পিঞ্জর (পর্ব ৩) // অমৃতা প্রীতম, অনুবাদ: জাভেদ ইকবাল

অধ্যায় ৩

রশিদ পোলাও-ভাতের একটা গামলা পুরো’র সামনে রাখে। রশিদ যখন গ্রামে যায়, তখন কাউকে দিয়ে নিশ্চয়ই খাবার রান্না করিয়ে আনে। পুরো অবশ্য এতোসব জানতো না। ঐদিন সে বেশ দুশ্চিন্তার মধ্যে পড়ে যায়। এই ভয়ে তার বুক কাঁপতে থাকে যে, তার সাহসও শেষমেষ তাকে ছেড়ে না যায়; মুখ ফিরিয়ে না নেয়। সে খানিকটা পোলাও-ভাত খেয়ে নেয়; এক কাটোরা পানিও গিলে নেয়।
সেই রাতে পুরো তার সমস্ত সাহস জড়ো করে মনকে স্থির করে ফেলে। রশিদের বালিশের তলা থেকে অত্যন্ত সন্তর্পণে সে তালার চাবিটা চুরি করলো। ওর বুক ধকধক করতে লাগলো- এই বুঝি রশিদ জেগে ওঠে, এই বুঝি রশিদ জেগে উঠে ওর হাত জাপটে ধরে। পুরো’র সৌভাগ্য, এমন কিছু ঘটলো না। এরপর, রশিদের ঘুম আরো গাঢ় হলে, নিঃশব্দে দরোজার তালা খুলে, সে তার বন্দিদশা থেকে বেরিয়ে পড়লো।
নিকষ, ঘন অন্ধকারে পুরো ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়লো। প্রায় উল্টো ঘুরে রশিদের ঘরেই আবার ঢুকে পড়ছিল। শেষমেষ সে কোনোভাবে নিজের মনকে বুঝ দিতে পারলো যে, ছাত্তোয়ানির দিকে যাওয়ার পথটা সে খুঁজে নিতে পারবে। তার ভয় করতে লাগলো, সে হয়তো রশিদের থেকে খারাপ মানসিকতার কোনো গেঁয়ো ষন্ডার হাতে পড়ে যাবে। কিন্তু এরপর ওর চোখের সামনে মা, বাবা ভাই-বোনদের মুখগুলো এক এক করে ভেসে ওঠে। পুরো তখন একটা পথ ধরে এই বিশ^াসে জোরে জোরে সামনে হাঁটতে লাগলো যে, এই পথটা তার বাড়ির দিকেই গেছে। এরপর আস্তে আস্তে, অগ্রসরমান ভোরের ক্ষীণ আলোয়, পথঘাট-মাঠ একটু একটু ওর চোখে ঠেকতে লাগলো, একটু একটু করে পরিস্কার হতে লাগলো।
পুরো’র ভাগ্য ভালো; ঠিক পথটা ধরেই ও হাঁটতে হাঁটতে, দূরে নিজ গ্রামের প্রান্তরেখা দেখতে পেলো।
এরপর সেদিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে, সেই পথে গায়ের সমস্ত জোর দিয়ে ঝাড়া দৌড় শুরু করলো সে। তারপর গ্রামে ঢুকে পড়ে সে তার বাড়ির দিকে চলে যাওয়া পথটা ধরলো। আকাশ তখনো ধূসর হতে শুরু করেনি, তার আগেই পুরো তার বাবার বাড়ির সামনে নিজেকে আবিষ্কার করলো।
