ফয়েজ আহমদ ফয়েজ ।। রাহুল চন্দ্র দাস

ফয়েজ আহমদ ফয়েজ বাংলা ভাষাভাষী রসিকের কাছে সত্যি বলতে বিশিষ্ট কেউ নন। এতটুকু জানা থাকাই আমাদের কাছে যথেষ্ট বলে মনে হয় যে, মীর তকি মীর, মির্জা গালিব, ইকবাল, মান্টো, প্রেমচাঁদ, কৃষণ চন্দর প্রমুখ উর্দু-হিন্দি সাহিত্যিকদের ভীড়ে ‘ফয়েজ’ নামটি উদ্ধৃত হয়। তারও বেশি জানার প্রয়োজন থাকলেও অবকাশ থাকে না। ফাঁকি দিতে চেষ্টা করার অভ্যাস স্বভাবকে অতিক্রম করে কর্তব্যের দায় নিয়েছে। যাঁরা কাব্য-কবিতা তথা শিল্পকে জানেন, ফয়েজকে বোঝার চেষ্টা করেন, ফয়েজকে গভীরভাবে পাঠের আয়োজনকে তাঁদের এড়ানোর সুযোগ থাকে না। উর্দু কবিতায় ইকবালের পর সবচেয়ে শক্তিশালী কবি ফয়েজকে নিয়ে বাংলা মুলূকে উৎসবের সুযোগ স্থূল রাজনৈতিক কারণে অল্প, নিকৃষ্ট চেতনাগত কারণে শূন্য। এককালে প্রতীচ্য ভাবাদর্শ-লালিত বিচিত্র প্ররোচনায় ভুলতে বসেছিলাম মৃত্তিকার সংলগ্নতা, আর এক কালে কড়া রকমের বাঙ্গালীয়ানার ফাঁপা উস্কানির যুগে সুন্দরের বিশ্বজনীনতা।এমন অনেক বাঙালী আমরা আছি, যাঁরা ফয়েজকে মনে রাখি পাকিস্তানের ঘরের শত্রু বিভীষণ– এই অসার জাতীয়তাবাদী বিবেচনার সুড়সুড়ি পেয়ে। সংসারে এমনও ঘটে থাকে।

তুর্কি, পাঠান, মোঘল শাসনামলে ভারতীয় সংস্কৃতি নানাভাবে সমৃদ্ধ হয়েছে।বিভিন্ন দেশি বিদেশী ভাষার ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে নতুন একটি ভাষা এগারো শতক বা তারও আগে থেকে রূপ নিতে শুরু করলেও সেই ভাষা ‘উর্দু’ নামে চিহ্নিত হয় অনেক পরে। উর্দুর ব্যাকরণগত কাঠামো ভারতীয়। উত্তর ভারতের অন্যান্য ভাষার মতো উর্দু পশ্চিমী শৌরসেনী অপভ্রংশ থেকে জাত।তার শব্দভাণ্ডারে ঢুকেছে অজস্র ফার্সি, আরবি, তুর্কি শব্দ। ধ্বনিবহুল জমকালো শব্দগুলো আরবি থেকে নেয়া। আর উর্দুর লালিত্যে আছে ফার্সির দান। উর্দুর ব্যাপারে রবীন্দ্র-ভাষ্য নিম্নোদ্ধৃত।

“উর্দু ভাষায় যতই পারসি এবং আরবি শব্দ থাক না তবু ভাষাতত্ত্ববিদগণ জানেন তাহা ভারতবর্ষীয় গৌড়ীয় ভাষারই এক শ্রেণী; ভাষার প্রকৃতিগত যে কাঠামোটাই তাহার নিত্যসামগ্রী, যে কাঠামোকে অবলম্বন করিয়া সৃষ্টির কাজ চলে, সেটা বিদেশি সামগ্রীতে আদ্যোপান্ত সমাচ্ছন্ন হইয়া তবুও গৌড়ীয়।’’

