লেনিন ।। পর্ব-৬।।আশানুর রহমান

নাইট্রিক এসিড

বিষ্যুদবার। সকাল  প্রায় আটটা। মারিয়া আলেকজান্দ্রাভা বসার ঘরে চুপচাপ বসে আছেন। তিনি এক দৃষ্টিতে দেয়াল বরাবর কালো সোফাটা দেখছেন। দু’দিন আগে এই সোফাটার উপরেই ইলিয়া দেহ রেখেছিলেন। সোফাটা আজ ফাঁকা। দু’দিন আগেও যে মানুষটার অস্তিত্ব ছিল সবটা জুড়ে, পরিবারটি ছিল যাঁকে ঘিরে, সেই মানুষটার অনুপস্থিতিতে সব কিছু কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। মানুষটার স্বপ্ন ছিল সন্তানদের ভালভাবে মানুষ করবে। তাঁর অনুপস্থিতিতে মারিয়া কী পারবে সে দায়িত্ব পালন করতে? বড় ছেলে-মেয়ে দু’টো রাজধানীতে থেকে পড়াশুনা করে। তাদের পড়ার অনেক খরচ। বছর খানেক পরে ভলোদিয়া এবং ওলগার স্কুল শেষ হবে। ওলগা ডাক্তার হতে চায়। রাশিয়ায় মেয়েদের মেডিকেল পড়ার সুযোগ নেই। ওলগা ইউরোপে পড়তে চেয়েছিল, ইলিয়ারও স্বপ্ন ছিল সেটাই। সে সব কী মারিয়া পূরণ করতে পারবে? মারিয়া এখনও জানে না ইলিয়ার পেনশন থেকে কত পাওয়া যাবে। ব্যাংকে অল্প কিছু টাকা আছে। সেটাও খোঁজ নিতে হবে। ককুশকিনোতে বাবার রেখে যাওয়া স্টেট থেকে বছরে কী পরিমাণ পাওয়া যাবে সেটাও এখন খোঁজ নিতে হবে। কিভাবে যে কী হবে এসব ভাবতে ভাবতে মারিয়া কিছুক্ষণের জন্য উদাস হয়ে পড়েন। সম্বিৎ ফিরে আবার সোফাটার দিকে চোখ ফেরাতেই মারিয়া দেখেন সাশার বিড়ালটা কখন যেন চুপচাপ এসে সেই কালো সোফাটার উপরে বসেছে। টের না পাওয়ায় মারিয়া একটু আশ্চর্য বোধ করেন। বসার ঘরের ঘড়িটার দিকে চেয়ে দেখেন সাড়ে আটটা। উপরে ছেলে-মেয়েদের জেগে ওঠার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। গতকাল সবাই দেরী করে ঘুমাতে গিয়েছিল। একটু পরে আন্নাকে নামতে দেখে  মারিয়া জানতে চাইলেন,
-ভলোদিয়া উঠেছে?
আন্না মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলতেই মারিয়া কিছুটা জোরে ভলোদিয়া ভলোদিয়া বলে ডাক দিলেন। কয়েকবার ডাকার পরও ভলোদিয়ার কোন সাড়া পাওয়া গেল না। কিছুক্ষণ পর ভলোদিয়া নিজেই নীচে নেমে আসে। মারিয়া ও আন্না দু’জনেই ভলোদিয়ার এমন আচরণে একটু অবাক হয়।  গত দু’দিনেই যেন ভলোদিয়ার মধ্যে একটা পরিবর্তন ঘটে গেছে। মারিয়া সেটা খেয়াল না করলেও আন্না বিষয়টা লক্ষ্য করে। ভলোদিয়া নীচে নামলে মারিয়া তাকে একটা কাগজ ও কলম আনতে বললেন। ভলোদিয়া কোন কথা না বলে সেগুলো নিয়ে ফিরে এলে মারিয়া ভলোদিয়াকে বলেন,
-তোমার বাবার পেনশনের টাকা চেয়ে মিনিস্ট্রি অব এনটাইটেলমেন্টকে আমি একটি চিঠি লিখবো। আমি বলে যাচ্ছি তুমি খসড়াটা লিখে ফেলো।  ভলোদিয়া মায়ের বলে যাওয়া কথাগুলো গোটা গোটা অক্ষরে খসড়া আকারে লিখে ফেলে। খসড়া লেখাটা মারিয়া দু’বার পড়লেন। দু/একটি জায়গায় নিজেই সংশোধন করে সেটা চূড়ান্ত করলেন। তারপর চিঠিটি ভলোদিয়ার হাতে দিয়ে বলেন,
-‘আজকের ডাকেই চিঠিটি পাঠিয়ে দাও’।
ভলোদিয়া চিঠিটা নিয়ে নিজের ঘরে যাবার জন্য উঠে দাঁড়ালে মারিয়া বলে উঠলেন,
-তুমি যেয়ো না। ওলগাকে ডাকো তো।
ভলোদিয়া ওলাগাকে ডাকতে চেয়ার ছেড়ে উঠতে যাবার আগেই ওলগা বসার ঘরে ঢোকে। ইলিয়া যে কালো সোফাটার উপর মারা গিয়েছিলেন ওলগা গিয়ে সেই সোফাটার উপর বসার আগে সোফাটার উপর শুয়ে থাকা সাশার বেড়ালটাকে নিজের কোলে তুলে নেয়। আন্না বসেছিল মায়ের পাশেই। এতক্ষণ মারিয়া, আন্না বা ভলোদিয়া যে বিষয়টি হয়তো বা ভুলে ছিল বা ভুলে থাকার চেষ্টা করছিল কালো সোফাটার উপর ওলগা এসে বসায় সবাই যেন সেই বিষয়ে আবার সচেতন হয়ে ওঠে। সবাই একসাথে ওলগার দিকে তাকায়। ওলগা প্রথমে কিছু বুঝতে পারে না। সবাইকে তার দিকে এভাবে তাকাতে দেখে সে একটু বিব্রতবোধ করে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে সেও যেন হঠাৎ সচেতন হয়ে ওঠে। সচেতন হওয়া মাত্রই সে সোফা থেকে নেমে আস্তে করে নীচের কার্পেটের উপর গিয়ে বসে। কালো বিড়ালটি তখনও তার কোলে চুপ করে বসে আছে। ছোট্ট এই ঘটনায় পরিবেশটা হঠাৎ করেই যেন গম্ভীর হয়ে ওঠে। গত দু’দিন ধরে পরিবারে সবাই যে শোকাবহ পরিবেশের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল সেটাই যেন হঠাৎ করেই আরেকটু ঘনীভূত হয়ে, আরো তীব্র হয়ে ফিরে আসে। পরিবেশটা বড্ড গম্ভীর হয়ে উঠেছে বুঝতে পেরেই যেন মারিয়া দ্রুত বলে ওঠেন,
-তোমাদের তিনজনকে একত্রে ডেকেছি একটি বিশেষ কারণে। বিষয়টি তোমাদের জানানো দরকার মনে করছি।
মারিয়ার কথা বলার ধরণে এবং এমন ভূমিকা করে কথা শুরু করাতে সবাই যেন একটু নড়েচড়ে বসে মারিয়ার মুখের দিকে তাকায়। মারিয়ার কানের কাছে একটা সাদা চুল দেখতে পেয়ে আন্নার মনে হলো গত দু’দিনেই মায়ের মাথার চুল পাকতে শুরু করেছে। ছেলে-মেয়েদের গম্ভীর মুখগুলো ভাল করে একবার দেখে নিয়ে মারিয়া বলেন,
-তোমাদের বাবা বড় অসময়ে আমাদের ছেড়ে গেলেন। আন্না এবং সাশা এখন বাড়িতে থাকে না। আমাদের এই মুহূর্তে এত বড় বাড়ীর দরকার নেই। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমাদের বাড়িটার অর্ধেকটা ভাড়া দেবো। তোমরা বড় হয়েছো। তোমাদের আগেভাগে বিষয়টি জানালাম। আন্না, তুমি আজকেই বাড়ির সামনে একটি নোটিশ টাঙিয়ে দেবে।

মারিয়া এমন কথায় বসার ঘরে যেন পিনপতন নীরবতা নেমে আসে। মারিয়ার কথা শেষ হবার সাথে সাথে ওলগা বড় বড় চোখ করে মাকে দেখতে থাকে। তার যেন বিশ্বাস হচ্ছে না এই মাত্র মা যা বললেন, সত্যিই তিনি সেটা করবেন। ভলোদিয়ার মুখটা মুহূর্তেই যেন শক্ত হয়ে গেল। তার চিবুকটা হয়ে ওঠলো লাল। যেমনটা সাধারণত রেগে গেলে তার হয়ে থাকে। আন্না শুধু মায়ের মুখের দিকে চেয়ে থাকে। মায়ের দিকে চেয়ে গভীর মনোযোগে সে যেন মায়ের এমন সিদ্ধান্তের মধ্যে যে নিদারুণ বেদনাটুকু লুকিয়ে আছে সেটাই দেখতে পেলো। ভলোদিয়ার মনে হলো বাবার মৃত্যুই সবকিছু এমন এলোমেলো করে দিল! তার ভীষণ রাগ হতে লাগলো এবং ভিতরে ভিতরে সে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলো। কিন্তু এই রাগ বা ক্রুদ্ধতা কেন? কার উপরই বা এই ক্ষুব্ধতা? সেটাও তার কাছে অস্পষ্ট। মায়ের কথাটা শোনার পর ছেলেমেয়েদের মধ্যে বাবার মৃত্যুশোকটা যেন নতুন করে ফিরে এলো। আরো গভীরভাবে এবং সম্পূর্ণ ভিন্নরূপে।