পুরো ছিটকিনি ধরে ভীষণ জোরে জোরে দরোজায় আঘাত করতে লাগলো। ভেতর থেকে দরোজা খুলে গেল, আর সে ভিতরে ঢুকে উঠোনের ওপর হুড়মুড়িয়ে পড়ে গেল। যেন বিজয়স্তম্ভে পৌঁছেই হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়ার মতো সে ওখানে পড়ে থাকলো। শরীরের শেষটুকু শক্তি পর্যন্ত সে নিঃশেষ করে ফেলেছে; মাটির উঠোনে পড়ে আহত এক পশুর মতো ওর শরীর থেকে গোঙ্গানি-আর্তনাদ বের হতে থাকলো। মুখ একটুখানি উঁচিয়ে পুরো দেখতে পেলো, বাবা-মা দু’জন লম্প হাতে ওর কাছেই দাঁড়িয়ে আছে; মায়ের চোখ গড়িয়ে অশ্রæর ¯্রােত নেমেছে। পুরো অনুভব করলো, ওর মা উবু হয়ে মাটিতে বসে ওকে দু’হাতে বুকে জড়িয়ে নিয়েছে। সাথে সাথে কষ্টের যতো কান্না পুরোর হৃদয়-বুক মথিত করে বেরিয়ে এলো।
‘এই চুপ, চুপ! প্রতিবেশিরা সবাই শুনে ফেলবে, ভীড় জমে যাবে তো!’ পুরোর বাবা চাপা ধমক দিয়ে, স্ত্রী’র কাঁধ ঝাঁকিয়ে ওদের সতর্ক করলো। পুরো’র মা নিজের ওড়নার এক কোনা দলা করে মেয়ের মুখের মধ্যে গুঁজে দিলো।
‘মেয়ে আমার, ভগবান তোর ভাগ্যে এই-ই লিখে রেখেছে, আমরা তার আর কি করতে পারি! আমরা যে বড়ো অসহায়!’পুরো তার বাবাকে বলতে শোনে। মায়ের বুকের সাথে লেপ্টে থাকে ও। ‘শেখরা এখন আমাদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে আমাদের যা-কিছু আছে সব ধ্বংস করে ছাড়বে; আমাদের সবগুলো বাচ্চার ওপর হামলে পড়বে।’
‘আমাকে তোমাদের সাথে সিয়াম নিয়ে চলো!’ কাঁদতে কাঁদতে পুরো বলে।
‘কে তোকে এখন বিয়ে করবে মা? তুই তো ধর্মকে খুইয়ে এসেছিস, তোর জন্মের অধিকারও। আমরা যদি এখন কোনোভাবে তোকে সাহায্যও করি, ঘরে জায়গা দেই, তাহলে আমরা সবাই যে একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবো! আমাদের কপালে, আমাদের নিয়তিতে কি ঘটেছে, তা বলার জন্য এক ফোঁটা রক্তের দাগও আর কোথাও থাকবে না!’
‘তাহলে আমাকে তোমরা নিজের হাতে মেরে ফেলো! মেরে ফেলো!’
‘মা’রে, তুই যদি তোর জন্মের সময়ে মরে যেতিস, তাহলেই বোধহয় ভালো হতো! শেখেরা যদি এখন তোকে এখানে খুঁজে পায়, তাহলে ওরা তোর বাপ-ভাইদের একেবারে খুন করে ফেলবে, আমাদের সব্বাইকে খুন করে ফেলবে;’ মনকে শক্ত করে, এক নিঃশ^াসে পুরো’র মা বলে ফেললো।
পুরো’র তখন রশিদের বলা কথাগুলো মনে পড়ে যায়: ‘ঐ বাড়িতে এখন তোমার আর কোনো স্থান নেই।’ রশিদ তাহলে তাকে সত্যি কথাই বলেছিল? কিন্তু ওর বাগদত্ত রামচন্দ্রের ব্যাপারটা কি? বিয়ের কথা পাকা হয়েছে আর বিয়ে হয়ে গিয়েছে- এই দু’য়ের মধ্যে আসলে পার্থক্যটা কোথায়? কেন সে পুরোকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসলো না? সে কি তার কেউ না? সে কেন একটাবারের জন্যও পুরো’র কথা জিজ্ঞেস করলো না?