বাংলায় হ্রস্ব ও দীর্ঘ স্বর একইভাবে উচ্চারিত হয়। কিন্তু উর্দুতে তাদের মাত্রাভেদ স্পষ্ট।সব মিলিয়ে বিচিত্র ব্যঞ্জনায় উর্দু খুব শ্রুতিমধুর ভাষা। পরবর্তীকালে রাজদরবারে লালিত হওয়ার দরুণ এর শব্দাবলী ও বাগভঙ্গীও পরিচ্ছন্ন ও মার্জিত। তবে রাজানুকূল্য পেতে উর্দুকে বেশ কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হয়েছিলো।  যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে তখন ফার্সির একাধিপত্য চলছে অভিজাত মননের মহলে মহলে।  রাজদরবারে ফার্সিতেই সাহিত্য করতেন ওই সময়কার কবিগণ। যোগাযোগের একটি উল্লেখযোগ্য ভাষা হিসেবে ততদিনে উর্দু নিজেকে সাবালক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে তুলতে সামর্থ্য অর্জন করে নিলেও কবিতা ইত্যাদি উচ্চমার্গের সাধনায় গৌরবের আসন নিতে পারে নি। অখ্যাতপ্রায় ওয়ালি দকনি নামধারী জনৈক কবি একরকম আচমকা উক্ত প্রতিবেশে প্রমাণ করে দিলেন যে, জনমানুষের মুখের গতিশীল উর্দুতেও ফার্সির সমতুল্য কবিতা লেখা যায়। তা দেখে দিল্লীর যশপ্রার্থী তরুণ কবিরাও উর্দুর প্রতি আগ্রহবোধ করলেন। উঠে আসতে লাগলেন একের পর এক প্রতিভাবান সব কবি, যাঁদের নাম উর্দু সাহিত্যের সাম্রাজ্যে আজও নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বলে থেকে গিয়েছে। উর্দু সাহিত্যের ইতিহাসে প্রথম উল্লেখযোগ্য কবির নাম মীর তকি মীর। মধ্য এশিয়া থেকে আসা তুর্কি, পাঠান, মোঘল প্রভৃতি জনগোষ্ঠীর সঙ্গে স্থানীয় মানুষদের সংযোগ থেকে জন্ম হয়েছিলো উর্দু ভাষার। বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষদের মধ্যে পারস্পরিক ভাব বিনিময়ের জন্য এক আটপৌরে সম্পর্ক-ভাষা হিসেবে এর সৃষ্টি। এর গায়ে সৈনিক শিবিরের গন্ধ লেগে আছে। সাম্রাজ্য বিস্তারের সাথে সাথে উর্দুর ঐতিহাসিক বিস্তৃতি ঘটে এসেছিলো। ১৮৫৭-এর পরপর উর্দুর ভাগ্যে প্রথম ট্র্যাজেডি ঘনিয়ে আসে রাজা আর রাজদরবারের বিলুপ্তির সাথে সাথে অভিজাতদের ইংরেজিমুখিনতার প্রতিক্রিয়ায়।

উর্দু রাজদরবারের গৌরবময় সাহিত্যিক তৎপরতার ভাষা হয়ে উঠার মানে সংস্কৃতের মতো এর বদ্ধাবস্থা নির্দেশ করে না। যেহেতু সাধারণ মানুষের যোগাযোগের ভাষা থেকে এই ভাষার সাহিত্যকে অভিজাতদের মাঝে স্থান করে নিতে হয়েছিলো, এই কারণে উর্দু সাহিত্যের রসাস্বাদনে আপামরের প্রবেশাধিকার অক্ষুণ্ন ছিলো এবং তা এখনো যে নেই তা নয়। তবে এর চর্চা ভালোরকমের করে জাঁকিয়ে বসেছিলো দরবারকে কেন্দ্র করে। গজলে গজলে দরবারগুলো বারাবরই জমিয়ে রাখা হতো। উর্দু সাহিত্যের সবচেয়ে ঈর্ষণীয় সম্পদ হল এর গজলের ভাণ্ডার। পরে আর এক সময়ে এসে উপনিবেশিত মনের নিকটে যা গীতিকবিতা বলে নিন্দনীয় হয়েছে।

