একটি বন্য স্বপ্নের অন্ধ যাত্রা (১৬ম পর্ব) // নীলিম কুমার II অসমিয়া থেকে অনুবাদ: বাসুদেব দাস

(৩৭)

বারান্দার চেয়ারে তরুণী পিসি বসে ছিল।

জিনিসপত্রের সঙ্গে বাবা গজেন্দ্রনাথ রাহুল এবং নতুন কনের রূপে রাহুলদের নতুন মাকে দেখে তরুণী উঠে দাঁড়াল। সে অস্ফুট স্বরে কিছু একটা বিড়বিড় করে বলল। সাধারণত কোনো মানুষ এই ঘরে প্রবেশ করলেই তরুণী প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। তরুণী যদি কাউকে পছন্দ না করে তাহলে অনেকক্ষণ ধরে চেয়ার থেকে একবার উঠে একবার বসে, আবার উঠে আবার বসে। এরকম করতে থাকে এবং মুখে বলতে থাকে ‘যা… যা… যা…’।

অনেকক্ষণ ধরে তরুণীকে কখনও কখনও ক্ষান্ত করতে পারা যায় না ।তখন অমৃতপ্রভা তাকে অন্ধকারের মধ্যে পড়ে থাকা তার বিছানায় নিয়ে যায় এবং শুইয়ে দেওয়ার যত্ন করে। অবশ্য কখনও তাকে গজেন্দ্রনাথ একবার ‘এই করবি না’ বলে ধমক দিলে সে শান্ত হয়ে পড়ে।আজ ভোঁতা হয়ে পড়া মস্তিষ্কে হলেও তরুণী নিশ্চয় বুঝতে পেরেছিল‐– গজেন্দ্রনাথ এবং রাহুল যাকে আদর করে এনেছে সে সাধারণ নয়। সে বরুণের দ্বিতীয় পত্নী ।অনাথ ছেলেমেয়েদের মা এবং গজেন্দ্রনাথ অমৃতপ্রভার বড়ো বৌমা শশীর জায়গা পূরণ করতে এসেছে।

নতুন ঘরের বারান্দা থেকে নেমে এসে ভানু নতুন বৌমাকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেল। তজো দীর্ঘ বারান্দার কাঠের বাটনে গজাল মেরে কনের আনা ছবি গুলি ঝুলিয়ে দিল ।এতদিন শূন্য হয়ে পড়ে থাকা বারান্দাটিতে নেমে এল এক সম্পূর্ণতা এবং গাম্ভীর্য। বরুণ বারান্দায় ঝুলিয়ে দেওয়া ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে কোনো মন্তব্য করল না। এর অর্থ বরুনের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন স্বভাবে তজোর কাজকে সমর্থন জানাল।

এখন রাহুলদের ঘরের প্রত্যেককে হাঁসটার  নিচে দিয়ে আসা-যাওয়া করতে হল। হাঁসটা ছিল পাতি হাঁস।

রাহুল ওদের নতুন মা ঘরের ভেতর কী করছে না করছে, কোনো কষ্ট হচ্ছে কিনা, বাড়ির সবার সঙ্গে  মেলামেশা করতে পারছে কিনা ইত্যাদি কথাগুলি লক্ষ্য করতে লাগল। সে যেন নিজেই এক দায়িত্ববোধ নিজের মাথায় চাপিয়ে নিল। তাই সে মাঝে মধ্যে হঠাৎ খেলাধুলা করে থাকার সময় সঙ্গীদের ‘প্রস্রাব করতে যাই’ বলে মাকে একবার গিয়ে দেখে আসে। এভাবে সে মাকে  কাছ থেকে, দূর থেকে এবং মনে মনে লক্ষ্য করে থাকে‐সত্যি এই শান্তশিষ্ট মায়ের প্রতি তার ভালোবাসা উথলে উঠতে থাকে।

