এনার্কিস্টের তিন কাপ চা ।। রওশন আরা মুক্তা

-আপনি এখন কই যাবেন এইটা সম্পূর্ণ আপনার ইচ্ছা স্বাধীন ব্যাপার।

এই বলে শান্ত নামের লোকটা রিকশা ডাকে। রাত সাড়ে বারোটা বাজে। রিপার হিসাবে এখন রাত নয়টার বেশি বাজার কথা না। কিন্তু পেটে মদ পড়লে সময়-গময় ঠিক থাকে না। কোন দিক দিয়ে এত রাত হয়ে গেছে বুঝতে পারা যায়নি। হোস্টেলের গেট বন্ধ হয়ে গেছে রাত দশটায়। আরেকটু আগে বের হলে, মানে রাত এগারোটার আগে বের হলেও অন্য কোথাও গিয়ে থাকতে পারতো। আর এই লোকটা কি জানে না, রিপা যে এত রাতে কোথাও গিয়ে থাকতে পারবে না? সে কি রাস্তায় থাকবে? রিপা ভার্সিটির কোচিং করতে এসেছে ঢাকায়। যথেষ্ঠ ভালো ছাত্রী। কোচিং না করলেও চলতো। কিন্তু এই স্বাধীনতা সে কোথায় পেতো, কাটায় কাটায় দ্বিগুণ বয়সের লোকের সাথে মদ খেয়ে রাত সাড়ে বারোটায় সেলফ ডিপেন্ডেসির পাঠ কই পেত রিপা?

রিপা শান্ত’র কলার চেপে ধরে। চিৎকার করে।
-ইচ্ছা স্বাধীন ব্যাপার মানে? এত রাতে এখন কই যাব আমি? খানকির বাচ্চা, এখন আমার জন্য কোন হারামি দরজা খুইলা বইসা আছে? ফালতুর বাচ্চা!

শান্তকে এমন কোনো গালি নাই যে দিচ্ছে না রিপা। অবশ্য এই ক্যারেকটারটাই এমন। নির্বিকার ইনডিভিজুয়াল। রিপার মুখে গালি এলে সে কী করতে পারে?

শান্ত বেশ শান্ত ভঙ্গিতে রিপার হাত ধরে। বলে,
-উত্তেজিত হইয়ো না। দাঁড়াও, দেখতেছি ব্যাপারটা।

রিপা চিৎকার করা থামায় না। সে বলতেই থাকে, ইচ্ছা করে তাকে ডেকে এনে মদ খাওয়ানো হয়েছে এবং মাতাল করে দিয়ে এখন মধ্যরাতে রাস্তায় ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। এটা অবশ্যই অনেক বড় কোনো পরিকল্পনার একটা অংশ। সে একা হয়ে যেতেই তাকে একদল লোক মাইক্রোবাসে করে তুলে নিয়ে যাবে এবং ভারতে নিয়ে বিক্রি করে দেবে। আর সারাটা জীবন তার বেশ্যা হয়ে থাকতে হবে। শান্ত নিজে যেহেতু একটা বেশ্যার সন্তান তাই দুনিয়ার সব মেয়েকে বেশ্যা বানাতে চায় সে।

শান্ত রিকশায় উঠে বসে। রিপাকে বলে,
-চিল্লাপাল্লা থামাও। মদ তুমি একলা খাও নাই। আমিও খাইছি। উঠো রিকশায়। কই আর যাব, আমার বাসাতেই যাই।

রিপা লাফ দিয়ে রিকশায় ওঠে। রিকশায় উঠেই সে জুতা-মোজা খুলে ফেলতে থাকে। শান্ত বলে,
-জুতা খুলতেছো কেন?
-আমার চ্যাটের খুশি। আমার জুতা আমি খুলব যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে খুলব। আমার জুতা আমি ফেলব যেভাবে খুশি সেভাবে ফেলব।