কয়েকদিন বাদেই মিনিস্ট্রি অব এনটাইটেলমেন্ট থেকে মারিয়ার চিঠির জবাব আসে। চিঠিতে জানানো হয়েছে ইলিয়ার পেনশন বাবদ মারিয়া মাসিক ১০০ রুবল পাবেন। এছাড়া নাবালক ৪ সন্তানের জন্য (আঠার বছর বয়স পর্যন্ত) ২৫ রুবল হারে আরো ১০০ রুবল করে পাবেন। এর দু’দিন আগে ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই উঠবেন জানিয়ে এক ডাক্তার ভদ্রলোক তাদের বাড়ির পিছনের অংশটুকু ভাড়া নিলেন। পরিবারের এই দু:সময়ে মারিয়া শক্তহাতে হাল ধরতে চাইলেও সমস্যা দেখা দিল অন্যদিক থেকে। যে ডাক্তার ভদ্রলোক বাসা ভাড়া নিয়েছেন তিনি আজ সন্ধায় এসেছিলেন অগ্রিম টাকা দিতে। অন্য সবাই ঘুমিয়ে গেলে আন্না গেলো মায়ের ঘরে। মায়ের ঘরে ঢুকতেই তার চোখ গেলো দেয়ালে টাঙানো বাবার ছবিটার দিকে। মাথার সামনের অংশ চুলবিহীন, মুখ ভর্তি দাঁড়িসহ বাবার এই ছবিটার দিকে তাকাতেই আন্নার চোখ আটকে গেলো বাবার চোখ দু’টোর দিকে। সেই মুহূর্তে আন্নার মনে হলো এমন সুন্দর চোখ সে আগে কখনো খেয়াল করেনি কেন? আন্নার আরো মনে হয় গভীর ও বুদ্ধিদীপ্ত অসম্ভব সুন্দর চোখ দিয়ে বাবা যেন তার মনের ভিতরটাও দেখতে পাচ্ছেন। আন্না সব কিছু ভুলে বাবার ছবিটার দিকেই চেয়ে থাকে।  মারিয়া তখন আলমারিতে কাপড় ভাঁজ করে রাখছিলেন। আন্নার পায়ের শব্দ পেয়ে তাকাতেই তিনি দেখেন আন্না ইলিয়ার ছবিটার দিকে এক দৃষ্টে চেয়ে আছে। তিনি নিজেও ইলিয়ার ছবিটার দিকে চেয়ে একটি দীর্ঘশ্বাস গোপন করলেন। তারপর বলে ওঠেন,
-এসো, খাটে বসো। তুমি এত রাতে এলে? কিছু বলবে?
মায়ের প্রশ্নের ধরনে আন্না যেটা বলার জন্য এতটা সাহস করে মায়ের ঘরে এসেছিল সেটা আর বলতে পারে না। মারিয়া আবার জানতে চান,
-কিছু বলবে?
আন্না কাঁশি দিয়ে নিজের গলাটা একটু পরিস্কার করার চেষ্টা করে। অথবা এমনও হতে পারে কাঁশিটা দিয়ে সে নিজেকে কিছুটা প্রস্তুত করে নেয়। মায়ের দিকে না তাকিয়ে নিজের পায়ের আঙুলের দিকে চেয়ে আন্না  বলে,
-মা, আমি আর পড়াশুনা করবো না।
আন্নার এ কথায় মারিয়া খুব অবাক হলো। মারিয়া ভেবে পেলেন না এমন চিন্তা আন্নার মাথায় কীভাবে এলো। হাতের কাপড়টা রেখে তিনি বিছানায় এসে আন্নার পাশে বসেন। আন্নার মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি যেন কিছু বোঝার চেষ্টা করলেন। আন্নার মনে হলো মা যেন তার মনের কথাগুলো পড়তে পারছেন। সে ভিতরে ভিতরে একটু কেঁপে ওঠে। মারিয়া আন্নার চোখের দিকে তাকিয়েই তাঁর ডান হাতটি আন্নার বাম হাতের উপর রেখে বললেন,
-কী হয়েছে, আন্না?
মায়ের এমন চাহনি, আর গলায় এমন আবেগ দেখে আন্না একটু থতমত খেয়ে যায়। সে তখন বলে ওঠে,
-মা, পড়ার অনেক খরচ। আমি আর সেন্ট পিটার্সবার্গ যাবো না। তাছাড়া আমি এখানে থাকলে তোমাকে একটু সাহায্য করতে পারবো।
আন্নার একথায় মারিয়ার চোখ-মুখ একটু শক্ত হয়ে যায়। তিনি ষ্পষ্টত:ই একটু রেগে গেলেন। আন্নার মনে হলো রাগলে ভলোদিয়ার চোখ-মুখও অবিকল এমনই শক্ত হয়ে যায়। মারিয়া বেশ কর্তৃত্বের সাথে আন্নাকে বললেন,
-টাকা-পয়াসা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। পেনশন পাওয়া যাবে, বাড়ির অর্ধেকটা ভাড়া দেয়া হয়েছে। এছাড়া তোমার বাবার একাউন্টে চার হাজার রুবল আছে। ককুশকিনোর স্টেট থেকেও একটা টাকা পাওয়া যাবে। ফলে এসব নিয়ে তোমাদের মাথা না ঘামালেও চলবে। তোমার এক বছর আছে, মন দিয়ে পড়াশুনাটা শেষ করো।
আন্না তবু নাছোড়বান্দা। সে বলে,
-মা, আমি বাড়ি থেকেও পরীক্ষাটা দিতে পারবো। তাছাড়া আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের বললে তারা বইপত্র পাঠিয়ে দেবে।
আন্নার এ কথায় মারিয়া এবার সত্যিসত্যিই বিরক্ত হলেন। তিনি জানতে চাইলেন,
-তোমার ক্লাস শুরু হবে কবে থেকে?
-মার্চের প্রথম সপ্তাহে। আন্না তার পায়ের আঙুলের দিকে তাকিয়েই উত্তর করে।
-তুমি মার্চের শুরুতেই সেখানে চলে যাবে। আমি সাশাকে চিঠি লিখে জানিয়েছি এখন বাড়ি আসার কোন দরকার নেই। গ্রীষ্মের ছুটিতে তোমরা একসাথে এসো। সাশাকেও বলবে যেমন চলছিল, সবকিছু সেভাবেই চলবে। সে যেন এসব নিয়ে কোন চিন্তা না করে।
মায়ের এমন কথায় আন্না চুপ করে যায়। তবে মায়ের এই দৃঢ়তাটুকু আন্নাকে মুগ্ধ করে। তার মনের মধ্যে অবশ্য একটা আনন্দও ঢেউ খেলে যায়। সে আনন্দটুকু ভীষণ গোপন। কতদিন বাদে মার্কের সাথে দেখা হবে! মার্কের কথাটা এবারে  মাকে আর বলা হলো না!

বাবা মারা যাবার পর অন্য সব কিছু আগের মতো চললেও সমস্যা দেখা দিল ভলোদিয়াকে নিয়ে। ভলোদিয়া কারো কথা শোনে না। অধিকাংশ সময় কথা বলে রাগী গলায়। কেউ কিছু করতে বললে বা  জানতে চাইলে সে প্রচন্ড বিরক্ত হয়। বেশিরভাগ সময় সে অন্যদের সাথে খারাপ ব্যবহার করে। এমনকি সে মারিয়ার কথাও শোনে না। একদিন কি একটা কারণে ভলোদিয়া দিমিত্রিকে প্রচণ্ড বকা দিল। সামান্য কারণে ভলোদিয়ার এমন ব্যবহারে আন্না প্রচণ্ড বিরক্ত হলো। সব শুনে মারিয়া চুপ করে থাকলেন। ভাই বোনদের মধ্যে ছোট্ট মারিয়া ভলোদিয়ার ভীষণ ন্যাওটা। ভলোদিয়াও তার এই ছোট্ট বোনটিকে প্রচণ্ড ভালবাসে। ছোট্ট মারিয়া সব সময় ভলোদিয়ার কাছে প্রশ্রয় পেয়ে থাকে। সেই ছোট্ট মারিয়া একদিন তার হোমওয়ার্ক করার সময় ভুল করায় তাকে পর্যন্ত ভলোদিয়া ভীষণ বকাবকি করে। আন্না বুঝতে পারে না তার কী করা উচিত। আন্না ভাবে একমাত্র সাশার কথায় হয়তো ভলোদিয়া শুনতে পারে। কিন্তু সাশার বাড়ি আসতে এখনও কয়েক মাস বাকী। এদিকে আন্নারও সেন্ট পিটার্সবার্গ যাবার সময় হয়ে আসছে।