আঠারো শতকে দিল্লী এবং লক্ষ্ণৌ-এর সমান্তরাল দুই ধারার বাইরে এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো অবস্থান নাজির আকবরাবাদীর। তাঁর সমসাময়িক কবিগণ সাহিত্যচর্চা করেছেন রাজশক্তির ছত্রছায়ায়। নাজির এঁদের ব্যতিক্রম। ‘বানজারা’ শিরোনামের কবিতার এই কবি উর্দু সাহিত্যের প্রথম বোহেমিয়ান। জনজীবনের সাথে নিবিড় যোগ থাকা এই কবি উর্দু নজমের জনক।  গালিবের পর উর্দু সাহিত্যে সবচেয়ে বিখ্যাত কবি ইকবাল যিনি গজলের চেয়ে নজমকেই পছন্দ করতেন বেশি। নজমের ক্রমবর্ধমান চর্চার যুগে অনেকের মনে হয়েছিলো যে, গজলের বদ্ধ কাঠামোর মাঝে বোধহয় আর নতুন  মহতী সৃষ্টি সম্ভব নয়। কিন্তু তা হলেও নজমের জনপ্রিয়তার যুগে হসরত মোহানি, জিগর মোরাদাবাদী, গোরখপুরী, ফানি বদায়ুনি, মির্জা ইয়াগানা, অসগর গোণ্ডবির মতন কবিগণ গজলেই মুখ গুঁজে থাকলেন। উল্লিখিত কবিগণ গজলকে অন্তিমপ্রায় দশা থেকে আগের গৌরবজনক ঐশ্বর্যে অভিষিক্ত করেন। পরে গজল আর এক মাত্রা পেয়েছে প্রগতি কবিদের আবির্ভাবে। যদিও প্রথম দিকে ইউরোপীয় ভাবধারার তোড়ে প্রগতি আন্দোলনের প্রতিভাগণ, যারা সত্যিকার অর্থেই প্রতিভাবান ছিলেন, তারা, ফয়েজের ভাষায়- ইংরেজি সভ্যতায় সকলেই প্রায় ছিলেন ইংরেজ। তাঁরা প্রায় কেউই গজলের উপর আন্তরিক আস্থা রাখতে পারেন নি। এঁদের অনেকেই ছিলেন সৈয়দ আহমদ, হালিদের মানসিক গড়নের। প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের সঙ্ঘর্ষের দোলাচলে থাকা এসব সংস্কারবাদী যেখানে এই দুই বিপরীতাত্মক রুচির দন্দ্ব দেখেছেন, মৃত্তিকার সাথে ভালো জানাশোনা না থাকার কারণে দেশীয় উপাদানটির মূলোৎপাটন করে বিজাতীয় উপাদানের প্রতিস্থাপন করতে কসুর করেন নি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে। এখানে অন্য আর সব কবিদের সাথে ফয়েজের পার্থক্য স্পষ্ট। প্রগতিপন্থীদের মাঝে সবচেয়ে পরিচিত নাম ফয়েজ আহমদ ফয়েজ(১৯১১-১৯৮৪)। গজলের মাধুর্যে ভরা সব রাজনৈতিক কবিতার মালা তিনি আমাদের উপহার দিয়ে গেছেন। কমিউনিস্ট হওয়ার পাশাপাশি তাঁর ছিলো এক সূফী মন। রাজনীতির কচকচির বাইরে এনে নব নব প্রতীক ইত্যাদি সৃষ্টি করে গজলকে তিনি আপন আধেয়ের উপযোগী করে নিয়েছিলেন আপন ক্ষমতাবলে। অন্য অনেকের মতো মননে তাঁর সাংস্কৃতিক অস্পষ্টতা আর দিশাহারা উন্মাদনা না থাকায় অনায়াসে নতুন যুগের সাথে পুরনো ঐতিহ্যের মেলবন্ধন ঘটাতে পেরেছিলেন নিজের সাথে নিজের ঘনিষ্টতম যোগাযোগের বিরলতম গুণের উপস্থিতির ফলে। গজলের পরিচিত আধারের মধ্যে ধারণ করতে পেরেছিলেন আপন সময়কে, যে রাজনৈতিক আদর্শের প্রতি দায়বদ্ধ ছিলেন কবি, যা অনাগত কালের সম্ভাবনার কথা বলে; তাকে মূর্ত করেছিলেন অত্যন্ত কার্যকরভাবে।