রাহুল দেখে-ওদের নতুন মা ঘরটাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। তিনি ঘর ঝাড়ু দেন, ঘর মোছেন, রান্নাঘরে ভাত‐তরকারি রান্না করেন, কাপড় ধুয়ে দেন। কিন্তু রাহুল সবচেয়ে ভালোবাসে সেই দৃশ্যটা‐- মা স্নান করে এসে যখন উঠোন এসে দাঁড়ান এবং মায়ের চুল থেকে টপটপ করে ঝরে পড়া জলে রোদ ঝলমল করে উঠে। সে দেখে মা ভিজে চুলগুলি শূন্যে তিন চারবার ঝাঁকিয়ে নেয় এবং বৃষ্টির মতো ছিটকে পরা সেই জল মাটির উঠানটা শুষে নেয়।

সবুজ খেলাধুলার সেই বন্য জগতটিতে আত্মহারা হয়ে রাহুল ভাবছিল ওদের নতুন মা বাড়িটাতে পরিবর্তন আনুক, ওদেরকে আদর করুক,শশী রেখে যাওয়া এক বছরের বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিয়ে ঘুম পাড়ানি গান গাওক, ঘুম পাড়াক। কিন্তু সে দেখে, তার সবচেয়ে ছোটো ভাইটা বেশিরভাগ সময় নীপার কোলে উঠে থাকে এবং রাতের বেলা তাকে সঙ্গে রাখে অমৃতপ্রভা। রাহুল বুঝতে পারে না কেন এরকম হচ্ছে। সে ভাবে-সমস্ত কিছুই তো বরুণের নির্দেশে চলে, কেন বরুণ এবং ঠাকুরমারা তাদের কনিষ্ঠ ভাইটিকে নতুন মায়ের হাতে সম্পূর্ণ ভাবে ছেড়ে দেয় না।

পরিবারের এবং প্রতিবেশীদের প্রিয় শশীর জায়গা পূরণ করার জন্য গজেন্দ্রনাথের বাড়িতে নতুন মানুষটা আসার পরে ভানুর কার্যকলাপ এবং আচরণে কিছু পরিবর্তন হতে দেখা গিয়েছিল।

রাহুলদের ঘরটিতে তিনবার ভাত রাঁধা হতো। সকালের ভাত ছেলেমেয়েদের সঙ্গে গজেন্দ্রনাথশাও খেয়ে নিতেন। অবশ্য শালগ্রাম শিলাকে স্নান করিয়ে চন্দনের ফোঁটা তিলক এবং কানে নির্মাল্য নেওয়া গজেন্দ্রনাথ ছেলেমেয়েদের দলটির সঙ্গে একসঙ্গে খেলেও আলাদাভাবে বসতেন। তাকে আলাদাভাবে খাবার দেওয়া হত। ধোঁয়া উঠতে থাকা মাড়  ভাত কাঁসার থালায় বেড়ে দিয়ে নুনের বাটিটা এবং ঘিয়ের বোতলটা সামনে রাখা হত। গজেন্দ্রনাথ চামচ দিয়ে নিজের পরিমাণে ঘি ,নুন  নিয়ে নিত। আর অন্যদিকে তার নাতি-নাতনিদের দেওয়া হত মিঠা তেল এবং নুন মেখে গরম গরম ভাত। ছেলেমেয়েদের ঘিয়ের বদলে মিঠা তেল দেওয়ার নির্দেশ ছিল স্বয়ং বরুণের। গজেন্দ্রনাথ তার নাতি-নাতনিরা যে ঘি না খেয়ে সরষের তেলের জোরে বড় হচ্ছিল এই কথা বিন্দু বিসর্গ  জানত না। কোনো কারণে বরুণ নিজের ছেলেমেয়েদের ঘি খাওয়াটা সহ্য করতে পারত না। কোনো কারণে বরুণ ওদের ঘি খাওয়ার যোগ্যতা নাই বলে ধরে নিয়েছিল। কিন্তু ওরাই গরু চড়াত, গোয়াল ঘরে গরু বাঁধত ওরাই, ওরাই গরুর জন্য মাঠ থেকে নড়া কেটে আনত। তার বিনিময়ে গাভীগুলি ওদেরকে দুধ দিত। কিন্তু ওদেরকে দুধও খেতে দেওয়া হত না। রাহুলদের ওই দলটির কেউ একদিনও এক গ্লাস দুধ খেয়েছে একথা বলতে পারবে না। যদি ওদের কারও কখনও জ্বর হয়, তখন ভাতের পরিবর্তে দুটি ব্রেডের সঙ্গে এক কাপ দুধ খেতে দেওয়া হত, সেই এক কাপ দুধের জন্য ওরা ভগবানের কাছে প্রার্থনা করত‐-‘ ভগবান আমাদের শরীর গরম করে দাও…’ বাড়িতে যতটুকু দুধ হত, চায়ের জন্যই লেগে যেত। আর দুধের সর একটা বাসনে রেখে রেখে সাত থেকে দশ  দিন পরে পরে সেটা থেকে অমৃতপ্রভা আগুনে জ্বাল দিয়ে ঘি তৈরি করত। ঘি তৈরি করলে ‘ক্রিম’ নামে এক ধরনের সুখাদ্য জিনিসের উৎপাদন হয়। সেই ‘ক্রিমের দাবিদার ছিল রাহুলরা। সামান্য নুন মেখে অমৃতপ্রভা রাহুলদের প্রত্যেককে সেই ক্রিম ভাগ করে খেতে দিত।

