গভীরে নীল, ডুবে যায় প্রাণ // লুনা রাহনুমা

ইমেইলে আর ইনবক্সে সম্পাদকদের পাঠানো মেসেজের দিকে তাকিয়ে বসে আছে ঐন্দ্রিলা সুবচনা। এটি তার জন্মের পর পরিবার থেকে পাওয়া নাম নয়। লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার শুরুতে ব্যবহার করা ছদ্মনাম। লেখকের ছবি হিসেবে পাঠক ও বাইরের মানুষ আসল ঐন্দ্রিলা সুবচনাকেই দেখে, চেনে, জানে। যদিও জনপ্রিয় এই লেখিকার আসল নাম আয়েশা আক্তার ঐন্দ্রিলা। জন্মসূত্রে পাওয়া নামটাকে উল্টে, পাল্টে, আধুনিকীকরণ করার পর বর্তমান নাম হয়েছে, ঐন্দ্রিলা সুবচনা। এটি তার নিজের দেওয়া নাম নয়, নামের পেছনে অন্য ইতিহাস আছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স প্রথমবর্ষে পড়ার সময় যখন সে প্রেমে পড়েছিল, সেই প্রায় বিশ বছর আগে, তখন একই সাবজেক্টের দুই ক্লাস সিনিয়র আতাউর রহমান সোহাগ এই নামটি নির্বাচন করে দিয়েছিল ওকে। তখন ঐন্দ্রিলা সোহাগকে নিবেদন করে লিখে যাচ্ছিল অজস্র প্রেমের কবিতা। সেই কবিতাগুলোর কিছু কিছু পড়ে সে নিজেই মুগ্ধ হয়ে যেত। বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজিলাতুন্নেসা হলের নিচে নোটিস বোর্ডে প্রতি সপ্তাহে টানিয়ে দিত নিজের লেখা নতুন কবিতা, আর কান ভরে শুনত সবার সীমাহীন প্রশংসা। সোহাগ তখন বলেছিল, আসলে কবির নাম কবিতার মতো কাব্যিক না হলে পাঠকের মনে সে কবিতা পড়ে ঠিক ভাব আসে না। তাই কবি ঐন্দ্রিলার জন্য উপযুক্ত একটি কাব্যিক নাম ধার করা হয়েছিল প্রেমিকের পরামর্শে। তাছাড়া, ঐন্দ্রিলা চারপাশে অনেক লেখককেই দেখেছে, লেখা শুরু করার পরপরই প্রথমে তারা নিজের পছন্দে একটি নতুন নাম উপহার দিয়েছে নিজেকে। পরবর্তীতে লেখক পরিচয়টি প্রতিষ্টিত না হলেও নিজের জন্য একটি ব্যতিক্রমী নাম থেকে যায় কবি বা লেখক হতে চাওয়া মানুষটির কাছে। তাই ঐন্দ্রিলাও প্রচলিত প্রবাহে গা ভাসতে দ্বিধা করেনি। যদিও তখন ধারণা ছিল না, একদিন সে সত্যি সিরিয়াস লেখিকা বনে যাবে। দেশের জাতীয় দৈনিকে নিয়মিত কলাম লিখবে, গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক এবং পররাষ্ট্রনীতির কটাক্ষ করে নিজস্ব মতামত প্রকাশ করে লিখে যাবে একের পর এক লেখা, যা সরকারি দলকে অস্বস্তিতে ফেলবে এবং বেসরকারীদলকে যোগাবে বিপ্লবের অনুপ্রেরণা, আবার সমানতালে দক্ষতার প্রমাণ রাখবে সাহিত্য রচনাতেও। আজকের এই বর্তমান, সেদিনের সেই অদূর ভবিষ্যতের বিন্দুমাত্র আভাস পেলে, হয়তো সে নিজের মায়ের রাখা নামটি ব্যবহার করাই সঠিক বলে মনে করতো। আর প্রেমিক সোহাগের নির্বাচন করে দেওয়া ছদ্মনামটিকে আলগোছে ছেঁটে ফেলতে পারতো, সময় থাকতেই।
নামের প্রসঙ্গটি ছাড়া ঐন্দ্রিলার মনে নিজের লেখকসত্তা নিয়ে বেশ অহংবোধ আছে। আর থাকবে নাই বা কেন, আজকের এই যে এত লেখা চাই, কবিতা দিন, নতুন গল্প কি লিখেছেন কিছু, ঈদের বিশেষ সংখ্যায় আপনার একটি আনকোরা উপন্যাস কিন্তু চাই-ই চাই, অমুক পত্রিকায় গল্প পাঠিয়েছেন দেখলাম আমাদেরকে দিলেন না কেন- সম্পাদক এবং প্রকাশকদের এত সব অনুনয় বিনয়ের পত্রালাপের শুরুটা এত সহজ ছিল কী? মুখের কথা তো নয় নিয়মিত তিনটি দৈনিকে লেখা জুগিয়ে যাওয়া, আর মাসভর লিটল ম্যাগাজিন, মাসিক, ত্রৈমাসিক, দ্বিবার্ষিক, আর যখন তখন অসংখ্য আন্তর্জালে ছোট বড় মিলিয়ে শতশত লেখা প্রসব করে যাওয়া!
ল্যাপটপে ইমেইল খুলে ইনবক্সে জমে থাকা মেইলগুলোর প্রেরকের নাম দেখে ঐন্দ্রিলা। ক্লিক না করেও সে জানে তেঁতুলিয়ার মফস্বল থেকে প্রকাশিত একটি পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক সোহরাব হোসেন ইমেইলে কী লিখেছে। এক সপ্তাহে সানজিদা চৌধুরীর এটা দশ কিংবা এগারো নাম্বার ইমেইল, মহিলা পাতার জন্য গুচ্ছ-কবিতা চাইছেন ভদ্রমহিলা। চুণি মল্লিক নামে এক সম্পাদক পেছনে লেগেছে গত ছয়মাস ধরে। সমাজ ও পরিবারে নারীর অবস্থান বিষয়ক একটি মুক্তগদ্য লিখিয়ে নেওয়ার জন্য খুব মিনতি ঝরাচ্ছে ইমেইলের পাতায়। ঐন্দ্রিলা লেখা দিতে পারছে না। লেখার মুড না আসলে লিখবে কেমন করে? লেখা কি কারখানার মেশিনে সুইচ টিপলেই টপাটপ নেমে আসে? ব্যাপারটি যে তেমন নয়। লেখার জন্য লেখকের মনে ভাব আসতে হবে আগে। তবেই না সে মন খুলে লিখে যাবে, বলে যাবে তার নিজের কথা মুক্তহস্তে। ইমেইল প্রেরকের নামগুলোর দিকে তাকিয়ে ঐন্দ্রিলার মনে কেমন ক্লান্তির ভাব আসে। আসে কি? এত যে লেখা ছাপা হচ্ছে তার, তবুও আনন্দটা সেই আগের মতো নেই যেন। উপচে পড়া খ্যাতির স্ফুর্তি উপভোগ করে সে সবসময়ই, কিন্তু সেই প্রথম প্রথম যখন লেখা ছাপা হতো, ছদ্মনামটির নিচে নিজের লেখা গল্প, কবিতার লাইনগুলো যেন কাগজের উপর কালির কালো গোলাপ হয়ে ফুটে উঠত চোখের পর্দায়। সেই এক অমূল্য হর্ষ, হ্লোদ, আমোদে উত্তাল হৃদয়ের মালকিন কোথায় যেন লুকিয়ে পড়েছে নিজেরই অতলে। হাতড়ে বেড়ায় ঐন্দ্রিলা, তবুও কদাচ তার দেখা পাওয়া ভার।
