সাদাত হাসান মান্টোর ২টি গল্প ।। ভাষান্তর-জাভেদ হুসেন

মোমবাতির অশ্রু

ভাঙা দেয়ালের ওপর বানানো নোংরা তাক। তাকের ওপর মোমবাতি সারারাত কেঁদে কাটায়।

মোম গলে কামরার ভেজা মেঝেতে ঠান্ডায় কুঁকড়ে যাওয়া আবছা বিন্দুর মতো ছড়িয়ে পড়ে। ছোট্ট লাজো মুক্তার মালার জন্য জেদ ধরে কাঁদা শুরু করল। ওর মা মোমবাতির জমে যাওয়া অশ্রুগুলো একটা সুতোয় গেঁথে মালা বানিয়ে দিলো। ছোট্ট লাজো সেই মালা পরেই খুশি। হাততালি দিয়ে সে বাইরে চলে গেল নাচতে নাচতে।

রাত এলো… নতুন মোমবাতি জ্বলল ধুলোভরা তাকের ওপর। কামরার অন্ধকার দেখে অবাক হয়ে চমকে উঠল একচক্ষু মোমবাতি। তবে সামলে নিলো একটু পরেই। তারপর ঘরের নীরবতার সঙ্গে এক হয়ে দেখা শুরু করল নিজের চারপাশ।

ছোট্ট লাজো ঘুমাচ্ছিল একটা ছোট চৌকির ওপরে। স্বপ্নে সে বান্ধবী বিন্দুর সঙ্গে ঝগড়া করছিল। বিন্দুর পুতুলের সঙ্গে তার মেয়েকে কোনোভাবেই বিয়ে দেবে না সে। কারণ পুতুলটি দেখতে বিশ্রী। লাজোর মা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে নিস্তব্ধ আধো অন্ধকার রাস্তায় ফেলে রাখা আবর্জনার দিকে কী আশায় যেন তাকিয়ে ছিল। সামনে বন্ধ শুড়িখানার বাইরে একটা চুলা থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়ছিল জেদি শিশুর মতো কয়লার স্ফুলিঙ্গ।

ঢং ঢং করে বারোটা বাজল ঘণ্টাপরে। বারোটা বাজার শেষ ঘণ্টার আর্তনাদ ডিসেম্বরের ঠান্ডা রাতে কিছুক্ষণ কেঁপে আবার নৈঃশব্দ্যের কাঁথা গায়ে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। তার আগে সে লাজোর মায়ের কানেও গুনগুন করে শুনিয়ে গেল ঘুমের সুন্দর বার্তা। কিন্তু সেই গুনগুনের অন্তরা তার মনে অন্যকোনো কথা শুনিয়ে দিয়েছিল।

হঠাৎ করে শীতল হাওয়ার ঝাঁপটায় নূপুরের মৃদু ঝনঝন শব্দ ওর কানে এলো। সে কান পাতল সেই আওয়াজ ভালো করে শোনার জন্য।

রাতের নীরবতায় নূপুরের শব্দ বাজছিল যেন কোনো মুমূর্ষু মানুষের গলায় আটকে যাওয়া শেষ নিঃশ্বাস। শান্ত হয়ে বসে পড়ল লাজোর মা। বাইরে রাস্তায় ক্লান্ত ঘোড়ার শ্বাস রাতের নীরবতায় কেমন শিহরণ জাগিয়ে তুলছিল। একটা টাঙ্গা এসে দাঁড়াল গ্যাসবাতির খাম্বার কাছে। টাঙ্গাওয়ালা নিচে নামল। ঘোড়ার পিঠে একটা থাপ্পড় দিয়ে সে জানালার দিকে তাকাল। জানালার পর্দা ছিল ওঠানো। একটা আবছা ছায়াও লটকে ছিল দেয়ালের গায়ে।

নিজের মোটা কর্কশ কম্বল ভালো করে গায়ে জড়িয়ে টাঙ্গাওয়ালা নিজের পকেটে হাত ঢোকাল। সাড়ে তিন টাকা ভাড়া পেয়েছে। এর থেকে এক টাকা চার আনা সে নিজের কাছে রাখল। বাকি টাকা রেখে দিলো টাঙ্গার গদির নিচে। এবার সে এগোল সিঁড়ির দিকে। লাজোর মা চান্দো দরজা খুলে দিলো।