আন্না সেন্ট পিটার্সবার্গ চলে যাবার দু/একদিন পরেই মারিয়া সাশার লেখা একটি চিঠি পেলো। চিঠিতে সাশা লিখেছে Segmented Worm নিয়ে তার থিসিসের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাকে একটি গোল্ড মেডেল দেয়া হয়েছে। খবরটি জেনে প্রথমে মারিয়ার যে কী প্রচন্ড আনন্দ হলো! মারিয়ার মনে হলো আজ ইলিয়া বেঁচে থাকলে কত খুশীই না হতেন! সাশাকে নিয়ে ইলিয়ার কত গর্ব ছিল! অথচ সাশার এই সাফল্যে যে মানুষটা সবচেয়ে খুশী হতো সেই মানুষটিই তো আজ নেই! কিন্তু চিঠিটি শেষ পর্যন্ত পড়ার পর মারিয়ার মনটা একটু একটু করে খারাপ হতে শুরু করে। সাশা চিঠিটি লিখেছে মার্চের ২ তারিখে। আর সে গোল্ড মেডেলটি পেয়েছে ফেব্রুয়ারির ৩ তারিখে। খবরটা সাশা এতদিন পরে দিল? আনন্দের পাশাপাশি মারিয়ার মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো। বাবা নেই, সাশা কী সে কারণেই এতদিন বাদে খবরটি দিল? নাকি ভলোদিয়ার মতো সাশাও পাল্টে গেলো? মারিয়ার আনন্দটুকু ক্রমশ: ফিকে হয়ে একটা কষ্ট যেন বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠতে থাকে। আনন্দে এবং দুঃখে তাই মারিয়ার চোখে পানি চলে আসে। বাড়িতে ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা আছে। নিজের কান্নাটুকু পাছে দেখে ফেলে তাই চোখের পানিটুকু দ্রুত মুছে ফেলে তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। মারিয়ার মনে হলো ইলিয়ার অনুপস্থিতিতে সে যতই শক্ত করে হাল ধরতে চাচ্ছে ততই যেন আরেকটা দিক থেকে গ্রন্থিগুলো আলগা হতে চাচ্ছে। ভলোদিয়ার আচরণে মারিয়া ভীষণ মর্মাহত। মারিয়া নিজেকে সান্তনা দেয় এই বলে যে ছেলেটা এখন তার বয়:সন্ধিকাল পার করছে। বাবার হঠাৎ মৃত্যু এবং অনেক কিছু রাতারাতি বদলে যাওয়াটা ভলোদিয়া মেনে নিতে পারছে না। আর সে কারণেই ভলোদিয়া বোধ হয় এমন করছে। কিছুদিন গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে। বাবার মৃত্যুর পর সাশা বাড়ী এলো না। মারিয়া নিজেই নিষেধ করেছিল। সাশার অর্গানিক কেমেস্ট্রি পরীক্ষা, পড়া নষ্ট হবার ভয় এবং সর্বোপরি শীতের সময় যাতায়াতের কষ্ট হবে ভেবেই মারিয়া নিষেধ করেছিল। মারিয়ার চকিতে একবার মনে হলো ‘আমি না হয় সাশাকে আসতে বারণ করেছিলাম কিন্তু সাশার কী নিজে থেকে একবারও বাড়ি আসতে ইচ্ছে হয়নি?’ সাশার গোল্ড মেডেল পাওয়ার এতদিন পর চিঠি লেখা এবং বাবার মৃত্যুতে মায়ের নিষেধ মেনে বাড়িতে না আসার দু’টো গোপন দুঃখ যেন একটু অভিমান আাকারে এই মুহূর্তে এক সাথে মিলে মিশে একাকার হয়ে গেলো। আর সেই মুহূর্তে মারিয়ার বুকের ভিতর থেকে চাপা দীর্ঘশ্বাসটুকু যেন আরো একটু দীর্ঘায়িত হয়ে বের হয়ে এলো।

সে বছর গ্রীষ্মের ছুটিতে আন্না ও সাশা একত্রে বাড়িতে এলো। সাশা সাথে করে নিয়ে এলো প্রচুর বই। আন্না দেখলো সেই সব বইয়ের মধ্যে কার্ল মার্কসের পুঁজির প্রথম খণ্ডও আছে। আন্না আগে কার্ল মার্কসের নাম কখনও শোনেনি।  সাশা যেন এই কয়েক মাসে অনেক বদলে গেছে। এবার বাড়িতে এসে ভাই-বোনদের সাথে সময় কাটানোর থেকে সে বেশি সময় কাটায় বই পড়ে। শুধু মারিয়া নয়, আন্নার চোখেও সাশার এই পরিবর্তনটা বেশি করে ধরা পড়ে। তবু ভলোদিয়ার আচরণে অতিষ্ট আন্না বিষয়টি নিয়ে একদিন সাশার কাছে কথা তোলে। সাশার ঘরে গিয়ে দেখে সাশা মার্কসের “ডাস ক্যাপিটাল” বইটিই পড়ছে। সাশার প্রিয় বেড়ালটা যথারীতি তার বিছানার উপর চুপ করে বসে আছে। আন্নাকে আসতে দেখে বইয়ের পাতাটা মুড়িয়ে সাশা একটু ঘুরে বসে। বিছানায় বসতে বসতে আন্না বলে,
-তুমি ভলোদিয়াকে খেয়াল করেছো?
-হ্যাঁ। কেন কি হয়েছে ওর?
সাশার এমন কথায় আন্না একটু অবাক হয়। সে বলে,
-তার মানে তুমি কোন কিছুই লক্ষ্য করোনি?
সাশা একটু বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করে,
-কী হয়েছে বলো তো? খারাপ কিছু?
-তুমি খেয়াল করোনি? ভলোদিয়া সবার সাথে খারাপ আচরণ করে। এমন কি মায়ের সাথেও। সে মায়ের কথা পর্যন্ত শোনে না।
আন্নার কথা বলার ভঙ্গিতে সাশা একটু অবাক হয়। আবার অন্যদিকে নিজেকে একটু অপরাধীও মনে হতে থাকে। সত্যিই তো সে বিষয়টি খেয়াল করেনি। তথাপি সে বলে ওঠে,
-না, মানে আমি ঠিক ভাল করে খেয়াল করে উঠতে পারিনি।
-তুমি অনেক বদলে গেছো সাশা!
আন্নার এমন অভিযোগে সাশা চুপ করে থাকে। সত্যিই কি সে বদলে গেছে? আন্না তো তার সাথে এমনভাবে কোনদিন কথা বলে না। ভলোদিয়ার ব্যবহার কি খুবই খারাপ হয়েছে? তবুও সাশা কোন জবাব দেয় না। আন্না তখন আবারও জানতে চায়,
-ভলোদিয়া সম্পর্কে তোমার কি ধারণা?
আন্নার একথায় সাশা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর বলে,
-সে তো এমনিতে বেশ দক্ষ ও ভাল ছেলে। তবে সত্যি কথা বলতে কি, আমি ওকে ভাল বুঝতে পারি না।
-ভলোদিয়া মা’কে পর্যন্ত মানে না। কারো সাথে কথা বলে না বললেই চলে। তুমি কি ওর সাথে একটু কথা বলবে?
-‘আমি?’ সাশা যেন কিছুটা অবাক হবার ভঙ্গিতে কথাটা জানতে চায়।
-‘হ্যাঁ। তুমি তো জানো সে তোমাকে মানে’। কথাটা বলেই আন্না উঠে পড়ে।
-ঠিক আছে, আমাকে একটু সময় দাও। আমি কথা বলবো।

পরেরদিন সাশা ভলোদিয়ার ঘরে আসে। জানতে চায়,
-ভলোদিয়া, দাবা খেলবে?
-‘খেলা যায়’। ভলোদিয়া উত্তর করে। এই একটা ব্যাপারে ভলোদিয়ার কোন আপত্তি নেই। দিন-রাত সে দাবা খেলতে পারে।
সাশা অবশ্য দাবা খেলার ফাঁকে ফাঁকে তার এই ছোট ভাইটির সাথে কিছু কথা বলতে চাচ্ছিল। ভলোদিয়ার বয়স এই এপ্রিলে ষোল হবে। সাশা তার এই ভাইটিকে খুব ভালবাসে! বাবার মৃত্যুটা বোধ হয় সে মানতে পারছে না। সাশা চিন্তা করে সে নিজেও কি পেরেছিল? সে নিজেও কী আত্মহত্যার কথা ভাবেনি?
আন্নার কাছে শুনেছে বাবার মৃত্যুর পর কেউ নাকি ভলোদিয়াকে এক ফোঁটা চোখের পানি ফেলতে দেখেনি। অন্যদের সামনে সে নাকি কোন আবেগই প্রকাশ করেনি। এত অল্প বয়সে চরিত্রের এই কাঠিন্যতা সে কিভাবে পেলো? বাবার মৃত্যুই কি তার এমন ব্যবহারের কারণ? নাকি বয়ঃসন্ধিজনিত কারণ? সাশা খেলার ফাঁকে ফাঁকে ভলোদিয়ার সাথে নানা বিষয়ে গল্প করছিল। এমন সময় মারিয়া রান্না ঘর থেকে ভলোদিয়াকে ডাকে। ভলোদিয়া বেশ রুঢ় গলায় বলে,
-আমি ব্যস্ত। এখন যেতে পারবো না।
সাশা নিজের চোখে সাশার এমন উত্তরে সত্যিই মর্মাহত হয়। সাশার তখন দাবার চাল দেবার কথা। ভলোদিয়ার ঘোড়ার চালটা তাকে একটু বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে। কিন্তু সাশা চাল না দিয়ে ভলোদিয়াকে বলে,
-ভলোদিয়া, তুমি এখনই মায়ের কাছে যাবে। মা যা বলবেন সেটা প্রথমে করবে। অন্যথায় আমি তোমার সাথে আর দাবাই খেলবো না।
ভলোদিয়া সাশার এমন কথায় তার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে সাশা কঠিন চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। দাবা খেলার জন্যেই হোক অথবা সাশাকে মান্য করার কারণেই হোক ভলোদিয়া তখনকার মতো রান্না ঘরের দিকে যেতে থাকে।