একটি পত্রিকা থেকে ঐন্দ্রিলার ইন্টারভিউ করতে চাইছে অনেকদিন থেকে। বেশ কয়েকমাস চেষ্টার পর অবশেষে দুজনের সময় মিলেছে ইন্টারভিউটা সেরে ফেলার। এক দেশে লেখিকা আরেক দেশে সাংবাদিক। তাই ইন্টারভিউ হচ্ছে জুমে। সাংবাদিকের প্রশ্ন সংক্ষিপ্ত, ঐন্দ্রিলা সুবচনার উত্তরগুলো দীর্ঘ। ঠিক যেমনটা পাঠক চায়। পাঠকের আগ্রহ বরাবর লেখিকার কথায়, তাই সাংবাদিকের প্রশ্ন এখানে ছোট কয়েকটি টোকা মাত্র। সাংবাদিক গতানুগতিক একই প্রশ্ন দিয়ে আরম্ভ করেন, এবারেও তাই করেছেন, অর্থ্যাৎ, `আপনার লেখালেখি শুরু হয়েছিল কবে?`
মনে মনে ঐন্দ্রিলা চলে যায় অনেক বছর আগের জীবনে। নিজের শৈশবের কথা মনে পড়ে। দুরন্ত কৈশোরের কথা ভাবে সে। বর্তমান থেকে অনেকখানি দূরে ভেসে যাওয়ার মতো করে ঐন্দ্রিলা কথা বলছে। বলে, `আমি যখন খুব ছোট, তখন থেকেই লিখতাম। ছড়া লিখতাম, কবিতা লিখতাম, স্কুলের বাৎসরিক স্মরণিকাতে আমার চার লাইনের একটি মতামত ছাপা হয়েছিল। বলতে পারেন নিজের নাম ছাপার অক্ষরে দেখার সেই আমার প্রথম অনুভূতি।`
ঐন্দ্রিলার মনে পড়ে, সেবার ক্লাস টেনে ওঠার পর স্কুল ম্যাগাজিনের জন্য লেখা চেয়ে ছোট্ট একটা নোটিশ টানানো হয়েছিল হেডস্যারের রুমের বাইরে দেয়ালে। ঐন্দ্রিলার ভীষণ ইচ্ছে ছিল একটা লেখা জমা দেয়, কিন্তু পরপর অনেকগুলো রাত চিন্তার কাঠ-খড় পুড়িয়েও কিছুই লাভ হলো না। ঠিক সেই সময়ে বাড়িতে বেড়াতে আসা বড়বোনের কবি বান্ধবীর ডায়রিতে পড়া একটি কবিতা তার খুব ভালো লেগে গিয়েছিল। স্বাধীনতার যুদ্ধে হারানো ভাইকে নিয়ে লেখা বোনের আর্তনাদের এক মর্মস্পর্শী কবিতা। আপার অনুমতি নিয়ে ডায়রি থেকে কবিতাটি লিখে নিয়েছিল ঐন্দ্রিলা এই বলে যে, স্কুল ফাংশানে সে কবিতাটি পাঠ করতে চায়। কিন্তু বাড়ি ফিরে কবিতাটির নাম বদলে আর নিচে নিজের নাম বসিয়ে স্কুল ম্যাগাজিন কমিটির কাছে জমা দিয়ে দেয় সে। বলা বাহুল্য, সেই কবিতা স্কুল জীবনে তাকে কবি হিসেবে বিশেষ খ্যাতি এনে দিয়েছিল। যদিও রক্ষা, সেই কবিতায় ঐন্দ্রিলা নিজের আসল নামটাই ব্যবহার করেছিল। তাই বর্তমানের জনপ্রিয় ঐন্দ্রিলা সুবচনাকে লেখা চুরির অভিযোগে পাঠকের আদালতে দাঁড় করাতে পারবে না কেউ।
স্কুলের ম্যাগাজিনে সেই কবিতা ছাপা হবার ঘটনাটির পর থেকে ঐন্দ্রিলার কাছে লেখা সংক্রান্ত আর কোন স্মৃতি নেই। কলেজে উঠে কবিতার বই কিনে পড়েছে অনেক। হেলাল হাফিজের যে জ্বলে আগুন জ্বলে, লক্ষাধিক বার পড়ে মুখস্ত করে ফেলেছে। তখন একটি অন্তত কবিতার বই তার ব্যাগে পাওয়া যেত সবসময়। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে সোহাগের জন্য কবিতা লেখার সময় প্রিয় কবিদের কবিতার প্রচ্ছন্ন ছায়া আবেশ ছড়িয়েছে ঐন্দ্রিলার কবিতাতেও।
আলো আঁধারিতে যাই, নত মুখে বিষন্ন তাকাই,
তবুও তোমারেই দেখি:
দেবতা তুমি, মানুষ নও বুঝি, রেখেছো দাসী করে আমায়…
দাসী বাঁদী না মনে করলেও সোহাগ যে ঐন্দ্রিলাকে নিজের জীবন সঙ্গিনী ভাবেনি, তার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে বছর দুয়েক পরেই। জাহাঙ্গীর নগরে থাকতেই ওদের প্রেমের সম্পর্কটা ভেঙে গেল। দেখা গেল অনার্স প্রথম বর্ষে ভর্তি হওয়া নতুন একটি মেয়েকে নিয়ে সোহাগ লেকের পাড়ে বসে শীতের পাখি দেখছে, চৌরঙ্গিতে হাত ধরে হাঁটে- আর বাদাম খায়, আবার মুক্তমঞ্চে দাঁড়িয়ে তারা যুগল ভ্রমর হয়ে গুনগুন করে প্রেমের কবিতা আবৃত্তি করছে। প্রেমে গুলগুলা হয়ে রাতারাতি অচেনা মানুষে পরিণত হলো ঐন্দ্রিলার নিজস্ব প্রেমিকপুরুষটি। কিন্তু ঐন্দ্রিলা এই চরম অপমান গায়ে মাখেনি। শুধু, প্রেমিক সোহাগের মতোই খুব প্রিয় তার কবিতার বইগুলো, এবং নিজের কবিতা লেখার খাতাটিকে স্টিলের ট্রাঙ্কের তলায় ফেলে রেখে ক্লাসের পড়াশোনায় মনোযোগী হয়ে উঠেছিল খুব আচমকা।
এই পর্যন্ত এসে চিন্তার তার ছিড়ে যায় ঐন্দ্রিলার। সাক্ষাৎকার নিতে বসা সাংবাদিকের দ্বিতীয় প্রশ্নটি ভেসে উঠেছে জুমের স্ক্রিনে। সেই সঙ্গে সাংবাদিক শব্দ করে প্রশ্নটি শোনায় ঐন্দ্রিলাকে। বলে, `কর্মজীবনে তো আপনি একজন সফল মানুষ। একজন ব্যাংকার। সপ্তাহে পাঁচদিন ফুলটাইম অফিস করেন। এত ব্যস্ততার ভেতরেও কখন থেকে আপনি সিরিয়াস হলেন লেখালেখিতে? নিয়মিত লেখা শুরু করার গল্পটা আমাদের পাঠকদের উদ্দেশ্যে বলবেন প্লিজ।`