এমনকি গজেন্দ্রনাথের ঘি খাওয়াটাও বরুণ সহ্য করতে পারত না। গজেন্দ্রনাথ ভাতের পাতে বসে ঘি বের করার দৃশ্যটা বরুণ প্রায় লক্ষ করত এবং অমৃতপ্রভা, ভানুদের সামনে ব্যক্ত করত এই বলে–’ বাবার ভাতের সঙ্গে ঘি নেওয়াটা দেখেছ– নামে এক চামচ, কিন্তু তিন চামচের কম নয়।’

কিন্তু গজেন্দ্রনাথকে এই কথা বলে কে? বরুণের এই মনোভাব গজেন্দ্রনাথের কাছে ব্যক্ত করতে পারা মানুষ শশী ছাড়া অন্য কেউ ছিল না। শশী এখন আকাশের বাসিন্দা এবং কেউ যদি সাহস করে গজেন্দ্রনাথকে বলত, বরুণের এই অসন্তোষের কথা, গজেন্দ্রনাথ মুখ ভেঙ্গিয়ে  বলে উঠতেন–’ ওর কি আসে যায়? গরু তো আমি পুষেছি।’

গরু পুষেছিল গজেন্দ্রনাথ। ছাই দিয়ে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করা দুধ দোয়ানো পিতলের বালতিটা দু হাঁটুতে চেপে ধরে গজেন্দ্রনাথ দুধ দোয়াত। তাই গজেন্দ্রনাথের ঘি খাওয়ার পুরো অধিকার ছিল। বরুণের অধিকার গুলি ছিল অন্য ধরনের। একদিনও গোয়ালঘরের দিকে না মাড়ালে কী হল, গোয়াল ঘরে উৎপাদিত ঘিয়ের ওপরে যেন বরুনের অধিকার ছিল। একদিনও একটা নারকেল না কাটলে কি হল, নারকেল নাড়ুর বৈয়ামটার ওপরে অধিকার ছিল বরুণের । অতিথিকে চায়ের সঙ্গে নাড়ু দিতে হলে বরুণের অনুমতির প্রয়োজন ছিল । তাই মাঝে মধ্যে দুপুর বেলার নির্জনে রাহুল ভাই জিন্টুর  সঙ্গে বিড়ালের মতো সন্তর্পনে নারকেলের নাড়ুর বৈয়াম থেকে শুভ্রতা চুরি করে তার অমৃত স্বাদ গ্রহণ করেছিল । সেরকম করলে নাড়ুগুলি কারো জিভায় গলে মস্তিষ্কের  কোষে ঘষে ছড়িয়ে পড়ার জন্য উদ্বেল হয়ে থাকে।

