর তলদেশীই কী নিরাপদ নয়?”
——————–

মার্চ ২৫
দৈব ঘোষণা

আজকের মত কোন এক শুভ দিনে জিব্রাইল স্বর্গ থেকে কুমারী মেরির জন্য দৈব এক সুসংবাদ বয়ে আনেন। মাতা মেরির গর্ভে ঈশ্বরের সন্তান বেড়ে উঠছে।
কুমারী মাতার যাবতীয় অনুষঙ্গ দুনিয়াব্যাপী সসম্মানে পূজা পাচ্ছে –
তিনি যে জুতা পড়তেন,
তাঁর পোশাকপরিচ্ছদ,
মাথার ফিতে রুমাল চিরুনি,
ঘোমটা চুলের কাটা,
যীশুর দুধ খাওয়ার পাত্র, এবং
চার চারটি ওয়েডিং রিং

যদিও তাঁর একবারই বিয়ে হয়!
——————–

মার্চ ২৬
স্বাধীনচেতা ‘মায়া’ নারী
১৯৩৬ সালের আজ এই রাতে, কিনচিল শহরে মায়ান ইন্ডিয়ান ‘ফেলিপা পুট‘কে পাথর ছুঁড়ে হত্যা করা হয়।। তাঁর সাথে আরও তিন রমণীকে একইভাবে খুন করা হয়। তাঁরাও মায়া সম্প্রদায়ের এবং ফেলিপার সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হতাশা ও বিভীষিকার বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছিলেন।
এই চার নির্যাতিত মায়ান নারী আরোপিত অভিজাত শ্রেণীর মানুষের হাতে নিহত হন, ইউকাটানের অধিকাংশ ভূমি ও জনতা যাদের আজ্ঞাবহ দাস।
——————–

মার্চ ২৭
বিশ্ব নাট্য দিবস

২০১০ সালে বেসরকারি গণসংযোগ সংস্থা ‘মারে হিল ইনকর্পোরেটেড’ রাজনীতিবিদদের চিরাচরিত রাজনৈতিক নাটক বন্ধ করতে বলে। কিছুদিন আগেই যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিমকোর্ট নির্বাচনী প্রচারণায় কর্পোরেট অনুদানের ন্যূনতম পরিমাণের বিধান তুলে দেন। এখন চাইলে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান যথেচ্ছা চাঁদা বা অনুদান দিতে পারবে। তদবিরকারীদের নিকট থেকে ঘুষ নেওয়ার বিধি তো আগে থেকেই ছিল।
নতুন আইন * বলে ‘মারে হিল ইনকর্পোরেটেড’ মেরিল্যান্ড থেকে কংগ্রেসের মনোনয়নপত্র দাখিল করে। এখন থেকে তারা আর মধ্যস্বত্বভোগীদের শরণাপন্ন হবে না।
তাদের অহংকারী কণ্ঠস্বর, “এটা আমাদের গণতন্ত্র, একে আমরা কিনে নিয়েছি, আর এর জন্য অঢেল ব্যয় করেছি । সময় এসেছে এখন নিজেদের হাল ধরার – নেতৃত্ব দেওয়ার। ‘মারে হিল’ কে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করুন। টাকায় কেনা গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত করুন।“
অনেকেই একে নতুন কোনো রসিকতা বলে উড়িয়ে দিয়েছেন।

*ব্যক্তির মতো কর্পোরেশনও নির্বাচন করতে পারবে।
——————–

মার্চ ২৮
হলিউডের আফ্রিকা

১৯৩২ সালে ‘টারজান অফ দা এপস‘ মুক্তি পেলে সিনেমা হলগুলোতে লম্বা লাইন পড়ে যায়। আর সেদিন থেকে টারজানের হলিউডীয় হাঁকডাক আফ্রিকার ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। যদিও অভিনেতা জনি ওয়েসমুলার কখনোই আফ্রিকা যাননি।
টারজানের ভাষাজ্ঞান খুবই নগণ্য। ‘আমি টারজান‘ আর ‘তুমি জেন‘ – এ ছাড়া মানব ভাষার আর কিছু সে জানে না। কিন্তু তাঁর সাঁতারের দক্ষতার তুলনা নেই। অলিম্পিকে তাঁর পাঁচ পাঁচটা স্বর্ণপদক জয়ের রেকর্ড আছে। আর তাঁর মতো টারজান-চিৎকার আজ পর্যন্ত কেউ দিতে পারে নি। বনের রাজা সেই গর্জন আসলে ডগলাস শিয়ারারের অনন্য এক সৃষ্টি। গরিলা হায়েনা উট বেহালা পুরুষ ও নারীর উচ্চ স্বরের সংমিশ্রনে তিনি যে অভিনব আওয়াজ সৃষ্টি করেন, তা-ই আমরা টারজনের কন্ঠ শুনতে পাই।
টারজানের সেই ডাক শুনতে নারীভক্তরা জনির কাছে যারপর নাই কাকুতিমিনতি করত।
——————–