কার্ল মার্কস ও মিখাইল বাকুনিনের মধ্যে বেশ কিছু বিষয়ে মতবিরোধ ছিল। বাকুনিন বিজ্ঞানকে আক্রমণ করে তাকে নতুন ধরনের ধর্ম হিসাবে অভিহিত করেন। রাজনৈতিক দলের নেতাদের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব নিয়েও তিনি মার্কসের দৃষ্টিভঙ্গির তীব্র সমালোচনা করেন। একই সাথে বাকুনিনের দূর্বলতা ছিল নেতৃত্বের ক্যারিশমার উপর। আর এই কারণে তাঁর ও রুশ বিপ্লবী সের্গেই নেখায়েভের মধ্যে বন্ধুত্ব হতে সময় লাগে না। তাঁরা একত্রে ১৮৬৯ সালে ‘The Catechism of a Revolutionary’ নামে একটি বই লেখেন। সেই বইয়ে তাঁরা বিপ্লবীকে সঙ্গায়িত করে বলেন, ‘বিপ্লবী, একজন দন্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তি। তার ব্যক্তিগত কোন স্বার্থ নেই, আসক্তি নেই, সম্পত্তি নেই এমনকি কোন নামও নেই। যে সব কিছু বিলীন করে দেবে একটি মাত্র প্রত্যয় ও আবেগের জন্য, যার নাম বিপ্লব’।
সে সময়  রাশিয়াতে নেখায়েভের এই চিন্তার অনুসারীদের অভাব ছিল না। রাশিয়ার পিপলস্ উইল এর সমর্থকরা তার এই চিন্তাধারায় উদ্বুদ্ধ ছিল। নেখায়েভ ১৮৬৯ সালে ইভানভ নামে তার এক সহযোদ্ধাকে পুলিশের চর হিসাবে সন্দেহ করে এবং শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে ছুঁরি দিয়ে খু্ঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। দস্তয়েভস্কি এই ঘটনাকে উপজীব্য করে ‘The Possessed’ নামে একটি উপন্যাস লেখেন যেখানে ‘ভারখোভেনস্কি’ নামের একটি চরিত্রের মধ্যে নেখায়েভকে এবং ‘শাটভ’ নামের অন্য চরিত্রটি দিয়ে ইভানভকে তুলে ধরেন। তাতেও অবশ্য নেখায়েভের জনপ্রিয়তা কমে না। বরং তরুণদের উপর নেখায়েভের প্রভাব দিন দিন বাড়তেই থাকে। এহেন নেখায়েভের সাথে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে কার্ল মার্কস বাকুনিনকে প্রথম আন্তর্জাতিক থেকে বহিষ্কার করেন। সেই নেখায়েভের একজন অনুসারী সের্গেই নিকোনভ সেন্ট পিটার্সবার্গ বিশ্ববিদ্যালেয় সাশার সাথে পড়ে। সেই সাশাকে অর্থনীতি গ্রুপে যোগ দিতে অনুরোধ করলে ১৮৮৬ সালের শরৎকালে সাশা সেই গ্রুপে যোগ দেয়। তার পূর্বেই অবশ্য সাশা কার্ল মার্কসের লেখার সংগে পরিচিত হয়। বাড়ি থেকে ফিরে আসার দিন পনের পরে সাশা একদিন মার্কসের ‘ধর্ম প্রসঙ্গে’ লেখাটি নিয়ে আন্নার হোস্টেলে যায়। বইটি আন্নাকে দিয়ে বলে,
-অ্যানিউটা, তুমি মার্কসের এই লেখাটি অনুবাদ করে দাও।
আন্না অবাক হয়। সাশার কাছে সিমবিরস্কিতে সে মার্কসের পুঁজি নামক বইটি দেখেছিল। আন্না বইটি হাতে নিয়ে দেখে সেটা জার্মান ভাষায় লেখা। আন্না প্রশ্ন করে,
-আমি অনুবাদ করবো? আমি কেন?
আন্না মার্কসের কোন লেখা আগে কখনও পড়েনি। এমনকি অর্থনীতি সার্কেলে যোগ দেবার আগে সে মার্কসের নামও ভাল করে শোনেনি। এমনকি সাশার কাছে মার্কসের ক্যাপিটাল দেখার আগে তার কোন লেখা সে চোখেও দেখেনি। তাই আন্নার প্রশ্নের উত্তরে সাশা বলে,
-লেখাটা তোমাকে অনুবাদ করতে দিচ্ছি কারণ জার্মান ভাষাটা তুমি ভাল জানো।
কথাটা মিথ্যা নয়। জার্মান ভাষাটা সে ভালই জানে। জার্মান ভাষার প্রতি তার ভালবাসা বেড়েছে কবি হেনরিক হাইনের কারণেও। তাই আন্না ‘ধর্ম প্রসঙ্গে’ মার্কসের লেখাটা রুশ ভাষায় অনুবাদ করতে শুরু করে। সাশা অর্থনীতি গ্রুপে যোগ দেবার পর গ্রুপটি ক্রমশঃ শক্তিশালী হতে থাকে। সাশার প্রচেষ্টায় আন্না ছাড়াও মার্ক এবং শেভোটারেভ ইতোমধ্যে অর্থনীতি গ্রুপে যোগ দিয়েছে। সাশা এই অর্থনীতি গ্রুপে যোগ দেওয়ায় সে নারোদনিকদের সবচেয়ে রেডিক্যাল অংশ পিপলস্ উইলের সম্ভাব্য ‘রিক্রুট’ হিসাবে গ্রুপের নেতাদের নজরে পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই গ্রুপের নেতা শেভেরেভের সাথে সাশার পরিচয় হয় এখানেই।

বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কিছুদিন আগে শেভেরেভ একটু ক্যান্টিন চালু করেছে। সেদিন রাতে ক্যান্টিন ফাঁকা হয়ে গেলে গ্রুপের আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য লুকাশেভিচকে শেভেরেভ বললো,
-গ্রুপের নতুন ছেলেটির উপর বিশেষভাবে নজর রাখো।
কোন খরিদ্দার নেই। বেশ রাত হয়েছে। কেন্টিন বন্ধ করার সময়। আর তক্ষুনি শেভেরেভ লুকাশেভিচকে কথাটা বললো। বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে শেভেরেভ বিশ্ববিদ্যালয়ে দু’টো জিনিস চালু করেছে। ছাত্রদের জন্য কেন্টিন আর অন্যটি হলো চাকুরি সংক্রান্ত তথ্য ও সহযোগীতা কেন্দ্র। এগুলো চালু করার প্রাথমিক উদ্দেশ্য পিপলস্ উইলের জন্য নতুন সদস্য সংগ্রহ করা। লুকাশেভিচ প্রথমে বুঝতে পারে না শেভেরেভ কার কথা বলছে। শেভেরেভের কাজে সহযোগিতা করতে করতেই সে প্রশ্ন করে,

-তুমি কার কথা বলছো? সাশা?

শেভেরেভ মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে। সাশা কিছুদিন হলো অর্থনীতি গ্রুপে যোগ দিয়েছে। লুকাশেভিচ ভেবে পায় না তার মধ্যে শেভেরেভ এমন কি দেখতে পেলো যে তার দিকে বিশেষ নজর রাখতে বলা হচ্ছে। বিষয়টা বুঝার জন্যই লুকাশেভিচ আবারো প্রশ্ন করে,
-কেন বলো তো?
কেন্টিনের জিনিষপত্রগুলো ঠিকঠাক গুছিয়ে রাখতে রাখতে শেভেরেভ উত্তর দেয়,
-আমাদের পরবর্তী পরিকল্পনায় সে বড় ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে।
লুকাশেভিচের হাতে সসেজের প্যাকেটা তখনও ধরা। সে টেবিলের উপর প্যাকেটটি নামিয়ে রেখে শেভেরেভের দিকে চেয়ে আবার প্রশ্ন করে,
-তুমি এমনটা কেন ভাবছো?
শেভেরেভ তার হাতের কাজগুলো করতে করতেই বলতে থাকে,
-ছেলেটার চরিত্রের একটা দিক বোধ হয় তুমি লক্ষ্য করোনি। সে যদি কোন কিছু করার জন্য মন স্থির করে, সেটার জন্য সে সব কিছু করতে পারে। একজন বিপ্লবী হবার জন্য এই গুনটি খুবই জরুরী।
ছেলেটির আরো দুটি গুরুত্বপূর্ণ গুণ আছে।
শেভেরেভের কথায় লুকাশেভিচ বেশ অবাক হয়। মানুষের ভিতরের চারিত্রিক এসব বিষয় বুঝার ক্ষমতা শেভেরেভের অসাধারণ। নেতৃত্বের
জন্য এমন গুনাবলীও সম্ভবতঃ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তার কৌতুহল বাড়ে। তাই সে জিজ্ঞাসা করে,
-কী সেটা?
-রসায়নের উপর তার ভাল দখল আছে। যেমনটা আছে তোমার। তোমাদের দু’জনের একটা চমৎকার জুটি গড়ে উঠতে পারে। যেটা হতে পারে আমাদের গ্রুপের একটা বড় সম্পদ।
লুকাশেভিচ দলের মধ্যে বোমা তৈরীতে ইতোমধ্যে খ্যাতি অর্জন করেছে। সামনে তাদের বড় একটা পরিকল্পনা আছে। বিষয়টি কেন তার মাথায় এলো না এটা ভেবে সে একটু অবাকই হলো। জানতে চাইলো,
-আর?
ততক্ষণে শেভেরেভের হাতের কাজ শেষ। ওভারকোটটা পরে নিতে নিতে সে বলে,
-তার ভাষাজ্ঞান এবং যে কোন বিষয়ের প্রতি তার গভীর পড়াশুনা। আমাদের রাজনৈতিক প্রপাগান্ডার জন্য এটাও অত্যন্ত জরুরী।
লুকাশেভিচ শেভেরেভের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতায় আরেকবার মুগ্ধ হয়। মাথা নেড়ে সে শেভেরেভের সাথে সহমত পোষণ করলে শেভেরেভ বলে,
-তাকে আরো দায়িত্ব দাও। অর্থনীতি গ্রুপে তাকে সামনে নিয়ে আসো।

অর্থনীতি গ্রুপে যোগ দিয়ে কয়েক মাসের মধ্যে সাশা ঐ গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হলো। আর তখন থেকেই সে গুপ্ত পুলিশের নজরদারীতে পড়ে। অর্থনীতি গ্রুপের মধ্যে মার্কসপাঠ তখন সবে শুরু হয়েছে। সত্যকথা হলো মার্কসকে ঠিক মত অধ্যায়নের জন্য এবং তাঁর লেখা নিয়ে পাঠচক্র পরিচালনা করার মতো দক্ষতা অনেক গ্রুপেরই নেই। সাশাদের ও অন্য আরো কিছু পাঠচক্রে বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে-রাশিয়ায় পুঁজিবাদ প্রবেশ করেছে কিনা? সমাজতন্ত্রে উত্তরণে পুঁজিবাদের প্রবেশ ও বিকাশ জরুরী কিনা? বিপ্লবে কাদের ভূমিকা নিয়ামক হবে-কৃষকের না শ্রমিকের? সন্ত্রাসবাদ বিপ্লবের জন্য কতটা জরুরী? সাশা একই সময় শেভোটারেভকে নিয়ে অন্য একটি গ্রুপেও যেতে থাকে যেটা চালাতো ভি ভি বার্টেনেভ। সেখানেও বিতর্ক চলে এসব নিয়েই। সাশা বিশ্বাস করে পুঁজিবাদ বিকাশের পথেই সমাজতন্ত্র আসবে আর সেটা কৃষকের নেতৃত্বে নয় যেমনটা নারোদনিকদের বড় একটা অংশই মনে করতো। এটা এমন একটা সময় যখন নারোদিকদের বড় একটা অংশ মার্কসবাদের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। প্লেখানভ, ভেরা জাসুলিচ, এক্সেলরডরা মার্কসবাদে দীক্ষা নিয়েছেন। এক সময় বাকুনিনের কঠোর সমর্থক প্লেখানভ ইতোমধ্যে নারোদনিকদের সাথে বিরোধীতার সূত্রগুলো একত্রিত করে লিখে ফেলেছেন ‘ Our Differences’। এসময় নারোদনিক ও পিপলস্ উইলের মত গ্রুপগুলিতেও মার্কসের প্রভাব বাড়তে থাকে। সাশাও তার ব্যতিক্রম ছিল না।