প্রশ্নটি শেষ হতেই, স্বামী, সন্তান, সংসার, চাকরি, আত্মীয়তা, সামাজিকতা এমন অনেকগুলো দায়িত্ব সম্পর্ক একসঙ্গে উঁকি মারে ঐন্দ্রিলার মনে। গুছিয়ে উত্তর দেওয়ার জন্য একটু সময় নিলো সে। তারপর বললো, `খুব বেশিদিন আগের কথা নয় অবশ্য, আমি সিরিয়াসলি লিখছি বছর সাত হবে। বলা যায় জীবনের মধ্যভাগে এসে একেবারে হঠাৎ করেই লিখতে শুরু করেছিলাম। তারপর লেখালেখির অভ্যাসটিকে ভালোবেসে ফেললাম। এখন এটাই আমার একমাত্র নেশা।`
ঐন্দ্রিলার নেশা শুধু লেখা নয়, পড়াও। সে নিজে লেখার চেয়ে পড়তে ভালোবাসে বেশি। সোহাগের সাথে প্রেমটা ভেঙে যাওয়ার পর নিজে লেখা ছেড়ে দিলেও প্রচুর বই পড়তো। প্রথম প্রেম চলে যাবার সাথেসাথে কবিতা বিদায় নিয়েছিল জীবন থেকে অনেকদিনের জন্য। প্রবেশ করেছিল গদ্য। বঙ্কিম, শরৎ, আশাপূর্ণা, রবিবাবু থেকে শুরু করে সেলিনা হোসেন, পূরবী বসু, হুমায়ন আজাদ, হুমায়ুন আহমেদ সবার বই পড়েছে সে, এবং উপভোগ করেছে। কিন্তু নিজে যে গদ্য লিখবে কোনোদিন এমন সুচিন্তিত পরিকল্পনা না থাকলেও, লেখক হবার এক অস্পষ্ট স্বপ্ন মনের ভেতরে সুপ্ত বাসনার মতো জমেছিল হয়তো, অগোচরে। শুধু ,সঠিক সময়ের অপেক্ষায় থেকেছে নীরবে। বিয়ের পর কয়েক বছর দেশে সংসার, স্বামী, শ্বশুরবাড়ির আচার পালনে অভ্যস্ত হওয়া, তারপর দেশ ছেড়ে ইউরোপের একটি দেশে আবার নতুন করে জীবন গোছানো, বাচ্চাদের লালনপালন করে হাঁপিয়ে উঠেছে যখন, ততদিনে তার বয়স চল্লিশ পার হয়েছে। নিজের ব্যস্ত জীবন কিছুটা রুটিনে ফেলে নিয়ে অবসরে একদিন লিখে ফেলল কয়েকটি লাইন। পরেরদিন আরো কিছু লাইন। তারপর কয়েক পাতার একটি সম্পূর্ণ গল্প দাঁড়িয়ে গেল সপ্তাহখানেকের চেষ্টায়। ঐন্দ্রিলা গল্পটি বারবার পড়ে, বারবার মোছে, কাটে পুননির্মাণ করে একই লেখা, লেখার বাক্য, উপমা, গদ্যের ছন্দ। অনেকবার বদলের পর একটি নাম ঠিক করে সে তার লেখা প্রথম গল্পের জন্য, “স্বর্ণলতা, একটি প্রেমের নাম”- যা ছিল এক সুডৌল প্রেমের গল্প। যেহেতু ঐন্দ্রিলা এককালে মনোযোগী পাঠক ছিল, তাই তার লেখাতেও সেই ছাপ ফুটে উঠতে দেখা যায় সুস্পষ্টভাবে। শব্দ করে নিজের লেখা গল্পটি পাঠ করে শোনায় সে নিজেকে। নিজের কানে কেমন লাগে বুঝতে কয়েকটি লাইন রেকর্ড করে শোনে । তারপর নিজেই নিজেকে সার্টিফিকেট দেয়, `মন্দ হচ্ছে না লেখা, তোমাকে দিয়ে হবে।`
স্বামীর ব্যবসার কারণে ইউরোপে স্থায়ীভাবে বসবাস করার সময় ঐন্দ্রিলা একটা বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করেছে অনেক বছর। নিয়ম ভঙ্গ করার কিছু অভিযোগ আসায় ব্যাংকটিকে বানিজ্য বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে। ব্যাংক বন্ধ হবার সাথে সাথে ঐন্দ্রিলার চাকরি জীবনের একরকম সমাপ্তি ঘটলো। ইচ্ছা করলে সে আরেকটি ব্যাংকে ফুলটাইম চাকরি খুঁজে নিতে পারতো। কিন্তু ব্যবসায়ী স্বামীর আয় রোজগার ভালো হওয়ায় পরিবারের অর্থনীতির জন্য তার চাকরি করাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। শুধু কাজের অভ্যাসের কারণে ঐন্দ্রিলা একটা ব্যাংকে পার্টটাইম লোন এডভাইসর হিসেবে যুক্ত হয়েছে। সপ্তাহে দুদিন মাত্র কাজ করে। ছেলেমেয়ে দুটিও এখন কলেজ শেষ করে ভার্সিটিতে চলে গেছে। অনেক বছর ধরে যে সঠিক সময়ের জন্য সে অপেক্ষা করেছিল, সেটি হয়তো এমন একটা সময়েরই অপেক্ষা ছিল। তাই সঠিক সময়কে খুঁজে পেয়ে তাকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে ঐন্দ্রিলা সম্পূর্ণভাবে মনোযোগ দেয় লেখালেখির দিকে। লিখে রাখা প্রথম প্রেমের গল্পটিকে অনেকবার ঝালাই বাছাই করার পর কোথাও পাঠানোর উপযুক্ত হয়েছে বলে মনে হয় তার নিজের কাছে। এতদিন যেসব অনলাইন গ্রূপ এবং সাহিত্য ম্যাগাজিনে লেখা পড়ত সে, সেখান থেকে বেছে একটি ত্রৈমাসিক পত্রিকায় সাহস করে পাঠিয়ে দিলো গল্পটিকে। গল্পের এটাচমেন্টের সাথে ইমেইলে জুড়ে দিলো নিজের পরিচিতিমূলক কয়েকটি লাইন। এরপর মোটামোটি এইরকম একটি ইমেইল বডির সাথে অসংখ্য সাহিত্য পাতায় নিজের লেখা পাঠাতে শুরু করে ঐন্দ্রিলা।
প্রিয় সম্পাদক,
আশা করি ভালো আছেন।
আমি ঐন্দ্রিলা সুবচনা। একসময় কবিতা লিখতাম। পরিচিত সবাই আমার কবিতার খুব প্রশংসা করেছে তখন। অনেকেই বলেছে, লিখলে আমি খুব ভালো করতে পারবো। কিন্তু লেখার ব্যাপারে আগ্রহ থাকলেও অনেক বছর লেখা হয়ে ওঠেনি। আসলে আমি লিখতে পারিনি সংসার ও পারিবারিক ব্যস্ততার কারণে। দীর্ঘ বিরতির পর ভাবছি, এখন থেকে নিয়মিত লিখবো।
আপনার সাহিত্য পত্রিকার জন্য একটি প্রেমের গল্প পাঠালাম। গল্পটি আমি অনেকদিন ধরে খুব যত্ন নিয়ে লিখেছি। লেখাটি যদি আপনার ভালো লাগে এবং ছাপা হয় তাহলে খুব খুশি হবো।
ধন্যবাদ জানবেন,
ঐন্দ্রিলা সুবচনা।