মাধব টাঙ্গাওয়ালা ভেতরে ঢুকে দরজার শেকল টেনে দিয়ে চান্দোকে জড়িয়ে ধরল। ‘ভগবান জানে, আমি তোকে কত ভালোবাসি…. যৌবনকালে তোর দেখা পেলে এই টাঙ্গা ঘোড়া সব বেচতে হতো!’ এই বলে সে চান্দোর হাতে এক টাকা গুঁজে দিলো।

চান্দো জিজ্ঞেস করল – ‘বাস, এই?’

“এই ধর, আরও দিলাম’, মাধব এবার রূপোর চার আনা ওর দ্বিতীয় হাতে রাখল। কসম, এই ছিল আমার কাছে।”

রাতের ঠান্ডায় বাজারে দাঁড়িয়ে ঘোড়া কাঁপছিল। আগের মতোই ঝিমাচ্ছিল গ্যাসবাতির খাম্বা।

মাধব বেহুঁশ পড়ে ছিল সামনে ভাঙা চৌকিতে। তার পাশেই চান্দো চোখ খুলে শুয়ে। দেখছিল মোম গলে গলে ভেজা মেঝেতে পড়ে ছোট ছোট মুক্তোর বিন্দুর মতো জমছে। হঠাৎ করে সে পাগলের মতো উঠে বসে পড়ল লাজোর চৌকির কাছে গিয়ে। ঘুমন্ত লাজোর গলায় মোমের বিন্দু নিঃশ্বাসের সঙ্গে দুলছিল। ঝাপসা চোখে মনে হলো যেন মোমবাতির এই জমে যাওয়া বিন্দুগুলোতে তার লাজোর অনাগত যৌবনের অশ্রু লুকিয়ে বাসা বেঁধেছে। তার কাঁপা কাঁপা হাত এগিয়ে লাজোর গলার মালা ছিঁড়ে ফেলল।

গলে শেষ হওয়া মোমবাতি থেকে জ্বলন্ত সুতো পিছলে নিচে পড়ে মেঝেকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়ল। ঘরে নিস্তব্ধতার সঙ্গে নেমে এল অন্ধকারও।




বাঘ এসেছে, বাঘ এসেছে, পালাও 

উঁচু টিলার ওপর রাখাল দাঁড়িয়ে। দূরে ঘন জঙ্গলের দিকে মুখ করে চিৎকার করছিল – ‘বাঘ এসেছে, বাঘ এসেছে, পালাও।’ বহুক্ষণ গলা ফাটিয়ে চিৎকার চলতে লাগল। জওয়ান গলার আওয়াজ। সেই আওয়াজ ভেসে বেড়াল চারদিকে – বহুক্ষণ। চিৎকার করতে করতে যখন তার গলা শুকিয়ে এসেছে, তখন গ্রাম থেকে দু-তিনজন বুড়ো এলো। লাঠি ঠুকতে ঠুকতে হাঁপাতে হাঁপাতে। এসেই রাখালের কান ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গেল।

ডাকা হলো পঞ্চায়েত। এসে জমা হলো গ্রামের সব বুদ্ধিমান লোক। শুরু হলো রাখালের বিচারকাজ। অভিযোগ – ভুল খবর দিয়ে গ্রামে অশান্তি সৃষ্টি করা।

রাখাল বলল- “মুরব্বিরা, তোমরা ভুল বুঝছ…বাঘ আসেনি

মানে যে আসবে না, এমন তো নয়।’

জবাব এলো – ‘হতেই পারে না।’

রাখাল বলল – ‘কেন হতে পারে না?’
উত্তর এলো – ‘বন বিভাগের লোকজন আমাদের চিঠিতে জানিয়েছে যে বাঘ বুড়ো হয়ে গেছে।

রাখাল পাল্টা জানাল – ‘তোমরা জানো না, বাঘ কদিন আগেই যৌবন ফিরে পাওয়ার চিকিৎসা করেছে।’