সাশাদের এই অর্থনীতি গ্রুপেই একদিন আন্নাকে বক্তা বানানো হলো। বিষয় ‘কৃষকের অর্থনৈতিক অবস্থা’। আন্না যে সব উদ্বৃতি দিল সেগুলো যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত না হওয়ায় তার বক্তব্য ভীষণ সমালোচনার মধ্যে পড়ে। সমালোচনার তোড়ে আন্নার তখন রীতিমত কান্না পাচ্ছিল। সে নিজের বক্তব্যের পক্ষে যুক্তিগুলো করার চেষ্টা করছিল কিন্তু শ্রোতাদের বুঝাতে ব্যর্থ হতে লাগলো। সে অসহায়ভাবে একবার মার্ক, আরেকবার সাশার দিকে তাকাচ্ছিল। মার্কের চোখে সহানুভূতির ছায়া দেখতে পেলেও সাশাকে নির্বিকার মনে হলো। সে তখন নিজের বক্তব্যের পক্ষে আর কোন কথা না বলে চুপ করে থাকে। তার মনে হচ্ছিল সে ভুল করেছে। আর কখনও সে এই পাঠচক্রে আসবে না। সে চুপ করে গেলে মার্ক আন্নার বক্তব্যের সমর্থনে কিছু যুক্তি তুলে ধরে। আন্না গভীর ভালবাসা ও আবেগের চোখ দিয়ে মার্ককে দেখতে থাকে। কিন্তু মার্কের যুক্তিও শ্রোতাদের পুরোপুরি সন্তুষ্ট করতে ব্যর্থ হলো। শ্রোতারা কৃষিতে পুঁজিবাদের অনুপ্রবেশ বা বিকাশের সব যুক্তিই পাল্টা যুক্তিতে উড়িয়ে দিতে থাকলে মার্কও যেন অসহায় বোধ করতে থাকে। বিশেষতঃ নিকোনভের পাল্টা যুক্তির সামনে। আন্না আবারও সাশার দিকে তাকায়, দেখে তখনও সাশা নির্বিকার। সাশা মার্ক ও নিকোনভ উভয়ের বক্তব্য মনোযোগ দিয়ে শুনে যাচ্ছিল। মার্ক পাল্টা যুক্তি দিতে বা বিতর্ক চালিয়ে নিতে অসমর্থ হলে সাশা উঠে দাঁড়ায়। নিকোনভের প্রতিটি বক্তব্য সে তথ্য ও উদাহরণ দিয়ে দিয়ে খণ্ডন করে দেখায় যে রাশিয়ার কৃষি ব্যবস্থায় পুঁজিবাদ শুধু অনুপ্রবেশই করেনি বরং সেটা রীতিমত পুষ্ট হচ্ছে। আর সমাজ পরিবর্তনে কৃষক নয়, শ্রমিকের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। ইউরোপের অন্য দেশগুলোর তুলনায় পুঁজিবাদের বিকাশ তেমন মাত্রায় না হলেও পুঁজিবাদ ক্রমশঃ বিকশিত হচ্ছে। সাশার বক্তব্য শেষ হলে শুধু আন্না নয়, গ্রুপের অধিকাংশই সদস্যই তার বক্তব্যের যুক্তি, উদাহরণ ও বলার ভঙ্গিতে মুগ্ধ হয়। আলোচনা সভায় শেভেরেভ ও লুকাশেভিচও উপস্থিত আছে। সাশার বক্তব্য শেষ হলে তারা দু’জন অর্থপূর্ণভাবে দৃষ্টি বিনিময় করে। পাঠচক্র শেষে সাশারা বের হয়ে গেলে শেভেরেভ ও লুকাশেভিচকে নিকোনভ বলে,
-আমাদের পরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়ন করা দরকার। তা না হলে সাশার মতো ছেলেদের আমরা হারাবো।
লুকাশেভিচ প্রশ্ন করে,
-কিন্তু সাশা তো আমাদের গ্রুপে এখনও যুক্ত হয়নি। তাকে নিয়ে আমরা এতটা কেন ভাবছি?
আজকের বিতর্কে নিকোনভ হেরে গেলেও সাশার প্রতি তার ব্যক্তিগত শ্রদ্ধাবোধ আছে। তাই সে বলে,
-একটা কিছু করা দরকার। যাতে সাশা দ্রুত কিছু করার জন্য উঠে পড়ে লাগতে পারে। কিন্তু কি করা যায়?
প্রশ্নটা সে করে শেভেরেভকে। শেভেরেভ তখন বলে,
-আগামী ১৭ই নভেম্বর নিকোলাই ডবরোলিউবভের ২৫তম মৃত্যুবার্ষিকী। এক কাজ করলে কেমন হয়?
নিকোনভ এবং লুকাশেভিচ দু’জনেই উৎসুক মুখে শেভেরেভের দিকে তাকায়। শেভেরেভ কয়েক মুহূর্ত নীরব থেকে কি যেন ভাবে। তারপর বলে ওঠে,
-এক কাজ করো। অর্থনীতি সমিতির পক্ষ থেকে নিকোলাই ডবরোলিউবভের মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য ব্যাপক জমায়েত ও শোক সভার উদ্যোগ নাও। পুলিশ বাঁধা দিতে পারে। আর সাশাকে এই উদ্যোগ সফল করার জন্য পুরো দায়িত্ব দিয়ে দাও।
অন্য দু’জন ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানায়।

পাঠচক্র থেকে বের হয়ে সাশা, আন্না ও মার্ক একসাথে হাঁটতে হাঁটতে ফিরছিল। ঠাণ্ডা পড়তে শুরু করেছে। আন্নার মন তখনও খারাপ। সে হঠাৎ করেই বলে ওঠে,
-সাশা, আমি আর তোমাদের এই পাঠচক্রে আসবো না।
মার্ক আন্নার দিকে তাকায়। সাশা আন্নার দিকে না চেয়েই জিজ্ঞাসা করে,
-কেন?
আন্নার কণ্ঠে কিছুটা অভিমান, কিছুটা ক্ষুব্ধতা। সে বলে ওঠে,
-আমি এই পাঠচক্রের যোগ্য নই। মনে হয়, আমার অনেক দূর্বলতা আছে।
সাশা এবার আন্নার মুখের দিকে তাকিয়ে তাকে বুঝার চেষ্টা করে। মুখে বলে,
-সেগুলো খুঁজে বের করো। পাঠচক্র ছেড়ে দিলে তোমার দূর্বলতা দূর হয়ে যাবে?
আন্না সাশার পাশে সরে আসে। সাশার দিকে চেয়ে বলে,
-আচ্ছা তুমিই বলো না আমার দূর্বলতা কোথায়?
মার্ক চুপচাপ পাশাপাশি হাঁটছিল। এতক্ষণ একটা কথাও বলেনি। আন্নার প্রশ্নে সেও সাশার মুখের দিকে তাকায়। সাশা পথের দিকে তাকিয়েই বলে,
-তোমার দূর্বলতা হলো তোমার মধ্যে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব। আর সে কারণে তোমার মধ্যে কোন প্রত্যয়ও গড়ে উঠছে না। আর যতক্ষণ কারো মধ্যে এ’দুটো জিনিসের অভাব থাকে তার উচিত নয় কোন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিজেকে জড়ানো।
সাশার কথায় শুধু আন্নায় নয়, মার্কও অবাক হয়। তারা দু’জন দৃষ্টি বিনিময় করে। সেই দৃষ্টি বিনিময়ের অর্থ পাঠচক্রে যোগদান করাটা কেন ঝুঁকিপূর্ণ কাজ হবে? তবে কি অর্থনীতি গ্রুপের অন্য সদস্যরা অন্য কিছুর সাথে যুক্ত? সাশা কী কোন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছে?