এরপর পুরো’র আর বেঁচে থাকতে মন চাইলো না। এই সবকিছু থেকে বাঁচার একটাই আশা দেখতে পেলো সে: মৃত্যুপুরীতে আশ্রয় নেওয়া। অন্য সব রাস্তা তো বন্ধ- সে ভাবে, এক মৃত্যুর পথই তার সামনে খোলা।
পুরো উঠে দাঁড়ালো, ঝড়ের বেগে দরোজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। না ওর বাবা, না মা ওকে থামানোর কোনো চেষ্টা করলো। একটু আগেই এই পথ ধরে ও যখন দৌড়ে দৌড়ে এসেছিল, ওর মনে হয়েছিল যে, ও জীবনের পানে ছুটে চলেছে, আবারো নতুন করে বাঁচতে চলেছে, বাবা-মা’র সাথে মিলেমিশে থাকতে চলেছে! কত আশায় ভরপুর হয়ে পুরো এতোটা পথ দৌড়ে দৌড়ে এসেছে! এখন তার আর কোনো আশা নেই, কোনো ভয়ও নেই। ওর জীবন থেকে কেড়ে নেবার মতো আর কি আছে? মৃত্যু ব্যতীত আর কোন্ ক্ষতি তাকে কে করতে পারে? মৃত্যুর চাইতে আর ভয়ানক কি-ই বা তার সাথে ঘটতে পারে? এসব চিন্তা করতে করতে পুরো’র চোখের পানিও শুকিয়ে আসে।
পুরো মাধোকিয়া কুয়োর দিকে চলতে থাকে। রশিদ উর্ধ্বশ্বাসে তার দিকে ছুটে আসে;সে একসময় হাঁটা থামিয়ে দেয়। মৃত্যুও এখন পুরো’র মুখের ওপর তার দরোজা বন্ধ করে দিয়েছে।
পুরো’র মনে হয়, এই পনের দিনে ওর শরীরের সবটুকু রক্তমাংস খুবলে নেওয়া হয়েছে। এখন সে পুরোপুরি একটা কঙ্কাল। এখন তার না কোনো আকৃতি আছে, না কোনো চেহারা, না কোনো মন, না মর্জি। রশিদ পুরো’র একটা হাত নিজ মুঠোয় চেপে ধরে। কোনো বাঁধা না দিয়ে, কোনো শব্দ না করে পুরো তাকে অনুসরণ করে।
এর তিনদিন পর দুই-তিনজন লোকসহ মৌলভী রশিদের সেই বাড়িতে হাজির হয়। ওরা মিলে পুরো’র সাথে রশিদের বিয়ে পড়িয়ে দেয়। এর কয়েক সপ্তাহ পর, রশিদ জানায় যে, পুরো’র বাবা, মা, পরিবার সহি-সালামাতে সিয়ামে চলে গিয়েছে।
ছাত্তোয়ানি’র নাম শুনতেই পুরো’র মাথা চক্কর দিয়ে উঠতে থাকে। রশিদ ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছিল। পুরোকে ছাত্তোয়ানি গ্রামে নিয়ে যাওয়া একেবারে বিপদমুক্ত ছিল না। রশিদের মনে আশঙ্কা ছিল যে, এতে করে গ্রামের কিংবা আশপাশের হিন্দুরা ক্ষেপে না ওঠে। যদিও ঘটনার পুরো একমাস হয়ে গেছে, আর কেউ সাহস করেও একটা কোনো কথাও বলেনি। তাছাড়া, অন্যের আগুনে কে-ই বা ঝাঁপ দেয়? কেউ কেউ ঘটনাটাকে মনের মধ্যে দাবিয়ে ফেলেছে, কেউ আবার মন থেকে একেবারে বেরই করে দিয়েছে।