এই বলে রিপা জুতাগুলো রাস্তায় ফেলে দেয়। রাতের রাস্তা। শো শো করে গাড়ি ছুটে যাচ্ছে। এর ভিতরেই রিকশা থামায় শান্ত। রিপা জুতা ফেলে দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছে এখন। কোনো দিকে খেয়াল আছে বলে মনে হয় না। শান্ত রিকশাওয়ালাকে ইশারা করে দাঁড়াতে। জুতাগুলো কুড়িয়ে আনে সে। ইচ্ছা করেই মোজাগুলো কুড়ায় না। জুতা কুড়িয়েছে সেই তো বেশি। মদ খেয়ে রাস্তায় জিনিসপত্র ছুঁড়ে আগেও ফেলেছে মেয়েরা। শান্ত কোনোদিন এভাবে রাস্তা থেকে কারও জিনিস কুড়িয়ে আনেনি। যার জিনিস তারই যদি ফেলে দিতে ইচ্ছা হয় তাহলে এখানে তার কী করার থাকতে পারে? তবে তারা আরেকটু বয়স্ক ছিল; মানে জিনিসপত্র ছুঁড়ে ফেলা মেয়েরা। রিপার বয়স আরও কম। ঠিক ততটাই কম যতটা কম শান্ত চায়। চাহিদা মাফিক কম বয়সের মেয়ে বলেই কি তার জুতাগুলো কুড়িয়ে আনলো কি না- বুঝতে পারছে না শান্ত।

একইভাবে শান্ত বুঝতে পারে না, রিকশায় বসে রিপাকে ধরে রাখবে কি না। মেয়েটা পড়ে যেতে পারে। রিপা পুরোপুরি বেহুঁশ বলা চলে। অথচ রিপাকে শান্ত মদ খেতে ডাকেনি। কয়েকদিন আগে এমনিতেই জিজ্ঞাসা করেছিল, রিপা মদ খায় কি না। রিপা বলেছিল বিয়ার খেয়েছে কয়েকবার, কিন্তু ভালো লাগে না। আজকে রিপা নিজেই দেখা করতে চেয়েছে। শান্ত বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিল; আসতে বলেছে, রিপা এসেছে। সবাই মদ খাচ্ছিল রিপাও খেয়েছে। কেউ তো তাকে জোরাজুরি করেনি! ১৮ বছরের একজন প্রাপ্তবয়স্ককে কেউ কোনোদিন জোর করে কিছু খাওয়াতে পারে না করতে পারে?


সুলতানা যাই করুক, ধরা যাক সে ফটোগ্রাফিতে বিদেশি পুরস্কার পেলো- বন্ধু-বান্ধবরা ফোন করবে, শুভ কামনা জানাবে কিন্তু শেষমেশ গল্প চলে যাবে শান্ত’র কোর্টে। সুলতানা হয়তো গেছে কলকাতায়, সেখানেও নানা লোক একথা-ওকথা বলাবলি করে হুট করেই শান্ত’র গল্প শুরু করবে। শান্ত এটা, শান্ত ওটা। শান্ত’র অমুক প্রেমিকা ওই, শান্ত’র তমুক প্রেমিকা সেই। ইদানীং শুরু হয়েছে শান্ত’র কম বয়স্ক মেয়েদের সাথে নানান গল্পগাঁথা। শান্ত এখন কম বয়স্ক মেয়েদের সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছে, যেকোনো দিন নারী নির্যাতন মামলায় দ্রুত বিচার ট্রাইবুন্যালের সম্মুখীন হতে যাচ্ছে। আরে বাবা! এই শান্তই যদি ঘুরে ফিরে আসে, তাহলে আর ডিভোর্স নেয়া হলো কেন? এই শান্ত বিষয়ক অত্যাচারই যদি সহ্য করতে হবে তাহলে তো সেই এনার্কিস্টটার সাথেই থাকা যেত!

সুলতানা খুব ভালো করে চেনে শান্তকে। ট্রাইবুন্যালে ওর বিচার করাবে এমন মেয়ে এ দেশে নাই। সুলতানাই পারলো না, আবার অন্য কেউ! ইচ্ছা করলেই তো সে নারী নির্যাতনের মামলা দিতে পারতো। যৌতুকের মামলা ঠুকে দিলে এখন সুলতানার স্বামী জেলে থাকতো। কিন্তু সুলতানার মামলা করার মতো প্রতিহিংসা জাগেনি। শান্ত যা-ই বলতো সে অক্ষরে অক্ষরে পালন করতো। সুলতানার তো ধারনা, ওই সময়গুলোয় শান্ত বিষের বোতল এনে দিয়ে যদি বলতো, ‘খাও তো দেখি লক্ষ্মীসোনা’। বিনা বাক্য ব্যয়ে সুলতানা তা খেয়ে নিত। বিষ না খাওয়ালেও বিষের কারবার ঠিকই করেছিল শান্ত। এখনও সুলতানার সে বিষ নামেনি। তালাক দিয়েও রেহাই পাচ্ছে না সে।