সেদিনের পর সাশা আন্নাকে আরো ভালভাবে প্রস্তুত করতে তাকে নিয়ে যেতে থাকে ভি আই সেমেভস্কি পরিচালিত আরেকটি পাঠচক্রে। রাশিয়ায় ছাত্রদের মধ্যে বিপ্লবী চিন্তা-চেতনা রোধে নানা প্রয়াসের একটি হলো ‘সিলেবাস’ নিয়ন্ত্রণ করা। ১৮৮৪ সালে সেন্ট পিটার্সবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস থেকে  ভি আই সেমেভস্কির ‘কৃষকের ইতিহাস’ নামের একটি সংক্ষিপ্ত লেখা তুলে দেয়ার পর থেকে তিনি নিজেই তাঁর বাসায় এই বিষয়ে ক্লাস নিতেন। তাঁর বাসায় সেদিনের ক্লাসে সাশা অনুপস্থিত থাকায় ক্লাস শেষে তিনি নিষিদ্ধ কিছু কাগজপত্র আন্নাকে দিয়ে বললেন সাশাকে পৌঁছে দিতে। দেবার আগে তিনি আন্নাকে বললেন সাবধানে নিয়ে যেতে কারণ পুলিশ ধরলে সবারই বিপদ হতে পারে। আন্না সাহস করে খুব সাবধানে তার ব্যাগের মধ্যে কাগজগুলো নিল বটে তবে দোতলা থেকে সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় তার হাত-পা কাঁপতে লাগলো। কোনরকমে সিঁড়ি দিয়ে নেমে সে যখন রাস্তায় এলো তার মনে হলো সারা পৃথিবী তাকে দেখছে। ভি আই সেমেভস্কির বাসা থেকে ২৫ নম্বর আলেকজান্দ্রাভস্কি স্ট্রিটে সাশার বাসায় হেঁটে যেতে লাগে দশ মিনিট। মিনিট দুয়েক হেঁটে আলেকজান্দ্রাভস্কি স্ট্রিটে উঠতেই আন্নার মনে হলো কেউ যেন তাকে অনুসরণ করছে। তখন  সন্ধা হয়েছে। তবে অন্ধকার তখনও গাঢ় হয়নি। আন্নার পা দু’টোকে একদিকে যেমন পাথরের মত ভারী মনে হচ্ছে অন্যদিকে তার মনে হলো সাশার কাছে পৌঁছাতে সে যেন অনন্তকাল ধরে হাঁটছে । সে যে পিছন ফিরে তাকাবে এই সাহসও তার নেই। তার মনে হচ্ছে পিছন ফিরে তাকালেই কেউ একজন খপ করে তাকে ধরে ফেলবে। অক্টোবর মাস। ঠাণ্ডা পড়তে শুরু করেছে কিন্তু আন্না রীতিমত ঘামতে থাকে। সন্ধার সেই আবছা আলোয় পথ দেখে দেখে আন্না কোন রকমে সাশার বাসায় সামনে এসে পোঁছায়। সাশার বাসায় ঢোকার আগে অনেক সাহস নিয়ে সে পিছন ফিরে তাকায়। কিন্তু দেখে কেউ নেই। তার শরীর থেকে যেন ঘাম দিয়ে জ্বর নামে। সে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে প্রথমে জোরে জোরে কড়া নাড়ে। কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে তার কাছে থাকা চাবিটা দিয়ে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে কোন রকমে সিটকিনিটা দিয়ে ধপাস করে সাশার বিছানার উপর বসে পড়ে। কিছুটা ভয়ে আর কিছুটা গোপন কাজে নিজের সম্পৃক্ততার শিহরণ নিয়ে সে সাশার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।

সাশারা তাদের অর্থনীতি গ্রুপের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত নিলো ১৮৮৬ সালের ১৭ই নভেম্বর রুশ বিপ্লবী লেখক ও সাংবাদিক নিকোলাই ডবরোলিউবভের ২৫তম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর কবরস্থান ভলোকভ সিমেট্রিতে তারা সমাবেশ করবে। সেই পঞ্চাশের দশকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন বিশ্ববিদ্যালয়ের অগণতান্ত্রিক নিয়মকানুনের বিরুদ্ধে তিনি আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। পরবর্তী তিনি তাঁর ক্ষুরধার লেখনী দিয়ে ছাত্র ও যুবকদের উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। তিনি একই সাথে তরুণ ও যুবকদের উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলা ‘কী করিতে হইবে?’ উপন্যাসের লেখক চেরনিশেভস্কির ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। সম্পাদক হিসাবে সমাবেশ সফল করার দায়িত্ব পড়ে সাশার উপর। একই সাথে বেস্টুজহেভ ও অন্য নারীদের সংগঠিত করার কাজের দায়িত্ব পড়ে আন্না, রাইসা ও আরো কিছু নারী কর্মীর উপর। সাশা বেশ কিছু চিঠি নিয়ে একদিন আন্নার হোস্টেলে এসে হাজির হলো। চিঠিগুলো আন্নাকে বুঝিয়ে দিয়ে সে বলে,
-তুমি এই চিঠিগুলো পোস্ট করবে আজই। কিন্তু এক ডাক বক্সে ফেলবে না।
আন্না একটু অবাক হয়। প্রশ্ন করে,
-এক ডাক বক্সে ফেললে কী হবে?
-অ্যানিউটা, তুমি বোধ হয় জানো না যে কয়েকবছর আগে থেকে জার সরকার ‘ব্ল্যাক অফিস’ নামে পুলিশের একটি বিশেষ গ্রুপ তৈরি করেছে। তাদের কাজ হলো সন্দেহভাজন চিঠিপত্র পরীক্ষা করে দেখা। আমাদের ১৭ই নভেম্বরের সমাবেশ নিয়ে সরকার সন্দেহ করুক আমরা চাই না। শহরের বিভিন্ন পোস্ট বক্স থেকে চিঠিগুলো পোস্ট করলে একসাথে চিঠিগুলো পুলিশের হাতে পড়বে না। আর এক আধটা ধরা পড়লেও তেমন কোন সন্দেহের উদ্রেক করবে না।
সাশার কথা শুনে আন্নার একটু ভয় ভয় করে। সে জানতে চায়,
-সাশা, তোমার কোন বিপদ হবে না তো?
সাশা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলে,
-চিঠিগুলো পুলিশের হাতে পড়লে বিপদ তো হতেই পারে। এই চিঠিগুলো ঠিক ঠিক জায়গায় সময়মত পৌঁছানো খুবই জরুরি। তুমি আজই কাজটি করে ফেলো।
কথাগুলো বলেই সাশা চলে যায়। আন্না তার চলে যাওয়াটা চেয়ে চেয়ে দেখে। সে মনে মনে সাশার জন্য উদ্বিগ্ন বোধ করে। তার মন বলে সাশা বিপদের মধ্যে জড়িয়ে পড়ছে। তবু আধ ঘন্টার মধ্যে সে বেরিয়ে পড়ে। নেভেস্কি প্রসপেক্ট ধরে হাঁটতে হাঁটতে কয়েকটা ভিন্ন ভিন্ন পোস্ট বক্সে চিঠি পোস্ট করার পর তার বড্ড ক্লান্তি লাগে। সে লাইব্রেরির সামনে থেকে বামে মোড় নিয়ে সাডোভায়া স্ট্রিট দিয়ে হাঁটতে শুরু করে একটি পোস্ট বক্সের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ব্যাগ থেকে চিঠির তোড়াটা বের করে একটি চিঠি নিয়ে বক্সে ফেলার আগে কি মনে করে যেন পিছন ফিরে তাকায়। সে দেখতে পায় রাস্তার অন্য পাশ থেকে একটি গাট্টা-গোট্টা বেঁটে লোক তার দিকে তাকিয়ে আছে। আন্নার বুকটা ধক করে ওঠে। গুপ্ত পুলিশ ‘ওখরানা’র কোন লোক নয় তো? অথবা সাশা যেমন বলেছিল ‘ব্ল্যাক অফিসে’র কোন সদস্য? আন্নার হাত কাঁপতে শুরু করে। সে কী করবে বুঝে উঠতে না পেরে সাশার নিষেধ সত্ত্বেও সব চিঠিগুলো সেই বক্সে ফেলে দেয়। তারপর সে একটু সামনে হেঁটে যায় কোন দিকে না তাকিয়ে। সাহস হয় না তবু জোর করেই সে পিছন ফিরে রাস্তার ওপাশের সেই জায়গাটার দিকে তাকিয়ে দেখে কেউ নেই। সে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে। কিন্তু সেই সাথে আবার নতুন করে তার মধ্যে ভয় শুরু হয়। ভয় হয় এই ভেবে যে, যদি চিঠিগুলো ধরা পড়ে? যদি সাশার কোন বিপদ হয়? আন্না খুব দ্রুত পা চালিয়ে সাশার খোঁজে হাঁটতে থাকে। সাশাকে বিষয়টা জানানো খুব জরুরি।

সাশারা ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়। ১৭ই নভেম্বর, দিনটি বুধবার। সকাল থেকেই মেঘলা। সূর্য দেখা যায় না বললেই চলে। মাঝেমাঝে দেখা মিললেও যেন তার মুখটা বড়ই মলিন। মাঝেমাঝে বৃষ্টি হচ্ছে সাথে কনকনে হিম বাতাস। ঠাণ্ডা যেন শরীর ভেদ করে হাঁড়ে গিয়ে লাগছে। সাশা একটু উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে এই আবহাওয়ায় জমায়েত কেমন হবে সেটা নিয়ে। সকাল ন’টা থেকেই সাশা, আন্না, রাইসা ও শেবোটারেভ অপেক্ষা করছে নেভেস্কি প্রসপেক্টে নিকোলায়েভস্কির রেল স্টেশনের সামনে। সেই মেঘলা আবহাওয়ার মধ্যেও সকাল দশটার মধ্যে শত শত ছাত্র-ছাত্রী জড় হতে থাকে। ছাত্রই বেশি। পুলিশ ও কসাক সৈন্যরা রাস্তা ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের নেতৃত্বে আছে লে. জে. গ্রেসার। গ্রেসার মিছিল বা শোকযাত্রা করতে দেবে না বলে জানায়। ছাত্রদের চলে যাবার জন্য নির্দেশ করে, অন্যথায় সে গ্রেফতারের হুমকি দেয়। সাশা তখন একটু সামনে এগিয়ে যায়। চিৎকার করে বলে,
-আমরা এখানে সমবেত হয়েছি শ্রদ্ধা জানাতে। আমাদের বাঁধা দেবার কোন অধিকার আপনাদের নেই।
গ্রেসার তার সিদ্ধান্তে অনঢ় থাকে। অনেকটা সময় নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলতে থাকলে অনেকে অধৈর্য্য হয়ে পড়ে। সাশা যখন বেরিকেডের নেতৃত্বে থাকা লে জে গ্রেসারের সাথে বাক-বিতন্ডায় লিপ্ত তখন অনেকে ঘোড়ায় চালিত ট্রামে করে ভলকভো সিমেট্রির দিকে চলে যেতে থাকে। সাশার সাথে বাক-বিতন্ডার এক পর্যায়ে গ্রেসার একটি প্রতিনিধি দলকে সিমেট্রি পর্যন্ত যাবার অনুমতি দিতে সম্মত হলেও সমবেত ছাত্র-ছাত্রীরা সেই প্রস্তাব প্রত্যাখান করে। সাশারা তখন সিদ্ধান্ত নেয় লিগোভকা ক্যানেল ধরে তারা নেভেস্কি প্রসপেক্টের কাজান ক্যাথেড্রাল নামের গির্জাটার কাছে মিলিত হয়ে প্রতিবাদ সমাবেশ করবে। কথামত সাশারা যখন এগোচ্ছিল, গ্রেসার তার বাহিনী নিয়ে ছাত্রদের কর্ডন করে হেঁটে যাচ্ছিল। সাশা, আন্না, শেবোটারেভ ও রাইসা পাশাপাশি ছিল। গ্রেসার বাহিনীর এভাবে কর্ডন করে যাওয়ায় ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ তৈরি করে। সাশা তখন চিৎকার করে শ্লোগান ধরে। রাইসা তার থেকে বেশি জোরে চিৎকার করে শ্লোগানের উত্তর করলে একজন কসাক সৈন্য রাইসার কাঁধে লাঠি দিয়ে সজোরে আঘাত করে। সাশা তখন ক্ষোভে ফেটে পড়ে। সে কাছে গিয়ে রাইসাকে জাপটে ধরে। এই ঘটনায় ছাত্ররা আরো ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। সাশা রাইসাকে জাপটে ধরার পর কসাক সৈন্যটি পিছিয়ে যায়। সাশা রাইসাকে জাপটে ধরেই চিৎকার করে শ্লোগান দিতে থাকে। আন্না একটু দুরেই দাঁড়িয়ে ছিল। সে বোঝার চেষ্টা করছিল রাইসার আঘাতটা গুরুতর কিনা। নিজেকে প্রথমে তার স্বার্থপর ও ভীতু মনে হলো। তা না হলে সেও তো রাইসাকে রক্ষা করতে ছুটে যেতে পারতো। এটা ভেবে তার মনটা একটু খারাপ হলো। অবশ্য কিছুক্ষণের মধ্যেই তার মন খারাপ ভাবটা কেটে গিয়ে আন্নার মনে হলো সাশা কী রাইসাকে ভালবাসে? তা না হলে নিজে ঝুঁকি নিয়ে তাকে রক্ষা করতে আসবে কেন? আরো অনেকেই তো ছিল। অন্য কেউ এগিয়ে এলো না কেন? আবার তার এমনটা মনে হওয়ায় নিজের কাছেই নিজেকে ছোট মনে হলো। হয়তো সে কারণেই আন্না দ্রুত রাইসার কাছে গিয়ে তাকে জাপটে ধরে।