যাঁরা উর্দু জানেন না তাঁরাও ‘গজল’ নামটির সাথে পরিচিত। মেহেদি হাসান, গুলাম আলিদের কন্ঠ ছুঁয়ে আঙ্গিনায় আঙ্গিনায় পৌঁছে গেছে উর্দু সাহিত্যের সবচেয়ে সমৃদ্ধ এই অংশ, যার অর্থ- নারীর সাথে সংলাপ। গজলের প্রধান স্বর পুরুষের। এ মূলত, প্রেমের কবিতা। তবে কেবল প্রেম না বলে একে বিরহের কবিতাও বলা যায়। এতে প্রেমিক হৃদয়ের মিলনের কামনা ও আর্তি আছে কিন্তু  সত্যিকার মিলন দুর্লভ। গোরখপুরী বলেন, “জঙ্গলে যখন শিকারি হরিণের পেছনে কুকুর লেলিয়ে দেয় আর হরিণ ছুটতে ছুটতে কোন ঝোপে আটকে যায়, যেখান থেকে তার বেরুনো অসম্ভব, সেই মুহুর্তে অসহায় পশুর কন্ঠ চিরে যে বেদনাভরা আর্তস্বর বেরিয়ে আসে, সেই করুণ স্বরেরই নাম গজল। বিবশতার দিব্যতম রূপ, ভাবের করুণতম প্রকাশ ফুটিয়ে তোলাই গজলের আদর্শ।’’

গজলের জন্ম কেবল লিপিতে বদ্ধ হয়ে থাকার জন্যই নয়, গজল লোকের মুখে মুখে ঘুরে গীত ও পঠিত হয় এবং গীতি ও গতি গজলের দুই বড় গুণ। আকবরের নবরত্নের মতো বাহাদুর শাহ জাফরের সভা আলো করে থাকতেন জউক, মোমিন, গালিব, দাগ প্রমুখ সর্বকালের শ্রেষ্ঠ গজলকারগণ। উনিশ শতকে আর দশটা ক্ষেত্রের  ভারতবর্ষের পটপরিবর্তনের মতো উর্দু সাহিত্যেও শুরু হয় পালাবদল। মধ্যযুগের উর্দু সাহিত্যের শেষ প্রজন্মের কবি মির্জা গালিব(১৭৯৭-১৮৬৯) ১৮২৮ সালে কলকাতায় এসে আধুনিক নগর সভ্যতার চাকচিক্য দেখে মুগ্ধই হন। ‘আইন-ই-আকবরি’র উর্দু সংস্করণের সমালোচনা করার বদলে একটি কবিতা লিখে জানিয়ে দেন যে, অতীতের মড়া ঘেটে আর লাভ নেই। আধুনিকতাকে গ্রহণ করার মত স্পর্ধা তাঁর ছিল। যুগের পরিবর্তনে অনেক উত্তম ব্যাপার হারিয়ে যায়, আবার নতুন উত্তম সৃষ্টির কিছু আশাও থাকে। আধুনিক বুর্জোয়া সমাজ তৈরি করে যাচ্ছে বিচিত্র বস্তুগত ও ভাবগত পণ্যায়নের স্রোত। সাথে সাথে, মার্ক্সের কথায়, এই সভ্যতা জন্ম দিয়ে চলেছে তার আপন কবরখনকদের। অর্থাৎ, আধুনিক শ্রমিকশ্রেণীর। নাজির আকবরাবাদীর প্রসঙ্গ আগেই এসেছে। তাঁর কাব্যে দারিদ্র্য আর গরীবের কথা থাকলেও যথার্থ সৃষ্টির কথা নেই। ইকবালের লেখনীতেও শ্রমজীবীর কথা আছে(যে খেত থেকে জোটে না কিষাণের অন্ন, পুড়িয়ে দাও তার প্রতিটি শস্যকণা)। এমনকি শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্বে সঙ্ঘটিত রুশ বিপ্লবের অভিনন্দনাও আছে; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে শ্রেণী-সচেতন সাহিত্য সাধনার যে কঠিন সাধনা, তার বাস্তব সূচনা ঘটে ‘প্রগতি লেখক আন্দোলন’-এর কালে। প্রগতিশীল লেখক আন্দোলনের সূচনা ১৯৩২ সালে; যা ‘অঙ্গারে’ নামে একটি ছোটগল্পের সঙ্কলনের মধ্য দিয়ে যাত্রা  শুরু করে।  উর্দু সাহিত্যিকরাই মূলত এর ভূমিকা রচনা করেন।  প্রগতি লেখক আন্দোলনের উদ্ভব ও বিকাশে যাঁর একক সর্বাগ্রগণ্য ভুমিকা আদি-স্মরণীয়, তাঁর নাম সাজ্জাদ জাহির। গত শতাব্দীর তিরিশের দশকের গোড়ায় লন্ডনে যে কয়েকজন ভারতীয় ছাত্র ও যুবক বিশ্বব্যাপী ফ্যাসিবিরোধী আন্দোলনের শরীক হিসেবে ভারতে প্রগতি আন্দোলন গড়ে তোলার কথা ভাবেন, সাজ্জাদ জাহির- ফয়েজের বন্ধু, তাঁদের অন্যতম। ইউরোপে কয়েক বছর কাটিয়ে ১৯৩৫ সালে যখন তিনি দেশে ফেরেন, একবারও রোজগারের কথা চিন্তা না করে তাঁর প্রথম কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে প্রগতি লেখক সংঘ স্থাপন করা এবং প্রগতি লেখক আন্দোলনের ইস্তাহার প্রচার করা। ১৯৩৬ সালে প্রগতি লেখক সঙ্ঘের প্রথম সর্বভারতীয় সম্মেলণ লক্ষ্ণৌ-এ অনুষ্ঠিত হয় মুন্সি প্রেমচাঁদের সভাপতিত্বে। গঠিত হয় ‘অল ইন্ডিয়া প্রগ্রেসিভ রাইটার্স এ্যাসোসিয়েশন’।