সুলতানা গতকাল খবর পেয়েছে তার এক সিরিজ ছবি ফ্রান্সের একটা প্রদর্শণীতে স্থান পাচ্ছে এবং ওরা তাকে হোটেল বুকিং, এয়ার টিকেটসহ দাওয়াত পাঠাচ্ছে। পনেরো দিনের জন্য প্যারিস যাবে সে। এ খবরে সুলতানা প্রথম যে কাজটি করলো তা হলো, ফোনের পাওয়ার অফ করে দিলো- যেন কেউ ফোন না করতে পারে। কারও সাথে শান্ত’র গল্পে অংশগ্রহণ করা তার পক্ষে এখন সম্ভব না।

বারান্দার গাছগুলোর দিকে কয়েকদিন তাকিয়েও দেখা হয়নি। অনেক শখের গাছ কিন্তু মাঝে মাঝে কী যে হয়, নিজের চুলগুলোও আঁচড়াতে ভুলে যায় সে, গাছের কী যত্ন নেবে? মনটা আজকে অনেক স্থির, একমাত্র সাফল্যই পারে সুলতানার অস্থিরতা কমাতে। গাছগুলো কয়েকদিন পানি না পেয়ে কেমন নেতিয়ে পড়েছে। সুলতানা গাছের সাথে কথা বলে।
-কয়েকদিন খুব কষ্ট হইছে না রে? কী করব আমি? আমিও তো কষ্টেই ছিলাম
গাছের পক্ষ থেকে নিজেই উত্তর দেয় সুলতানা।
-তুমি এমন কোনো কষ্টে ছিলা না যাতে করে আমাদের মেরে ফেলার প্ল্যান করতে পারো, যাও তোমার পানি দেয়া লাগবে না।
-আরে আরে কী রাগ! তোরা না গাছ? তোদের এমন শিকড়ভরা পাতাভরা রাগ থাকলে দুনিয়ায় তো কেয়ামত হয়ে যাবে!
-মন ভোলানো কথা বলবা না, তুমি নিজে যা মন চায় করো, আর আমাদের উপদেশ দিতে আসছো!
-আমি কী করলাম? তোরা তো কয়েকদিন দেখলি, আমি তো এমনকি এই কয়দিন খাই-ও নাই ঠিকমতো, মাথাটা আমার খারাপ রে! আর তোদের খারাপ ভাগ্য, এমন মেয়ে মানুষের বারান্দায় জায়গা হলো তোদের!
-আমরা হাতে পায়ে ধরে তোমার বারান্দায় মরতে আসি নাই, তোমার মন চাইছে তুমি আমাদের আনছো, এখন দয়া করে ভেবে দেখো, প্রতিদিন পানি দিবা কি না, নাহলে রাস্তায় ফেলে দাও। কপালে থাকলে বাঁচবো না হলে একেবারে মরে যাবো।
-ভেবে দেখার মতো কথাই বলছিস কিন্তু, তবে রাস্তায় ফেলব না। দরকার পড়লে ভালো মাথাওয়ালা কারো বারান্দায় রেখে আসব, অনেক মায়া পড়ছে তো, কতদিন ধরে থাকিস আমার সাথে।
-হ্যাঁ তাই করো, রেখে আসো আমাদের অন্য কোথাও, আর নিজে সারাদিন শান্ত শান্ত করে মারা যাও একদিন।

সুলতানা ‘হা হা হা’ করে হাসে। একা একাই। গাছে পানি দেয়া শেষ। আবার সেই শান্ত। গাছের হয়ে নিজের মুখ দিয়ে শান্ত নামটাই উচ্চারণ করলো সে! একটা সুখবর, তাও অতদিনের পরিচিত লোকটাকে দেয়া যাচ্ছে না। শান্ত এমনই এবিউজ করেছে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটাকে।