সম্পাদককে ইমেইল পাঠিয়ে অপেক্ষা করে থাকে ঐন্দ্রিলা। আবারো যেন অপেক্ষা করে থাকা সেই সঠিক সময় আর সঠিক সৌভাগ্যের আশায়। আর অপেক্ষার সময়গুলোতে সে লিখে ফেললো আরো কিছু অণুগল্প, ছোটগল্প। সোশ্যাল মিডিয়াকে মানুষ যতই খারাপ বলুক না কেন, ঐন্দ্রিলার কাছে মনে হয়, সোশ্যাল মিডিয়াই আসলে তাকে নিজের ভালোলাগার মন্ত্র লেখালেখির কাজটিকে সহজ করে দিয়েছে। ফেইসবুকে দু চারটি স্ট্যাটাসের কমেন্টে বন্ধুরা যা লেখে, সেগুলো পড়তে খুব ভালো লাগে তার। নতুন লেখা গল্পের অংশবিশেষ ফেসবুকে পোষ্ট করে বন্ধুদের মতামত জানতে চায় সে। অধিকাংশ বন্ধুরাই দারুণ, খুব ভালো, অসাধারণ লিখে মন্তব্য শেষ করে। দুই একটা সমালোচনা পাওয়া যায় কখনো সখনো। ঐন্দ্রিলা মনোযোগ দিয়ে সেগুলো পড়ে। সমালোচনার পয়েন্টগুলো সঠিক মনে করলে নিজের গল্পটিকে আবার ঠিক করে নেয়। এখন যেহেতু সে লেখার কাজ ল্যাপটপে করে, তাই লেখা এডিটিং করার কাজটি খুব সহজ। নিজে লেখা ছাড়াও অনলাইনে পছন্দ মতো অনেকগুলো সাহিত্য পাতা খুঁজে বের করেছে নিজের পছন্দ মতো। বন্ধুদের প্রোফাইল থেকে খুঁজে বের করে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে অসংখ্য লেখকের সাথে যুক্ত হয়েছে। তাতে করে সমসাময়িককালের লেখকদের লেখা সম্পর্কে তার ধারণা জ্ঞান বৃদ্ধি পেয়েছে।
অনলাইন সাহিত্য পাতাগুলো একদম ফ্রি। অনেক ভালো লেখকের লেখা পড়া যায় ওখানে। ঐন্দ্রিলা নিজের লেখাগুলো পাঠাতে শুরু করে তুলনামূলক ছোটখাটো, বেশি নাকউঁচু নয়, এমন অনলাইন পত্রিকাগুলোতে। তার চিন্তা ছিল, প্রথমে লেখায় নিজের হাত পরিষ্কার করতে হবে। বাগানে যেমন করে আগাছা, ময়লা, প্লাস্টিকের ব্যাগ, মরে যাওয়া শিকড় বেছে ফেলে মাটিকে তৈরী করতে হয়, ঠিক তেমনি করে ঐন্দ্রিলা অল্পঅল্প করে লেখার জন্য উপযুক্ত করে গড়ে তোলে নিজেকে। নিয়মিত নিড়ানি দেয় মগজে, মননে, চিন্তায়। আর একসময় সে অনলাইন লাইভ, সাংবাদিকের সম্মুখ সাক্ষাৎকার, রেডিও টেলিভিশনে টক-শো, লেখালেখির গল্প নিয়ে অনর্গল কথা বলায় পারদর্শী হয়ে উঠলো। এসব সাক্ষাৎকার আর আড্ডাগুলোতে অধিকাংশ প্রশ্নই খুব কমন, সবাই ঘুরেফিরে একই কথা জানতে চায়। ঐন্দ্রিলা সব প্রশ্নের উত্তরে প্রতিবার একই কথা বলে, তবে একটু আলাদা ঢঙে।
ঐন্দ্রিলাকে সাংবাদিক এবার একটা হাস্যকর প্রশ্ন করেছে। প্রশ্নটি হয়তো ইচ্ছাকৃত, লেখিকাকে উস্কে দেওয়ার জন্য, কিংবা তার আত্মনিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা পর্যবেক্ষণ করার উদ্দেশ্যেও হতে পারে। এই যেমন সাংবাদিকটি বললো, `আপনার লেখা অনেক সস্তা পত্রিকায় দেখা যায়। মানে বলতে চাইছি যেগুলোতে সাধারণত হাল আমলের জনপ্রিয় লেখকরা লেখা দেন না, সেখানেও আপনার লেখা দেখা যায়। কেন?`
প্রশ্নের উত্তর শোনার আগে ঐন্দ্রিলার হা হা হাসির শব্দ শোনা যায়। যদিও প্রশ্নটিতে হাসির কথা কী আছে, সাংবাদিক বুঝে পায় না। তবু, অপেক্ষা করে থাকে উত্তর শোনার জন্য। ঐন্দ্রিলা হাসতে হাসতে বলে, `আজকের এই পুরস্কারপ্রাপ্ত জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক ঐন্দ্রিলা সুবচনাকে যে তারাই তৈরী করেছে, ভাই। সেকথা ভুলে গেলে চলবে কেন?`
-বুঝলাম না। আরেকটু বুঝিয়ে বলবেন প্লিজ?
সাংবাদিকের প্রশ্ন ভেসে যায় ঐন্দ্রিলার কানের পাশ দিয়ে। শুরুর সেই দিনগুলোর কথা মনে করে পুলকিত হচ্ছে সে মনেমনে। অল্প আয়োজনের অনলাইন পেইজগুলো যখন ডিজিটাল ফুল-পাতা দেয়া কভারে অণুগল্প ছাপিয়ে তাকে ফেইসবুকে ট্যাগ করত, তখন নিজের প্রোফাইলে ট্যাগ করা সেই লেখার পোষ্টগুলো দেখার আনন্দ কি ভোলা যাবে কোনোদিন? প্রথম কয়েকবার তো সে সমস্ত রাত ঘুমাতেই পারেনি উত্তেজনায়। চোখের পাতায় আলো হয়ে ভাসছিল নিজের লেখার পাতাটি। যোগ্যতা এবং পরিশ্রম মানুষকে সাফল্য এনে দেয় সন্দেহ নেয়। সেইসাথে ঐন্দ্রিলা সহনশীল এবং বিনয়ী হওয়ায় লেখা পাঠানোর সূত্রে পরিচয় হওয়া সম্পাদকদের সাথে তার একটা সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে ধীরে ধীরে। মাস ছয়েক পর একটি জনপ্রিয় ত্রৈমাসিকে ঐন্দ্রিলার প্রেমের গল্পটি প্রকাশিত হবার আনন্দে অন্তত তিনদিন সে সুস্থির থাকতে পারেনি। অতিরিক্ত উত্তেজনা ঐন্দ্রিলাকে খানিকটা অসুস্থ করে দিয়েছিল যদিও, কিন্তু তখনকার সেই প্রাপ্তি তাকে লেখার জগতে লক্ষ্য স্থির করতে সাহায্য করেছিল, কোনো সন্দেহ নেই।