মায়াকোভস্কি, পাবলো নেরুদা, পল এলুয়ার, লুই আরাগঁ, নাজিম হিকমতদের কাতারে ফয়েজকে রাখার যে কারণ, তা ফয়েজের কাব্য ও জীবনেই খুঁজে পাওয়া যাবে।   ইকবাল-উত্তর যুগের সবচেয়ে প্রতিভাবান উর্দু কবি ফয়েজ তার বলিষ্ঠ সমাজ ভাবনা প্রকাশ করার জন্য গজলের সুমধুর ভাষা-শৈলী এবং চিত্রকল্পের সাহায্য নিয়েছেন। এই অর্থে ব্যাপারটাকে তাঁর সমাজ ভাবনা বলা অসঙ্গত নয় যে, ফয়েজ তাঁর ব্যক্তিক অনুভবের সাথে সামষ্টিক চেতনাকে সংশ্লিষ্ট করে দিয়েছেন। নিঃসন্দেহে যা মহৎ সৃষ্টির চারিত্র্য। ফয়েজের ‘আমি’ এবং ‘আমরা’ পরস্পরবিরোধী দুই সত্ত্বা নয়। তাঁর এই উপলব্ধি তাঁকে উর্দু সাহিত্যের নতুন যুগের স্রষ্টার মর্যাদা দান করেছে গালিবের মতোই। ‘চাক গরেবাঁ’ দ্বারা ঐতিহ্যগতভাবে গজলে বোঝানো হয়ে থাকে আত্মভোলা ব্যাকুল প্রেমিককে, যার পোশাক-আশাকের দিকেও নজর দেয়ার মতো মনের অবস্থা নেই।  ফয়েজ এই শব্দবন্ধের সঞ্চারণ করেছেন প্রাণ উৎসর্গীকৃত বিপ্লবীদের অভিধায়। গজলের নতুন নির্মাণে এরকমটি অজস্রবার করেছেন ফয়েজ, অথচ ঐতিহ্যের সাথে সংঘর্ষ না ঘটিয়ে।

“বসন্তের সম্ভাবনা কোথাও তো উঠেছে ফুঁটে

ফুল বাগানে কিছু বসন তো অন্তত ছিন্ন হয়েছে

এখনো হেমন্তের রাজত্ব, তবু কোথাও কোথাও

উদ্যানের পথের নির্জন কোণে শুরু তো হয়েছে গজল গাওয়া

মরু এখনো মরু, তবু পায়ের রক্তে ‘ফয়েজ’