ততক্ষণে বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের ঠেকাতে গ্রেসার বাহিনী শুরু করে লাঠিপেটা। ছাত্ররা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। সৈন্যরা গণহারে গ্রেফতার শুরু করে। গ্রেফতার এড়াতে সাশা এক হাতে রাইসা অন্যহাতে আন্নাকে ধরে লিগোভকা ক্যানেল ধরে পালাতে থাকে। সাশারা যখন তার বাসায় ফিরে আসে সেখানে ক্ষুব্ধ ছাত্রদের অনেকে জড় হতে থাকে। অনেকের শরীরে আঘাতের চিহৃ। কারো কারো শরীরে রক্ত। ক্ষুব্ধ ছাত্ররা তাদের অভিজ্ঞতা বলতে শুরু করে। এই ঘটনাটি সাশার মধ্যে দারুণ ক্ষুব্ধতা তৈরি করে। সাশার মনে হয় সমাজ পরিবর্তন জরুরি, তবে তার থেকেও জরুরি জারকে হঠানো। সেখানে উপস্থিত ছিল নিকোনভ নিজেও। ক্ষুব্ধ সাশার ভাবনায় ঘি ঢেলে সে বলে,
-এই মুহূর্তে রুশ জনগণের প্রধান কর্তব্য জারকে হঠানো।
সেদিন সবাই চলে গেলেও থেকে যায় নিকোনভ। ক্ষুব্ধ সাশার মাথায় তখন একটিই ভাবনা। জারের শাসন থেকে মুক্তির উপায় কী? নিকোনভ ও সাশা এই বিষয় নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করতে থাকে। ঐ দিনই সাশা সিদ্ধান্ত নেয় পিপলস্ উইলে যোগ দেবে। কথাটা নিকোনভকে বলতেই সে আনন্দে সাশাকে জড়িয়ে ধরে। নিকোনভের কাছে খবরটি ছিল এতটাই আনন্দের যে সেদিন রাতেই সেই সংবাদটি সে শেভেরেভের কাছে পৌঁছে দেয়।

সাশা পিপলস্ উইল গ্রুপে যোগ দেবার এক মাসের মধ্যে শেভেরেভ তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়। তারই অংশ হিসাবে শেভেরেভ ভাসিলেভস্কি আইল্যান্ডের তুককভি লেনে ‘কানসার’ এবং ‘গরকুন’ নামের দুই ছাত্রের বাসায় বড় দিনের পার্টির আয়োজন করে খুব নির্বাচিত অল্প কয়েকজনকে নিয়ে। সেই বাসায় সেই রাতে শেভেরেভ ও গভরুখিনের বাইরে হাজির হয় লুকাশেভিচ, নিকোনভ ও সাশা। বড় দিনের জন্য উপহারের প্যাকেট নিয়ে প্রত্যেকে ভিন্ন ভিন্নভাবে তুককভি লেনের বাসায় এমনভাবে উপস্থিত হয় যেন শুধু পুলিশই নয়, আশেপাশের সবাই ভাবে এটা নিছক নির্দোষ একটি বড় দিনের পার্টি। সেই রাতে শেভেরেভ তার পরিকল্পনা পেশ করে জানায় আগামী ১লা মার্চ জার আলেকজান্ডার-২ হত্যাকান্ডের ৬ষ্ঠ বার্ষিকীর দিনই জার আলেকজান্ডার নিকোলাস-৩ কে হত্যা করতে হবে। কথা হচ্ছিল খাবার টেবিলে বসে। সাশা তখন বলে ওঠে,
-জার আলেকজান্ডার-২ কে হত্যার পর ব্যাপক মানুষের মধ্যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছিল। মানুষকে বুঝাতে তারা ব্যর্থ হয়েছিল কেন জারের হত্যা করাটা অনিবার্য ছিল। এবার জার-৩ কে হত্যার পরও যদি আমরা জনগণকে বুঝাতে ব্যর্থ হয় সেটা হবে আমাদের বড় রাজনৈতিক ব্যর্থতা।
সবাই সাশার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। কিছুক্ষণ সবাই চুপ করে থাকে। নীরবতা ভেঙে শেভেরেভ প্রশ্ন করে,
-এক্ষেত্রে তোমার কোন প্রস্তাব আছে?
শেভেরেভের প্রশ্নের উত্তর সাশা কি দেয় সেটা শুনার জন্য লুকাশেভিচ ও নিকোনভ দু’জনেই সাশার দিকে তাকায়। কানসার ও গরকুনকে সাশা এই প্রথম দেখছে। সাশা নতুন ছেলে দুটোর দিকে তাকিয়ে বলতে থাকে,
-আমি মনে করি জার-৩ কে হত্যার একটি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা জনগণের সামনে আমাদের তুলে ধরা উচিত।
অন্য কেউ কিছু বলার আগেই লুকাশেভিচ প্রশ্ন করে,
-বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা? সেটা কেমন?
সাশা চেয়ারে একটু ঝুঁকে বসে ছিল। লুকাশেভিচের প্রশ্ন শুনে সে সোজা হয়ে বসে। সবার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে সে বলে,
-আমাদের একটি সম্মিলিত বক্তব্য থাকতে হবে। সেই বক্তব্যে আমরা রাশিয়ার বিপ্লবী আন্দোলনের সারসংক্ষেপ তুলে ধরে জারের উচ্ছেদের ঐতিহাসিক প্রয়োজনীয়তা আর একই সাথে তাকে হত্যার কারণ তুলে ধরতে পারি।
সাশার কথা শুনে নিকোনভ মুগ্ধ হয়। শেভেরেভ ও লুকাশেভিচ অর্থপূর্ণ দৃষ্টি বিনিময় করে। নতুন ছেলে দু’টো একটু নড়েচড়ে বসে। গভরুখিন একটু দূরে বসেছিল। সে তার চেয়ারটা একটু এগিয়ে সাশার কাছাকাছি সরে আসে। শেভেরেভ তখন উত্তর করে,
-উলিয়ানভ, রাজনৈতিক বক্তব্য তৈরির দায়িত্বটুকু তোমার উপরেই থাকলো।