আবার, ঐন্দ্রিলার লেখক জীবনের শুরুর দিকে সবই যে একচেটিয়া অনুকূলের গল্প ছিল, এমন কথা বললে ভুল হবে। নানারকম অভিজ্ঞতা হয়েছে ততদিনে তার লেখালেখির জগৎ সম্পর্কে। বেশ কিছু তিক্ত এবং অনাকাঙ্খিত ঘটনার মধ্যেও পড়তে হয়েছিল তাকে। বর্তমানকালের জনপ্রিয় লেখকদের মোটামোটি সবাই লিখছেন এমন একটি রংচঙা অনলাইন পত্রিকার সন্ধান পেয়ে যায় সে একবার। ঐন্দ্রিলার খুব ইচ্ছে জেগেছিল মনে নিজের নামটি দেখবে প্রতিষ্ঠিত লেখকদের নামের পাশে। পত্রিকাটির ওয়েব পেইজ থেকে ইমেইল এড্ড্রেস নিয়ে নিজস্ব স্টাইলে তাদের কাছে কয়েকটি কবিতা পাঠালো সে ঐন্দ্রিলা সুবচনা নামে। ইমেইল পাঠানোর বেশ অনেকদিন পর পত্রিকার সম্পাদকের কাছ থেকে একটা রিপ্লাই আসে। রিপ্লাই ইমেইলটি দেখে তার খুশি আর ধরে না যেন। যদিও ঐন্দ্রিলার বারো লাইন ইমেইলের জবাবে সম্পাদক সাহেব একটিমাত্র লাইন লিখেছেন, `আপনার কবিতা ছাপা হবে।`
কবিতা ছাপা হবে এই সংবাদটি মন খুশি করার জন্য যথেষ্ট ছিল। ঐন্দ্রিলা খুশিতে আত্মহারা হয়। চল্লিশের মহিলা হয়েও পঁচিশের মেয়ের মতো বেখাপ্পা নাচে কিছুক্ষণ ঘরের ভেতরে। একা। খাঁচায় পোষা হলদে পাখিটির কাছে গিয়ে বারবার খুশির সংবাদটি শোনায়। উত্তরে পাখিটিও কয়েকবার কিচিরমিচির করে অভিনন্দন জানিয়েছে। পরদিন থেকে ঐন্দ্রিলার ইচ্ছে হয় সম্পাদককে জিজ্ঞেস করে, `কবে? কবিতাগুলো কবে ছাপা হবে?` খুব জানতে ইচ্ছে করলেও নিজেকে সংবরণ করে সে। সম্পাদক সাহেব নিশ্চয়ই ভীষণ ব্যস্ত মানুষ। ইমেইলের জবাব দিয়েছে একটি মাত্র লাইনে, এখন যদি আবার প্রশ্ন করে, কবে, তাহলে অবশ্যই খুব বিরক্ত হবেন ভদ্রলোক। সপ্তাহ তিনেক পর ঐন্দ্রিলার ইমেইলে প্রকাশিত কবিতার লিংক চলে আসে। সেই সাথে আসে সম্পাদকের কাছ থেকে ফেইসবুকের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট। ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করতেই আসে মেসেঞ্জারে কল। কিছুটা নার্ভাস আর অনেকটা আনন্দিত কণ্ঠে কল রিসিভ করে ঐন্দ্রিলা। হ্যালো, এবং প্রথম দুটি বাক্য শোনার পর ঐন্দ্রিলা একটু দমে গিয়েছিল, এত সুপরিচিত একটি পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক অথচ তিনি এভাবে কথা বলেন! এতগুলো শব্দের অশুদ্ধ উচ্চারণ! এত অশৈল্পিক শব্দের ব্যবহার! কবি ও লেখকদের প্রতি এতটা অসম্মান! যাক, তবু ঐন্দ্রিলা সম্পাদকের কাছে নিজেকে ঋণী মনে করে। তার মতো একজন নতুন লেখকের কবিতা ছাপিয়েছে, ধন্যবাদ তো তাকে দিতেই হয়।
-আপনাকে ধন্যবাদ ভাই, আমার কবিতাগুলো ছাপানোর জন্য।
-না ঠিক আছে। আপ্নে লিখতাছেন যে এইটাই বড় কথা।
-আমি আগে খুব লিখতাম। মাঝে অনেকদিন লেখা হয়নি। সাহস করে আবার লিখবো বলে ঠিক করেছি।
-হুম। আপ্নের কবিতা কিন্তু আমি ছাপাইতাম না। কবিতার মান ভালো না। কিন্তু আপ্নের ইমেইলটা দেইখ্যা খারাপ লাগল। আপ্নে যেইভাবে লেখছেন, অনেকদিন পর আবার লেখতে শুরু করছি, মনে হইল, থাক, বেচারি লেখতে চেষ্টা করতাছে, ছাপাই দেই হের কবিতাগুলান। তয় আপ্নের কবিতার সাথে ইমেইলডা না থাকলে এইসব কবিতা আমার পেইজে ছাপা অইত না।
ঐন্দ্রিলার কাছে লোকটির কথা বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। সে নিজেও একজন পাঠক, পাঠক হিসেবে নিজের লেখা বিচার করতে জানে বিলক্ষণ। কিন্তু সম্পাদকের সাথে তর্ক করলো না। খুব বুঝতে পারে নিজের লেখা নিয়ে তর্ক করার মতো অবস্থানে এখনো পৌঁছায়নি সে। তাছাড়া সাহিত্য পাতায় ঐন্দ্রিলার ছাপা হওয়া কবিতাগুলোর ফরমেট ঠিক নেই। এক কবিতার ফন্ট ছোট, আরেক কবিতার ফন্ট অনেক বড়। সেটি নিয়েও ঐন্দ্রিলা কোনো অভিযোগ করলো না।
-আচ্ছা। অস্ফুটে বলেছে শুধু।
-আপ্নে কয়ডা অণুগল্প পাঠান দেকি আমারে।
-জি। কয়টা পাঠাবো?
-পাঠান। চাইর পাঁচটা পাঠান।
-আচ্ছা। পাঠিয়ে দিবো।
-শোনেন, আপনি কিন্তু সাহিত্য পাতার ইমেইলে লেখা পাঠাইবেন না। আমাদের পাতার অন্যান্য সম্পাদকরা দেখলে আপনারা লেখা সরাসরি ডিলিট কইরা দিব। আপ্নেরে আমার ব্যক্তিগত ইমেইল এড্ড্রেস দিতাছি, ওইটাতে পাঠাইবেন গল্প।
-জি। নিশ্চয়ই। বিনা বাক্যব্যয়ে মোসাহেবের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় ঐন্দ্রিলা।
-এখন থিকা আপ্নের সব লেখা আমি সম্পাদনা কইরা দিমু। আপ্নের লেখা একদমই মান সম্পন্ন হয় না।
-জি তাহলে তো খুব ভালো হয়। আপনি কষ্ট করে সম্পাদনার দায়িত্ব নিবেন, আমার সৌভাগ্য।
ঐন্দ্রিলা কি সিরিয়াসলি কথা বলছে নাকি তাকে খোঁচা মারছে, ধরতে পারে না সম্পাদক সাহেব। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। ঐন্দ্রিলা বুঝতে পারে পরিস্থিতি বদলে যাচ্ছে। দ্রুত প্রসঙ্গ বদলায় সে।
-আপনিও কি লিখেন নাকি?
-কেন আপ্নে আমার লেখা পড়েন নাই? আমার লেখা তো নিয়মিত ছাপা হয় জাতীয় দৈনিকে।
-আসলে আমি দেশের বাইরে থাকি তো। অনেকদিন দৈনিক পত্রিকা পড়া হয় না। আপনি কি গল্প লিখেন? নাকি শুধুই কবিতা?
-আইচ্ছা, দেশের বাইরে থাকেন। এরলাইজ্ঞাই তো আপনার লেখা এমুন। আপনি আমার পাতার কবিতাগুলা সব পড়বেন। এইটা আপনার হোমওয়ার্ক এই সপ্তাহে।
-আমার কবিতার ত্রুটিগুলো কী? মানে কীভাবে আমি মানসম্মত কবিতা লিখতে পারবো?