(৩৮)

কিছুদিন থেকে রাহুল- জিন্টুরা কাকিমণি ভানুর অন্য এক আচরণ লক্ষ্য করেছে । সকালবেলা ভাত খাওয়ার সময় রাহুলরা প্রত্যেকেই মুখোমুখি পিঁড়ি পেতে বসে। ভানু ভাত বেড়ে দেয়। ধোঁয়া উড়তে থাকা মাড় ভাত গরমের জন্য নিজে মাখতে না পারা কয়েকজনকে ভানু নুন তেল দিয়ে মেখে দেয়।ঘিয়ের স্বাদ পেয়ে অনুপ আরও ভাত চায়।সমস্ত ছেলেমেয়ের মধ্যে অনুপের স্বাস্থ্যই ভালো।সে আঁটোসাটো,শরীরে শক্তিও আছে ,খায়ও বেশি।ভানু সবসময় তাকে মনে মনে কিছু না কিছু খাইয়ে থাকে।এক সঙ্গে খেলতে থাকার সময় তাকে মাঝে মধ্যে ঘরে ডেকে নেয়।আর সে যখন সঙ্গীদের কাছে ফিরে আসে,তার মুখে রাহুলরা কিছু না কিছু খাবার গন্ধ পায়।রাহুল-জিন্টুরা তাকে বলে ,’দেখি হাঁ কর,তুই কিছু খেয়ে এসেছিস।’

সে না,না,না করে।অনুপ যে একটু লোভী প্রকৃ্তির সে কথা সবাই জানে।তাই তাকে চুপিচুপি ভানুর খাবার দেওয়াটা রাহুলরা সহ্য করতে পারে না।ওরা সেটাকে অন্যায় বলে মনে করে,দুঃখও পায়।দুপুরবেলা বা রাতের খাবার সময়ও ভানু কাকিমা অনুপদের দিকে একটু বেশি করে নজর দেয়।মাংস বা মাছের বড়ো টুকরোগুলি পড়ে ওদের পাতে।মাছ-টাছ না থাকলেও আলুর টুকরোগুলি পড়ে ওদের ভাগে,ডাল থাকে ওদের জন্য,ডালের জলগুলি ওদের ভাগে পড়ে।আর অনুপ,সে তো মার কাছে জোরজুলুম করে –‘আমার আরও মাংস চাই,আমাকে আলু দাও,আমাকে আরও ভাত দাও…’।

কারই বা ইচ্ছা করে না আরও একটু খেতে এবং এক টুকরো মাংস বা আলু পেতে।কিন্তু ইচ্ছা হলেও রাহুল-নীপারা কাকিমার কাছে সেই দাবি করতে পারত না। শশীর খালি জায়গা পূরণ করার জন্য আগত নতুন মা ও ছিল প্রয়োজনের তুলনায় বেশি শান্ত এবং নির্বিকার।তাই যা দেয়,যা ভাগে পড়ে তাই খেয়ে রাহুলরা দুঃখের জল গিলে ফেলত।

ভানুর আশকারা পেয়ে অনুপ-রিকিরা খাবারের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছিল।আর রাহুল-নীপাকে নিয়ে ওদের নিজের ভাইগুলি –প্রত্যেকের বুকে ঈর্ষা এবং দুশ্চিন্তার জন্ম হয়েছিল।এই এক ডজন ভাই বোনের মধ্যে থাকা এত স্নেহ ভালোবাসার কোথায় যেন একটা ফাটল সৃষ্টি হচ্ছিল।রাহুলদের এই দুঃখের কাহিনি শোনার জন্য কেউ ছিল না,উইয়ের ঢিবিটা ছাড়া।