তারপর সেই বৈঠকেই শেভেরেভ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য চারটি গ্রুপ তৈরি করে ফেলে। প্রথম গ্রুপের কাজ হলো বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করা। জারের দৈনন্দিন রুটিন, তাঁর চলাফেরার রুট, পহেলা মার্চ জারের কর্মসূচি ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রাথমিকভাবে এ কাজের ভার দেয়া হলো সাশা ও গভরুখিনকে। দ্বিতীয় গ্রুপের কাজ হলো অর্থ সংগ্রহ করা। শেভেরেভ ও লুকাশেভিচ দু’জন এই দায়িত্ব নিলো। তৃতীয় গ্রুপটির দায়িত্ব বোমা তৈরি ও অস্ত্র সংগ্রহ করা। একাজের দায়িত্ব দেয়া হলো সাশা ও লুকাশেভিচকে। চতুর্থ গ্রুপটি হলো স্ট্রাইকিং ফোর্স অর্থাৎ যারা অপারেশন পরিচালনা করবে। এই গ্রুপকে আবার দুটো সাবগ্রুপে ভাগ করা হলো। একটা গ্রুপ বোমা ছুড়বে আর অন্য গ্রুপটি অপারেশনের দিন সংকেত প্রদানের কাজ করবে।
এই গ্রুপের প্রাথমিক দায়িত্ব দেয়া হলো অসিপানভকে। অসিপানভ এতক্ষণ চুপচাপ বসে ছিল। এসময় সে বলে,
-আমার গ্রুপে কমপক্ষে ছয় জন লোক লাগবে। তিনজন বোমা ছোড়ার জন্য আর তিনজন সংকেত দেবার জন্য।
শেভেরেভ তখন লুকাশেভিচ ও সাশার দিকে তাকায়। লুকাশেভিচ কিছু বলার আগেই সাশা বলে,
-আমার সাথে লুকাশেভিচের এ বিষয়ে কথা হয়েছে। আমরা আন্দ্রেয়ুশকিন ও জেনারেলভের নাম প্রস্তাব করছি। আমরা দু’জনেই তাদের একাজে প্রতিজ্ঞাবদ্ধতার বিষয়ে নিশ্চিত। আমাদের মনে হয় স্ট্রাইকিং ফোর্সে তাদেরকে যুক্ত করা যেতে পারে।
শেভেরেভ নিজেও সেই দু’জনকে চিনতো। লুকাশেভিচ ঘাড় নেড়ে সাশার প্রস্তাবে সন্মতি দিলে শেভেরেভ তাদের প্রস্তাব গ্রহণ করে। সেদিনের রাতের সভাটি যখন শেষ হয় ততক্ষণে ভোর হয়ে গেছে। নিজ নিজ কাজের দায়িত্ব বুঝে নিয়ে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে তারা একজন একজন করে সেই বাড়িটা থেকে বের হয়। সাশা যখন বের হবে তখন শেভেরেভ জানতে চাইলো,
-উলিয়ানভ, তোমার বাসাটা কি বোমার তৈরির কাজে ব্যবহার করা যাবে?
সাশা এ প্রশ্নের উত্তরে একটু ভাবে। তারপর বলে,
-আমার সাথে যে ছেলেটি থাকে সে ঠিক আমাদের গ্রুপের নয়। বিকল্প জায়গা খুঁজে না পেলে আমি তাকে অন্যত্র চলে যেতে বলতে পারি। হয়তো কোন অসুবিধা হবে না।

সেদিনের পর থেকে সাশা বোমা তৈরির সরঞ্জাম যোগাড় এবং বোমা তৈরির উপযোগী জায়গা খুঁজতে থাকে। উপযুক্ত জায়গা না পেয়ে সে তার বাসাতেই বোমা বানানোর সিদ্ধাম্ত নেয়। আর সে কারণে ১৮৮৭ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে সাশা শেবোটারেভকে ২৫ নম্বর আলেকজান্দ্রাভস্কির বাসা ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে অনুরোধ করে প্রথমত: শেবোটারেভের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে আর দ্বিতীয়তঃ বোমা তৈরির সময় যে এই কাজে কোনভাবেই যুক্ত নয় এমন কাউকে বাসায় রাখাটা গোপনীয়তার জন্য হুমকি মনে করে। সাশার এরকম অনুরোধে স্বাভাবিকভাবেই শেবোটারেভ একটু অবাক হয়, কিছুটা বিরক্তও। তবু জানুয়ারির ২০ তারিখে সে বাসা ছেড়ে দেয়। শেবোটারেভ চলে গেলে সাশা বোমা তৈরির কাজে পুরোপুরি মনোনিবেশ করে। সে নাইট্রিক এসিড ও সীসার ছোট ছোট পাত যোগাড় করতে থাকে। ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতেই সে নাইট্রোগ্লিসারিন, ডিনামাইট এবং বিস্ফোরক রাখার পাত্র বানাতে শুরু করে। লুকাশেভিচ নিজে একজন বোমা বিশেষজ্ঞ, সে এসব কাজে সাশাকে সাহায্য করতে থাকে। সমস্যা দেখা দিল নাইট্রিক এসিড নিয়ে। সেন্ট পিটার্সবার্গ থেকে এত এসিড সংগ্রহ করতে গেলে তাদেরকে সন্দেহ করতে পারে।  বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে একদিন সাশা ও লুকাশেভিচ শেভেরেভের সাথে দেখা করে তার ক্যান্টিনে। লোকজন চলে গেলে তারা কথা তোলে। লুকাশেভিচ তখন বলে,
-আমার একটা যোগাযোগ আছে ‘ভিলনিয়াস’ নামক শহরে। সেখানে একাজে সাহায্য করার মতো লোকও আছে। সমস্যা হচ্ছে এখান থেকে কাকে দায়িত্ব দেয়া যায়? এমন কেউ কি আছে যাকে এই দায়িত্ব দেয়া যায়?
শেভেরেভ একটু চিন্তা করে। তারপর বলে,
-কানসারকে দিলে চলবে?
সাশা একটু অবাক হয়। ছেলেটি অল্প কিছুদিন হলো গ্রুপে যুক্ত হয়েছে। সে কি এ কাজের জন্য নির্ভর করার মতো? তাই সে প্রশ্নটা করেই ফেলে,
-ছেলেটি কি পুরোপুরি বিশ্বস্ত?
লুকাশেভিচ সাশার এমন প্রশ্নে একটু ভ্রু কোঁচকায়। তাছাড়া কানসার ও গরকুন শেভেরেভের রিক্রুট। শেভেরেভ নিজে যে নাম প্রস্তাব করছে তার সম্পর্কে প্রশ্ন তোলায় লুকাশেভিচ বিরক্তবোধ করে। শেভেরেভের মুখ দেখে অবশ্য মনোভাব বুঝা গেলো না। সে মুখে বললো,
-আমি কানসারকে বলবো। উলিয়ানভ, তুমি তার সাথে যোগাযোগ করো।
তারপর শেভেরেভ লুকাশেভিচের হাতে ৫০টি রুবল দিয়ে বলে,
-তুমি এটা কানসারকে দিও আর ভিলনিয়াসের যোগাযোগের ঠিকানাটাও।
সেখান থেকে ফেরার পথে লুকাশেভিচ সাশাকে বলে,
-শেভেরেভ মানুষ চিনতে খুব বেশি ভুল করে না। লুকেশেভিচের কথায় সাশা শুধু বলে,
-ভুল না হলেই ভাল। এমন কাজ একদল প্রচণ্ড প্রতিশ্রুতিবদ্ধ মানুষ ছাড়া করা সম্ভব নয়। আমি সে বিষয়টিই বুঝাতে চেয়েছিলাম। অন্যকিছু নয়।

সাশা দাঁড়িয়ে আছে ওয়ারশ রেল স্টেশনের টিকিট কাউন্টারের উল্টোদিকে। স্টেশন যাত্রীদের পাশাপাশি কয়েকজন পুলিশকেও দেখা যাচ্ছে টহল দিতে। সে অপেক্ষা করছে কানসারের জন্য। ভিলনিয়াসে যাবার ট্রেনটি ছাড়তে মিনিট পনের বাকী। ট্রেনটি স্টেশনে এসে দাঁড়ালে মানুষের ছুটোছুটি বাড়ে। টহলরত পুলিশরাও উঠা-নামায় ব্যস্ত যাত্রীদের দিকে শকুনের চোখ নিয়ে দেখতে থাকে। কানসার এখনও আসছে না কেন ভেবে সাশা একটু চিন্তিত হয়ে পড়ে। কথা বলার জন্য এই সময়টা উপযুক্ত ছিল। সবাই ব্যস্ত, আলাদা করে তাদের দিকে কেউ খেয়াল করতো না। খুব অল্প সময়ে যুক্ত একটি ছেলেকে এরকম ঝুঁকিপূর্ণকাজে দায়িত্ব দেয়াটা ঠিক হচ্ছে কিনা সেটা নিয়ে সাশার মনে এখনও খটকা রয়ে গেছে। হঠাৎ করে পিছন দিক থেকে একটি হাত সাশার কাঁধ স্পর্শ করে। সাশা একটু চমকে পিছনে তাকাতেই দেখে কানসার হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। সাশার বুক থেকে দুঃশ্চিতার ভারটা নেমে যায়। সাশা কিছু বলার আগেই কানসার প্রায় ফিস ফিস করে বলে,
-তোমাকে আগেই দেখেছি কিন্তু এই সময়টির জন্য অপেক্ষা করছিলাম। তোমাকে কোন ঠিকানায় টেলিগ্রাম করবো? তোমার নিজের বাসার ঠিকানায়?

সাশা চট করে মনে হলো তার বাসাটা কোন কারণে পুলিশের নজদারীতে মধ্যে পড়ে গেলে পুলিশ অনেক তথ্য পেয়ে যেতে পারে। অাবার সব ঠিকানা বিশ্বাসযোগ্যও নয়। তাই তাৎক্ষণিকভাবে সাশা বলে,

-না, তুমি আমার বোন আন্নার ঠিকানায় টেলিগ্রাম করো। যেভাবে তোমাকে কোড ব্যবহার করতে বলেছি সেভাবে।

কথাটা বলেই সাশা পকেট থেকে একটি কাগজ ও পেন্সিল বের করে চটপট ঠিকানাটা লিখে কানসারের হাতে দিয়ে কানসার থেকে একটু দুরে, স্টেশন থেকে বের হবার মুখে একপাশে গিয়ে দাঁড়ায়। ট্রেনটি তখনই হুইসেল দেয়। কানসার দ্রুত গিয়ে বগিতে ওঠামাত্র ট্রেনটি চলতে শুরু করে। প্রথমে আস্তে আস্তে তারপর ট্রেনের গতি বাড়তে থাকে। সাশা তখনও দাঁড়িয়ে থেকে ট্রেনটির স্টেশন ছেড়ে যাওয়া দেখছিল। আর ঠিক তখনই তার মনে হলো সে মস্ত বড় ভুল করে ফেলেছে। তার এমন ভুলেই সে আন্নাকে এমন একটি অপারেশনের সাথে জড়িয়ে ফেলেছে। আন্না যার বিন্দুমাত্র জানে না। কিন্তু সাশার তখন কিছুই করার নেই। ট্রেনটি ততক্ষণে হু হু করে ভিলনিয়াসের পথে ছুটতে শুরু করেছে। সাশার দ্রুত পায়ে হাঁটতে শুরু করে। আন্নার সাথে তার এখনই দেখা করা দরকার।

Facebook Comments

comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top