-অনেক, অনেক ত্রুটি আপ্নের লেখায়। আপ্নে এখনো সাধু ভাষায় লিখেন। আইজকাল আর কেউ সাধু ভাষায় লিখে না। আপ্নের কবিতা পুরানা শব্দ দিয়া ভরা। এইগুলা শব্দ বদলাইতে অইবো। আমার হাতে সময় থাকলে আমি আপ্নের কবিতার শব্দগুলা বদলাইয়া দিতাম। কিন্তু আমি খুবই ব্যস্ত থাকি সবসময়। এত লেখকের লেখা পড়ার, ঠিক করার সময় নাই আমার হাতে।
ব্যস্ত সম্পাদক এরপর ঐন্দ্রিলাকে প্রতিদিন ফোন করত। একপাশে সম্পাদক একটানা নিজের কথা বলে যেত, ঐন্দ্রিলা কানের কাছ থেকে মোবাইল সরিয়ে রেখে হু হা করে যেত শুধু। কথা বলার সময় সম্পাদক ঐন্দ্রিলাকে মেসেঞ্জারে অসংখ্য ছবি পাঠাতে শুরু করে। বাংলাদেশ বেতার এবং টেলিভিশনে স্বরচিত কবিতা পাঠ করেছে সে বিভিন্ন সময়ে, তার জন্য সম্মানী পাওয়া রশিদের ছবি। দৈনিক পত্রিকায় লেখা ছাপা হওয়ার সম্মানী চেকের ছবি। পত্রিকায় প্রকাশিত কবিতার ছবি। একের পর এক হাবিজাবি সব ছবিতে ভর্তি হয়ে যেতে থাকে ঐন্দ্রিলার মেসেঞ্জার আর ইমেইলের ইনবক্স। বিরক্ত হলেও কিছু বলে না সে। সম্পাদকের উচ্ছসিত কথা চলতেই থাকে মোবাইলের অন্যপাশে। কয়েকদিন পর সম্পাদক সাহেব আশ্চর্যজনক একটি কথা বলে। চমকে উঠে ঐন্দ্রিলা।
-শোনেন আপা, আপ্নে ইচ্ছা করলে দেশের জাতীয় দৈনিকে লিখতে পারেন।
গলায় কথা আটকে বেহুস হবার দশা হয় ঐন্দ্রিলার। বলে কী লোকটা? গত কিছুদিন ধরে এই লোকটিই তো তার লেখা নিয়ে যাচ্ছেতাই আজেবাজে কথা বলে যাচ্ছে ওর কানের কাছে। এখন আবার জাতীয় দৈনিকে লিখতে বলছে। হাসি পেলেও হাসা উচিত হবে না, বোঝে। তাই গলায় দুঃখের ভাব ফুটিয়ে তুলেছে বরং।
-আমি তো লিখতেই চাই। কিন্তু জাতীয় দৈনিকে কাউকে আমি চিনি না যে!
-আমি হেল্প করব। আমার পরিচিত লোক আছে সব পত্রিকায়।
-সব দৈনিকে? দিনের আলো? ভোরের কালো? এইকাল সেইকাল? আহাআহাদিন? যে কোনোটায়?
-জি। সবখানেই ব্যবস্থা আছে।
ব্যবস্থা শব্দটা ভালো লাগে না ঐন্দ্রিলার কাছে। ব্যবস্থার ভেতর মনে হচ্ছে অব্যবস্থাপনার ইঙ্গিত আছে। তবুও নিষ্পাপ অপাপবিদ্ধ কণ্ঠে ঐন্দ্রিলা কথা চালিয়ে যায় সাহিত্য সম্পাদকের সাথে।
-তাহলে তো খুব ভালো হয় মোতালেব ভাই। আমাকে আপনার ব্যক্তিগত ইমেইল এড্ড্রেস দিবেন। সেখানেই আমি গল্পগুলো পাঠাবো না হয়।
-আপা, আপ্নে কয়টা দৈনিকে লেখলেই দেখবেন আপ্নের নাম কেমনে সবাইর কাছে পৌঁছাইয়া যায়। হেরপর আপ্নে বড় লেখক হইয়া যাইবেন রাতারাতি। জাতীয় দৈনিকে লেখা ছাপা না হইলে আসলে লেখক হওন যায় না কোনোদিন।
-কিন্তু আমি তো একেবারেই নতুন লিখছি। আমার লেখা কি তারা পছন্দ করবে?
-আপ্নে চিন্তা কইরেন না। পছন্দ করানোর ব্যবস্থা আছে আপা।
আবারো, “ব্যবস্থা” শব্দটি কানে লাগে খটাং করে। ঘরের কাজের অজুহাত দেখিয়ে ঐন্দ্রিলা ফোন রেখে দিয়েছিল। কিন্তু পরদিন আবার সম্পাদকের সেই একই কথা। তারপরের দিনও। সম্পাদককে কেমন বেপোরোয়া মনে হতে থাকে ঐন্দ্রিলাকে জাতীয় দৈনিকে লেখা ছাপানোর ব্যবস্থার মধ্যে প্রবেশ করাতে। ঐন্দ্রিলা এবার যথেষ্ট বিরক্ত হয়। টাকা দিয়ে লেখা ছাপানোর মতো মরিয়া হয়ে উঠেনি সে। এরপর কয়েকদিন সম্পাদক সাহেবের কল ইচ্ছাকৃতভাবেই মেসেঞ্জারে উপেক্ষা করার ফলে সাহিত্য সম্পাদক মোতালেব বন্ধ করেছে ঐন্দ্রিলার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা।
রাস্তায় একটা বড় গাড়ি গেল শব্দ করে। সাধারণত ঐন্দ্রিলাদের এলাকায় প্রাইভেট কার ছাড়া মালবাহী বড় গাড়ি দেখা যায় না। আজ বুধবার হওয়ায়, বাড়ির ময়লা কালেক্ট করার গাড়ি এসেছে। ঐন্দ্রিলা উঠে গিয়ে জানালার কাচ নামিয়ে দিলো। স্ক্রিনে সাংবাদিকের দিকে তাকিয়ে সৌজন্যমূলক হাসি উপহার দিলো সে। জুমে সাক্ষাৎকার নিতে বসা সাংবাদিকের পরের প্রশ্নটি শোনা যায় এবার। সাংবাদিককে একটু অসন্তুষ্ট মনে হচ্ছে। বারবার নিজের চিন্তায় মগ্ন হয়ে যাওয়া ঐন্দ্রিলা অবশ্য লক্ষ করে না সাংবাদিকের মনোভাব। সাংবাদিক বলে, `লেখকের দায়বদ্ধতার ব্যাপারটিকে আপনি কীভাবে দেখেন?`