ডোরবেল বাজে। একবার, দু’বার। কে আসতে পারে? ফোন বন্ধ পেয়ে তূর্য চলে এলো না কি? তূর্য এলে অবশ্য খুশিই হবে সুলতানা। বহু ঝামেলা যন্ত্রণা পেরিয়ে এই একজনকে পাওয়া গেছে যে অন্তত এবিউজ করছে না। হয়তো ভালোবাসে না, নিছকই বন্ধু হিসাবেই কাছে আসে; অবশ্য এর বেশি কিছু চায়-ও না সুলতানা। কিন্তু দরজা খুলে দেখা গেল দাঁড়িয়ে আছেন মহীয়সি জেবিন। মুখ থেকে শুরু করে অন্তর পর্যন্ত তিতা হয়ে গেল সুলতানার। এই সেই জেবিন যার কথা মনে হলেও সুলতানার হাতের জিনিস আছড়ে ভেঙ্গে ফেলতে মন চায়, এবং মাঝেমধ্যে ভাঙ্গেও। জেবিনের আখাস্তা জামাইয়ের কথা মনে হলেও তাই। এদের কাছ থেকে দূরে থাকতে চায় সে। অথচ সেই জেবিন আজ দেড় বছর পর সুলতানার বাসায় চলে এসেছে। কী দেখতে? সুলতানার মরা মুখ?

-কী মনে করে?
-পানি খাব।
-দুনিয়ায় পানির অভাব? তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে? পানি পাইতেছ না কোথাও?
-পানি চাইলে দিতে হয় বুঝছো? নাইলে মরার সময় পানি পাবা না।
-মরার সময় পানি আমি এমনিতেও পাব না। তুমি, তোমার জামাই আর শান্ত মিলে সেই ব্যবস্থা করছো, এখন হাদিস শোনাইতে আসছ আমারে?

সুলতানাকে ধাক্কা দিয়ে ঘরের ভিতরে ঢুকে যায় জেবিন।

-আমার জামাইরে নিয়া আর খিচ খাওয়া লাগবে না তোমার, ওরে আমি ছাইড়া দিছি। দাও পানি দাও।
সুলতানা দরজা লাগাতে লাগাতে বলতে থাকে,
-তোমার অনেক সাহস জেবিন। তুমি আমার বাসায় আইসা আমারে ধাক্কা দিয়া মাস্তানি দেখাও? পাইছটা কি তোমরা আমারে? আমি কি মানুষ না? জামাই ছাইড়া দিছো সেইটা আমারে বলতে আসছো কেন? আমি কিছু করছি তোমার জামাইয়ের সাথে? কিছু করি নাই আর করতে দেইও নাই। এইসব কাজকর্ম করছো তুমি আর শান্ত। আমার লাইফটা হেল কইরা দিছো তোমরা।

ছোট ডাইনিং টেবিলটার পাশে চেয়ার টেনে বসে জেবিন। সিগারেট ধরায় একটা। ফ্রিজ থেকে পানি এনে দেয় ওকে সুলতানা।

-পানি খাও, আর খেয়ে বিদায় হও।

হঠাৎ সুলতানাকে জড়িয়ে ধরে হাওমাও করে কাঁদতে থাকে জেবিন। সাদা টাইলস বসানো ঘরটায় পানির গ্লাস পড়ে ভেঙ্গে যায়। পানি আর ভাঙ্গা কাচে মিলমিশ হয়ে গেছে। ভরদুপুরের রোদ এসে পড়েছে এই ভাঙ্গাভাঙ্গির ঘরে। সুলতানা জেবিনের পিঠে হাত রাখে।


ঘুম ভেঙ্গে রিপা আবিস্কার করলো ঘড়িতে সাড়ে বারোটা বাজে। রাত না, দুপুর সাড়ে বারোটা। শেষ যা মনে আছে, তখনও সাড়ে বারোটাই বাজছিলো ঘড়িতে। তাহলে লাস্ট এই বারো ঘণ্টা সময় জীবন থেকে হারিয়েই গেল কি না এই ভাবতে ভাবতেই তার মনে হলো, এটা তার বিছানা না। তাহলে এটা কার বিছানা? পরিস্কার চাদর, জানালায় পরিস্কার সাদা পর্দা। ও কি হাসপাতালে? হাত-পা দেখে সব ঠিক আছে কি না। সব ঠিক। পাশের ঘর থেকে মৃদু মিউজিকের শব্দ আসছে, আর দুইজন মানুষের গলার স্বর। রিপার মনে পড়লো, সে শান্ত নামক মাঝ বয়সী লোকটার সাথে মদ খেয়েছে রাতে। এবং মাতাল হয়ে গেলে শান্ত’র বাসায় এসে থাকতে হয়েছে তার। কী বোরিং! রিপা জুতা খুঁজতে থাকে। এ ঘরে নাই ওর শখের কেডসগুলো। ওর প্ল্যান জুতাগুলো বগলদাবা করে কোনোদিকে না তাকিয়ে সোজা বের হয়ে যাওয়া। অসহ্য লাগছে, যেন মাথার তাড় ছিঁড়ে যাবে এমন মাথা ব্যথা।