এক বুড়ো বলল – ‘একদম গুজব, আমরা বন বিভাগের লোকদের জিজ্ঞেস করেছি। চিকিৎসার বদলে বাঘ তো নিজের সব দাঁত ফেলে দিয়েছে। জীবনের বাকি দিনগুলো সে অহিংসার পথে কাটাতে চায়।’

রাখাল এবার তেড়ে উঠল – ‘এই খবর মিথ্যাওতো হতে পারে!” সবাই একজোটে এবার বলল – ‘কখনো না। বন বিভাগের ওপর আমাদের পুরো বিশ্বাস আছে। ওরা সত্য বলার শপথ নিয়ে চাকরি নেয়।’

রাখাল পাল্টা জবাব দিলো – ‘কেন? শপথ মিথ্যা হতে পারে না?’

জবাব এল – ‘কখনোই না…তুমি ষড়যন্ত্রকারী, ফিফথ কলামিস্ট, কমিউনিস্ট, গাদ্দার, প্রগতিশীল…তুমি সাদাত হাসান মান্টো!”

রাখাল হাসল। বলল – ‘তবু ভালো, যে আসবে, আমি সেই বাঘ নই… বন বিভাগের লোকজন মোটেই সত্য বলেনি….আমি… আমি…’

পঞ্চায়েতের এক বুড়ো রাখালের কথা থামিয়ে বলল, “তুমি সেই রাখালের বংশধর না, যার গল্প স্কুলের বাচ্চাদের পড়ানো হয়? তোমার অবস্থাও ওর মতো হবে। বাঘ আসলে তোমাকেই খাবে।’
রাখাল আবার হাসল, “আমি তো বাঘের সঙ্গে লড়ব। আমি জানি সে আসবে। তোমরা বোঝো না কেন! যে গল্প বাচ্চাদের স্কুলে পড়ানো হয়, সে আজকের গল্প নয়! আজকের গল্পে “বাঘ এসেছে, বাঘ এসেছে” মানে সাবধান থাকো। সতর্ক থাকো। হয়তো বাঘের বদলে নেকড়েই এসে পড়ল! তাকে তো আটকানো দরকার!’

সবাই হো হো করে হেসে উঠল – ‘কী ভিতু রে বাবা! নেকড়েকে ভয় পায়!’

রাখাল বলল – “বাঘ-নেকড়ে কাউকেই আমি ভয় পাই না। তবে এদের হিংস্রতা নিশ্চয়ই পছন্দ করি না। তাই নিজেকে তৈরি রাখি। মুরব্বিরা, তাহলে স্কুলের বই থেকে গল্পটা বাদ দিয়ে দাও! সে গল্প তো পুরনো হয়ে গেছে। তার বদলে আজকের এই নতুন গল্পটা পড়াও।”

কাশতে কাশতে বলল এক বুড়ো – এ ছেলে দেখি আমাদের ভুল পথে নিয়ে যেতে চায়! সরল পথে থেকে আমাদের সরানোর ধান্দা!’

রাখাল হেসে বলল- ‘দাদু, জীবন সরল নয়।

আরেক বুড়ো রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলল – এ দেখি বিধর্মী! অশান্তি সৃষ্টিকারীদের এজেন্ট! একে এক্ষুনি জেলে ঢোকানো হোক!’

রাখালকে জেলে ঢোকানো হলো।

সেই রাতেই গ্রামে বাঘ এলো। চারদিকে ছোটাছুটি শুরু হয়ে গেল। কেউ গ্রাম ছেড়ে পালাল, বাকিরা মরল বাঘের থাবায়। | গোঁফ থেকে রক্ত চাটতে চাটতে বাঘ যখন জেলখানার পাশ দিয়ে যাচ্ছিল, দেখল মজবুত লোহার গরাদের ওপাশে রাখাল। রাগে গড়গড় করল বাঘ। কিন্তু নিরুপায়!

রাখালের ঠোঁটে আবার হাসি। বলল – ‘বন্ধু, সব দোষ আমার মুরব্বিদের! নইলে আমার রক্তের স্বাদও তুমি পেতে।’

[গল্প দুইটি গ্রন্থিক প্রকাশন থেকে প্রকাশিত (২০২১) গ্রন্থ ‘মির্জা গালিবের সাথে আরও কয়েকজন’ থেকে সংগৃহীত]

Facebook Comments

comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top