কয়েকটি কাঁটা তো ভিজে হয়েছে কোমল”

(আগস্ট ১৯৫২)

শিল্প-ব্যাপারে ফয়েজের মত প্রকাশ পেয়েছে তাঁর এই অভিজ্ঞানেঃ

“আমি শুধু এইটুকু বলতে চাই যে, মানুষের সম্মিলিত সংগ্রামকে পূর্ণ মাত্রায় উপলব্ধি করে সেই সংগ্রামে অংশ নেয়ার সজ্ঞান প্রচেষ্টা কেবলমাত্র জীবনের দাবি নয়, শিল্পেরও দাবি।  শিল্প জীবনেরই এক অংশ এবং শৈল্পিক প্রয়াস সেই সংগ্রামের একটি রূপ মাত্র। শিল্পীর কাছে এই দাবি চিরন্তন। তাই শিল্পীর সংগ্রামের কোন সমাপ্তি নেই। শিল্পীর এই প্রচেষ্টার সাফল্য-ব্যর্থতা নির্ভর করে তাঁর ক্ষমতার উপর। কিন্তু এই প্রচেষ্টার সাথে অক্লান্তভাবে যুক্ত থাকা শুধু সম্ভবই নয়, অত্যন্ত জরুরি।  আমার কবিতাও এমনই এক প্রচেষ্টার ফল।”

“এই কাগজ কলমের পরিচর্যা করে যাব আমি

যা কিছু সয়েছে এই হৃদয় সব লিখে যাব আমি

প্রেমের বেদনার উপকরণ সঙ্গে রেখে যাব

কালের ঊষরতাকে কৃপা করে যাব আমি

এই দিন-রাত্রির তিক্ততা আরো বাড়বে জানি

জানি শোষকও চালিয়ে যাবে শোষণের খেলা

মানলাম এই তিক্ততা, সইতে পারি এই নির্যাতন

প্রাণ থাকে যদি জগত-দুঃখের প্রতিবিধান করে যাব আমি

পানশালা যদি অটুট থাকে তবে রক্তিম মদিরায়

পবিত্র গৃহের দেয়াল দরোজা সাজিয়ে যাব আমি

হৃদয়ে যদি বাকি থাকে রক্ত, তবে প্রতি বিন্দু অশ্রু দিয়ে

আমার প্রতিমার ঠোঁট, চিবুকের জন্য রঙ তৈরি করে যাব আমি

তাদের নির্বিকারের খেলা তাদেরই থাক

বাসনার যে দাবি, সে আমি জানিয়েই যাব”

(কাগজ কলম)

ভারতের অন্যান্য ভাষার সাহিত্যের বিবেচনায় উর্দু সাহিত্যে কবিতার জনপ্রিয়তা বেশি। মুশায়েরায় উর্দু কবিরা যেরকম সংবর্ধনা পান তা অন্যদের কাছে ঈর্ষণীয়। এই প্রিয়তার মূলে আছে এক শুদ্ধ ঐতিহ্য। কবি ও পাঠকের অন্তরঙ্গতা। প্রথমদিকে ফয়েজ যেসব কবিতা লিখেছেন সেগুলো গজলের ধারা মেনেই যথারীতি বিলাপে ভরা ।

“নিঃসঙ্গতা আজ কোন পুরনো বন্ধুর মতো

আমার পান পাত্র পূর্ণ করতে এসেছে সন্ধ্যা ঢলতে

আমরা দু’জনই বসে আছি অপেক্ষায় কখন উঠবে

কখন প্রতিটি ছায়ার তলে ঝলমল করবে তোমার প্রতিচ্ছবি”

(নিঃসঙ্গতা)

গোড়ার পর্ব কেটে যেতেই প্রেম-বিরহের গতানুগতিক পথ ছেড়ে জীবনের বৃহত্তর উপলব্ধির মুখোমুখি হলেন ফয়েজ।