অনেকবার এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে সে। উত্তরটি মস্তিষ্কে গোছানোই আছে। তবু প্রতিবারের মতো এবারেও ঐন্দ্রিলা কথা বলতে গিয়ে উত্তেজিত হয়। নিজের ভেতরে আলোড়ন ওঠে লেখকের দায়বদ্ধতার প্রশ্নে। ঐন্দ্রিলা বলে, `সক্ষম এবং যোগ্য লেখকের জন্য এই দায়বদ্ধতার বিষয়টি অবশ্য প্রযোজ্য। সামাজিক প্রাণী হিসেবে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা রয়েছে প্রতিটি মানুষের। লেখক লেখেন নিজের কথা, তার চারপাশে দেখা কিংবা শোনা মানুষের জীবনের কথা, মনের কল্পনার কথা। এই লেখার ভেতরেও লেখক কিছু সমাধান দেবার চেষ্টা করেন। প্রচলিত নিয়মের অসঙ্গতিগুলোকে পাঠকের সামনে তুলে ধরতে চেষ্টা করেন গল্প, উপন্যাস, কলামের মাধ্যমে। আমি মনে করি একজন লেখকের সামাজিক দায়বদ্ধতা রয়েছে। এবং প্রতিটি লেখকই সেই দায় মাথায় রেখে কিছু হলেও লিখে থাকেন।`
দায়বদ্ধতা- শব্দটি ঐন্দ্রিলাকে আলোড়িত করে। পিতা-মাতার কাছে নাবালক সন্তানের দায় দায়িত্ব গচ্ছিত থাকে, সাবালক সন্তানের কাছে বৃদ্ধ বাবা-মায়ের দেখ-ভালের দায় থাকে, রাষ্ট্র-প্রধানের কাছে অর্পিত থাকে দেশের জনগণের জীবন ও সম্মানের নিরাপত্তার দায়, ধর্ম-গুরুর কাছে ওহী নাজিল হয়ে আসে মৃত্যুর পর ওপারে সুখের ঠিকানা দেখিয়ে দেয়ার দায়, বড় রাস্তার উপর অশ্বথ আর বটের পাতাদের দায় আছে ক্লান্ত পথিককে ছায়া দিয়ে শীতল করার। দায়মুক্ত জীবন বলে কিছু নেই এই পৃথিবীতে। লেখকদেরও একপ্রকার দায় থাকে পাঠক শ্রেণীর কাছে।
ঐন্দ্রিলা নিয়মিত লিখতে শুরু করেছে যখন, তখন সে যুক্ত হয়েছিল একটি অনলাইন গ্রূপের সাথে। “মুক্ত মনে সাহিত্য রচনা করি” নামের বেশ জনপ্রিয় এই অনলাইন গ্রূপটির পাঠক এবং ফলোয়ার কয়েক লক্ষ। গার্হস্থ বিষয়ে লেখা ছাড়া অন্য আর কোনো বিষয়ের লেখা এখানে বিশেষ জনপ্রিয়তা পায় না। ঐন্দ্রিলা এবং তার পরিচিত কয়েকজন লেখক একই সাথে লিখেছে অনেকদিন গ্রূপটিতে। পাঠকের চাহিদা অনুযায়ী অনেক লেখক পরবর্তীতে গার্হস্থ প্রাপ্তবয়স্ক লেখক লেখিকায় পরিণত হয়েছে। সে তাদের ব্যক্তিগত ইচ্ছে। ঐন্দ্রিলা মাথা ঘামায়নি। আসলে পাঠকপ্রিয়তার মোহ ভীষণ মারাত্মক হয়। সেও এক ভয়ংকর নেশা। পাঠকের মন জুগিয়ে লিখতে গিয়ে নিজের চিন্তার চেয়ে পাঠক কী পড়তে চায়, সেটি লিখতেই চেষ্টা করে পাঠকপ্রিয় তকমা পাওয়া এইসব লেখকেরা।
অন্যান্য নেশার চেয়ে লেখালেখিতে জনপ্রিয় হবার নেশাও কম মারাত্মক নয়। মারাত্মক এই নেশার কারণে আরেকটু হলে ঐন্দ্রিলা ফেঁসে যাচ্ছিল অন্য আরেকটা অনলাইন সাহিত্য গ্রূপে। “কদম-রেনু” নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা ঐন্দ্রিলাকে পেয়ে বসেছিল যখন, তখনকার কথা এটি। তখন ঐন্দ্রিলা লেখালেখিতে পরিপক্ক হয়ে উঠতে শুরু করেছে কেবল। বছর দুয়েক ধরে নিয়মিত লিখছে। আর ততদিনে অনলাইন এবং অফলাইনের অনেকেই ঐন্দ্রিলা সুবচনার নামটি দেখেছে, লেখা পড়েছে। কদম-রেনুর সাহিত্য পাতার সে নিয়মিত ও দারুণ জনপ্রিয় লেখিকা। কদম-রেনুর বিশেষ সংখ্যার জন্য সম্পাদক নিজে একদিন টেলিফোনে কথা বলেন ঐন্দ্রিলার সাথে। ইনিয়ে বিনিয়ে যা বললেন তার সারমর্ম হলো, `পাঠকের চাহিদা মতো লেখার যোগান দিতে হবে, আর তাহলে অনলাইন পত্রিকার সাবস্ক্রাইবার বাড়বে। কিছুটা নিষিদ্ধ, কিন্তু মানুষের যৌন অনুভূতিতে সুড়সুড়ি দেয়, লেখায় এমন কিছু শব্দ থাকলে পাঠক ওসব লেখা খুব খায়।`
সম্পাদকের কথা না বোঝার কিছু নেই। তিনি হিব্রু কিংবা জাপানিজ ভাষায় কথা বলেন না। আর ঐন্দ্রিলা একজন মধ্যয়সী মহিলা। সে সবই বুঝতে পারে। সম্পাদক চাইছেন ঐন্দ্রিলা কিছু চটুল লেখা লিখে তার অনলাইন পত্রিকাটির সাবস্ক্রাইবার বাড়াক। পরপর কয়েকটি সংখ্যায় তারা ঐন্দ্রিলার সাদামাটা লেখার সঙ্গে নগ্নবক্ষা নারীর ছবি কিংবা নারী পুরুষের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের স্কেচ দিয়ে ছাপাতে লাগল। প্রথমদিকে কিছু মনে না করলেও, একসময় ঐন্দ্রিলা আঁতকে উঠেছে। সাহিত্য মানে কি এইসব? সাহিত্য এবং অশ্লীলতা দুটো কি কখনো এক হতে পারে? অশ্লীল সাহিত্য রচনা করে যেসব লেখক তারা মূলত কার কাছে দায়বদ্ধ? মানসিকভাবে বিকৃত কিছু বৈকল্য চাহিদাসম্পন্ন পাঠকের কাছে?