রশিদের বাপ-মা আগেই গত হয়েছিল। ওর কোনো বোনও ছিল না, শুধু চাচা’রা আর কয়েকজন চাচাতো ভাই। রশিদ সিদ্ধান্ত নিলো, কয়েক মাইল দূরের আরেকটা গ্রাম সাক্কাড়ানি গিয়ে সে পাকাপাকি বসত গড়বে। ওখানে ওর এক চাচাতো ভাই, রহিম বাস করে। ওখানে রহিমের বেশ কিছু জমি-জমাও আছে। রহিমের সাথে এই গাঁয়ের ওর নিজের কিছু জমি বিনিময় করে রশিদ সাক্কাড়ানিতে ঘরবাড়ি তুলবে। পুরোকে সে এই পরিকল্পনার কথা জানালো। এতে অবশ্য পুরো কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। বাপ, মা ওভাবে ঘর থেকে তাড়িয়ে দেবার পর, বাপ-দাদার গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র বসত গড়ার কথা তার কাছে তেমন বড় কিছু মনে হলো না। রশিদ যা বলছে, তাই-ই যদি করে, তাতে কি এমন পরিবর্তনটা হবে? সব গ্রামই তো সেই একইরকম।
সংসারের ছোটবড়, খুঁটিনাটিসব মালপত্র কয়েকটা স্টিলের ট্রাংকে ভরে নিয়ে, পুরোকে সঙ্গে করে রশিদ সাক্কাড়ানি গ্রামের উদ্দেশ্যে নিজ গ্রাম ছাড়লো। পুরো রশিদকে অন্ধের মতো অনুসরণ করলো। রহিমদের বাসা থেকে অল্প একটু দূরে একটা বাসা পেল ওরা। রশিদের প্রথম কোনো আত্মীয়-স্বজন বলতে, রহিমদের বাড়ির মহিলাদের সাথে পুরো’র পরিচয় হলো। ওরা কিন্তু অনেক প্রশ্নের বানে তাকে জর্জরিত করে তোলে নি। ওরা শুধু জানতে চেয়েছিল যে, নতুন সংসার পাততে কোনো কিছু লাগবে কিনা; আর ওরা কোনো সাহায্যে আসবে কিনা। এরপরও পুরো’র নিজেকে ‘অদ্ভুত এক গরুর পালের মধ্যে পথভ্রষ্ট একটা বাছুরের মতো’ মনে হতে লাগলো।
পুরো’র কপালে তখনো আরো বড় কিছু পরিবর্তন অপেক্ষা করছিল। এতোদিন পর্যন্ত রশিদ ওকে ওর হিন্দু নামেই ডেকে আসছিল। একদিন রশিদ সাথে করে অচেনা এক লোককে বাসায় নিয়ে এলো। পুরোকে বললো, হাতটা সোজা করে বাড়িয়ে দিতে। পুরো’র বিয়ের সময় তাকে দেওয়া নতুন নামটা সেই লোক ওর বাম হাতে খোদাই করে লিখে দিলো। সেদিন থেকে, গাঢ় সবুজে লেখা ঐ নাম সে শুধু হাতেই বহন করে না, রশিদসহ সবাই তাকে ‘হামিদা’ নামে ডাকতে শুরু করে।
কিন্তু নিজের স্বপ্নের ভেতরেসে যখন বান্ধবীদের দেখতো, নিজ বাড়িতে সখীদের সাথে খেলা করতে দেখতো, সবাই কিন্তু ওকে তখন ‘পুরো’ নামেই ডাকতো। দিনের বেলার পুরোটা সময় সে ‘হামিদা’। রাতে, নিজের কাছে, একান্ত নিজের কাছে সে ‘পুরো’। অদ্ভুত একটা দ্বৈত-জীবন শুরু হলো তার- দিনের বেলার সবার ‘হামিদা’, আর রাতের বেলা একান্ত নিজের ‘পুরো।’ আর বাস্তবে সে না হামিদা, না পুরো- শুধুমাত্র একটা পিঞ্জর, একটা খাঁচা: নামহীন, আকৃতিহীন একটা কঙ্কাল।
ছয়মাস পর ওর সেই পিঞ্জরের ভেতর নতুন একটা প্রাণের স্পন্দন শুরু হলো।

Facebook Comments

comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top