রিপা পাশের ঘরে গিয়ে বলে,
-আমার জুতা কই?
শান্ত বসেছিল কম্পিউটারের সামনে, সাথে একটা কম বয়স্ক ছেলে। শুধু কম বয়স্ক না, দেখতে অস্বাভাবিক রকম সুন্দর এক ছেলে। রিপার মাথা ঠাণ্ডা হয়ে যায় ছেলেটাকে এক নজর দেখেই। শান্ত বলে,
-তোমার জুতা শু র‍্যাকে আছে। তোমার যা যা কিছু সবই ঠিকঠাক জায়গায় আছে। মাথা গরমের কিছু নাই। আই এম নট এ রেপিস্ট।
রিপার মেজাজ আবার খারাপ হয়ে যায়। বলে,
-আই ডোন্ট গিভ এ ফাক এবাউট ইউ আর আ রেপিস্ট অর নট। হোয়ার ইজ দ্যা ফাকিং শু র‍্যাক?
রিপার গলা চড়ায় সুন্দর দেখতে ছেলেটা ওর দিকে তাকায়। কিছুটা মুগ্ধতা মেশানো দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে সে। রিপার মাথাটা আবার ঠাণ্ডা হয়। সে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে ধপ করে বসে পড়ে। তারপর আস্তে করে জিজ্ঞেস করে,
-কী হইছিল রাতে? ওখান থেকে বের হওয়ার পর আমার আর কিছু মনে নাই।
-কিছুই হয় নাই, তুমি বাচ্চাসুলভ প্রেমের কথা বলতেছিলা। অতটা ইমম্যাচিউর ভাবি নাই তোমারে, অথচ তুমি সেইরকমই!
-মানে আপনারে প্রেম নিবেদন করতেছিলাম?
-আমাদের সাথে তো আর কেউ ছিল না, নিবেদন কইরা থাকলে তো আমারেই করার কথা, নাকি! এবং প্রেম নিবেদনের এক পর্যায়ে রাস্তায় তুমি জুতা খুইলা ফেললা। আরও কিছু খুলতা কি না জানি না; তবে সেই সুযোগ আমি তোমারে দেই নাই।
-জুতা খুইলা কী করলাম?
-রাস্তায় ফেলে দিলা। গালিগালাজও করলা।
-তাইলে ঠিক আছে, মদ খেয়ে মেয়েদের এমনই করার কথা। আর আপনিও সেই রিস্ক নিয়াই মদ্যপানের আসরে ডাকছেন আমারে।

কম বয়স্ক ছেলেটা কথা বলে ওঠে, রিপার দিকে পানির বোতল এগিয়ে দিয়ে বলে,
-আপনি একটু পানি খান। মুখটা অনেক ফ্যাকাশে দেখাইতেছে।
রিপা পানির বোতলটা নেয়। শান্ত বলে,
-ও হইল আবরার; ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে।
রিপা আবরারের দিকে হাত বাড়িয়ে বলে,
-আমি রিপা, কোন কলেজে পড়ো?
আবরার মৃদু হেসে হাত মিলায়।
– ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
-আই সি! আমি ভাবছি তুমি মানে আপনি ইন্টার মিডিয়েট ফার্স্ট ইয়ারে পড়েন!
শান্ত বলে,
-আমার আস্তানায় অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়েরা আসতে পারে না রিপা। আই এম নট এ পেডোফিলার।
রিপা বা আবরার শান্ত’র কথায় কোনো মনযোগই দেয় না। আবরার হাত মিলিয়ে হাতটা ফিরিয়ে নিজের বুকের সাথে লাগায়। শান্ত পাত্তা না পেয়ে কম্পিউটারে মনোনিবেশ করেছে। রিপা বলে,
-হ্যান্ড শেক কইরা হাত বুকে লাগাইলেন কেন?
-ছোটবেলায় শিবির করতাম। করতাম মানে, বুঝতামও না যে শিবির করতেছি। ক্লাস ফোরে পড়ি তখন। নানা রকম আচরণ শিখাইতো বড় ভাইয়েরা। হাত মিলাইয়া বুকে লাগানো তার মধ্যে একটা। অভ্যাস হইয়া গেছে। আসলে যা মন থেকে শিখি তা ভুলতে পারি না।
-গত সাত বছর ধইরা আমি সকাল বেলা চা খাই, সো, মন দিয়া চা খাওয়া শিখছি বইলা আমারে কি কেউ এক কাপ চা আইনা দিতে পারেন?