সেবার অনলাইন গ্রূপ কদম-রেনু থেকে বের হয়ে গিয়ে আরেকটু হলে নিজের নামের সাথে জুড়তে যাওয়া পর্ণ-লেখক বদনাম থেকে রক্ষা পেয়েছিল ঐন্দ্রিলা। মনে হলে এখনো তার গা রি-রি করে ওঠে। তবে সবই অভিজ্ঞতা। ঐন্দ্রিলা কোনো অভিজ্ঞতাকেই অদরকারি মনে করে না। নিজেকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য লেখকের জানা দরকার লেখার জগতের এইসব অন্ধকার কানাগলির অস্তিত্বের কথা। তাই লেখক-জীবন শুরুর এমন সব অম্ল মধুর ঘটনায় নিজের অভিজ্ঞতার ঝুলি সমৃদ্ধ করেছে সে অম্লান চিত্তে, সতর্ক থেকেছে পরবর্তী দাবদাহের অনিষ্ট থেকে নিজেকে বাঁচাতে।
গলার স্কার্ফটাকে খুলে টেবিলের একপাশে রাখতে গিয়ে ঘড়ির দিকে চোখ পড়ে ঐন্দ্রিলার। এক ঘন্টা ত্রিশ মিনিট ধরে কথা বলে যাচ্ছে সে। মাঝে এক মগ চা আর কয়েকটা ক্রিসপ খেয়েছে। বাইরে বিকেলের আকাশে রং এখনো তেমনই আছে। একটু পর ঝুপ করে রাত নেমে আসবে, শীতকালে এখানে প্রকৃতিতে সন্ধ্যার আগমন টের পাওয়া যায় না বলা চলে। ঐন্দ্রিলার সঙ্গে সাংবাদিকের সাক্ষাৎকারের জন্য নির্ধারিত সময় শেষ হয়ে এসেছে প্রায়। আর পনেরো মিনিট বাকি আছে। বিনয়ের সঙ্গে শেষ প্রশ্নটি করলো সাংবাদিক, `নতুন লেখকদের জন্য আপনার অভিজ্ঞতা থেকে কিছু পরামর্শ দিন।`
ঠান্ডা হয়ে যাওয়া চায়ের মগে ঠোঁট ছোঁয়ায় ঐন্দ্রিলা। যদিও ঠান্ডা চা তার পছন্দ নয়, তবুও একটুখানি কণ্ঠ ভেজানোর জন্য কিছুটা তরল গলায় ঢাললো সে। তারপর নিজের ভাবনা মতো উত্তর দেয়। বলে, `নতুন লেখক এই শব্দটি নির্ভর করে ব্যক্তির উপর। কেউ কেউ সারাজীবনই লিখে যান খুব অগোছালোভাবে। সারাজীবনই তারা লেখার জগতে নতুনের মতো রয়ে যান। আবার কেউ শুরু থেকেই লিখেন পরিপক্কতার সাথে, লেখার তাল, ছন্দ, ভাষা ঠিক মতো রপ্ত করে নিতে জানেন। যখন কেউ নতুন লিখতে আরম্ভ করে, তার উচিত হবে নিজের লেখা এবং পাঠে তার নিজস্ব আগ্রহের জায়গাটিকে ভালোভাবে বুঝে নেওয়া। পাঠকের পছন্দে লেখার চেষ্টা না করে নিজের লেখার মান বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দেওয়া। লেখা ভালো হলে তা ভালো পাঠককে আকৃষ্ট করবেই, একদিন না একদিন।`
শেষ প্রশ্নের উত্তরটি সংক্ষেপে সেরে ঐন্দ্রিলা জুমের লাইনটি ডিসকানেক্ট করে দিলো। একটানা অনেকক্ষণ কথা বলে মাথা ধরে গিয়েছে। এমনিতে সে নিজের সাথে নিজে কথোপকথন করে সমস্ত দিন, সমস্ত রাত্রি। ব্যক্তি ঐন্দ্রিলা এবং ঐন্দ্রিলার ছায়ামন, তারা কথা বলে বর্তমান নিয়ে, চিন্তা করে ভবিষ্যৎ নিয়ে, বৈদ্যুতিক তারণার মতো স্পৃষ্ট হয় স্মৃতিরোমন্থনের অকস্মাৎ দুর্ঘটনায়। অনেক বছর আগে, ভার্সিটিতে পড়ার সময়, নবাগতা প্রেমিকার জন্য ছেড়ে চলে যাওয়া সোহাগের সাথে আবার যোগাযোগ হয়েছে ঐন্দ্রিলার। বন্ধুদের কাছ থেকে ফোন নাম্বার জোগাড় করে ফোন করেছিল একদিন সোহাগ, অপরাধীর মতো নিজের কৃতকর্মের জন্য সাফাই গেয়েছে এটাসেটা অনেক কথা বলে। ঐন্দ্রিলা হেসে উড়িয়ে দিয়েছে সেসব দিনের কথা। বলেছে সোহাগের উপর তার কোনো অভিযোগ নেই। এখন তারা পুরোনো বন্ধুর মতো অল্পবিস্তর কথাবার্তা বলতেই পারে মাঝেমধ্যে। এবং, সেই থেকে তাদের দুজনের কথা হয় বেশ নিয়মিত, সহজভাবে। ঐন্দ্রিলার আর মন কেমন করে না সোহাগের জন্য। বরং সে কিছুটা বিরক্তই হয়। প্রাণখোলা উচ্ছল প্রেমিক ছেলেটা এখন কেমন গোমড়ামুখো বুড়োমানুষ হয়ে গিয়েছে। স্ত্রী পরিত্যক্ত সোহাগ এখন জীবনের ব্যর্থতার গল্প শোনাতে আর একটুখানি নিজেকে খুলে ঢেলে ভারমুক্ত হতে কিছুটা সময় ভিক্ষা চায় অতিব্যস্ত ঐন্দ্রিলার কাছে। আর ঐন্দ্রিলা, প্রাক্তন প্রেমিককে মূল্যবান উপহার নয়, কিছুটা সময় দান করে মাঝেমধ্যে। অনাগ্রহ মিশ্রিত আগ্রহ নিয়ে শোনে সোহাগের একটানা বকবক করে যাওয়া না-পাওয়ার কিচ্ছা- হিসাব- দাগ- ব্যর্থতার খতিয়ান। একদিন যে যুবক যৌবনকে শুধুই উপভোগের জন্য উৎসর্গ করতে চেয়েছিল, সে যুবকের জীবন এখন একতাল বিদ্রুপ ও পরিতাপ ছাড়া আর কিছুই নয়, সেই পূর্বকালীন প্রেমিক আর বর্তমান স্তুতিকারীকে ঐন্দ্রিলা উৎসর্গ করেছে তার লেখা সর্বশেষ উপন্যাসটি। উৎসর্গপত্রে লিখেছে দুটি লাইন-
যে নিয়েছে অংশ আধেকটা মোর একাকিত্বের-
যে দিয়েছে ভাগ আধেকটা তার দুঃখদিনের-

একাকিত্ব- একের পর এক সৃষ্টি করে যাওয়া জনপ্রিয় সাহিত্যের স্রষ্টা ঐন্দ্রিলা সুবচনা আর একাকিত্ব, এই দুটি শব্দকে পাশাপাশি বসাতে কষ্ট হবে পরিচিত সকলেরই। কিন্তু মানুষ মাত্রই একা। নিজের ভেতরে একটা শূন্য বলয়কে ঘিরে মানুষ হাসে, কাঁদে, নিশ্চুপ মধ্যরাতে শব্দ করে ঝরতে থাকা তুষারপাতের সময় বুকে বালিজ গুঁজে কান্নার শব্দকে ঢাকে। ধবধবে সাদা তুষারে ছেয়ে ফেলা শুভ্র আগুনে যখন দাউদাউ করে জ্বলতে থাকে আকাশ, মাটি, গাছের বাদামি শুকনো ডাল, লোহার গাড়ি শরীর হিমে ঢেকে দিয়ে যখন কালো পিচের পিশাচ রাস্তার বুক তলিয়ে যায় কয়েক ফুট বরফের নিচে, তখনো মানুষ একা। কফিন আর কবরের তলায় চুপচাপ বসে থাকে প্রতিটি একলা মানুষ। সেই একাকিত্বের কথা ঐন্দ্রিলা কখনো বলে না সোহাগকে। এককালে ভালোবাসা থাকলেও এখন আর তার কাছে চাইবার কিছু নেই। প্রাণভরে প্রতারণা দিয়েছে প্রেমিক, যতখানি সাধ্য ছিল তার। দুঃসহ এই একাকিত্ব সমৃদ্ধ করেছে ঐন্দ্রিলাকে। সে মনে করে, বুকের ভেতরে কষ্ট আছে বলেই তো এখন সে লিখতে পারছে। শেষপর্যন্ত যদি সোহাগের সাথে তার জীবনটা সত্যাসত্য বিনিময় হয়েই যেত, তাহলে কি আর এমন করে দুঃখের গাঢ় গভীরতায় ডুব দিতে পারতো সে, কোনোদিন? বলতে কি পারতো, যত কথা বলে যাচ্ছে এমন অনর্গল, সেই বিরহকাল শুরু থেকে আজ এই অবধি! ঐন্দ্রিলা সুবচনার কলমের কালিতে ফুটে উঠতো কি কোনোদিন এমন নিদারুণ অসম্পূর্ণতার ব্যথামাখা কিছু কাব্য;
অপূর্ণ অন্তরে জেনো সাধ মিটে নাই ভালোবাসিবার-
অনাহূতের আমন্ত্রণ ফিরিয়ে দিয়েছে প্রেমের আহ্বান!
বারেবারে আমি শুধু, প্রেমিক হতে চেয়েছি তাই…

Facebook Comments

comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top