রাহুল পুনরায় উইয়ের ঢিবিটার কাছে দৌড়ে গেল।সে তার মনের কথাগুলি বলল।উইয়ের ঢিবিটার সঙ্গে বাঁশঝাড়টাও তার দুঃখের কথা শুনল।অবশ্য রাহুলের হাতে অস্ত্র ছিল।সেই অস্ত্র প্রয়োগ করে সে ওদের এই নতুন সমস্যাটার সমাধান করার জন্য একটা বুদ্ধি বের করল।

সে ওদের প্রতিটি ভাই বোনকে ডেকে এনে গম্ভীর ভাবে বলল যে গতরাতে তাকে স্বপ্নে ভগবান নির্দেশ দিয়েছেন– বলেছেন, কেউ কারও কাছে খাবার জিনিস চাইতে পারবে না। চুপি চুপি কেউ কাউকে খাবার দিলেও খেতে পারবে না। ভাতের সঙ্গে রাঁধুনী যা দেয় তাই খেতে হবে– একবারও নিজে থেকে চাইতে পারবে না। ভাত খাবার সময়’ কিছু লাগবে কি’ বলে রাঁধুনী জিজ্ঞেস করলে শুধুমাত্র মাথা নেড়ে জবাব দিতে পারবে, মুখে কিছু বলতে পারবে না। স্বপ্নে ভগবান দেওয়া এই আদেশ আমাদের সবাইকে মেনে চলতে হবে।…’

রাহুল সবাইকে প্রশ্ন করল–’ তোরা বল, এই কথা মেনে চলবি কিনা? যদি কেউ এই নির্দেশ না মানে তাহলে তাকে আমাদের সঙ্গে খেলতে দেওয়া হবে না, তার সঙ্গে কথাবার্তা বন্ধ করা হবে…।’

প্রত্যেকেই রাহুলের কথায় সায় দিয়েছিল। এমন কেউ ছিলনা যে রাহুলের কথায় বিশ্বাস করেনি। রাহুল যা বলেছিল সেটা তো ন্যায় এবং ধর্মের কথা। শিশু হলেও ওদের একটা ধর্মবোধ ছিল। প্রতিদিন বিকেল বেলা গজেন্দ্রনাথের মুখ থেকে রামায়ণ- মহাভারত শোনা ঘরটা ন‍্যয় কী, অন্যায় কী, ধর্ম কী, অধর্ম কী জানত?

জিন্টু অনুপের দিকে তাকিয়ে বলল–’ তুই মানবি কিনা বল। তুই তো বেশ লোভী। যদি না মানিস, আমাদের সঙ্গে তোর খেলা-ধুলা বন্ধ।। আমাদের কাছাকাছি আসতে পারবি না।’

অনুপ বলল–’ মানব… মানব… মানব…। কিন্তু যদি কখনও ভুলে যাই!’

রাহুল গম্ভীর ভাবে উত্তর দিল–’ সেই জন্য আমরা এই ধর্মটির একটা নাম দেব। নামটা হল ‘যিদি’। অর্থাৎ যা দেয় তাকেই নিতে হবে, চাইতে পারবেনা। আমরা যখন ভাত খেতে বা চা( শরবত- দুধ- জল) খেতে যাব, তখন আমরা একে অপরকে মনে করিয়ে দেবার জন্য উচ্চারণ করব–’ যিদি যিদি যিদি…।’ তারপর রাহুল সবাইকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিল–’ আজ থেকে ‘যিদি’ ধর্ম মেনে চলব।’.

সকালে ভাতের থালা নিয়ে বসে একে অপরকে বলল–’যিদি ‘ কথাটা সবাই কিন্তু মনে রাখবি।’

ভানু ভাত বেড়ে দেওয়ার সময় অনুপ মাকে বলল–’ মা আমি কিন্তু ঘি খাব না, নুন তেল খাব।’

রাহুল নিজের কূট–কৌশলের ফলাফল দেখে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠল। এভাবেই রাহুল ওদের মাঝখানে ভানু ছড়িয়ে দিতে চাওয়া অন্যায়কে প্রতিহত করার চেষ্টা করতে লাগল।