আবরার আবার মৃদু হাসে। শান্ত বলে
-আমি আনতেছি চা। আপনারা বসেন। আবরার, আপনি একটু দেখবেন আউটলাইনটা দাঁড়াইছে কি না? পিসিতে বসেন একটু।

ওরা কোনো কাজের কথা বলতেছে সম্ভবত। রিপার এসবে আগ্রহ নাই। এবং গত সাত বছর ধরে সে চা-ও খায় না। শান্ত নামের লোকটিকে ঘর থেকে বের করে দিতেই চায়ের কথা বলা। কিছুদিন আগে শান্ত জিজ্ঞাসা করেছিল, রিপা সেক্স করতে চায় কি না। রিপা বলেছিল, সেক্স ছাড়াও তো নানা সম্পর্ক হতে পারে মানুষে মানুষে; কেন সেটা না? কেন সেক্সই? শান্ত’র ব্যাখ্যা ছিল, ইন্টারপার্সোনাল কমিউনিকেশনে মানুষ সেক্স নিয়ে ঝামেলায় পড়ে, তাই সম্পর্কের স্বার্থেই হেলদি সেক্স করে বিষয়টাকে একপাশে সরিয়ে রাখা ভালো। অবশ্য রিপা না চাইলে না। আর রিপা চাইলে, থ্রিসামও করতে পারে। শান্ত’র সব সময়ই এমন কিছু বিশ্বস্ত ছেলে বন্ধু থাকে যারা কোনো যন্ত্রণা সৃষ্টি করবে না। সাউন্ড এন্ড সেফ। সেক্স নিয়ে ছুৎমার্গের কিছু নেই। রিপা কথাগুলো শুনেছিল, যৌন বিষয়ক কথাবার্তা বলেই হয়তো না শুনেও পারেনি। এই কথাগুলোতেও একটা রগরগে যৌনতার স্বাদ আছে।

শান্ত ঘর হতে বের হয়ে যেতেই রিপা দরজাটা আটকে দিলো। আবরার হাহা করে উঠল রিপার কাজ-কারবার দেখে। রিপা আবরারের পাশে গিয়ে বসে বললো,
-প্রাপ্তবয়স্ক দুইটা ছেলে মেয়ে যেকোনো স্থানে, যেকোনো সময়, যেকোনো ভাবে দরজা আটকাইয়া দিতে পারে, কী বলো? এতে মাঝ বয়সী প্রাপ্তবয়স্ক বালকের কোনো সমস্যা থাকার কথা না! উই লিভ ইন স্বাধীন বাংলাদেশ!

আবরার আবারও আস্তে করে হাসে। রিপার হাত ধরে বলে,

-তুমি অনেক পাওয়ারফুল, যেভাবে তুমি এই ঘরে আইসা ঢুকলা তখনই টের পাওয়া গেছে তা। আর হ্যান্ডশেক কইরা নিশ্চিত হইছি।
-তুমি কি শান্ত’র থ্রিসামের সেই নির্বিষ ছেলে বন্ধুটা? সত্যি কইরা বলবা কিন্তু!
-আরে না, আমি উনার এইসব জানি, কিন্তু এসবে অংশগ্রহণ করি না। কতদিন আমার চোখের সামনেই নানা ছেলেমেয়েরা আইসা উনারে নিয়া দরজা বন্ধ কইরা দেয়। আমার এইগুলায় আগ্রহ নাই।

রিপা আবরারকে চুমু খায়। কেন খায় কে জানে! শান্ত চা নিয়ে এসে দরজা বন্ধ দেখে নক করে না। বারান্দায় বসে একে একে তিন কাপ চা খেয়ে ফেলে। তিন কাপ চা, তিন রকম ছিল।

Facebook Comments

comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top