মার্চ ২৯
হে অরণ্য কথা কও

১৯৬৭ সালে আমাজনের ‘লেগো এগ্রিও‘ অরণ্যে আজব এক ঘটনা ঘটে সেদিন । মাটি ফুঁড়ে তেলের স্বতঃস্ফূর্ত ফোয়ারা বেরিয়ে আসে।
সেদিন থেকে পরবর্তী দুই যুগ ধরে টেক্সাকো পেট্রোলিয়াম কোম্পানি সেখানে রাজত্ব করে আসছে।
ঝকঝকে তকতকে চেয়ার টেবিলে বসে, গলায় ধবধবে ন্যাপকিন জড়িয়ে, বহুমূল্য ছুরি চামচ হাতে নিয়ে তেল ও গ্যাসের মহা উপাদেয় খাবার খেয়ে চলে তারা। খায় আর হাগে। হেগে হেগে আঠারো বিলিয়ন বিষাক্ত বিষ্ঠা বিসর্জন দেয় ইকুয়েডরের জঙ্গলে!
রেড ইন্ডিয়ানদের অভিধানে ‘দূষণ‘ বলে কোন শব্দ নেই। নদীতে যখন মাছ মরে ভেসে উঠলো, একের পর এক জলাশয় রাসায়নিক ভাগাড়ে পরিণত হলো, নদীর তীরের গাছ শুকিয়ে মরে গেল, পশুপাখি পালিয়ে গেল, মাটি উর্বরতা হারালো আর অসুস্থ শিশুর জন্ম হওয়া শুরু হলো – তখন তারা বুঝলেন দূষণ কি জিনিস!
ইকুয়েডরের সবরাষ্ট্রপতিই তাদের সাথে হাত মিলিয়েছে আর পেছন থেকে উৎসাহ দিয়েছে ব্যক্তিত্বহীন ধান্দাবাজ সব আমলা আইনজীবী সাংবাদিক ও বৈজ্ঞানিক।
——————–

মার্চ ৩০
আন্তর্জাতিক গৃহকর্মী দিবস

মারুজা জানেনা তার বয়স কত চলছে। পূর্বেও জানতো না, ভবিষ্যতেও জানবে না – এই তার নিয়তি!
দেখতে সুন্দরী নয় কুৎসিত কদাকারও নয় কিংবা বলা যায় সাধারণ চেহারার নারী-ও সে নয়। হাঁটার সময় তার হাতে থাকে কোদাল অথবা ঝাড়ু অথবা নিদেনপক্ষে চামচ বা বাসনপত্র। যখন সে জেগে থাকে মাথা ঝুলে থাকে কাঁধের নিচে আবার
ঘুমালে দু হাঁটুর মাঝখানে সেঁটিয়ে দেয় তার ছোট্ট মাথাটি। কথা বলার সময় মাটির দিকে এমনভাবে তাকিয়ে কথা বলে যেন রাজ্যের সব পিপড়ে গুনছে মনে মনে।
জ্ঞান হওয়ার পর থেকে সে অন্যের বাড়িতে বাড়িতে কাজ করছে । তার নিজের বাড়ি কখনোই ছিল না এখনো নেই। জীবন তার ‘লিমা‘ শহরে এর-তার হেঁসেলে খামারে কেটেছে একঘেয়ে ক্লান্তিকর।
শেষে একদিন সে নিজের আপন ঠিকানা খুঁজে পায়। এ ঠিকানা কখনোই পাল্টাতে হয় নি আর হবেও না কোনোদিন!
——————–

মার্চ ৩১
মশা

১৬৩১ সালের এই দিনে লন্ডনে জন ডান মারা যান।
শেক্সপীয়ারের সমসাময়িক এই কবির জীবদ্দশায় কোন কবিতাই প্রকাশ পায়নি।
আমরা আজ ভাগ্যবান – কয়েক শতাব্দী পর হলেও তাঁর বেশকিছু কবিতার দেখা পেয়েছি।

তেমনি একটি কবিতা –

‘বহুবার তোমাকেই ভালোবাসিয়াছি
নাম জানি নাই শুধু, মুখ ভুলিয়াছি।‘

অথবা –

‘সে আমার রক্তসুধা শুষে শুষে খায়
শোনিত তোমারো দেখি তার পেটে হায়।
তুমি আমি রক্তে মিশে আছি একাকার
উদরে বাসরশয্যা হাতে ফুলহার।‘

Facebook Comments

comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top