(৩৯)

বসন্তকালে টিহুর  চকে বাসন্তী পুজো হয়েছিল। টিহুর চক মানেই ছিল মৌজাদারের বাড়ি অর্থাৎ রাহুলদের মামার বাড়ি। সেখানেই শশী নামের অতীতটার জন্ম হয়েছিল, আজ যার সেই বাড়িতে কোনো চিহ্ন নেই। রাহুলদের মামা অর্থাৎ শশীর নিজের ভাই গুলির মুখে তো দিদির কথা একেবারেই বের হত না। বাসন্তী পূজার আনন্দ উৎসবে সেই দিদিটির কথা কারও মনে পড়েনি।

বাসন্তী পূজা দেখার জন্য রাহুল এবং নীপাকে মামার বাড়িতে পাঠানোটা যেন বরুণের এক অঘোষিত কর্তব্য ছিল। সেই বরুণ প্রতিবছর বাজার-বাসের আসা- যাওয়া ভাড়াটা রাহুলের হাতে গুঁজে দিয়ে টিহুর চকে পাঠিয়ে দিয়েছিল। সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী এবং দশমী– এই চার দিন রাহুল-নীপা ছিল মুক্ত বিহঙ্গ। মামারা তাদের কম দামি বেলুনের- বাঁশি কিনে দিয়েছিল। মুড়ির লাড্ডু এবং তেলে ভাজা পাপড় কিনে দিয়েছিল। কম দামি হলে কী হবে? সেই পাপড়ের স্বাদের কাছে বরুনের বন্ধু মালচান্দ বা মঙ্গোলিয়ার বাড়ির পাপড়ের স্বাদও পাত্তা পেত না।

প্রতিদিন রাতে যাত্রা পার্টির নাটক হয় সেই পূজা মন্ডপে। মাটিতে খড় পেতে দিয়ে বসার ব্যবস্থা করা হয়। অবশ্য কিছু মানুষ বাড়ি থেকে বসার জন্য বস্তাও নিয়ে যায়, কিছু মানুষ আবার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখত, মাটিতে খড় পেতে যে সমস্ত শিশুরা বসে আছে তাদের সঙ্গে একাকার হয়ে যাবে বলে ভেবে। যাই হোক না কেন প্রত্যেকেই কিন্তু সমান উপভোগ করেছিল যাত্রাপার্টির কেবল অভিনয় নয়, সাজ সজ্জা প্রসাধন ইত্যাদিও। মহিলা অভিনেত্রী না থাকার হেতু সেই যাত্রা পার্টি গুলিতে প্রায়ই পুরুষদের  মহিলার অভিনয় করতে হত। নিখুঁতভাবে দাড়ি কামিয়ে নিলেও, কণ্ঠস্বর যতটা সম্ভব কোমল করলেও, চলাফেরায় যতটা সম্ভব কোমরে দোলার সৃষ্টি করলেও, বুকে কিছু একটা ঢুকিয়ে নিয়ে নারীর স্তনের সদৃশ করলেও ওরা যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পুরুষের মতো প্রস্রাব করে, সে কথা মাটিতে খড় পেতে বসে নাটক দেখা ছোটো ছোটো বাচ্চারা জানত। তাই সেই নারী চরিত্রগুলির অভিনয় শুধুমাত্র কৌতুকের সৃষ্টি করেছিল! ওরা যখন কান্নার অভিনয় করে, তখন কৌতুকের মাত্রা আরও বেড়ে গিয়েছিল। সেই যাত্রাভিনয়ের খলনায়ক যত বেশি অট্টহাসি হাসতে পারত, নাটক তত বেশি সফল  হত‌‌। কখনও নাটক চলার সময় কোনো রাজা বা সেনাপতির মাথার মুকুট ছিটকে এসে মাটিতে খড় পেতে বসে থাকা ছোটো ছোটো দর্শকদের মধ্যে পড়ত। তখন সেই দর্শক মঞ্চে উঠে গিয়ে অভিনেতার হাতে তুলে দিত সেই মুকুট। যেন কিছুই হয়নি এরকম ভাবে একটা অর্থহীন হাসি হেসে অভিনেতাটি মুকুটটা পরে নিত এবং নাটকের না থাকা এক সংলাপের মাধ্যমে দর্শককে এভাবে ভোলাত–’ আমার মুকুট খসে পড়লে কী হবে, সেই মুকুট তুলে দেওয়ার মানুষ আমার আছে।’ মোটকথা অভিনয় কেবল অভিনেতাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, দর্শকরা ও সংলাপ আউরাত…