“এখনো হৃদয় ভুলানো সৌন্দর্য তোমার, কিন্তু কী করব

প্রেমের দুঃখ ছাড়া আরো দুঃখ আছে জগতে

জগতে আরো প্রশান্তি আছে মিলনের প্রশান্তি ছাড়া

আগের মতো ভালোবাসা আমার কাছে চেয়ো না প্রিয়”

(আগের মতো ভালোবাসা আমার কাছে চেয়ো না প্রিয়)

ফয়েজের দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন এই ঘোষণার মধ্যেই পরিষ্কার। কিন্তু তাঁর কবিতার উপজীব্য পাল্টালেও উপকরণ যা ছিলো, তা-ই রইল। নিজের ব্যাপারে ফয়েজ কী বলেন, এ বিষয়ে আমরা আরও একবার ফয়েজের বিবৃতির কাছে যেতে পারি।

“নিজেকে কবি হিসেবে দেখবার বড় রকমের কোনো ধারণা আমার ছিলো না, কিন্তু আমার ধারণা ছিলো যে, আমি গভীরভাবে প্রেমে পড়েছি। প্রেমে পড়েছিলাম কি-না, সে কথাটা গুরুত্বপূর্ণ ছিলো না। গুরুত্বপূর্ণ ছিলো শুধু এ কথাটাই যে, আমার এই আবেগ চারপাশের সবকিছুর হাব-ভাবকেই বদলে দিয়েছিল।…এই বস্তুরাজির অনুভব থেকে মন আমার সঞ্চারিত হলো চারপাশের মানুষে।”

আমরা যাকে কবিতা করা বলি, তার ব্যাপারে ফয়েজ আরও জানান যে, তাঁর অল্প বয়সের নিঃসঙ্গ ভালোবাসা নানা ধরনের বড় বড় ভালোবাসার সাথে মিশে একাকার হয়ে গিয়েছিলো। প্রিয়জনের মুখ হয়ে উঠেছিলো দেশবাসী জনগণের মুখ, স্বদেশের মুখ, জনগণের মুক্তির দিনের মুখ। কবিতা লেখার প্রেরণা ফয়েজ পান মানুষের ভালোবাসা  এবং ভালোবাসা যে বেদনার জন্ম দেয়, তার থেকে।

উর্দু থেকে বাংলায় অনুবাদের প্রসঙ্গ এলে প্রথমেই মনে আসে আবু সয়ীদ আইয়ুবের নাম। গালিব এবং মীর তকি মীরের কিছু বাছাই শের তিনি অত্যন্ত সফলভাবে অনুবাদ করেছেন। ছন্দ-মিল বজায় রেখে গজলের অনুবাদ দুঃসাধ্য ব্যাপার। পদ্যে অনুবাদ করলে মূলের প্রতি আনুগত্য বজায় রাখা সম্ভব হবে না বলে তিনি ছন্দ-মিল বর্জন করে গদ্য অনুবাদেই সন্তুষ্ট থেকেছেন। মূল ভাষায় দখল ছিলো বলে এবং অবশ্যই তাঁর বৈদগ্ধ্যের গুণে এই অনুবাদগুলো উর্দু থেকে বাংলায় অনুবাদের সার্থক দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। কিন্তু শক্তি চট্টোপাধ্যায় গালিবের যে অনুবাদ করেছেন তা আমাদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারে নি। আইয়ুবের মতো অনুবাদের ব্যাপারে কোন নির্দিষ্ট নীতি ছিলো না তাঁর। কোথাও মিল দিয়েছেন, কোথাও দেননি। অনুবাদেও মনে হয় নিজেকে ভালো প্রয়োগ করতে পারেন নি বলে এমনকি কোথাও কোথাও অনুবাদ বিভ্রাট ঘটিয়েছেন। সতর্কতার অভাবে এসব ক্ষেত্রে কী হতে পারে তা “গাই কা পিছলা হিসসা বিজ্ঞান আউর কলা দুনো হ্যায়” এর আক্ষরিক অনুবাদ থেকে আন্দাজ করতে পারি(অর্থাৎ কিনা, গাভীর পিছনের অংশ একই সাথে বিজ্ঞান ও কলা দু’টোই!)। রণেশ দাশগুপ্ত বাংলায় প্রথম ফয়েজের কবিতার অনুবাদক। তিনি ছিলেন ফয়েজের বন্ধু এবং রাজনৈতিক সহকর্মী। বাংলায় অনুবাদ করতে গিয়ে বাংলা বাক্যবিন্যাসের যে রীতি, তার অনুসরণ করাতে বিষয়টি মূলানুগ থাকে নি। এক্ষেত্রে প্রথম অনুবাদকের সম্মান তাঁর প্রাপ্য। নীলাঞ্জন হাজরা ফয়েজের কবিতা অনুবাদের আন্তরিক চেষ্টা করেও মূল ভাষায় দখল না থাকায় ফয়েজের ‘তারা’-কে চিনতে ভুল করেছেন। তিনি ‘দর্দ কা সিতারা’র অনুবাদ করেছেন ‘বেদনার্ত তারা’।  ক্ষেত্রবিশেষে এর অর্থ যে ‘সমবেদনা’ হতে পারে ব্যাপারটি তাঁর মাথায় আসে নি অথবা তিনি মনোযোগ দেন নি মূলের বিকল্প অর্থের সম্ভাবনার প্রতি।

আমাদের আলোচ্য জাভেদ হুসেনের অনুদিত ফয়েজের নির্বাচিত কবিতার সংকলন  ‘ফয়েজ আহমদ ফয়েজঃ কবিতা’তে এক সম্পূর্ণ ফয়েজকেই পাই। এখানে কালানুক্রমিক সাজানো নয় অনুদিত ফয়েজের সৃষ্টিগুলো। নজম, গজল, কাতা, অন্যান্য প্রভৃতি ভাগে গুচ্ছাকারে সজ্জিত থাকায় ফর্মের প্রতি আমাদের ন্যূনতম যে দায়বোধ থাকার আবশ্যকতা আছে, বিশেষত, ফয়েজের কিংবা গজলমুখর উর্দু কবিতার অনুবাদের বেলায়, ঐতিহাসিকভাবে যে বিষয়টা নিয়ে ভালো রকমের বিতর্ক হয়ে গিয়েছে, পাঠকমনে তার প্রশমন ঘটায়। অনুবাদক যাঁর সৃষ্টিকর্মের অনুবাদ করতে গিয়েছেন, তাঁর বিষয়ে পর্যাপ্ত জানেন এবং গভীরভাবেই জানেন। অধিকন্তু, উর্দুতে পণ্ডিত এবং মার্ক্সীয় রাজনীতির সাথে তাঁর আন্তরিক ঘনিষ্টতা ফয়েজের অনুবাদে অনুবাদকের যে অধিকার থাকা দরকার তার শর্ত পূরণ করেছে। অনুবাদককৃত একটি প্রাসঙ্গিক প্রস্তাবনা যুক্ত হওয়াতে এবং অনুবাদের পাশাপাশি মূলের স্বাদ পেতে অনুদিত সৃষ্টিগুলোর প্রত্যেকটিকে মূল উর্দু উচ্চারণে বাংলা লিপিতে অনুদিত কবিতাগুলোর পাশাপাশি রাখাতে সত্যিকারের যাকে কাজের কাজ আমরা বলি-  তা হয়ে উঠেছে। উৎসর্গপত্র থেকে অনুবাদকের অনুবাদের কঠিন কাজটিতে (যা আসলে একটি নতুন সৃষ্টিকর্মের নামান্তর)প্রবৃত্ত হতে যাওয়ার উদ্দেশ্য দু’কথায় আছেঃ

“ফয়েজকে নিয়ে বাংলা ভাষায় বহাল লেখাগুলোর ঘাটতি অনুভব করে এই বই। এই চেষ্টার কমতি পূরণে যারা লিখবেন…তাদের জন্য।”

আমরা মনে করি অনুবাদক আপন উদ্দেশ্যে সফল। আরও মনে করি যে, কোন চেষ্টাই ত্রুটির উর্ধ্বে নয় বলেই অধিকতর বিশুদ্ধতার দিকে আমাদের অভিযাত্রা অব্যাহত থাকে, যা আমাদেরকে উত্তরোত্তর শৈল্পিকতার বিচিত্র বর্ণিল পথে নিয়ে যেতে সাহায্য করে।

Facebook Comments

comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top