শশীর সতীন বোন সরস্বতীর স্বামী গোপাল শর্মাও ছিলেন যাত্রাপালার একজন অভিনয়শিল্পী। সুদর্শন উচু লম্বা চেহারার এরকম একজন অভিনেতা যাত্রা পার্টিতে থাকা কথাটা প্রায় বিরল। কিন্তু চেহারাটা হলে কী হবে, তার কণ্ঠস্বর ছিল খুবই ক্ষীণ। কণ্ঠস্বরের জন্যই তার দাম অনেক কমে গিয়েছিল। এই গোপাল মেসোকে রাহুলরা কাছ থেকেও পেয়েছিল, ব্যক্তি জীবনেও তার কণ্ঠস্বর ছিল খুবই ক্ষীণ। ভালোভাবে কান না পাতলে তার কথা শোনা যায় না।

কিছুক্ষণ আগে যদিও শশীর’ সতীনের বোন’ বলা হল, কিন্তু আমাদের ছোট্ট নায়ক রাহুলই কেবল নয়, রাহুলদের সমগ্র পরিবার সতীন মা, সতীন বোন, মাসিমা ইত্যাদি শব্দ গুলিকে ওদের হৃদয় থেকে স্বীকৃতি দেয় নি। কেননা ওরা ছিল অকপট এবং ধুলোবালির সঙ্গে খেলতে থাকা প্রাণী। যারাই ওদের সঙ্গে ধুলোবালিতে খেলত, তারাই ছিল ওদের আপন। এই শব্দগুলি কেবল আশেপাশের এবং বড়োরা ওদের মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে দিতে চাওয়া বীজ। অবশ্য নীপাও মাঝেমধ্যে রাহুলকে বেশি গলাগলি করতে দেখলে সতর্ক করে দিত যাতে ভুলে না যায় যে পৃথিবীতে বিমাতা নামের এক ধরনের মা আছে।

বিমাতা বললে রাহুলের মনে পড়ে যায় ঠাকুরমার বলা তেজীমালা নামের রূপকথার গল্পটির বিমাতার কথা। মানুষ যে এত নির্দয় নিষ্ঠুর হতে পারে রাহুল ভাবতে পারেনা। সরস্বতীর মায়ের মুখটা রাহুল দূর থেকে দেখে ভাবে– এই মানুষটা তো দেখছি রাহুল নীপাকে ভালো না বেসে থাকতেই পারে না, কিন্তু এই মানুষটাই শশীকে একবেলা ভাতের বিনিময়ে এক থালা মাছ বাছতে দিয়েছিল কেন?

রাহুলের ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক ভাবে তার বিপরীতে তার নতুন মা কত নিষ্পাপ! নতুন মা রাহুলদের বাড়িতে আসার পর থেকে রাহুলের ইচ্ছা হয় মায়ের বুকে জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে থাকতে। কিন্তু সেরকম রাস্তা কেউ দেখিয়ে দেয় নি।তাই নতুন মাকে রাহুলের একটা নতুন মন্দিরের মতো মনে হত, যেখানে সে একটা ঘন্টা বাজাতে থাকবে…

একটি বন্য স্বপ্নের অন্ধ যাত্রা (১৫ম পর্ব) // নীলিম কুমার II অসমিয়া থেকে অনুবাদ: বাসুদেব দাস

Facebook Comments

comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top